কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৩
৪৩
মিস্টার ঘোষাল শুধু একলাই নয়। মিস্টার ঘোষালের জন্মের বহু আগে এমনি ঘটনা অনেক বার ঘটেছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মিস্টার ঘোষাল পৃথিবীতে এসেছে আর গেছে। সভ্যতার আদিযুগ থেকে আজ পর্যন্ত সে-নিয়মের আর ব্যতিক্রম হয়নি। একদিন পৃথিবীর মধ্যযুগে দেশের বাইরে কী আছে, নিজেদের দেশের ওপিঠের ভূগোলে কী ঘটছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার হয়নি কারো। রোমানরা গ্রীকরা যা জানতো তার বেশি এক তিল কারো জানা ছিল না। জানবার কৌতূহল থাক্ বা না থাক্, সে কৌতূহল মেটাবার উপায়ও ছিল না। চায়নাকে তারা বলতো ক্যাথে, জাপানকে বলতো সিপানগো। আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ছিল তাদের কাছে রূপকথার দেশ। কিন্তু সেই রূপকথার দেশেও একদিন মহাজনদের যাবার দরকার হলো। দরকার হলো, কারণ তখন হাতে টাকা জমে গেছে অনেক। সেই টাকা নিজের দেশে খাটিয়েও আর কুলোচ্ছে না। স্বদেশে খাটছে, বিদেশেও খাটাতে হবে। পশ্চিম দিকে ছিল আমেরিকা। নিওলিথিক যুগের মানুষ তখন তারা। মেক্সিকো, পেরু, তাদের বশে আনা বেশি শক্ত নয়। কিন্তু মুশকিল হলো এশিয়া নিয়ে। এশিয়া মানে চায়না আর ইন্ডিয়া। এশিয়া তখন সভ্য দেশ দু হাজার বছরেও সেখানে কিছুই বদলায় নি। কিন্তু নতুন জাহাজে উঠে সেই এশিয়াতেই এসে হাজির হলো মিস্টার ঘোষালরা। এখানে মশলা আছে, জমি আছে সোনা, রূপো, তামা আছে। সমস্ত চাই তাদের। সব টাকা এখানেই খাটাবে মিস্টার ঘোষালরা।
চায়নাতে তখন সম্রাট সর্বেসর্বা। সবাই যো-হুজুর বলে মানে তাকে। যারা বাইরের লোক তাদের ওপর কড়া নজর সেখানে। জাপানও তাই। সেখানে মিস্টার ঘোষালরা ঢুকতে পারলে না। কিন্তু ইন্ডিয়ার মাটি বড় নরম। এখানে ঘরে-ঘরে ঝগড়া। এখানে জাত নিয়ে বাছ-বিচার। এ এক অদ্ভুত পেনিনসুলা। এখানে দিল্লীর অত্যাচার একদিকে আর একদিকে কারোর সঙ্গে কারো মিল নেই। এখানে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর মিল নেই। স্ত্রীর সঙ্গে মিল নেই শাশুড়ীর। শাশুড়ীর সঙ্গে মিল নেই আবার স্বামীর। মা ছেলে বউ—কেউ কারো নয়। কেউ কারো শাসন মানে না, কেউ কারো কর্তৃত্ব স্বীকার করে না। তাই বড় সুবিধে হলো মিস্টার ঘোষালদের আর নির্মল পালিতদের। বড় সুবিধে হলো পর্তুগীজ, স্প্যানীজ, ডাচ, ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চদের—
এ হলো ষোড়শ শতাব্দীর গল্প!
