কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৮
৬৮
এবার টাকার কথা বলি। আগেও বলেছি, আবার বলি। টাকার কথা যেন বলে শেষ করাও যায় না। টাকা যে-ই সৃষ্টি করুক, সৃষ্টির পর থেকেই টাকা যেন তার সৃষ্টিকর্তাকেও আর মানতে চাইলো না। মধ্যযুগ পেরিয়ে টাকা যখন সাবালক হলো তখন তার পাঁচ পা গজিয়েছে। আগে টাকা ছিল ব্যক্তির, এখন হলো দশের। টাকা একদিন বললে-আমি বহু হবো। আর তাই-ই সে হলো। তখন সে মাটিতে পোঁতা সম্পত্তি রইল না আর। কখনও হলো সোনা। সোনা হয়ে অলঙ্কার হলো। কখনও কাগজ হয়ে নোট হলো, আবার কখনও চেক হয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকলো। টাকার তখন দুর্দম গতি। আগে টাকা ছিল মানুষের বাহন, এখন মানুষ হলো টাকার বাহন। আগে মানুষ বলতো—টাকা চাই। এখন টাকা বললে—মানুষ চাই। টাকার মানুষরা শেষকালে আর কোথাও মানুষ পায় না শিকার করবার। তখন নতুন মানুষ, নতুন মহাদেশ খুঁজতে বেরোল সমুদ্র পেরিয়ে। খুঁজতে খুঁজতে পেলে আফ্রিকা, পেলে ইন্ডিয়া, পেলে চায়না, পেলে জাপান। এখানে জিনিস ছিল, টাকা ছিল না। মহাজনরা বললে— তোমাদের জিনিস দাও, তোমাদের আমরা টাকা দেব। জিনিস বেচে প্রচুর টাকা হলো। টাকার পাহাড়। তারপর একদিন দেশে মহামারী হলো, দুর্ভি হলো, বন্যা হলো। চাল, ডাল, তরিতরকারি কিছু নেই, সব বেচে দিয়েছি। খালি টাকা আছে। কিন্তু টাকাতে পেটের ক্ষিধে মেটে না। তখন আমরা চালাক হয়ে গেলাম। টাকাকে বাঁধতে হবে, টাকাকে বুঝতে হবে, টাকাকে ভালবাসতে হবে। টাকা আগে ছিল মানুষের ক্রীতদাস, তখন থেকে মানুষ হলো টাকার ক্রীতদাস। আগে টাকা মানুষের হুকুম তামিল করতো, এখন মানুষ টাকার হুকুম তামিল করে। টাকা নতুন করে বংশ-কৌলীন্য বেঁধে দিলে। টাকা বললে—এখন থেকে বর্ণ নিয়ে সমাজ বিভাগ হবে না। হবে টাকা দিয়ে। মহাজনই হবে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। সেই মহাজনই নিজের প্রয়োজনে কায়স্থ বৈশ্য শূদ্র শ্রেণী-ভাগ করবে। আজকে যে শূদ্র সেও একদিন কায়স্থ হতে চাইলো। আজকে যে কায়স্থ সেও একদিন ব্রাহ্মণ হতে চাইলো। তখন বাধলো বিরোধ। ব্রাহ্মণ বৈশ্য কায়স্থ শূদ্রদের মধ্যে বিবাদ বিরোধ জটিল হয়ে উঠলো প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই। টাকা দর নামলো, সোনার দাম চড়লো। লক্ষ লক্ষ শূদ্র ব্রাহ্মণ হলো। কোটি কোটি ব্রাহ্মণ শূদ্র হলো। আর তারই ফলে অঘোরদাদুর মৃত্যুর পর ছিটে- ফোঁটারা হলো ব্রাহ্মণ, প্রাণমথবাবু হলো শূদ্র। শুধু তারাই নয়। নির্মল পালিত, মিস্টার ঘোষাল, দাতারবাবু, নয়নরঞ্জিনী, লক্ষ্মীদি, সতী, সুধাংশু, গাঙ্গুলীবাবু, সবাইকে নিয়ে এক দীর্ঘ উপন্যাস লিখে চললো টাকা। টাকা দিয়ে যাচাই হতে লাগলো মনুষ্যত্ব, ধর্ম, পাপ, পুন্য, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা সব কিছুর। টাকাই হলো ধর্ম, টাকাই হলো মোক্ষ, টাকাই হলো কাম। টাকাই সকলকে এক হাটে বেচে আর এক হাটে সওদা করতে লাগলো। বিংশ শতাব্দীর অর্ধশতকে পৌঁছে মানুষ হলো পোটেন্ট, কিন্তু টাকা হয়ে গেল অমনিপোটেন্ট!
এই টাকাই মিস্টার ঘোষালকে আবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আনলে সতীর কাছে। তখন রোদ উঠে গেছে। প্যালেস-কোর্টের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আবার রাস্তায় পড়লো সতী। আগের দিনের ক্লান্তি তখনও ঘোচেনি। সমস্ত রাত ঘুম না হওয়ার ক্লান্তি! পীরালি গেট পর্যন্ত এসেছিল।
সতী বলে এসেছিল—আমার কথাটা মনে থাকবে তো পীরালি? তোমার সাহেবকে বলবে না তো?
—না মেমসাহেব!
তারপর সোজা একেবারে নিজের বাড়িতে। রঘু দরজা খুলে দিয়েই বললে— একজন আপনাকে খুঁজতে এসেছিল দিদিমণি।
—কে রে? কী রকম চেহারা?
চেহারার বর্ণনা শুনে বোঝা গেল মিস্টার ঘোষাল।
—তুই কী বললি?
ভালোই হয়েছে। অনেক বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে সতী! তারপর তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে হাতের জিনিসগুলো ভালো করে আলমারির ভেতরে রেখে দিলে। বাইরে রঘু দাঁড়িয়েছিল। সতী বললে—আজকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আমি শুয়ে পড়বো। যদি কেউ আসে তো বলবি দেখা হবে না—
—কিন্তু সে ভদ্রলোক যে বলে গেলেন আবার আসবেন তিনি!
—তা হোক, আমি ঘুমোব আজকে, সারারাত কাল ঘুম হয়নি, আজকে দীপুবাবু আপিস থেকে আসবার আগে আর কারো সঙ্গে দেখা করবো না—
—তাহলে কী বলবো তাঁকে?
সতী বললে—বলবি আমার সঙ্গে দেখা হবে না—আর কিছু বলতে হবে না!
কিন্তু যে অমোঘ অনিবার্যতা মানুষের ভাগ্যকে অবরাধিতের দিকে প্রতিমুহূর্তে ঠেলে নিয়ে যায়, তাকে ঠেকিয়ে রাখা মানুষের সাধ্যের বাইরে। প্রথমে দেখা যায় না, হয়ত আভাসও পাওয়া যায় না। যুগের পর যুগ এই অমোঘ অনিবার্যতাকে মানুষ আগে-ভাগে জানতে চেয়েছে। জানলে সে অন্ততঃ প্রস্তুত হয়ে থাকতে পারবে। দুঃখের তীব্রতা সে এড়াতে পারবে। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে তাই নিজের উত্থান-পতনের ছন্দ সে আয়ত্ত করতে চেয়েছে। জীবনের অর্থ উদ্ধার করতে চেয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য দেবতা কোথায় কোন্ গ্রহলোকে অদৃশ্য হয়ে আছে তা কেউ জানতে পারেনি আজো। মাঝে-মাঝে মানুষের গড়া ঈশ্বর মানুষের ঘরেই জন্মগ্রহণ করে বুকে ক্রস এঁটে মানুষের দুঃখ-বেদনার ভার লাঘব করতে চেয়েছে। কখনো আবার মানুষই ভয়াল-করাল এ মূর্তি গড়ে তাকে ‘মা’ বলে ডেকে সব দুঃখের অবসান কামনা করেছে। কেউ সুখকে বলেছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। কেউ দুঃখকেও বলেছে ঈশ্বরের প্রসাদ। সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা সব কিছুকেই এক অদৃশ্য শক্তির পায়ে অর্পণ করে মানুষ অমোঘ অনিবার্যতাকে ভুলতে চেয়েছে। কিন্তু তবু কোনও দিক দিয়ে তার পরিত্রাণ মেলেনি। কিছু না পেয়ে তখন একনিষ্ঠ হয়ে অর্থ নিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে সে। ভেবেছে টাকাই ঈশ্বর। ঈশ্বরই টাকা। ঈশ্বরই বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে এবার টাকা হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। অঘোরদাদুর মত টাকারই ভজনা করো। টাকাই তোমাকে ইষ্ট দেবে, অভীষ্ট লাভ করাবে। নইলে নয়নরঞ্জিনী দাসীই বা কেন এমন করে সব মান-অপমান জলাঞ্জলি দিয়ে এখানে ছুটে আসবেন সেদিন!
সতী তখন স্নান করে ভিজে চুল এলিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা করে সিঁদুর পরছিল।
—বৌমা, বৌমা কোথায় গো?
চিরুনীর উল্টো পিঠ দিয়ে সিঁদুর পরতে পরতে হঠাৎ আওয়াজটা শুনেই চমকে উঠলো সতী। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে লম্বা চিরুনীটা পড়ে গিয়ে দু’খানা হয়ে গেল।
—বৌমা কোথায় গো, কেমন আছো?
সবই অদৃশ্য ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলা। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই একেবারে মুখোমুখি দেখা। মা-মণি একলা নয়। সনাতনবাবু আছেন সঙ্গে। দীপঙ্করও পেছনে। সতী নিজের মাথায় ঘোমটা টেনে দিলে।
—এ কী চেহারা হয়েছে বৌমা তোমার? মুখখানা একেবারে শুকিয়ে গেছে যে তোমার? আহা, থাক্, থাক্—
সতী ততক্ষণে শাশুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথা ঠেকিয়েছে। নয়নরঞ্জিনী সতীর চিবুকে হাত দিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন। বললেন—বড় খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি বৌমা কাল রাত্তিরে—
বাইরের ঘরে চেয়ারের ওপর বসলেন নয়নরঞ্জিনী। চারদিকে দেখতে লাগলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বললেন—এই বাড়িই বুঝি তোমার বোনের বৌমা? বাঃ, বেশ বাড়ি করেছে তো! নতুন তৈরি করিয়েছে বুঝি? কত পড়লো?
ততক্ষণে দীপঙ্কর বসে পড়েছে। সনাতনবাবুও বসে পড়েছেন।
—ওমা, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন বৌমা? বোস!
সতী বসলো। নয়নরঞ্জিনী বললেন—বড় খারাপ স্বপ্ন দেখেছি বৌমা, সকাল থেকে মনটা যে কী রকম করছিল কী বলবো! এখন তোমাকে দেখে তবু মনটা ঠান্ডা হলো! তা, বেশ ভালো আছো তো?
সতী মুখে কিছু বললে না। শুধু মাথা নাড়লে।
—দেখ বৌমা, আমি সোনাকে তাই বলছিলুম। বলছিলুম বুড়ো হয়েছি তো, আমার আর ক’দিন, আমি তো গঙ্গামুখো পা বাড়িয়েই আছি, ভালোয় ভালোয় যেতে পারলেই হয়। তোমাদেরই সংসার, তোমরা দেখে শুনে নিলে তবু নিশ্চিন্ত হতে পারতাম—তা কপালে যখন তা নেই, তখন আর ভেবেই বা কী হবে! সবই আমার কপাল বৌমা! সবই কপাল!
সতী এ-সব কথার কোনও অর্থই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ কেনই বা এলেন শাশুড়ী আর কেনই বা স্বামী এলেন তারও কোনও কারণ ঠিক করতে পারছিল না। শাশুড়ীর কথাগুলো কানেই যাচ্ছিল শুধু, মনের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না তার। সাদা ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে দেখছিল সবাইকে। তার সামনে সবাই যেন পাথরের মানুষ। তাদের সঙ্গে এক জায়গায় থেকে সে-ও যেন তাদের মত পাথর হয়ে গেছে।
—কাল রাত্তিরে যখন বোমা পড়লো বৌমা, আমি আর সোনা তো লাইব্রেরী-ঘরের ম্যেধ চুপ করে বসে রইলুম। তখন কেবল তোমার কথা মনে পড়ছিল বৌমা! ভাবছিলুম বৌমা এখন কোথায়, আমার বৌমা কী করছে এখন? কেবল এই কথাই মনের মধ্যে খচ্ খচ্ করে বাজছিল বার বার। আহা, বাপও নেই যে মেয়ের খোঁজ করবে! তা বাপ কি চিরকাল কারো থাকে, না থাকা উচিত! সময় হলে সকলের বাপ-মাই তো একদিন চলে যায়……না কি বলো?
তবু সতী কিছু উত্তর দিলে না। নয়নরঞ্জিনীও এ-কথার যেন জবাব চাইছিলেন না।
—আমার বাপের কথাও মনে আছে, আহা কী বাবাই ছিলেন আমার। তোমার মতন আমিও যে ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম কি না। তা এমনই আমার কপাল যে বাবার মৃত্যুর সময় একবার কাছে গিয়ে শেষ দেখাও দেখে আসতে পারলাম না। এ দুঃখ আমার জীবনে যাবে না।
দীপঙ্কর এতক্ষণে কথা বললে। বললে—কেন? দেখা করতে পারলেন না কেন?
—ওই যে, এই সোনা তখন আমার সবে হয়েছে। আমার তখন আঁতুড়। এই ছেলে আজ বড় হয়েছে, বই পড়ে পড়ে লায়েক হয়েছে, পন্ডিত হয়েছে—এখন তো ছেলে আমার সেদিনের কষ্টটা বুঝবে না! আমি যে কষ্ট করে ছেলে মানুষ করেছি তা ছেলে যদি বুঝতো তো আমার এই ভাবনা! আজকে আমি ছেলের বিয়ে দিয়েছি, এমন সতীলক্ষ্মী বউ এনে দিয়েছি। আমি মায়ের যোগ্য যা কাজ তা যথাসাধ্য করেছি। এখন তো আমার ছুটি পাবার বয়েস বাবা! এখন তো আমার কাশী-বাস করারই কথা। তা নয় এই বুড়ো বয়েসেও তেল-নুন-মশলার সংসার নিয়ে তিতি-বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি! বুড়ো বয়েসে কোথায় ভগবানের নাম করবো নিরিবিলিতে বসে, তা না এই সব করছি, এ-বয়েসে এ-সব করতে কি ভাল লাগে, তুমি বলো দিকিনি বাবা?
তারপর সতীর দিকে ফিরে বললেন—আমারও তোমার মত এমনি অভিমান ছিল বৌমা। তাহলে শোন, একদিন কী হয়েছিল! একদিন তোমার শ্বশুরের ওপর রাগ করে আমিও ভাত খাইনি! তা ভাত খাইনি তো খাইনি! এদের বংশের ধারাই যে এইরকম বৌমা। এই আমার সোনা যেমন, তোমার শ্বশুরও ওইরকম ছিলেন! বংশের ধারা কোথায় যাবে! তা সারা দিন উপোস করে রইলুম। কর্তা একবার জিজ্ঞেসও করলেন না খেলুম কি খেলুম না! আমি উপোস করলুম তো তাঁর বয়েই গেল! শেষকালে আমাকেই আমার খোঁতামুখ ভোঁতা করে সেই ভাত খেতে হলো পরের দিন! ভাবলাম মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি, কষ্ট করা তো জন্মের সাথী হয়ে গেছে—তার জন্যে আর ভেবে কী করবো? আমি নিজের মনেই কাঁদতাম আবার নিজের মনেই চোখের জল মুছতাম—কেউ দেখবারও ছিল না, কেউ একজন আহা বলবারও ছিল না! তা এসব কথা কাকেই বা বলবো আর কে-ই বা শুনবে! আজ তোমার কথা ভেবেই কথাগুলো বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে—
সতী তখনও কিছু কথা বলছে না।
নয়নরঞ্জিনী আবার বলতে লাগলেন—কত কথাই আজ মনে পড়ছে বৌমা, কত সাধই ছিল মনে তোমাকে কী বলবো! সোনার যখন বিয়ে দিলাম তার অনেক আগে থেকে আমি গয়না গড়িয়ে রেখেছিলুম তার বৌএর জন্যে। তোমার বাবা যখন তোমার ছবি দেখালেন আমাকে, দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। আহা! আমি ঠিক যেমন বউটি চেয়েছিলুম, তেমনি বউই আমায় দিয়েছেন ভগবান! ভেবেছিলুম এ-বউকে সংসারের কাজ করতে দিলে এ ধূলো লেগে ময়লা হয়ে যাবে। ন’দিদির হিংসে হয়েছিল দেখে। ন’দিদির নিজের তো সব কালো-কুচ্ছিত বউ হয়েছে। ন’দিদি বললে—ওরে নয়ন এ- বউএর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিসনে তুই, এত রূপ গেরস্তঘরে সয় না। ভেবেছিলুম—হিংসের চোটে ন’দিদি বুঝি ওই কথা বলছে। তা আমারও জেদ্ চেপে গেল, আমি ভাবলুম, এই মেয়ের সঙ্গেই আমার ছেলের বিয়ে দেব। যে যা-ই বলুক! তা শেষ পর্যন্ত ন’দিদির শাপ্ই তো ফলে গেল বৌমা! আমার মত গেরস্তের সংসারে তুমি তো টিকতে পারলে না
দীপঙ্কর বললে—ও-কথা কেন বলছেন মা-মণি? সতী তো থাকতেই চেয়েছিল—
—তা হবে! হয়ত আমারই দোষ, কিংবা হয়ত আমার কপালেরই দোষ! আমিই হয়ত এমন সতীলক্ষ্মী বউকে ঘরে ধরে রাখতে পারলুম না। ভগবান আমার কোনও সুখই রাখেন নি, এ-সুখটাই বা রাখতে যাবেন কেন? এমন কী পুণ্যি করেছি আমি যে এমন বউ-এর সেবা আমি পাবো?
