কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৫
৬৫
পীরালিও প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ঘর পরিস্কার করতে-করতে হঠাৎ মুখোমুখি হতেই চমকে উঠেছিল।
মেমসাহেব, আপনি?
—আমি এলুম পীরালি। তোমাদের দেখতে এলুম।
পীরালি সেলাম করতেই ভুলে গিয়েছিল। মাথা নিচু করে দু’বার হাত ঠেকালে কপালে।
—কিন্তু সাহেব তো নেই মেমসাহেব?
সতী বললে—সাহেব কোথায় গেছে?
যেন সতী জানে না। যেন সতী মিস্টার ঘোষালকে বাইরে যেতে দেখেনি। মিস্টার ঘোষালের গাড়িটা সামনে পড়তেই আর একটু হলে ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে আত্মগোপন করতে পেরেছিল বলেই রক্ষে। আগের দিন সমস্ত রাত ঘুম হয়নি। ঘুম না-হবারই কথা। সেই রাত্রে সতী যেন জীবনে সেই প্রথম দীপঙ্করের ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেয়েছিল। সাইরেন বাজবার পর অনেকক্ষণ সব শান্ত, সব স্তব্ধ। সমস্ত পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মানুষ নেই, মানুষের প্রেতাত্মাও বুঝি নেই কোথাও। সাইরেন বাজবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ করেছে সবাই। আলো নিভিয়ে দিয়েছে। সবাই পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারে অসাড় হয়ে গেছে।
সতী জিজ্ঞেস করেছিল—কী ভাবছো দীপু?
দীপঙ্কর বলেছিল—কিন্তু কেন তুমি আমাকে টেনে আনলে সতী? কী উদ্দেশ্য তোমার?
—কিন্তু এ-সময়ে কি কেউ বাইরে থাকে? নিশ্চয় কোথায়ও বোমা পড়বে। আমি জেনে-শুনে কী করে তোমাকে ছেড়ে দিই বলো তো?
দীপঙ্কর বলেছিল—কিন্তু আমি বাঁচলে তোমার কী লাভ?
—আমার লাভ না-হলেও তোমার তো লাভ! তুমি বেঁচে থাকলে তোমার নিজেরও তো ভালো?
—আমার ভালো কি তুমি সত্যিই চাও?
সতী অন্ধকারের মধ্যেই বলেছিল—চাই না, এ-কথা তোমায় কে বললে? জানো, তোমার মা’র পরে আমার মত এমন করে তোমার ভালো কেউ চায়নি!
অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায়নি। সতীর মনে হয়েছিল একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ যেন কোথা থেকে শোনা গেল। কার দীর্ঘশ্বাস, দীপঙ্করের না তার নিজের, তাও ঠিক বোঝা গেল না। তবু শব্দটা শুনে মনে হলো যেন বড় ক্লান্তি বড় শ্রান্তির খাদ মেশানো তাতে। যেন সতীই নয়, দীপঙ্করও যেন ক্লান্ত। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের উনিশের-একের-বি বাড়িটা থেকে যে ছেলেটা একদিন যাত্রা শুরু করেছিল সংসারে, সে যেন এতদিন পরে এত বাধা অতিক্রম করে এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এ পৌঁছে বড় বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
বাইরে তখন সব নিঃঝুম। দীপঙ্কর হঠাৎ বললে-আমাকে আজ এমন ভাবে এখানে এনে তুমি ভুল করেছ সতী!
—কেন? কী ভুল করলাম?
দীপঙ্কর বললে—তুমি জানো না, আমি কত দুর্বল! এমন ভাবে আমাকে এখানে এনে তুমি ভাল করো নি!
সতী বললে—তোমাকে বিপদের মধ্যে ছেড়ে দিলেই কি তোমার ভাল করতাম বলতে চাও?
—হয়ত ভাল করতে! হয়ত তাই করাই তোমার উচিত ছিল। হয়ত তাই করলেই আমি সহজে আত্মরক্ষা করতে পারতাম!
