কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৭
৪৭
সকাল বেলাও দীপঙ্কর জানতো না। একটার পর একটা প্রশ্ন শুরু হয়েছে। যুদ্ধের বড় দুর্বৎসর সেই উনিশ শো বেয়াল্লিশ সাল। অ্যালায়েড পাওয়ার্স-এর চোখের সামনে তখন আলোর সামান্য একটু রেখা দেখা দিয়েছে সবে। স্ট্যালিন-গ্র্যাড্ তখনও জার্মান আর্মির টাঙ্কের সামনে অচল-অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নর্থ আফ্রিকাতে জেনারেল মন্টগোমারী আরো জোরে এগিয়ে চলেছে ফিল্ডমার্শাল রোমেলের দিকে। সেকেন্ড ফ্রন্ট খোলবার কথা বলছে রাশিয়া। বলছে—তোমরা আরো একটু চাপ দাও। তোমরা চাপ দিচ্ছ না বলে রাশিয়াকে একলা একশো বাহাত্তরটা জার্মান ডিভিসনের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে—কিন্তু আর কতদিন তারা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? ওদিকে যখন হোয়াইট-সী থেকে ব্ল্যাক-সী পর্যন্ত সমস্ত জায়গাটা জুড়ে তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ জার্মান আর রাশিয়ান লড়াইতে মেতে আছে, তখন চার্চিল পৃথিবীর সব জায়গা থেকে সব কিছু জোগাড় করে পাহাড় করে তুলেছে। লিবিয়া, ইথিওপিয়া, সিসিলি, সার্ডিনিয়া সব জায়গায় আঘাত করবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। চারদিকের সমস্ত গোলমালের মধ্যে ইন্ডিয়াতেও গোলমাল বেধে গেছে। ইন্ডিয়া বলছে—করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে—
মহাত্মাজী বলেছেন— You have to forsake wife, friends, for sake everything in the world. Even if all the United Nations opposed me, even if the whole of India tried to persuade me that I am wrong, I will go ahead, not for India’s sake alone, but for the sake of the world. I have pledged the Congress and the Congress will do or die.
কলকাতা শহরের সমস্ত পাড়ায় এ-আর-পি, সিভিক-গার্ড-এ ভরে গেছে। যে-সব ছেলে এতদিন চাকরি পায়নি, বেকার বসে ছিল, তারা তিরিশ টাকা করে হাতখরচ পাচ্ছে, খাকি পোশাক পাচ্ছে। তাদের মুখে বিড়ি, সিগারেট। তারা পুরো দমে সিনেমার সামনে লাইন দিচ্ছে। হিন্দী সিনেমার পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছে শহর। আর এদিকে সন্ধ্যে হলেই ব্ল্যাক-আউট, পাড়ায়-পাড়ায় সাইরেন-পোস্ট হয়েছে। সরকারী টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। কিন্তু কোথা থেকে কারা ঠিক সন্ধ্যে হলেই বাইরে বেরিয়ে আসে। ইকেলট্রিকের তার কেটে দেয়, মিলিটারি লরীতে ঢিল ছোঁড়ে। তারপর বন্দুকের শব্দ হলেই হুড় মুড় করে ছুটে পালিয়ে হাওয়া হয়ে যায়।
দীপঙ্কর রাস্তায় বেরিয়ে এসে চারদিকে চেয়ে দেখলে। মনে হলো যেন আর-এক নতুন পৃথিবী দেখছে সে। ট্রাম, বাস, লোকজন সবই যেন নতুন লাগলো। মনে আছে, খানিকক্ষণের জন্যে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। লক্ আপের মধ্যে কিছু খবর পেত না, কিছু দেখতে পেত না। শুধু মনে হতো সারা গ্লোবে যেন আগুন লেগেছে। শুধু খাকি পোশাক চারদিকে। কোথা থেকে সব নতুন পুলিসের দল এসেছে। সবাই ব্যস্ত। যেন এক মুহূর্ত দেরি করলে জাপান এসে পড়বে ইন্ডিয়ায়। দীপঙ্কর তাদের দেখতো আর ভাবতো, এত লোক চাকরি পেয়েছে আজ। আজ পৃথিবীর কেউ বেকার তো বসে নেই। ইন্ডিয়ায় একটা বেকার লোকও আজ আর আপিসে-আপিসে ধর্না দিয়ে বেড়ায় না। কেউ ঢুকেছে মিলিটারিতে, কেউ সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে, কেউ ফুড রেশনিং-এ, কেউ এ-আর-পি, কেউ সিভিক গার্ড-এর দলে। কিন্তু যুদ্ধের সময় যদি সবাই চাকরি পেতে পারে তা হলে যুদ্ধের পর কেন পাবে না? সে টাকা কোথায় যাবে? কাদের পেটে? এই পুলিস আর মিলিটারির দল যদি বাড়ি ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে—কেন আমরা বেকার হবো আবার? কেন আমরা আবার বেকার বসে বসে আড্ডা দেব? এতদিন যুদ্ধের কাজে লেগেছি, এখন পিটাইমের প্রোডাকশানের কাজে কেন লাগবো না?
