কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩১
৩১
আপিসের ভেতরে সেদিন তখনও সেই আলোচনা চলেছে। সেই মিস্টার ঘোষালের কীর্তি-কাহিনী। এতদিন ভয়ে কারো মুখ ফোটেনি। সবাই ভেবেছিল মিস্টার ঘোষাল শুধু দেবতা নয়, শয়তানেরও নাগালের বাইরে। এতদিন সবাই মিস্টার ঘোষালকে সেলাম করেছে, সামনে খোশামোদ করেছে, সামনে স্বার্থসিদ্ধির একটা মহা-অস্ত্র হিসেবে দেখেছে। আর আজ এক মুহূর্তে সেই দেবতাই বাঁদরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এক মুহূর্তে সব শাসনের বাঁধ ভেঙে গেছে। সবাই বলছে—বাবা, কলিযুগ হলে কি হবে, এতগুলো লোকের শাপ ওম্নি যায় কখনও?
পুলিনবাবু টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বললে—আমি বলে দিচ্ছি ও কিস্যু হবে না—
—কিচ্ছু হবে না মানে?
—কিছু হবে না মানে, দেখবেন, ও ঠিক ছাড়া পেয়ে যাবে!
—কখনো ছাড়া পাবে না, ছাড়া যদি পায় তো ব্রিটিশ-রাজত্ব উল্টে যাবে মশাই, দেখে নেবেন!
ওপাশ থেকে কাঞ্চনবাবু বললে—উল্টোতে আর বাকিটা কী আছে মশাই? ব্রিটিশ- রাজত্ব এমনিতেও উল্টোবে, ওম্নিতেও উল্টোবে! আজকের কাগজ দেখেছেন?
এমনি প্রত্যেক সেকশানে। প্রতিটি কোণে কোণে প্রকাশ্যে আলোচনা চলেছে। টিফিনরুমেই সবচেয়ে বেশি। সিঁড়িতে, কোরিডোরে সর্বত্র। কেবিনে কেবিনে, কন্ট্রোল- রুমে-রুমে। খবরটা রেলের ডিভিসনে-ডিভিসনে ছড়িয়ে গেছে। টরে-টক্কায় সেদিন যে কত আর এক ডিভিসন থেকে আর এক ডিভিসনে পাঠানো হলো, তার কোনও হিসেবই রইল না রেলের খরচের খাতায়।
মিস্টার ক্রফোর্ড বললে-এবার থকে ওয়াগন অ্যালমেন্টের কাজ আর তোমায় করতে হবে না সেন—জেনালের ম্যানেজার দিল্লিতে কথা বলেছে, নতুন প্রায়রিটি-অফিস খোলা হবে—যদ্দিন না খোলা হয়, ততদিন আমি দেখবো—
দীপঙ্কর চুপ করে সামনে বসে ছিল। বললে—ভালোই হয়েছে, আমি তাতে দুঃখিত নই—
ক্রফোর্ড সাহেব আবার বললে—মিস্টার রবিনসন্ আমাকে মিস্টার ঘোষাল সম্বন্ধে খুব হাইলি বলেছিল। তোমার কী মনে হয় সেন, মিস্টার ঘোষাল এ-কাজ করতে পারে? সাহেবের প্রিয়পাত্র হবার জন্যে যে-লোক বাঙালী হয়েও নিজেকে সাইথ-ইন্ডিয়ান বলে প্রচার করতে পারে তার দ্বারা কী যে অসম্ভব, তা দীপঙ্কর কল্পনাও করতে পারে না। মিস্টার ক্রফোর্ডকে এ সব কথা বলেও বোঝানো যাবে না। নৃপেনবাবুর ফেয়ারওয়েলের সময়ও কি সত্যি-কথা কেউ মিটিং-এ দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছিল? আসলে আমরা কেউ-ই