কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৬
২৬
কিন্তু দীপঙ্কর কি জানতো তারই অজ্ঞাতে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে তখন আর- এক নাটক অভিনয় হচ্ছে। আর-এক নাটকের প্রথম অঙ্ক। আর প্রথম অঙ্কও ঠিক নয়। প্রথম অঙ্ক আরম্ভ হয়েছিল অনেক আগেই। অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। সে কবেকার কথা। কোন্ এক বিচক্ষণ লোক কবে টাকা আবিষ্কার করেছিলেন কে জানে। ইতিহাসের সে মধ্যযুগের কাহিনী। ধান, চাল, বাসন, তৈজস, ঘরবাড়ি, গরু-মোষ সমস্তই ছিল, টাকা ছিল না। কিন্তু একদিন সেই অদ্ভুত জিনিসটার আবির্ভাব হলো সংসারে আর সব ওলোটপালোট হয়ে গেল রাতারাতি। দরকারের বেশি টাকা এসে জমলো যাদের হাতে, তারাই হলো শেষে মহাজন। মহাজনদের তখন ভারি খাতির! যুদ্ধ বাধবে, টাকা চাই। দাও ধার। রাজা প্রাসাদ বানাবে, টাকা চাই। দাও ধার। রাজা-রাজড়াদের স্বার্থেই মহাজনরা ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগলো দেশে দেশে। টাকা এল—আর সঙ্গে সঙ্গে এল টাকার সুদ। শেষে একদিন সেই মহাজনরাই রাজার ঘাড়ে চেপে বসলো। বললে—আমার কারবারের সুবিধে হচ্ছে না, আইন বানাও। এমন আইন করো, যাতে আমার টাকা-খাটানোর সুবিধে হয়। তা সেই আইনই হলো। সেই টাকা এদেশ থেকে ওদেশে গেল। স্বদেশ থেকে বিদেশে। কোথায় কাদের দেশে দুর্ভিক্ষ হয়ে খেতে পায় না, মোটা সুদে সেখানে ধার দাও। অবস্থা ভাল হলে শোধ দিও। শেষে রাজা-রাজড়ারা আর কেউ কিছু নয়—আসলে মহাজনরাই সর্বেসর্বা। এডওয়ার্ড থার্ড কি একশো বছর ধরে যুদ্ধ চালাতে পারতো—মহাজনেরা সাহায্য না করলে? সেই মহাজনেরাই শেষে ব্যাঙ্ক খুললে, টাকা খাটাবার নানান ফন্দি বার করলে। ব্যবসাদারদের টাকা দাদন দিতে লাগলো। মোটা সুদ, মোটা লাভ। নতুন নতুন ব্যবসা গড়ে উঠলো টাকা পেয়ে পেয়ে। সেই টাকায় জাহাজ বানিয়ে ভাস্কো-ডি-গামা আরো টাকা উপায় করতে বেরোল—আরো নতুন মার্কেট। আরো নতুন মহাদেশ। নতুন টাকার বাজার খুললো আমেরিকায়, ইন্ডিয়ায়। তারপর এল মেশিন। মেশিনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গোটা চেহারাটাই বদলে গেল। গোটা সমাজটার ভোল পাল্টে গেল। এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন সমাজ, পুঁজিপতি, মজুর, কেরানী, উকিল, ব্যারিস্টার—যাদের নাম কখনও কেউ শোনেনি আগে। আর সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠলো লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, নিউ ইয়র্ক, বোম্বাই, কলকাতা। নেপোলিয়ান যুদ্ধ করবে—টাকা জোগায় মহাজনেরা। আকবর যুদ্ধ করবে, টাকা জোগায় মহাজনেরা, আলীবর্দীও যুদ্ধ করবে, টাকা জোগায় জগৎশেঠরা। হিটলার যুদ্ধ করবে, টাকা জোগায় থাইসেনরা। এমনি করে গড়ে উঠলো একাদশী বাঁদুজ্জে আর শশধর চাটুজ্জেরা। এমনি করে গড়ে উঠলো অঘোরদাদুরা। এমনি করে গড়ে উঠলো শিরীষ ঘোষ, নয়নরঞ্জিনী দাসী, প্রাণমথবাবু। এমনি করেই তৈরি হলো ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুল। এমনি করেই গজিয়ে উঠলো রেল কোম্পানি, রবিনসন সাহেব, রোটারী ক্লাব। এমনি করেই সৃষ্টি হলো মিস্টার ঘোষাল, ছিটে-ফোঁটা, কিরণ, দীপঙ্কর। এমনি করেই সম্ভব হলো লক্ষ্মীদি, দাতারবাবু আর সুধাংশু। এমনি করেই একদিন এসে হাজির হলো নির্মল পালিতরা।
নির্মল পালিতরাই একদিন শিরীষ ঘোষকে হটিয়ে দিয়ে গ্রাস করলো প্রপার্টি কাইজার গেল, জার গেল, পোপ গেল, পুরোহিত গেল, সিরাজউদ্দৌলা গেল, নির্মল পালিতরাই একদিন দখল করে বসলো গদি। তারপর যখন যুদ্ধ বাধলো, তখন তাদের জয়-জয়কার। এবার কেবল টাকা, টাকা, টাকা! টাকা তখন উড়তে শুরু করেছে।
সেই নির্মল পালিতেরই সেদিন খোঁজ পড়লো প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের নয়নরঞ্জিনী দাসীর বাড়িতে।
সরকারবাবু ছুটতে ছুটতে এসেছে। ডাকলে—মা-মণি—
মা-মণি তখনও বিছানায় পড়ে। পা’টা মচকে গেছে। জখম-পায়ের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বললেন—আবার কী? তুমি কি আমাকে একটু স্বস্তিতে থাকতে দেবে না, সরকারবাবু!