সেই ইনস্পেক্টর ভদ্রলোক সুযোগ পেলেই চলে আসতো। এসে দীপঙ্করকে অভয় দিয়ে যেত। বলতো-আপনার ইকোয়ারী হচ্ছে, আপনার কিছু ভয় নেই—
দীপঙ্কর একদিন বলেছিল—দেখুন, আমার জন্যে ভাববেন না, কিরণের কী হবে বলুন?
ইন্সপেক্টর বলতো—দেখুন, ইন্ডিয়ায় অনেকগুলো, এ-কেস্ হয়েছে, ফিফ্থ্ কলাম্নিস্টদের আর কোনও মাপ্ নেই, ও ফাঁসি হবেই—
—আমার সঙ্গে কিরণের একবার দেখা করিয়ে দিতে পারেন না?
—অসম্ভব স্যার, অসম্ভব! ও ব্রিটিশ-ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের আসামী, ওকে কেউ বাঁচতে পারবে না, কারো বাবার সাধ্যি নেই…..কেবল একজন পারে।
—কে?
—চার্চিল, ইংলন্ডের প্রাইম মিনিস্টার!
দীপঙ্কর একটু থেমে জিজ্ঞেস করেছিল—কবে ফাঁসি হবে?
—তা কেউ জানে না। এ-সব সিক্রেট্ কাউকে জানানোও হয় না। পুলিস কমিশনারও জানে না। সব দিল্লি থেকে হচ্ছে কি না?
বেশিক্ষণ দাঁড়াত না ভদ্রলোক। যখন একটু ফাঁক পেত, তখনই চলে আসতো। তারপর হঠাৎ কথা শেষ হবার আগেই চলে যেত। দীপঙ্কররের ওপর ভদ্রলোকের যেন কেমন একটা মায়া ছিল। বলতো—আপনি ইনোসেন্ট্, তা আমরা জানি, কিন্তু আমাদের তো হাত নেই কিছু, সব দিল্লি থেকে হচ্ছে—
অনেক কথাই ভাবতো দীপঙ্কর একলা বসে বসে। কাশীকে একটা টাকাও দিয়ে আসা হয়নি। বাড়িতে কাশী আছে, ক্ষীরোদা আছে। তারা কী করছে কে জানে! চাল – ডাল-তরী-তরকারি কিনছে কেমন করে। দিন চালাচ্ছে কীভাবে কে বলতে পারে। আপিসেই বা কী ভাবছে মিস্টার ক্রফোর্ড! একা অভয়ঙ্করই সব চালাচ্ছে হয়ত। আর সতী! লক্ষ্মীদি নিশ্চয় দিল্লি চলে গেছে। ভোর সাড়ে ছ’টায় প্লেন ছাড়বার কথা ছিল। হয়ত দীপঙ্করের জন্যে অপেক্ষা করেছিল তারা। কথা দিয়েছিল যাবে। হয়ত ভোর পাঁচটা থেকেই সবাই অপেক্ষা করেছে। সেদিন ভোর পাঁচটা বেজেছে। লক্-আপের বাইরে কোথায় ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজলো, আর ঘরের ভেতরে দীপঙ্করের হৃৎপিন্ডে এসে যেন আঘাত লাগলো পাঁচ হাজার বার! হয়ত তাকে না দেখতে পেয়ে সতীও চলে গেছে লক্ষ্মীদির সঙ্গে। চলে গিয়ে থাকলেই ভালো। এখানে থেকেই বা লাভ কী? বাইরে থেকে কনস্টেবলদের লেট্-রাইটের শব্দ এল। সেই অত ভোরে ট্রামের চাকার ঘর- ঘড় শব্দ শুরু হলো রাস্তায়। আর পুলিস-হেডকোয়ার্টার্সে আরম্ভ হলো প্যারেড। লে- রাইট-লেফ্ট্। ইন্ডিয়াকে সেভ্ করতে হবে, কলোনীকে হাতে