Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ২ – বিমল মিত্র

    বিমল মিত্র এক পাতা গল্প950 Mins Read0

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৭

    ৩৭

    সমস্ত দিনই খাটুনি গেছে লক্ষ্মীদির। কাজও তো আর কম নয়। সমস্ত সংসারটা উঠিয়ে দিল্লি নিয়ে যাওয়া। দাতারবাবুকে দিয়ে কিছুই হবার নয়। সব লক্ষ্মীদিকে একলাই করতে হয়েছে। সুধাংশুরও সময় নেই। সুধাংশু আপিস থেকে টেলিফোন করে অর্ধেক কাজ সেরেছে। ভারি ভারি মালগুলো সব গুডস্-ট্রেনে যাবে। খাট, আলমারি, টেবল, চেয়ার, ফার্নিচারই কি কম তৈরি করিয়েছিল লক্ষ্মীদি এই ক’ বছরে। আর শুধু ওই ফার্নিচারই বা কেন? যে-লক্ষ্মীদির কিছুই ছিল না, একটা ভাঙা তক্তপোশ নিয়ে এই বাড়িতে এসে উঠেছির ানন্তর সঙ্গে, সেই লক্ষ্মীদিরই ফার্নিচারের স্টক আজ গুনে শেষ করা যায় না। দিনে দিনে শুধু অর্থই জমেনি, পরমার্থও জমেছে লক্ষ্মীদির। সমাজে লক্ষ্মীদির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আজকের কলকাতার উঠতি-সমাজে লক্ষ্মীদির নাম বললে সবাই চিনতে পারে। আজকে লক্ষ্মীদির ব্যাঙ্কার লক্ষ্মীদিকে ওভারড্রাফট দিতে পারলে কৃতার্থ হয়ে যায়। অথচ এই কিছু দিন আগেও একখানা শাড়ি সাবান দিয়ে কেচে শুকিয়ে নিয়ে বাইরের বেরোতে হয়েছে। ওই একখানা শাড়িই যেদিন সম্বল, সেদিন একা একা চৌরঙ্গীতে দাঁড়িয়ে নিজের ফিগারটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাতে হয়েছে। সেদিনের কথা কেউ জানে না। সেটা না জানাই ভালো। সেদিনকার সব অপবাদ আজ টাকার জলুসে ঢাকা পড়ে গেছে।

    জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে লক্ষ্মীদির সব কথা মনে পড়ে গেল।

    হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠলো। লক্ষ্মীদি বললে—মিসেস দাতার স্পীকিং—ও, খবর মিস্টার হাজ?

    —ওপাশ থেকে উত্তর এল-শুনলাম আপনি দিল্লি চলে যাচ্ছেন? গোয়িং টু দেলি—?

    —হ্যাঁ, সুধাংশু ছাড়ছে না। ঘুরে আসি দিনকতক! আপনার খবর কী? আজ বিকেলে আসবেন নাকি? আসুন না। অনেকদিন এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া হয়নি। সব তো প্যাক করা হয়ে গেছে—তবু আজকের জন্যে কিছু স্টক্ বাইরে রেখেছি—আসুন, প্লীজ্ ডু কাম্‌—

    তারপর একটু থেমে বললে—আপনার সেই সিগ্রেটের কী হলো মিস্টার হাজ আপনি থাকতে কী উপোস করে মরবো বলতে চান?

    —সিগ্রেট চাই তা আগে বলেন নি কেন? কোন্ ব্র্যান্ড?

    —বিলিতি সিগ্রেট, যে-কোনও ব্র্যান্ড। দিশি সিগ্রেট টেনে টেনে যে থ্রোট্-ক্যানসার হবার যোগাড়।

    সত্যিই, কোনও বিলিতি জিনিসই আর পাওয়া যাচ্ছে না তখন। লক্ষ্মীদিদের বড় কষ্ট হচ্ছে তখন। একে-ওকে ধরে খোশামোদ করে আদায় করতে হয়। মিস্টার হাজ কথা দিলে। তারপর একটা টেলিফোনের পর আর একটা টেলিফোন্। মিস্টার মাধো, মিস্টার লালচাঁদ, মিস্টার সিং।

    হো হো করে হেসে গড়িয়ে পড়লো লক্ষ্মীদি। বললে—কী যে বলেন মিস্টার সিং, আমি গরীব লোক, আমি কি আপনাকে ইন্টারটেন করতে পারবো? আমার কি এত সৌভাগ্য হবে?

