কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৭
২৭
এমন এক-একটা ঘটনা জীবনে ঘটে, যখন মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনা, যুক্তি-বিচার সমস্ত কিছু গোলমাল হয়ে যায় হঠাৎ। সমস্ত আইন, সমস্ত বিশ্বাস ধূলিসাৎ হয়ে যায় এক নিমেষে। যদি তা না হতো তাহলে মানুষ এমন অনিশ্চিতের দিকেও দৌড়তো না, বাধা পেলে সেই বাধাকেই শাশ্বত বলে স্বীকার করে নিয়ে নিস্পৃহ হয়ে বসে থাকতো। হয়ত এই বাধা আছে বলেই বাধা থেকে মুক্তি পাবার এত আনন্দ। হতাশা আছে বলেই হয়ত মানুষ আশা করতে এত ভালবাসে। বেদনাই হয়ত আনন্দের পরমায়ু।
সেই বেদনাই দীপঙ্করকে এতপথ চালিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত। এই দীর্ঘ পথের যাত্রায় শুধু আনন্দের পাথেয় পেলে কি তার এতদূর আসার ধৈর্য থাকতো! প্রতি পদে পদে বাধার বেদনাই তো তার আনন্দের পরমায়ু বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই কালিঘাটের অন্ধকার অস্বাস্থ্যই তো তাকে কেবল আলোর দিকে ঠেলে নিয়ে এসেছে। আরো আনন্দ চাই, আরো আলো, আরো মুক্তি। ছোটবেলায় মা যে-আনন্দের আশায় দীপঙ্করের ভবিষ্যৎকে নিষ্কন্টক করতে চেয়েছিল, সেই আনন্দ না-পাক্ দীপঙ্কর, কিন্তু আর এক আনন্দ তো পেয়েছে। আর এক মুক্তি, আর এক স্বাতন্ত্র্য।
দীপঙ্করের মনে হতো—এই যে আমি, এতবড় জগতের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকেও এই যে স্বতন্ত্র আমি, এই আমি কার? আমি সতীর, না আমি লক্ষ্মীদির? আমি কিরণের, না মা’র? আমি প্রাণমথবাবুর না ছিটে- ফোঁটার? আমি পৃথিবীর না পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনও অদৃশ্য শক্তির? দীপঙ্করের মনে হতো—কেন আমি এত ব্যথা পাই, কেন আমি আবার এত আনন্দও পাই? কেন আমি জন্মেছি, কেন আমি সংগ্রাম করছি? এই আমার অস্তিত্বের সংগ্রাম দিয়ে কার কোন উদ্দেশ্য সুসিদ্ধ হচ্ছে? সংসারের কার কোন্ উপকারটা সাধিত হচ্ছে?
সেদিন আপিসের করিডোরে যখন নানা মানুষের ভিড় উদ্দাম হয়ে উঠেছিল, যখন সেক্শানে-সেক্শানে কুৎসিত আলোচনার অন্ত ছিল না, ক্লার্কদের মুখে-মুখে যখন হীন-নীচ প্রসঙ্গের খোলাখুলি আলাপ চলছিল, তখন দীপঙ্করের মনে হচ্ছিল, এই সমস্তর পেছনেও যেন কোন্ অদৃশ্য শক্তির কোনও অজ্ঞাত এক সঙ্কেত লুকিয়ে আছে।
ক্রফোর্ড সাহেব নিজেও এসেছিল সঙ্গে। দীপঙ্কর নিজে মিস্টার ঘোষালের চেয়ারে বসলো। কাগজ-পত্র, ফাইল, চিঠি, ইন্ডেন্ট, এস্টাব্লিশমেন্ট, সব কিছুই দীপঙ্করের জানা কাজ। মিস্টার ঘোষালের মুখটা কিন্তু গম্ভীর। কী সব অনেকগুলো কাগজ-পত্র নিয়ে বুঝিয়ে দিতে লাগলো দীপঙ্করকে। কারো কোনও কথাই কানে গেল না। কোনও দিকেই যেন খেয়াল নেই দীপঙ্করের। এই আপিসেই একদিন তেত্রিশ টাকার সামান্য ক্লার্কের চাকরি নিয়ে ঢুকেছিল দীপঙ্কর, আবার এই আপিসেরই সর্বোচ্চ চেয়ারটাতে এসে বসলো। সেদিন এখানে মনে ক্ষোভ আর বুকে ঘৃণা নিয়েই ঢুকেছিল সে, আর আজ এই চেয়ারটাতে বসেও তার সে-ঘৃণা আর ক্ষোভের যেন এতটুকু লাঘব হলো না। এই চেয়ারটাতেও যেন সংসারের সব পাপ আর কলঙ্ক চিরস্থায়ী হয়ে লেগে আছে। দীপঙ্করের মনে হলো সে-ও যেন হঠাৎ মিস্টার ঘোষালের সব অপরাধের অংশ-ভাগী হয়ে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে।
মিস্টার ঘোষালের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে দীপঙ্কর। একটা চুরুট নতুন করে ধরালো আবার মিস্টার ঘোষাল।
মিস্টার ঘোষাল অনেকক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলে—ইজ্ দ্যাট্ অল্রাইট সেন? সমস্ত ঠিক আছে?
