কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৬
৬৬
অত রাত্রে কিছুই পায়নি দীপঙ্কর। না একটা ট্যাক্সী, না ট্রাম, বাস, না অন্য কিছু। অন্ধকার রাস্তায় শুধু ঝাপসা পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়েছে। গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং- এর ভেতরে ভূষণ বোধ হয় ডিউটি করছিল। কয়েকজন সিভিক-গার্ড আর এ-আর-পি’র ভলান্টিয়ার মাথায় স্টীল-হেলমেট পরে এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এখনি যেন কোথাও সর্বনাশ হয়ে গেছে। রাস্তার কয়েকজন ভিখিরি নিরুপায়ের মত খোলা আকাশের তলায় পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে বসে ছিল। তাদের জীবনও নেই, জীবনের ভয়ও নেই। এ- আর-পি’রা এসে তাদের বকাবকি করছে। এই কলকাতা শহরেই এত মানুষ। এখানে মানুষ আছে এত, কিন্তু মানুষের আশ্রয় এত নেই। অথচ এই ইন্ডিয়ার পয়সাতেই স্যার আজিজুল হক গ্রেটব্রিটেনে ইন্ডিয়ার হাই কমিশনার। এই ইন্ডিয়ার টাকাতেই স্যার নলিনীরঞ্জন সরকার কমার্স মেম্বার। শীতে থর থর করে কাঁপছে মানুষগুলো। রোজ খবরের কাগজে লিস্ট বেরোয় কারা মরলো না-খেয়ে। ক’জন মরলো। বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ডিরেক্টর অব ইনফর্মেশন নাম-ধাম ছাপিয়ে দেয় তাদের। কিন্তু ইন্ডিয়ার বাইরে সে-খবর পাঠানো নিষেধ। পাঠালে আমেরিকা জানতে পারবে, ব্রিটিশ পাবলিক জানতে পারবে। অ্যালায়েড পাওয়ার্স জানতে পারবে। তার চেয়ে তারা জানুক ইন্ডিয়ার গান্ধী কেউ নয়, নেহরু কেউ নয়, জানুক সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা চায় ব্রিটিশ-রাজ। জানুক ইন্ডিয়ার কোটি কোটি মানুষ সুখে আছে, আরামে আছে। কোটি কোটি মানুষের একমাত্র ভাগ্যবিধাতা ফজলুল হক। একমাত্র ত্রাণকর্তা লর্ড লিনলিথগো।
লর্ড লিনলিথগো পরের দিন কাগজে স্টেটমেন্ট ছাপিয়ে দিলে। কলকাতাই যুদ্ধের প্রথম বলি। কলকাতাতেই প্রথম বোমা পড়লো।
I am glad to learn that city’s defences have proved so effective. Yours is the first capital city in India to suffer in this war a baptism of fire and her citizens have proved an admirable example of steadiness and fortitude. Well done Calcutta!
.
—একটা পয়সা দাও না বাবা!
রাস্তার দোকান-পাট সমস্ত বন্ধ। পয়সা নিয়ে কী করবে ভিখিরিটা কে জানে। কাল সকালেই হয়ত কিছু কিনবে। দীপঙ্কর পকেট থেকে একটা আনি বার করে দিলে লোকটার হাতে। চেহারাটা দেখে চমকে উঠলো। এ তো ভিখিরি নয়, এরা যে মানুষ। এদের জন্যে ইস্পাহানী কোম্পানীকে এজেন্ট বানিয়েছে লর্ড লিনলিথগো। তারা ছ’টাকা চার আনা দরে চাল কিনে আর্মির কাছে বেচছে এগার টাকা দরে। মনে আছে যেদিন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে গিয়েছিল, ছিটে বলেছিল—চাকরি করে কি করবি তুই দীপু, কত টাকা জমাবি? তার চেয়ে কিছু চাল কিনে স্টক কর। অনেক প্রফিট হবে। ছিটেও তাই কিনেছিল। উঠোনের মধ্যে গুদাম করে মণ-মণ চার স্টক করেছিল। আর ফোঁটা গিয়েছিল জেলে। কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
বাড়ির কাছে আসতেই যেন আবার সব মনে পড়েছিল। বাড়িতে সন্তোষ-কাকার মেয়ে আছে, কিরণের মা আছে, কাশী আছে। এতক্ষণে যেন তাদের কথাও মনে পড়েছিল।
মাসিমা মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল—কী হয়েছে তোমার বাবা? খাবে না কেন?
