কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৯
৪৯
সেদিন গড়িয়াহট-লেভেল-ক্রসিং থেকে দীপঙ্কর একেবারে সোজা চলে গিয়েছিল কালিঘাটে। সতীর দিল্লি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর যেন বাইরে মুক্তি পেয়ে গেছে। যেন সতীর ভরণ-পোষণের দায়িত্বটাই তার কাছে বড়, আর কিছু নয়। দীপঙ্কর যেন সেদিনও জানতো না এ-বিচ্ছেদ তার বিচ্ছেদ নয়। জানতো না এই বিচ্ছেদের অসম্পূর্ণতাই তাকে আবার সতীর কাছে টেনে আনবে! অথচ ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে আবার যেতে যেতে মনে হলো ভালোই হয়েছে। সতীর দিল্লি চলে যাওয়া তো মঙ্গল হয়েছে তার পক্ষে! সতী সুখে থাকুক, সতী শান্তি পাক, এই কামনাই তো দীপঙ্কর দিনরাত করে এসেছে! সতী যদি চলে গিয়েই থাকে, তাতে তো দীপঙ্করের আনন্দ হবারই কথা। না চলে গিয়ে সে কী করতো এখানে! বরং সেখানে গেলে শান্ত হবে মনটা। সমস্ত কলকাতাটাই যেন বিষিয়ে দিয়েছিল সতীকে। একদিন তার শুভাশুভ ভেবেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ধনী পরিবারে। যখন সেখানে সুখ পেলে না, এত চেষ্টা করেও যখন সুখী হলো না সে, তখন চলে গিয়েছে ভালোই করেছে। সতী সেখানেই থাক, সেখানে গিয়েই সুখী হকো, শান্তি পাক—
—বাঁ দিকে চলো, বাঁ দিকে।
ডান দিকে মোড় ঘুরছিল ট্যাক্সিটা। আবার বাঁ দিকে চলতে লাগলো। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভেতরে ঢুকে গাড়িটা ছেড়ে দিলে। ভেতরে গাড়ি যাবে না। নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের ভেতরে যেতে গেলে হেঁটে যেতে হয়। বিকেল হবো-হবো। পাড়ার কলে তখনও জল আসেনি। কিন্তু কলের সামনে অনেক ঘড়া-কলসী-বালতি ঘেঁষাঘেঁষি সাজানো। ঠিক সেইরকমই আছে পাড়াটা। এতটুকু বদলায় নি। ভূগোলের এত কিছু বদলে গেল যুদ্ধের এই ক’টা বছরে, কিন্তু এই নেপাল ভট্টাচার্যি লেনটা তেমনি অক্ষয়-অটুট হয়ে আছে। কিরণদের বাড়ির সামনে সেই নর্দমাটায় পর্যন্ত সেই একই রকম দুর্গন্ধ। কেমন করে কিরণের মাকে খবরটা দেওয়া যায়, তাই ভাবতে লাগলো।
—মাসীমা!
বাড়ির সামনে এত মাস ধরে পুলিস-পাহারা ছিল, আজ আর তা নেই। তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে এখন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টর সব ভাবনা চুকেছে। কিরণকে ধরে নিশ্চন্ত হয়েছে স্যার জন হার্বার্ট। নিষ্কন্টক হয়েছে ইন্ডিয়া। এবার জাপান আসুক, আর অ্যাক্সিস পাওয়ার্সই আসুক, কোনও দুর্ভাবনা নেই আর। যে যত চাও মিলিটারি কন্ট্র্যাক্ট দিচ্ছি। চালের, নুনের, কাপড়ের এজেন্সি দিচ্ছি। সে-সব ব্ল্যাক-মার্কেট করে লাল হয়ে যাও, কিন্তু ইন্ডিয়ার ফ্রিডম চেয়ো না। ইন্ডিয়ানদের অবস্থা ভালো করতে চেয়ো না। ইন্ডিয়ানদের পেট-ভরা খাবার চেয়ো না। তোমরা যে-ক’জন বড়লোক আছো, সেই ক’জনকে আমরা আরো বড়লোক করে দেব, তোমাদের রায় সাহেব, রায়-বাহাদুর টাইটেল দেব, এমনকি তোমাদের কাউকে-কাউকে নাইট করে দেব, কিন্তু খবরদার, তার বেশি কিছু চেও না। তা যদি চাও তো, তোমাদের কিরণ চ্যাটার্জির মত অবস্থা করবো। আমরা লর্ড সিংহ বানিয়েছি একজনকে, তার জন্যে তোমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমরা কত লোককে নাইট করে দিয়েছি, কত রায়-সাহেব কত রায়-বাহাদুর বানিয়েছি, তবু তোমরা ফ্রিডম চাও ইন্ডিয়ার?