কলম্বাস, ডা’গামা আর ম্যাগেলানরা টাকার বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পৃথিবীর বাজার খুঁজতে। নতুন নতুন টাকা খাটাবার বাজার। যেখানে পাবে সেখানেই গেড়ে বসবে। একদিন মিস্টার ঘোষালও এসে ঢুকে পড়েছিল রেলের আপিসে এই বিশ শতকের মাঝামাঝি। অনেক টাকা তখন জমে গেছে হাতে। ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট তখন শেষ করে এনেছে। সারা কলকাতায় বাজার তখন ফতুর। কত মিস্ মাইকেলের লাইফ তখন মিস্টার ঘোষালের পায়ে আত্মবলি দিয়েছে। এমন সময় সন্ধান পেলে ইন্ডিয়ার। এ ইন্ডিয়াতে তখন অরাজক অবস্থা। নির্মল পালিত ব্যাঙ্কের সব টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ। সনাতনবাবু সমস্ত তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে মনুষ্যত্বের মহৎ গবেষণায় ব্যস্ত। আর শাশুড়ী নয়নরঞ্জিনী দাসী তখন একেবারে অসহায়। আভিজাত্যের মর্যাদাটুকু ছাড়া আর কিছু অবলম্বনই নেই তার তখন। এমন সুযোগ ক’জন ভাস্কো-ডাগামা পায়?
ন’দিদি আবার সেদিন এল গাড়ি করে। মোটা-সোটা মানুষ। কিন্তু বেশ খট্খটে।
বললে—কই রে নয়ন, কোথায় তুই—
মোটা শরীর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠলো তেতলায়। বললে—আর পারিনে বাপু সিঁড়ি ভাঙতে—
মা-মনি খবর পেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন—এসো ন’দিদি, পাখার তলায় বোস একটু—
ন’দিদি বিছানায় বসে পড়লো। বললে—তোর জন্যে আবার হাঁফাতে হাঁফাতে এলুম, ওদিকে আমার সেজবৌমার আবার আঁতুড় ফেলে এসেছি—
মা-মণি বললেন—তুমি আছো ন’দিদি তাই তবু একটু কথা বলতে পেরে বাঁচি, আজ সারাদিন মুখ বুজে আছি, জানো—
কথা বলবার জন্যে আসেনি ন’দিদি। বললে—বসবো না আর, বসবার আমার সময় নেই রে। সেই বাগবাজারে মিত্তির-বাড়ি তোকে নিয়ে যাবো বলে এইচি—
নয়ন বললে—তুমি কি তাদের কথা দিয়ে দিয়েচ নাকি ন’দিদি?
—ও মা, কথা দেব না, বলছিস্ কী তুই নয়ন? তোর ছেলের বিয়ে না হলে, আমার স্বস্তি আছে? চল্ চল্—দেরি করবো না আর, বেলাবেলি যেতে হবে। মেয়ে দেখার ব্যাপার, বেলাবেলি করাই ভালো—
নয়ন বললে—কিন্তু কথাবার্তা কিছু হলো না, আগেই মেয়ে দেখতে যাবো ন’দিদি?
ন’দিদি বললে—পাকা কথা তো পরে, আগে মেয়ে তোর পছন্দ হোক!
—কিন্তু শেষে যদি মেয়ে পছন্দ না হয়?
ন’দিদি বললে—পছন্দ হবে না মানে? ডানা বসিয়ে দিলেই উড়ে যাবে, মেয়ের এমন রূপ! রূপের কথা আর বলতে হবে না, রূপ তুই তোর বউ-এর সঙ্গে মিলিয়ে নিবি, যদি এ-ছটাক নিরেস হয় তো তখন আমাকে দুষিস্
—কিন্তু তুমি সব খুলে বলেছ তো ন’দিদি? আমার ছেলের প্রথম বিয়ের কথা সব খোলসা করে বলেছ তো?
ন’দিদি বললে—আরে, তারা যে সব জানে রে। আমার আপন জা’এর মাসতুতো ভাইয়ের মেয়ে—
—কিন্তু বউ বেরিয়ে গেছে তা শুনেও এখানে দিতে রাজী হচ্ছে?
