কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৪
৪৪
এক ঘন্টা আগে গড়িয়াহাটেও ভোর হলো। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে চা নিয়ে এল রঘু। সতী বিছানা থেকেই হাত বাড়িয়ে নিলে চা। বললে—কেউ এসেছিল রে রঘু?
রঘু বললে—কই, কেউ তো আসে নি—
—রাত্তিরে, আমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম তখন?
—না ছোটদিদিমণি, কেউ আসে নি তো—
আশ্চর্য। কেউ আসেনি! চায়ে চুমুক দিয়ে সতী উঠে বসলো। রঘু চলে গেল বাইরে। রঘুর অনেক কাজ। একলা সে সারাদিন ধরে রান্না করবে। বাজার করবে। ঘর ঝাঁট দেবে। লক্ষ্মীদি যাবার আগে টেলিফোন লাইনটাও কেটে দিয়ে গেছে।
সতী আবার ডাকলে—রঘু—
রঘু আসতেই সতী বললে—খবরের কাগজ আসে না এ-বাড়িতে?
রঘু বললে—ক’দিন থেকে তো কাগজ দিচ্ছে না কাগজওয়ালা। আমি দেখতেই পাইনি ক’দিন তাকে —
সত্যিই কোনও খবরের কাগজ নেই কলকাতা শহরে। সারা ইন্ডিয়াতে কোথায় কী হচ্ছে, তা গভর্নমেন্টকে আগে জানিয়ে তবে ছাপাতে হবে নিয়ম হয়েছে। তারই প্রতিবাদে কোনও খবরের কাগজ বেরোচ্ছে না। বেরোচ্ছে শুধু বুলেটিন। সেই বুলেটিন লুকিয়ে লুকিয়ে বিলোন হচ্ছে।
রঘু এসে একখানা কাগজ দিয়ে গেল। বললে—এই চিঠিখানা পড়ে ছিল দিদিমণি জানালার নিচে।
—চিঠি নাকি?
সতী কাগজখানা হাতে নিয়ে দেখলে। সাইক্লোস্টাইল করা একটা কাগজ। ওপরে বড় বড় করে লেখা আছে—
Mahatma Gandhi’s last Message
Everyman is free to go to the fullest length under Ahimsa by complete deadlock, strike and all other non-violent means. Satyagrahis should go out to die and not to live. It is only when individuals go out to seek and face death that the Nation will survive, Karenge ya Marenge.
—এটা কে দিলে তোমাকে?
রঘু বললে—খবরের কাগজ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম এইটে পড়ে আছে—
রঘু চলে যেতেই সতী কাগজটাকে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলে বাইরে। রেল-লাইনের ওপর দিয়ে বোধহয় একটা ট্রেন আসছিল। গুম্ গুম্ আওয়াজ হচ্ছে। সতী একমনে শুনতে লাগলো শব্দটা। এত কাছে মনে হয়। মনে হয়, যেন গাড়িটা বাড়িটার মাথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক-একবার বিকট শব্দ করে হুইশল্ দেয়। কাল রাত্রে ঘুমের ঘোরেও ওই শব্দটা তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। কালকের স্বপ্নটার কথাও মনে পড়লো। আশ্চর্য! স্পষ্ট যেন দীপঙ্করকেই এই ঘরের মধ্যে দেখতে পেয়েছিল সে। একেবারে এই ঘরের বিছানার ওপর। আশ্চর্য! স্বপ্নগুলোকেও এমন সত্যি বলে মনে হয় মাঝে-মাঝে!
রঘু কাছাকাছি বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল। সতী আবার ডাকলে—রঘু—
রঘু এল। সতী বললে—তুমি আমার সঙ্গে একবার যেতে পারবে রঘু? —কোথায়?
সতী বললে—তোমার রান্না-বান্না হয়ে যাবার পর। কাজ-কর্ম সেরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার সঙ্গে একবার যেতে পারবে না? এই ধরো, ভবানীপুর পর্যন্ত?
