কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭১
৭১
সেদিন প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ির ভেতরে ঢুকে যে-স্বপ্নটা দেখেছিল দীপঙ্কর, তা যে শুধু স্বপ্নই, তা জানতে তা বিশ্বাস করতে যেন অনেক কাল, অনেক যুগ লেগেছিল তার। মানুষের জীবনে অনেক স্বপ্নই উঁকি মারে, অনেক বাস্তবই আঘাত দেয়। কিন্তু এক-একটা বাস্তব মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যায় অকারণে। আবার এক- একটা স্বপ্নও জীবনভোর যেন আচ্ছন্ন করে রাখে। দিনে রাত্রে সেই স্বপ্নটাই বার বার আনন্দ দেয়, বেদনা দেয়। আবার হয়ত মাঝে মাঝে বিড়ম্বনাও দেয়।
পরে সতী বলেছিল—বারে, তুমি অমন স্বপ্নই বা দেখতে গেলে কেন? তুমি কি কেবল ওই কথাই ভাবো নাকি?
সত্যিই তো, এ-সংসারে দীপঙ্করেরই কি কম দায়িত্ব ছিল? এ-পৃথিবীর আর সব সাধারণ মানুষের মত দীপঙ্করেরও তো অনেক দায় ছিল। জীবনের দায়, জীবিকার দায়। দীপঙ্করের মাথার ওপর ঝুলছিল কিরণের দায়িত্বটা। কিরণের মায়ের ভরণ-পোষণের বোঝা। আর শুধু তারাই বা কেন? কোথাকার কে এক সন্তোষ-কাকা! সেই সন্তোষ- কাকার কোন্ এক অরক্ষণীয়া মেয়ে এসে তার সংসারে একদিন বোঝা হয়ে ঢুকেছিল। তারপর চাকরি। চাকরিরই কি কম দায়িত্ব! প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চাকরি খড়্গগাটা মাথার ওপর যেন ভীতিকর হয়ে উঠছিল।
অভয়ঙ্কর বলতো—মিস্টার সেন, আপনার কী হয়েছে? আপনাকে এত পেল্ দেখাচ্ছে কেন?
বাইরে জার্নাল সেকশনে, ট্রানজিট্ সেকশনে, এস্টাব্লিশমেন্ট সেকশনে সেই আলোচনাই করতো সবাই। সেন-সাহেব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে দিন-দিন। যারা পুরোন লোক তারা দীপঙ্করকে আগে দেখেছিল। যুদ্ধের পর থেকে নতুন নতুন সেকশন হয়েছে, নতুন নতুন ক্লার্ক এসেছে আপিসে। নতুন কোনও ক্লার্ক এসে আপিসে ঢুকলেই উন্নতির শিখর হিসেবে সেন-সাহেবের উদাহরণটা দেখিয়ে দিত।
তারা বলতো—সে-সব সাহেবই নেই ভাই, সে-সব সাহেব থাকলে আজকে আমাদের ভাবনা?
তারা রবিনসন সাহেবের গল্পগুলো বলতো সবাইকে। কবে কোন্ সাহেব আপিস থেকে বাড়িতে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছিল। পেছন-পেছন একটি ছেলে রোজ বাড়ির দরজা পর্যন্ত যেত।
একদিন সাহেব আর থাকতে পারলে না। রেগে গেল। বললে—হু আর ইউ? কে তুমি?
—আজ্ঞে হুজুর, আই য়্যাম্ এ পুওর ম্যান্!
—কী চাও? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট্?
—সার্ভিস স্যার। চাকরি!
সাহেব রেগে গেলে। বললে—তা চাকরি কি আমার পকেটে থাকে? ডু আই ক্যারি ইট্ ইন্ মাই পকেট্? সী মি ইন্ মাই অফিস। আমার আপিসে দেখা করো—যাও, গে আউট্—
মনে হবে সে-সব বুঝি সত্য যুগেরই কথা। সে-সব সাহেবরা গালাগালি দিতেও যেমন ছিল পটু, আবার পরের দুঃখ-দুর্দশা দেখে চাকরি দিতেও ছিল তেমনি উদার! তার পরদিনই ছেলেটার চাকরি হয়ে গেল। চাকরির পর সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে ছেলেটা কেঁদে অস্থির। এখন সেই ছেলেটাকেই দেখতে পাবে টি-টি-আই সেকশনে গেলে। সেই গরীব ছেলেটাই এখন কোট্-প্যান্ট্ নেকটাই পরে গাড়ি চড়ে আপিসে আসে। দিনকাল বদলে গেছে, সে-ছেলেটাও বদলে গেছে। এখন দু-হাতে ঘুষ নেয়। বেনামীতে বাড়ি করেছে বালিগঞ্জে। ময়মনসিং থেকে তার ঘি আসে, দেরাদুন থেকে চাল আসে, খুলনা থেকে আসে ইলিশ মাছ আর নতুন গুড়ের পাটালি। এসব হলো ভেট।
এ-সব গল্প আপিস লাইনে অজস্র। এ-গল্প সকলের মুখে মুখে চলে। মুখে-মুখে চলে মিস্ মাইকেলের গল্প। মুখে-মুখে চলে মিস্টার ঘোষালের গল্প। মুখে-মুখে চলে রবিনসন সাহেব আর রবিনসন সাহেবের কুকুরের গল্প।
আজকের নতুন যুগের আপিসে সেন-সাহেবও এক গল্পে পরিণত হয়েছে। কেউ বলে—সেন-সাহেব চাকরি ছেড়ে দেবে। কেউ বলে—সেন-সাহেব বিয়ে করবে। কেউ বলে—সেন-সাহেবের অনেক টাকা। বাইরেই শুধু সেন-সাহেব ওই রকম সাদাসিধে সেজে থাকে। কেউ বলে—তা নয়। সেন-সাহেবের অনেক চ্যারিটি হে—
পুলিনবাবু বলে—না হে, অনেক চ্যারিটি আছে সেন-সাহেবের—তোমরা জানো না। দেখনি, এখনও গাড়ি করেনি সেন-সাহেব —
মধুকে সবাই জিজ্ঞেস করে চুপি চুপি। বলে—তোমার সাহেব এখনও বিয়ে করছে না কেন মধু? এত বয়েস হয়ে গেল—
মধু বলে—বিয়ে এবার করবে আমার সাহেব। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে কথা।
—কবে বিয়ে হবে?
মধু কোনও সেকশনে গেলেই বাবুরা চেপে ধরে। নানান্ কথা জিজ্ঞেস করে সেন – সাহেব সম্বন্ধে। সেন-সাহেবকে সম্বন্ধে আপিসের কেরানী-মহলে কৌতূহলের সীমা নেই। সেন-সাহেবকে আর পর মনে হয় না কারো। সেন-সাহেবের সঙ্গে যেন তাদের নাড়ির যোগ। একদিন তাদের মতন ছারপোকা-ওয়ালা চেয়ারে বসে গেছে সেন-সাহেব। তাদের দুঃখ, তাদের ভাবনা সেন-সাহেবের মত আর কে বুঝবে? এত আপন জেনেও কোথায় যেন একটা দূরত্ব গড়ে উঠেছে সেন-সাহেবের সঙ্গে। হঠাৎ সেন-সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে সাহসও হয় না তাদের। যেন ভয়-ভয় করে। সেন-সাহেব বেশি কথাও বলে না। মাথা নিচু করে ফাইলগুলো সই করেই হাতে দিয়ে দেয়। আগে যদিও বা একটু কথা বলতো, এখন তা-ও কমে গেছে।
সেদিন মধু গিয়েছিল স্টেশন রোডের বাড়িতে। ফাইল নিয়ে মাঝে-মাঝে গিয়ে দিয়ে আসে। দীপঙ্কর না থাকলে ফাইলগুলো রেখে আসে। মাসীমা জিজ্ঞেস করেছিল— তুমি কে বাছা?
মধু চালাক-চতুর লোক। দ্বিজপদর নিরুদ্দেশ হবার পর মধুর প্রমোশন হয়েছে। মাইনে বেড়েছে তার।
মাসীমার পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়েছিল। বলেছিল—আমি সাহেবের চাপরাসী মা!
—ওমা তুমি আমাদের দীপুর চাপরাসী? আমার দীপু বুঝি তোমাদের আপিসের বড়সাহেব বাবা?
—হ্যাঁ মা, সেন-সাহেব আমার বড়সাহেব। সাহেব আমার খুব ভালো লোক মা। সাহেব যখন ছোটসাহেব ছিল তখন থেকে আমি সাহেবের চাপরাসী।
মাসীমা জিজ্ঞেস করেছিল—তা তোমার সাহেব রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত আপিসে কাজ করে কেন? কী এত কাজ? তোমরা বাড়িতে আসতে বলতে পারো না? এত রাত পর্যন্ত খাটলে কি শরীর ঢেঁকে কারো?
মধু বললে—কই মা, সাহেব তো সন্ধ্যে ছ’টার পর আর আপিসে থাকেন না?
—আপিসে থাকে না তো কোথায় যায়?
কে জানে কোথায় যায়। তা আপিসের পর বাড়িতে আসতে বলতে পারো না? এত রাত পর্যন্ত দিনের পর দিন রোজ বাইরে থাকা তো ভালো কথা নয়। মধু চলে যাবার পর মাসীমা ক্ষীরোদাকে জিজ্ঞেস করলে—হ্যাঁরে শুনলি তো? যে এসেছিল ও আমার দীপুর আপিসের চাপরাসী।
ক্ষীরোদা প্রশ্নটা এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। মাসীমা তাড়াতাড়ি তার হাতটা ধরে ফেললে। বললে—কোথায় যাচ্ছিস? কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে?
ক্ষীরোদা বোবার মত চাইল মাসীমার মুখের দিকে।
—হাঁ করে দেখছিস কী? বল্? বল্ দীপু কোথায় যায়? কোন্ বাড়িতে?
ক্ষীরোদার চোখ দুটো ছল্ ছল্ করে এল।
—বল্ কোথায় যায়? তুই নিশ্চয়ই জানিস্। উত্তর দে?
ক্ষীরোদা কোনও কথা বলতে পারলে না। সে সেখানে দাঁড়িয়েই থরথর করে কাঁপতে লাগলো।
—বল্ কোথায় যায়? ওই যে এসেছিল এখানে, ও কে? কে সতী? কার নাম সতী? সতীর সঙ্গে দীপুর কীসের সম্পর্ক? বল্?
ক্ষীরোদা হঠাৎ মাসীমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কান্নায় হা হা করে উঠলো। কিন্তু মেয়ের মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোল না তবু।
রাস্তায় বেরিয়ে মধু কাশীকে জিজ্ঞেস করলেও কে গো তোমাদের বাড়িতে? সেন- সাহেবের মা?
কাশী বললে—না, ও অন্য লোক—
মধু বললে—আর ওই যে আর একজন? ও কে? সেন-সাহেবের বোন বুঝি?
কাশী বললে—দূর, বোন হতে যাবে কেন? ওরই সঙ্গে তো আমার দাদাবাবুর বিয়ে হবে!
এমন করেই কথাটা কখন আপিসেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। শুধু দীপঙ্করই জানতো না। শুধু দীপঙ্করই তার নিজের বাড়ির কোনও খোঁজ-খবর রাখতো না। নইলে এ নিয়ে আলোচনাও হয়ে গেছে সেকশনে-সেকশনে ক্লার্কদের মধ্যে। সবাই সেন-সাহেবকে দূর থেকে আঙুল দিয়ে দেখাত। পরম ভাগ্যবান অফিসার। পরম সৌভাগ্যবান মানুষ। কত ছোট থেকে কত তাড়াতাড়ি কত উঁচুতে উঠেছে। একেবারে আঙুল ফুলে কলাগাছ হে! বৃহস্পতি তুঙ্গী একেবারে। আর আমাদেরই যত ফাটা কপাল। আমাদের দেখবার কেউ নেই কোথাও। সেই থার্টি-থ্রি রুপীজ্-এ চাকরিতে ঢুকেছি, আর দু’বছরে পাঁচ এাকা ইন্ক্রিমেন্ট্।