রাখতে হবে। হোয়াইট্ ম্যানস্ বার্ডেন। সাদা মানুষের গলগ্রহ। থ্রি-হানড্রেড্-মিলিয়ন লোক খেটে মরবে থার্টি মিলিয়ন জন্-বুলের জন্যে। জাগো। ওয়ার্ডার, জেগে পাহারা দাও। কিরণ চ্যাটার্জি বেঁচে থাকলে জন-বুলের দল খেতে পাবে না পেট ভরে, গাড়ি চড়তে পাবে না। শ-ওয়ালেস, গ্রেন্ডলে, এন্ড্রু-ইয়ুল আর জার্ডিন স্কিনারের দল বেকার হয়ে পড়বে।
সেদিন তাড়াতাড়ি এসে ঘরে ঢুকেছে ভদ্রলোক। বললে—একটা সুখবর আছে স্যার—
—কী খবর? কিরণ ছাড়া পাবে?
ভদ্রলোক তখনও হাঁফাচ্ছে। বললে—না, আপনার রিলিজ্ অর্ডার বেরোচ্ছে— দীপঙ্কর একটু হতাশ হলো। তবু অবাকও হলো।
ভদ্রলোক বললে—ইনভেস্টিগেশন কমপ্লিট হয়ে গেছে, কোয়াইট্ ইনোসেন্ট্—
দীপঙ্কর বললে—আর কিরণ চ্যাটার্জি?
সে-কথার উত্তর না-দিয়ে ভদ্রলোক বললে—আপনার বস্ মিস্টার ক্রফোর্ড একজন ইংলিশম্যান্, তাঁকে রেফার করা হয়েছিল, তিনি আপনার সম্বন্ধে হাইলি বলেছেন, এদিকে ইনটেলিজেন্স রিপোর্টও স্পট্-লেস্—
ভদ্রলোক খবরটা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বললে—আর একটা খবর—আপনাদের সেই মিস্টার ঘোষাল—মনে আছে তো?
দীপঙ্কর বললে— হ্যাঁ, কী হয়েছে তাঁর?
—তার এগেস্টে তো দু’টো চার্জ, একটা স্পেশ্যাল ট্রাইবিউন্যালে, করাপশন চার্জের জন্যে। আর একটা হবে সেস-এ। মার্ডার চার্জ। মিস্ মাইকেল মার্ডারড় হবার সময়, মিস্টার ঘোষাল ওই ফ্ল্যাটেই ছিল, তার এভিডেন্স আছে পুলিসের হাতে—
—কিন্তু কেন মার্ডার করবে মিস্টার ঘোষাল?
—টাকার জন্যে, আবার কিসের জন্যে! ঘুষের চার্জে ছাড়া পেলেও মার্ডার-চার্জে কভিক্শন হবেই—
বলেই ভদ্রলোক চলে গিয়েছিল। তারপর সেল্ থেকে বেরিয়ে কোরিডোরের কাছে আপিসে ঢুকতে হয়েছিল দীপঙ্করকে। যথারীতি নাম-ধাম মিলিয়ে রিলিজ করে দেবার পালা। অনেক পুলিস-অফিসার দাঁড়িয়ে। যে-যার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ তাদের মধ্যে সেই ইনস্পেক্টর ভদ্রলোককে দেখেই দীপঙ্কর এগিয়ে গেল। বললে—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে চাইলে দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বললে—আপনাকে মেনি থ্যাঙ্কস্, আমি আসি তাহলে—
হঠাৎ ভদ্ৰলো যেন অবাক হয়ে গেল। বললে—কাকে বলছেন আপনি?
—আপনাকে!
ভদ্রলোক বললে—কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না, আপনি কে?