—তা রাজী হবে না? ভবানীপুরের শিরিষ ঘোষের নাতির সঙ্গে বিয়ে দিতে কলকাতা শহরের কে পেছ্পা হবে শুনি? তুই কাপড় বদলে নে—
তা সেই ব্যবস্থাই হলো। নয়ন কাপড় বদলে নিলে একটা মলমলের ফরসা ধোপার- বাড়ির থান। মুখখানা মেজে ঘষেও নিলে। বাতাসীর মা’কে ডেকে পাঠালেন মা-মণি। বললেন—সব রইল, বুঝলে বাতাসীর-মা, আমি ন’দিদির সঙ্গে বেরুচ্ছি সন্ধ্যেবেলা ফিরবো—
—তোমার খাওয়ার কী ব্যবস্থা করবো?
মা-মণি বললেন—কী আবার করবে, যা রোজ হয় তাই করবে! চারখানা ফুলকো লুচি আর আলুভাজা ছাড়া আমি আর কী সোনাদানা খাই এমন শুনি?
বাতাসীর মা বললে—কিন্তু ঘি যে নেই আর—
মা-মণি রেগে গেলেন। বললেন—এই যাবার সময় আমায় বলতে এলে ঘি নেই? কাল মনে পড়েনি?
—কালই তো বলেছি সরকারবাবুকে।
মা-মণি এবার একটা হেস্তনেস্ত না-করে যেন ছাড়বেন না। বললেন—কোথায় সরকাবাবু, ডাকো তাকে, আমি একটা এর হেস্ত-নেস্ত করে তবে বেরোব—
বাতাসীর মা বললে—সরকারবাবু যে নেই এখন, সকাল বেলা দেশে গেছেন—
–দেখেছ ন’দিদি, আমায় সবাই মিলে এমন করে পাগল করলে আমি বাঁচি কী করে? এরা আমায় একটু সুস্থির হয়ে বাঁচতেও দেবে না? আমি আর জন্মে কত পাপ করেছিলুম বলো তো?
তারপর হঠাৎ বাতাসীর মা’র দিকে নজর পড়তেই মনে পড়ে গেল। বললে—তুমি আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন বাতাসীর মা? যাও, আমি কিচ্ছু খাবো না, আমি ছাই খাবো, আমাকে দুটো উনুনের ছাই তুলে দিও পাতে—যাও এখন এখান থেকে—
বাতাসীর মা চলে গেল। মা-মণি বললেন—দেখলে তো ন’দিদি, কেমন আমার সংসার! এই পোড়া সংসার করতে কারো সাধ হয়?
ন’দিদি বললে—থাম্, আর কাঁদিসনে, বউ এলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন চল্—
নয়ন উঠলো। ন’দিদিও উঠলো। ঘরের দরজায় চাবি লাগালো নয়ন। লাগিয়ে চাবিটা কোমরের ঘুনসিতে আটকে দিলে। মা-মণি আজ আবার ঘোষ-বাড়ির গৃহিণী সেজেছেন। সাদা ফিতে পাড় থান্। মাথায় সাদা চুলের খোঁপা। সাদা ধপধপে গায়ের রং। পবিত্রতার প্রতিমূর্তি যেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ন’দিদি বললে—হ্যাঁ রে, তোর ছেলে কোথায়?
—আবার কোথায়? বই মুখে দিয়ে রয়েছে—
–ছেলে রাজী আছে তো? ছেলের মত আছে?
—খবরদার ন’দিদি! ছেলেকে আমি বলছি নে। আমি নিজের পেটের ছেলের বিয়ে দেব, তাতে ছেলের মতামতের ধার ধারবো? আমি কি ছেলের খাই, না ছেলের পরি?
—কিন্তু ছেলে যদি শেষে বেঁকে বসে?
নয়ন বললে—তেমন ছেলে আমি গভ্যে ধরিনি ন’দিদি! আর শুনেছ বোধহয় একটা কথা, বউ আবার পালিয়েছে?
ন’দিদি বললে—সে তো জানিই!
—না না, সে-পালানো নয়, পাশের বাড়ির কোন্ এক ছোঁড়ার সঙ্গে পীরিত জমিয়ে পালাচ্ছিল, পুলিসে ধরেছে ছোঁড়াটাকে! সোনাও জানে সে-কথা!
ন’দিদি বললে—সে কী রে? ছি ছি ছি—কে বললে তোকে?
—সেই ছোঁড়াটারই আপিসের বড়-সাহেব! সে নিজে এসে জানিয়ে গেল। আহা, ভারি ভাল ছেলে ন’দিদি। মা বলতে একেবারে অজ্ঞান! কে এমন করে বাড়ি বয়ে এসে বলে বলো তো!
—তা ছেলে শুনে কী বললে?
নয়ন বললে—সেই শুনে এস্তোক্ তো একটু সেয়ানা হয়েছে। নইলে আমি অ্যাদ্দিন যখন বউ-এর নামে বলতুম তখন তো কানে যেত না। তখন ভাবতো মা মাগী পর, এখন বুঝেছে ঠেলাটা! এখন আর মুখে কথা নেই, এখন আরো বই মুখে দিয়ে পড়ে থাকে দিন রাত—
তারপর একটু থেমে বললে—তা এখন আমিও কিছু আর বলি নে।
—ভালোই করিস। এখন আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে কাজ নেই। হাজার হোক, পেটের ছেলে বলে কথা! কত নাড়ি ছিঁড়ে যে ছেলের জন্ম দেয় মা, ছেলে তা বুঝবে কেমন করে, বল্? ছেলেই যদি মায়ের দুঃখু বুঝতো তো পৃথিবী উল্টে যেত নয়ন, উল্টে যেত—
ন’দিদির গাড়ি তখন হু হু করে কলকাতার রাস্তা ধরে চলেছে। ন’দিদির নিজের গাড়ি। নয়নরঞ্জিনী দাসী তখন নিজের দুঃখের কথাই বলে যাচ্ছিল। একদিন তারও গাড়ি ছিল। একদিন তার গাড়িতেও কত লোককে তিনি চড়িয়েছেন। একখানা নয়, দুখানা। ন’দিদির গাড়িতে চড়ে সেই কথাই তার হঠাৎ মনে পড়লো।
নয়ন বললে—আচ্ছা, দেনা-পাওনার কথাটা বলেছ তো ওদের?
ন’দিদি বললে—বলিছি বৈ কি! ওই তো একই মেয়ে। ক’ভরি গয়না চাস্ তুই বল্—আর নগদ কত নিবি তাও বল্?
—গয়না তারা যা দেবে তাই-ই দিক, কিন্তু ঘর থেকে তো খরচ করে আমি ছেলের বিয়ে দেব না—
—তা কত নগদ নিবি বল্ না!
নয়ন বললে—আমি বড় ঠকিচি প্রথম বিয়ে দিয়ে ন’দিদি। আমি কি তখন জানতুম বেয়াই মস্ত বড় লোক! সে যা-ঠকান্ ঠকিচি সে আর বলার কথা নয়, শুনলে লোকে হাসবে! এবার আমি শুধু নগদ একটু বেশি নেব—
ন’দিদি বললে—তবু কত নিবি?
—কত নিলে ভালো হয়, তুমিই বলো না ন’দিদি? তুমিই যখন বরের ঘরের মাসী আর কনের ঘরের পিসি—
ন’দিদি বললে—আমি কী বলবো বল্। তোর কত হলে চলবে, সেইটে আগে বল্?
নয়ন বললে—তাহলে তোমাকে সব খুলেই বলি ন’দিদি। তুমি তো আমার অবস্থার কথা সব জানো। গাড়ি পর্যন্ত বেচে দিতে হলো আমাকে। তিরিশ লাখ টাকার সম্পত্তি— নগদে সম্পত্তিতে ছিল আমার, সব উকীল খেয়েছে। এখনও পুলিসের হুলিয়া ঘুরছে সেই উকীলের পেছনে—সে টাকার আশা আমি ছেড়ে দিয়েছি ন’দিদি। তার আশা আর আমি করিনে, এখন ঝি-চাকরের মাইনে বাকি পড়েছে ক’মাস ধরে, তাও আমি দিতে পারছিনে—
—তা কত নিবি, খুলে বল্ না?
নয়ন বললে—বেশি বলবো না ন’দিদি, তোমার কুটুম, তিরিশ হলেই আমার আপাততঃ চলবে—
ন’দিদি বললে—তা ঠিক আছে—মেয়ের তো ভাইও নেই, আর একটা বোনও নেই, বাপ মারা গেলে সব সম্পত্তি তো এই মেয়েই পাবে! তা সব মিলিয়ে মেয়ের বাপের সম্পত্তিও তো কম নেই রে। কুড়িয়ে বাড়িয়ে লাখ দশেক টাকার সম্পত্তি বেকসুর পাবে তোর ছেলে—
তা বাগবাজারে পৌঁছে মিত্তিরদের বাড়ি দেখে নয়নরঞ্জিনী দাসী চমকে উঠলো। এককালে যখন বাড়ির মালিকের অবস্থা আরো ভালো ছিল, তখন এ-বাড়িরই চেহারা ছিরি অন্যরকম। বড় বড় থাম। থামের মাথায় চুন-বালির পরী বসানো। পরীদের এখন ডানা, হাত-পা ভাঙা অবস্থা। বাগানে ঘাসও নেই এখন। কিন্তু এককালে ছিল। মোষের খাটাল হয়েছে বাগানের কোণের দিকটায়। দেয়ালের ইঁট বেরিয়ে আসছে জায়গায়- জায়গায়। কিন্তু তা হোক, মা-মণি দেখে বুঝলেন—এরা বনেদী পরিবার বটে!
খুব খাতির করলে মিত্তির-গিন্নী। বললে—আমার তো আর কোনও সাধ নেই দিদি, এই মেয়েটির বিয়ে দিয়েই আমি মনের সব সাধ মিটিয়ে নেব—
কথাগুলো কেমন যেন লাগলো! ন’দিদি বলেছে তো সব এদের? এত টাকা নগদ দেবে, এত রূপসী মেয়ে, তবু দোরে বিয়ে দিচ্ছে। এতে অবাক হবারই তো কথা।
ন’দিদি বললে—নয়নেরও তো কোনও সাধ মেটেনি, ধরে নাও সেই প্রথম বিয়েটা বিয়েই নয়—নামেই শুধু বিয়ে—
নয়ন বললে—ন’দিদি আমার সমস্তই জানে—
মিত্তির-গিন্নী বললে—ইনি আপনারও ন’দিদি, আমারও ন’দিদি! ন’দিদি আমাদেরও সমস্ত কিছু জানে! কর্তা তো তাই বললেন—উনি যখন মাঝখানে রয়েছেন, তখন আর আমাদের ভাবনার কী আছে। আর আপনাদের নাম করলে কলকাতায় কে না চিনবে?
মা-মণি বললেন—সে-সব দিনকাল আর নেই ভাই, এখন দুবেলা দুমুঠো খেতে পাচ্ছি, এই-ই যথেষ্ট—
ন’দিদি বললে—তা কর্তাকে তোমরা বলো ছেলের সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে, আমার কথায় বিশ্বাস করো না বাপু—
মা-মণিও বললেন—হ্যাঁ তোমরা খোঁজ-খবর নাও, তারপর অন্য কথা— মিত্তির-গিন্নী বললে—আপনার ছেলের আবার খবর কী নেব দিদি, আপনি দয়া করে আমার মেয়েকে ঘরে ঠাঁই দেবেন, তাহলেই ওর ভাগ্যি—
মেয়েটিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে সামনে এনে দাঁড় করালে মিত্তির-গিন্নী। গা-ময় গয়না। মেঝের ওপর একটা কার্পেটের আসন পাতা ছিল, তার ওপরেই বসানো হলো। বেনারসী দিয়ে মোড়া। মাথা থেকে পা পর্যন্ত জড়োয়াতে ভর্তি। মিত্তির-গিন্নী বললে—এই গয়না- গাঁটি গড়িয়ে রেখেছি দিদি। এখন আপনারা দিন স্থির করে দু’হাত এক করলেই হয় – ন’দিদি মা-মণি দুজনেই অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। ন’দিদি জিজ্ঞেস করলেন—কী নাম তোমার মা?
মিত্তির-গিন্নী অভয় দিয়ে মেয়েকে বললে—বলো, নাম বলো?
—লীলারাণী দাসী।
ন’দিদি বললে—বাঃ, বেশ নাম, তুই ভালো করে জিজ্ঞেস-পাতি করে নে নয়ন, শেষে যেন দুষিস্ নে আবার আমাকে।—লেখা-পড়া শেখেনি, সে তো তোকে আগেই বলে রেখেছি—
মা-মণি তখনও এক মনে চেয়ে দেখছিলেন পাত্রীর দিকে। ঠিক এমনটিই তিনি চেয়েছিলেন সেবার। ঠিক এমনি নরম-নরম স্বভাব। এমনি মোমের পুতুলের মত। বেশ নম্র স্বভাব। কেমন মাথা নিচু করে মা-মণির পায়ে হাত ঠেকিয়ে মাথায় ছোঁয়াল। বেশ ছোট মানাসই কপাল। কান দুটো পাতা। ঠোঁট জোড়া পাতলা। বয়েসও এমন কিছু বেশি নয়। সতেরোর মধ্যেই। পায়ের আঙুলগুলো গোল গোল টোপা কুলের মত। গায়ের রংটাও দুধে-আলতা। ন’দিদি নিজেই মেয়ের হাত-পিট-কোমর টিপে টিপে দেখলে। হাতের পাতার উল্টো পিঠটা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে দেখতে লাগলো। তারপর সব কিছু দেখে বললে—কী রে নয়ন, এখন মেয়ে পছন্দ হলো কি না বল্ – তোর বউ, তুই দেখে শুনে বাজিয়ে নিয়ে যাবি, আমার কী? আমি কে? আমি তো মাসী রে! মাসীর সংসার তো আর করবে না। যার সংসার করবে সে দেখাই ভালো—
মিত্তির-গিন্নীও তাই বললে—তা তো বটেই ন’দিদি, আমার মেয়েকে আপনি বউ করবেন, দেখে শুনে নেবেন বৈ কি! আমার নিজের পেটের মেয়ে বলে বাড়িয়ে বলছি না, ও মেয়েই আমার লক্ষ্মী। যার ঘরে যাবে তারও ঘর লক্ষ্মীমন্ত হয়ে উঠবে—
ন’দিদি বললে—তা তোর কেমন লাগলো খুলে বল নয়ন। এ আপনা-আপনির মধ্যে লুকোচুরির তো কিছু নেই—পছন্দ হয়েছে তোর!
মা-মণি বললেন—পছন্দের কথা যদি বলো ন’দিদি তো আমার এখুনি বাড়িতে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে—
মিত্তির-গিন্নী বললে—তা নিয়ে যান না দিদি, ও তো এখন থেকে আপনারই মেয়ে হয়ে গেল—
ন’দিদি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে—কী রে, লীলা, যাবি মা তুই? দেখে আসবি কেমন শ্বশুর-বাড়ি—
লীলারাণীর মুখটা আরো নিচু হয়ে গেল লজ্জায়। মিত্তির-গিন্নী বললে—ওকে আবার জিজ্ঞেস করছো কেন ন’দিদি, আমি যখন বলছি তখন ও আর কী বলবে, আমার মেয়ে তেমন নয়—
ন’দিদি বললে—তবে চল্, তোকে নিয়েই যাই—
মা-মণি বললেন—সত্যি-সত্যিই যে তুমি নিয়ে যাচ্ছ ন’দিদি?
ন’দিদি বললে—তা নিয়ে গেলে দোষটা কী, মেয়েও চলুক, ওর-মা-ও চলুক—
মিত্তির-গিন্নী বললে—না না, আমাকে আবার কেন? মেয়েকেই তোমরা নিয়ে যাও ন’দিদি, আমি তো পরে যাবোই—
কিন্তু ন’দিদির যে কী ঝোঁক! গাড়ি রয়েছে সঙ্গে। কোনই অসুবিধে হবে না। ন’দিদির যখন কুটুম, তখন নয়নেরও কুটুম। আর কুটুম এখন না-হলেও দুদিন পরে তো কুটুম হবে! তখন তো হামেশাই দেখা-সাক্ষাৎ হবে।
ন’দিদি বললে—নাও, তোমার মেয়ের গয়না-টয়না খুলে মোটমুটি সাজ করিয়ে দাও, তুমিও সঙ্গে চলো, বাড়ির মধ্যেই তো সারাদিন থাকো, একেবারে না হয় কালিঘাটের মন্দিরে মা’কে দর্শন করেও আসবে—
অনেক দিন পরে মা-মণির বুকের ভারটা যেন একটু হাল্কা হলো। মেয়ে-মা তখন ভেতরে গেছে। ন’দিদি বললে—দেখ নয়ন, এই বউ যা করে দিলুম তোকে, যখন সংসার করবি, তখন আমাকে বলিস্ —
নয়ন বললে—দেনা-পাওনার কথাটা তো তুললে না তুমি ন’দিদি—
—আঃ তুই থাম্ তো! মাঝখানে যখন আমি আছি তখন তোর ভয়টা কি! মেয়ের গায়ের গয়নাগুলো তো তুই স্বচক্ষে দেখলি, কম করে ওর দামই তো বিশহাজার টাকা হবে—
—কিন্তু নগদ?
—নগদের জন্যে অত ভাবছিস কেন তুই? তোকে তিরিশ হাজার টাকা পাইয়ে দিলেই তো হলো?
এর পরে আর কোনও কথা চলে না। মা-মণি যেন কেমন অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন, এমন মেয়ে থাকতে তিনি কী ঘোড়া মুখো বউই করেছিলেন মরতে। ব্যারিস্টার পালিতের কথায় কী লোকসানটাই না কপালে ছিল! আর শুধু কি লোকসান! দুর্ভোগটারই বা দাম দেয় কে? ন’দিদি বললে—আর এই বাড়ি দেখছিস তো, বাপ-মা’র অবর্তমানে এই মেয়েই তো সব পাবে রে-এ-বাড়ির দামও তো কম করে লাখখানেক টাকা হবে—
মা-মণির সব দেখে শুনে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো। বললেন—শেষকালে পিছিয়ে যাবে না তো ন’দিদি?
ন’দিদি বললে—পেছবে কেন? আমি তো আছি মাঝখানে। আমার জা’য়ের মাসতুতো ভাই-এর মেয়ে—তোর টাকা-কড়ি চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা যেন আবার খুলে বলিস নে-দ্যাখ্ না কী হয়—। আর সেইজন্যেই তো নিয়ে যাচ্ছি তোর বাড়িতে দেখাতে—
—তা আমার প্রথম বউ-এর ব্যাপারটা খুলে বলেছ তো তুমি ওদের?
—তোকে তো বললুম সব খুলে বলিচি। এমন ছেলে তো কোথাও পাবে না। এরা তো বনেদী-ঘরই চায়!
মা-মণি তখনও চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। একমাত্র মেয়ে। এই মেয়েই একদিন সব কিছু পাবে! আর ক’টা বছর মাত্র। তিরিশ হাজার টাকা। আর তার সঙ্গে বিশ হাজার টাকার গয়না। মনে মনে মা-মণি তাঁর ইস্টদেবতাকে স্মরণ করতে লাগলেন।