আজ দীপঙ্করের অনুমতি নিয়ে মিস্টার ঘোষালকে যেতে হচ্ছে। একটু আগেই জামিনে খালাস পাওয়া মানুষটা যেন পেলে সমস্ত বিশ্ব-সংসারটাকে কাড়মে চিবিয়ে নিঃশেষ করে ফেলে দেবে। যেন হাঁফাচ্ছে মিস্টার ঘোষাল। জীবনে এই-ই বোধহয় প্রথম আঘাত, প্রথম পরাজয়। সেই লন্ডন আপিসের ধর্মঘট থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে অগাধ উন্নতির শিখরে উঠতে উঠতে এই প্রথম পিছলে যাওয়া।
—আমি দেখে নেব সেন, তুমি দেখে নিও, আই শ্যাল্ ফাইট্, ইট্ আউট্, আই শ্যাল—
দীপঙ্কর কিছু কথা বললো না। ক্রফোর্ড সাহেব তখন নিজের ঘরে চলে গিয়েছে। মিস্টার ঘোষাল আবার গর্জন করে উঠলো—আমি প্রমাণ করবো আমাকে ম্যালিসালি ধরা হয়েছে, আমি সকলকে ওয়াগন দিতে পারিনি। ডিসগ্রান্টল্ড পার্টির এটা কাজ— আই শ্যাল প্রুভ ইট্—আই শ্যা—
এক-তরফা কথা বেশিক্ষণ হয় না। তবু দীপঙ্করের কাছে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্যে মিস্টার ঘোষালের যেন আগ্রহের অন্ত ছিল না সেদিন। বললে—ডু ইউ নো সেন, আমি সকলকে চিনি—আমি পুলিস কমিশনারকে চিনি, আমি গভর্নর স্যার জন হার্বাটকে চিনি, উই.আর ফ্রেন্ড্স, দরকার হলে আমি ফজলুল হকে বলবো, আই উইল মুভ হেভেন্ য়্যান্ড আর্থ সেন—একজন ইনোসেন্ট গভর্নমেন্ট অফিসারকে এই হ্যারাসমেন্ট করা—
মিস্টার ঘোষাল ঘরের মধ্যে চুরুট টানতে টানতে খাঁচার বাঘের মত এধার-ওধার করতে লাগলো। যেন পারলে দীপঙ্করকেই কামড়ে ছিঁড়ে খাবে। তারপর আরো কত কী বলেছিল মিস্টার ঘোষাল—সমস্ত মনে আছে দীপঙ্করের। যথারীতি টেন্টেড মানি দিয়ে ধরেছিল স্পেশাল পুলিস। কোনও ফাঁক রাখেনি তারা। পুলিসের এস-পি ছিল, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট ছিল—আর ছিল ইন্ডেন্ট ফর্ম নিয়ে পার্টি। মাড়োয়ারী নয়, গুজরাটী নয়, সিন্ধী নয়, বাঙালী। খাস্ বাঙলা দেশের খাঁটি বাঙালী। ওয়াগনের জন্যে অনেকদিন ধরে আসা-যাওয়া করেছে, অনেক সাধ্য-সাধনা করেছে, অনেক খোশামোদ করেছে। দ্বিজপদকে বখশিশ দিয়েছে। কিন্তু মিস্টার ঘোষালকে খুশী করতে পারেনি। মিস্টার ঘোষাল দশখানা ওয়াগনের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিল। পাঁচটি হাজার টাকা ব্রাইব্। পাঁচ হাজার টাকা দিলেও আরো পাঁচ হাজার প্রফিট থাকতো পার্টির। কিন্তু তখন স্পেশাল পুলিস তৈরি হয়েছে। চারদিকে আপিসের দেয়ালের গায়ে পোস্টার পড়ে গেছে—’ঘুষ দিবেন না। ঘুষ দেওয়া এবং ঘুষ নেওয়া, উভয়ই অপরাধ।’ শেষে বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক হাজির হয়েছিল গিয়ে পুলিসের আপিসে।
মিস্টার ঘোষাল অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল—ডু ইউ বিলিভ ইট সেন? এ তুমি বিশ্বাস করো? আমি ব্রাইব্ নিতে পারি?
দীপঙ্কর কী বলবে বুঝতে পারেনি তখন
মিস্টার ঘোষাল আবার জিজ্ঞেস করেছিল—এ তুমি বিশ্বাস করতে পারো? আমার দ্বারা ব্রাইব্ নেওয়া সম্ভব? তুমি আমাকে এতদিন দেখে আসছো! মিস্টার রবিনসন্ আমাকে চিনতো! আমি এ-কাজ করতে পারি? দিস্ ইজ্ ক্রিমিন্যাল্—ডু ইউ বিলিভ ইট্ রিয়্যালি?
