কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৬
৩৬
মা-মণি তখনও অপেক্ষা করছিলেন নিজের ঘরে। যদি খোকা বৌমাকে নিয়ে এখানেই এসে ওঠে তো তাঁরই একদিন কি ছেলেরই একদিন। নিজের মা কেউ হলো না, যত আপনার জন হলো কিনা বউ। লাথি মেরে অমন বউ-এর দেমাক ভেঙে দেবেন না তিনি। ন’দিদি ঠিকই বলেছিল—আদর দিয়েই তিনি মাথা খারাপ করে দিয়েছেন বউ-এর। আমরাও তো একদিন বউ ছিলাম। আমরাও তো একদিন নতুন-বউ সেজে শ্বশুর- ঘর করতে এসেছিলুম। কই, বলুক দিকি কেউ, শাশুড়ীর সামনে কখনও মুখ তুলে কথা বলেছি। একদিনের তরে কখনও দিনের বেলা বরের মুখে মুখ দিয়ে দরজায় হুড়কো দিয়ে শুয়েছি? কর্তা একদিন বলেছিলেন—একটা পান নিয়ে যেও তো বউ খাবার পরে সে-পান তিনি চাকরের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তবু দিনের বেলা মুখ দেখাননি কর্তাকে। এই তো এত বাড়ি রয়েছে ভবানীপুরে। এই চাউলপট্টির চাটুজ্জেরা রয়েছে, চরকডাঙার মিত্তিররা রয়েছে। তাঁদের বাড়ির ভেতরে গিয়ে মা-মণি দেখেছেন—আহা, কেমন লক্ষ্মী বউ সব। ভেতর-বাড়ির গেলে শাশুড়ী একে একে ডাকেন সব বউদের। সবাই এসে সামনে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ায়। শাশুড়ী বলে—মাসীমাকে প্রণাম করো বউমা—
শাশুড়ীর মুখ থেকে কথা থামতে-না-থামতে বউরা সব পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে।
তারা বলে—দিদি, তোমার বউ পোয়াতি হলো নাকি আবার?
কী সব সুখের সংসার। দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। নাতি-পুতি হয়ে ঘর ভরে গেছে। যেমন পোড়াকপাল তাঁর! বউ আসবার পর থেকেই যেন অলক্ষ্মী এসে ঢুকেছে তাঁর সংসারে। গেল বছর বোমার ভয়ে সবাই চলে গিয়েছিল কলকাতা ছেড়ে। চাউলপট্টির ওরা গিয়েছিল মধুপুরে। চড়কডাঙার মিত্তিররা গিয়েছিল গিরিডিতে। ন’দিদিও গিয়েছিল ঘাটশিলায়। যাবার আগে পই-পই করে বলেছিল—চল নয়ন, চল তুই আমাদের সঙ্গে—কার জন্যে সংসার আগলে রয়েছিস তুই?
—কার জন্যে আবার ন’দিদি, সোনার জন্যে!
—তা সোনার বিয়ে দিয়েছিস্, বউ এসেচে, এখনও তুই তাদের দেখবি? চিরকালটা কি সংসার নিয়েই কেবল থাকবি তুই?
মা-মণি বলেছিল—ছেলে যে আমার কাঁটা ন’দিদি! লোকের মেয়ে-কাঁটা হয়, আমার ছেলে-কাঁটা।
ন’দিদি বলেছিল—সে ছেলের কথা তোর বউ বুঝবে! তুই কেন জড়িয়ে আছিস শুনি? তোর কীসের টান? ধাড়ি ছেলে হলো, এখনও নিজের জিনিস নিজে বুঝে নিতে শিখলে না?
তারপর একটু থেমে ন’দিদি বলেছিল-তা তোর ছেলে-বউই বা আবার এখানে থাকবে কোন্ সুখে? বাড়ি-ঘর-দোর সব চাবি দিয়ে চল্—
মা-মণি বলেছিল—এই এতগুলো বাড়ি, এতগুলো ভাড়াটে, আমি চলে গেলে কি চলে ন’দিদি?
—তা তোর সরকারবাবু আছে কী করতে? আমারও তো বাড়ি রয়েছে, ভাড়াটে রয়েছে—বাড়ি গেলে বাড়ি আসবে বাছা, কিন্তু প্রাণ গেলে কি আর আসবে?
তারপর সতীর ঘরে গিয়ে সতীকে ডেকে ন’দিদি বলেছিল—হ্যাঁগা বৌমা, তোমার এই বুড়ী শাশুড়ী, তার দিকে তোমরা একটু দেখ না বাছা? তুমিও তো একদিন শাশুড়ী হবে, তখন আবার তোমার বেটার-বউ এলে এই হেনস্তা করবে তো? সে-সব কথা একবার মনে পড়ে না তোমাদের বাছা, কী আর বলবো!
সতী কিছুই উত্তর দেয়নি তখন।
ন’দিদি বলেছিল—অনেক তপস্যা করলে লোকে এমন শাশুড়ী পায় বাছা, এইটে জেনে রেখো। এখন বুঝছো না তো, দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য কেউ বোঝে না। বাসি হলে তখন আমার কথাটা বুঝবে।
সেই ন’দিদিরাই এতদিন কলকাতায় ছিল না। এতদিন পরে আবার ফিরে এসেছে। চাউলপট্টির চাটুজ্জে-গিন্নীরা, চড়কডাঙার মিত্তির-গিন্নীরাও আবার ফিরে এসেছে। এ-সব কথা চাপা থাকে না কখনও। কোথা থেকে কোন্ কান দিয়ে যে কোন্ কানে উঠলো, তাও কেউ বলতে পারে না। মা-মণি কারোর বাড়ি যেতেন না। সকলের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিলেন। কিন্তু লোকে তবু শুনবে কেন? চাটুজ্জে-গিন্নী একদিন এসে খুব মায়া- কান্না কেঁদে গেল। বললে—আহা, শুনলুম সব দিদি, শুনে পর্যন্ত মুখে আমার আর ভাত রোচে না, তাই বলছিলুম আমার বেয়ানকে, বলছিলুম, দিদির মত শাশুড়ী পেয়ে যে-বউ ঘর করতে পারলে না, তার কপালে অনেক দুঃখ আছে ভাই—
তারপরেই ঠিক আসল কথাটা বেরোল। মুখ নিচু করে বললে—তা বউ গেল কোথায়, খোঁজ-খবর কিছু পেয়েছ দিদি?
ঘোষ-গিন্নী কিছুই বললেন না।
চাটুজ্জে-গিন্নী নিজেই বললে—তা তুমি বা জানবে কেমন করে দিদি? ভাতারকে যাদের মনে ধরে না, তারা কি আর বলে কয়ে যায়?
তারপর নিজেই আবার চাটুজ্জে-গিন্নী বললে—শুনলুম নাকি ফিরিঙ্গীদের আপিসে চাকরি নিয়েছে? আমার তো বিশ্বাস হলো না দিদি! চাকরি করতে যাবে কোন্ দুঃখে তুমিই বলো না! সেই কথায় আছে না, বাড়ির বউ ঘর-ভাঙানি—এ তাই, নির্ঘাত তাই— তোমার ছেলেকে একটু চোখে-চোখে রেখো দিদি-। আজকালকার ছেলে, কিছু বলা যায় না। আমার মা বলতো-জা-জাউলী আপনাউলী ননদ-মাগী পর, শাশুড়ী-মাগী গেলে পরে হবো স্বতন্তর—এও হয়তো তাই দিদি—
চড়কডাঙার মিত্তির-গিন্নীও একদিন এসেছিল। সাধারণত এত আসা-যাওয়া নেই এ-বাড়িতে। ঘোষ-গিন্নী নিজেই কারো বাড়িতে যান না। কিন্তু গরজ বড় বালাই। মিত্তির-গিন্নী এ-কথা সে-কথার পর আসল কথাটাই পাড়লে। বললে—বউকে দেখছিলেন যে দিদি—বাপের বাড়ি গেছে বুঝি!
ঘোষ-গিন্নী বললেন—হ্যাঁ—
—তা এই সময়ে যে বাপের বাড়ি পাঠালে? পোয়াতি বুঝি?
এমন অনেক আজে-বাজে কথা সব। শেষকালে কোনও ভাবেই কথা আদায় করতে না পেয়ে মিত্তির-গিন্নী চলে গেল। কিন্তু ন’দিদি ঘাটশিলা থেকে এসেই একেবারে দৌড়ে এসেছে। বললে—হ্যাঁরে নয়ন, যা শুনছি, সত্যি?
মা-মণি বললে—হ্যাঁ সত্যি! কে বললে তোমাকে?
—এসব কি চাপা থাকে রে? ঢি-ঢি পড়ে গেছে যে কলকাতায়।
—কিন্তু কে ছড়ালে বলো তো?
ন’দিদি বললে—তার লোকের কি অভাব আছে সংসারে? এসব খবর চাপা রাখবিই বা তুই কেমন করে? কিন্তু কেন এমন হলো! তোর একটা বউকে তুই টিট্ করতে পারলি না? আমার পাঁচ-পাঁচটা বউ ঘরে, একটু টু শব্দ করুক তো! মুখে ঝামা ঘষে দেব না? তা গেছে কোথায়? বাবার কাছে?
