কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৯
৩৯
বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাড়িতে আস্তে আস্তে ভোর হলো। আস্তে আস্তে সকাল ও হলো। ঘর-দোর তছ-নছ করে করে ফেলে গেছে পুলিসরা। এক একটা দৈত্যের মতন চেহারা তাদের। কাশী কিছুই জানতো না। সন্ধ্যেবেলা সবে ব্ল্যাক আউট শুরু হয়েছে পাড়ায়। সেই তখনই দাদাবাবুর বন্ধু এসে দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। চেনা চেহারা। আর একদিন রাত্রে এসেছিল। কাশী তাই তেমন কিছু সন্দেহ করেনি। দাদাবাবু নেই শুনে বসতে চেয়েছে ভেতরে। টক টক করছে গায়ের রং। সাহেবী-পোশাক পরা। কিছুই সন্দেহ হয়নি। ওপরের ঘরেই নিয়ে গিয়ে বসিয়েছিল বাবুকে। আর ঠিক তারপরেই যে এত কান্ড হবে কে জানতো? সমস্ত পাড়ায় একেবারে হৈ চৈ পড়ে গেছে। পুলিসরা চলে যেতেই একে একে পাড়ার লোকজন এসে হাজির হলো। কেউ বললে—হ্যাঁ রে, ও কে?
কাশী বললে—আজ্ঞে, তা আমি কী করে জানবো, দাদাবাবুর বন্ধু বলে আমি বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিলুম—
—তা তোর বাবুকেও ধরে নিয়ে গেল কেন? তোর বাবুও কি ওদের দলে?
ঘরের মেঝেতে তখনও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। দাদাবাবুর বন্ধুর মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়েছিল মেঝের ওপর। বাক্স, বিছানা, আয়না, আলমারি, কিছু আর আস্ত রাখেনি তারা। সমস্ত ওলট-পালট করে ভেঙে-চুরে এক্শা করেছে। কাশীর কান্না পেতে লাগলো। মা থাকলে এমন করে হয়ত নষ্ট করতে পারতো না। মা’র পুজোর বাসন- কোসনও বাদ দেয়নি। কালিঘাটের পটখানার দিকে চেয়ে মা চান করে উঠে রোজ নমস্কার করতো। ধূপ-ধুনো দিত। সেই পটখানাই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে পাষন্ডগুলো। একটা ঝাঁটা নিয়ে সেই সমস্ত পরিষ্কার করতে হলো। পরিষ্কার করা কি চারটিখানি কথা? আর শুধু তো শোবার ঘরই নয়। সমস্ত কিছু ঘেঁটেছে। কয়লার ঝুড়িটা পর্যন্ত। কয়লাগুলো পর্যন্ত উপুড় করে ছড়িয়ে রেখে গেছে উঠোনের মাঝখানে। রান্না- ঘরের ভেতরেও বুট পরে ঢুকেছিল। হাঁড়ি-কুড়ি সব ভেঙে ছত্রখান করে দিয়েছে। আবার নতুন করে হাঁড়ি কিনতে হবে বাজার থেকে। আবার থালা-বাসন কিনতে হবে। আবার সবই কিনতে হবে বলতে গেলে।
—কাশী!
এতক্ষণে যেন কাশীর মনে পড়লো। এ মানুষটা যেন পৃথিবী থেকেই মুছে গিয়েছিল। তার কথা কারোরই মনে ছিল না। সেই সন্তোষ-কাকা মারা যাবার পর থেকেই যেন ক্ষীরোদার অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল সংসার থেকে। অথচ প্রতিদিন সংসারের অনেকখানি কাজ তো ক্ষীরোদাই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কাশী ঝাঁটাটা হাতে নিয়েই দৌড়ে এল।
ক্ষীরোদা বললে—ওরা চলে গিয়েছে সবাই?
কাশী বললে—অনেকক্ষণ চলে গেছে দিদিমণি, দাদাবাবুর বন্ধুকে মেরে একেবারে অজ্ঞান করে দিয়েছিল পুলিস—
আর একজনের কথাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারলে না মুখ ফুটে। যার ওপর নির্ভর করে এ-বাড়িতে থাকা, সেই মানুষটার কথাও বার বার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো তার। রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে সমস্ত অবস্থাটা দেখে ক্ষীরোদার চোখেও জল এল। বললে—কী হবে তাহলে কাশী?
তা কাশীই কি জানে, কী হবে। তবু মুখে অভয় দিলে। বললে—কী আর হবে! তুমি কিছূ ভেবো না দিদিমণি—
—যদি আর না আসেন?
কাশী বললে-খাওয়া-দাওয়ার কথা বলছো? আমার কাছে টাকা আছে—
ক্ষীরোদা যেন টাকার কথা ভেবেই অস্থির হচ্ছে। আশ্চর্য!
কাশী বললে—না, চাল ডাল কেনবার কথা ভাবছে তো? সে আমি এখনি কিনে আনছি বাজার থেকে, আমার মাইনের টাকা নেই ভেবেছ?