সতী কিছু কথা বললে না খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ বললে—সত্যি, তোমার মত যদি মনের জোর পেতাম আমি…..
দীপঙ্কর বললে—তুমি আমার মন চেনো না বলেই এ-কথা বললে! আমি নিজেই এতদিন ধরে এত চেষ্টা করেও আমার নিজের মনকে চিনতে পারলাম না! তুমি কত দিন কত আঘাত দিয়েছ, কত অপমান করেছ, তবু কি দূরে চলে যেতে পেরেছি? আমার মনের যদি অত জোরই থাকতো তো তোমার এত বড় অভিযোগের পরেও আমি এখানে আসি?
সতী বললে—সত্যি দীপু, ও-ও যদি তোমার মতন হতো!
—কে? কার কথা বলছো?
কিন্তু প্রশ্নটা করেই দীপঙ্কর ভুল বুঝতে পেরে থেমে গেল। অন্ধকারের মধ্যে থেকে সতীর গলার আওয়াজ শোনা গেল আবার। সতী বলতে লাগলো—সত্যি বলছি দীপু, তোমার মতন যদি ও হতো!
দীপঙ্কর বললে—ছিঃ, সনাতনবাবুকে তুমি এখনও চিনলে না!
—খুব চিনেছি। আমার আর ওকে চিনতে বাকি নেই। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন এক ঘরে এক বিছানায় শুয়েও যদি না-চিনতে পেরে থাকি তো আর চিনতে পেরেও কাজ নেই। তোমাকে দেখি আর ভাবি ও-মানুষটার কথা! জানো দীপু, রূপ আছে বলে আমার খ্যাতি ছিল, গুণও কিছু ছিল বলে সবাই বলেছে, কিন্তু সে-সব কী কাজে লাগলো শেষ পর্যন্ত? আমার রূপ-গুণ দিয়ে আমি কার কোন্ উপকারটা করতে পারলুম? অথচ দেখ—
একটু পরে আবার সতীর গলার শব্দ শোনা গেল। সতী বলতে লাগলো—অথচ দেখ আজ আমার সব থেকেও কিছু নেই! ছোটবেলায় লক্ষ্মীদির জন্যেই বাবার ভাবনা ছিল, আমার জন্যে বাবা ভাবতেন না। বাবা বলতেন—সতী আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে। সতী নিজের ভালো-মন্দ বোঝে, ওর জন্যে আমার মাথা-ব্যথা নেই, কিন্তু লক্ষ্মীর কথা ভেবেই আমার রাত্তিরে ঘুম হয় না। কিন্তু আজ বাবা বেঁচে থাকলে কী হতো বলো তো? লক্ষ্মীদি আজ কোথায়, আর আমি কোথায়—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু লক্ষ্মীদিই কি সুখী?
সতী বললে—তা আমিই কি সুখী বলতে চাও? এত ভাল হয়ে আমি কী সুখ পেলাম জীবনে? কী লাভটা হলো আমার? তাহলে লক্ষ্মীদির মতন জীবন কাটালেই পারতাম! ওই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে শ্বশুরবাড়ির সামনে ঘর-ভাড়া নিয়ে আমিও তো বেশ আনন্দে লক্ষ্মীদির মত দিন কাটাতে পারতাম!
কিন্তু তাহলে তোমার বিবেকের কাছে তুমি কী জবাবদিহি করতে?
—তা লক্ষ্মীদিই কি বিবেকের কাছে কিছু জবাবদিহি করে ভেবেছো? কোন্ দুঃখটা পাচ্ছে শুনি সে? লক্ষ্মীদির তো কোনও কষ্টই নেই। টাকা, ছেলে, স্বামী সংসার সবই তো লক্ষ্মীদি পেয়েছে। কোটা পেতে বাকি রয়েছে লক্ষ্মীদির? লক্ষ্মীদির কাছে আমি কী? লক্ষ্মীদির কাছে আমি কতটুকু? আজ লক্ষ্মীদির বাড়ি ছিল বলে তবু মাথা গোঁজবার জায়গা পেয়েছি একটা, নইলে কোথায় থাকতুম আমি? কী করতুম বলো তো?