—আজ্ঞে, চেক ফিরে এসেছে।
—সে কি? বলছো কী তুমি?
মা-মণি চমকে উঠলেন। মাসকাবারি সংসার খরচের চেক কেটেছিলেন তিনি। যেমন কাটেন বরাবর। এমন প্রত্যেক মাসে কাটা হয়ে থাকে। নেই-নেই করেও তো এখনও অনেক খরচ আছে। ঝি-চাকরের মাইনে, খাই-খরচ, জামা-কাপড়। সরকারবাবু আছে, তার মাইনে আছে। তারও সংসার চালাতে হয় এই মাইনের ওপর নির্ভর করে। নিজের হাতে দায়িত্ব নেবার পর থেকেই খরচের বহরটা টের পাচ্ছেন তিনি। সনাতনবাবু যখন চেক কাটতেন, তখনকার কথা আলাদা। নির্মল পালিতই সেসব আলাদা করে দিয়েছে। নির্মল পালিতকেই আমমোক্তার-নামা দিয়ে দিয়েছেন নয়নরঞ্জিনী দাসী। নির্মল পালিতই তাঁর একমাত্র বিশ্বাসী লোক। তার সঙ্গে এক-পুরুষের নয়, দু-পুরুষের সম্পর্ক।
মা-মণি বললেন—চেক ফেরত দিলে কেন? কী বললে তারা?
—আজ্ঞে, বললে, টাকা নেই—
—সে কি? হাজার টাকা নেই? এই যে গেল মাসে বউবাজারের বাড়ি বিক্রি করে কুড়ি হাজার টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে এলে তুমি? সে টাকা কি রাতারাতি উড়ে গেল? যাও, তুমি আবার যাও, আবার গিয়ে বলো তাদের। তোমাদের নিয়ে যত ঝামেলা হয়েছে আমার, একটা কাজ যদি তোমাদের দিয়ে হয়। যাও,হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কী? যাও —
সরকারবাবু বললে—আজ্ঞে, মা-মণি, আমি তা বলেছি—দিলে না কিছুতেই—
—তার মানে?
খোঁড়া পায়েই উঠে বসতে চাইলেন মা-মণি। টাকা গেল কোথায়? টাকার কি পাখা আছে নাকি যে উড়ে পালাবে! চিৎকার করে ধমক দিয়ে উঠলেন। সেই চিৎকার রান্নাঘরের মধ্যে কৈলাস, বাতাসীর-মা, ভূতির-মা সবাই চমকে উঠলো। আবার মাগী ধম্কায় কাকে! মাগীর পা খোঁড়া হয়ে গেছে, তবু গলার তেজ কমলো না এতটুকু গা। বউটাকে তো বাড়ির তিষ্ঠোতে দিলে না এখন কাকে আবার ধম্কাচ্ছে?
শম্ভু বললে—ও সরকারবাবুকে—সরকারবাবুরও যেমন কপাল।
বাতাসীর-মা বললে—তা সরকারবাবু ছেড়ে দিলেই পারে চাকরি। কে খোশামোদ করতে বলেছে তোর সরকারবাবুকে শুনি? মাইনে নেবে কাজ করবে, তুমি কি আমার পর! এ-মাসে তো মাইনে দিলে না এখনও—এখনও কাজ করছে কেন?