অপ্রিয় হতে চাই না। মানুষের কাছে অপ্রিয় হবার ভয়ে অনেক ঘা-ই তো আমরা ফরসা ধুতি-পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে রাখি। আমরা আমাদের দারিদ্র্য ঢেকে রাখি, লজ্জা ঢেকে রাখি, দীনতা-নীচতা সমস্ত ঢেকে রাখি কিন্তু আমরা জানতেও পারি না, সেই ঘা-ই একদিন সাইনাস্ হয়ে আমাদের মেরুদন্ড আক্রমণ করবে, মস্তিষ্ক আক্রমণ করবে। সেই ঘা-ই একদিন সমস্ত জাতির মেরুদন্ডে গিয়ে তার বিস্ফোরণ ঘটাবে। মিস্টার ঘোষাল কি শুধু একলা নিজের ক্ষতি করলে? আর কারো নয়? শুধু কি সতীরই সর্বনাশ ডেকে আনলে? আর কোনও মেয়ের নয়? চেঙ্গিস খাঁ কি শুধু নিজেরই সর্বনাশ করেছিল নিজের হাতে? আর কারো সর্বনাশ করেনি? একজন চৈতন্যদেবের কি একজন রামমোহন রায়ে পুণ্যের ফল যদি কোটি-কোটি মানুষের কাজে আসে, তাহলে একজন কালাপাহাড়ের পাপও সমস্ত মানুষ-জাতকে স্পর্শ করতে বাধ্য। পুণ্যে ফলের মত পাপের ফলও যে ভাগাভাগি করে ভোগ করতে হয়।
—আমায় ডেকেছিলেন?
দীপঙ্কর তাকিয়ে দেখলে লক্ষ্মণ সরকার। বললে—তোমার সঙ্গে কথা ছিল একটু বোস—
তবু লক্ষ্মণ সরকার বসতে একটু দ্বিধা করতে লাগলো। কবে একদিন একসঙ্গে পড়েছিল একই স্কুলে। সেদিন অপমানের চূড়ান্ত করেছে। আজ তারই দয়ায় চাকরি পেয়েছে। তারই দয়ায় একটা ভদ্র পরিচয় পেয়েছে।
লক্ষ্মণ সসঙ্কোচে বসলো সামনের একটা চেয়ারে। দীপঙ্কর বললে—কেমন চাকরি চলছে তোমার?
লক্ষ্মণ বললে—কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, তোমার দয়ায় আমি বেঁচে গেছি ভাই— দু’বেলা খেতে পাচ্ছি—
—সংসারে কে-কে আছে তোমার?
লক্ষ্মণ বললে—ছিল সবাই, কিন্তু কেউই নেই এখন।
—তাহলে কোথায় থাকো?
লক্ষ্মণ বললে—একটা মেসে—
—চিরকাল কি মেসেই থাকবে?
লক্ষ্মণ বললে—আমাদের জীবনে তাছাড়া আর কী আছে?
সেন-সাহেবের সামনে কথাগুলো বলতে পেরেই যেন ধন্য হয়ে গিয়েছিল লক্ষ্মণ সরকর। অনেক কথাই জিজ্ঞেস করলে দীপঙ্কর। হাতে কত মাইনে পায় লক্ষ্মণ। মেসে কত টাকা খরচ হয়। অনেক কথা। এতক্ষণ সামনে বসিয়ে সেন-সাহেব কথা বলবে, এটা লক্ষ্মণ সরকার কল্পনা করতেই পারেনি। তারপর দীপঙ্কর হঠাৎ বললে—আচ্ছা তুমি যাও, কে-জি-দাশবাবুকে পাঠিয়ে পাঠিয়ে দাও তো একবার—
কে-জি-দাশবাবু এল। বললে—আমায় ডেকেছিলেন স্যার?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা কে-জি-দাশবাবু আপনার সেকশানে ওই যে নতুন ক্লার্ক দিয়েছি, লক্ষ্মণ সরকার, ও কেমন কাজ করছে—?
