কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৩
৫৩
মিত্তির-গিন্নীকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ন’দিদি। মিত্তির-গিন্নী জিজ্ঞেস করেছিল—ও বউ এই সময় আবার কোত্থেকে এল ন’দিদি?
ন’দিদি বললে—কপালের গেরো ভাই, একেই বলে কপালের গেরো। শুনেছে তো যে ছেলের আবার বিয়ে দিচ্ছে শাশুড়ী, তাই এসে জুটেছে আর কী!
—কিন্তু তোমার বোন্পো’র তো খুব টান দেখছিলুম ন’দিদি বউ-এর ওপর-
ন’দিদি বললে—ওর আবার টান! জামাইকে তো দেখলে সদাশিব মানুষ, কোনও কিছুতেই নেই—এই যে বাড়ি দেখছো, এই সম্পত্তি তো ওই ছেলে একলাই পাবে! নেই- নেই করেও যা আছে, তাই ভাঙিয়ে খেলে তিন পুরুষ হেসে-খেলে কেটে যাবে—
—কিন্তু ন’দিদি, বিয়ের পর যদি ওই বউ এসে আবার গন্ডগোল বাধায়!
ন’দিদি বললে—তা তোর মেয়ে রয়েছে কী করতে? সোয়ামীকে বশ করতে পারবে না?
—কি জানি ন’দিদি, আমার যেন কেমন ভয় করছে। কর্তা সব শুনলে কী বলবে কে জানে!
ন’দিদি বললে—তোকে সে-সব কিছু ভাবতে হবে না, আমি আছি, দেখ্ না কী করি আমি। সেই যে কথায় আছে রে—অতি চতুরের ভাত নেই, অতি-সুন্দরীর ভাতার নেই—ওরও সেই হবে।
—কিন্তু আমি তো মেয়ের মা ন’দিদি, আমার যেন কেমন ঠেকছে!
ন’দিদি বললে—তুই বোস্ একটু, আমি ফয়সালা করে আসছি, আরে, তুই যেমন মেয়ের মা, আমিও তো তেমনি মেয়ের মা রে—তাই তো বলি—মেয়ের নাম ফেলী, পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি! মেয়ে যখন বিইয়েছিস্ তখন জ্বালা তো থাকবেই ভাই—
বলে আর দাঁড়ায়নি ন’দিদি। সোজা একেবারে নিচেয় চলে গিয়েছিল। নিচেয় তখন নয়ন পুলিসের দারোগার সঙ্গে কথা বলছিল।
ঠিক সেই সময়েই দীপঙ্কর এসে গিয়েছিল। মা-মণি দীপঙ্করকে নিয়ে সোজা ওপরে উঠতে লাগলেন। বললেন—তোমার যেখানে খুশী নিয়ে যাও ও-বউকে, অমন বউ আমার চাই না—
দীপঙ্কর তখনও কিছু বুঝতে পারছিল না। তাহলে এখানেই এসেছে সতী? সেবার জোর করে এনে সে এক বিভ্রাট ঘটেছিল, আর এবার স্বেচ্ছায় এসেছে আবার!
মা-মণি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছিলেন—ওই বউ আসার পর থেকেই আমার এই হাল হলো, যখন চলে গিয়েছিল, আপদ চুকেছিল, আবার এসেছে জ্বালাতে, বলি মরতেই যদি চাস্ তুই, তো রাস্তা খোলা পড়ে রয়েছে সেখানে গিয়ে মর না—
ন’দিদি পেছন পেছন যাচ্ছিল।
দারোগাসাহেব এতক্ষণ নিচেয় দাঁড়িয়েছিল। এবার ওপর দিকে চেয়ে বললে—আমি যাই মিসেস ঘোষ —
মা-মণি পেছন ফিরে বললেন—হ্যাঁ বাবা, তুমি এসো, পরে কী হয় আমায় জানিও আমি মেয়েমানুষ, দেখছো তো বাবা, আমার কেউ নেই, আমি একলা, আমি মরে গেলেও কেউ ফেলবার নেই আমাকে—
দারোগাসাহেব চলে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কনস্টেবল দুজনও গেল।
মা-মণি বলতে লাগলেন—আমার একূল গেল, ওকূল গেল ন’দিদি। সবাই ঠকালে, জানো ন’দিদি? আমি ভেবেছিলুম টাকাগুলো অন্ততঃ পুলিসে আদায় করে দেবে—যেমন হয়েছে পুলিস তেমনি হয়েছে উকীল! উকীল পুলিস সবাই মিলে আমাকে একেবারে জেরবার করে ছাড়লে। শেষকালে বউ এনেছিলুম, সে-ও চেটে পুটে একেবারে আঁটি- সার করে ছাড়লে গো—
দীপঙ্কর কিছু কথা বলছিল না। সঙ্গে সঙ্গে উঠছিল।
মা-মণি আবার বলতে লাগলেন—লোকে ঘরে বউ আনে বুড়ো বয়সে সুখ হবে বলে, সেবা পাবে বলে, আর আমার সেবা হচ্ছে এই, এই বুড়ো বয়সে সিঁড়ি ভেঙে কেবল ওপর-নিচ করছি—
তারপর হঠাৎ দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললেন—তা তোমাকে তো পুলিসে ধরেছিল শুনেছি, আবার ছাড়লে কেন?
দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিলে না।
—তা আমার বউকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে, সেখানে ধরে রাখতে পারলে না তাকে? আসতে দিলে কেন? আমার হাড়-মাস জ্বালাতে?
যখন সনাতনবাবুর ঘরের সামনে গেছে, তখন দেখা গেল ভেতরে বিছানার ওপর সতী শুয়ে আছে, আর সনাতনবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
মা-মণি চেঁচিয়ে উঠলেন—কই গো ন’দিদি তুমি যে বললে বউ আমার ভিরমি গেছে, কই, এই তো এখনও জ্যান্ত রয়েছে। কী গো, খুব যে নাটক করতে শিখেছ, বলি নাটক আমরাও করতে জানি, এখন ওঠো তো বাছা, নাটক যদি করতেই হয় তো বাড়ির বাইরে গিয়ে নাটক করো, এখানে এ-সব চলবে না—
সনাতনবাবু চোখ তুলেই দীপঙ্করকে দেখতে পেয়েছেন হঠাৎ। বললেন— দীপুবাবু, আপনি?
দীপঙ্কর সামনে ঘরের ভেতরে এগিয়ে গেল। বললে—কী হয়েছিল?
সতী তখনও দুর্বল। কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। শুধু ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে—কী হয়েছিল, সনাতনবাবু?
সনাতনবাবু বললেন—বেশি আঘাত সইতে পারেনি তাই শুয়ে পড়েছে, বড় দুর্বল দীপুবাবু—
সতীর মুখ দিয়ে হঠাৎ কথা বেরোল। বললে—তুমি এতদিন কোথায় ছিলে দীপু?
দীপঙ্কর বললে—তুমি কথা বোল না সতী, চুপ করো—
মা-মণি হঠাৎ বললেন—ওই তো কথা বলছে গো ন’দিদি, তুমি বললে একেবারে জ্ঞান নেই, দাঁতকপাটি মেরে পড়ে আছে?
দীপঙ্কর বললে—আপনি দয়া করে চুপ করুন মা-মণি, দেখছেন কী রকম দুর্বল হয়ে গেছে সতীর শরীর—
মা-মণি গলা আরো চড়িয়ে বললেন—চুপ করবো কেন শুনি? তুমি আমাকে চুপ করতে বলবার কে?
দীপঙ্কর বললে—সতীর শরীরের কথা বিবেচনা করেই আপনাকে চুপ করতে বলেছি, আপনি কিছু মনে করবেন না!
ন’দিদি এতক্ষণ কিছু কথা বলেন নি। এবার তিনি উতোর গাইলেন। বললেন— যাই হোক বাছা, নয়ন তোমার মায়ের বয়েসী, তার মুখের ওপর কথা বলা কি উচিত?
দীপঙ্কর বললে—আমার দোষ হয়েছে, আমায় ক্ষমা করবেন!
মা-মণি বললেন—ক্ষমা করা-করির কী আছে, তুমি এসেছো, আমি বলছি তুমি ওকে নিয়ে যাও, মরতে হয় রাস্তায় গিয়ে ও মরুক, নাটক করতে হয় রাস্তায় গিয়ে নাটক করুক, আমার বাড়িতে এ-সব ছেনালী চলবে না—
কিন্তু এই অবস্থায় কী করে নিয়ে যাবো?