অনেকক্ষণ দরজা ঠেলতে হলো। মাসীমা বোধহয় প্রথমে শুনতে পায়নি। হয়ত ভেবেছ আবার পুলিস এসেছে থানা থেকে। এমনি বছরের পর বছর জীবন অবিষ্ঠ করে তুলেছে কিরণের মা’র
—ওমা, তুমি দীপু! আমি ভাবি কে না কে! কী খবর বাবা?
মাসীমার মুখের ওপর কথাটা বলতে দীপঙ্করের কেমন সঙ্কোচ হলো।
মাসীমা বললে—আজকে মাসের পয়লা নাকি বাবা?
দীপঙ্কর বললে—না পয়লা তারিখ নয়, তবু এলাম একবার দেখতে—
কথাটা শুনে মাসীমার চোখে জল এল। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললে—তুমি আমার জন্যে যা করছো বাবা, আমার নিজের পেটের ছেলেও তা কখনও করেনি। তোমাকে আশীর্বাদ করি বাবা, তুমি বিরজীবী হও-—
দীপঙ্কর বললে—আমি আপনাকে নিতে এসেছি মাসীমা—আপনি চলুন আমার সঙ্গে—
মাসীমা বললে—আমাকে আর যেতে ব’লো না বাবা, তুমি আমার জন্যে যথেষ্ট করেছো, তোমাকে আর বেশি কষ্ট দিতে চাই না—
—সেই জন্যেই তো বলছি আপনি চলুন। আমাকে আপনি কিরণের মতই মনে করবেন মাসীমা, মনে করবেন আমিই আপনার কিরণ!
মাসীমার গলাটা যেন খানিকক্ষণের জন্যে বন্ধ হয়ে এল। বললে—তার নাম আর আমার সামনে কোর না বাবা, সে মরে যাক্, তার ফাঁসি হোক, আমার তাতে কিচ্ছু এসে যায় না—যে-কিরণকে আমি পেটে ধরেছি, সে মরে গেছে! মরে গেছে বালাই চুকে গেছে।—
দীপঙ্কর বললে—তা হোক, আমি আপনাকে আমার কাছে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো—আপনি আপত্তি করতে পারবেন না—আর আপনার এখানে যদি কারো কাছে কিছু ধার থাকে, তাও বলুন, আমি সব মিটিয়ে দেব—
—না বাবা, আমি যাবো না, আমি এখানেই মরে পড়ে থাকবো—
দীপঙ্কর এবার নাছোড়বান্দা। বললে-আমি আপনার কথা কিছুতেই শুনবো না মাসীমা, আমি আপনাকে নিয়েই যাবো, আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন—
তখন আর বেশি সময় ছিল না। কিরণের ফাঁসির খবর শুনলে মাসীমা হয়ত আর বাঁচবে না। সুতরাং মাসীমাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু তার আগে দরকার কিরণকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করা। যে-কোনও রকমে। শাস্তিই যদি দিতে হয় তো ট্র্যান্সপোর্টেশন-ফর-লাইফ হোক। কত লোকের তো তাই হয়েছে। কুড়ি বছর, চব্বিশ বছর পরে আবার ফিরে আসুক। সে-ও ভালো। কিন্তু ফাঁসি! দীপঙ্করের মনে হলো যেন তার নিজেরই মৃত্যুর অর্ডার বেরিয়েছে। তার নিজেরই যেন আর বাঁচবার অধিকার নেই পৃথিবীতে। সে নিজেই যেন দাগী হয়ে গেছে মানুষের কাছে। কিরণের চেয়ে সে নিজে কি কম অপরাধী! করিণ শুধু ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের চোখে অপরাধী! কিন্তু দীপঙ্কর যে মানুষের কাছেই ক্রিমিন্যাল। তার নিজের ক্রাইম কি কিছু কম! সে তো সমাজের সামনে ভদ্রলোক সেজে বেড়াচ্ছে বুক ফুলিয়ে। যে-চাকরির জন্যে তার এই প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তি তার পেছনেও তো সেই তেত্রিশ টাকার ঘুষ। তেত্রিশ টাকার ঘুষের কনক্রিটের ওপরেই তো তার এই সম্মান। চোখের সামনে অন্যায় দেখেও তো সে প্রতিবাদ করতে পারেনি কতবার। কতবার বিশ্বাসের অপব্যবহার করেও তো সে আপিসে সম্মানের শিখরে উঠে চলছে! কেউ তো তার ফাঁসি দেয় না, কেউ তো তার অসম্মান করে না! যত অপরাধ করেছে কিরণ!