দীপঙ্কর বিশ্বাস করুক আর না-করুক, তাতে কারো কিছু এসে যায় না। পৃথিবীও থেমে থাকে না তার জন্যে। টাকার চাকা তখন গড়িয়ে চলেছে এদেশ থেকে ওদেশে। সেই টাকা। টাকা তখন অনেক জমে গেছে সিন্দুকে। অঘোরদাদুর সিন্দুকের মত আমেরিকার সিন্দুকে অনেক টাকা জমে পাহাড় হয়ে উঠেছে। ব্রিটেনের সিন্দুকেও টাকার পাহাড়। নিজের খাওয়া-পরার সমস্যা মিটে গেছে। কিন্তু ঘরে টাকা রেখেও শান্তি নেই অঘোরদাদুদের। কারবারী যারা, যারা ব্যাঙ্কার, তাদের কাছে টাকা থাকাটাই সব নয়। টাকা খাটানোটাই বড় কথা। তখন কাদের দেশে সোনা আছে, কোন্ জঙ্গলে তামা লোহা টিন আছে খোঁজো। কাদের চা-বাগানে মূলধন দরকার, কাদের রবার ক্ষেতে ক্যাপিট্যাল চাই সন্ধান নাও। কোন্ দেশে রেল-লাইন তৈরি হচ্ছে না টাকার অভাবে, পৃথিবীর কোন কোণে হাইড্রো-ইলেক্ট্রক প্ল্যান্ট বানাবার পয়সা নেই, খুঁজে বার করো। তারপর সেখানে টাকা ধার দিয়ে সুদ নাও, সেই সুদ আবার খাটাও ক্যাপিট্যাল হিসেবে। তারপর সেই মূলধন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আরো বড়লোক হও। আরো বড় মহাজন। তখন টাকা পাহারা দেবার জন্যে আর্মি রাখো, নেভি করো, পরের দেশে লগ্নী মূলধনের খাতিরে বেশ কড়া করে আইন বানাও। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করে প্যালেস-কোর্টের ফ্ল্যাটের ভেতরে সতীদের নিয়ে এসে দিন কাটাও। কোথাও কোনও অশান্তি নেই, কোথাও কোনও অভাব নেই, কোনও অস্বস্তি নেই, খাও দাও ফুর্তি করো—গড় ইজ্ ইন্ দি চার্চ!
কিন্তু, তা তো হবার নয়। প্রেমের মত টাকারও বড় বিচিত্র গতি। আমেরিকাও মহাজন, ব্রিটেনও মহাজন। জার্মানী, ইটালী, ফ্রান্স—তারাও বড় বড় সব মহাজন। সবাই টাকা খাটাচ্ছে পৃথিবীর মার্কেটে। একদিন সেই মার্কেট বন্ধ হয়ে গেল। কেউ আর মাল কিনতে আসে না বাজারে। সবারই দেনা হয়ে গেছে। আফ্রিকার দেনা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার দেনা হয়েছে, ইজিপ্ট, পার্শিয়া, টার্কি—সকলে দেনাগ্রস্ত। মাল দরকার বটে কিন্তু দেনা আর বাড়াতে চাই না। মহাজনরা বললে—তা হোক। দেনার জন্যে তোমাদের ভাবনা নেই, ধার নাও। ধার দিচ্ছি। ইচ্ছে হয় শোধ করো কিংবা শোধ করো না। কিন্তু টাকা তোমরা নাও বাপু। টাকা না খাটালে আমাদের ঘুম আসবে না। টাকা না খাটাতে পারলে আমাদের ভাত হজম হবে না। তা তাই হলো। কেউ ধার নিলে, কেউ নিলে না। যারা ধার নিলে, তারা দেন্দার্ স্টেট। দেন্দার হয়েই রইল চিরকাল্ সে-ধার আর শোধ হবার নয় ইহকালে। তখন দেন্দারদের ওপর পাওনাদারদের পীড়ন চলতে আরম্ভ করলো। তাতেও কিছু সুরাহা হলো না। এল ট্রেড্-ডিপ্রেশন। কিন্তু ততদিনে সমস্ত পৃথিবীটাই মহাজনদের কবলে চলে গেছে। একদলের আছে, আর একদলের নেই। সেই নেই আর আছের মধ্যে বিরোধ বাধলো। জার্মানী বললে—তোমার যখন আছে, আমারই বা থাকবে না কেন? আমারও চাই স্বাস্থ্য, আমারও চাই আলো, আমারও চাই বাতাস। তোমাদের মত আমারও আরাম করবার অধিকার আছে—। আর তারপরই এল উনিশশো উনচল্লিশ সাল। আর তারপরেই এল ডিবচারি, ব্রাইব অ্যাডালট্রি। তারপরেই এল স্পেশ্যাল পুলিস। আর তারপরেই অ্যারেস্ট হলো মিস্টার এন্-কে-ঘোষাল!
কিন্তু এর পরে এল আর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা কিন্তু সে-কথা এখন থাক্।