হঠাৎ কোথায় যেন গুম্ গুম্ করে শব্দ হলো কয়েকটা। বোধহয় কোথাও বোমা পড়লো। দুজনেই চুপ করে রইল। তারপর আবার সব চুপচাপ। অন্ধকারের মধ্যে দু’জনেই চুপ করে রইল। তারপর আবার সব চুপচাপ। অন্ধকারের মধ্যে দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দটা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। দীপঙ্করের মনে হলো যেন বড় কাছাকাছি বসে আছে সে। দীপঙ্কর একটু দূরে সরে বসলো।
সতী বললে—ওখানে কী হচ্ছে এখন কে জানে!
—কোথায়?
—প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে!
—ওদের কথা তুমি এখনও ভাবো?
সতী বললে—ভাববো না? তুমি যেমন এখানে না-এসে পারো না, আমিও যে তেমনি ওদের কথা না-ভেবে থাকতে পারি না। এক-একবার মনে হয় আর ভাববো না। আমার কথা যে ভাবে না, আমার কথা নিয়ে যে মাথা ঘামায় না, তার কথা আমিও ভাববো না। কিন্তু জানো দীপু, যখন থেকে শুনলাম যে ওদের বাড়ি নীলেম হয়ে যাবে, ওদের থাকবার জায়গা থাকবে না, তখন থেকে বড় কষ্ট হচ্ছে মনে মনে-অথচ আমি কোথায় থাকছি, কী করছি, তা নিয়ে তো ওদের কোনও মাথা-ব্যথা নেই?
—ওরা যদি তোমার কাছে টাকা চাইতে আসে তো তুমি দেবে নাকি?
—সে তো পরের কথা। ওরা তো আর সত্যি-সত্যি টাকা চাইতে আসছে না!
—কিন্তু চাইতে আসতেও তো পারে! ওদের কিন্তু টাকার ভীষণ দরকার। টাকা না দিলে কোর্ট থেকে ওদের বাড়ি দখল করবে! তুমি টাকা দিলে ওরা এই বিপদ থেকে বেঁচে যায়।
সতী যেন রেগে গেল। বললে—ওরা তো বাঁচবেই। কিন্তু কেন আমি দেব বলো তো? আমার কীসের দায় পড়েছে? আমার বিপদের সময় কি ওরা দেখেছে একটু? আমি যখন বিপদে পড়েছিলুম, কোনও আশ্রয় না-পেয়ে ঘোষালের প্যালেস-কোর্টে গিয়ে উঠলুম, তখন কি একবারও খোঁজ নিয়েছিল আমার?
দীপঙ্কর বললে—বিপদের দিনে কেউ কাউকে দেখে না সতী, সেটা আশা করাই অন্যায়—
—কিন্তু তুমি তো দেখেছিলে?
দীপঙ্কর বললে—আমার কথা ছেড়ে দাও—
—কেন, ছাড়বো কেন? তোমার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক? তবু তো তুমি বরাবর আমার দেখা-শোনা করেছ! তুমি ভুলে যেতে পারো কিন্তু আমি তো ভুলিনি সে-সব দিনের কথা! তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলুম, চাকর মনে করে চারটে পয়সা তোমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলুম! তারপর আমি কত অপমান করেছি, কত অন্যায় করেছি—অন্য কেউ হলে কি আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতো সে? অন্য কেউ হলে আজকে আমার বিপদের দিনে দেখতো আমাকে?
দীপঙ্কর হেসে উঠলো। বললে—তোমার তো স্মরণশক্তি খুব দেখছি?
সতী যেন আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। বললে—স্মরণশক্তি নয় দীপু, এ শুধু স্মরণশক্তি নয়—
—স্মরণশক্তি নয় তো কী?
সতী বললে—সে তুমি বুঝবে না, সে আমি তোমাকে বোঝাতেও পারবো না। যদি কোনওদিন আমার ক্ষমতা হয় তো তোমার এ-ঋণ আমি একদিন শোধ করবোই —
দীপঙ্কর আবার হাসতে লাগলো। বললে—শোধ করবে? কী করে?