দীপঙ্কর কিছুই বলতে পারেনি মুখ ফুটে। শুধু বলেছিল—মাসিমা—
—দেখ তো কী কান্ড। এদিকে বোমা পড়ছে, আর আমি বাড়ির ভেতর একলা মেয়েমানুষ, কেমন করে সামলাই বলো তো সব?
তারপর আবার জিজ্ঞেস করেছিল—তা এত রাত পর্যন্ত তোমাদের আপিস খোলা থাকে কী জন্যে বাবা? রাত্তিরেও কাজ হয় আপিসে? তোমার না-হয়—কেউ নেই, কিন্তু আপিসের আর কারোরই সংসার নেই নাকি?
দীপঙ্কর বলেছিল—আপনারা খেয়ে নিন মাসিমা, আমি কিছু খাবো না আজকে—
কিন্তু দীপঙ্কর না-খেলে আর কেউ খাবে কী করে! ক্ষীরোদা চুপ করে বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।
মাসিমা বাইরে এসে বলেছিল—তুই খেয়ে নে বাছা; আমি আর খাবো না—আয় খাবি আয়—
ক’দিন থেকেই মাসিমা বলছির ক্ষীরোদাকে—হ্যাঁরে, রোজ এত রাত করে কোত্থেকে আসে বল তো দীপু? তুই জানিস কিছু? কোথায় থাকে ও?
কাশী সবজান্তা। কাশী বলতো-দাদাবাবু যে আপিসের বড়সায়েব মাসিমা, দাদাবাবুর যে অনেক কাজ!
—তুই থাম দিকিনি! তুই সব জেনে বসে আছিস একেবারে! তোকে আমি জিজ্ঞেস করেছি?
রাত্রে পাশে শুয়ে মাসিমা জিজ্ঞেস করতো—হ্যাঁ রে, তুই কীরকম মেয়ে রে? এতদিন আছিস এ-বাড়িতে আর একটা টু-শব্দ বেরোয় না তোর মুখ দিয়ে? দেশে তোদের কে আছে? কেউ একবার খবর নিতেও আসে না তোর? মামা জ্যাঠা কাকা কেউ নেই?
কথাগুলো শুনে ক্ষীরোদা যেন মাসিমার বুকের আরো কাছ সরে আসতো। আরো বুকের ভেতরে মুখ গুঁজতো। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতো। আর এই বোবা মেয়েটাকে যত দেখতো মাসিমা ততই যেন ঠান্ডা হয়ে আসতো মাসিমার বুকখানা।
—যদি দেশে কেউ থাকে তোর তো বল আমাকে, আমি দীপুকে দিয়ে চিঠি লিখে এখানে আসতে বলবো!
মেয়ের মুখ যেন আরো বোবা হয়ে যেত। আরো পাথর। অথচ সংসারে প্রত্যেকটা কাজ যেন যন্ত্রের মত চালিয়ে নিতো একলা। চোখের পলকে ভাতটা চাপিয়ে বাটনা বেটে নিত নিজেই। কত তাড়াতাড়ি যে দীপুর আপিসের ভাত দিত, মাসিমাও তা দেখে অবাক হয়ে যেত।
—হ্যাঁরে, এত কখন করলি? তুই ম্যাজিক জানিস নাকি রে ক্ষীরোদা?