কৈলাস বললে—গেল মাসেও তো মাইনে পাইনি আমার বাতাসীর-মা—
বাতাসীর-মা বললে—আর পেয়েছিস তুমি ছোঁড়া, এখন ভালোয় ভালোয় বিদেয় হ’ দিকিনি—সেই যে কথায় আছে না—বিশ্বকর্মাও ঋষি, পদীর মা-ও পিসী—। ওই আবার চেঁচাচ্ছে মাগী—
সত্যিই তখন ওপরে আবার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে জোর। চেক্ ভাঙানো যায়নি। নিশ্চয় কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে। সনাতনবাবুর ডাক পড়লো। নিজের লাইব্রেরী ঘরে তিনি পড়ছিলেন। সরকারবাবু গিয়ে বললেন— দাদাবাবু, ব্যাঙ্ক থেকে চেক্ ভাঙায়নি, আপনি একটু দেখবেন?
সনাতনবাবু বললেন—কীসের চে? কার চেক সরকারবাবু?
কোনওদিন চেক্-বই নিয়ে মাথা ঘামাননি তিনি। আগে শুধু সই করতেন। ইদানীং তাও করতে হয় না। তিনি বেঁচেই গিয়েছিলেন। সরকারবাবু বললেন-আজ্ঞে, মহা মুশকিলে পড়েছি, মা-মণি আমায় বকাবকি করছেন—আপনি একবার চলুন—
সনাতনবাবু বললেন—তা আমি কী করবো গিয়ে, নির্মল পালিত বাবুকে খবর দাও না—
সরকারবাবু বললে—আজ্ঞে তাঁকে তো মা-মণি টেলিফোন করেছিলেন, তিনি তো বাড়িতে নেই—
—তা তাড়াতাড়ি কীসের সরকারবাবু, তিনি বাড়ি ফিরে এলে আসবেন—
—আজ্ঞে না, তিনি কলকাতাতেই নেই।
—কলকাতাতেই নেই তো কোথায় গেলেন? তিনি তো পালিয়ে যেতে পারেন না। মা-মণি কিন্তু অতটা অপেক্ষা করতে পারেন নি। তাঁর যেন কেমন সন্দেহ হয়েছিল। তিনি প্রথমে পাঠালেন শম্ভুকে। তারপরে পাঠালেন কৈলাসকে। শেষে সরকারবাবু নিজেই গেল। আগে একবার টেলিফোল করলেই হতো। টেলিফোন পেলেই নির্মল পালিত কাজ-কর্ম ফেলে দৌড়ে আসতো। কিন্তু সেই নির্মল পালিত আর বাড়িতেই নেই। দারোয়ান কিছু বলতে পারলে না। মুহুরি ম্যানেজার কেউই কিছু বলতে পারলে না। শুধু বললে—সাহেব কাল সন্ধ্যেবেলা মেমসাহেবকে নিয়ে কলকাতার বাইরে চলে গেছে।
সরকারবাবু জিজ্ঞেস করলে—কবে আসবে সাহেব?
মুহুরি বললে—সাহেব তা বলে যায়নি—
আর তারপরই মা-মণির উদ্বেগটা আরো বেড়ে গেল। একবার টেলিফোন করেন ব্যাঙ্কে। তাতে সুবিধে না পেয়ে, সরকারবাবুকে যেতে হয়। সরকারবাবু ফিরে আসেন শুকনো মুখে। মা-মণির কাছে আরো বকুনি খেতে হয়। তখন আবার ছুটতে হয় নির্মল পালিতের বাড়িতে। সেখানে গিয়েও কোন সুরাহা হয় না। সমস্ত সকালটা এ-বাড়িতে একটা তুমুল কান্ড বেধে গেল। সরকারবাবু আবার সনাতনবাবুর কাছে গিয়ে হাজির হয় ভয়ে-ভয়ে। বলে—দাদাবাবু, সর্বনাশ হয়েছে
—কীসের সর্বনাশ সরকারবাবু?
—আজ্ঞে আপনি একবার মা-মণির কাছে চলুন—সর্বনাশ হয়ে গেছে—
মা-মণি সনাতনবাবুকে দেখেও ধমক্ দেন। পায়ের যন্ত্রণায় ক’দিন থেকেই তিনি ছট্ফট্ করছিলেন। সামনে সনাতনবাবুকে দেখে আরো জ্বলে উঠলেন। বললেন- তোমাকে কে আবার আসতে বললে আমার কাছে? তুমি আমার কাছে এসেছ কিসের জন্যে শুনি? যাও, বেরিয়ে যাও সামনে থেকে, যেমন আহাম্মক বাড়ির সরকার, তেমনি হয়েছে পেটের ছেলে—সবাই সমান!