নয়ন বললে—আমারই ভুল হয়েছিল ন’দিদি! আমিই আদর দিয়ে বউকে মাথায় তুলেছিলুম—
—সে যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন বেয়াই মশাইকে চিঠি লিখেছিস?
নয়ন বললে—ও চামারদের নাম আর মুখে আনতে চাই না ন’দিদি! ও-বউ আমার চুলোয় যাক, জাহান্নামে যাক, আমি দেখতেও যাচ্ছিনে তা, শুনতেও যাচ্ছিনে—
—তোর ছেলে কী বলে?
—সোনার কথা ছেড়ে দাও ন’দিদি। সোনাকে আমার চেনো না তুমি!
ন’দিদি বললে—তোর সোনাকে একবার আমার কাছে ডাক দিকি, আমি কথা বলি তার সঙ্গে। এ কী কথা। বাড়ির বউ বেরিয়ে যাবে!
নয়ন বললে—তোমার কাছেই তাহলে বলি ন’দিদি, বউ বাপের কাছেও যায়নি, অন্য কারোর কাছেই যায়নি, গেছে চাকরি করতে—
ন’দিদি কথাটা শুনে গালে হাত দিলে। বললে—তুই যে অবাক করলি নয়ন, ঘোষ- বাড়ির বউ চাকরি করছে?
—তবে আর বলি কি ন’দিদি। আমি লজ্জায় কোথাও বেরোতে পারিনে। ভবানীপুরে আমার মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে গেছে সেই থেকে।
—তা চাকরি না-হয় করছে, কিন্তু রাত কাটায় কোথায়?
নয়ন বললে—সেও আবার তোমায় খুলে বলতে হবে ন’দিদি? সাধ করে কি আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি! আমি শুনেছি তুমি ফিরে এসেছো! কিন্তু কোন্ মুখে যাই তোমার কাছে বলো তো? আমার যে নিজের গালেই চড় মারতে ইচ্ছে করছে নিজের—
—না, না, এমন বেবুঝ হলে তো চলবে না। তোর ছেলেকে ডাক্!
ছেলেকে আর ডেকে কী করবো ন’দিদি! ছেলে বলে সেই বউকে আবার বাড়িতে এনে তুলবে!
ন’দিদি বললে—খবরদার, খবরদার, অমন কাজ করিসনি নয়ন, অমন কাজও করিসনি! বার-মুখো বউকে ঘরে ঠাঁই দিসনি—তার চেয়ে ছেলের তোর আবার বিয়ে দে, আমি তোকে ভাল মেয়ে এনে দেব —
নয়ন বললে—সেবার ব্যারিস্টারের কথায় এক বিয়ে দিয়ে ঠকেছি, আবার ঠকবো নাকি ন’দিদি—
—ঠকবি কেন? বেয়াই বাজিয়ে নিবি, বাপের এক সন্তান হওয়া চাই, দেবে থোবে ভাল, তবে না বিয়ে দেব ছেলের—আমার পাঁচ ছেলের বিয়ে তো আমি দিয়েছি, একটাও ঠকেছি বলতে পারে কেউ?
তারপর আর কথা না বাড়িয়ে ন’দিদি বললে—ডাক তোর ছেলেকে, কোথায় সে? পড়ছে? কী ছাই-ভস্ম পড়ে তোর ছেলে দিনরাত শুনি? ওই বই পড়াই কাল হয়েছে তোর ছেলের। বেটাছেলে অত পড়াশুনো কেন রে? এবার এমন বউ করে দেব তোর ছেলের, দেখবি বউ-এর মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকবে দিনরাত—
—তা সেটাই কি ভাল ন’দিদি?
—ভালো নয়? তুই বলছিস কী? আমার ছেলেদের দেখিসনি? মা-অন্ত প্রাণ সব, দিনরাত মা তুমি কী খাবে, মা তুমি কী পরবে—কেউ বলতে পারে আমার ছেলেরা মাগ- মুখো? তোর ছেলে কোথায়?
নয়ন বললে—ছেলে তো সেখানেই গেছে—
—কোথায়?
নয়ন বললে—আবার কোথায়? বউ-এর কাছে। আমাকে বলে গেছে, আজ বউকে বাড়িতে এনে তুলবে। তা আমিও বলেছি, বউ যদি তুই আনিস তো তোরই একদিন কি আমারই একদিন!
—কখন আসবে?
নয়ন বললে—সেই তো বেলা এগারোটায় গেছে, এখনও পর্যন্ত দেখা নেই— চাকরটা হয়েছে আবার তার সোহাগের—সেও সঙ্গে গেছে—
—খাওয়া হয়নি এখনও?
নয়ন বললে—কে জানে! ছেলের সঙ্গে আমার কথা বলতেও মন সরে না। অমন ছেলের মুখ দেখলেও পাপ ন’দিদি—আমার ছেলে যদি আমার বশ হতো তো আমার ভাবনা। ছেলে বশে নেই বলেই তো বউ অত জো পেয়েছে। তোমায় আমি কী বলবো ন’দিদি, আমার কত টাকা যে কতদিকে নয়-ছয় হয়ে গেল, সেসব ওই ছেলের জন্যে —
—কেন, ছেলে টাকা ওড়ায় নাকি?
—ছেলের যদি ওড়াবার প্রবৃত্তি হতো তো তা-ও বুঝতুম! এ নয়-ছয় হয়ে গেল ন’দিদি! দশ জনে লুটে পুটে খেলে!
—কী রকম?
আশ্চর্য! হয়ত কথাগুলো বলবার জন্যেই একজন শ্রোতা খুঁজছিলেন নয়নরঞ্জিনী দাসী। যে-হোক কেউ! কাউকে না-বলতে পেরে যেন অসহায় বোধ করছিলেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনহীন অবস্থায় গিরীশ ঘোষের বিধবা স্ত্রী সেদিন বড় অপারগ হয়েই সব বলে ফেললেন। যেন এতদিনের সব কথা বলতে পেরে খানিকটা হাল্কা হতে পারলেন। খানিকটা স্বস্তি।
—তা মামলা কর! পুলিসে খবর দে!
নয়ন বললে—সব হচ্ছে ন’দিদি! আমি একলা মেয়েমানুষ, আমি নিজে যা করতে পারি, করছি। আমার যে কেউ নেই, একলাই যে আমাকে সব করতে হচ্ছে। একলা ছাড়া দোকলা পাবোই বা কোত্থেকে। কে আমার আছে? আমার ছেলে নেই, আমার বউ নেই, আমার টাকা ছিল, সম্পত্তি ছিল, তাও আজ নেই—কর্তা আমায় এ কী অবস্থায় ফেলে গেছেন, সংসার আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে, একলা চলে গেছেন—
ন’দিদি অনেকক্ষণ ধরে সান্ত্বনা দিলেন। দুজনে ছোটবেলা থেকে এক পরিবারে মানুষ। দুজনেই পরস্পরের দুঃখে সুখে চিরকাল দুজনকে দেখে এসেছে। ন’দিদি বললে—আচ্ছা, দেখি, তোর ছেলে আসুক, তোর ছেলের সঙ্গে কথা বলে তবে আমি আজ যাবো—
হঠাৎ মা-মণি বলেন—ওই গাড়ির আওয়াজ হলো—ওই এসেছে—
তারপর ডাকলেন—কৈলাস, কৈলাস—
কৈলাস আসতেই বললেন—যদি কেউ আসে তো ঢুকতে দিবিনে বাড়িতে—
ন’দিদি বললে—কেন রে? সোনা এলে ঢুকতে দেবে না? তুই বলছিস কী? তাহলে বউ নিয়ে যাবে ও কোথায়?
নয়ন বললে—না, ও-বউকে নিয়ে এলে এখানে ঠাঁই হবে না, তা সে ছেলেই হোক আর যেই হোক—
কিন্তু কৈলাস খানিক পরেই ফিরে এল। বললে— আজ্ঞে না মা-মণি, ও দাদাবাবু নয়, সাহেবপানা অন্য একজন লোক
—কে সাহেবপানা লোক? উকীলবাবু?
কৈলাস বললে—না, উকীলবাবুকে তো আমি চিনি, এ অন্য লোক, ঘোষালবাবু না কী যেন নাম বললে, আমি তাড়িয়ে দিয়েছি—বলেছি এখন কেউ নেই, দেখা হবে না—
মা-মণি বললেন—বেশ করেছিস—
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সনাতনবাবু যখন এলেন তখন সন্ধ্যে উতরে গেছে। ন’দিদির গাড়ি তখনও বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে। কৈলাস গাড়ির আওয়াজ পেয়েই সদর-গেটের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ট্যাক্সিটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। শম্ভু সামনে বসে ছিল। আর ভেতরের সীটে সনাতনবাবু হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন।
ওপর থেকে মা-মণি তখন ডাকছেন—কৈলাস, কৈলাস—
কৈলাস তিন লাফে দৌড়ে গিয়ে হাজির হয়েছে মা-মণির কাছে।
—কে এল রে? বৌদিমণিকে নিয়ে এসেছে দাদাবাবু?
ন’দিদিও সব শুনছিল। বললে—তুই একটু মাথা ঠান্ডা কর নয়ন, হুট্ করে একটা কিছু করে ফেলিস নে—ছেলে বলে কথা, পেটের ছেলেকে অত অচ্ছেদ্দা করতে নেই—
মা-মণি বললেন—না, খবরদার বলছি না! ও বউ-এর আমি মুখ দেখবো না—ও হতভাগী যেখানে ছিল, সেখানেই গিয়ে উঠুক, আমি ছেলের নতুন করে আবার বিয়ে দেব—
ন’দিদি বললে—তা বিয়ে দিস না, কে তোকে বারণ করেছে? কিন্তু তোর পেটের ছেলেকে তো বাড়িতে ঢুকতে দিবি-নইলে শেষকালে যে ছেলে-বউ দুকূল যাবে তোর—
ন’দিদি ঠান্ডা মাথার লোক। কথাটা শুনে শান্ত হলেন মা-মণি।
কৈলাস বললে–বৌদিমণি আসেনি মা-মণি-দাদাবাবু একলা এসেছে—দাদাবাবুর গা দিয়ে রক্ত পড়ছে—
—রক্ত?
ন’দিদি, মা-মণি দুজনেই চমকে উঠলেন। কৈলাস বললে—শম্ভু আছে সঙ্গে, সে বললে মিলিটারি গাড়ির ধাক্কা লেগেছিল রাস্তায়—
সেদিন যখন সনাতনবাবুকে ট্যাক্সি থেকে নামানো হলো, তখনও তিনি বেশ সচেতন। এমন কিছু লাগেনি। সনাতনবাবু বললেন—মিলিটারি লরীর কিছু দোষ ছিল না মা-মণি, আমাদের ট্যাক্সিটারই দোষ ছিল—
ন’দিদি বললে—তুমি চুপ করো বাবা, তুমি এখন কথা বলো না। ডাক্তারকে খবর দিতে বল্ নয়ন—
ন’দিদি ছিল সেদিন, তাই বেশ সামলে নিলে অবস্থাটা। শম্ভুরও লেগেছিল বেশ। তবে সনাতনবাবুর মত নয়। শম্ভু বললে— ধাক্কাটা পেছন দিকে লেগেছিল কিনা, তাই দাদাবাবুরই বেশিটা লেগেছে—
ন’দিদি বললে—কী সব্বনাশ হতো বলো দিকিনি, ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন, পোড়ারমুখো গাড়িগুলোর যে কী হয়েছে, দিনরাত রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মরে কেবল—
শম্ভু ছিল বলে তাই রক্ষে। শম্ভুই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তারা ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দিয়েছে। তারপর আর-একটা ট্যাক্সি করে এখানে এসেছে। একে সারাদিন খাওয়া নেই, তারপর এই অপঘাত—সনাতনবাবুকে বড় কাতর দেখাচ্ছিল। ধরে ধরে সবাই তুললে ওপরে। বিছানায় শুইয়ে রাখা হলো। সনাতনবাবু চারিদিকে চেয়ে দেখছিলেন—বললেন—আমার কিচ্ছু হয়নি মা-মণি, তোমরা কিছু ভেবো না—
ন’দিদি বললে—তা বললে কি হয় বাছা, মায়ের প্রাণ কি তাই বললে মানতে চায়? সনাতনবাবু বললেন—মাসীমা, আপনি বাড়ি যান, আমি বলছি, আমার কিছু হয়নি, আমার এই হাতটায় শুধু একটু ব্যথা করছে, এ সেরে যাবে, আপনি বাড়ি যান্
ন’দিদি নয়নকে আড়ালে ডাকলে। ফিস ফিস করে বললে—ছেলেকে যেন এখন কিছু বলিসনে নয়ন-তোকে যা বললুম, তাই করিস—
—কিন্তু ও-বউকে আমি এ-বাড়িতে প্রাণ থাকতে ঢুকতে দেব না, তা আমি বলে রাখছি ন’দিদি—
—সে যখন বউ আসবে, তখন দেখা যাবে! তা সে-বউ এখন কোথায়?
নয়ন বললে—কে জানে ন’দিদি, সে-খোঁজ রাখতে আমার তো ভারি বয়ে গেছে—
ন’দিদি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলে না। তারও বেটা আছে, বেটার বউ আছে। গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল ন’দিদি।