শুধু দীপঙ্করের রান্নাই নয়, মাসিমার দিকটাও যে নিজের পেটের মেয়ের মত এমন করে দেখবে, তা কে জানতো! মাসিমা ক্ষীরোদাকে দেখতো আর বুকটা হু হু করে উঠতো কেবল। হয়ত অবচেতন মনে এমনি একটি মেয়েই একদিন চেয়েছিল মাসিমা। কিরণ ছোট বয়েস থেকেই বাউন্ডুলে হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সে সাধ তাই মেটেনি মাসিমার।
মাসিমা বলতো—উনুনের কাছে তুই আর যাসনি মা, আমার ভয় করে— সত্যিই ভয় করতো মাসিমার। এখনও বিয়ে হয়নি। যদি ভাতের ফ্যান গালতে
গিয়ে হাতটা পুড়ে যায়। যদি ফোড়ন ছিটকে এসে মুখে লাগে।
—সর মা, সর, আমি রাঁধছি, আমার হাত তো খালি এখন, তুই বরং ততক্ষণ চালগুলো বাছগে,
চালে আজকাল এত ধান এত কাঁকর মেশানো থাকে যে না-বাছলে আর খাওয়া যায় না। কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই শুনবে না। যতক্ষণ মাসিমা, দীপু না-খাবে, ততক্ষণ না – খেয়ে উপোস করে থাকবে। হাতে কিছু কাজ না থাকে ছুঁচ নিয়ে মাসিমার কাপড়টা সেলাই করতে বসবে। রোদ্দুরে ডাল শুকোতে দেবে। একটু বসে থাকতে জানে না মেয়েটা! এমন মেয়ে কোথায় কার হাতে পড়বে কে জানে! কার হাঁড়িতে এ-মেয়ের চাল মাপা আছে কে বলবে?
সমস্ত রাত বড় অশান্তিতে কাটলো সেদিন। মাসিমা নিজেও খায়নি। বললে—তুই খেলিনে কেন বল তো মা? আমি না-হয় বিধবা-মানুষ, আমার উপোস করা অভ্যেস আছে, কিন্তু তুই কেন না-খেয়ে রইলি? রাত-উপোসী থাকা কি ভালো এই বয়েসে?
ভোর না হতেই মাসিমা আবার ওপরে দীপঙ্করের কাছে গেল। দীপঙ্করও সারা রাত ঘুমোয়নি।
মাসিমা বললে—এখন কেমন আছো বাবা?
দীপঙ্কর বললে—ভাল আছি মাসিমা, আপনি কিছু ভাববেন না আমার জন্যে—
মাসিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে—তোমার জন্যে বড্ড ভাবনা হয়েছিল বাবা, ও মেয়েটাও সারারাত কিছু খেলে না। ঘুমোল না—
দীপঙ্কর বললে—আপনাকে এখানে এনে খুব কষ্ট দিচ্ছি মাসিমা —
মাসিমা বললে—কষ্ট আমাকে যা দিচ্ছ তা তো দিচ্ছই, কিন্তু ওই মেয়েটাকে যে কষ্ট দিচ্ছ তা আর চোখ মেলে দেখতে পারছি নে আমি। ওকে এমন করে কেন এখানে আটকে রেখেছ বল তো বাবা?
এ-কথার উত্তর একটা কিছু দিত হয়ত দীপঙ্কর। কিন্তু তার আগেই কাশী এসে ঘরে ঢুকলো। বললে—দাদাবাবু আপনাকে কারা ডাকতে এসেছেন?
মাসিমা বললে—কারা এসেছে আবার? বলগে যা দাদাবাবুর অসুখ, এখন দেখা করতে পারবে না—
কাশী বললে—আমি বলেছিলুম, একজন বুড়ী মেয়েমানুষ আছে সঙ্গে, বললে একটুখানির জন্যে দেখা করে যাবো—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কারা? কোত্থেকে এসেছে?
কাশী বললে—পিরোনাথ মল্লিক রোড থেকে, তাদের সেই চাকরটাও এসেছে, অনেকদিন আগে একবার এসেছিল—
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি বিছানার ওপর উঠে বসলো। তারপর বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিল।
মাসিমা বললে—উঠছো কেন বাবা? তোমার শরীর এখনও দুর্বল, এ অবস্থায় কোথায় যাচ্ছো?
দীপঙ্কর বললে—না মাসিমা, সতীর স্বামী এসেছে। সতীর শাশুড়ী এসছে যে— মাসিমা বুঝতে পারলে না। বললে—কে? কার শাশুড়ী? কে সতী?
দীপঙ্কর বললে—ওরে কাশী, শিগির দরজা খুলে দে, বসতে বল ওদের, – আমি যাচ্ছি—
মাসিমা বললে—তা তুমি উঠছো কেন বাবা, তারাই আসুক না, তাদেরই আসতে বলো না এখানে, তোমার শরীরের এই অবস্থায় কি নিচে নামা ভালো? যা কাশী, ওদের ওপরে ডেকে নিয়ে আয়—যা—