কে-জি-দাশবাবু বললে—কিছুই জানে না স্যার, ড্রাফ্ট পর্যন্ত লিখতে শেখেনি এখনও, ইংরিজীর বানান্ ভুল করে বড্ড, আমকে সব দেখে-শুনে তবে আপনার কাছে পাঠাতে হয়—
—নতুন তো এখন, কিছুদিন থাকতে-থাকতেই সব শিখে নিতে পারবে বোধহয়—
কে-জি-দাশবাবু বললে-স্যার, আপনারা ছিলেন অন্যরকম, আপনাদের শেখবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এরা তেমন নয়, লেখাপড়াটাও জানে না তেমন, আর সকলেরই যদি বুদ্ধি থাকবে তাহলে তো আর কথাই ছিল না—
দীপঙ্কর বললে—আপনি একটু দেখে দেবেন, তাহলেই শিখে যাবে—ছেলেটা অত্যন্ত গরীব, খেতে পায় না এমন অবস্থা—
—আপনি যখন বলছেন, তখন দেখবো বৈকি নিশ্চয়ই দেখবো—বলে কে-জি- দাশবাবু চলে গেল। সেক্শানে যেতেই সবাই উন্মুখ হয়ে ছিল। সবাই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে—কী হলো কে-জি-দাশবাবু, সেন-সাহেব ডেকেছিল কেন?
কে-জি-দাশবাবু গায়ের কোট্ খুলতে খুলতে বললে—লক্ষ্মণবাবুর ওপর সাহেব খুব চটে গেছে,—
—কেন? কেন?
—আর কেন? ইংরিজীর ভুল। ছি ছি ড্রাফ্ট পাঠালেন সাহেবের কাছে, আর আমাকে একবার দেখালেন না পর্যন্ত। ফাইলের নিচে অসবর্ন সাহেবের নোট ছিল, সেটা দেখে টুকে দিতেও আলিস্যি হলো?
—তারপর কী হলো?
কে-জি-দাশবাবু চেয়ারের ওপর বসে পড়েছে তখন। বললে—উঃ, সেন-সাহেব যা রেগে গেছে লক্ষ্মণবাবুর ওপর, বললে, ওঁকে আমি ডিসচার্জ করে দেব। তা আমি খুব বুঝিয়ে বললুম, গরীব লোক, কেন চাকরিটা খাবেন, চাকরি দেওয়া শক্ত, চাকরি কেন খাবেন তার?
—তারপর?
কে-জি-দাশবাবু বললে-তোমরা তো বিশ্বাস করবে না, তোমরা ভাবো সাহেবদের কাছে আমি তোমাদের এগেস্টেই বলি কেবল—
লক্ষ্মণ সরকার নিজের সীটের ওপর বসে ভয়ে ভয়ে কাঁপছিল। মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরোল না। আজ অভাবে পড়ে সমস্তই মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয় তাকে। একদিন অকারণে সবাইকে অপমান করে বেেিয়ছে সে। অকারণে বন্ধুদের মাথায় চাঁটি মেরে বেরিয়েছে। কিন্তু সেদিন আর নেই। দীপু যদি আজ তার চাকরি খতম্ করেও দেয়, তাতেই বা তার বলবার মুখ কোথায়? পৃথিবীটাকে একদিন সে-ই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেছিল। আর আজ তাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাইছে পৃথিবীটা। মেসের চার্জ দিন দিন বাড়ছে। চালের দাম চার টাকা থেকে পাঁচ টাকায় উঠেছে, একদিন হয়ত এই চালের দামই ছ’ টাকা মণ দাঁড়াবে। তখন? তখন চাকরি না-থাকলে খাবে কী? দীপঙ্কর যখন আপিসে আসে, গুর্খা দারোয়ান থেকে শুরু করে যে সামনে পড়ে, সেই-ই সেলাম করে। দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মণ সব লক্ষ্য করে। সেই ধর্ম-দাস ট্রাস্ট মডেল স্কুলের নিরীহ লাজুক মুখচোরা ছেলেটা কেমন করে এই পোস্টে উঠলো। সেইটেই লক্ষ্মণের কাছে এক বিচিত্র ব্যাপার বলে মনে হয়। কত সুখে আছে দীপু। ঝি- এর ছেলে—ওর মা পরের বাড়িতে রাঁধুনি-বামুনের কাজ করতো। একেই বলে কপাল মশাই। আর যত ফাটাকপাল আমাদের বেলায়!
—আপনি সেন-সাহেবকে চিনতেন নাকি আগে?
—চিনতাম মানে? ছোটবেলায় এক স্কুলে একসঙ্গে একই ক্লাশে পড়েছি। কী গো- বেচারা মানুষ ছিল তখন, সাত চড়ে রা বেরোত না মুখে—তখন ওর মাথায় কত চাঁটি মেরেছি, জানেন—
এমনি অবাকই লাগে বটে। পৃথিবীর হাল-চাল নিয়ম-কানুন দেখে এমনি অবাকই হয়ে যায় লক্ষ্মণ সরকারের দল। এমনি কপালের ওপর দোষারোপ করে সান্ত্বনার সস্তা- সহজ আশ্রয়টিতেই সবাই মুখ লুকোয়। কিন্তু ওরা যদি জানতো দীপঙ্করের মনের গোপন কক্ষটিতে দিনরাত কত দ্বন্দ্বের আন্দোলন চলেছে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সরু গলি থেকে শুরু করে আজই এই ডি-টি-এস’এর চেয়ারে এসেও কেন যে সেই যন্ত্রণার জানোয়ারটা তাকে দিনরাত কামড়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে ছারখার করে দিচ্ছে—তা যদি জানতো! শুধু নিজের একান্ত আপন ইচ্ছেটা নিয়ে থাকলে সে তো বেঁচে যেত। কিন্তু তা তো হয় না। মনে হয়, এই কলকাতাই শুধু নয়, সমস্ত পৃথিবীর সব সমস্যাগুলো যেন তার মাথার ভার হয়ে বোঝা হয়ে চেপে বসে থাকে। নিজের উন্নতির বিড়ম্বনা তাকে যে দিনের পর দিন অশান্তির আগুনে পুড়িয়ে মারে।
—জানেন, আপনি এখন যে-চেয়ারে বসছেন, এই চেয়ারেই গাঙ্গুলীবাবু বলে এক ভদ্রলোক বসতো। তার কাছেই শুনেছি আমরা, ওই সেন-সাহেব একদিন তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে এই চাকরিতে ঢোকে!
—সে কি? কে বললে আপনাকে?
—জানি মশাই সব জানি। নৃপেনবাবু বলে আগে যে সুপারভাইজার ছিল, তাকেই ঘুষ দিয়েছিল। ঘুষ দিতে আর ঘুষ নিতে না পারলে আজকের পৃথিবীতে কেউ বড় হতে পারবে না। এ আর সত্যযুগ নয়। দেখলেন না আজ মিস্টার ঘোষালের কী হলো? ভালোমানুষ হয়ে মুখ বুজে থাকুন, জীবনে আপনার চাকরিতে প্রমোশন হবে না! ওই সেন-সাহেব ঘোষাল-সাহেবদের মত তোখোড় ধড়িবাজ হতে হবে—এটা ধড়িবাজদেরই যুগ যে মশাই—
—কিন্তু ঘোষাল-সাহেবকে তো অ্যারেস্ট করেছে পুলিস, এবার তো জেল হয়ে যাবে।
—রাখুন মশাই, বড়লোকরা অত সহজে জেলে যায় না। জজ্ ম্যাজিস্ট্রেটরাও ঘুষ খায় না ভেবেছেন? আপনি আছেন কোথায়? পৃথিবী যে চোরের রাজ্যি—যে চুরি-ডাকাতি করতে পারবে এখানে, তারই পোয়া বারো! আর সৎপথে থাকুন, তাহলে ওই গাঙ্গুলী- বাবুর মত গলায় দড়ি দিয়ে মনের জ্বালা জুড়োতে হবে! কোটা করবেন বলুন এখন!
