কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৯
৫৯
রাস্তায় অন্ধকার ঘুরঘুট্টি। সমস্ত গাড়িগুলো ছুটেছে সামনের আলোর ওপর ঠুলি এঁটে, সমস্ত কলকাতাটা যেন মা-মণির মেজাজের মত থম্থম্ করছে। মা-মণিকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। জাপানীদের কাছেও যেন সমস্ত কলকাতাটা ছেড়ে দিতে হবে বাঙালীদের।
এসব দিনগুলোর কথা দীপঙ্করের মনে আছে। নয়নরঞ্জনী দাসী যখন বাড়িটাকে বাঁচাবার জন্যে ছটফট করে বেড়াচ্ছেন, একবার উকীল আর একবার ঘর করছেন, যখন দু’হাতে উকীলরা পয়সা দুয়ে নিচ্ছে, কোনও দিকেই কোনও আশার রেখা খুঁজে পাচ্ছেন না, দীপঙ্করও সেই সময়ে একবার আপিসে, একবার গড়িয়াহাটায় গিয়ে সতীর কাছে গিয়ে সান্ত্বনা খুঁজছে। বাড়িতেও শান্তি নেই, বাইরেও তাই। সেই সব দিনগুলোতে অন্ধকার বিছানার ওপর শুয়ে চোখ বুজলেই কেবল কিরণের কথাটা মনে পড়তো। কিরণ যেন বলতো—আমার কথা ভাবিসনি তুই দীপু, এখন কোনও বাজে কথা ভাববার সময় নেই, এখন গ্লোবে আগুন লেগে গেছে, তুই নিজের কথা ভাব, এখনও কেবল চুপ করে দেখবি—? গান্ধীজীর কথাও মনে পড়তো দীপঙ্করের।
“I have not asked the British to hand over India to the Congress or to the Hindus. Let them entrust India to God or in modern parlance to anarchy. Then all the parties will fight one another like dogs, or will, when real responsibility faces them come to a reasonable agree- ment.”
সেদিন দীপঙ্কর যথানিয়মে আপিস থেকে সোজা চলে এসেছিল সতীর কাছে। এ আসাটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্করের। রঘুও জানতো ঠিক কখন আসবে দাদাবাবু। এসে চুপ করে বসে থাকবে হেলানো-চেয়ারটায়। চা খাবে না, খাবার খাবে না, সিগারেট পান কিছুই চাইবে না। শুধু বসে থাকবে। পৃথিবীর সমস্ত সমস্যা, জীবনের সমস্ত জটিলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীপঙ্কর এখানে এই গড়িয়াহাটার বাড়িটার নির্জন ঘরটাতে এসে মুক্তি খুঁজবে। মুক্তি খুঁজবে না জটিলতা বাড়াবে তা সেদিন সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু প্রতিদিনই এসে বসতো, প্রতিদিনই সতী তৈরি থাকতো। দীপঙ্কর এলেই সতী এসে বসতো পাশের চেয়ারটায়। তারপর চুপচাপ মুখোমুখি বসে চলতো দু’জনের নির্বাক আলাপ।
একবার দুবার শুধু সতী বলতো—কেন তুমি আর আসো?
কিংবা বলতো—আজ সকালে বৃষ্টি হয়েছিল—
এই রকম অনাবশ্যক আলাপের মধ্যে দিয়ে কোথায় যেন একটা গ্ৰন্থি বেঁধে উঠছিল একেবারে অন্তরের অভ্যন্তরে। লোকচুর আড়ালে কোন্ এক অদ্ভুত সম্পর্কের ক্ষীণ সূত্র সৃষ্টি হচ্ছিল, তা দু’জনের কেউই জানতে পারেনি। দীপঙ্কর শুধু জানতো সতী নিয়ম মাফিক পাশের খালি চেয়ারটায় এসে বসবে। আর সতীও জানতো দীপঙ্কর আপিস থেকে সোজা এখানে একটা চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দেবে।
কিন্তু সেদিন একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছিল দীপঙ্কর। অভয়ঙ্কর এসেই খবরটা দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—মিস্টার ঘোষালের কেস-এর খবর কিছু রাখো সেন?