    সব জাগয়াতেই খবর চলে গেছে যে, মিসেস দাতার কলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে যাচ্ছে। সব জায়গাতেই সাড়া পড়ে গেছে। মিসেস দাতার কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া মানে কলকাতা কানা হয়ে যাওয়া। তারপরেই হঠাৎ দীপঙ্করের কথা মনে পড়লো। দীপঙ্করকে টেলিফোন করার মাঝখানেই মিস্টার দাতার এসে কাছে দাঁড়ালো। বললে— শুনছো লক্ষ্মী?

    লক্ষ্মীদি তখন টেলিফোনে কথা বলতেই ব্যস্ত। বললে—আঃ, একটু চুপ করো না তুমি—

    দাতারবাবু একটু থেমে বললে—দেখো, মানস দুধ খাচ্ছে না—

    —তা মানস দুধ খাচ্ছে না, তাও কি আমাকে দেখতে হবে? তুমি কী করছো? কেশব কোথায়? কেশবকে বলতে পারছো না? দেখছো আমি একটা কাজ করছি—

    তারপর টেলিফোনটা ছেড়ে দিয়ে এসে ইজি-চেয়ারটায় হেলান দিয়ে পড়লো। বললে—নিজে তো একটা কাজ করতে পারবে না, অন্য লোককেও কাজ করতে দেবে না তুমি। কই? মানস কোথায়? দাও, আমি দুধ খাইয়ে দিচ্ছি—। কজের সময় একটু সাহায্য করবে কোথায়, তা না, কানের কাছে কেবল ঘ্যান্ ঘ্যান্ করতে আরম্ভ করেছো—।

    দাতারবাবু বললে—মানস চলে গেছে—রঘুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে লেকে—

    —দুধ না খেয়েই গেল? কেন যেতে দিলে?

    দাতারবাবু বললে—না, দুধ খেয়ে গেছে—আমি নিজেই খাইয়ে দিয়েছি—

    —তা হলে তো তুমি ইচ্ছে করলেই পারো সব, শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত করা। দেখছো কত দিকে তাল সামলাতে হচ্ছে আমাকে একলা। সন্ধ্যেবেলা মিস্টার হাজ আসছে, মিস্টার মাধো, মিস্টার লালচাঁদ, সবাই আসছে, এই সময়ে তুমি আমাকে বিরক্ত করছো। ওদিকে দীপঙ্কর এখুনি টেলিফোন করছিল—বাবা নাকি নেই —

    দাতারবাবু বললে—সে তো দীপুবাবু সেদিন এসে বলে গেল—

    —তা কই, তুমি তো আমাকে বলো নি?

    দাতারবাবু বললে—ভুলে গিয়েছিলাম বলতে। তুমি তখন ঘুমোচ্ছিলে। তারপর তোমারও তো এ ক’দিন শোনবার সময় ছিল না, কাজে ব্যস্ত ছিলে তুমি, আর আমিও ভুলে গিয়েছিলাম—

    —তা তো ভুলে যাবেই। কোন্ কাজটা তোমাকে দিয়ে হবে? বাবার টাকাগুলোর কথা ভাবতে হবে না? বাবার কি কম টাকা আছে ব্যাঙ্কে? দীপুকে তো তাই বলছিলুম। বর্মার টাকা, সে না-হয় জাপানীরা যা করে করবে, কিন্তু ইন্ডিয়ার ব্যাঙ্কে যদি কিছু থাকে তো তার তো ওয়ারিশন্ আমরা, আমি আর সতী—দুজনে—। সে-সব কথা ভাবতে হবে না?