প্রাণমথবাবুর বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো।
এমন সময় তো প্রাণমথবাবুর সদর দরজা বন্ধ থাকে না।
—কে?
সেই পুরোন চাকরটা দরজা খুলে দিলে। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—স্যার কোথায়? বাড়িতে নেই?
চাকরটা অবাক হয়ে গেছে। সবাই জানে আর এই বাবুই জানে না! বললে—আপনি শোনেননি কিছু? বাবুকে তো পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে—
—কবে?
—তিন-চার মাস হলো। বাবুকে তো আটকে রেখেছে জেলে। বাবু কোথায় কোন জেলে আছে, তাও জানি না।
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি তো খবর পাইনি। তাহলে মামীমাকে ডেকে দাও— চাকরটা বললে—মা-ও নেই, মা’কেও বাবুর সঙ্গে ধরে নিয়ে গেছে—কংগ্রেস আপিসের সব লোককেই ধরেছে একসঙ্গে—ফটিকবাবুও জেলে—
–কে? ফোঁটা?
চাকরটা বললে—হ্যাঁ—
সব যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন দীপঙ্করের চোখে। সতী নেই, প্ৰাণমথবাবু নেই, কিরণ নেই, লক্ষ্মীদি নেই—সমস্ত যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। সেই বিকেল বেলা কালিঘাটে দাঁড়িয়ে দীপঙ্করের মনে হয়েছিল সব যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে তার প্রাণমথবাবুর বাড়ির দরজা থেকে সেদিন সোজা একটা কথাও না-বলে চলে এসেছিল দীপঙ্কর। এবার কার কাছে সে যাবে? কাকে নিয়ে সে পৃথিবীতে বাঁচবে? কেউ নেই, কেউ নেই। শুধু আপিসটা থাকলেও থাকতে পারে। আর আপিসটা চলে গেলেও যেন আর তার কোনও দুঃখ থাকবে না।
—কী রে, দীপু না?
একটা গাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ আসতেই দীপঙ্কর ফিরে দেখলে—ছিটে। গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেছে তাকে দেখে।
দীপঙ্কর বললে—এই এদিকে এসেছিলাম একটা কাজে—তুমি কোথায় যাচ্ছো?
ছিটে বললে—বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, তোদের আপিস থেকেই ফিরছি। শালারা ওয়াগন দিলে না, ক’দিন ধরে হাঁটাহাঁটি করছি। শুনলুম তোকেও নাকি মিস্টার ঘোষালের মত পুলিসে ধরেছিল? কী হয়েছিল রে? ঘুষ নিয়েছিলি?
তারপর দরজা খুলে দিয়ে বললে—আয় ভেতরে উঠে আয়—
দীপঙ্করকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে বলতে লাগলো—বেশ করেছিস তুই ঘুষ নিয়েছিস, ঘুষ না নিলে কেউ বাঁচে আজকালকার বাজারে? ও পুলিসে কিচ্ছু করতে পারবে না। যতগুলো ঘুষের কেস্ হচ্ছে সবগুলো তো ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। স্পেশ্যাল ট্রাইবুন্যাল বসিয়েছে—তাতেও ফস্কা। আরে আজকাল যে জজ ম্যাজিস্ট্রেটরাও ঘুষ খাচ্ছে, ছাড়া পাবে না? নইলে তাদের চলবে কী করে বল্?
