কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৩
৭৩
রয়াল এক্সচেঞ্জ প্লেসে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল বসেছে। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন বুঝি কী খেয়াল হলো কর্তাদের—যে চুরিরও নাকি একটা মাত্রা আছে। পাপেরও নাকি একটা সীমা আছে। ব্ল্যাক্-মার্কেট ভালো জিনিস ততক্ষণ, যতক্ষণ তা কর্তাদের সরকারী তহবিল স্পর্শ না করে। চুরিও খারাপ জিনিস নয়, যতক্ষণ তা সরকারের নিজের ভাঁড়ারে সিঁকাঠি না ঢোকায়। ওটা বন্ধ করতে হবে। কারণ একদিন মিলিটারি সাপ্লাইতেই ভেজাল ঢুকে পড়লো শেষকালে। যাদের হাতে গভর্নমেন্ট তারাই একদিন বারুদে বালি মেশালে। তারাই একদিন ওয়ার-স্ট্র্যাটেজির স্ক্রু আলগা করে দিলে। সে শুরু হলো উনিশ শো তেতাল্লিশ সালের শুরু থেকেই। পাব্লিককে ঠকাচ্ছো ঠকাও, কিন্তু সরকারকে নয়। তাতে অ্যালায়েড পাওয়ার্সের ক্ষতি হবে। সাউথ ইস্ট এশিয়া কম্যান্ডএর পরাজয় হবে। সেই তখনই প্রবর্তন হলো স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যালের। যখন কোর্টের রেকর্ড-সেকশনে আর মামলার নথি-পত্র রাখবার জায়গা নেই, যখন জজদেরও আর বিচার করবার ফুরসত নেই-ঠিক সেই তখনই সৃষ্টি হলো স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যাল। রাতারাতি সব ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ারদের শায়েস্তা করতে হবে। নইলে ইউনাইটেড স্টেট্স-এর কাছে লজ্জায় পড়তে হয়। তারা বলে—দু’শো বছর রাজত্ব করবার পর ইন্ডিয়াকে কোথায় এনে ফেলেছো তোমরা? আবার যুদ্ধ যেদিন মিটে যাবে, সেদিন আবার যত ইচ্ছে চুরি করো, ব্ল্যাক-মার্কেট করো, কিছু বলবো না। পীস্- টাইমে চুরি পাপ নয়, ক্রাইমও ক্রাইম নয়। কিন্তু এখন জীবন-মরণ সমস্যা। দিস ইজ ওয়ার!
মিস্টার গাঙ্গুলীর গাড়িটা সোঁ সোঁ করে ছুটে আসছিল টেম্পল চেম্বার্স থেকে। মেন- উইটনেস্ মিসেস ঘোষ। তাকে আনা চাই কোর্টে।
মিস্টার ঘোষাল একটু হতাশ হয়ে গিয়েছিল প্রথমে। মিস্টার গাঙ্গুলী বলেছিল— আপনি কিছু ভাববেন না মিস্টার ঘোষাল, আমি মিসেস ঘোষকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো—
মিস্টার ঘোষাল বলেছিল-কিন্তু আমি অনেকবার গেলাম, কিছুতেই দেখা করলে না আমার সঙ্গে। কারো সঙ্গেই দেখা করছে না মিসেস ঘোষ এই ক’দিন —
মিস্টার গাঙ্গুলী জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু কেন? এরকম হঠাৎ হলো কেন? কী হয়েছে তাঁর?
—কে জানে মশাই, এতদিন অনেক রকম মেয়েমানুষ দেখেছি, এমন আর দেখিনি। সি ইজ্ এ মিস্ট্রি টু মী! টাকায় ভোলে না, মিষ্টি কথায় ভোলে না, কিছুতেই ভোলানো যায না, অদ্ভুত চীজ একটি—
মিস্টার গাঙ্গুলীরও অভিজ্ঞতা কম নয়। সারা জীবন টেম্পল—চেম্বার্সের পৃথিবীতে মানুষ চরিয়ে আসছে। খুনী, ডাকাত, ভদ্রলোক, মেয়েমানুষ, বেশ্যা, ছাত্রী, প্রফেসার, ডাক্তার, কবিরাজ, বাঙালী, ইহুদী–হাজার রকমের বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে আজ বুড়ো হতে চলেছে। যুদ্ধের সময় ক্রাইম্ যেমন বেড়েছে ক্রিমিন্যালও তেমনি বেড়েছে। সারা কলকাতায় যে এত ক্রিমিন্যাল ছিল তাই-ই তো আগে জানা ছিল না কারো। নিরীহ ছাপোষা ভদ্রলোকরা হঠাৎ কখন ব্ল্যাক-মার্কেটিয়ার হয়ে ওঠে! গৃহস্থবাড়ির বউ হঠাৎ কখন সংসার ছেড়ে বেরিয়ে চলে যায়। নিজের মায়ের পেটের ভাই হঠাৎ কখন ভাইকে খুন করে বসে! এ-সব খবর কোর্টে না-গেলে পাওয়া যায় না। সমস্ত কলকাতার চেহারাখানা যেন কোর্টে এসে উলঙ্গ হয়ে যায়। মানুষ যেন বেআব্রু হয়ে পড়ে কোর্টে এসে। এখানে কৃপণের ট্যাক থেকেও অনায়াসে হাজার-হাজার টাকা বেরিয়ে আসে। এখানে অহঙ্কারীর অহঙ্কার, দরিদ্রের দারিদ্র্য, পন্ডিতের পান্ডিত্য সব কিছু বানচাল হয়ে যায়। এখানে এসে সাধু ভন্ড বলে প্রমাণ হয়, ভন্ড সাধু! এখানে অনুমানের কোন স্থান নেই। স্থান আছে প্রমাণের। এখানে প্রমাণ করতে পারলে অসতী সতী হয়ে যাবে। প্রমাণ দাখিল করতে পারলে খুনী এখানে বেকসুর খালা পাবে। এই প্রমাণের রাজ্যের সম্রাট হলো টাকা। টাকা দিয়ে এখানে প্রমাণ কেনা যায়, প্রমাণ বেচা যায়। টাকা দিলে প্রমাণ ম্যানুফ্যাক্চার করা যায়।
মিস্টার ঘোষাল সাধারণত আসত দুপুর বেলা। যখন সব নিরিবিলি। ভেবেছিল নিরিবিলিতে মিসেস ঘোষকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। এই কেসটা মিটে গেলেই আবার মিস্টার ঘোষাল ডি-টি-এস্ হয়ে বসবে রেলওয়ের চেয়ারে। তারপরে হবে টি-এম-এ। তারপর হবে এজেন্ট। সেখানে থেকে রেলওয়ে বোর্ড।
মিস্টার ঘোষাল বলতো-ইন্ডিয়ার রেলওয়ে-য়্যাডমিনিষ্ট্রেশন-এ বড় গলদ আছে, আমি সব রেকটিফাই করবো—
সতীকে বলতো—তখন দিল্লি হবে আমার হেড কোয়ার্টার—কিন্তু আমি রুল্ করবো হোল্ অব্ ইন্ডিয়া—
সত্যিই সমস্ত ইন্ডিয়া রুল্ করবার স্বপ্ন দেখতো মিস্টার ঘোষাল! তখন সতী মিস্টার ঘোষালের কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু কে জানতো মিস্টার ঘোষালের সে-স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে! কে জানতো স্বাধীনতার পর মিস্টার ঘোষালরাই সমস্ত ইন্ডিয়া রুল্ করবে। সমস্ত ইন্ডিয়াময় তাদেরই রাজত্ব এমন অপ্রতিহতভাবে চলবে!
কিন্তু সে অনেক পরের কথা। তখন এ-উপন্যাসের যবনিকা-পৰ্ব চলছে!
মিস্টার ঘোষাল দুপুরবেলা এসেই একেবারে চুরোটের ধোঁয়া ছেড়ে ডাকতো—রঘু!
রঘু এলেই বলতো—কই, তোমার দিদিমণি কই?
রঘু বলতো—দিদিমণি ঘরের ভেতরে—
মিস্টার ঘোষাল দরজার সামনে গিয়ে ঠক্ ঠক্ শব্দ করতো। বলতো—মিসেস ঘোষ, আমি ঘোষাল —
ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসতো না।
মিস্টার ঘোষাল আবার ডাকতো-সতী, পরশুদিন হিয়ারিং আছে—মনে আছে তো? দরজা খোল—
তবু ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসতো না। মিস্টার ঘোষাল পোড়া চুরোটটাকে জুতোয় মাড়িয়ে আবার গট গট্ করে বেরিয়ে যেত! সতী রঘুকে বলে দিয়েছিল কারোর সঙ্গে দেখা করবো না আমি, কাউকে ঢুকতে দিস্ নি বাড়িতে—
এমনি ক’দিন ধরেই মিস্টার ঘোষাল এসে ফিরে যাচ্ছিল।
এবার মিস্টার গাঙ্গুলী। মিস্টার গাঙ্গুলী আসতেই রঘু বললে—দেখা হবে না দিদিমণির সঙ্গে—
মিস্টার গাঙ্গুলী বললে—বলো, আজকে মিস্টার ঘোষালের কেস্ আছে, দিদিমণিকে সাক্ষী দিতে হবে—
রঘু বললে—দেখা হবে না, দিদিমণি বলে দিয়েছে, কারোর সঙ্গে দেখা করবে না-
মিস্টার গাঙ্গুলী বললে—তুমি বলো না গিয়ে আমার কথা—বলেই দেখ না একবার—
—কেন মিছিমিছি দিক্ করছেন বাবু, দেখা হবে না তো বললুম!
মিস্টার গাঙ্গুলী অত সহজে দমবার পাত্র নয়। বললে—চলো, কোন্ ঘরে তোমার দিদিমণি আছে, দেখি—
বলতে গেলে একরকম জোর করেই মিস্টার গাঙ্গুলী ভেতরে ঢুকলো। সতীর ঘরের সামনে গিয়ে ডাকলে—মিসেস ঘোষ, আমি টেম্পল চেম্বার্স থেকে গাঙ্গুলী এসেছি, আজকে মিস্টার ঘোষালের ডিফেন্স হিয়ারিং—
আর বেশি বলতে হলো না—হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। আর মিস্টার গাঙ্গুলী দেখলে সামনেই সতী দাঁড়িয়ে আছে। একবারে সেজেগুজে তৈরি। যেন এতক্ষণ ধরে তৈরিই হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে।
মিস্টার গাঙ্গুলী বললে—নমস্কার, আমায় চিনতে পারছেন তো?
সতী বললে—হ্যাঁ, চলুন—
—আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত ভুলে গেছেন।
সতী কিছু কথা বললে না। আস্তে আস্তে বাইরের ঘরের দিকে চলতে লাগলো। মিস্টার গাঙ্গুলী আবার জিজ্ঞেস করলে–আপনার শরীর ভালো আছে তো মিসেস ঘোষ? সতী তবু কিছু উত্তর দিলে না। যেমন চলছিল। তেমনি সামনে রাস্তার দিকে চলতে লাগলো।
মিস্টার গাঙ্গুলী বললে—মিস্টার ঘোষাল ক’দিন এসে ঘুরে গেছেন, তিনি বড় ভাব- নায় পড়ে গেছেন, তিনি বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছেন—
তবু সতী কিছু কথা বললে না। যেন সচল পাথর একখানা। সচল পাথরের মত সামনের দিকে চলতে লাগলো কঠিন হয়ে। সামনেই মিস্টার গাঙ্গুলীর গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তাতেই গিয়ে উঠলো। এবার আর পাশে নয়। এবার মিস্টার গাঙ্গুলী সামনের সীটে গিয়ে বসলো। তারপর ড্রাইভারকে বললে—চলো, রয়্যাল এক্সচেঞ্জ প্লেস্—