সত্যি, দীপঙ্করও অনেকদিন নিজের মনে ভেবেছে সে কাদের দলে? তার আগেকার চেয়ারটাতে এসে বসেছে অভয়ঙ্কর। সেই চেয়ারে বসার পর থেকেই যেন অন্যরকম হয়ে গেল রাতারাতি। তারও মত বদলে গেল এক মুহূর্তে। সে-ও বললে—ক্লার্কদের বেশি প্রশ্রয় দিলে তারা মাথায় ওঠে সেন—তাহলে আর ওরা তোমায় রেসপেক্ট করবে না—
দীপঙ্কর বলেছিল—রেসপেক্ট বড়ো না কাজটা বড়ো?
—কিন্তু রেসপেক্ট না করলে যে কাজও করবে না ওরা!
দীপঙ্কর বলেছিল—ভুল তোমার ধারণা অভয়ঙ্কর, আমিও একদিন ক্লার্ক ছিলাম, আমিও ক্লার্কদের ব্যথাটা বুঝি, ওদের একবার ভালবেসে দেখো তুমি, ওরা ডবল্ কাজ করবে—
অভয়ঙ্কর তাই বলতো—তুমি বড় ভীতু সেন, অত ভয় করে কেন চলো ওদের? অত ভীতু বলেই ওরা অত কাজে ফাঁকি দেয় তোমার কাছে—।
কথাটা শুনে দীপঙ্কর হেসেছিল। সত্যিই কি দীপঙ্কর ভীত! ভয় পায় বলেই কি এত সহানুভূতি ওদের ওপর! কিন্তু যখন ছেঁড়া জামা, ময়লা কাপড়, একমুখ দাড়ি দেখে ওদের, তখন কেমন করে কোন প্রাণে শাস্তি দেয়? ওদের মধ্যেই যে দীপঙ্কর নিজের ছায়াকে দেখতে পায়। ওরাই যেন হাজার-হাজার দীপঙ্কর হয়ে সেকশানে সেকশানে ধুঁকছে। ওদের সামনে ফরসা কোট-প্যান্ট পরতেও লজ্জা হয় দীপঙ্করের। ওদের জন্যে কিরণ নিজের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আর দীপঙ্কর ওদেরই একজন হয়ে আজ এই ওদের মাথায় বসে হুকুম চালাচ্ছে।
হাসপাতাল থেকে ঘরে ঢুকতেই মধু সেলাম করে সুইং-ডোরটা খুলে দাঁড়াল। কিন্তু ঘরে ঢুকতে গিয়েই একটা চেনা-মুখের সঙ্গে আট্কে গেল দৃষ্টিটা।
—আরে কী খবর? তুমি এখানে?
ছিটেও অবাক হয়ে গেছে। বহুদিন ধরে বহুভাবে দেখে দেখে ছিটে-ফোঁটাদের সম্বন্ধে আর অবাক হবার কিছু ছিল না। এখন আর চেনা যায় না দু’জনকেই। সেই যেদিন থেকে নতুন অ্যাক্ট চালু হয়েছে দেশে, সেইদিন থেকেই ছিটে-ফোঁটার আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। অবস্থা ভাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাল-চলনেও কেমন একটা গাম্ভীর্য আসে। অতীতের দারিদ্র্য, অতীতের হীনতা, নীচতা, ভন্ডামি, গুন্ডামি সব কিছুই বুঝি ঢাকা পড়ে যায়। সেই কালিঘাটের বস্তির দু’টো গুন্ডাকে আজ এই খদ্দর- পরা চেহারার মধ্যে কে খুঁজে বার করতে পারবে!
ছিটে এসে চেয়ারে বসে চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। বললে—তুই এখানে? ঘোষাল-সাহেব কোথায়?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে— ঘোষাল-সাহেবকে তুমি চিনতে নাকি?
—সেকি রে, ঘোষাল-সাহেবকে চিনবো না? কত দহরম-মহরম করেছি একসঙ্গে। প্যালেস-কোর্টে কতদিন রাত কাটিয়েছি। আর শুধু রাত কেন, দিনও কাটিয়েছি একসঙ্গে। ছুটিতে বুঝি ঘোষাল-সাহেব?
—না।—দীপঙ্কর সমস্ত ঘটনাটাই খুলে বললে।
—তাহলে ওয়াগন অ্যালমেন্ট কে করবে? তুই?
দীপঙ্কর বললে—না, নতুন প্রায়রিটি আপিস হচ্ছে—সব অ্যালমেন্ট সেখান থেকেই হবে। কিন্তু তুমিও কি ব্যবসা করছো নাকি? তোমরা তো ব্যবসা করতে না আগে? তোমরা তো কংগ্রেসে ঢুকেছিলে।
ছিটে হেসে উঠলো। বললে—ব্যবসার সুবিধে হবে বলেই তো কংগ্রেসে ঢুকেছি— দীপঙ্করের মনে পড়লো সেই হাজরা পার্কের মিটিং-এর দৃশ্যটা। সেই বক্তৃতার কথাগুলোও ভেসে উঠলো কানে। বললে—কিন্তু কংগ্রেস করলে ব্যবসা করবে কখন? এই তো শুনছি কংগ্রেসকেই ব্যান্ করে দেবে, তখন তো সব কংগ্রেস-লীডারদের ধরবে—তখন ব্যবসা করবে কী করে?
ছিটে বললে—আরে, আমি তো কংগ্রেসের কেউ নই, কংগ্রেস করছে ফোঁটা। ফোঁটা পারমিট বার করে দেয় আমার নামে, আর আমি ব্যবসাটা দেখি। দু’জনে জেলে গেলে কখনও চলে? ফোঁটা যদি জেলেও যায়, আমি তো আছি—অঘোরদাদু তো বেশি টাকা রেখে যায়নি—সিন্দুক ভেঙে মাত্র দশ লাখ টাকা পেয়েছিলুম—আর কিছু গয়না, কিন্তু তাতে তো পোষায় না—
—কেন পোষায় না?
—পোষাবে কী করে? এখন তো তুই আর যানি বাড়িতে। সে-বাড়ি তো ঢেলে সেজে নতুন করে ফেলেছি, বাড়িটা সারতেই তো হাজার ষাটেক টাকা বেরিয়ে গেল। তারপর গাড়ি কিনলাম দু’জনে দুটো প্রথমে গাড়ি তো কিনতে চাইনি। কিন্তু দেখলাম কংগ্রেসই করি আর যাই করি, গাড়ি না থাকলে কেউ মানতে চায় না—তার ওপর আবার ড্রাইভার পুষতে হচ্ছে—আর সংসার তো বেড়েই চলেছে দিন-দিন, জিনিসপত্তরের দাম যে কী হচ্ছে, তা দেখছিস তো—
উনিশ শো বিয়াল্লিশের সেই বালা দেশ। বাঙলা দেশ শুধু নয়, সমস্ত ভারতবর্ষ সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ভূমিকম্পের আঘাতে টল্ করছে। একদিন ইন্ডিয়া থেকে আয়রন ওরা নিয়ে গিয়েছিল জাপানে। তখন নগদ দাম পেয়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট মাল বেচেছে তাকে। কিন্তু তখন কি জানতো সেই আয়রন-ওরই আবার বোমা হয়ে ফিরে আসবে ব্রিটিশ এম্পায়ারের সেকেন্ড সিটি এই কলকাতার বুকে! আর ঠিক সময় বুঝেই মহাত্মা গান্ধী আরম্ভ করে দিয়েছেন তাঁর আন্দোলন। এই কলকাতা! এই কলকাতাই হলো ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ইনডাস্ট্রিয়্যাল স্ট্রংহোন্ড্। এই এখানকার ইন্ডিয়ান ব্যবসাদাররাও চাঁদা দিয়েছে কংগ্রেসকে। নিউ ইয়র্ক টাইমস্ লিখেছে—
.