গাড়ি চলছিল ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের দিকে।
ছিটে বলতে লাগলো—এই দ্যাখ না, গভর্নমেন্ট পেট্রল র্যাশনিং করেছে। পেট্রল কমিয়ে দিয়ে কী লাভটা হলো শুনি? আমি একটা ভাঙা মটর কিনেছি, সেটা চলেই না। সেই গাড়ির নাম করে পেট্রল পাচ্ছি। দুখানা গাড়ির পেট্রলে একটা গাড়ি চালাচ্ছি—এতে কার ফয়দা হচ্ছে শুনি? ওরাও যত প্যাঁচ দেবে, আমরাও তত প্যাঁচ দিতে জানি—
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে—আমাকে এখানে ছেড়ে দাও ভাই, আমি নেমে যাই—
—কেন রে, চল্ না, আমাদের বাড়ি চল! ফোঁটা জেলে গেছে শুনেছিস তো? ফোঁটার এখন খুব নাম হয়েছে। জেল খাটতে তো আমাদের কষ্ট নেই, ছোটবেলা থেকে আমরা জেল খেটে আসছি। তখন ছিল থার্ডক্লাস বন্দী, এখন কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে ফাস্ট ক্লাস বন্দোবস্ত! প্রাণমথবাবুরও তাই। এখন তো আর জেল খাটতে লজ্জা নেই, গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, ফোঁটা, কেউই জেল খাটতে পেছপাও নয়—
ততক্ষণে বাড়ি এসে গিয়েছিল। ‘অঘোর-সৌধ’। আগে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে গাড়ি, বাস কিছু ঢুকতো না। লক্ষ্মীদি সতী সবাই নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে গিয়ে কলেজের বাসে উঠতো। এখন ‘অঘোর-সৌধ’ পর্যন্ত গাড়ি চলে। ছিটের গাড়ি একেবারে বাড়ির উঠোনে গ্যারেজের সামনে গিয়ে উঠলো। বহুদিন পরে আবার এই উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে ঢোকা। দীপঙ্কর দেখলে সমস্ত কিছু বদলে গেছে। বাইরে যেমন বদলেছে, ভেতরেও বদলেছে। যে-ঘরে দীপঙ্কর থাকতো সে-ঘরটার চিহ্ন নেই কোথাও। যে পাঁচিল টপ্কে বাড়ির মধ্যে ঢুকতো ছিটে-ফোঁটা, সে পাঁচিলটাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই কাঁঠাল গাছটাও নেই কোথাও। যে-ঘরে চনুনী থাকতো তাও যেন ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। যুগ বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন স্মৃতিগুলোকেও কেউ মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে। চারিদিকে চেয়ে অবাক হয়ে দেখছিল দীপঙ্কর।
ছিটে টেনে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে।
বাবুকে দেখে চাকর-বাকর ছোটাছুটি শুরু করে দিলে। বেশ হাঁক ডাক পড়ে গেল চারিদিকে। যে-বাড়িতে একদিন অঘোরদাদুর অগোচরে নিঃশব্দে টিপিটিপি পায়ে ঢুকতে হতো, আজ সেখানে বুক ফুলিয়ে ঢুকছে। এও কি কম বিপ্লব। এর চেয়ে বড় বিপ্লব কি ভাবা যায়! পৃথিবীর ম্যাপেও তো এতবড় রঙের বদল হয়নি। হিটলার যা পারেনি, ছিটে- ফোঁটা যেন তাই-ই করে ফেলেছে রাতারাতি।
—কী খাবি বল? শ্যাম্পেন ছাড়া আর সব কিছু দিতে পারি। শ্যাম্পেনটা ফুরিয়ে গেছে ক’দিন হলো।
দীপঙ্কর বললে—না, তার চেয়ে আমি উঠে পড়ি—
—কেন? উঠবি কেন? কীরকম বাড়ি করেছি বল? ভাই, বাড়ির নাম ‘অঘোর-সৌধ’ রাখলুম আমি। ফোঁটা আপত্তি করেছিল, বলেছিল একটা আধুনিক নাম রাখতে। তোদের রবি ঠাকুরের কায়দায়। শেষে আমার কথায় রাজী হলো। তা ছাড়া দাদুর ক্যাপিট্যাল ছিল বলেই তো হলো এ-সব! আরে, ক্যাপিট্যালটাই তো সব। ব্রেন, বুদ্ধি, স্কীম এডুকেশন যতই থাক, ক্যাপিট্যাল না হলে তো কিছুই হবে না। সেই অঘোরদাদুই তো ক্যাপিট্যাল সাপ্লাই করলে। তাই বুড়োর নামেই শেষ পর্যন্ত বাড়িটার নাম দিলুম। কী বল্, ভাল করিনি?