    সত্যিই, কত লাখ টাকা বাবার আছে কে জানে। একদিন ভুবনেশ্বর মিত্র ভেবেছিলেন মৃত্যুর আগে জামাইদের সব দিয়ে যাবেন। মনের মত জামাই করবেন। তারাই তাঁর কারবার দেখবে। কিন্তু কোনও আশাই পূর্ণ হলো না তাঁর। যখন রেঙ্গুনে বোমা পড়লো তখনই তিনি দেশে চলে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনকার সেই বর্মার সে-দৃশ্য বোধ হয় কেউ কোনও দিনই ভুলবে না। সেদিন শিয়রে মৃত্যুর ভয়ও তাদের সাদা-কালোর তফাত মুছে ফেলতে পারেনি। সেদিন ইংরেজদের জন্যে ছিল এক রাস্তা, আর নেটিভদের জন্যে অন্য রাস্তা। কালো চামড়াদের সেদিন যে-অত্যাচার সইতে হয়েছে, ইতিহাসে তার রেকর্ড হয়ত একদিন মুছে যাবে, কিন্তু হাতে হাতে নগদ ফল পেয়ে গিয়েছিল সেদিনকার ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট। নর্থ বার্মা থেকে মেজর-জেনারেল স্টীলওয়েল নিজে পালিয়ে এসেছিল, কিন্তু সেখানকার বার্মীজদের রক্ষা করার কোনও ব্যবস্থাই করেনি মিস্টার চার্চিল। হাজার-হাজার লোক পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে পথ সে-পথেও বাধা পেতে হয়েছে বার বার। লো মরে পড়েছে। এক ফোঁটা জলও পায়নি। পথে কত মরেছে, আর কত মরেছে ইরাবতী নদীতে কে তার হিসেব রেখেছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ের মধ্যে লক্ষপতি ভুবনেশ্বর মিত্রও ছিলেন কিনা কে জানে! হয়ত ছিলেন, হয়ত ছিলেন না। যদি সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকে তো তাঁকেও আর সকলের মত এক ফোঁটা জলের জন্যে ছট্‌ফট্ করতে হয়েছে। সেদিন লক্ষপতি বলে কেউ আর তাঁকে আলাদা খাতির তো করেনি। অঘোরদাদু কড়ি দিয়ে নিজের জীবন কিনতে পারেননি। ভুবনেশ্বর মিত্রের অত টাকা। শেষকালে এক ফোঁটা জলের তেষ্টাও সেই টাকা মেটাতে পারলে না। আশ্চর্য!

    সন্ধ্যেবেলা গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এর ধারের বাড়িটা অন্য দিনের মতই আবার উচ্ছল হয়ে উঠলো। বাইরে আবার সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। ভেতরে দাতারবাবু কোট-প্যান্ট্-নেকটাই পরে রোজকার মত টেবিলের ধারে গিয়ে বসেছে। মিস্টার হস্রাজ এসেছে। মিস্টার মাধো এসেছে। মিস্টার লালচাঁদ এসেছে। মিস্টার সিংও এসেছে। কলকাতার বড় বড় কন্‌ট্র্যাক্টার সব। আর তাদের ইহকালের দেবতা সুধাংশুও। সেই সুধাংশু টেবিলের সামনে সকলের দিকে মুখ করে বসে আছে। সুধাংশুর কলমের একটা আঁচড়ে কন্‌ট্র্যাক্টরদের ভাগ্য ফিরে যায়। সুধাংশুর একটা হাসির দামই বিশ হাজার টাকা। সুধাংশুকে ধন্য করার জন্যেই সবাই জমা হয়েছে লক্ষ্মীদির বাড়িতে। সেই সুধাংশুই দিল্লি চলে যাচ্ছে। আরো বড় বড় কন্ট্রাক্টার তাকে খাতির করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে সেখানে। কলকাতার চেয়েও বড় দিল্লি। দিল্লি হলো রাজধানী। ইন্দ্রের নগর দিল্লি। তাই হয়ত তার নাম ইন্দ্রপ্রস্থ।

    তা সুধাংশু যদি দিল্লি যায় তো সবাই দিল্লি যেতে প্রস্তুত! মিস্টার হস্রাজ, মিস্টার মাধো, মিস্টার লালচাঁদ, মিস্টার সিং। সবাই। সুধাংশু দিল্লি চলে গেলে এখানে থেকে তাদের ফয়দা কী?

    মিস্টার হস্রাজ বললে—আমিও দিল্লি যাবো সুধাংশু সাব? আমাকে নিয়ে চলুন—

    সুধাংশু বললে—চলুন না এক সঙ্গে থাকা যাবে—মন্দ কী!

    লক্ষ্মীদি বললে—চলুন মিস্টার হাজ, আপনিও চলুন, সবাই মিলে দিল্লি গুলজার করে তোলা যাবে’খন—মিস্টার মাধো আপনিও চলুন—

    তারপর বাইরের ব্ল্যাক-আউট যত ঘন হয়ে উঠতে লাগলো, ভেতরের আলো তত ফেনিল হতে লাগলো। তত উদ্দাম। বিলিতি হুইস্কির নেশা তত মদির হয়ে উঠলো এ- বাড়ির মেজাজে। কাউকে পরোয়া নেই। কাউকে ভয় নেই। আরো যুদ্ধ চলুক। হিটলার আরো কিছুদিন স্ট্যালিনগ্রাড-এর চার পাশে ঘিরে থাকুক। সুধাংশু আছে, মিস্টার হস্রাজ আছে, মিস্টার মাধো আছে, মিস্টার লালচাঁদ আছে, মিস্টার সিং আছে। কীসের ভাবনা লক্ষ্মীদির?