রঘু জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু বাড়িতে কে থাকবে? আমাকে দিদিমণি বাড়ি ছেড়ে যেতে বারণ করেছে—
—তা হোক, তুমি তো আমার সঙ্গে যাবে। তালা-চাবি দিয়ে যাবো, আবার একটু পরেই ফিরে আসবো?
রঘু বললে—কিন্তু কোথায় যাবেন আপনি দিদিমণি?
—বেশি দূর নয়, ধরো ভরানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক রোড পর্যন্ত?
—সেখানে কী করতে যাবেন আপনি?
সতী বললে—কিছু না, এমনি, তুমি শুধু একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে আসবে একজন ভদ্রলোক কেমন আছেন, আর আমি বাইরে ট্যাক্সিতে বসে থাকবো।
—আমি ভেতরে গিয়ে কার নাম করবো? কী বলে ডাকবো?
—সে তোমাকে ভাবতে হবে না।
রঘুর একটু কৌতূহল হলো বোধ হয়। চলে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে—সেটা কাদের বাড়ি?
সতী বললে—তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। আমার খুব চেনা বাড়ি সেটা-কেউ তোমায় কিছু বলবে না।
—আর যে-ভদ্রলোকের খবর নিতে যাবো, তিনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি কোত্থেকে আসছি, তখন কী বলবো?
সতী বললে—তোমাকে কিছু উত্তর দিতে হবে না, তুমি বলবে তোমাকে একজন খবর আনতে পাঠিয়েছে—আর কিছু বোল না যেন। ভুলেও যেন আমার কথা বলে ফেলো না—
—তা বলবো না। কিন্তু তারা আমাকে ছাড়বে কেন? আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে পারে।
—জিজ্ঞেস করলেও তুমি বোল না। তুমি তাড়াতাড়ি বাইরে চলে এসো। আমি গলির বাইরে একটা ট্যাক্সিতে বসে থাকবো—
—কিন্তু তিনি কে দিদিমণি?
সতী একটু বিব্রত হয়ে পড়লো। কিন্তু এক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে—সে তাঁকে তুমি চিনবে না রঘু, আমার খুবই আপন জন—
তারপর একটু থেমে বললে—যা হোক, তোমাকে এ-সব ভাবতে হবে না, বেশিক্ষণও তোমাকে বাইরে থাকতে হবে না, আমার ট্যাক্সি করে যাবো আর চলে আসবো—
তারপর সত্যিই রঘু খুব তাড়াতাড়ি করতে লাগলো। তাড়াতাড়ি উনুনে কয়লা দিয়ে আগুন ধরালে। ভাত চড়ালে। তারপর বাজার। দৌড়তে দৌড়তে বাজারে গিয়ে মাছ তরকারি কিনে আনলে। সতীও তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিলে। তারপর……তারপর হঠাৎ তার মনে পড়লো শাড়িগুলো তো সবই পড়ে আছে প্যালেস-কোর্টে। একটা শাড়িও তো সঙ্গে করে আনা হয়নি। সোজা হাসপাতাল থেকেই দীপু তাকে এখানে এসে তুলেছে।
ডাকলে—রঘু—
রঘু আসতেই সতী বললে-রঘু, তোমার দিদিমণির শাড়ি-ব্লাউজ কিছু নেই? আমি তো আসবার সময় কিছুই নিয়ে আসিনি—
রঘু বললে—তা তো আমি জানি না দিদিমণি, এই পাশের ঘরের চাবি তো দিদিমণি আপনার হাতেই দিয়ে গেছেন, আপনি এই ঘরটা খুলে দেখুন না—