সনাতনবাবু নির্বাক হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মা-মণি আবার তেড়ে উঠলেন—বলি, সামনে দাঁড়িয়ে দেখছো কী, হাবার মত? যা দু’ চক্ষে দেখতে পারিনে, তাই হয়েছে আমার—
সনাতনবাবু বললেন—কী হয়েছে মা-মণি?
মা-মণি তখন পারলে যেন নিজের মাথাটাই নিজে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতেন। বললেন-তোমাকে আর সোহাগ করতে হবে না, তোমাকেই যদি বলে বোঝাতে পারবো, তো আমার এই দশা হয়! আমি মরছি পায়ের ব্যথায়, আর তুমি এলে এখন সোহাগ জানাতে। এখনও গেলে না সামনে থেকে? এখনও দাঁড়িয়ে আছো হাঁ করে?
—তা কী হয়েছে বলবে তো?
মা-মণি বললেন—আমার কিছু হয়নি, আমি মহা আরামে আছি, তোমাদের সোহাগে আমি একেবারে স্বর্গে বাস করছি, আমার সুখের আর সীমে-পরিসীমে নেই, টাকার গাদায় শুইয়ে তোমরা কিতাথ করে দিয়েছ একেবারে—
—শুনছিলুম চেক্ নাকি ফিরে এসেছে ব্যাঙ্ক থেকে। সরকারবাবু বলছিল ব্যাঙ্কের টাকা নাকি সব তোলা হয়ে গেছে।
মা-মণি আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন—সরকারবাবু বলছিল? কোথায় গেল সরকাবাবু? ডাক তাকে আমার কাছে। ডেকে দাও—
সরকারবাবু পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সামনে আসতেই মা-মণি গর্জন করে উঠলেন— বলি, তুমি ডেকেছ দাদাবাবুকে? কেন তুমি ডাকলে শুনি আমার হুকুম ছাড়া? আমার হুকুম ছাড়া তুমি ডাকবার কে? তোমায় এত নবাবী করতে কে বললে বলো তো? কেন তুমি ডাকলে জবাব দাও। দাও, জবাব দাও। চুপ করে রইলে কেন, কৈফিয়ৎ দাও—
—আজ্ঞে, আমার ভুল হয়ে গেছে।
—ভুল হয়ে গেছে? এমন ভুল কেন হলো তাই বলো আগে। কেন তুমি ডাকলে? তুমি জানো আমার কেউ নেই। আমার ছেলে বউ কেউ নেই। তুমি জানো আমার পেটের ছেলে আমার শত্রু! অমন ছেলের মুখদর্শন পর্যন্ত আমি করি না। তবু কেন তুমি ডাকলে শুনি? কী করতে ডাকলে?
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু চেকটা কেন ক্যাশ হলো না, সেইটেই তো আগে ভাবতে হবে—
—রাখো তোমার ভাবনা, তুমি বৌকে আনতে যাচ্ছিলে আগে তাই যাও, পরে চেকের কথা ভেবো। এ-বাড়ি ভেঙে যাক্, চুরে যাক্, চুলোয় যাক্, আমার টাকা সাত ভূতে লুটে-পুটে নিক্, তা তো তোমার দেখবার দরকার নেই—।
—কিন্তু নির্মলবাবুর তো খোঁজ-খবর নিতে হবে। তিনি এই সময়ে হঠাৎ না-বলে- কয়ে কোথায় গেলেন, তাও তো দেখতে হবে!
মা-মণি বললেন—খুব হয়েছে, যা দেখবার যা করবার, তা আমি করবো। আমি এই খোঁড়া পা নিয়েই করবো। আমার পর ভেঙে গেছে বলে আমি তো মরে যাইনি। আর আমি নির্মলকে আমমোক্তার-নামা দিয়েছি, সে আমার খুশি! আমার টাকা যদি খোয়া যায় তো তোমার কী? তুমি কেন বলতে আসো আমাকে? তোমার টাকা খুইয়েছি আমি? তোমার টাকায় আমি হাত দিয়েছি? তুমি বলবার কে?
সনাতনবাবু কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মা-মণি থামিয়ে দিলেন। বললেন— যাও, আর কথা বাড়িও না—যাও আমার সামনে থেকে—
নিচে একতলায় দীপঙ্কর এসে ঢুকতেই কেমন যেন একটা সন্দেহ হলো। সরকারবাবুর ঘরটা খোলা। ওপর থেকে মামণির গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। কাকে ডাকবে, কেমন করে সনাতনবাবুকে খবর দেবে ভাবছিল। হঠাৎ দেখলে শম্ভু সিঁড়ি দিয়ে নামছে।
দীপঙ্কর ডাকলে। বললে—তোমার দাদাবাবু কোথায় শম্ভু?
শম্ভু কাছে এসে বললে—আপনি এসেছেন? কিন্তু ওপরে মা-মণির সঙ্গে দাদাবাবুর খুব ঝগড়া হচ্ছে—
–কেন? হঠাৎ ঝগড়া হচ্ছে কেন?
—আজ্ঞে, ঝগড়া তো রোজই হয়, আজকেও হচ্ছে। ব্যারিস্টারবাবুকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। মা-মণির ব্যাঙ্কের টাকা চুরি হয়ে গেছে—
দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে—সে কি? কোন্ ব্যারিস্টারবাবু? নিৰ্মল পালিত বাবু?
শম্ভু বললে—হ্যাঁ, তাঁকে খুঁজতেই তো আমরা সবাই তঁর বাড়ি গিয়েছিলুম—আপনি বসুন, আমি দাদাবাবুকে ডেকে দিচ্ছি—
সনাতনবাবু খানিক পরেই এলেন। বললেন—এই যে দীপঙ্করবাবু, কী হয়েছে জানেন, আমাদের একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, নির্মল পালিত বাবু, তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না—
দীপঙ্কর বললে— হয়ত বাইরে কোথাও গেছেন।
সনাতনবাবু বললেন—তা তো বটেই, পাওয়া যাচ্ছে না মানে, তিনি বাইরে গেছেন—আবার ফিরে এলেই পাওয়া যাবে। তিনি লোক খুব ভালো, ভেরি অনেস্ট ম্যান্, তাঁকেই তো পাওয়ার-অর্-য়্যাটর্নী দেওয়া ছিল। এখন একটা হাজার টাকার চেক্ ডিঅনার্ড হয়ে ফিরে এসেছে—
—এখন কী হবে?
সনাতনবাবু বললেন—সেই কথাই তো আমি মা-মণিকে বলছিলাম। টাকা বড় তুচ্ছ জিনিস দীপঙ্করবাবু, কিন্তু সেই তুচ্ছ জিনিসটাও তো এক-এক সময় অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই হয়েছে আর কি—আর কিছু নয়! ওর জন্যে আপনি ভাববেন না, নির্মল পালিত বাবু এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে—
দীপঙ্কর বললে—তা হলে আমি উঠি, আমি ভেবেছিলাম, আজকে আপনাকে নিয়ে আমাদের আপিসে যাবো—
এতক্ষণে যেন সনাতনবাবুর মনে পড়লো। বললেন—ও, তাই তো! আমার একেবারে মনে ছিল না। আপনি সতীকে সব বলেছিলেন তো সেদিন? বলেছিলেন তো যে সেদিন বাধা পড়ে গিয়েছিল? বলেছিলেন তো?
—আজ্ঞে না বলিনি। বলবার সুযোগ পাইনি। আর আপনাকে তো বলেইছিলাম, সতী আমার সঙ্গে কথা বলে না।
—কেন? কথা বলে না কেন?
দীপঙ্কর বললে— সে-সব অনেক কথা, পরে সব আপনাকে বলবো। তা এখন বোধহয় আপনি যেতে পারবেন না আমার সঙ্গে?
সনাতনবাবু বললেন—কেন? যেতে পারবো না কেন?