    লক্ষ্মীদির কাঁধ থেকে শাড়িটা টপ্ করে খসে গেল। সেটা সামলে নিয়ে বললে-আর এক পেগ্‌ দেব তোমায় সুধাংশু?

    হঠাৎ বাইরে আওয়াজ হতেই লক্ষ্মীদি সচেতন হয়ে উঠেছে। কেশব এসে খবর দিলে—দীপুবাবু এসেছে—

    লক্ষ্মীদি সোজা হল্-ঘর ছেড়ে বাইরে এল। সতী অবাক হয়ে তখনও দেখছে চারদিকে। এই বাড়ি লক্ষ্মীদির? এত সুন্দর বাড়ি? এসব কেমন করে হলো? লক্ষ্মীদির নিজের বাড়ি? নিজের উপায় করা টাকায় কেনা?

    বাইরের সিঁড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল দুজনে। দীপঙ্কর সতীকে নিয়ে সদর-দরজার ভেতরে ঢুকতেই একেবারে লক্ষ্মীদির মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। লক্ষ্মীদিকে দেখেও যেন আর চিনতে পারা যায় না। মুখে রুজ। কাঁধ কাটা ব্রোকেডের ব্লাউজ। আলুথালু সিফন্। বব্ করা চুল। ব্লাউজের তলার দিকে পেটের আধখানা দেখা যাচ্ছে। এই সেই লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদির মুখেও তখন আর কোনও কথা নেই। একেবারে ঝাঁপিয়ে এসে সতীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

    —তুই এসেছিস ভাই? আমি যে কত খুশী হয়েছি, কী বলবো। উঃ, কতদিন যে দেখিনি তোকে!

    তারপর চিবুকটা ধরে সামনে উঁচু করে দেখলে। বললে—আহা, কী হয়েছিল তোর সতী? এমন শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

    লক্ষ্মীদির মুখের গন্ধটা নাকে লাগতেই কেমন যেন একটু সচকিত হয়ে উঠেলি সতী। ভলো করে দেখলে চেয়ে চেয়ে। কিন্তু আজ আর তার মুখ দিয়ে কোনও প্রতিবাদের কথাই বেরোল না।

    দীপঙ্কর এতক্ষণ কোনও কথাই বলে নি। এতক্ষণে তার মুখ দিয়ে কথা বেরোল। বললে—সতী রইল লক্ষ্মীদি, আমি তাহলে যাই, অনেক রাত হলো—

    —কেন, তুই যাবি কেন? বোস্—

    —কিন্তু তোমার বাড়িতে তো এখন অনেক গেস্ট এসেছে দেখছি—

    লক্ষ্মীদি বললে—ও কিছু না, আমি কাল চলে যাচ্ছি, তাই এসেছে সবাই—সতীকে আমি অন্য ঘরে নিয়ে যাচ্ছি ওর থাকবার ব্যবস্থা করছি অন্য ঘরে, সেখানে কেউ যাবে না—

    —কিন্তু এখন তো তুমি ব্যস্ত!

    লক্ষ্মীদি সে-কথার উত্তর না দিয়ে সতীকে ধরে ভেতরে ঢুকলো। হল-ঘর থেকে কথার টুকরো কানে আসছে। সিগ্রেটের ধোঁয়ার গন্ধও ভেসে আসছে টুকরো হাসির সঙ্গে। অনেক হাসি আর অনেক কথার আসর জমেছে ওখানে বোঝা গেল। লক্ষ্মীদি বারান্দা পেরিয়ে দক্ষিণের একখানা ঘরে নিয়ে গিয়ে তুললো সতীকে। ঘরে খাট আছে, বিছানা আছে। মশারি বালিশ, সব আছে। চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং-ব্যুরো আছে। লক্ষ্মীদি বললে—এই ঘরে তুই থাকবি ভাই, যতদিন ইচ্ছে, ততদিন থাকবি—তোর কোনও অসুবিধে হবে না তো এখানে!