—কে মিস্টার ঘোষাল!
কথাটা বলেই নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এই অল্পদিনের মধ্যেই ভুলে গেল নাকি দীপঙ্কর। অভয়ঙ্করও অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—শুনেছ বোধহয় মিসেস ঘোষের এভিডেন্সের ওপরেই এখন মিস্টার ঘোষালের ভাগ্য নির্ভর করছে?
—সে কী? কেন?
অভয়ঙ্কর বললে—তুমি জানো না?
দীপঙ্কর বললে—কই পেপারে তো কিছু দেখিনি—? মার্ডার কেসএর খবর তো পেপারে বেরোচ্ছে না কিছু?
—সেদিকে মিস্টার ঘোষাল এক্সপার্ট। টাকা দিয়ে প্রেসকে গ্যাগ করে দিয়েছে। কোনও খবরের কাগজেই তার কেস-এর রিপোর্ট বেরোবে না। কিন্তু শুনছি এবার মিসেস ঘোষকে ডিফেন্স উইটনেস করেছে—
—কোন্ মিসেস ঘোষ?
অভয়ঙ্কর বললে—মিস্টার ঘোষালের এক্স পি-এ, সতী ঘোষ। কেন, তোমার সঙ্গে তার দেখা হয় না আর?
দীপঙ্কর আকাশ থেকে পড়লো। বললে—আর ইউ সিওর? তুমি ঠিক জানো? অভয়ঙ্কর বললে—আমি কারেক্ট! হাইকোর্টে আমার এক য়্যাডভোকেট ফ্রেন্ড আছে, সে ডে-টু-ডে অকারেন্স আমাকে বলে যায়, তার কাছেই সব শুনেছি। শুনছি মিসেস ঘোষের আজকে স্টেটমেন্ট দেবার কথা আছে, মিসেস ঘোষকে সামন করা হয়েছে আজ—
—আজ কখন?
—আজ এই এখন, এখন হিয়ারিং হচ্ছে হয়ত
বলে ঘড়িটা দেখলে অভয়ঙ্কর। দু’টো বেজেছে। দীপঙ্কর তখন অন্য কথা ভাবছে। ঘৃণা নয়, রাগও নয়। মিস্টার ঘোষালের ওপর কোনও রাগ কোনও ঘৃণা নেই দীপঙ্করের। পৃথিবীর কোনও লোকের ওপরেই রাগ নেই তার। কিন্তু যা-কিছু কুৎসিত, যা কিছু অন্যায়, যা কিছু অসুন্দর, তার কাছ থেকেই বরাবর দূরে থাকতে চেষ্টা করেছে সে। দীপঙ্কর মুক্তি চায়নি, সংগ্রাম করে কুশ্রীকে সুশ্রী করতেও চায়নি! তার কেবল মনে হয়েছে সমস্ত কলঙ্ক থেকে সে প্রাণপণে দূরে থাকবে! কলঙ্ক থেকে দূরে থাকা কি সহজ কথা নাকি? প্রতি মুহূর্তে আমরা সংগ্রাম করি মিথ্যার সঙ্গে, আত্মরক্ষা করি শত্রু থেকে। আমরা তেল-নুন-মশলার অধীন, আমরা তো তুচ্ছতাকে অস্বীকার করে এক মুহূর্ত ও বাঁচতে পারি না। তবু তো মানুষ পরিচ্ছন্ন হতে চায়, নিজের সংসারকে সকাল-বিকেল ঝাঁটা দিয়ে আবর্জনা—মুক্ত করতে চায়। এই এতটুকুই মাত্র করতে বলেছিল সতীকে এর বেশী কিছু নয়। সেই সামান্য কথাটুকুও সতী রাখলো না তার! সত্যিই কি সতী আবার মিস্টার ঘোষালের সংস্রবে গেছে? আবার, এত কান্ডের পরেও সেখানে গিয়ে সে আত্মবিক্রয় করছে!
—তুমি ঠিক জানো অভয়ঙ্কর? আর ইউ ভেরি সিওর?
দীপঙ্কর উঠলো। বললে—আমি আজ সকাল-সকাল উঠবো অভয়ঙ্কর, আমার একটা কাজ আছে—
—হঠাৎ মনে পড়লো বুঝি?