—কী জানি কী করে শোধ করবো! কিন্তু মনে হয় এ-ঋণ শোধ করতে না-পারলে আমি হয়ত স্বর্গে গিয়েও সুখ পাবো না।
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি বলে দিতে পারি কী করে এ-ঋণ তুমি শোধ করতে পারবে।
—কী করে?
—তোমার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে। তুমি সনাতনবাবুর কাছে গেলেই আমি সবচেয়ে সুখী হবো সতী, আর কিছুতেই অত সুখী হবো না আমি।
—কিন্তু এর পরেও তুমি আমাকে যেতে বলছো সেখানে? এত ঘটার পরেও? তুমি সব জেনেও এই কথা বলতে পারছো? এর পরে হয়ত আমার কাছে টাকা আছে শুনে তারা আসবে, হয়ত খুব খাতিরও করবে জানি, কিন্তু তাতেই কি আমি আগেকার সব অপমান ভুলে যেতে পারবো? এর পরেও কি আমি তাদের ক্ষমা করতে পারবো?
দীপঙ্কর বললে—করলেই বা! তাতে তো তুমি নিজের কাছে নিজে ছোট হবে না! সতী কী যেন ভাবতে লাগলো। বললে—কিন্তু সত্যিই তাতে তুমি সুখী হবে? তাতেই তোমার সব চাওয়া-পাওয়া মিটে যাবে?
—যদি বলি যাবে?
সতী বললে—তোমাকে তো বলেছি দীপু, তোমার জন্যে আমি তাও করতে পারি, দাঁতে দাঁত চেপে না-হয় আমি সেখানেই পড়ে রইলুম সারাজীবন, কিন্তু তুমি? তুমি কী করবে? তুমি কী পাবে? তোমার কী লাভ হবে তাতে?
দীপঙ্কর বললে—সংসারে লোকে লাভ-লোকসানের নানারকম ব্যাখ্যা করে, আমারও হয়ত নতুন ধরনের একরকম ব্যাখ্যা আছে। যে-ব্যাখ্যা কেউ আজ পর্যন্ত করেনি!
—কিন্তু কেন? কেন তুমি এত কষ্ট করতে যাবে দীপু? কীসের জন্যে? কোন্ দায়ে? দীপঙ্কর বলে—ও-সব কথা নাই বা বললে তুমি, অন্য কথা বলো এখন। সতী বললে—কিন্তু কেন বলবো না? কেন তুমি সারাজীবন এমন করে নিজেকে কষ্ট দেবে? তোমার কষ্ট দেখলে যে আমারও কষ্ট হয়! তোমার জন্যে যে আমারও রাত্রে ঘুম হয় না, তা জানো?—সত্যি বলো তুমি, তোমাকে বলতেই হবে, আমার কথার জবাব দিতেই হবে—
বলতে বলতে সতী যেন এগিয়ে এল। অন্ধকারের মধ্যেই দীপঙ্করের হাতটা আন্দাজে ধরে ফেললে জোরে। বললে—তোমাকে এ-কথার জবাব দিতেই হবে দীপু, জবাব না দিলে তোমাকে আজ আমি ছাড়বো না—
দীপঙ্কর হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। বললে—ছি, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
সতীর হাতের স্পর্শটা যেন গরম ঠেকলো দীপঙ্করের কাছে। বললে—এ কি করছো তুমি?
সতী তখনও বলছে—না, জবাব না-দিলে তোমায় আমি ছাড়বো না আজ, দিতেই হবে জবাব—
সতী যেন আরো জোরে চেপে ধরলো তার হাতটা। চারিদিকে সব নিস্তব্ধ, সব অন্ধকার। দীপঙ্করের মনে হলো এতদিন পরে তার জীবন যেন তাকে এক কুটিল পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এতদিন বঞ্চনা করে এসে যেন এবার সে প্রতিশোধ নেবে তার ওপর। দীপঙ্কর বললে—ছাড়ো—
কিন্তু সতীকে ছাড়তে হলো না। তার আগেই অল্ ক্লিয়ার সিগন্যাল্ বেজে উঠেছিল বিকট শব্দ করে। অস্পষ্ট মানুষের কোলাহল শোনা গেল বাইরে। শান্ত শহর যেন এতক্ষণ নির্জীব হয়ে ঘুমোচ্ছিল, এবার জেগে উঠলো। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি ঘরের আলোটা জ্বেলে দিলে। সতীও ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। রঘু বাইরে ছিল, সে- ও ডাকলে বাইরে থেকে—দিদিমণি—
দীপঙ্কর ঘর থেকে বেরোল। পেছন ফিরে দেখলেও না একবার। তারপর সদর দরজা খুলে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।
সে-রাত্রে তারপর আর ঘুম আসে নি সতীর। কেবল মনে হয়েছিল-এ কেমন করে সম্ভব হলো? রঘু খাবার কথা বলতে এসেছে। কিন্তু শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে সতী কিছুই খায়নি। বিছানায় শুয়ে কেবল সারারাত ছট্ফট্ করেছে। হয়ত কলকাতার কোথাও বোমা পড়েছে, কিংবা হয়ত পড়েনি। অল্ ক্লিয়ার সিগন্যাল বাজবার পর অনেক রাত পর্যন্ত এ-আর-পি সিভিক-গার্ডরা রাস্তায় টহল দিয়ে হল্লা করেছে। মনে আছে সমস্ত রাতটা যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটেছিল। তারপর আস্তে আস্তে ভোর হলো। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অপরাধটা যেন আরো প্রকট হয়ে উঠলো নিজের কাছে। নিজের কাছেই নিজের লজ্জা করতে লাগলো। তারপর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে রঘুকে ডাকলে।
রঘু ঘুমোচ্ছিল। অনেক রাত্রে শুয়েছে সে। ধড়ফড় করে উঠে বসতেই দিদিমণিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। বললে—কী হলো দিদিমণি?
সতী বললে—আমি একবার বেরোচ্ছি এখন রঘু—
—আমি সঙ্গে যাবো?
সতী বললে—না, শুধু দরজাটা বন্ধ করে দাও—
—গাড়ি ডাকতে হবে না?
সতী বলেছিল—না, আমি হেঁটেই চলে যাবো এ-টুকু।
তারপর আরো অনেক প্রশ্ন করেছিল রঘু। কোথায় যাচ্ছে সতী, কখন ফিরবে, কিন্তু কোনও কথারই জবাব দিতে পারেনি তখন। মনের সে-স্থিরতাই ছিল না তার তখন তারপর সোজা চলে এসেছে একেবারে এখানে। প্রথমে একটু ভয় ছিল। হয়ত সকাল বেলা দেখা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মনে মনে একটা সন্দেহ ছিল— অনেক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে হয়ত ঘোষাল বাড়িতে নাও থাকতে পারে। তারপরে গাড়িটা দেখেই চিনতে পেরেছিল। আর তারপরেই মিস্টার ঘোষাল সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে গাড়িতে উঠলো। আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছেড়ে দিল।
পীরালি বললে—আপনাকে অনেক দিন দেখেনি মেমসাহেব?
সতী বললে—তোমার সব ভালো ছিল তো পীরালি? কাজ-কর্ম ভাল চলছে তো?
পীরালি বললে—শুনেছেন তো সাহেব খালাস পেয়ে গেছেন কাল?
সতী বললে—হ্যাঁ শুনেছি, সেই জন্যেই তো দেখা করতে এলাম—
পীরালি বললে—একটু বসুন না মেমসাহেব, এতদূর এলেন একটু কফি বানিয়ে দিচ্ছি—ভেতরে এসে বসুন না—
সতী ভেতরে ঢুকলো। অনেকদিন পরে আবার এখানে আসা। অনেক দিন অনেক রাত কেটেছে এই বাড়িতে। সে-সব মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়লে এখনও যেন আতঙ্ক হয় সতীর। এখানেই তার হাত দিয়ে হাজার-হাজার টাকা নিয়েছিল মিস্টার ঘোষাল। এই ঘরেই কত হাজার-হাজার মেয়ের জীবন-যৌবন লুঠ হয়েছে, লক্ষ-লক্ষ টাকার কত বেসাতির বেচা-কেনা চলেছে এই বাড়ির এই কামরাতেই, তার হিসেব কোথাও লেখা নেই। এখানে এই খবরের কাগজ আর টেলিফোনের পৃথিবীতেই কত ওয়ার, কত স্ট্রাগল ঘটে গেছে। নিঃশব্দে কত বোমা এখানেই ফেটেছে কেউ টের পায়নি এতদিন। ব্রিটিশ রাজত্বের শুরু থেকেই এখানে টাকা, নাম, পলিটিক্স, রক্ত নিয়ে কত রাহাজানি চলেছে। কলকাতার এই সব ফ্ল্যাটের ভেতরেই তো আসলে ‘ ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হয় প্রথম, তারপর তো পৌঁছোয় অ্যাসেমব্লিতে, পার্লামেন্টে। এখানেই যে-সব ষড়যন্ত্র হয়,—তাই-ই একদিন পার্লামেন্টে আইন হয়ে পাস হয়ে যায়। এতদিন শুধু ধরা পড়েনি এই যা তফাৎ। আজ ধরা পড়েই মিস্টার ঘোষাল মহা ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠেছে। নইলে গভর্নর, মিনিস্টার, মিনিস্টারদের আই-সি-এস-দের সঙ্গে মিস্টার ঘোষালের আর তফাৎটা কোথায়?
—আমার সেই ট্রাঙ্ক, সেই আলমারী-ওয়ারড্রোব সব কোথায় গেল পীরালি?
পীরালি কফি এনে দিয়েছিল। বললে—আপনার ফ্ল্যাট তো খঅলি করে দেওয়া হয়েছে মেমসাহেব, জিনিসগুলো সব আমি রেখে দিয়েছি পাশের কামরায়—
—আমার শাড়ি-ব্লাউজ সব ছিল যে সেখানে?
পীরালি বললে—সে যেমন ছিল তেমনি আছে মেমসাহেব, আমি কিছুতে হাত দিইনি। এসে দেখুন না আপনি—
—কিন্তু চাবি? আমার চাবিটা কোথায়?
পীরালি বললে—চাবিও আমি রেখে দিয়েছি মেমসাহেব, আমি চাবিতে হাতই দিইনি—
বলে ঘোষাল-সাহেবের ড্রয়ার থেকে এক তাড়া চাবি বার করে দিলে। অনেক দিন হাত পড়েনি চাবিতে। মরচে ধরে গেছে।
পীরালি বললে—আমি সব ভালো করে রেখে দিয়েছি মেমসাহেব আপনার জন্যে, আমি হুজুরকে আপনার কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি,
চাবিটা নিয়ে সতী পাশের কামরায় গেল। এ-সব ফার্নিচার মার্চেন্টদেরই দেওয়া। এই স্টীলের ফার্নিচারের সেট। এই ওয়ারড্রোব, এই ড্রেসিং টেবল, এই খাট, এই সমস্ত কিছু। পয়সা দিয়ে মিস্টার ঘোষালকে কিনতে হতো না কিছু।
—একটা কথা রাখবে পীরালি?
—কী কথা মেমসাহেব?
সতী বললে—আমি যে এখানে আজকে এসেছিলুম, এ-কথা তুমি নাই বা বললে তোমার সাহেবকে।
—কেন মেমসাহেব? সাহেব যদি কিছু জিজ্ঞেস করে?
সতী বললে—তোমায় কিচ্ছু বলতে হবে না সাহেবকে, জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবে না। আমার জন্যে তুমি এইটুকু করতে পারবে না পীরালি? আমি বড় কষ্টে আছি। আর তুমি তো জানো পীরালি তোমার সাহেব কী-রকম রাগী মেজাজের লোক?
পীরালি তা হাড়ে হাড়ে জানে। বললে—আপনিও তো জানেন মেমসাহেব, আমি আর নিজের মুখে কী বলবো। সাহেব আসল হারামীর বাচ্চা, মোটা টাকা মাইনে দেয সাহেব তাই পড়ে আছি। আচ্ছা এত লোকের ফাঁসি হয়, সাহেবের কিছু হয় না মেমসাহেব?
সতী বললে—সাহেব যে বড়লোক পীরালি। বড়লোকদের কি কেউ ধরতে পারে?
সতী ওয়ারড্রোবটা খুলে ফেললে। শাড়ি জামা দু’একটা নিলে।
পীরালি বললে—আমি কাগজ দিয়ে ভালো করে প্যাকেট বানিয়ে দেব, দিন আমাকে ওগুলো—
কিন্তু আসলে শাড়ি নিতে তো আসেনি সতী! আসল জিনিসগুলো কোথায় রেখেছে মনে পড়ছে না। সতী বললে—ওই ট্রাঙ্কটা খুলে দাও তো পীরালি—ওর ভেতরেও অনেক জিনিস আছে আমার—
সেই ট্রাঙ্কের ভেতরেই পাওয়া গেল আসল জিনিসগুলো। একটা, দু’টো, তিনটে অনেকগুলো। অনেকগুলো জিনিস পাওয়া গেল ভেতরে। ভাগ্যিস সবগুলো রেখে দিয়েছিল সেদিন বুদ্ধি করে। এগুলো যে এতদিন পরে কাজে লাগবে, সেদিন সতী তা ভাবতেই পারেনি। ট্রাঙ্কের সমস্ত জিনিসপত্রগুলো ঘেঁটে যা-কিছু পেলে নিয়ে নিলে নিজের ব্যাগের মধ্যে পুরে।
পীরালি বললে—আর কী নেবেন মেমসাহেব?
সতী বললে—না, আর কিছু না পীরালি—এতেই হয়ে যাবে—
তারপর আবার বললে-কিন্তু তোমাকে যা বললুম তোমার মনে থাকবে তো পীরালি? সাহেবকে আমার কথা কিছু বলবে না তো?
.
কিন্তু ওদিকে গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এর বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াতেই মিস্টার ঘোষাল দরজা খুলে নেমে পড়লো। তারপর সোজা সদর দরজায় কড়া নাড়তেই রঘু এসে দরজা খুলে দিয়েছে।
—কাকে চাই হুজুর?
—মিসেস ঘোষ আছে? বলো মিস্টার ঘোষাল এসেছেন।
তারপর বাড়িতে মিসেস ঘোষ নেই শুনে অবাক হয়ে গেল। সে কি! এত আর্লি- আওয়ার্সে কোথায় গেল!
—এখানে থাকে না এখন? কাল েরাত্রে কোথায় ছিল মিসেস ঘোষ?
—আজ্ঞে এখানেই ছিলেন দিদিমণি। আজ ভোরবেলাই বেরিয়েছেন।
—কোথায় গেছে এত সকালে?
রঘু বললে—আজ্ঞে তা জানি না—
—কখন ফিরে আসবে? এখানেই লাঞ্চ খেতে আসবে তো?
তারপর হতাশ হয়ে বললে—ঠিক আছে, আমি আবার আসবো। এই দুপুরের আগেই আমি ফিরে আসবো আবার, বাড়ি ফিরে এলে মিসেস ঘোষকে আমার কথা বোল, ঠিক বলে দিও —
বলে মিস্টার ঘোষাল আবার গিয়ে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভারকে বললে—চলো ওল্ড বালিগঞ্জ, ব্যারিস্টার দত্ত সাহেবের বাড়ি—
গাড়িটা ছেড়ে দিল। স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যালের কেস-এর ব্যাপার, আর একবার কনসাল্ট করে আসা ভাল। আর কালকের ব্যাপারে থ্যাঙ্কস্ দিয়ে আসাও দরকার একবার।