কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭২
৭২
সনাতনবাবু বললেন—আসুন দীপঙ্করবাবু!
নয়নরঞ্জিনী সামনে ছিলেন। বললেন—তুমি তো কোনও ভাবনার ধার দিয়েও যাও না। আমি সারা দিন উকিল-মুহুরী করে বেড়াচ্ছি—
সনাতনবাবু বললেন—উকিলবাবু কী বললেন মা আজ?
—তুমি থামো! উকিল কী বলেছে তাই শোনবার জন্যে তোমার যেন ঘুম হচ্ছে না একেবারে? উকিল আবার বলবেটা কী? মামলা করেছি, এখন টাকাটা জমা দিতে হবে। সেই টাকার চেষ্টায় গিয়েছিলাম—
সনাতনবাবু জিজ্ঞেস করলেন—টাকা পেলে?
নয়নরঞ্জিনীর মেজাজ সপ্তমে চড়ে উঠলো। বললেন—কেমন করে পাবো টাকা, শুনি? টাকা ওনি চাইলেই তারা দেবে? টাকা নিয়ে সবাই বসে আছে আমার জন্যে? বলে ন’দিদি আমার আপনার লোক হয়েই টাকা দিলে না, টাকা দেবে পরেরা? আমার আপন জন কে আছে শুনি? কে টাকা নিয়ে বসে আছে আমার জন্যে, শুনি?
দীপঙ্কর বললে—কাঁচা টাকা কারোর কাছেই নেই মা-মণি। সবাই টাকা ইনভেস্ট্ করে ফেলেছে। কেউ চাল স্টক করেছে, কেউ মেডিসিন, কেউ অন্য কিছু—সমস্ত ব্ল্যাক্- মার্কেট করবার জন্যে টাকা খাটাচ্ছে—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—এই যে আমার ন’জামাইবাবু, আমি আজ উকিলের কাছ থেকে গিয়ে হাতে-পায়ে ধরলুম ন’জামাইবাবুর। বললুম অন্তত হাজার পঞ্চাশ টাকা আমাকে দিন, আমি তাইতেই এ-যাত্রা চালিয়ে নেব, আমার শাশুড়ীর আমার নিজের যা গয়না-গাঁটি আছে, তাই বাঁধা দিয়েই চালিয়ে নেব। তা দিলে? ন’জামাইবাবু তো আমার আপনার জন, সে-ই দিলে আমাকে টাকা?
এর পর আর সনাতনবাবুর বলার কিছু ছিল না হয়ত। তিনি চুপ করেই রইলেন।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—তারপরে আর বৌমার কাছে গিয়েছিলে বাবা তুমি?
দীপঙ্কর বললে—আমি তো রোজই যাই, একবার করে গিয়ে দেখা করে আসি—
সত্যিই প্রত্যেকদিনই দীপঙ্কর গিয়ে বসে থাকতো লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে। সেই যেদিন সনাতনবাবু গিয়েছিলেন, সেই দিন থেকে ক’দিন পর-পর। কিন্তু সতী যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। আর তেমন করে এসে বসতো না পাশের চেয়ারটায়। ভেতর থেকে বলে পাঠাতো—শরীর খারাপ তার।
দীপঙ্কর গিয়ে দাঁড়িয়েছিল একদিন তার দরজার সামনে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দীপঙ্কর দরজার বাইরে থেকে ডেকেছিল—সতী, দরজা খোল সতী!
ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসে নি। রঘু বলেছিল, দিদিমণি সারাদিনই ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে থাকে। আগেকার মতন বাইরে আসে না আর। আগে দোতলার সিঁড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখতো। ট্রেন যাওয়া-আসা দেখতো। দীপঙ্কর আসবার আগে গা-ধুয়ে শাড়ি-ব্লাউজ বদলে তৈরি হয়ে থাকতো। দীপঙ্কর এলেই পাশে এসে বসতো। তারপর সারাক্ষণ চুপ করে বসে থাকতো দু’জনে। মুহূর্তগুলো দু’জনের ভাবনার ছাদের ওপর দিয়ে হুহু করে উড়ে যেত নিঃশব্দে। তারপর রাত হতো। আরো রাত। আরো অন্ধকার। আরো ঘনিষ্ঠতা। তখন উঠে দাঁড়াতো দীপঙ্কর। আস্তে আস্তে সদর দরজা দিয়ে সোজা রাস্তায় গিয়ে নামতো। কিন্তু সেদিন আর দেখা করলে না সতী। সেদিন আর দরজা খুললে না। দীপঙ্কর অনেকক্ষণ চুপ করে একলা বসে থেকে থেকে এক-সময়ে সদর দরজা খুলে বাইরের অন্ধকার রাস্তায় এসে নেমেছিল।
—তারপর?
নয়নরঞ্জিনী জিজ্ঞেস করলেন—তারপর?
দীপঙ্কর বললে-তারপর টাকার কথাটা বলবার আর কোনও সুযোগই পাইনি মা- মণি—
—আর সেই যে তোমাদের আপিসের আর একটি ছেলে–ঘোষাল না কী যেন নাম তার। সে তো রইল সেখানে সেদিন। বলেছিল—খবর দেবে। কিন্তু সে-ও তো আর কোনও খবর দেয়নি বাবা! তুমিও খবর দিলে না, তোমার ঘোষালও খবর দিলে না- আমি ক’দিন থেকে খুবই ভাবছিলাম।
দীপঙ্কর বললে—আমিও কি কম ভাবছি ভাবছেন?
—তুমি আর আমার ভাবনার কতটুকু বুঝবে বাবা। আমার যা হচ্ছে সে আমিই বুঝছি আর ভগবানই বুঝছে। এই দেখ না, কেবল উকিলবাড়ি যাচ্ছি আর মুঠো-মুঠো টাকা গুনে দিয়ে আসছি। সব যাচ্ছে উকিল আর পেকারের গর্বে। কী যে হবে!
তারপর একটু ভেবে বললেন—আচ্ছা বাবা, সেদিন বউমার নামে ওই টেলিগ্রাম কে করলে? কার টেলিগ্রাম? বৌমার তো সাত কুলে কেউ নেই এক বোন ছাড়া, তা বউমাকে টেলিগ্রাম করতে যাবে কে? সে বোন তো দিল্লিতে থাকে শুনেছি—না?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—
—তা তার তো খুব পয়সা শুনেছি। তার সঙ্গে তোমার জানাশুনো আছে?
দীপঙ্কর বললে—আছে। লক্ষ্মীদি ইচ্ছে করলে দু’তিন লাখ টাকা দিতে পারে।
—তা তাকেই একবার বলে দেখ না বাবা! আমি তো তার বোনের শাশুড়ী। মায়ের পেটের বোনের শাশুড়ী। এটুকু উপকার তুমি বললে আমার জন্যে করবে না?
এ-কথাটা দীপঙ্করের এ ক’দিন এক বারও মনে হয়নি। ছিটে-ফোঁটার কথা মনে হয়েছে। আপিসে যে-দুচারজন মার্চেন্ট আসে, তাদের কথাও মনে হয়েছে। হোসেনভাই- এর কথা মনে হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্মীদির কথাটা একবারও মনে হয়নি। লক্ষ্মীদি তো টাকাটা দিয়ে দিতে পারে। দিল্লির কন্ট্রাক্টার মহলে তো ভীষণ প্রতিপত্তি লক্ষ্মীদির। সুধাংশুকে বললেই যে-কোনও কন্ট্রাক্টার এক মিনিটে টাকাটা দিয়ে দিতে পারে। এটুকু করবে না লক্ষ্মীদি?
—তা তাই-ই করো বাবা তুমি দীপু
বলে নয়নরঞ্জিনী দাসী যা কখনও করেন নি, তাই-ই করে ফেললেন। হঠাৎ দীপঙ্করের হাত দুটো দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন—তোমাকে বাবা আমার এই উপকারটা করতেই হবে। আমার এতদিনে মনে পড়েনি বলে বলিনি তোমাকে-বউমার বোনকে বলে দিতেই হবে—
দীপঙ্কর এতদিন পরে এই প্রথম নয়নরঞ্জিনীর দিকে যেন স্পষ্ট করে চেয়ে দেখলে। কী করুণ, কী বেদনাদায়ক চেহারা হয়েছে সতীর শাশুড়ীর। নির্মম ভাগ্য তাঁকে কত নিচে নামিয়ে নিয়ে এসেছে তা যেন তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। মুখের চামড়ার রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। বললেন—তুমি তো আমার সব জানো বাবা, তুমি তো আমার সব কিছু দেখেছ! সেই বাড়ি আজ কী হয়েছে, তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছো। আজ চাকর-ঝি’দের মাইনে দিতে পারি নি কত মাস —
দীপঙ্কর আর থাকতে পারলে না। বললে-আপনি চুপ করুন, মা-মণি, আমাকে আপনি আপনার ছেলের মত দেখবেন, আমি আমার যথাসাধ্য করবো আপনার জন্যে—
নয়নরঞ্জিনী আবার চোখের জল মুছে নিলেন নিজের আঁচল দিয়ে।
বললেন—তুমি আমার ছেলের মতই বাবা, আমি আগে যা যা বলেছি তোমায়, সব ভুলে যেও বাবা, কিছু মনে রেখো না। বুড়ো মানুষের সব সময় মাথার ঠিক থাকে না। কী বলতে কী বরে ফেলি—
দীপঙ্কর বললে—আপনি থামুন মা-মণি, সে-সব কথা মনে রাখলে আমি এমন করে এত কান্ডর পরে এখানে আসতাম না। আমি আজ সতীর কাছে সনাতনবাবুকে নিয়ে যাবো বলেই এসেছি—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—কিন্তু আমার ছেলেকে তো তুমি চেনো বাবা, সোনাকে নিয়ে গেলে যে সব পন্ড হয়ে যাবে, বউমার মুখ দেখে আমার ছেলে যে সব ভুলে যাবে—
দীপঙ্কর বললে—না মা-মণি, আপনি তাহলে আপনার বউমাকেও চেনেন নি, আর আপনার ছেলেকেও চেনেন নি।
—কিন্তু সেদিন তাহলে বউ অমন করে আমার মুখের ওপর কথা বলে? আজকে আমার এই অবস্থা বলেই তো সেদিন অত কথা শোনাতে পারলে! আগে হলে আমি দশ- ঘা জুতো মেরে অমন বউকে শায়েস্তা করতুম না! বউ হয়ে শাশুড়ীর মুখের ওপর কথা বলবে—এত আস্পর্ধা বৌ-এর!
দীপঙ্কর বললে—সে-সব কথা থাক্, এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমরা যাচ্ছি—চলুন সনাতনবাবু—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—সেখানে গিয়ে এই দীপু যেমন ভাবে কথা বলতে বলবে, তেমনি ভাবে কথা বোল, বুঝলে সোনা?
দীপঙ্কর বললে—সে আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না মা-মণি, সনাতনবাবু নিজেই সতীর সঙ্গে কথা বলবেন, দু’জনের মধ্যেখানে আমি থাকবোই না—
—না না বাবা, অমন কাজটি করো না, সে-রাক্ষুসী ভালো-মানুষ পেয়ে আমার সোনাকে বশ করে ফেলবে। তাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। শেষকালে আমার ছেলেও আর বাড়ি ফিরবে না।
সনাতনবাবু এতক্ষণ কিছু কথা বলেন নি। এবার একটু হাসলেন। বললেন—না মা- মণি, তোমার ভয় নেই, আমি তোমার বউমাকে বাড়ি ফিরিয়েই আনবো—তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
—তাই যদি আনবে তো সেদিন অমন করলে কেন? আর তাছাড়া বউমাকে আনো আর না-আনো, বৌমার টাকাটাই আসল, সেইটে আনতে ভুলো না—
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু সে তো আনতে পারবো না মা। তোমার বৌমাকে আনবার ভার নিতে পারি, টাকা সে দেবে কি না সে আমি জানি না।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—বেশ তো কথা বললে! বৌমাকে এনে আমার কিসের লাভ শুনি? টাকাই যদি না-পেলুম তো বৌমার মুখ দেখলে আমার পেট ভরবে?
দীপঙ্কর বললে—সে-সব আপনাকে ভাবতে হবে না মা-মণি। আমি যখন আছি, তখন সব ভার আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—
গাড়ি ডাকা হয়েছিল। দীপঙ্কর তখনও কেবল ভাবছিল আজ যদি সমস্ত ভালোয় ভালোয় সমাধা হয়ে যায, তাহলে হয়ত আবার সতী সুখী হবে। হোক ঘুষ, হোক টাকার প্রলোভন, হোক মিথ্যে কথা, তাতে কিছু দোষ নেই। সংসারের প্রতিদিনের কাজ- চালাবার মত একটা সম্পর্কও যদি সে স্থাপন করে দিতে পারে, তখন সে তার নিজের কথা ভাববে। যে-স্বপ্নটা সে এই বাড়িগতে ঢোকবার সময় দেখেছিল, সে স্বপ্নটা তো শেষ পর্যন্ত সত্যি হতেও পারে! মিস্ মাইকেলের আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি হয়নি। তা বলে দীপঙ্করের স্বপ্নটা সত্যি হবে না এ-কথাই বা কে বললে। প্রাণমথবাবুই তো স্কুলে একদিন ছোটবেলায় বলেছিলন—এক-একজনের স্বপ্ন সত্যিই ফলে।
গাড়িটার ভেতরে গিয়ে উঠলেন সনাতনবাবু। দীপঙ্কর তাঁর পাশে গিয়ে বসলো। বললে—চলো, গড়িয়াহাট—