দীপঙ্কর বললে—না, আজ ক’মাস ধরে আই য়্যাম ফীলিং ভেরি ব্যাড। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না—
—তাহলে ছুটি নাও না, টেক লীভ্—
দীপঙ্কর বললে—ছুটি নিয়েই বা কী করবো। ভাবছি ট্রান্সফার নেব, কলকাতা থেকে ট্র্যান্সফার নিয়ে শিলিগুড়ি কিংবা ময়মনসিং কোথাও গিয়ে চাকরি করবো, আমার এই টেনশন্ আর ভালো লাগছে না অভয়ঙ্কর, আমি রান-ডাউন হয়ে গেছি, আমি হেরে গেছি, আমি লস্ট অভয়ঙ্কর, লাইফের রেসে আমি আজ লাস্ট হর্স—
হঠাৎ দীপঙ্করের কথা শুনে অভয়ঙ্কর আরো অবাক হয়ে গেল। যত প্রমোশন হয়েছে মিস্টার সেন-এর ততই যেন কেমন মনমরা হয়ে গেছে। আগে যেন একটু নিজের শরীরের দিকে যত্ন দিত, আগে যেন জামা-কাপড়ের দিকেও একটু যত্ন নিত। হয়ত মাদার মারা যাবার পর থেকেই সেন এরকম হয়ে গেছে। আর তো কোনও কারণ নেই। আর কোনও কারণই খুঁজে পেলে না অভয়ঙ্কর।
তাড়াতাড়ি ক্রফোর্ড সাহেবকে বলে দীপঙ্কর সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল।
অভয়ঙ্কররা জানবে কী করে? অভয়ঙ্কররা বুঝবেই বা কী করে? দীপঙ্করই বা কাউকে বোঝাবে কেমন করে? সকালে ঘুম ভাঙবার পর থেকে শুরু করে রাত্রে ঘুমোতে যাবার সময় পর্যন্ত মানুষের কেবল তো দেবারই পালা চলে প্রতি মুহূর্তে। চাকরকে দিতে হয়, আত্মীয়-স্বজনকে দিতে হয়, ভাই, বোন, বন্ধু, সমাজ, রাষ্ট্র, সকলকে কেবল দিয়েই যেতে হয়। এ দেওয়ায় যেন তৃপ্তি পায় না দীপঙ্কর। এমন কে আছে সংসারে, কিংবা এমন কে আছে এই সংসারের বাইরে, যাকে দিলে সব দান দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে? দীপঙ্কর তো দিতেই চায় কেবল। কিন্তু নেবার মত সেই মহাপ্রাণ কোথায়? তাকে সব কিছু দিতেই চায় কেবল। তাকে সব কিছু দিতে পারলেই যেন কৃতার্থ হতো সে। ধন্য হতো। এতদিন মা ছিল, এতদিন কিরণ ছিল, এতদিন প্রাণমথাবাবু ছিল, তাদের কেউ নেই আর। তারা সবাই দীপঙ্করের দেওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। একজন মাত্র ছিল তখনও। সে সতী! সেই সতীও যেন দীপঙ্করের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেল আজ। দরজার কড়া নাড়তেই রঘু দরজা খুলে দিয়েছে। আজ এত সকাল-সকাল দীপঙ্করকে আসতে দেখে রঘু একটু অবাক হয়ে গেল। দীপঙ্করের সেদিকে নজর ছিল না। সোজা গিয়ে হেলানো চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলে। রঘু পাখাটা ঘুরিয়ে দিলে জোর করে।
—দিদিমণি তো নেই!
দীপঙ্কর যেন সব জেনেও বিশ্বাস করতে চায়নি। অভয়ঙ্কর এত কথা বলবার পরও যেন অবিশ্বাসে মন থেকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কথাটা। কিন্তু রঘুর মুখ থেকে কথাটা শুনে যেন নতুন করে আবার অবাক হবার পালা এল।
—কোথায় গেছে?
—হাইকোর্টে।
—হাইকোর্টে? কার সঙ্গে গেছে? একলা?