সত্যিই, কাশী ভেবেছে রান্না-খাওয়ার জন্যেই ক্ষীরোদা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাশী বললে—কলে জল এয়েছে, এই বেলা তুমি চান-টান যা করবার করে নাও, আমি বাজার থেকে সমস্ত কিনে আনছি—
ক্ষীরোদার রাগ হলো। রেগে বললে—তোমার যদি খেতে সাধ হয় এত তো তুমি খাও আমার ক্ষিদে নেই।
কাশী সে-কথায় কান দিলে না। তাড়াতাড়ি ঘর-পরিষ্কার করে ঝুড়ি নিয়ে একেবারে তৈরি। বললে—আমি বাজারে চললুম, দরজায় হুড়কো লাগিয়ে দাও—
ক্ষীরোদা তখনও চুপ করে বসে রইল।
কাশী আবার কাছে এল। বললে—উঠে দরজাটা বন্ধ করে দাও, আমি বাজারে যাচ্ছি—
ক্ষীরোদার চোখ দু’টো বড় করুণ হয়ে উঠলো এবার। বললে—কিন্তু কেন যাচ্ছো কাশী, কে খাবে?
—আমি খাবো, আমি। আমি তোমার মত উপোস করে থাকতে পারবো না। আমি নিজে খাবো। তুমি সদর দরজাটা আগে বন্ধ করে দাও তো—
ক্ষীরোদার ইচ্ছে ছিল না। তবু অনেক পীড়াপীড়িতে ক্ষীরোদা উঠলো। কাশী বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বললে—বেশ ভাল করে এঁটে দরজা বন্ধ করে দাও, কেউ ঠেললেও দরজা খুলবে না, আমি এসে উনুনে আগুন দেব-আমার বেশি দেরি হবে না—
তারপর বাইরে থেকেই দরজাটা ভাল করে ঠেলে দেখলে কাশী। ঠিক-ঠিক বন্ধ হয়েছে কিনা। ক্ষীরোদা আবার এসে বসলো বারান্দায়। আবার হারিয়ে গেল নিজের মনের তলায়। সারা রাত ঘুম হয়নি কারো। কাশীও ঘুমোয় নি। বাড়িতে অমন কান্ড হলে কেউ ঘুমোতে পারে নাকি? কোথাকার কোন্ রসুলপুর থেকে একদিন এ-সংসারে এসে পড়েছিল ক্ষীরোদা, সেদিন কলকাতা দেখবার কলকাতায় থাকবার একটু আগ্রহ ছিল হয়ত। তারপর সেই একদিন মাসীমার সঙ্গে কাশীতে গিয়েছিল রেলে চড়ে, আর কোথাও যায় নি। আর কিছু দেখবার শোনবার ইচ্ছেও হয়নি ক্ষীরোদার। এ-সংসারে সে কেউ না, কিন্তু এই সংসারই তাকে কেমন করে জড়িয়ে ধরলে, আর তার পালাবার ও উপায় রইল না। এখন এখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দিলেও সে আর যেতে পারবে না। আর কোথাও যাবার জায়গাও নেই তার।
হঠাৎ দরজার কড়াটা নড়ে উঠলো!
এর মধ্যেই কাশী ফিরে এল নাকি! ক্ষীরোদা দাঁড়িয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি সদর দরজার সামনে গিয়ে বললে—কে? কাশী?
কেউ সাড়া দিলে না বাইরে থেকে।
ক্ষীরোদা বললে—কাশী, ফিরে এলে?
তবু সাড়া নেই।
ক্ষীরোদার কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। কে এল হঠাৎ এমন সময়?
—কাশী? কাশী দরজা ঠেলছো? নাম বলো তোমার। কে?
তবু কারো সাড়া পাওয়া গেল না। আরো জোরে-জোরে কড়া নাড়তে লাগলো।
এবার যেন আরো ভয় পেয়ে গেল ক্ষীরোদা। দরজা খুলে যদি দেখে অচেনা লোক। যদি আবার পুলিসের লোক আসে? বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই একটা যে কথা বলতে পারবে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারলে না ক্ষীরোদা।
তখনও কড়া নাড়ছে।
ক্ষীরোদা আবার বললে—কে? কাশী তুমি?
মনে হলো যেন কাশীই বললে—হ্যাঁ দিদিমণি, দরজা খোল—
দরজাটা খুলতেই কিন্তু ক্ষীরোদা অবাক হয়ে দু’পা পেছিয়ে এসেছে। এ কে? একে তো দেখেনি কখনও। এতদিন এ-বাড়িতে এসেছে এ-চেহারা তো কখনও নজরে পড়েনি!
ভয়ে গলাটা শুকিয়ে এসেছে তখন। তবু একটু সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করলে— আপনি কে?
—তুমি কে?
ক্ষীরোদা প্রশ্ন শুনে আরো অবাক হয়ে গেল। দু’জনেই দু’জনের দিকে খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল।