কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪০
৪০
যে জীবন নিয়ে দীপঙ্কর একদিন নিঃসঙ্গ যাত্রা করেছিল, সেদিন অত বছর অতিক্রম করেও সেই জীবনের বুঝি তীর্থসঙ্গমে গিয়ে পৌঁছোবার সময় তখনও হয়নি। আশুতোষ কলেজের সেই প্রফেসার অমলবাবু বলছিলেন—জীবন দিয়েই তোমার এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে দীপঙ্কর। এ প্রশ্নের সমাধান তুমি তোমার ছাপানো বইতে পাবে না, প্রফেসারের লেকচারের মধ্যেও পাবে না। জীবন দিয়ে সমাধান না খুঁজলে, সে সমাধান সত্যও হবে না, স্থায়ীও হবে না। হয়ত তখনও জীবন দিয়ে দেখার অনেক বাকি ছিল তার। হয়ত এমনি করেই বাধা অতিক্রম করে মহাজীবনের দিকে এগিয়ে চলে মানুষ। এগিয়ে চলতে গিয়ে কেউ ফতুর হয়ে যায়, কেউ উত্তরণ করে। এ জীবনে যত জীবন দেখেছে, তত মৃত্যুও দেখেছে সে। যত আলো দেখেছে, তত অন্ধকারও দেখেছে। সেই সোক্রেটিস্, কনফুসিয়াস, সেই বাইবেলের আগের যুগ থেকে শুরু করে যত মানুষ যত মহামানুষ জন্মেছে সকলের সব জীবন যেন বিংশ শতাব্দীর কলকাতায় এসে এই দীপঙ্করের মধ্যেই জীবন পেয়েছে। তার অনুভূতির মধ্যে বাসা বেঁধেছে ইতিহাসের মানুষের সমস্ত অনুসন্ধান বৃত্তি। মাঝে মাঝে এই ভাবনাটা আসতো তার মনে, আবার মাঝে মাঝে মিলিয়েও যেত। হঠাৎ দু’দিন তিন দিন যেন বিভোর করে রাখতো তাকে, আবার সে সাধারণ হয়ে যেত। অতি সাধারণ। আবার সে রেলের স্টাফ হয়ে যেত। আবার পারিপার্শ্বিকের আবহাওয়া তাকে ঘুড়ির মত সংসারের পঙ্কিলতার মধ্যে নামিয়ে আনতো হঠাৎ। প্রাণমথবাবুর কাছে গেলে, প্রাণমথবাবুর কথা ভাবলে, কিরণ কাছে এলে, কিরণের কথা ভাবলেও যেন আবার এই সব তুচ্ছতার ওপরে উঠে যেত কয়েকদিনের জন্যে।
আজো মনে আছে সেদিন পুলিসের গাড়িতে কিরণের সেই ব্যবহার। মাথা দিয়ে ঝর-ঝর করে রক্ত পড়ছে। দু’জন সার্জেন্ট দু’দিক থেকে তাকে রিভলবারের নলের সামনে নির্জীব করে ধরে আছে। কিন্তু নির্জীব থাকবারই কি ছেলে কিরণ! কই, দীপঙ্কর তো সেদিন কিরণের মত বেপরোয়া হতে পারেনি। চোখের সামনে নিজের মার পূজোর জিনিসের অপমান তো নীরবে সহ্য করছে মুখ বুজে। আর কিরণ? কিরণের নিজের মা’র অপমানের কথা তো কিরণ ভাবেনি। তার নিজের মা কেমন করে সংসার চালায়, তার নিজের মা বেঁচে আছে কিনা, সে-কথা তো সে একবারও জিজ্ঞেস করেনি। তবে কেন সেদিন অমন হুঙ্কার করে উঠেছিল নিজের জীবনকে বিপন্ন করে?
কিরণ বলতো—কষ্টা সহ্য করার অভ্যেস করা ভাল ভাই, শেষকালে যখন পুলিসেরা কষ্ট দেবে, তখন আর কোন কষ্ট হবে না—
ছোটবেলায় কিরণ ইচ্ছে করে গায়ে বিছুটি লাগাতো, ইচ্ছে করে তেতো ওষুধ খেতো, না-খেয়ে দিনের পর দিন থাকতো, সে তো কেবল এই জন্যেই। এই এরই জন্যে এতদিন ধরে নিজেকে তৈরি করিয়ে রেখেছিল সে। একবার বুঝি তার সেই কষ্ট সহ্য করারই পরীক্ষার পালা। এতদিন পরে যেন তাকে পরীক্ষা দিতে যেতে হচ্ছে—
আর আশ্চর্য, কিরণের দিকে চেয়ে দেখছিল দীপঙ্কর আর নিজেরও যেন আনন্দ হচ্ছিল। এক অদ্ভুত আনন্দ। যেন কিরণ নয়, যেন দীপঙ্করের নিজের মাথা দিয়ে ঝর- ঝর করে রক্ত পড়ছে। যেন মিলিটারি-পুলিস দীপঙ্করের ওপরেই অত্যাচার করছে। যেন দীপঙ্করই নিজে জার্মানী থেকে পালিয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছে। মারো, আরো মারো তোমরা আমাকে, তাতেও যদি সকলের সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়। ছিটে-ফোঁটা, অঘোরদাদু নয়নরঞ্জিনী দাসী, নির্মল পালিত, মিস্টার ঘোষাল, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মহীন্দ্র সকলের সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবে কিরণ। সকলের সমস্ত পাপ সব নিজে আত্মসাৎ করে তোমাদের পবিত্র করবে সে। তোমাদের যত আঘাত সমস্তটুকু কিরণের ওপর পড়ুক, তাতে দীপঙ্করও পরিত্রাণ পাবে। দীপঙ্করও পরিশুদ্ধ হবে।
গাড়িটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে উঠলো আবার সেই লোহার গেটের ভেতর। বহুদিন আগে একদিন এখানেই এসেছিল দীপঙ্কর একলা। সেদিন রায় বাহাদুর নলিনী মজুমদারের সামনে যে নাটক অভিনীত হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি হলো আবার। একদল কিরণকে নিয়ে কোথায় চলে গেল। আর দীপঙ্কর রইল দাঁড়িয়ে। অন্ধকার কলকাতা, বাইরে নিশুতি ব্ল্যাক-আউট। কিন্তু এখানে এই কর্মব্যস্ত ঘরের ভেতরে যেন তখন সতর্ক সন্ধানী দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে, চঞ্চল হয়ে, উন্মাদ হয়ে উঠেছে। কোনও দিকে লক্ষ্য নেই শুধু খোঁজ কোথায় কে লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের মঙ্গল-চিন্তা করছে। খোঁজ নাও কোথায় কোন্ সৎলোক মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করছে। সন্ধান করো কে কোথায় আছে এমন মানুষ, যে নিজের সংসার দেখেনি, নিজের স্বার্থের কথা ভাবেনি, যে অনাহার করেছে দিনের পর দিন, আর তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, কিম্বা যে জীবনে একদিনের জন্যে মিথ্যে কথা বলেনি, মিথ্যে আচরণ করেনি, মিথ্যে আড়ম্বরে নিজেকে ভূষিত করেনি। খুঁজে বেড়াও সেই সব সোক্রেটিসদের, সেই সব যিশু খৃষ্টদের, আর সেই সব দীপঙ্করদের, সেই সব কিরণদের। তাদের হাতে বিষ তুলে দাও, তাদের ক্রুসে বিঁধে মারো। তাদের ধরে আনো লালবাজার পুলিস হেড কোয়াটার্সে।
লোহার একটা দরজা সশব্দে খুলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক সামনে এসে দাঁড়াল। পুলিস-ইউনিফর্ম পরা চেহারা। বাঙালী।
—এ কি স্যার, আপনি?
দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে। চেনা গেল না। লোকটা আবার বললে—চিনতে পারছেন না?
—কে আপনি?
লোকটা বললে—সেই মিস্ মাইকেলের মার্ডার-কেসে আপনি স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটে!
দীপঙ্কর বললে—তা হবে, আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
—কিন্তু আপনি আবার ডিফেন্স-অব-ইন্ডিয়া অ্যাক্টে জড়িয়ে পড়লেন কেন? কিরণ চ্যাটার্জি আপনার কে?
দীপঙ্কর বললে—আমার বন্ধু।
—কিন্তু আপনি তো গভর্নমেন্টের গেজেটেড অফিসার! আপনি এইসব অ্যান্টি- ব্রিটিশ কাজের মধ্যে কেন যেতে গেলেন? কিরণ চ্যাটার্জির এগেনস্টে তো সিভিয়ার চার্জ, তার তো ফাঁসি হবে মশাই, আপনি আবার এ সবের মধ্যে কেন যেতে গেলেন? মহামুশকিলে ফেললেন দেখছি—আপনি এর মধ্যে আছেন, তা তো জানতাম না—
—কিরণের কি ফাঁসিই হবে?
লোকটা বললে—এই ডিপার্টমেন্টে একলা আমি শুধু বাঙালী মশাই, আর সব ইংরেজ—তাই আপনাকেই আমি বলছি, এরা কিরণ চ্যাটার্জির ফাঁসি না দিয়ে ছাড়বে না, অনেক পুরোন দাগী, রায় বাহাদুরের আমলের পুরোন ফাইল পাওয়া গেছে।
—কোর্টে মামলা হবে?
লোকটা বললে—কোর্টে মামলা হবে না, এ সব কেস কোর্টে যায় না, এ তো মিলিটারির ব্যাপার—। ইনভেস্টিগেশনও কমপ্লিট হয়ে আছে, এ ফাঁসি না হয়ে যায় না। কিন্তু আমি আপনার কথাটাই ভাবছি…..
দীপঙ্কর বললে—আমার কথা থাক, কিরণ চ্যাচার্জির কি ফাঁসি হবেই?
ভদ্রলোক বললে—নির্ঘাৎ, অনেকদিন ধরে খোঁজ চলছিল, লন্ডন থেকে স্পেশ্যাল কেবল এসেছে, চার্চিল থাকতে কোনও আশা নেই—
তারপর একটু থেমে চারদিকে চেয়ে নিয়ে গলা নিচু করে বললে—আপনাকে দেখেই আমি এলুম ঘরে, ভাবলাম আপনি এ সবের মধ্যে কখনও থাকতে পারেন না, তা কিরণ চ্যাটার্জির সঙ্গে আপনার কিসের রিলেশন? ও তো এককালে টেররিস্ট ছিল— দীপঙ্কর বললে—আপনি নিজে বাঙালী, কিরণের জন্যে যদি কিছু পারেন তো করুন না—ফাঁসিটা যে কোনও রকমে বন্ধ করুন না—
—সে কি বলছেন স্যার, তাহলে যে আমার চাকরিটাই চলে যাবে। আগে তো দেখেছেন থানার ইন-চার্জ ছিলুম, এখন প্রমোশন নিয়ে এই ব্র্যাঞ্চে এসেছি, দেড়শো টাকা বেশী পাচ্ছি, এ ব্যাপারে কারো হাত নেই, গভর্নরেরও হাতের বাইরে।
—উকিল ব্যারিস্টার যদি কিছু লাগে আমি তাও লাগাতে পারি। আপনি জানেন না বোধহয় কিরণের কেউ নেই, এক বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই সংসারে। আর তা ছাড়া ও তো সকলের ভালোর জন্যেই এ কাজ করেছিল।
ভদ্রলোক এবার বললে—এ সব কথা থাক স্যার, এ লালবাজার, এখানে দেয়ালেরও কান আছে, আমি চলি—
ভদ্রলোক চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু আবার ফিরলো। বললে—একটা কথা, সেই মিস্ মাইকেলের মার্ডার কেসটার কথা মনে আছে তো আপনার? শেষ পর্যন্ত একটা ব্লু পাওয়া গিয়েছিল, তা জানেন তো? ওটা আমারই কেস কি না!
দীপঙ্কর কিছু কথা বললে না।
ভদ্রলোক আবার বলতে লাগলো—সেদিন মিছিমিছি আপনাকে ডাউট করেছিলাম, সেও মিস্টার ঘোষালের কথায়—
—মিস্টার ঘোষালের কথায়?
—হ্যাঁ, কিন্তু আশ্চর্য, এতদিন পরে তার একটু ক্লু পাওয়া গেছে, সেই মিস্ মাইকেলের মার্ডারের পেছনেও মিস্টার ঘোষালের হাত রয়েছে। আমি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কাছে শুনেছি—
কথাটা বলে ভদ্রলোক চলেই যাচ্ছিল। ভেবেছিল হয়ত দীপঙ্কর কিছু বলবে। কিন্তু দীপঙ্কর তখনও নির্বাক হয়ে আছে। ভদ্রলোক যাবার সময় বললে-এখন অ্যান্টিকরাপশনের কেসের সঙ্গে সে চার্জটাও এসে পড়বে—
বলে ভদ্রলোক আর দাঁড়াল না।
দীপঙ্কর ডাকলে—আর একটা কথা শুনুন—
—কী বলছেন? আপনার কিছু ভাবনা নেই মশাই, আপনার জন্যে আমি চেষ্টা করবো, ইনভেস্টিগেশন কমপ্লিট না-হওয়া পর্যন্ত এখানে আপনাকে ডিটেন করে রাখা হবে—
—আমার কথা নয়, কিরণ চ্যাটার্জির কথা জিজ্ঞেস করছি। আমাকে রেখে দিয়ে ওর জন্যে বরং আপনি একটু চেষ্টা করুন।
—অসম্ভব! বড় সিরীয়াস চার্জ ওর বিরুদ্ধে। ওর ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না।
বলেই ভদ্রলোক আবার দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। বাইরে লোহার দরজায় চাবির ঝন ঝন শব্দ হলো। বোঝা গেল এ-ঘর থেকে বাইরে যাবার পথ তার বন্ধ।