কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬১
৬১
নয়নরঞ্জিনী দাসীর মাথার মধ্যে যেন সমস্ত গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। এতদিন যে নিশ্চিন্ততার মধ্যে জীবন চালিয়ে এসেছিলেন তিনি, সেই নিশ্চিন্ততায় যেন হঠাৎ একটা ফাঁক আবিষ্কৃত হলো, তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌঁছেই ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরের ঘরে যাচ্ছিলেন।
নিজের ছেলের সঙ্গে তাঁর বহুদিন ধরেই কথা বন্ধ ছিল। প্রত্যেক দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর নিজের ঘরের মধ্যেই কাটতো। কখন ছেলে খেলে, কখন সে ঘুমোতে গেল, কখন ঘুম থেকে উঠলো, সে-সব কিছুই তাঁর জানবার প্রয়োজন ছিল না। সনাতনবাবুকে গিয়ে ডাকতো শম্ভু। সনাতনবাবু এসে খেতে বসতেন। কী খাচ্ছেন, কেন খাচ্ছেন তাও বুঝতে পারতেন না। শুধু যেন খেতে হয় বলেই খাওয়া, ঘুমোতে হয় বলেই ঘুমোন। ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ছেলের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেলে মা-মণি মুখ ফিরিয়ে নিতেন। সনাতনবাবু কথা বলবার চেষ্টা করবার আগেই মা- মণি কোথায় অদৃশ্য হয়ে যেতেন।
প্রথম প্রথম একদিন-দুদিন সনাতনবাবু এসেছিলেন মা-মণির ঘরে।
বাইরে থেকে ডাকতেন—মা-মণি—
ভেতর থেকে নয়নরঞ্জিনী বলতেন—আমার এখন সময় হবে না খোকা, পরে এসো—
সেই কবে একদিন ছেলের বিয়ে হয়েছিল, ছেলের বউ এসেছিল এ-বাড়িতে, সেই- ই বোধ হয় এ-বাড়ির শেষ উৎসব। সেদিন ন’বৎ বেজেছিল দেউড়িতে, চাকর-দরোয়ান – ঝি-ঠাকুর সবাই নতুন কাপড়-জামা পেয়েছিল। তারপর থেকেই যেন এক দুর্লঙ্ঘ্য অভিশাপ এ-বাড়ির ওপর ধীরে ধীরে নেমে এসেছে। যারা এতদিন এ-বাড়ির ঐশ্বর্যকে ঈর্ষা করে এদের দূরে রেখেছিল, তারা আবার একে একে কাছে আসতে লাগলো। অযাচিতভাবে এসে দেখা করে যেতে লাগলো। শুভাকাঙ্ক্ষী তারা কেউই নয়। নয়ন – ঞ্জিনী তা জানতেন। তারা কেবল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বউ-এর কথা জিজ্ঞেস করতো। চাকর- ঝির সংখ্যা কেন কমছে, গেটে কেন দারোয়ান নেই, সেই সম্বন্ধেই কৌতূহল প্রকাশ করতো। যত কৌতূহল প্রকাশ করতো, ততই তিনি কঠিন পাথর করে ফেরতেন নিজেকে। শেষ পর্যন্ত কেবল ন’দিদিই ছিল। সেই ন’দিদিকে আশ্রয় করেই আবার তিনি আগেকার গৌরব ফিরে পাবার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এবার এমন জাক-জমক করবেন, এমন ন’বৎ সানাই বাজাবেন যে, ভবানী – পুরের গিন্নীদের তাক লেগে যাবে। আলোর ফোয়ারা ছুটিয়ে দেবেন। দু’ হাজার লোক খাওয়াবেন। এসব তাঁর মনের গোপন বাসনা। এ-বাসনা কারোর কাছে তিনি প্রকাশ করতেন না। ভেবেছিলেন একেবারে কাজে দেখিয়ে দেবেন তিনি সকলকে। কিন্তু সব যেন ভেস্তে গেল। সব যেন নিভে গেল হঠাৎ।
আস্তে আস্তে তিনি ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
সনাতনবাবু তখন একমনে পড়ছিলেন।
—খোকা!—
অনেকদিন পরে অনেক দূর থেকে যেন আওয়াজটা ভেসে এল।
—মা-মণি!
সনাতনবাবু উঠে এলেন। বললেন-আমায় ডাকছিলেন মা?
মা-মণির চেহারার দিকে চেয়ে সনাতনবাবু বুঝতে পারলেন না কী বলতে এসেছে মা। তবু দু’জনেই দু’জনের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন।
সনাতনবাবু বললেন-আমায় কিছু বলবে মা-মণি?
মা-মণি বললেন—তোমায় আর বলেই বা কী হবে, তুমি তো কোনও কাজেই আমায় সাহায্য করতে পারবে না! কিন্তু একটা কথা তুমি শুনবে আমার?