বলে নয়নরঞ্জিনী একবার আঁচল দিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছে নিলেন। নাক দিয়েও একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরোতে লাগলো তাঁর!
তারপর আবার বলতে লাগলেন—তা আমার যে ঘাট হয়েছে তা তো আমি মানছিই বাবা! আমি তো বলছি অপরাধ যদি করে থাকি তো ভগবান আছেন মাথার ওপর, তিনি তো সব দেখছেন! তিনি দর্পহারী মধুসূদন, তিনিই আমার সব দর্প চূর্ণ করবেন! আমি পক্ষাঘাতে পড়ে থাকবো বিছানায়, শেয়াল-কুকুরে আমাকে শ্মশানে টেনে নিয়ে যাবে, তবু আমি কাউকে এতটুকু দোষ দেব না—ভাববো সে আমারই কৃতকর্মের ফল! আমি তো তা স্বীকারই করছি বাবা—
তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন—এই যে বৌমার কাছে আজ এসেছি, একবার শুধু চোখের দেখা দেখতে। এ কেন এলুম? না এলেই তো পারতুম! বৌমা তো আমাকে ডাকেনি! আমি তো নিজের গরজেই এসেছি! আর বৌমাও তো একবারও ভাবেনি যে শাশুড়ী বাড়িতে রয়েছে, মোলো কি বাঁচলো একবার গিয়ে চোখের দেখা দেখে আসি! বৌমা তো একবার এক মিনিটের জন্যেও আমাকে গিয়ে দেখে আসেনি! আমি বুড়ী মানুষ, আমিই বাতের ব্যথা নিয়ে ছুটতে ছুটতে এলুম। বলি—যাই, বৌমা কেমন আছে, কোথায় আছে একবার দেখে আসি! এ ভাবনা কেন এল আমার মনে? না এলেই তো পারতুম? ওই যে বললুম—গরজ বড় বালাই, নিজের গরজেই তাই তোমার বাড়িতে খোঁজ করে এখানে এলুম। নইলে খেয়ে-ঘুমিয়ে যে শান্তি পেতাম না আমি মনে মনে—
তারপর হঠাৎ বললেন—তাহলে এবার আসি বৌমা, দেখা হলো, ভালো আছো সুখে আছো, এ দেখেও মনটার তৃপ্তি হলো—এখন আসি! তুমি তো আবার আপিসে যাবে বাবা! তোমারও দেরি করে দিলাম—
তারপর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন—নাও সোনা, এবার ওঠো—
সনাতনবাবু এতক্ষণ সমস্ত চুপ করে শুন্ছিলেন। এতক্ষণে যেন তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। সতীকে বললেন—অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম—
সতী সনাতনবাবুর দিকে সোজা মুখ তুলে চাইলে এবার।
—কেমন আছো?
সতী বলে—ভালোই তো!
সনাতনবাবু বললেন—এখন বোধহয় আর আমার কাছে যেতে আপত্তি হবে না!
সতী ম্লান একটু হাসলো শুধু। বললে— আগেও তো কখনও আপত্তি ছিল না আমার—
সনাতনবাবু বললেন—তাহলে চলো না—আজকে এখনই চলো—
—না না বৌমা, অমন কাজটি কোর না, – খবরদার!
বলে নয়নরঞ্জিনী দু’জনের মাঝখানে দাঁড়ালেন। বললেন—না বৌমা, তুমি আমার মত ভুল কোর না! আমি নিজে এক পুরুষ মানুষের কাছে ভুগেছি বলেই বলছি। যে স্বামী নিজের বউকে ঘরে রাখতে পারে না, সে আবার পুরুষ মানুষ কীসের শুনি? আমার নিজের পেটের ছেলে বলে কি আমি তার হয়ে টেনে কথা বলবো? আমাকে তেমন শাশুড়ী পাওনি। স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই। তোমার আজ লজ্জা করে না সোনা! বিয়ে করা বউ বলে কি কেনা-বাঁদী হয়ে এসেছে? তার একটা মান-মর্যাদা বলে জিনিস নেই! মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছে বলে কি তার এতই হেনস্তা? তুমি যদি অন্যায় করে থাকো মনে করো, তো ঘাট চাও, মাপ চাও বৌমার কাছে। এ কী সর্বনেশে কথা? তুমি যেমন আমার নিজের পেটের ছেলে, বৌমাও তো তেমনি আমার পেটের মেয়ের মত! চলো বললেই যাবে? এতদিনে তোমার এই বুদ্ধি হলো? ছি ছি—
সনাতনবাবু কথাগুলো যেন শুনতেই পেলেন না। বললেন—অনেকবার তো তুমি নিজের থেকেই যেতে চেয়েছিলে! এবার মা’র যখন আপত্তি নেই তাহলে চলো—
সতী এতক্ষণে স্পষ্ট হলো যেন। শাশুড়ীর দিকে চেয়ে বললে—আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতেই এসেছিলেন আজ?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—না বৌমা, মিথ্যে কথা বলবো না, তোমাকে নিয়ে যেতে আসিনি আমি, আমার ছেলে যে-অন্যায় করেছে তারপর তোমাকে নিয়ে যেতে আর সাহস হয়নি আমার, আমি শুধু তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখতে এসেছিলাম—
—কিন্তু হঠাৎ এতদিন পরে চোখের দেখাই বা দেখতে ইচ্ছে হলো কেন?
নয়নরঞ্জিনী দাসী কেমন যেন থমকে গেলেন। কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যে। তারপরই নিজেকে সামলে নিলেন। হেসে বললেন—হাজার হোক বৌমা, তুমি কি করে বুঝবে? তোমার যদি কখনও ছেলের বউ হয়, তখন বুঝতে পারবে—এর কী জ্বালা।
—কিন্তু আপনি আমাকে যতখানি জ্বালা দিয়েছেন, তার একতিল জ্বালাতেও যদি আপনি জ্বলতেন!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—সে আমি তোমাকে কী বলবো বউমা, সে শুধু আমি জানি আর আমার ভগবান জানেন কত জ্বালায় আমি জ্বলছি! আমার বুক চিরে যদি তোমায় দেখাতে পারতুম তো তুমি বুঝতে পারতে! কিন্তু তোমার বয়েস কম, তোমাকে বলা আমার বৃথা! প্রাণের দায় বলেই আজ এই অথর্ব শরীর নিয়ে তোমাকে দেখতে এসেছি—
সতী বললে-আজ তো প্রাণের দায় হবেই আপনার? নইলে যে আপনাকে ছেলের হাত ধরে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে!
—তার মানে?
সতী বললে—তার মানে আপনি নিজেই ভালো করে জানেন!
নয়নরঞ্জিনীর যেন আসল রূপটা বেরিয়ে পড়লো হঠাৎ। বললেন—বৌমা!