দীপঙ্কর বললে—এই অবস্থায় আপনার বোধহয় যেতে অসুবিধা হবে। তার চেয়ে আপনি যদি একটা চিঠি দেন—তাহলেও হতে পারে। আমি পরশু দিন তো ময়মনসিং- এ বদলি হয়ে যাচ্ছি-আজকেই আমি তার হাতে চিঠিটা দিয়ে দিতে পারতাম। যাবার আগে আমি দেখে গেলে মনে তৃপ্তি পেতাম যে, সতী আপনার কাছে এসেছে।
—তা দিতে পারি। চিঠিও দিতে পারি। চিঠি দিলে যদি কাজ হয়, আমি তা-ও দিতে পারি। আমি এখনি দিয়ে দিচ্ছি। আর বলে দেবেন, আমি ব্যাঙ্কের ব্যাপারটা মিটে গেলেই যাবো তাঁর কাছে। আর তিনি তো আমার ওপর রাগ করেননি? আপনি কী বলেন? তিনি রাগ করেছেন আমার ওপর? তাঁকে তো আমি চিনি দীপঙ্করবাবু, রাগ তিনি আমার ওপর করতেই পারেন না—
তারপর একটা কাগজ টেনে নিয়ে একটা চিঠি লিখতে বসলেন। অনেকক্ষণ ধরে চিঠি লিখে সেটা দিলেন দীপঙ্করের হাতে। বললেন-এবার আপনি পড়ে দেখুন তো, ঠিক হয়েছে কি না!
দীপঙ্কর বললে—এ-চিঠি আমি আর পড়বো না, আমার পড়া উচিত নয়।
—না-না, তাতে কী! আপনি পড়ন। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে গোপনীয় কিছু নেই, আপনি স্বচ্ছন্দে পড়তে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে আবার গোপনীয় কী থাকতে পারে বলুন—
শম্ভু হঠাৎ এসে বললে-দাদাবাবু, মা-মণি আপনাকে ডাকছেন আবার।
—আমাকে? আচ্ছা যাচ্ছি, তাহলে ওই কথাই রইল দীপঙ্করবাবু।
সনাতনবাবু বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
দীপঙ্কর আবার রাস্তায় বেরিয়ে এল। এতদিন যে-ভয় করছিল, সেই ভয়ই যেন ঘটে গেল শেষ পর্যন্ত। চিঠিটা পকেটে পুরে ট্যাক্সিতে উঠে বসলো আবার। তারপর আপিসে পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নামতেই যথারীতি গুর্খা দারোয়ান সেলাম করলে। কিন্তু কোরিডোরের ভেতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল। মিস্টার ঘোষালের ঘরের সামনে অনেক লোকের ভিড়। ম্যাকফারসেন সাহেব নিজের ঘর থেকে বেরোলেন। অভয়ঙ্কর, সোম, সবাই এদিক থেকে ওদিকে যাতায়াত করছে। আপিসের চাপরাসীরা, বাবুরা, সবাই ভিড় করেছে। অন্যদিন মার্চেন্টদের ভিড় থাকে, তারা কেউ নেই। এ যেন অন্য রকম। যেন কোনও ব্যতিক্রম ঘটেছে আপিসে। কী হলো? কীসের এত ভিড়? দীপঙ্কর সোজা নিজের কামরার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাসবাবু সামনে এসেই মাথা নিচু করে সেলাম করলে—গুড মর্নিং স্যার।
দীপঙ্কর চলতে চলতে বললে—এত ভিড় কীসের এখানে?
পাসবাবু বললে—স্যার, মিস্টার ঘোষালকে পুলিসে ধরেছে স্যার—আন্টি- করাপশনের পুলিস ধরেছে—
—কেন? দীপঙ্কর যেন আকাশ থেকে পড়লো। ওদিক থেকে ক্রফোর্ড সাহেব নিজের ঘরে যাবার পথে দীপঙ্করকে দেখেই ডাকলে। বললে—মিস্টার সেন, কাম টু মাই রুম, আমার ঘরে এসো—
ঘরে গিয়ে বসতেই ক্রফোর্ড সাহেব বললে—তুমি শুনেছ বোধহয় মিস্টার ঘোষাল হ্যাজ বীন অ্যারেস্টড্ বাই স্পেশাল পুলিস। বেইল-এ রিলিজ করবার ব্যবস্থা করেছি আমি–আমি চাই, তুমি চার্জ টেক-ওভার করে নেবে—
—কিন্তু আমি যে ময়মনসিং-এ ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি স্যার, ডে আফটার টু-মরো।
ক্রফোর্ড সাহেব বললে-দ্যাট্ অর্ডার ইজ ক্যানসেলড্—
সমস্ত পরিস্থিতিটা যেন এক মুহূর্তে ওলোট-পালোট হয়ে গেল। দীপঙ্কর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বললে—স্যার, আমি মিসেস ঘোষের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, সী মাস্ট বি ফীলিং আন্ইজি—
মিস্টার ক্রফোর্ড বললে—মিসেস ঘোষ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল—সী ইজ সীক, আমি তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি না কী করবো—আই ডোন্ট নো হোয়াট টু ডু—