সত্যিই অনেক জিনিসপত্র শেষ পর্যন্ত রেখে গিয়েছিল লক্ষ্মীদি। একটা খাট, একটা মীট-সেফ্, কিছু ছোটখাটো ফার্নিচার, দু’ একটা ট্রাঙ্ক। একটা পুরোন ট্রাঙ্কের ভেতরেই দু’ একটা শাড়ি পাওয়া গেল। যেগুলো লক্ষ্মীদি পুরোন বলে ফেলে রেখে গিয়েছে। সব জিনিসপত্র দিল্লি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শাড়ি-ব্লাউজগুলো বার করে দরজায় আবার তালা লাগিয়ে দিলে সতী। তারপর নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পরে দেখলে। দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাটা দেখতে লাগলো একমনে। ভেতরে রঘু রান্না করছে। কোথাও কেউ নেই। অনেকক্ষণ সতী নিজের চেহারাটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখতে লাগলো আয়নাতে। এই চেহারা, এই মুখ, এই চোখ, এই চুল–এর দিকে কোনওদিন চেয়ে দেখেন নি তিনি। কোন্ শাড়ি পরলে তাকে ভালো মানায় তাও মুখ ফুটে কখনও বলেন নি! কী অদ্ভুত মানুষটা। এক- একবার মনে হয়, মানুষটা যেন নিষ্প্রাণ, নির্জীব পাথর। আবার সত্যিই যা ভাবে সতী, আসলে হয়ত মানুষটা তা নয়। হয়ত দেবতা। সত্যিই দেবতার মত রূপ, দেবতার মত মন, দেবতার মত ব্যবহার। কেন এমন হয় কে জানে! আস্তে আস্তে ঠিক কপালের মধ্যে দুটো ভ্রূর মাঝখানে ছোট করে কুঙ্কুমের একটা টিপ্ লাগিয়ে দিলে। সমস্ত মুখখানা কী চমৎকার দেখাতে লাগলো। সতী নিজের মুখখানার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন সুন্দর আমি! আমি এত সুন্দর!
তারপর শাড়িটা সমস্ত শরীরে জড়িয়ে বাঁদিকের কাঁধে ফেলে দিলে।
একটা হাল্কা লাল রঙের শাড়ি। ব্লাউজটা সাদা। কাঁধে গলায় গালে কপালে সব জায়গায় ফেস্-পাউডার বুলোতে লাগলো আপন মনে। সতীর মনে হলো যেন নিজের শরীরটা নিয়ে নিজেই খেলা করে। নিজেই নিজের গাল দুটো টিপে ধরলে। আরো জোরে টিপ্লে। আরো জোরে। কেমন যেন একটা লালচে দাগ হয়ে গেল দু’টো গালের দু’দিকে। কই, লাগেনি তো মোটে। গাল টিপ্লে তো কই লাগে না মোটে। শুধু লাল হয়। নিজের ঠোঁটটা নিয়েও আঙুল দিয়ে মোচড়াতে লাগলো। ঠোঁটটা তার খুব নরম তো! এত নরম, অথচ লাগলো না মোটে। নিজের শরীরটার সব জায়গাতে টিপতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো যেন টিপ্লে খুব ভালো লাগে। হাত-পা-গাল-ঠোঁট-কোমর সমস্ত —
তারপর হঠাৎ কী যে হলো, সতী আয়নাটার সামনে আরো ঝুঁকে পড়লো। একেবারে নিজের ছায়ার মুখোমুখি। তার ছবিটার সঙ্গে যেন ছোঁয়া লেগে যাবে। বড় কাছাকাছি। বড় ঘেঁষাঘেঁষি নিশ্বাসের বাতাস লাগছে নিজের ছবির ওপর। তারপর হঠাৎ নিজের ঠোঁট দু’টো ঠেকিয়ে দিলে আয়নার গায়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো নিজের ছবিটাও যেন ঠোঁট দুটো দিয়ে তাকে চুমু খাচ্ছে। সতী আর সামলাতে পারলে না। তার সমস্ত সত্তা দিয়ে সতী ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে রইল ঠান্ডা আয়নার ওপর। তার সমস্ত শরীর যেন আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসতে লাগলো—