সতীও ফণা তুলে দাঁড়াল। বললে—কাকে আপনি ভয় দেখাচ্ছেন মা, কোথায় দাঁড়িয়ে ভয় দেখাচ্ছেন?
নয়নরঞ্জিনী দাসী হঠাৎ সতীর চেহারা দেখে চমকে উঠলেন। দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেল সতীর ব্যবহার দেখে। বললে—সতী, এ কী বলছো? ছিঃ—
সতী সেই একই সুরে বলতে লাগলো—কেন! ছিঃ কেন? আমি জানিনা বলতে চাও কেন উনি এসেছেন? আমি কি এতই বোকা উনি ভেবেছেন? আজ এসেছেন খোসামোদ করতে! আজ এসেছেন মিস্টি কথা বলে বাড়িতে নিয়ে যেতে! আমি এর মানে বুঝিনে বলতে চাও?
সতী কথাগুলো বলছিল আর হাঁফাচ্ছিল। দীপঙ্কর বললে—তুমি থামো সতী! এ- রকম করে ওঁকে বলতে নেই! উনি সত্যি সত্যিই তোমাকে নিতে এসেছেন। উনি যা বলছেন শোনো! ওঁর কথা আজকে অমান্য কোর না। সনাতনবাবু নিজে তোমাকে যেতে বলছেন!
সতী বললে—কিন্তু কেন? এতদিন ওঁরা আমার খোঁজ নেনি, আর হঠাৎ আজকেই বা এত আদিখ্যেতা কেন? এতদিন আমার নামে কুৎসা রটিয়ে, আমার দিদির নামে কুৎসা রটিয়ে, আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েও সাধ মেটেনি, আর এখনই বা কেন এত আগ্রহ? কেন এতদিন বাদে মা-ছেলে দু’জনে আমি ভালো আছি কিনা জানতে এসেছেন! আমি কি হঠাৎ রাতারাতি এত ভাল হয়ে গেলাম? না, রাতারাতি আমি একেবারে সতী হয়ে গেলাম যে আমার জন্যে শাশুড়ীর বুক একেবারে ফেটে গেল।
নয়নরঞ্জিনী এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। এবার কথা বললেন। বললেন — ঠিক! ঠিক কথাই বলেছ বৌমা! তুমি ন্যায্য কথাই বলেছ! ঘোষ-বাড়ির বউ-এর উপযুক্ত কথাই বলেছ।
তারপর ছেলের দিকে ফিরে বললেন—দাও, এর জবাব দাও সোনা—তোমাকে এর জবাব দিতেই হবে।
সনাতনবাবু প্রথমে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—তর্কে শুধু তর্ক বাড়ে সতী, তর্ক দিয়ে তো সমস্যার সমাধান হয় না!
সতী বললে—কিন্তু তুমি কেন এর পরেও আমাকে যেতে বলছো?
সনাতনবাবু বললেন—আমি তো তোমাকে ত্যাগ করিনি যে ফিরে যেতে বলতে আমার বাধবে! আমি তো কোনওদিন আশা ছাড়বো না। যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে ততদিন যে তোমার আশায় আমি থাকতে প্রস্তুত! আমি যে হতাশ হতে জানি না!
—কিন্তু যেদিন তোমার এই মা আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন, সেদিন তো তোমার মায়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলো নি!
সনাতনবাবু বললেন-সে তো আজো বলছি না, কোনওদিন বলবোও না! শুধু তোমায় ফিরে যেতে বলছি!
—কিন্তু কেন যেতে বলছো? আমাকে অপমান করে তোমাদের আশা কি এখনও মেটেনি? আরো অপমান করতে চাও আমাকে? বলো, এ-কথার জবাব দাও?
সনাতনবাবু হাসলেন। বললেন—জবাব দিতে পারি, কিন্তু তা কি তুমি বিশ্বাস করতে পারবে?
সতী বললে—খুব বুঝতে পারবো, তোমাদের এত বদমায়েশি বুঝতে পেরেছি আর এইটে বুঝতে পারবো না?
—তাহলে বলি, তুমি আপনা-আপনিই প্রকাশিত! তুমি রাগে-দুঃখে-অপমানে- অনুরাগে স্বপ্রকাশ! তুমি যখন যা-খুশি করেছ, যা কিছু ভেবেছ, অন্য লোকের মত আপনাকে নিয়ে ছলনা করোনি। যখন রাগ করেছ—গালাগালি দিয়েছ, যখন কষ্ট পেয়েছ—তখন আর্তনাদ করে উঠেছ, যখন স্নেহ-ভালবাসা চেয়েছ—তখন জোর গলায় তা দাবী করেছ! সূর্যের মতই তুমি স্বয়ম্প্রকাশ! সূর্যকে আর মানুষের জানতে বাকি নেই। কিন্তু এবার আমাদেরই প্রকাশ হবার পালা! এবার আমাদের কাছেও তুমি প্রকাশ হও—আমাদেরও জানতে দাও তোমাকে! আমার এই মা তোমাকে ভালো করে জানুক, তাকেও তুমি প্রকাশিত করো—
নয়নরঞ্জিনী ছেলের কথাবার্তা কিছুই বুঝছিলেন না। বললেন—ও-সব কী হেঁয়ালি বলছো ছাই ভস্ম! ভালো করে বলতে পারো না যে তোমার ঘাট হয়েছে মাপ করো?
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু অপরাধের প্রশ্ন তো এ নয় মা, অপরাধ তো কেউই করেনি! তুমিও করোনি, আমিও করিনি, তোমার বউমাও করেন নি!
—ও মা, এ ছেলে কী বলে গো! শোন বউমা শোন! শোন তোমার স্বামীর কথা শোন! সারাজীবন আমি এক পুরুষমানুষের হাতে পড়ে ভুগেছি, আর এও হয়েছে সেই একরকম! বংশের ধারা পেয়েছে এ ছেলে! শোন বৌমা, এ-সব বাজে কথা থাক্, তুমি চলো আজ, সারা বাড়িটা খাঁ খাঁ করে, আমি আর সে-বাড়িতে থাকতে পারছি না বাপু! সতী বললে—কিন্তু অপরাধ যদি আপনারা কেউ না করে থাকেন তো আমি কি মিছিমিছি এই কষ্ট করে এখানে আছি?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আচ্ছা, আচ্ছা, অপরাধ না-হয় আমিই করেছি বৌমা, আমারই ঘাট হয়েছে। সব দোষ আমার! এখন হলো তো?
সতী বললে—আপনি আজ এই কথা নিজের মুখে স্বীকার করছেন? আমার এত ক্ষতি করার পরও আপনার স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে না?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—কিন্তু বৌমা, বলি, আমিও তো মানুষ, না কী? মানুষ বলে কি আমারও মান-অপমান লজ্জা-সম্ভ্রম থাকতে নেই? আমি হেন মানুষটা যে আজ তোমার কাছে এসে এই খোসামোদ করছি, তাতেও তোমার একটু জ্ঞান হয় না? এতখানি অপগেরাহ্যি আমাকে? নিজের ছেলেকে দিয়ে মাপ চাওয়ালুম; আমি নিজে এতখানি নিচু হলুম তোমার কাছে, তাতেও তোমার রাগ পড়লো না? এত অহঙ্কার তোমার? তুমি চাও তোমার শাশুড়ী হয়ে আমি তোমার পায়ে ধরে সাধবো? এই বুড়ো মানুষকে সেই অপমানটা না-করলে আর তোমার মনের সাধ মিটছে না?
দীপঙ্কর আর থাকতে পারলে না। হঠাৎ কথার মাঝখানে বলে উঠলো—ছি ছি মা- মণি, এ আপনি কী বলছেন? আপনি সতীর গুরুজন, এ কথা বললে যে সতীরই অকল্যাণ হবে! ছি, চুপ করুন —
নয়নরঞ্জিনী আবার আঁচল দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিলেন। বললেন—গুরুজন হয়ে ভাল কথা বলতে এসে খুব ঝাঁটা লাথি খেলাম বাবা, এও আমার কপালে ছিল-আমার খুব শিক্ষা হলো বটে –!
দীপঙ্কর বললে—আপনি চুপ করুন মা-মণি, সতী যাবে, সতী আপনার বাড়িতে যাবে, আপনি চোখের জল ফেলবেন না এমন করে! আপনি চোখের জল ফেললে সতীর যে অকল্যাণ হবে তা বুঝছেন না?
সতী হঠাৎ বলে উঠলো—তুমি চুপ করো দীপু! কোন্ অকল্যাণটা হতে আমার বাকি আছে শুনি যে আবার আমার নতুন অকল্যাণের ভয় দেখাচ্ছ? আর আমি যাবোই বা কোন্ দুঃখে? কেন যেতে যাবো? আমার টাকা হয়েছে বলে? আমার বাবার দেড় লাখ টাকা পেয়েছি বলে?
—টাকা!
নয়নরঞ্জিনী হঠাৎ চোখ থেকে আঁচল সরিয়ে বললেন—কী বললে বউমা? টাকা?
সতী বললে—হ্যাঁ টাকাই তো! আমার টাকা হয়েছে বলেই তো আপনি এসেছেন! আমি বাবার দেড় লাখ টাকা না-পেলে কি আপনি আসতেন এ-বাড়িতে? এসে এত দরদ দেখাতেন?
—বৌমা, তুমি আজকে এই কথা বললে আমাকে? আমি তোমার টাকার পিত্যেশ করি? তোমার কাছে আমাকে আজ এই কথা শুনতে হলো?
সতী বললে—শুধু টাকার কথা কেন, আরো কিছুক্ষণ থাকলে অনেক কথাই শুনবেন, কথা কি আমার বুকে কম জমেছে মনে করেন? এই ক’বছরে তিলে তিলে প্রতি মুহূর্তে আমার বুকের ভেতর কথা জমে জমে হিম হয়ে গেছে, আজকে আপনি সামনে এসেছেন বলেই সব বেরিয়ে পড়লো, নইলে এত কথা আমি কাউকে বলি না!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—বলো বৌমা, তোমার যত কথা আছে, সব আমি শুনবো আজ—বলো!
সতী বললে—না, তার চেয়ে আপনি চলেই যান, কথা বলতে আরম্ভ করলে অনেক অপ্রিয় কথাই হয়ত মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়বে, তখন আপনি আবার চোখের জল ফেলবেন দেখিয়ে দেখিয়ে! তার চেয়ে আপনি যান এখন, আমার কপালে না-হয় শ্বশুরবাড়ির সুখ নেই বলেই ভাববো, —
—তা আমি না-হয় চলেই যাচ্ছি বৌমা, তোমার এখানে থাকতে তো আমি আসিনি। কিন্তু আমার ঈশ্বর জানেন আমি তোমার কাছে টাকা চাইতে আসিনি। তুমি বিশ্বাস করো আমার কথা!
সতী বললে-আপনি যদি শালগ্রাম-শিলা ছুঁয়েও দিব্যি গালেন তবু আমি বিশ্বাস করবো না এ-কথা!
—তাহলে আমি মিথ্যেবাদী বলতে চাও? শেষকালে তুমিই আমাকে এই বদ্নাম দিলে বউমা?
সতী বললে—আমি বদনাম দেবার কে বলুন! আপনি যে-ঠাকুরের সামনে বসে রোজ আহ্নিক করার ভড়ং করেন, একদিন ধীরমনে সেই ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনিই এর সঠিক জবাব দেবেন!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—কিন্তু টাকা আমি তোমার কাছে কেন চাইতে যাবো বউমা? আমার টাকার কীসের অভাব?
—হ্যাঁ, টাকারই আপনার অভাব!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—তুমি আমাকে অবাক করলে বউমা, আমার শ্বশুরের অথ লাখ-লাখ টাকার সম্পত্তি থাকতে আমি তোমার কাছে টাকা চাইতে যাবো?
সতী বললে—সে আপনার উকীলই সব বলেছে! আপনি লাখ টাকার জন্যে দোরে- দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু আপনি টাকা আমার কাছে পাবেন না এ আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি! ভাববেন না টাকা দিয়ে আমার আজ শ্বশুরবাড়ির সুখ কেনবার দুর্বুদ্ধি হবে, টাকা দিয়ে স্বামী-সুখ কেনবার দুর্বুদ্ধি হবে! ঘুষ দিয়ে সুখ কেনা যায় না মা, কেনা যায় না। ঘুষ দিয়ে জীবনের কোনও সুখই কেনা যায় না—এ আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি—
নয়নরঞ্জিনী তখনও অবাক হবার ভান করছেন। বললেন—এ-সব তুমি কী বলছো বউমা?
সতী বললে—হ্যাঁ ঠিকই বলছি! একদিন আমার বাবা দশ হাজার টাকা দিয়ে আমার সুখ কিনতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন নিষ্কন্টক হবে। ভেবেছিলেন তাঁর মেয়ে মা পাবে, স্বামী পাবে, ছেলে পাবে, সংসার পাবে! হিন্দু মেয়েরা যা-যা চায় সবই পাবে! বাবার অনেক সৌভাগ্য যে বাবাকে আজ আমার এই দুর্ভাগ্য চোখে দেখে যেতে হয়নি! দেখলে তিনি আত্মহত্যা করে মনের জ্বালা জুড়োতেন!
নয়নরঞ্জিনী দাসীর মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোল না। তিনি যেন হতবাক হয়ে গেছেন!
—আমি ছোটবেলা থেকে শিবপূজো করেছি। ছোটবেলা থেকে স্বামীর ধ্যান করেছি। ছোটবেলা থেকে পুণ্যিপুকুর ব্রত করে এসেছি। ফল যা হয়েছে তা তো আপনি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন! আর আমার দিদি ঠাকুর-দেবতাই মানেনি, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মারহাট্টি বিয়ে করেছে। সে মদ খেয়েছে, হিন্দু গৃহস্থঘরের মেয়েদের যা করা নিষিদ্ধ তাই-ই করেছে। সে সিগারেট খায়, আরো কী-কী করে, কী- কী খায় তা মুখ দিয়ে আমি বলতে পারবো না—কিন্তু সে আজ সুখী! সে আজ অনেক টাকার মালিক! সে স্বামী পেয়েছে, শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছে, ছেলে পেয়েছে, সংসার পেয়েছে। হিন্দু মেয়েরা ছোটবেলা থেকে যা-যা কামনা করে সবই সে পেয়েছে। তার এই বাড়ি ছিল বলেই আমি এখানে আজ আশ্রয় পেয়েছি—এর পরেও আপনি আমাকে সুখের লোভ দেখাবেন?
নয়নরঞ্জিনী, সনাতনবাবু, দীপঙ্কর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত সতীর কথাগুলো শুনছিল। সকলের মুখেই যেন কথা ফুরিয়ে গিয়েছে। সবাই যেন পাথর হয়ে গিয়েছে!
—আর আমি? আমি তো সব সহ্য করতেই প্রস্তুত ছিলুম! ভেবেছিলুম মুখ বুজে পড়ে থাকলেই আমার মোক্ষ লাভ হবে! মন প্রাণ দিয়ে শাশুড়ীর সেবা করলেই জীবন- কৃতার্থ হবে, মন-প্রাণ দিয়ে স্বামী-সেবা করলেই অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে! আমি তো কোনও প্রতিবাদই করিনি প্রথমে! কিন্তু আমিও তো আপনার মত মানুষ মা, আমিও তো স্নেহ ভালবাসার কাঙাল, আমারও তো মা হতে ইচ্ছে করে, আমারও তো সংসার করতে সাধ হয়! কই, সে-সাধ তো আপনি মেটাতে দিলেন না আমাকে! তার বদলে আপনি আমার মাথায় জুতো তুলে দিলেন বাড়ির সমস্ত চাকর-ঝি-দরোয়ানের সামনে! সেদিন কি আপনি জানতেন না যে আমিও একজন মেয়েমানুষ, আমারও মন-প্রাণ বলে একটা জিনিস আছে? অথচ, এই দেখুন…..
হঠাৎ সতী এক কাজ করে বসলো। সনাতনবাবুর পায়ের জুতোজোড়া হঠাৎ হাত দিয়ে তুলে নিয়ে নিজের মাথার ওপর রাখলে।
বললে—এই দেখুন আজকে আমি আবার সেই জুতোই মাথায় তুলে নিলাম মা, কেউ আমাকে এর জন্যে জোর করেনি, কেউ আমাকে এর জন্যে অনুরোধ-উপরোধ ও করেনি, আমি আজ স্বেচ্ছায় আমার স্বামী দেবতার জুতো মাথায় করে নিলাম— আজকে আর এ আমার অপমান নয়, এ আমার আশীর্বাদ, এ আমার কল্যাণ, এ আমার অলঙ্কার, এ আমার ভূষণ……
ঘটনাটা এত শিঘ্রি ঘটলো যে কেউ যেন জিনিসটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো না সহজে। প্রহেলিকার মত সবাই একদৃষ্টে চেয়ে রইল সেদিকে। সনাতনবাবু বাধা দিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সতীর সেই শুচি-শুভ্র মূর্তির দিকে চেয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। ভিজে এলানো চুলের মাঝখানে সরু একটু সিঁথি। সেই সিঁথির মাথায় টাকা সিঁদুর জ্বল্- জ্বল্ করছে। সকাল বেলায় স্নিগ্ধ সূর্যের মত সতী যেন সকলের দৃষ্টির সামনে নতুন রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠলো এতদিন পরে। এ রূপ যেন এতদিন কেউ দেখেনি তার। সে-চেহারা দেখে দীপঙ্করের মনে হলো সতী যেন অনেক কুটিল, অনেক জটিল পথ অতিক্রম করে, অনেক স্বার্থ অনেক অভিমানের ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, অনেক বিস্তারের মধ্যে দিয়ে অনেক আসক্তি আর অনেক অনুরক্তির পাথর বিদীর্ণ করে তার অন্তরের অন্তরাত্মাকে অনন্ত প্রেম-সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে মেলাতে পেরেছে! সেদিন যা ছিল অপমান, আজ যেন তা কল্যাণের মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। সে-মূর্তি দেখে অনেকক্ষণ কারো কোনও বাক্-স্ফূর্তি হলো না।
কিন্তু হঠাৎ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো মিস্টার ঘোষাল! কখন যে তার গাড়ি এসে বাইরে থেমেছে, কখন গাড়ির দরজা খোলার আওয়াজ হয়েছে, কখন তার জুতোর শব্দ হয়েছে, কেউই তা টের পায়নি।
মিস্টার ঘোষাল ঘরে ঢুকেই সকলকে দেখে বললে—মাই গড়, সকলেই যে হাজির এখানে!
তারপর নয়নরঞ্জিনীর দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি পড়তেই একেবারে সোজা গিয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে—কেমন আছেন আপনি। মা-মণি? অনেকদিন পরে দেখা—
তারপর সতীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—মিসেস ঘোষ, সকাল বেলা একবার আপনার বাড়িতে এসে ফিরে গেছি—
সতী ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। এতক্ষণে যে উত্তেজনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল ঘরের মধ্যে, মিস্টার ঘোষালের আবির্ভাবে তা যেন তখন খানিকটা শান্ত হয়েছে।
দীপঙ্করের মনে আছে হঠাৎ সেই নাটকীয় অবস্থায় সেদিন মিস্টার ঘোষাল ঘরে এসে না ঢুকলে হয়তো সতীও চুপ করতো না, নয়নরঞ্জিনী দাসীও হয়তো শেষপর্যন্ত কী করতেন বলা যায় না। এতদিন পরে সেই-ই প্রথম মুখোমুখি কথা বলা। একেবারে মুখোশ খুলে সামনা-সামনি দাঁড়ানো। দীপঙ্কর ভেবেছিল দুজনের সামনা-সামনি দেখা হয়ে গেলে হয়ত একটা যা-হোক কিছু সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। হয়ত সতী চলে যাবে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে। আর সব মেয়ে যেমনভাবে মুখ বুজে ভালবাসে, মুখ বুজে সংসার করে, আবার মুখ বুজে সহ্যও করে, সতীও হয়ত তেমনি করবে। চিরকাল ধরে মানুষ ভালবেসেছে, সংসার করেছে, সহ্য করেছে এই পৃথিবীকে। চিরকাল ধরে কখনও হাসি, কখনও আনন্দ, কখনও দুঃখ—সংসারের এই নিয়মকেই সবাই অমোঘ বলে মেনে এসেছে। কিন্তু সতী যে আলাদা ধাতুর মানুষ তা যেন আবার নতুন করে বুঝতে পারলে দীপঙ্কর। আগের রাত থেকে কেমন একটা অস্বস্তির মধ্যে কাটছিল, এবার সে-অস্বস্তি যেন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেল।
সমস্ত ঘরটার মধ্যে তখন কেবল মিস্টার ঘোষালের অনর্গল কথার ফুলঝুরি ফুটছে। নয়নরঞ্জিনী দাসীর সঙ্গে যেন মিস্টার ঘোষালের বহুদিনের আলাপ। বহুকালের আত্মীয়তা।
নয়নরঞ্জিনী হঠাৎ কথার মধ্যখানে বললেন—আমি উঠি তাহলে বাবা?
মিস্টার ঘোষাল বললে—সেকি? আমি আপনাদের কথার মধ্যে বাধা দিলাম নাকি?
দীপঙ্কর বললে—না মা-মণি আপনি একটু বসুন।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—না বাবা, বসলে তো আমার চলবে না, আমার আবার অন্য কাজও তো আছে—
দীপঙ্কর মিস্টার ঘোষালের দিকে চেয়ে বললে—আপনার কী কোনও জরুরী কাজ আছে মিস্টার ঘোষাল? মা-মণির সঙ্গে মিসেস ঘোষের একটা ইমপর্ট্যান্ট কথা হচ্ছিল এতক্ষণ—
—তাহলে আমি এসে বাধা পড়লো? কিন্তু আমারও যে একটা ইমপর্ট্যান্ট কথা ছিল মিসেস ঘোষের সঙ্গে—
দীপঙ্কর বললে—আপনি আপনার কথাটা তাহলে বলে নিন্
মিস্টার ঘোষাল বললে—আমার এত তাড়াতাড়ি নেই, আপনারা কথা বলে নিন, মা-মণি, আমি ওয়েট্ করতে পারবো—
সতী এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবার বললে—না, আমার সঙ্গে কারোরই কোনও জরুরী কথা নেই, আমি কারোর সঙ্গেই কোনও কথা বলতে পারবো না—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু তা বললে চলবে না সতী! কথা তোমাকে বলতেই হবে! মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে যা বলার তা আগে শেষ করে নাও—
মিস্টার ঘোষাল বললে—কিন্তু মিসেস ঘোষ যখন ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না, তখন কেন আর পীড়াপীড়ি করছো সেন?
তারপর হঠাৎ সতীর দিকে দেখিয়ে বললে—আর দেখছ না, ওঁর শরীর খারাপ, কালকে অনেক হয়রানি হয়েছে ওঁর—কালকে আমার জন্যে মিসেস ঘোষের অনেক হ্যারাসমেন্ট হয়েছে, এখন ওঁকে রেহাই দাও—
দীপঙ্কর বললে—আপনার এখন লজ্জা হয় না মিস্টার ঘোষাল? আপনি আর কত ক্ষতি করবেন সতীর?
মনে আছে সেদিন ধৈর্যের সীমা বোধহয় হারিয়েই ফেলেছিল দীপঙ্কর। এতদিন ধরে এত প্রতীক্ষার পর যখন সনাতনবাবু, সতীর শাশুড়ী, দু’জনেই সতীকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল, ঠিক তখনই কি না মিস্টার ঘোষাল এসে সমস্ত কিছু বানচাল করে দেবার বন্দোবস্ত করেছে!
মিস্টার ঘোষালের চেহারাটা আরো কালো হয়ে উঠলো কথাটা শুনে। বললে—ক্ষতি! হোয়াট্ ডু ইউ মীন সেন?
দীপঙ্কর বললে—আপনি নিজেই তা জানেন! আমার মুখ দিয়ে না-ই বা শুনলেন? মিস্টার ঘোষাল রুখে দাঁড়াল।—আই টেক অবজেক্শান টু ইট। তোমাকে জবাব দিতেই হবে, আমি কার কী ক্ষতি করেছি!
নয়নরঞ্জিনী বাধা দিয়ে বললেন—তুমি চুপ করো বাবা, ও-সব কথা নিয়ে তর্ক করে লাভ কী? আমি এসেছিলুম বৌমার কাছে, বৌমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে! রাগ করে বউমা এখানে থাকলে পাড়ার লোকেরা তো আমাকেই বদনাম দেবে। আমি যে বৌমার নিন্দেয় কান পাততে পারছি নে বাবা। যে-সে এসে জিজ্ঞেস করে তোমার বউমা কোথায়? হাসি-ঠাট্টা-টিটকিরি চলে বউমাকে নিয়ে, এটা কি আমাদেরই শুনতে ভালো লাগে বাবা? তারপর আমি তো বুড়ো হয়েছি, আমি কবে আছি কবে নেই, আমি চলে গেলে আমার সংসার কে দেখবে, তাও তো আমাকে ভাবতে হবে—
মিস্টার ঘোষাল বললে—একজ্যাক্টলি! আপনিই তো শাশুড়ী, আপনারই তো সমস্ত দায়িত্ব—
—তাহলে তুমি একটু বুঝিয়ে দাও তো বাবা বউমাকে! তুমি বুঝিয়ে বললে বউমা শুনবে! ছেলেমানুষ বউমা, হাতে অনেক টাকা এসেছে, এ-সময়ে এই নিরিবিলি জায়গায় একলা- একলা পড়ে থাকা কি ভালো? আর কলকাতা শহরে এখন বোমা পড়ছে, কত রকমের বিপদ আপদ আছে, আমিই কি বউমাকে একলা ফেলে রেখে শান্তিতে থাকতে পারি?
—নিশ্চয়, নিশ্চয়, ঠিক কথাই বলেছেন! আমি বুঝিয়ে দেবো সব মিসেস ঘোষকে!
—হ্যাঁ বাবা, তুমি একটু বুঝিয়ে বলো, আমাদের তাড়াতাড়ি আছে, একেবারে সঙ্গে করে বউমাকে বাড়ি নিয়ে যেতাম—
মিস্টার ঘোষাল বললে—ঠিক আছে, আপনারা এখন বাড়ি যান, আমিই মিসেস ঘোষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব—
সতী হঠাৎ বললে—না, আপনাদের কাউকেই থাকতে হবে না, আমি এখানেই থাকবো!
দীপঙ্কর কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মিস্টার ঘোষাল বললে—তা আপনার বউমা যখন আপত্তি করছে মা, তখন থাকলোই বা এখানে—আর যদি যেতেই হয় তো পরে গেলেও তো চলবে।
দীপঙ্কর বললে—না, এখনই যেতে হবে সতীকে!
নয়নরঞ্জিনী বললেন-তোমরা সবাই মিলে বলো তো বাবা সেই কথা! আমার ছেলে রইল সেখানে আর বউমা রইল এখানে—তা কী করে হয়!
মিস্টার ঘোষাল হঠাৎ সনাতনবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলে—আপনি কী বলেন মিস্টার ঘোষ? আপনার কী মত এ-বিষয়ে?
দীপঙ্কর বললে—তার চেয়ে আমরা এক কাজ করি মা-মণি, আমরা সবাই এখন এখান থেকে চলে যাই, আসুন মিস্টার ঘোষাল। লেট্ মিস্টার ঘোষ রিমেন্ হিয়ার, লেট্ দেম্ ডিসাইড, ওঁরা দুজনেই থাকুক এখানে, ওঁদের দুজনকে এক জায়গায় থাকতে দিন—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—না বাবা দীপঙ্কর সে ভালো হবে না,
মিস্টার ঘোষাল কথাটা লুফে নিয়ে বললে—ঠিক বলেছেন মা-মণি, আন-উইলিং ওয়াইফকে এরকমভাবে ফোর্স করা উচিত নয়, তার চেয়ে বরং আপনারা চলে যাবার পর আমি ভালো করে বুঝিয়ে বলবো যাতে মিসেস ঘোষ আপনাদের বাড়িতে যান—
সতী যেন এতক্ষণ এ-সব কথায় বিরক্ত হয়ে উঠছিল। অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করে করে এতক্ষণে যেন তার সহ্যের সীমা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এবার হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে—আপনারা কেন গোলমাল করছেন সবাই মিলে, আপনারা চলে যান এখান থেকে, সবাই চলে যান্—
মিস্টার ঘোষালও একটু যেন থমকে গেল কথাটা শুনে। তারপর বললে— আপনার সঙ্গে যে আমার একটা কথা ছিল মিসেস ঘোষ—
সতী বললে—সকলের সব কথা শোনবার আমার সময় নেই আজ, আপনার কোর্টে আমি সাক্ষী দিয়ে আসবো, আপনার ভাবনা নেই, আপনি এখন যান এখান থেকে—যান্—
—কিন্তু এই শনিবারই যে আমার ডিফেন্স হিয়ারিং—
সতী ধমকানির সুরে বললে—আপনি যাবেন কিনা বলুন?
বলেই চিৎকার করে ডাকলে—রঘু—
রঘু ঘরে আসতেই সতী বললে—এই সকলকে ঘর থেকে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দে, কাউকে এখানে ঢুকতে….
কিন্তু ঠিক সেই সময়েই একটা অঘটন ঘটলো। বাইরে কে যেন সদর দরজায় কড়া নাড়লে। রঘু গিয়ে দরজা খুলে দিতেই এক পোস্টাফিসের পিওন ঘরে ঢুকলো।
—কী চাই?
— টেলিগ্রাম!
কার টেলিগ্রাম! দীপঙ্কর একটু উৎসুক হয়ে ছিল। রঘু টেলিগ্রামটা দিতেই সতী সই করে দিলে। তারপর খামখানা খুলে নিজের মনেই পড়তে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে চেয়ে আছে সেই দিকে। কার টেলিগ্রাম! কে পাঠিয়েছে! কিছু জানা যাচ্ছে না। তারপর সেখানা হাতে নিয়েই সতী সোজা ভেতরে চলে গেল। ভেতরে গিয়ে নিজের ঘরের দরজায় সশব্দে খিল বন্ধ করে দিলে।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—কার টেলিগ্রাম? কে পাঠিয়েছে?
কে আর উত্তর দেবে এ-কথার! কেউই তো জানে না! মিস্টার ঘোষাল বললে— ঠিক আছে আপনারা এখন যান মা-মণি, আমি রইলুম, আমি দেখি কী করতে পারি! যা হয়, আমি আপনাকে জানিয়ে আসবো আপনার বাড়িতে গিয়ে—
.
নয়নরঞ্জিনী উঠলেন। সনাতনবাবুও উঠলেন। দীপঙ্করও উঠে বাইরে এল। তারপর গিয়ে গাড়িতে উঠলো। সামনের-রাস্তায় তখন কুলিরা কাজ করছে। রাস্তা মেরামত হচ্ছে। খোয়ার রাস্তায় অ্যাশফাল্ট দেওয়া হচ্ছে। মিলিটারি লরীর যাতায়াতের সুবিধের জন্যে কলকাতার সমস্ত খোয়ার রাস্তায় পিচ্ ঢালা হচ্ছে। চার্চিলের আর্মি মহাত্মা-গান্ধীকে অ্যারেস্ট করেছে। আবুল কালাম আজাদকে অ্যারেস্ট করেছে, সর্দার প্যাটেল, পন্ডিত নেহরুকে অ্যারেস্ট করেছে, প্রাণমথবাবুকে অ্যারেস্ট করেছে, ফোঁটাকে অ্যারেস্ট করেছে। এমন কি কিরণকেও অ্যারেস্ট করেছে ল্যান্ড লীজ় চুক্তির ফলে এই বেঙ্গলেই জড়ো হয়েছে অ্যালায়েড পাওয়ার্সের সব মাল মশলা। জেনারেলিশিমো চিয়াং-কাই- শেককে সাহায্য করতে হবে প্লেন দিয়ে, আর্মি দিয়ে, আর্টিলারি দিয়ে। আমেরিকার প্রোডাকশনের টেন্ পার্সেন্ট দিলে চায়না হান্ড্রেড পার্সেন্ট করে তা ফেরত দেবে। কোটি- কোটি টাকার রসদ, ওষুধ, জিপ্, সব কিছু বেঙ্গলের মাটিতে এসে জড়ো হয়েছে। এখানকার কন্ট্রাক্টাররা দুহাতে সাপ্লাই দিয়ে উঠতে পারছে না। চিয়াং-কাইশেককে বাঁচাতেই হবে। নইলে জাপানকে রোখা যাবে না। প্যাসিফিক্ এরিয়াতে ব্রিটিশ আর আমেরিকার আধিপত্য বজায় রাখতে গেলে জাপানের দাঁত ভাঙতেই হবে। কিন্তু হায়রে, সেদিন কি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জানতো, না চার্চিলই জানতো যে এত কোটি-কোটি টাকা চিয়াং-কাইশেককে দিয়ে শুধু ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। সেদিন কি তারা আরো জানতো যে চিয়াং-কাইশেককে চায়নার ভেতরে মাও-সে-তু-এর আর এক নতুন চায়না মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে?
সত্যিই তো, কখন রং বদলায়, কখন রাজ্য বদলায়, কখন মানুষ, মানুষের মন, সব কিছু বদলে যায়, কেউ জানতে পারে না। কেউ টের পায় না। ১৯১৮ সালে ১১ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট উইলসন বলেছিলেন এবার শান্তি আসবে। এবার মানুষ সুখী হবে। এবার আমিস্টিস্ সই হয়ে গেছে। আর ভয় নেই কারো! লীগ অব্ নেশনস্ তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু তখন কি প্রেসিডেন্ট উইলসনই জানতো যে সোভিয়েট রাশিয়ার গোকুলে লেনিন নামে আর একজন ভদ্রলোক মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে? কিংবা জার্মানীতে হিটলার নামে এক ভদ্রলোক মালকোঁচা মেরে তৈরি হবে? ফ্যাসিজম্ আর নাজিজম্-এর স্বপ্নই কি দেখতে পেয়েছিল উইলসন সাহেব? ভাবতে পেরেছিল সান্ ইয়াত্ সেনের কথা? কিম্বা গান্ধীর কথা? অথচ ঠিক সেই সময়েই ভিয়েনার একটা বন্ধ ঘরে বসে আর একজন ভদ্রলোক এই সনাতনবাবুর মতই নির্বিকার চিত্তে এই যুদ্ধ আর এই মৃত্যু, এই সভ্যতা আর এই যন্ত্রণার কথা নিয়ে ভেবে চলেছে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কে? কার কথা বলছেন?
সনাতনবাবু বললেন—ফ্রয়েড্—
রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার ট্যাঙ্ক আর মিলিটারি লরী সাজানো রয়েছে সার সার। নতুন গাড়ি, নতুন মেশিন। সব ল্যান্ড-লীজের মাল। সনাতনবাবু বললেন—ওই দেখুন- কাল শোভাবাজারে বোমা পড়েছে এই জন্যেই, এ সমস্তই চায়নায় পাঠানো হবে—
সত্যিই, মুষ্টিমেয় মানুষের পাপের খেসারত দিতে হবে সারা পৃথিবীর মানুষের মৃত্যু দিয়ে। হংকং-এর মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো শোভাবাজারের বাঙালীরা। সনাতনবাবু আবার বললেন—আসলে এই পৃথিবীটারই অসুখ করেছে দীপঙ্করবাবু— পৃথিবীটাই অসুস্থ—
নয়নরঞ্জিনী আর থাকতে পারলেন না। এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বলে উঠলেন—তুমি থামো তো সোনা, আমি আমার নিজের জ্বালায় জ্বলছি, এখন যত বক্- বক্ আরম্ভ করলে, থামো—
দীপঙ্কর বললে—আপনি কেন ভাবছেন মা-মণি, আমি তো বলছি সব ঠিক করে দেব—
—ভাবি কি সাধে বাবা! আমার মাথার ওপরে যে খাঁড়া ঝুলছে!
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি বলছি আমি যেমন করে পারি, সতীর কাছ থেকে আপনার টাকা যোগাড় করে দেবই—
—কিন্তু দেরি করলে তো আমার চলবে না বাবা, আমি কোর্টে দরখাস্ত করে শুধু ক’মাস নীলেম ঠেকিয়ে রাখতে বলেছি আমার উকীলকে। তিনমাস পরে করকরে লাখখানেক টাকা তো আমাকে দিতেই হবে?
—কিন্তু এমনভাবে ঠকবেনই বা আপনি কেন? আপনিও তো মামলা করতে পারেন পাওনাদারের নামে?
—সে তো আমার উকীলও বলেছে। এই মামলা করতে করতেই দেখছি বাজিভোর হয়ে যাবে। কিন্তু টাকাটা তো আমাকে জমা রাখতে হবে কোর্টে! তাই বলছিলাম টাকাটা পেলে আমার এখন সুবিধে হতো! আসলে বাবা আমি তোমাকে খুলে বলি, তুমি খুব বিবেচক ছেলে। বউমাকে যদি কোনওরকমে এই সময়ে বাড়িতে আনতে পারতুম তো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যেমন করে হোক টাকাটা আদায় করতে পারতুম—তা তো হলো না।
—কবের মধ্যে টাকাটা দরকার আপনার?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আজ দিলে আজই ভালো হয় বাবা, এমন হয়েছে কান্ড! তোমায় কী বলবো বাবা, আমার ন’দিদি আছে একজন, সে ইচ্ছে করলেই দিতে পারে, কিন্তু টাকার বেলায় কেউ কারো নয়। এমনি জগৎ। এই নীলেমের নোটিশের খবর পাবার পর থেকে আমার বাড়ির ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না—অথচ আগে রোজ আসতো।
তারপর দীপঙ্করের হাত দুটো হঠাৎ ধরে ফেললেন। তাঁর চেহারার দিকে চেয়ে দীপঙ্করের মায়া হলো। এত অসহায় রূপ আর কখনও দেখেনি সে মা-মণির।
মা-মণি আবার বলতে লাগলেন—ভেবেছিলুম আমি নিজে এসে বউমাকে বললে বউমা হয়ত ‘না’ বলতে পারবে না, কিন্তু টাকা না পেলে আমি কী করবো?
সনাতনবাবু বললেন—টাকা আনতে গিয়েছিলে তো টাকাটা চাইতেই পারতে? টাকা তো তুমি চাওনি মা! তুমি তো তোমার বউমাকেই চেয়েছ—
—তুমি থামো তো, তুমি আর আমাকে জ্বালিও না! টাকা সোজাসুজি ওমনি চাওয়া যায়? সোজাসুজি টাকা চাইলে কেউ দেয়? ন’দিদি টাকা দিলে?
দীপঙ্কর বললে—আমি সোজাসুজিই চাইবো। অত টাকা সতীর কী হবে! আপনাদের বিপদ তো তারও বিপদ!
গাড়িটা সোজা খোলা রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে চলছিল। নয়নরঞ্জিনী বললেন—দেখি এখন কী হয়, তোমরা দুজনে চেষ্টা করে যদি টাকা যোগাড় করে দিতে পারো তো আমি এ-যাত্রা বাঁচি বাবা, আমার আর কেউ নেই—
আর ওদিকে ঘরের মধ্যে মিস্টার ঘোষাল তখনও চেয়ারের ওপর বসে ছিল। তখনও সতী আসছে না। রঘু কাছে আসতেই মিস্টার ঘোষাল জিজ্ঞেস করলে—তোমার দিদিমণি কোথায়?
রঘু বললে—ঘরে। —ঘরে কী করছে?
—তা জানি না। ঘরের ভেতরে ঢুকে খিল বন্ধ করে দিয়েছে—
—চলো তো, আমি গিয়ে ডাকি একবার!
বলে মিস্টার ঘোষাল উঠলো। তারপর রঘুর সঙ্গে সতীর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে ঠক্ ঠক্ শব্দ করতে লাগলো।
—সতী! মিসেস ঘোষ! সতী!
কোনও সাড়া শব্দ নেই। ভেতরে যেন মৃত্যুর স্তব্ধতা বিরাজ করছে। মিস্টার ঘোষাল আরো জোরে শব্দ করতে লাগলো।
—ওরা চলে গেছে! সবাই চলে গেছে। আমি শুধু একলা আছি, দরজা খোল!
সতী! তবু কোনও শব্দ নেই। কোনও উত্তর নেই। দরজার মাথায় সিলিং-এর কোণে একটা টিকটিকি শুধু ঘাড় বেঁকিয়ে একবার মিস্টার ঘোষালকে দেখলে। টিকটিকিটাও যেন গ্রাহ্য করলে না মিস্টার ঘোষালকে। সেও নড়লো না একটুকু। সে-ও ভয় পেলে না একটু!