    দীপঙ্কর বললে—নাঃ, অসুবিধে হবে কেন? চমৎকার ঘরটা।

    লক্ষ্মীদি বললে—আমি কাল ভোরবেলা চলে যাচ্ছি, তোর জন্যে সব ব্যবস্থা করে গেছি। আমার রঘুকে এখানে রেখে যাবো, সে-ই তোর কাজকর্ম করবে! তা তোর শাশুড়ী কী বলছে এখন? শুনলুম তুই দীপুদের আপিসে চাকরি করছিলি—তা হঠাৎ কী হলো তোর? এতদিন কোথায় থাকতিস?

    দীপঙ্কর বললে—এখন ওসব কথা থাক লক্ষ্মীদি, সতীর শরীর ভাল নেই—

    লক্ষ্মীদি বললে—আর সেই বাবার টাকা? শুনেছিস তো বাবা মারা গেছেন? তাঁর টাকাগুলোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কোথায় কত টাকা আছে, কোন্ কোন্ ব্যাঙ্কে, তারও তো খোঁজ নিতে হয়—আমি তো চলে যাচ্ছি—

    দীপঙ্কর বললে—সে-সব তুমি কিছু ভেবো না, আমি তো রইলুম—তুমি সতীকে কিছু খেতে দেবার ব্যবস্থা করো শিগগির, আমি কাল ভোর চারটে-পাঁচটার মধ্যেই আসবো—

    লক্ষ্মীদি বললে—আমার যে সাড়ে ছটায় প্লেন রে—

    দীপঙ্কর বললে—আমি তার আগেই আসবো, সতী এখন একটু ঘুমোক, খুব ক্লান্ত ও—আমি চলি—

    তারপর আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি দীপঙ্কর। সেখান থেকেই সোজা সদর দরজা খুলে বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিল। ট্যাক্সিটা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। সেইটেতেই উঠে বসলো।

    .

    কিন্তু স্টেশন রোডের বাড়ির সামনে আসতেই অনেক লোকের ভিড় দেখে অবাক হয়ে গেছে দীপঙ্কর। এত লোক। এত লোক কেন? রাত অনেক হয়ে গিয়েছে। এ-সময় পাড়া নিস্তব্ধই হয়ে যায় অন্য দিন। অন্ধকার ব্ল্যাক-আউটের মধ্যেও যেন বহু লোকের অস্পষ্ট ছায়া ঘোরাফেরা করছে তারই বাড়ির সামনে।

    সামনে যেতেই দীপঙ্কর দেখলে সমস্ত বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পুলিসে। মিলিটারি পুলিসে জায়গাটা ছেয়ে গেছে। পাড়ার কয়েকজন লোক আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ে ভয়ে।

    দীপঙ্কর সামনে যেতেই একজন সার্জেন্ট এগিয়ে এল। বললে–আর ইউ ডি সেন? তুমিই ডি সেন?

    দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—

    —আমরা কিরণ চ্যাটার্জিকে তোমার বাড়ির ভেতর থেকে অ্যারেস্ট করেছি। ডু ইউ নো হিম?

    দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। কিরণ! কিরণ আজ হঠাৎ কোথা থেকে এল। কখন এল? সে কি তার আশাতেই অপেক্ষা করছিল? কিন্তু তার তো এ-সময় আসার কথা নয়। সে তো ওয়্যারলেস সেটটা সেদিন নিয়ে চলে গিয়েছিল! কেন সে এমন বোকামি করলে?

    আর সঙ্গে সঙ্গে দু’জন সার্জেন্ট হাতকড়া পরানো কিরণকে এনে সামনে দাঁড় করালো। ফরসা টক্ করছে গায়ের রং। নিবাত-নিষ্কম্প দীর্ঘ দেহ। হাসি-হাসি মুখ। দীপঙ্কর কিরণের দিকে চেয়ে নির্বাক হয়ে রইল। একবার কথা বলতে গেল, কিন্তু সার্জেন্ট দু’জন থামিয়ে দিলে। বললে–আপনাকেও আমাদের হেড-কোয়াটার্সে যেতে হবে মিস্টার সেন। কাম্ অন্—আপনার বাড়িটা আগে সার্চ করবো আমরা—

    মনে আছে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দীপঙ্করের বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর, প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি, প্রত্যেকটি জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে দেখেছিল তারা। কোনও বাক্স, কোনও আলমারি, কোনও বিছানা খুঁজতে বাকি রাখেনি আর। আর কিরণ? কিরণের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। শোবার ঘর, বারান্দা, উঠোন, রান্নাঘর সমস্ত তাদের দেখা চাই। সেই অন্ধকার মাঝ-রাত্রেই যেন ওয়ার-ফিল্ড হয়ে উঠেছিল সে-বাড়িটা।