—এখনও জ্ঞান আছে, এই বেলাই নিয়ে যাও, নইলে হাঁফ উঠলে তখন সামলাবে কে?
দীপঙ্কর সনাতনবাবুর মুখের দিকে চাইলে। সনাতনবাবু তখনও সতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সতী সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে ক্ষীণ স্বরে বললে-আমি যাবো না, আমি এখান থেকে যাবো না—
নয়নরঞ্জিনী দীপঙ্করকে বললেন-কই, নিয়ে যাও, আবার হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছো কী?
দীপঙ্কর বললে—আপনাকে আমি এখনও অনুরোধ করছি, আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন, সতী এখানেই থাকতে চায়, এ ওর স্বামীর ঘর, ওর শ্বশুরের ঘর, এখান থেকে ওকে এমন করে তাড়াবেন না আপনি—
ন’দিদি বললে—দেখ বাবা, তোমার ডবল বয়েস হয়েছে আমার বোনের, তাকে তুমি উপদেশ দিতে এসো না—যা বলছে তাই করো না, যেখানে পারো ওকে নিয়ে যাও—আমার বোনেরও শান্তি হোক, ওরও শান্তি হোক—
কিন্তু এখানেই তো থাকতে চাইছে ও, আর কখনও কোথাও যাবে না ওর হয়ে আমি কথা দিচ্ছি, আপনারা তো অনেক শাস্তি দিয়েছেন, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও, এখন আর একবার শেষবারের মত সুযোগ দিন না—
ন’দিদি বললে—শাস্তি যা পাবার তা আমরাই পাচ্ছি, যথেষ্ট পাচ্ছি, ওই বউ এ-বাড়ি থেকে না-যাওয়া পর্যন্ত এ-শাস্তির আর শেষ নেই, আমরা যা বলছি তাই করো তুমি—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবো বলুন?
—যেখানে তোমার খুশী নিয়ে যাও, যেখানে তুমি নিয়ে গিয়েছিলে সেখানেই নিয়ে যাও, আমরা কিচ্ছু বলবো না!
দীপঙ্কর বললে—ওর এক বোন ছিল, সে-ও কলকাতার বাইরে চলে গেছে। ওর বাবা ছিলেন, তিনিও মারা গেছেন, এখন নিয়ে গেলে আমার নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। আপনাদের বাড়ির বউ হয়ে আমার বাড়িতে থাকবে, সেটাই কি ভাল?
মা-মণি বললেন—খুব ভাল! খুব ভাল! কেউ কিচ্ছু বলবে না, তুমি নির্বিঘ্নে নিয়ে যাও—আমার আপদের শান্তি হোক—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আপনারা ভাল করে ভেবে দেখুন, ও তো কোন দোষ করেনি, মিছিমিছি কেন ওকে এই শাস্তি দিচ্ছেন?
মা-মণি আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। বললেন—বলি, তুমি ওকে নিয়ে যাবে কি না বলো?
দীপঙ্কর চুপ করে রইল। তারপর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে বললে—আপনিও কি তাই বলেন?
সনাতনবাবু বললেন—না!
দীপঙ্কর মা-মণির মুখের দিকে চাইলে।
মা-মণি সনাতনবাবুর দিকে ফিরে বললেন—কী বললে তুমি?
সনাতনবাবু গম্ভীর গলায় বললেন—সতী এখানেই থাকবে!
সমস্ত আবহাওয়াটা যেন থম্ থম্ করতে লাগলো হঠাৎ। এতক্ষণের এত ঝড়-ঝঞ্ঝা সব যেন সনাতনবাবুর একটা কথায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তে। সবাই বুঝলো যে- লোকটা চুপ করে থাকতে জানে, সে যখন কথা বলে তখন সে-কথার বুঝি আর নড়-চড় হবার নয়। সে অমোঘ। সনাতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে ন’দিদিও স্তব্ধ হয়ে গেল হঠাৎ। খানিকক্ষণ কারোর মুখ দিয়েই কোনও কথা বেরোল না। সনাতনবাবু যে ‘না’ বলে দিয়েছেন সেই ‘না’-ই যেন চিরস্থায়ী হয়ে রইল। কারো কোনও প্রতিবাদেই তার যেন আর অদল-বদল হতে নেই।
সনাতনবাবু আবার বললেন—যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ সতী এখানেই থাকবে!
দীপঙ্কর এই মানুষটার দিকে চেয়ে বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় বিমূঢ় হয়ে রইল। একটা সামান্য নেতিবাচক শব্দ যে এতখানি শ্রদ্ধা উদ্রেক করতে পারে তা যেন এর আগে আর জানা ছির না তার!
তারপর সনাতনবাবু আবার মুখ খুললেন। বললেন-তোমরা সব বাইরে যাও, এখানে ভিড় করলে রোগীর অসুবিধে হবে!
ন’দিদি কথাটা শুনে বোধহয় বাইরেই চলে যাচ্ছিল। দীপঙ্করও ঘর থেকে বাইরে পা বাড়িয়েছিল কিন্তু হঠাৎ নয়নরঞ্জিনী দাসী এক কান্ড করে বসলেন।
হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন। বললেন—তবে আমিও বলছি, আমিও যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই, আমিও যদি এ-বাড়ির সতী-লক্ষ্মী বউ হই, আমিও যদি একদিন কায়মনোবাক্যে স্বামীসেবা করে থাকি, তাহলে আমিও বলছি এ-বউ এখানে থাকতে আমিও জলগ্রহণ করবো না, করবো না, করবো না। আমিও এই হত্যে দিয়ে পড়ে রইলাম এখানে—দেখি সোনা কী করতে পারে—
আর তারপরেই সেইখানে সেই মেঝের ওপর বসে পড়ে দেয়ালের সিমেন্টের ওপর ঠাঁই ঠাঁই করে মাথা ঠুকতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রক্তে ভেসে গেল সারা মুখখানা।
—ওমা, করিস কী, করিস কী নয়ন!
ন’দিদি নিচু হয়ে ধরতে গেল নয়নকে। কিন্তু সেই বুড়ো মানুষের শরীরে যে কোত্থেকে হঠাৎ অত প্রচন্ড শক্তি এল কে জানে। মা-মণি তখনও ঘন ঘন মাথা ঠুকে যাচ্ছেন, আর রক্তের ধারা দর দর করে ঝরে পড়ছে মুখের ওপর, গায়ের ওপর, আর মেঝের ওপর।
দীপঙ্কর ধরতে গেল মা-মণিকে। কিন্তু যে-শক্তির খান্ডব-দাহন করেও তৃপ্তি হয় না, তাকে নিবৃত্ত করবে কে? তিনি ঠাঁই ঠাঁই করে মাথা ঠুকেই চলেছেন।
সনাতনবাবু নিবাত নিষ্কম্প দীপ-শিখার মত ধীর-স্থির দৃষ্টিতে শুধু সেদিকে চেয়ে দেখতে লাগলেন। একটা প্রতিবাদ, কি একটা সান্ত্বনার কথাও তাঁর মুখ দিয়ে বেরোল না।
অন্য যে-কেউ হলে ততক্ষণে অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তো কিন্তু নয়নরঞ্জিনী দাসীর প্রকৃতি বোধহয় বড় কঠিন ধাতুতে গড়া। তাঁর ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই। তিনি মাথা ঠুকছেন আর বলে চলেছেন—আমি যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই, আমি যদি সতী-লক্ষ্মী বউ হই এ-বাড়ির, আমি যদি কায়মনোবাক্যে স্বামীসেবা করে থাকি তো আমার কথাও থাকবে—থাকবে—থাকবে—
সত্যি, শেষ পর্যন্ত সুঝি সতী মায়ের সতী কন্যারই জয় হলো।
সনাতনবাবু বললেন—দীপঙ্করবাবু!
দীপঙ্কর সামনেই ছিল। বললে—বলুন—
—আপনি সতীকে নিয়েই যান এখান থেকে। এখানে থাকলে সতীও অপবিত্র হয়ে যাবে—
—কিন্তু আপনি?
সনাতনবাবু বললেন—আমাকে এই অপবিত্রতার মধ্যেই বাঁচতে হবে দীপঙ্করবাবু। আমি এই অপবিত্রতার মধ্যেই অপরূপের সন্ধান করবো। যদি কোনদিন সে-সন্ধান পাই তখনই সতীকে আবার নিয়ে আসবো এখানে, তার আগে নয়—