অদ্ভূত সব কথা শোনাতে লাগলো ছিটে। যে-সব কথা ছিটের মুখ দিয়ে শোনার আশা করেনি দীপঙ্কর। কনট্র্যাক্ট পেতে গেলে কাকে ধরতে হয়, কাকে ঘুষ দিতে হয়, সে ছিটের জানা। দিল্লির খোদ কর্তার কাছে গিয়ে কী-রকম করে কনট্র্যাক্ট আদায় করে নিয়ে এসেছে, তাও বললে। বললে—তুই টাকা খরচ কর, আমি তোকে আকাশের চাঁদ এনে দেব—টাকা দিয়ে আমি সব বেটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে পারি—
তারপর বললে—এই দেখ না, এই বাড়ি দেখছিস তো, এই সবই আমি আর ফোঁটা দুজনে মিলে করেছি কিন্তু সোজা আঙুলে তো ঘি বেরোয় না—
ছিটে আরো কী-কী সব নিজের গুণপনা বলতে যাচ্ছিল। কোথায় কেমন করে কাকে ধরে এইসব সম্পত্তি করেছে। অঘোরদাদু আর কত ক্যাপিট্যাল দিয়ে গেছে? মাত্র এক লাখ। সেই এক লাখকেই আজ তারা দুজনে মিলে দশগুণ করেছে—এ স্রেফ ব্রেন, বুদ্ধি, স্কীম আর ঘুষের কল্যাণে। এডুকেশন না থাকলেও ক্ষতি নেই। ঘুষ দিতে জানলেই হলো। ঘুষ সবাই নিতে চায়। কিন্তু নিতে চাইলেই তো হয় না। ঘুষ দিতেও জানা চাই। ঘুষ নেওয়ানোর মত শক্ত কাজ আর দুনিয়ায় নেই। ঘুষ নেওয়াতে হবে, অথচ সম্মানে এতটুকু দাগ লাগবে না, এই-ই হলো এ-যুগের এডুকেশন। স্কুল-কলেজে মিছিমিছি ইংরিজী আর অঙ্ক কষিয়ে সময় নষ্ট করা হয়, সেই সময়টাতে যদি ঘুষ দেওয়া আর ঘুষ নেওয়ার ফরমুলাটা শেখানো হয় তো তাতেও খানিকটা কাজ হয় দেশের। যুগ বদলেছে আর শিক্ষা বদলাবে না?
অনেক কথা শেখাচ্ছিল ছিটে।
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললে—তোদের মিস্টার ঘোষাল, মিস্টার ঘোষাল যে আমার কাছে এসেছিল রে—
দীপঙ্কর বললে—মিস্টার ঘোষাল? কেন?
—আবার কেন? কিছু টাকা চাইতে। বলছিল বিপদে পড়েছে, আমি যদি কিছু টাকা দিই—
—তুমি দিলে?
ছিটে বললে—রামঃ, আমি কেন টাকা দিতে যাবো? তুমি যখন চেয়ারে বসেছিলে, তখন তোমাকে ঘুষ দিয়েছি আমার স্বার্থে, এখন তোমাকে টাকা দিতে যাবো কেন? তুমি কে হে আমার?
বলে ছিটে হো হো করে হাসতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে—এবার আমি উঠি ভাই, তোমার অনেক দেরি করিয়ে দিলুম- ছিটে বললে—তা তোকেও তো পুলিসে ধরেছে, এখন জামিনে খালাস আছিস বুঝি? আচ্ছা, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বল তো ঘুষ নিয়েছিস বেশ করেছিস, কিন্তু ধরা পড়তে গেলি কেন?
দীপঙ্কর বললে—আমি ঘুষ নিয়ে ধলা পড়েছি, কে বললে তোমায়?
—কেন? তোদের আপিসেই শুনে এলুম! তোদের আপিসের সব লোক বললে। আমি মনে মনে বললুম দীপু বাপের বেটা তাই ঘুষ নিয়েছে, কিন্তু বোকার মত ধরা পড়তে গেল কেন? যেই দেখলি পুলিস ঘরে ঢুকছে ওমনি নোটগুলো মুখে পুরে গিলে ফেলতে পারলি না?
দীপঙ্কর আর দাঁড়াল না। বললে—আসি আমি, অনেক দেরি হয়ে গেল—