    কিরণ ধীর স্থির দৃষ্টিতে সমস্ত দেখছিল।

    যেন কিছুই ঘটে নি তার। যেন কোনও বিপর্যয়, কোনও বিপৎপাত তার জীবনে ঘটেনি। সে যেন একদিন এই পৃথিবীতে জন্মেছিল আকস্মিকভাবে, আবার আকস্মিকভাবেই তার বিদায় নেবার পালা এসেছে আজ। জন্মগ্রহণের জন্যে যদি আনন্দ করবার কারণ না ঘটে থাকে, তো মৃত্যুর জন্যেও দুঃখ করবার যেন প্রয়োজন নেই। জীবন নিয়ে বাড়াবাড়ি যারা করে, তাদেরই যেন মরণ নিয়ে ভয় করবার কথা। লক্ষ লক্ষ বছর আগে একদিন জীবন-জগতের সূত্রপাত হয়েছিল পৃথিবীতে। তাই জীবের বিবর্তন হয়েছে, কিন্তু পৃথিবী তো তেমনই আছে। পৃথিবী যেমন ছিল তেমনই থাকবে, আসা- যাওয়ার পালা শুধু জীবের বেলায়। তাকে আসতেও হবে আবার যেতেও হবে। কিরণের আগে তো আরো অনেক লোকই চলে গেছে, আরো অনেক মানুষই তো পুলিসের গুলীতে মরেছে তাতে কি তারা দুঃখ পেয়েছিল? ফাঁসির আগে গোপীনাথ সাহার শরীরের ওজন কত পাউন্ড বেড়ে গিয়েছিল পুলিসের খাতায় কি তার রেকর্ড নেই?

    কিন্তু কেন এমন বে-হিসেবী হলো কিরণ? কেন এমন অসতর্ক হলো? আর একটু সাবধান হলে পারতো না?

    মা’র এত সাধের রান্নাঘর, এত সাধের পুজোর ঘর, সমস্ত তছনছ হয়ে গেল দীপঙ্করের চোখের সামনে। মা’র পুজোর কোষাকুষি গঙ্গাজলের তামার ঘড়া, মা-কালীর একখানা পট—পুলিসের আইনে তার যেন কোনও দাম নেই। দুম্ দাম করে সমস্ত ভেঙে ফেললে তারা। ভারি-ভারি বুট্ দিয়ে সুট মারতে লাগলো। ছড়িয়ে ছিট্‌কে গেল সেগুলো ঘরের ভেতরে।

    হ্যান্ড-কাফ্ বাঁধা কিরণ আর স্থির থাকতে পারলে না। চিৎকার করে উঠলো—স্টপ্ দ্যাট্—

    হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ হলো ঘরের ভেতরে।

    আর সঙ্গে সঙ্গে কিরণের মাথায় রিভলবারের বাঁট্ দিয়ে প্রচন্ড আঘাত করলে তারা। অশ্লীল একটা গালাগালি বেরোল তাদের মুখ দিয়ে—ব্লাডি বাস্টার্ড-সান্-অর্-এ-বিচ্—

    সেই এক আঘাতেই কিরণ তখন মাটিতে পড়ে গেছে। ছট্‌ফট্ করছে, কথা বলবার চেষ্টা করছে—যেন প্রাণপণে বাঁচবার চেষ্টা করছে। মাথার খুলিটা ফেটে ঝর-ঝর করে রক্ত পড়ে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত মুখখানা।

    দীপঙ্কর সামনে ঝুঁকে পড়তে যেতেই একজন সামনে রিভলবার উঁচিয়ে তার দিকে তাক্ করে বলে উঠলো—হ্যান্ডস্ আপ—

    আর তারপর সব পড়ে রইল সেখানেই। সেই তেমনি ছড়ানো ছিটোনো। মা’র এত সাধের সংসার। সমস্ত লন্ড ভন্ড হয়ে গেল। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তাতেই গিয়ে তারা তুললো কিরণকে। দীপঙ্করকেও তাদের মধ্যে গিয়ে উঠতে হলো গাড়িতে। নতুন আমেরিকান জিপ্ বিপ্লবের সুড়ঙ্গ পথ ধরে মহা-জীবনের রাজধানীর দিকে চললো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী
    Next Article কড়ি দিয়ে কিনলাম ১ – বিমল মিত্র

    Related Articles

    বিমল মিত্র

    সাহেব বিবি গোলাম – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    বেগম মেরী বিশ্বাস – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    আসামী হাজির – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ১ – বিমল মিত্র

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }