কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৪
৩৪
অনেক রাত্রে ডি-এম-ও এলেন। ভারি অমায়িক ভদ্রলোক। দীপঙ্করই ডাকয়ে আনালে। বললে—আপনি যদি মিসেস্ ঘোষকে রিলিজ করে দেন তো আমি আজকেই এঁকে নিয়ে যেতে পারি—
রেলের হাসপাতাল। হাসপাতাল বটে, এ হাসপাতালের নিয়ম-কানুনও অন্য হাসপাতালেরই মত। তবু একটু যেন ঢিলে-ঢালা গতি। ডি-এম-ও তা জানেন! বললেন—আপনি নিয়ে যেতে পারেন মিস্টার সেন, আমার কোনও আপত্তি নেই—আমি রিলিজ করে দিচ্ছি—
সতী বললে—একলা সে বাড়িতে আমি কেমন করে থাকবো দীপু —
দীপঙ্কর বললে—না থাকতে পারো প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে শ্বশুর-বাড়িতে চলে এসো–সে পথ তো খোলাই রইল—
—সেখানে আর আমার যাওয়া চলে না দীপু!
—এখনও তোমার রাগ গেল না সতী! জানো সে বাড়ির কী অবস্থা! আজ সে বাড়িতে গেলে তুমিই চিনতে পারবে না আর। সেই বাগান নেই, সেই মালি নেই, সেই দারোয়ান নেই—সমস্ত বাড়িটার চেহারাই এখন বদলে গেছে। তুমি চলে আসবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রীও চলে গেছে।—আজ তোমার শাশুড়ী বুঝতে পেরেছে তুমিই ছিলে বাড়ির লক্ষ্মী—
সতী চুপ করে রইল। দীপঙ্কর বলতে লাগলো—আমি আজো ঠিক বুঝতে পারি নি কেন এমন হলো!
সত্যিই দীপঙ্কর সারাজীবন ধরে ভেবেছে কেন এমন হয়। কোন্ পথ ধরে চলেছে এই জীবন! কোন দিকে এর গতি! সেই ইতিহাসের আদিযুগ থেকে আজ পর্যন্ত কোন্ নিয়মে এর কাজ চলছে! সত্যিই যদি কোনও নিয়ম থাকবে তবে সে-নিয়মের নিয়ন্তা কে? আর নিয়মই যদি থাকবে একটা, তাহলে এত ব্যতিক্রমই বা হবে কেন! ইতিহাসে এক-একটা যুগ এসেছে, আর সব নিয়ম ভেঙে চুরে একাকার হয়ে গেছে একেবারে। একজন চৈতন্যদেব যা গড়ে, আর একজন শঙ্করাচার্য তা ভাঙে কেন? একজন বিসমার্ক যা তৈরি করে, আর একজন হিটলার তা ধ্বংস করে কেন! তাতে কার কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়?
সেদিন কিরণ এসে সেই কথাই বলেছিল।
হঠাৎ কিরণ আবার একদিন এসেছিল। সেই একদিন অনেক রাত্রে কিরণ এসে কী একটা প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিল, সে প্যাকেটটা ট্রাঙ্কের মধ্যেই পড়ে ছিল। তা খুলেও দেখেনি দীপঙ্কর। খুলে দেখবার আগ্রহ হলেও খুলে দেখেনি। তারপর তারই খোঁজে পুলিস এসেছিল বাড়িতে। ডিফেন্স-অব-ইন্ডিয়া য়্যাক্টে ধরতে এসেছিল কিরণকে। তারপর চলে গিয়েছিল, আর আসেনি।
সেদিন আবার চুপি চুপি এসে হাজির হয়েছিল কিরণ 1
প্রথমটায় অবাক হয়ে গিয়েছিল। কাশী বলেছিল—একজন সাহেব এসেছে দাদাবাবু।
—সাহেব? সাহেব আবার কে রে?
—হ্যাঁ দাদাবাবু, আপনার নাম করে ডাকছেন। ইংরিজি কথা আমি বুঝিনে।
তারপর নিজে নিচেয় নেমে যেতেই দেখে আর কেউ নয়, কিরণ! তাড়াতাড়ি কিরণকে নিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে এনে বসিয়েছিল সেদিন দীপঙ্কর।
—তুই কেমন আছিস?
মুখ দেখেই বুঝেছিল দীপঙ্কর ভালো নেই সে। বড় উদ্বিগ্ন, উস্কোখুস্কো চেহারা। সেই ফরসা লাল টকটকে রং আবার তামাটে হয়ে গেছে। আবার মুখে-চোখে অনিদ্রা আর অনাহারের ছাপ। দরজা বন্ধ করে দোতলার ঘরের ভেতর বসিয়েছিল কিরণকে। এ কিরণকে যেন চেনাই যাচ্ছিল না। এ যেন সেই কালিঘাট বয়েজ লাইব্রেরীর সেক্রেটারী আর নয়। এ যেন সেই ম্যাট্রিকে ফেল করা কিরণও আর নয়। সেই সেদিনকার রাস্তার ডাব কুড়িয়ে খাওয়া কিরণকে যেন এ-কিরণ আর চিনতেই পারবে না।
কিরণ বললে—অনেকের কাছেই গেলুম এ ক’দিন, কিন্তু কিছুই হলো না—
দীপঙ্কর একবার জিজ্ঞেস করলে—তোর সেই ভজুদা কোথায় রে? সেই বারোটা ল্যাঙ্গোয়েজ জানতো?
কিরণ বললে—কী জানি। কে যে সব কোথায় ছড়িয়ে আছে, বুঝতেই পারছি না। এ দেশে এসে আমাদের দলটাকে আবার গড়বার চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু সবাই বদলে গেছে ভাই, এখানে এসে সব দেখে শুনে তাজ্জব হয়ে গেছি—
—কেন? কী দেখলি?
—আমাদের দলে যারা ছিল আগে, তাদের মধ্যে অনেকেই বিট্রে করেছে। —বিট্রে করেছে? কাকে?
—কাকে আবার? নিজেকে, কান্ট্রিকে। সবাই নিজের নিজের লাভ-লোকসান নিয়ে মেতে আছে। এদিকে কংগ্রেসের মধ্যেও মতের মিল নেই, রাজাগোপালাচারী তো কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে মিনিস্টার হবার তালে আছে, আর কেউ-কেউ আবার এই সুযোগে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। কংগ্রেসের কী কান্ড জানিস?
দীপঙ্কর বললে—আমি কী করে জানবো?
—আরে তোরা যদি না জানিস তো জানবে কে? এই যে আজকে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ করছে গান্ধীজী, একমাস আগেই তো এটা করবার কথা ছিল, একমাস পেছিয়ে দিলে কেন, জানিস?
দীপঙ্কর কিছু কথা বললে না।
কিরণ বলতে লাগলো—বিড়লার সুবিধের জন্যে। শেয়ার মার্কেটে সব শেয়ারের দাম পড়ে গেল। কিন্তু যে তারিখে হবার কথা ছিল, তা হলো না, একমাস পিছিয়ে গেল। শেয়ারের দাম আবার হু-হু করে চড়ে গেল রাতারাতি। বিড়লা গোয়েঙ্কা আর মাহীন্দ্র কোম্পানী এই সুযোগে শেয়ারগুলো বেচে দিলে, তারপরে শেয়ারের দাম কমে যেতেই তারা আবার কিনে নিলে। কংগ্রেস তো মাড়োয়ারীদেরই সুবিধে করে দিলে এই করে। প্রায় তিনশো কোটি টাকা প্রফিট হয়ে গেল একমাসের মধ্যে! তা কাকে আর কী বলবো? কিরণ নিজের মনেই অনেক কথা বলে গেল। জার্মানীতে যখন ছিলুম, ভেবেছিলুম ইন্ডিয়ায় এখন খুব কাজ হচ্ছে। আর এই তো অপারচুনিটি। এ অপারচুনিটি কেউ নিলে না দেখে এত কষ্ট হচ্ছে মনে—
তারপর হঠাৎ বললে-দে, আমার জিনিসটা দে, আমি চলে যাই—
—কোথায় যাবি এত রাত্রে?
কিরণ বলেছিল—রাত্রেই তো আমার সুবিধে। বড় পেছনে লেগেছে পুলিস। এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে দিচ্ছে না আমাকে। কোনও কাজ হচ্ছে না, শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে ভাই বসে বসে, তাই মনে বড় কষ্ট হচ্ছে। এতদিন এখানে এসেছি অথচ কিছুই কাজ করতে পারলুম না। জানিস তো সুভাষ বোস জার্মানীতে?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে—সত্যি কথা? অনেকে বলছে বটে, কিন্তু বিশ্বাস করিনি—
—একটা খাঁটি মানুষ দেখলাম। পাগল একেবারে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একঘন্টার জন্যে। সুভাষ বোসই তো আমার এখানে আসার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। হিটলারও খুব সাহায্য করবে বলছে। শেষে যদি হিটলারও কিছু না করে তো অন্য কারও সাহায্য নিতে হবে। জাপানে যাবারও কথা আছে। দেখা যাক। তাই তো বলছিলুম এ অপারচুনিটি কেউ নিলে না দেখে বড় দুঃখ হচ্ছে ভাই—
কিরণের কথাগুলো শুনে দীপঙ্করের মনে হচ্ছিল—কিরণের মনের ভেতরটা যেন কিছু করবার জন্যে ছটফট করছে। যা হোক একটা কিছু করতেই হবে। এ সময়ে জেলে গিয়ে কিছু লাভ হবে না। জেলে গিয়ে নাম-কেনা ছাড়া আর কিছু হবে না। আরে, ওয়ার তো পৃথিবীতে রোজ-রোজ হয় না!
দীপঙ্করের আজও মনে আছে সেই রাতটার কথা। সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে বসে কিরণ যখন কথা বলছিল মনে হচ্ছিল যেন দীপঙ্কর হেরে গেছে তার কাছে। বড় দুঃখ হয়েছিল মনে। বড় অনুতাপ হয়েছিল। কোথায় সেই বার্লিন, আর কোথায় এই কলকাতা। কোথায় সেই জাপান, আর কোথায় এই স্টেশন রোড। সেই ক’দিন ইন্ডিয়ার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়িয়েছে কিরণ। কতদিন খাওয়া হয়নি, কতদিন ধরা পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেছে। কতদিন অনাহারে অনিদ্রায় কেটেছে। কাছে টাকা নেই, পেটে ভাত নেই। আপনারা কিছু করুন, কিছু করুন আপনারা। হিটলার আমাদের সাইডে আছে, মুসোলিনী আমাদের সাইডে আছে, টোজোও আমাদের সাইডে। এ ওয়ারে হিটলার জিতবেই, এই আমি আপনাদের বলে দিচ্ছি। আপনারা কমিউনিস্টই হোন, আর মুসলিম লীগই হোন, কিম্বা হিন্দু মহাসভার লোক হোন—কিছু করুন। পার্টির কথা না ভেবে, সুভাষ বোসের মত দয়া করে দেশের কথা ভাবুন! চার্চিল থাকতে স্বাধীনতা আপনারা পাবেন না। আমেরী থাকতেও পাবেন না। কেউ স্বাধীনতা কাউকে দেয় না—স্বাধীনতা জোর করে কেড়ে নিতে হয়। দেখুন, আমি বেশি লেখাপড়া শিখিনি। আমি ম্যাট্রিক ফেল, আমি পয়সার জন্যে লেখাপড়া চালাতে পারিনি। আমার বাবা কুষ্ঠ রোগে মারা গেছে। বাবার সেবা করিনি। মা এখনও খেতে পায় কিনা, বেঁচে আছে কিনা, তার খবরও রাখি না। আমি বার্লিন থেকে এসেছি আপনাদের পায়ে ধরতে। আপনারা কিছু করুন।
বলতে বলতে গলা বুজে এসেছিল কিরণের। শেষকালে প্যাকেটটা নিলে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—এটা কী রে?
কিরণ বললে—ওয়্যারলেস্ সেট—জার্মান গভর্নমেন্ট দিয়েছে আমাদের—এবার যাই, আবার কবে দেখা হবে জানি না ভাই—
দীপঙ্কর বললে—আমি তো তোর কিছুই করতে পারলুম না—
কিরণ বললে—তোর দ্বারা কিছুই হবে না আমি জানতুম, তুই ওই চাকরি করবি আর সংসার করবি কেবল—মানুষের জীবনে টাকা উপায় করা আর সংসার করাটা বড় জিনিস নয়—এটা তুই জেনে রাখিস
—তবু তুই কিছু টাকা নে!
—টাকা? টাকারই তো ভীষণ দরকার রে আমার। টাকা দিবি, দে না। যত দিবি তত নেব—
দীপঙ্কর উঠলো। কিরণ বলতে লাগলো—আমি এখানে এসে সব দেখে অবাক হয়ে গেলুম, সবাই দু’হাতে টাকা লুটতে শুরু করেছে ভাই। দেশের কাজেও টাকা, ঠাকুরের মন্দির করে দিয়েও টাকা। টাকা উপায়ের জন্যেই যেন সবাই বেঁচে আছে। এ রকম তো ছিল না ভাই আগে। এই ক’বছরই যা এখানে ছিলাম না, কিন্তু আগে তো ছিলাম। তখন তো এমন ছিল না। তখন তো আমাদের লোকে চাঁদা দিয়েছে কোনও উদ্দেশ্য না নিয়েই। আমাদের গরীব দেখে কত লোক চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেছে, কিন্তু প্রফিটের কথা তো তারা ভাবেনি। এখন দেখছি জেল খাটতে গিয়েও লোকে আগে মনিটারি বেনিফিটের কথাটা ভাবে। টাকা দিয়ে। প্যাট্রিঅটিজম্-এর বিচার হয়। আশ্চর্য, যে সি- আর-দাশ কংগ্রেস গড়লে, আর একজন তাকে ভাঙতেই কত কষ্ট করছে—
তাড়াতাড়ি বাক্সর মধ্যে হাত পুরে দিয়ে দীপঙ্কর যে ক’টা টাকা পেলে, সব তুলে দিলে কিরণের হাতে। একবার গুণেও দেখলে না। কিরণও টাকাগুলো নিয়ে পকেটে পুরে ফেললে। কত টাকা, কীসের টাকা তাও জিজ্ঞেস করলে না।
দীপঙ্কর বললে—তোর মা’র জন্যে ভাবিসনি তুই, আমি আছি—
—আমি যাই—।
কিরণ চলে যাচ্ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর-দরজা পর্যন্ত এসে এবার থমকে দাঁড়াল। তারপর বাইরে দু’দিকে এবার দেখে নিয়ে ঘাড়ের দিকে কোটের কলারটা উঁচু করে দিলে। দীপঙ্কর বললে—তোর জন্যে খুব ভয় করে ভাই, একটু সাবধানে থাকিস্
তারপর অন্ধকার ব্ল্যাক-আউটের মধ্যে সেদিন মিলিয়ে গিয়েছিল কিরণ। আর আসেনি।