—একজন ভদ্রলোক এসেছিল, তিনিই ডেকে নিয়ে গেলেন। আমাকেও যেতে বলেছিলেন সঙ্গে, কিন্তু আপনি আসবেন আপিস থেকে, তাই যাবার সময় আমাকে থাকতে বলে গেলেন—
এরপর আর রঘুর কোনও কাজ নেই। রঘু নিজের কাজে চলে গেল। দীপঙ্করের মনে হলো পৃথিবীর কোথায় এক কোণে যেন একটা ক্ষীণ আশার আশ্রয় ছিল তার, তাও যেন হঠাৎ এক ঝড়ের ফুৎকার রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তবু যেন কিছু করবার নেই তার। তবু যেন এখানেই তাকে বসে থাকতে হবে। তবু যেন এমনি করেই প্রতিদিন প্ৰতি মুহূর্ত প্রতীক্ষা করে করে মুহূর্তের পদধ্বনি শুনতে হবে—
.
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সতীরও মনে হচ্ছিল সেও যেন মুহূর্তের পদধ্বনি শুনতে এসেছে এখানে। একদিন জীবনের সব অবলম্বন নিঃশেষ করে দিয়ে যখন নিরাশ্রয়ের শিখরটার ওপরে উঠেছে সে, তখনই যেন সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে ভাগ্যের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবার হুকুম হলো তার ওপর। এ-এক অদ্ভূত জগৎ। কোনও দিকে চাইবারই সাহস হয়নি তার। মাথা নিচু করে সে যেন তার নিজের ভাগ্যদেবতার শেষ জাজমেন্ট শুনতে এসেছে এই হাইকোর্টে।
—আপনি তো একদিন রেলের আপিসে চাকরি করতেন মিসেস ঘোষ? একথা কি সত্যি যে সে চাকরি আপনি নিজের ইচ্ছেয় ছেড়ে দিয়েছেন?
সতী মাথা নিচু করেই ছিল। মাথার ঘোমটাটা আরো একটু নামিয়ে দিলে। তারপর বললে—হ্যাঁ—
স্ট্যান্ডিং কাউন্সিল বললে—অনুগ্রহ করে আপনি আর একটু জোরে উত্তর দিলে সুবিধে হয়, আমরা তাহলে একটু স্পষ্ট শুনতে পাই—
সতী স্পষ্ট গলায় আবার বললে—হ্যাঁ—
—যদি নিজের ইচ্ছেতেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে আসামী মিস্টার ঘোষাল য়্যারেস্ট হবার আগে চাকরি ছাড়লেন না কেন? আপনার স্বামী কি আপত্তি করেছিলেন বলেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন?
সতী বললে—না—
সমস্ত কোর্টময় শ্মশানের স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আজ এতদিন ধরে কেস চলছে, বহু লোক উদ্দ্গ্রীব হয়ে আছে ফলাফল শুনবে বলে। আজকের সাক্ষীর ওপরে মিস্টার ঘোষালের ভাগ্য নির্ভর করছে। সার সার বেঞ্চের ওপর সভ্য-শিক্ষিত কৌতূহলী মানুষের ভিড়। কৌতূহল মিস্টার ঘোষালের জন্যে নয়, কৌতূহল অন্য করণে। এত বড় নৃশংস মার্ডার যে করেছে তাকে দেখবে সবাই। প্রতিটি সাক্ষীর জবানবন্দীর সঙ্গে আসামীর মুখের হাবভাব, চোখের চাউনি সমস্ত প্রতিক্রিয়া দেখবে। মিলিয়ে নেবে। খুন চোখের সামনে দেখবার সৌভাগ্য সকলের হয় না, কিন্তু কোর্টের কল্যাণে হত্যাকারীকে দেখবার সৌভাগ্য সকলের মেলে। আসলে দীপঙ্করের মনে হয়, সকলেই মার্ডার করতে চায়। সকলেই খুন করতে চায়। শিক্ষা, সংস্কার খুনের বাধা হয়ে দাঁড়ায় পদে পদে, তাই খুন করে না কেউ, তাই হত্যার খবর, হত্যাকারী আর ডিটেকটিভ উপন্যাসের এত আদর মানুষের সমাজে। নইলে কেন মানুষ নিজের কাজ ফেলে স্বাস্থ্য নষ্ট করে খুনের মামলা শোনে কোর্টে গিয়ে দিনের পর দিন!