Birla brothers of Bombay finance the All India Congress. Mr. Birla is out openly to oust the British and he subsides the Congress heavily. Mr. Birla, Sir Badridas Goenka, Mr. J. C. Mahindra and others are not afraid that Jawaharlal Nehru’s socialistic ideal will gain the ascendency. Even if he runs the show, the Indians believed that he will be ‘sensible’,
ছিটে বললে-আমিই তো কংগ্রেস ফান্ডে চাঁদা দিয়েছি বিশ হাজার টাকা—একলা-
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বলে—তুমিও দিয়েছ?
—শুধু কি আমি? সবই দিয়েছে। বিড়লা দিয়েছে, টাটা দিয়েছে, গোয়েঙ্কা দিয়েছে আমি কি ওনি-ওনি দিচ্ছি ভেবেছিস? এর চার ডবল তুলে নেব না পরে! তখন তো ফোঁটাই কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাচ্ছে—
মনে আছে সেদিন ছিটের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। প্রাণমথবাবু থাকতে ফোঁটা হবে প্রেসিডেন্ট! শুধু দীপঙ্কর কেন, কেউ-ই বিশ্বাস করেনি। কেউ-ই বিশ্বাস করেনি, মিস্টার চার্চিলও বিশ্বাস করেনি, এত কষ্টে গড়া ইন্ডিয়ান এম্পায়ার এত শীঘ্র চার্চিলের হাত-ছাড়া হয়ে যাবে। ধর্ম দিয়ে যখন ইন্ডিয়া জয় করেনি ব্রিটিশ, তখন ধর্ম আশ্রয় করে তাকে ধরে রাখতেও পারা যাবে না। ইন্ডিয়াকে কে রুখবে? একদিকে মহাত্মা গান্ধী আর একদিকে মিস্টার বিড়লা। একদিকে বাইবেল আর একদিকে গীতা। বাইবেলের সঙ্গে রুজভেল্ট আছে। গীতার সঙ্গেও আছে বিড়লা। দেখা যাক্ কার শক্তি বেশি!
—এ ক’দিন কাজ চালাবে কে?
দীপঙ্কর বললে—ক্রফোর্ড সাহেব নিজে!
—সাহেব কত ঘুষ নেবে?
দীপঙ্কর বললে—তা আমি জানি না। নেবে কিনা তাও জানি না।
ছিটে হেসে উঠলো। বললে—দূর, ঘুষ নেয় না এমন মানুষ আছে নাকি দুনিয়ায়? কত বড়-বড় মহারথীকে দেখলুম, তোদের সাহেব তো কোন্ ছার। তোদের জেনারেল ম্যানেজারকে পর্যন্ত ঘুষ দিতে পারি। বাজি রাখ্। সব শালা ঘুষ নেয়। ঘুষ না নিলে বড়লোক হওয়া যায়? আমি নিজেই ঘুষ দিই পারমিট্ বার করবার জন্যে—ঘুষটা নিস্ বুঝলি? যদি দু’পয়সা করতে চাস্ তো বড় ভাই-এর মত উপদেশ দিয়ে যাচ্ছি তোকে—ঘুষটা নিস। তোর এই চাকরিতে কিছু হবে না। হাজার মন দিয়ে কাজ করলেও কিছু হবে না—
আশ্চর্য, ছিটে সেই ছিটেই আছে। বাইরেই শুধু খদ্দর পরেছে, সভ্য হয়েছে, কংগ্রেসের মেম্বার হয়েছে।