ভদ্রলোক বেমালুম অপরিচয়ের ভান করলে। বললে—কাকে কী বলছেন আপনি? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? হু আর ইউ?
এর পর আর দীপঙ্কর দাঁড়ায়নি সেখানে। যে-ভদ্রলোক দিনের-পর-দিন তার সেলে গিয়ে এত কথা বলেছে, এত সহানুভূতি দেখিয়েছে, সেই লোকই একেবারে সম্পূর্ণ বদলে গেল বাইরে। এরই নাম হয়ত পুলিস। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রেস্টিজের আপহোল্ডার।
আবার সেখান থেকে সোজা একেবারে গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে চলে এসেছে। আর কোথাও দাঁড়ায় নি। যখন লক্-আপ্ থেকে ছাড়া পায় তখন দুপুর একটা। দুপুরবেলা পথ ঘাট ফাঁকা ছিল। তবু কলকাতার লোকের হাতে টাকা এসেছে। ট্যাক্সি, বাস-ট্রাম-রিক্শা, সব জিনিসেরই চাহিদা বেড়েছে। টাকা কয়েকটা গুনে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়েছিল। নিশ্চয়ই সতী দিল্লি চলে গেছে। নেই এখানে।
লেভেল-ক্রসিং-এর গেটের সামনে এসে আবার আটকে গেল গাড়ি। ভূষণ মালীই ডিউটিতে ছিল তখন। সেই এক চেহারা। একইভাবে রেড সিগন্যাল দিচ্ছে! গুডস্ ট্রেন আসছে। হয়ত থ্রি-থার্টি-ফোর ডাউন। এইটেই শিডিউল টাইম। ধীরস্থির মানুষটা। এখনি দেখতে পেলেই হয়ত এসে সেলাম করবে সেন-সাহেবকে। এসে দুঃখ করবে। প্রথম প্রথম দেখা হলেই বলতো-রবিনসন সাহেব আর আসবে না হুজুর?
কোথায়ই বা গেল সেই মিস্টার রবিনসন্। আর সেই মিসেস রবিনসন। এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে এলেই বারবার রবিনসন সাহেবের মুখটা মনে পড়ে যেত। অসংখ্য জন্-বুলের মধ্যে কী ভাবে একজন ভদ্রলোক ঢুকে পড়েছিল কে জানে। বেচারা সাহেব ইন্ডিয়া থেকে পভার্টি দূর করতে চেয়েছিল। কী অদ্ভূত কথা। শ-ওয়ালেস্, গ্রিন্ডলে, এন্ড্রু-ইয়ুল, জার্ডিন স্কিনার, বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মাহীন্দ্র থাকতে কোথাকার কে রবিনসন পভার্টি দূর করবে ইন্ডিয়ার!
হঠাৎ গেটা খুলে যেতেই হুড় হুড় করে ট্র্যাফিক চলতে লাগলো সামনের দিকে। ভূষণ মালী তখন গুটি-ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছে।
লাল রং-এর বাড়িটার সামনে যেতেই কেমন খটকা লাগলো।
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমেই দীপঙ্কর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটা তালা ঝুলছে দরজায়! তাহলে সতীও চলে গেছে নিশ্চয়। হয়ত তার আসতে দেরি দেখে লক্ষ্মীদি সতীকেও নিয়ে চলে গেছে। দীপঙ্কর কী করবে বুঝতে পারলে না। আর কিছু দূর গিয়েই রাস্তার বাঁকের মুখে আরো দু-একটা বাড়ি। দীপঙ্কর সেই বাড়িগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একদল ছোট ছেলে বাইরের ঘরে খেলা করছিল। দীপঙ্কর জানালার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে—খোকা, ওই ও-পাশের লাল বাড়িতে যারা থাকতো, তারা কোথায় গেছে বলতে পারো?
—ওরা তো নেই।
–কোথায় গেছে, জানো তোমরা?
—দাঁড়ান্ মা’কে জিজ্ঞেস করে আসি—বলে একজন ভেতরে চলে গেল। তারপর খানিক পরেই দৌড়তে দৌড়তে এসে বললে—তারা দিল্লি চলে গেছে—
দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে—সবাই দিল্লি চলে গেছে?
—হ্যাঁ সবাই। মা বললে।