—আপনি চাকরি করতেন বলে আপনার শাশুড়ী কি কোনওদিন আপত্তি করেছিলেন?
—হ্যাঁ—
—আপনি তো স্ত্রী হিসেবে খুব সুখী, হ্যাঁ কি না বলুন?
সতী বললে-না—
মিস্টার ঘোষালের এটর্নী বিশেষ করে শিখিয়েছিল সতীকে যে স্ত্রী-হিসেবে তার বিবাহিত জীবন সুখী এইটেই প্রমাণ করতে চাইবে স্ট্যান্ডিং কাউন্সিল।
—আপনার স্বামীর অগাধ টাকা, আপনার স্বামীর অপরূপ স্বাস্থ্য, কলকাতার এক নামকরা ধনী-বংশে আপনার বিয়ে হয়েছিল-একথা কি সত্যি?
সতী বললে—না—আমার শাশুড়ীর সমস্ত টাকা লোকসান হয়ে গেছে!
—কিন্তু নষ্ট তো আগে হয়নি, তখন কেন চাকরি করতে গিয়েছিলেন? মিস্টার ঘোষালই কি আপনার চাকরি করে দিয়েছিলেন?
সতী বললে—হ্যাঁ-আমার নিজের টাকা উপার্জন করবার ইচ্ছে হয়েছিল।
—কিন্তু আপনি চাকরি করার পরও তো আপনার স্বামী আপনার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন। আপনার স্বামী একজন দেবতুল্য মানুষ,–
সতী মাথা তুললো। সিংহের মতন যেন কেশর নাড়া দিয়ে নিলে। বললে—না—দেবতুল্য মানুষ হলে আমি প্যালেস-কোর্টে ফ্ল্যাট ভাড়া করতুম না—
স্ট্যান্ডিং কাউন্সিল ভদ্রভাবে সবিনয়ে বললে—মিসেস ঘোষ, আমি যে প্রশ্নটুকু করবো আপনি শুধু সেই প্রশ্নেরই জবাব দেবেন, তার বেশী দেবার দরকার নেই—। এখন বলুন, আপনার এত সুখের মধ্যেও কেন আপনি এই জঘন্য চিঠি লিখতে গেলেন? মিস্টার ঘোষালকে বাঁচাবার জন্যে, সত্যি কি না বলুন তো?
সতী যেন একটু ঘাড়বে গেল। তারপর ব্যারিস্টার দত্তর মুখের দিকে চাইলে একবার। সামনে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মিস্টার ঘোষালের দিকেও চাইলে।
—বলুন, বলুন, যা সত্যি ঘটেছিল তাই-ই বলুন? কেন এমন জঘন্য অদৰ্য চিঠি লিখলেন? আপনি অন্যের বিবাহিতা সতীসাধ্বী স্ত্রী হয়ে, আপনার অমন স্বাস্থ্যবান সুন্দর স্বামী থাকতে, আপনার নিজের মায়ের মত অমন শাশুড়ী থাকতে, কেন লুকিয়ে লুকিয়ে এমন চিঠি লিখেলেন? আপনি কি জানতেন না যে এতে আপনার নামে মিথ্যে কলঙ্ক রটতে পারে? আপনার সংসারে আগুন জ্বলে উঠতে পারে? আপনি মিস্টার ঘোষালের প্ররোচনায় ব্যাক ডেট দিয়ে নিজের ক্ষতি করে এই চিঠি লিখলেন? জানেন না যে এতে নিজের হাতে নিজের ডেথ-সেনটেন্স লিখে দেওয়া হলো? আপনি এমন শিক্ষিতা মহিলা হয়েও এই সহজ কথাটা একবার বুঝতে পারলেন না?