সনাতনবাবু বললেন—তোমার সব কথাই তো আমি শুনেছি মা, আমি তো তোমার কোনও কথা অমান্য করিনি কখনও, আর করবোও না—
মা-মণি বললেন—সে-সব পুরোন কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই, তুমি শুনবে কি না বলো? আমার মাথা ঘুরছে, আমি বেশি কথা বলতে আসিনি—
সনাতনবাবু কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। আবার বললেন—তোমার কি শরীর খারাপ হয়েছে মা?
—আমার শরীরের কথা তোমায় ভাবতে হবে না। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খাটাখাটুনি করলে শরীর কখনও কারো ভালো থাকতে পারে না। আমি শরীরের কথা বলতে আসিনি তোমাকে—
সনাতনবাবু বললেন—বলো তুমি কী বলবে, আমি তো শুনছিই—
মা-মণি হঠাৎ বললেন—বৌমার কোনও খবর তুমি রাখো?
—কোন্ বৌমা?
মা-মণি আর থাকতে পারলেন না। বললেন—দেখ সোনা, তুমি ন্যাকামি কোর না আমার সঙ্গে, বৌমার কোনও খবর রাখো কি না সেইটে শুধু আমি জানতে চাই!
সনাতনবাবু এতক্ষণে যেন বুঝতে পারলেন। বললেন—না—
–কোথায় থাকে তা-ও জানো না?
সনাতনবাবু বললেন—না।
—আর সেই ছোঁড়ার খবর? যে সেই মাতব্বরি করতে আসতো বার বার?
—দীপঙ্করবাবুর কথা বলছো?
মা-মণি রেগে উঠলেন। বললেন—অত নাম-ফাম আমার মনে থাকে না বাপু, নাম জানতে চাইও নে আমি! বৌমাকে একবার ডেকে দিতে পারে সে? তার সঙ্গেই তো সে ছিল?
সনাতনবাবু বললেন—ছি মা, ও-কথা বলতে নেই—
নয়নরঞ্জিনীর মাথা তখন আরো ঘুরছে। সমস্ত সন্ধ্যেটা উকিলের কাছে বকাবকি করে শরীর যেন কেমন করছিল। বললেন—দেখ সোনা, একদিন আমি থাকবো না, সেদিন তোমাকেই দেখাশোনা করতে হবে এসব। সবই তো গেছে তোমার, বাড়ি টাকা- কড়ি; কর্তা আমার কাছে যা কিছু গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন সবই গেছে। এখনি উকিলবাবুর কাছে শুনে এলুম এ-বাড়িটাও গেছে, তা আমার আর কী? আর আর ক’টা দিন বাঁচবো? শেষকালে তুমিই থাকবে, তোমার জন্যেই ভাবনা, আর তোমার ভবিষ্যতের জন্যেই এত কথা বলা—
বলতে বলতে নয়নরঞ্জিনীর যেন মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে হলো। দু’পায়ে ভর দিয়ে আর দাঁড়াতে পারছিলেন না।
সনাতনবাবু বললেন—তা আমি কী করবো বলো তুমি? উকিলবাবুর কাছে যেতে হবে?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আমি তো এই উকিলের কাছ থেকেই আসছি, সে-সব কাজ তোমায় কিছু করতে হবে না, তোমায় যে-কাজ করতে বলছি, সে-কাজ কি পারবে তুমি?
—কী কাজ, বলো?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—তাহলে এসো, আমার ঘরে এসো, আমার শরীর আর বইছে না—
বলে নয়নরঞ্জিনী সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। সনাতনবাবুও পেছনে-পেছনে চললেন। ওপরে গিয়ে নয়নরঞ্জিনী বললেন—এসো, বোসো এখেনে, তোমার সঙ্গে কথা আছে—
বহুদিন পরে আবার ছেলে আর মা এক ঘরে বসলেন। নয়নরঞ্জিনী বিছানার ওপর বসে একটু হাঁফ ছেড়ে নিলেন। তারপর বললেন—দরজাটা বন্ধ করে দাও—
সনাতনবাবু দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—না না, কেউ শুনতে পাবে, তুমি দরজায় খিল দিয়ে দাও-
ভেতরবাড়িতে বাতাসীর-মার কাছে দৌড়তে দৌড়তে এল ভূতির-মা। বললে— শুনেছ বাতাসীর-মা, আবার মায়ে-পুতে ভাব হয়েছে যে গো—
বাতাসীর-মা জাঁতি দিয়ে সুপুরি কাটছিল। বললে-কে বললে তোকে লো? কে?
—ওই তো শম্ভু, শম্ভু নিজে দেখে এসেছে, হুড়কো বন্ধ করে কী শলা-পরামর্শ করছে বসে বসে কে জানে মা? কার কপাল ভাঙছে মাগী!
শম্ভুও এসে পড়েছিল। বললে—হ্যাঁ গো সত্যি, আমি দাঁড়িয়ে ছিলুম পেছনে, আমাকে দেখে মা-মণি দরজায় হুড়কো দিতে বললে দাদাবাবুকে—
ভূতির-মা বললে—এখন টাকার খাঁকতি হয়েছে, এখন বোধ হয় বৌদিমণিকে খোশামোদ করবে মাগী—
শম্ভু বললে—শুনিচি বৌদিমণি নাকি বাপের এক কাঁড়ি টাকা পেয়েছে—
বাতাসীর-মা সুপুরি কাটতে কাটতে বললে—মুয়ে আগুন, অমন শাউড়ীর, সেই যে কথায় আছে না-ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারবার গোঁসাই-–!
ভূতির-মা বললে—তা ভাতার যদি নিজে ডাকতে যায় তো ভাতারের কথা ফেলতে পারে মাগ?
বাতাসীর-মা আর থাকতে পারলে না। বললে—ওলো, তবে শোন বলি—শুন ভাতার শুন শ্বশুর ধরি তোমার পায়, আর রণে মাতে গেলে গামছা রয় না গায়। এও হয়েছে তাই লো—
হঠাৎ ওপর থেকে ডাক এল-শম্ভু—
দাদাবাবুর গলা নয়, মা-মণির। শম্ভু বললে—ওই, ডাক পড়েছে—
সনাতনবাবু তখন ঘর থেকে বেরিয়েছে। মা-মণিও বেরিয়েছে। মুখ দেখে বোঝা গেল যেন এতক্ষণে শান্ত হয়েছে খানিকটা মা-মণি। বাইরে তখন চাঁদ উঠেছে পূবদিকে। পূর্ণিমার চাঁদ। মা-মণি একবার সেই দিকে চাইলেন। বললেন—বেশি দেরি কোর না সোনা, রাত অনেক হয়েছে—
সনাতনবাবু বললেন—না মা-মণি, আমি যাবো আর আসবো—
মা-মণি বললেন—শম্ভু, তুমি সেই দীপঙ্করবাবুর বাড়িটা চেন তো? তুমিও চলো আমার সঙ্গে—
—আমিও যাবো?
তাড়াতাড়ি হাজরার মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতেই মা-মণি আবার বললেন—বেশি দেরি কোর না সোনা, যাবে আর আসবে, অনেক রাত হয়েছে—
আর ঠিক তারপরই সেই বিপর্যয়টা ঘটলো। সনাতনবাবু তখনও গাড়িতে ওঠেননি শম্ভু গাড়ির দরজাটা খুলে ধরে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সাইরেন বেজে উঠলো বিকট শব্দ করে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটা থর থর করে কেঁপে উঠলো, সমস্ত কলকাতা শহরটা থর থর করে কেঁপে উঠলো, সমস্ত ইন্ডিয়া, সমস্ত সাউথ- ইস্ট-এশিয়া কম্যান্ড যেন থর থর করে কেঁপে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। টোকিও থেকে জেনারেল তোজো বম্বার পাঠিয়েছে ক্যালকাটাতে। ক্যালকাটা ধ্বংস করে ফেলবে, ব্রিটিশ হেড কোয়াটার্সের ইস্টার্ন সাপ্লাই অফিসের মাথায় বোমা ফেলবে য়্যাক্সিস পাওয়ার্স। প্রথমে মৌমাছির গুন গুন শব্দের মত একটা ক্ষীণ সুর। তার পর সব নিস্তব্ধ। সবাই প্রতীক্ষা করছে মৃত্যুর।
মা-মণি বললেন—সোনা, নেমে এস, সোনা, নেমে এসো—
আর কোথায় মাটি থেকে পঞ্চাশ হাজার ফুট ওপরে, একেবারে আকাশের হৃৎপিন্ডের অভ্যন্তরে য়্যাক্সিস সোলজাররা চোরের মত ইন্ডিয়ার দেয়ালে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে এখানে। এখানে মানুষের সংসারে তখন কোন্ নাটকের কোন্ অঙ্ক অভিনয় হচ্ছে, প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, গড়িয়াহাট, লেভেল-ক্রসিং, স্টেশন রোড, প্যালেস-কোর্ট আর হাইকোর্টের ভেতরে, কোথায় টাকার আর ভালবাসার আর ঘৃণার আর বঞ্চনার সিঁদ কাটা হচ্ছে তাও জানতে পারলে না। উনিশ শো বিয়াল্লিশ সালের বিশ-এ ডিসেম্বর রাত্রে পর-পর বোমা ঢেলে গেল একটা…..দু’টো….. তিনটে….