কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৩
৩৩
প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে মা-মণি নিজের বিছানায় শুয়েও শান্তি পাচ্ছিলেন না। একবার উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের বারান্দায় এলেন। চারিদিকে চেয়ে দেখলেন। দুপুর গড়িয়ে গেল। নিচের রান্নাবাড়ির উঠোনে তখন বাসন-মাজার ঘ-ঘ শব্দ হচ্ছে। এখনও ফিরে এল না। এখনও শব্দ হল না গাড়ির। তারপর আবার বিছানায় গিয়ে বসলেন। কিন্তু শুতে গিয়েও শুতে পারলেন না।
রান্নাবাড়িতে বাতাসীর মা বললে—মাগীর এখন হয়েছে কী, সবে তো কলির সন্ধ্যে, যখন বউ এসে শাশুড়ীর মুখে ঝামা ঘষবে, তখন শিক্ষা হবে! ওলো সেই কথায় আছে না—ভালো দেখে বউ আনলাম ঘরে, বাঁশ দেখে বউ বাজি করে—
কৈলাস বললে—দাদাবাবু বৌদিমণিকে আনতেই তো গেচে বাতাসীর মা! তা বুঝি জানো না—
বাতাসীর মা বললে—জানি রে জানি, জানতে কিছু বাকি থাকে না বাতাসীর মা’র— মাগীর হেনস্থা দেখবো বলেই তো বসে আছি এখনও এ-বাড়িতে, নইলে কবে চলে যেতুম—
ওপর থেকে চিৎকার এল—হ্যাঁরে, রান্নাঘরে অমন চেঁচায় কে রে? তোরা একটু জিরোতে দিবিনে আমাকে।
কথাটা কানে যেতেই সবাই চুপ করে গেল। বাতাসীর মা দাঁতে দাঁত চেপে বললে—তোর বুড়ীর হয়েছে কী এখন? হামানদিস্তে দিয়ে ওই বউ এসে তোর দাঁতের গোড়া ভাঙবে, তবে জিরোতে দেব। একেবারে ক্যাওড়াতলার শ্মশানে গিয়ে তবে জিরোবি তুই—
সমস্ত বাড়িতেই এই রকম চলছিল কয়েকদিন ধরে। দিনের পর দিন এমনি আলোচনাই চলে রান্নাবাড়িতে। একদিন এই বাড়িরই জলুস ছিল কত। সব তারা দেখেছে। একদিন এই বাড়ির জাঁক-জমক দেখে তারা অবাক হয়ে গেছে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের অন্য দশটা বাড়ির ঝি-চাকরদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই নিয়ে।
তারা বলেছে—তোদের কী বাছা, তোরা মনিব পেয়েছিস্ ভালো, তোদের চাকরি করেও সুখ—
আর পাঁচটা বাড়ির চেয়ে ঘোষ-বাড়িতে মাইনে বেশি। ইজ্জত বেশি। বছরে দু’খানা কাপড়, একখানা গামছা। তারপর তেল দোক্তা পান তামাক, সবই আছে। সকালবেলা জলখাবারে রুটি, আখের গুড। সন্ধ্যেয় মুড়ি। আর দু’ গেলাস চা দু’বেলা।
পাড়ার লোকে বলতো—ঘোষ-বাড়ির ঝি-চাকর আমাদের বাড়ি চলবে না বাছা, ওরা হলো গিয়ে জমিদার, আর আমরা গেরস্ত-পোষা মানুষ, তুমি অন্য বাড়িতে চেষ্টা দেখ বাছা—
সেই বাড়িরই আজ এই হেনস্থা। ভূতির-মা কাজের চেষ্টায় এদিক-ওদিক ঘোরে। একবার কাজের ফাঁকে কালিঘাটটা ঘুরে আসে। চড়কডাঙার বাবুদের বাড়িটাতেও খোঁজ নিয়ে আসে।
তারা বলে—তা ওরা ছাড়িয়ে দিচ্ছে কেন গা?—
ভূতির-মা বলে—ওদের লোকের আর দরকার নেই মা—
—তা হঠাৎ দরকার নেই-ই বা কেন শুনি?
—কী জানি মা, মনিবদের ভেতরের কথায় তো আমরা থাকিনে। তবে শুনছি নাকি, ব্যাঙ্কের টাকা চুরি হয়ে গেছে বাবুদের।
ব্যাঙ্কের টাকা-চুরির কথাটা কেউ বিশ্বাস করে না। তাই নাকি আবার হয়। তারপর আসল কথাটা বেরিয়ে পড়বে। বলে—হ্যাঁগা বাছা, তোমাদের বউ ফিরেছে?
ভূতির মা বলে—না মা, ফেরেনি—
—তা কোন্ পাড়ায় ঘর ভাড়া নিয়েছে তোমাদের বউ, সোনাগাছি না রামবাগান? শুনেছ কিছু?
তারপর হতাশ হয়ে বলে—আর ফিরেছে! অমন শাশুড়ীর কাছেও যখন ঘর করতে পারলে না, তখন আর ফিরেছে সে বউ!
শুধু চড়কডাঙা নয়। ওই চাউলপটি, লখার মাঠ, সব পাড়ার লোকই জানে ঘোষ- বাড়ির বউ-এর কীর্তি। এসব পাড়ার বনেদী বাড়ির মধ্যে আসা-যাওয়া না থাকলেও পরস্পরের হাঁড়ির খবর পরস্পরে রাখে। আর সেসব খবর এই ভূতির মা বাতাসীর- মারাই বয়ে নিয়ে যায়। এই বৌদিমণির বিয়ের সময়ই সমস্ত ভবানীপুর ঝেঁটিয়ে লোক এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। এ-বাড়ির ঐশ্বর্য তারা দেখেছে নিজের চোখে। দেখে হিংসে হয়েছে, বুকে জ্বালা হয়েছে। আজ এ-বাড়ির পতনের খবর পেয়েও তাই তারা উল্লসিত হয়, আনন্দ পায়।
বাতাসীর-মা রেগে ওঠে। বললে—তা তুই কেন বললিনে, আমরা খাই ভাতারের ভাত, তোদের কেন গালে হাত?
কৈলাস বলে—পড়শীরা অমন বলবেই বাতাসীর-মা, পড়শীর কথায় কান দিলে চলে?
ভূতির মা বলে—আমারও যেমন হয়েছে পেটের জ্বালা, কবে সরকারবাবু ছাড়িয়ে দেবে, তখন হা-ভাত হা-ভাত করে ঘুরে বেড়াবো—
তা হা-ভাত হা-ভাত করে ঘুরে বেড়ানোর দশাই বটে। বছর খানেকও কাটেনি, কলকাতার লোক পিল পিল্ করে সব পালিয়ে গিয়েছিল কলকাতা ছেড়ে, আবার সবাই ফিরে এসেছে। আবার রাস্তা ঘাটে মানুষের ভিড়। আবার দোকান-পাটে খদ্দের আনা- গোনা করছে।
সবে তখন খাওয়া-দাওয়া চুকেছে। বাসাতীর-মা কলতলায় দাঁড়িয়ে কুলকুচো করছে, এমন সময় বাইরের গেটে গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
—কে এল রে কৈলাস?
কৈলাস ছিল নিচেয়। ডাক শুনেই দৌড়ে গেল। বললে—আমায় ডাকছেন মা-মণি। –তোর মুখ দেখতে ডেকেছি নাকি হতচ্ছাড়া? বাইরে কার গাড়ি এল দেখবি তো? তোকে বলে রেখেছিলুম না—
—এই যাচ্ছি মা-মণি—
কৈলাস চলেই যাচ্ছিল নিচেয়। মা-মণি আবার ডাকলেন। অস্থির হয়ে এতক্ষণ পায়চারি করছিলেন তিনি। একবার ঘর, আর একবার বার। কখন যে এসে পড়ে তার ঠিক নেই। হাসপাতাল থেকে সোজা হয়ত এখানেই নিয়ে আসবে খোকা। দরকার নেই, কাউকে দরকার নেই। সমস্ত পুড়ে-ঝুড়ে থাক। শ্বশুরের এই সম্পত্তি সব নষ্ট হয়ে যাক। কার জন্যে আর সংসার করা। আমি মরি-বাঁচি করে না-খেয়ে না-পরে এতদিন ধরে কার জন্যে এই সংসার আগলে আছি? রাত্রে আমার ঘুম নেই, দিনে আমার সোয়াস্তি নেই, সব সেই পোড়ারমুখীর জন্যে!
—আয়, শুনে যা, যদি কেউ ঢোকে এ-বাড়িতে তো তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
কৈলাস কেমন থতমত খেয়ে গেল। বললে— আজ্ঞে, দাদাবাবু যে আজকে খায়নি এখনও—
—দাদাবাবু হোক, আর যেই হোক, কাউকে ঢুকতে দিবিনে, এ আমার বাড়ি। আমি যদি কাউকে ঢুকতে না দিই তো কা’র কী? যা—
—আজ্ঞে, শম্ভুও গেছে দাদাবাবুর সঙ্গে, দাদাবাবু বৌদিমণিকে নিয়ে আসবে বলেছে—
—চোপরাও হারামজাদা! আমার কথার ওপর আবার কথা!
এবার আর দাঁড়াবার ভরসা হলো না কৈলাসের। তরতর করে নেমে এল নিচেয়। তারপর একেবারে সদর গেটের কাছে যাবার আগেই গাড়িটা ঢুকে পড়েছে ভেতরে। ইঁট বাঁধানো রাস্তাটার ওপর গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে কে একজন সাহেব-পানা লোক। অনেকটা ব্যারিস্টারবাবুর মত দেখতে।
কৈলাস কাছে যেতেই সাহেব বললে—বাড়িতে কে আছে?
কৈলাস বললে—হুজুর, আপনি ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়েছেন কেন? গাড়ি বাইরে নিয়ে যান, বাইরে নিয়ে যান—
মিস্টার ঘোষাল এত সহজে পেছপাও হবার লোক নয়। আবার জিজ্ঞেস করলে— বাড়িতে কে আছে তোমাদের?
কৈলাসও কম নয়। বললে-আজ্ঞে যেই থাকুক, দেখা হবে না—গাড়ি আপনার বাইরে নিয়ে যান—
মিস্টার ঘোষাল বলে—মিসেস্ ঘোষ ভেতরে আছেন? আমি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করবো—
কৈলাস বললে—দেখা করবার হুকুম নেই সাহেব, বাড়ির ভেতরে গাড়ি ঢোকবার হুকুম নেই মা-মণির
—তোমার মা-মণির সঙ্গে একবার দেখা হবে না? তোমার মা-মণিকে গিয়ে বলো না মিস্টার ঘোষাল এসেছেন, একবার দেখা করতে চান—
—আপনি তো ভারি বে-আক্কেলে লোক দেখছি, আমি তো হুকুমের চাকর, আমার ওপর তম্মি করেন কেন? বলছি হুকুম নেই! এ-বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেবার হুকুম নেই—
মিস্টার ঘোষাল এবার কী করবে বুঝতে পারলে না। বললে—বাড়িতে আর কেউ নেই?
—আর কে থাকবে? দাদাবাবু ছিল, তা সেই দাদাবাবুও তো বেরিয়েছেন। বৌদিমণিকে হাসপাতাল থেকে আনতে গেছেন—
—আর কেউ? কোনও পুরুষ মানুষ! যে কেউ হলেই চলবে। আমার জরুরী কাজ ছিল একটা।
—আপনি অন্য সময় আসবেন। এখন বাইরে যান দিকি, আমি গেট বন্ধ করে দিই—
মিস্টার ঘোষাল কী করবে বুঝতে পারলে না। তারপর বললে—ঠিক আছে, পরে আমি আসবো—
—আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই ভালো, পরে আসবেন।
গাড়িটা ঘুরলো এবার। ঘুরে রাস্তায় গিয়ে পড়লো। সামনেই সেই বাড়িটা। ভাড়া নিয়েছিল ঘোষাল। বাড়ির সামনে গিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলো জোরে জোরে।
—মিস্টার মিত্র আছেন?
একটা চাকর বেরিয়ে এল। বললে-বাবু তো মধুপুরে গিয়েছেন, এখনও আসেননি—
মিস্টার ঘোষাল বললে—কবে আসবেন?
—আজ্ঞে তা আমি জানি না।
মিস্টার ঘোষাল বললে-এ-বাড়ি আমার নামে ভাড়া নেওয়া আছে, দু’ মাসের অ্যাডভান্স দিয়ে গেছি আমি তোমার বাবুকে।
—আজ্ঞে, সে বাবু সব জানেন। আমি জানি না। মা-বাবু-দাদাবাবু-দিদিমণি সবাই মধুপুরে, আমি কিছুই জানি না।
—তা বাড়ি যেন আর কাউকে ভাড়া না দেওয়া হয়, তুমি তোমার বাবুকে জানিয়ে দেবে।
—আপনি কবে থেকে আসবেন বাবু?
মিস্টার ঘোষাল বললে—সে আমার সুবিধে হলেই আসবো। আর আমি আসি আর না-আসি তাতে তোমার বাবুর কী? আমি ভাড়া দিলেই তো হলো?
চাকরটা মিস্টার ঘোষালের কাছে ধমক খেয়ে থেমে গেল। আর কিছু বললে না। মিস্টার ঘোষালও আবার গাড়িতে এসে উঠলো। মিস্টার ঘোষালের কাছে সারা পৃথিবীটাই যেন রেলের আপিস। এ যেন তারই জমিদারী। তার নিজের ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্ট। ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টের সবাই তার আন্ডারে। এই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের সমস্ত বাসিন্দারাই যেন তার ক্লার্ক। মিস্টার ঘোষালের একটা কলমের খোঁচায় ক্লার্কদের যেন এক মুহূর্তে প্রমোশন হয়ে যেতে পারে! পুওর ক্লার্কস। দে আর বর্ন টু বি ক্লার্কস! পুওর সোলস্!
সকাল থেকেই মিস্টার ঘোষালকে যেন কেউ তার জমিদারী থেকে উৎখাত করেছে। তাড়িয়ে দিয়েছে। ক্লাস ওয়ান গভর্নমেন্ট অফিসার মিস্টার ঘোষাল! হাজরা রোডের মোড়ে গাড়িটা দাঁড়াতেই একটা ভিখিরি জানালায় হাত বাড়াল।
—সায়েব, একটা পয়সা সাহেব, একটা পয়সা—
মিস্টার ঘোষালের ডি-টি-এস মনটা চিৎকার করে উঠলো—গেট আউট—গেট আউট—
তবু ভিখিরিটা নড়ে না। একটা পয়সা সাহেব, গরীব আদমী, একটা পয়সা—
—ইউ সিলি বীচ, গেট আউট ফ্রম হিয়ার, গেট আউট—
পুলিসের হাত নামতেই গাড়িটা ছেড়ে দিলে। তারপর ট্রাম-লাইন ধরে সোজা রাস্তা। তারই ডান দিকে হরিশ মুখার্জি রোড। নাম্বারটা মনে আছে মিস্টার পালিতের। দ্যাট শ্রুড ল-ইয়ার। মিসেস্ ঘোষের বার-য়্যাট-ল।
তখন নতুন এক সমাজ গড়ে উঠছে পৃথিবীতে। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে যে নতুন দল উঠেছিল, এরা তারা নয়। এরা আর এক নতুন দল। আর এক নতুন সমাজ। এরা একদিন রাস্তার লোক ছিল। এরা কেউ স্কুল-মাস্টার, কেউ দোকানদার, কেউ সেলসম্যান। কেউ গেজেটেড অফিসার। এরা ধূলো-মুঠো ধরছে আর সোনা-মুঠো করছে। এরা কুইনাইন কিনছে তিন টাকায়, বেচছে তিন শো টাকায়। ধান, চাল, ওষুধ,—যা কিছু ইচ্ছে ধরতে পারো, হোর্ড করতে পারো, তারপর একমাস পরে বেচলেও লাভ। রাতারাতি নতুন সমাজ গড়ে উঠলো তাদের নিয়েই এই কলকাতা শহরের বুকে। তাদের দলে নতুন নাম লিখিয়েছে মিস্টার ঘোষাল। উনিশশো বিয়াল্লিশের নতুন প্রোডাক্ট। বংশগৌরব থাকার আর দরকার নেই এখন। কানেকশন থাকারও দরকার নেই। ঢাকা থাকলেই প্রেস্টিজ। তোমার টাকা আছে তাহলেই তুমি আমাদের দলে। তোমাকে তাহলেই আমরা দলে টেনে নেব। সেই ফিউডালিজম-এর নবাবিআনার দিন চলে গেছে। এখন নিও-অ্যারিস্ট্রোক্রাসির ঢেউ এসেছে। আমরা নিও- অ্যারিস্ট্রোক্রাট। লেটেস্ট মডেলের গাড়ি আছে তোমার? ফরেন-এডুকেশন আছে? তা- থাক আর না-থাক, তোমার টাকা আছে জানলেই আমরা আমাদের সমাজে তোমাকে ঠাঁই দেব। চুরি করেই হোক আর ডাকাতি করেই হোক, কিম্বা ঘুষ নিয়েই হোক আর ব্ল্যাক-মার্কেট করেই হোক—অনেক টাকা তোমার থাকা চাই-ই।
অঘোরদাদুরও টাকা ছিল। কিন্তু সে টাকা দিয়ে চলবে না। সে টাকা সিন্দুক বন্দী করা টাকা। তার ইউটিলিটি নেই। সে স্থাণুর মত সমাজে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাকে আমরা দলে নেব না। নয়নরঞ্জিনী দাসীরও টাকা ছিল। কিন্তু সে তো বংশানুক্রমিক টাকা। উত্তরাধিকারীসূত্রে পাওয়া। সঞ্চয়ী-বৃত্তি থেকে তার উৎপত্তি। সে টাকা পরের ঘাড় ভেঙে উপায় করা। সে টাকাও বাতিল। কিন্তু আমাদের টাকা অন্যরকম। আমরা মিস্টার ঘোষাল, আমরা সুধাংশু, আমরা লক্ষ্মীদির দল। এতদিন আমাদের অস্তিত্ব ছিল না। চোর ছিল, ডাকাত ছিল, খুনী ছিল দেশে। কিন্তু বড়লোক- চোর বড়লোক-ডাকাত বড়লোক-খুনী ছিল না। এরা কথায়-কথায় মিনিস্টার, গভর্নর দেখাতে লাগলো। এরা আপিসের পর লক্ষ্মীদির বাড়িতে গিয়ে ফ্ল্যাশ খেলার জুয়ায় রিক্রিয়েশন খোঁজে। এরা প্যালেস-কোর্ট থেকে বেরিয়ে মিস্ মাইকেলের ফ্ল্যাটে যায়। এরা নেশা করে, কিন্তু হুঁশিয়ার হয়ে করে। এরা ফ্ল্যাশ খেলে, কিন্তু সজ্ঞানে খেলে। কলকাতার বুকে তখন এই এদেরই রাজত্ব। এদেরই প্রতিপত্তি। এদেরই প্রবল প্রতাপ মিস্টার ঘোষালের ভিড়ে তখন কলকাতা ভরে গেছে। সুধাংশুদের প্রভাবে তখন কলকাতা ডুবে গেছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই তারা প্রভাবে, প্রতিষ্ঠায়, প্রতিপত্তিতে, সংখ্যায় কেবল বেড়ে চলেছে।
—ইজ মিস্টার পালিত ইন্?
কয়েকটা পুলিস তখন পাহারা দিচ্ছে নির্মল পালিতের বাড়ির সামনের পৈঠের ওপর বসে। টবের ওপর গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। খাঁচাটা ঝুলছে শুধু পাখী নেই। কিন্তু কুকুরটা তখনও জিভ বার করে নিঃশ্বাস টানছে।
—ইজ মিস্টার পালিত ইন্?
কে আর উত্তর দেবে এ কথার? মিস্টার ঘোষাল নাম্বারটা মিলিয়ে দেখেছিল। কোনও ভুল নেই। গেটের বাইরে এন-কে-পালিত, বার-য়্যাট-ল লেখা ট্যাবলেটটা তখনও আঁটা।
—কোঠিমে কোই নেই হুজুর।
মিস্টার ঘোষাল অবাক হয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার আরো অবাক হয়ে গেল। কেন? বাড়িতে নেই কেন? সামথিং রং ইন দি স্টেট অব ডেনমার্ক?
পুলিস দুটো মিস্টার ঘোষালের চেহারা দেখে একটু সমীহ করে কথা বললে। মিস্টার ঘোষাল সবটা শুনে কেমন হয়ে গেল যেন! হলো কী তাহলে? ভদ্রলোকের পক্ষে ক্যালকাটা সিটিতে কি আর থাকা চলবে না! ও হেল! পুলিস কমিশনার তাহলে আছে কী করতে? সার জন হারবার্টকে আজকেই বলতে হবে। ফজলুল হককেও রিং করতে হবে! কোনও জেন্টেলম্যানের পক্ষে দেখছি আর এখানে থাকা সম্ভব নয়—এই ক্যালকাটা সিটিতে!!
—ও হেল্!
আর একবার ‘ও হেল্’ বলে মিস্টার ঘোষাল গাড়িতে উঠলো। সমস্ত দিনটাই আজ তার বাজে নষ্ট হলো। গাড়িতে ওঠবার মুখেই হঠাৎ একটা চিৎকার কানে গেল। হকাররা চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে—টেলিগ্রাফ—টেলিগ্রাফ
হকারটা কাছে আসতেই মিস্টার ঘোষাল একটা কাগজ কিনলে। দু’পয়সা দামের একস্ট্রা-অর্ডিনারি ইসু।
—গান্ধীজী গ্রেপ্তার—গান্ধীজী গ্রেপ্তার—
গাড়ির ভেতরে বসেই মিস্টার ঘোষাল পড়তে লাগলো—মহাত্মা গান্ধী, আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, মিসেস্ সরোজিনী নাইডু সবাই অ্যারেস্টেড। বোম্বাই থেকে স্পেশ্যাল ট্রেনে করে তাদের পূণায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রাইলি সার্ভড়। রাইলি সার্ভড্।
মিস্টার জিন্না স্টেটমেন্ট দিয়েছে—
deeply regret that the Congress has finally declared war and has launched a most dangerous mass movement in spite of numerous warnings and advice from various individuals, parties and organisations in this country.
.
পড়তে পড়তে মিস্টার ঘোষাল যেন এতক্ষণে একটু শান্ত হলো। সারাদিনের ব্যর্থতা আর অপমানের যেন প্রতিশোধ নিতে পেরেছে এতক্ষণে।
রাইলি সার্ভড্। রাইলি সার্ভড্—