হঠাৎ কী যেন একটা গোলমাল হলো।
ব্যারিস্টার দত্ত কী যেন বললেন জজকে। স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের সঙ্গে ব্যারিস্টার দত্তর কী যেন নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে। সতীর চোখের সামনে তখন সমস্ত হাইকোর্টটা যেন ঘুরছে। মনে হলো সে পড়ে যাবে। চারিদিকে গুজ্- গুজ্ ফিস্-ফিস শব্দ। সমস্ত এজলাস যেন গম্ গম্ করছে এতগুলো মানুষের কৌতূহলে। হঠাৎ সব থেমে গেল। হঠাৎ আবার প্রশ্নে ঝড় বয়ে যেতে লাগলো।
—আপনি জানেন যে, এই চিঠি যদি আপনি নিজের হাতের লেখা বলে স্বীকার করেন, তাহলে সমস্ত কলকাতার নারী-সমাজে আপনার নামে ঢি ঢি পড়ে যাবে? আপনার নামে কলঙ্ক রটবে?
সতী বললে-আমি জানি।
—এ চিঠি কি আপনার মত একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার দ্বারা লেখা সম্ভব? এও জজকে বিশ্বাস করতে বলেন?
সতী বললে—হ্যাঁ, সম্ভব!
—আপনি জানেন যে যদি আসামী এই মামলায় দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে বাঙলা দেশের ঘরে-ঘরে একদিন এই পাপ সংক্রামিত হবে? খুনীর যদি শাস্তি না হয়, তাহলে সমাজে খুনের সংখ্যা বেড়ে যাবে? সে-অধঃপতন থেকে বাঙলা দেশের কোনও বাঙালীই আর রেহাই পারে না? আরো জানেন কি যে আপনিও তার অংশভাগী হবেন?
সতী মাথা নিচু করে ঘোমটা টেনে দিলে।
—এ-সব জেনেও আপনি স্বীকার করছেন এ আপনার নিজের হাতের লেখা চিঠি? তবে কি আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবো যে, বাঙলার নারী-সমাজ থেকে সতী নারীর সম্পূর্ণ অন্তর্ধান হয়েছে? এতদিন ধরে এত মহাপুরুষ যা উপদেশ দিয়ে গেছেন,–বেদ উপনিষদ, মহাভারত, শ্রীরামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, কেশবচন্দ্র, বিদ্যাসাগর- সকলের সব শিক্ষা, সব উপদেশ কেবল ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে? বাঙলার নারী-সমাজের ওপর তার কোনও প্রতিক্রিয়াই হয়নি? মানুষ এখনও সেই আদিম অসভ্য মানুষই রয়েছে, তার এতটুকু একতিলও উন্নতি হয়নি? তাহলে কেন নারীকে আমরা মায়ের জাত বলে এত শ্রদ্ধা করি? কেন মাতৃভূমিকে আমরা এত সম্মান দিই? কেন বঙ্কিমচন্দ্ৰ সেই মাকেই উদ্দেশ্য করে গান গেয়েছিলেন— বন্দেমাতরম্—
সতীর মাথার মধ্যে সব যেন তখন তাল-গোল পাকিয়ে গেছে। স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের পোশাক পরিচ্ছদ, স্ট্যান্ডিং কাউন্সিলের বক্তৃতার ভঙ্গি, হাতের কাজগটাকে পাকিয়ে গোল করে দুলিয়ে দুলিয়ে সতীর দিকে চ্যালেঞ্জ করা—এ যেন অসহ্য হয়ে উঠলো। সতীর শেষকালের দিকে আর কিছুই কানে গেল না। নিন্দে, কলঙ্ক, খ্যাতি, অখ্যাতি, সতীত্ব, অসতীত্ব সমস্ত শব্দগুলো যেন মাথার মধ্যে ঢুকে এক অশরীরী আন্দোলন শুরু করে দিলে। সতীর মনে হলো যেন এবার আর তার শাশুড়ী নয়, এবার আর প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ির ভেতরের উঠোনে নয়, এবার যেন কলকাতার চৌমাথার ওপর দাঁড়িয়ে সভ্য-শিক্ষিত মানুষের সার একের পর এক তার ওপর রেপ করছে। আর সে অসাড় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে সকলের সামনে বিবস্ত্র হয়ে—!
শুধু সামান্য একটা-দুটো ক্ষীণ শব্দ যেন তার কানে ভেসে এল দূর থেকে। কেউ বলছে-বরফ, কেউ বলছে-হাওয়া, কেউ বলছে—