কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৫
৭৫
রয়্যাল এক্সচেঞ্জ স্পেসের স্পেশ্যাল ট্রাইবুন্যাল কোর্টে সবাই ভেতরে ঢুকতে পারবে না। পুলিস-পাহারা বন্দোবস্ত আগে থেকেই করা ছিল। শুধু যারা এ মামলায় উইটনেস তারাই আসবে। আর আসবে উকীল, বার-অ্যাট-ল, অ্যাটর্নী, জজ, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর। আর আসবে পীরালি, যতীন, জগন্নাথ, মকবুল। আর আসবে কে-জি- দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু। আর আসবে আসামী মিস্টার ঘোষাল। আর, আর-একজন আসবে। সে মিসেস ঘোষ। শ্রীমতী নয়নরঞ্জিনী দাসীর পুত্রবধূ, শ্রীযুক্ত বাবু সনাতন ঘোষ মহাশয়ের স্ত্রী—শ্রীমতী সতী ঘোষ।
এমনি ক’দিন ধরেই মামলা চলছে। বিরাট অভিযোগ আসামীর নামে। সম্ভ্রান্ত পোস্টের অধিকারী হয়ে আসামী ইল্লিগ্যাল গ্র্যাটিফিকেশন নিয়েছে। এ রেলওয়ের শুধু নয়, গভর্নমেন্টেরও ডিসগ্রেস। বিশেষ করে এই ওয়ারের সময়। ব্রিটিশ ওয়ার-এফর্টে এ ক্রাইম পেছন থেকে ছুরি মারার মতন। লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি সোলজার যুদ্ধের ফ্রন্ট- লাইনে অমানুষিক পরিশ্রম করছে দিনরাত। লাইফ দিচ্ছে আর্মার্ড-কারের সামনে। আর্টিলারির মুখে বুক পেতে দিচ্ছে। ওপর থেকে প্লেন এসে বোমা ফেলছে মাথায়। ঠিক সময়ে তাদের ওষুধ গিয়ে পৌছুনো চাই সেখানে, ঠিক সময়ে ফুড গিয়ে পৌছুনো চাই সেখানে। ঠিক সময়ে গুলি, বারুদ, পেট্রল পৌছুনোও চাই সেখানে।
ক’দিন ধরে একে একে সবাই সাক্ষী দিয়ে গেছে। নিখুঁত নির্ভেজাল সাক্ষী। একেবারে চোস্ত ট্রেনিং মিস্টার গাঙ্গুলীর। যতীন বলেছে—ঘোষাল সাহেব বড় ভালো লোক। আমি তাঁকে ভালো করে চিনি—
—কত বছর ধরে তুমি চেন তাঁকে?
—আজ্ঞে বিশ-বাইশ বছর।
—বিশ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে তোমার চেনা কী করে হলো?
—আজ্ঞে হুজুর, আমি গরীব লোক, সাহেব আমাকে দয়া করে সাহায্য করেন।
—কত টাকা করে সাহায্য করেন?
—মাঝে মাঝে পঞ্চাশ টাকা। কখনও একশো টাকা। আমার দরকার হলেই আমি গিয়ে চাই—
—তোমার মত আর কত লোককে সাহায্য করেন?
—আজ্ঞে, তা আমি জানি না। শুনেছি সাহেবের কাছে গিয়ে টাকা চাইলে কেউ খালি হাতে ফিরে আসে না।
—তুমি জানো কি যে সাহেব মার্চেন্টদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়?
—না হুজুর। এ হতেই পারে না। সাহেবের মত সাঁচ্চা লোক কখনও ঘুষ নিতে পারে না। সাহেব সদাশিব মানুষ। টাকা-কড়ির ব্যাপারে সাহেব বড় দিল-দরাজ। সাহেব কখনও এ-কাজ করতেই পারে না। সাহেবকে আমি বিশ-বাইশ বছর ধরে দেখে আসছি।
—তুমি কি জানো যে একজন ফিরিঙ্গি মেয়েকে খুন করার অপরাধে সাহেবের বিচার হয়েছিল ক’দিন আগে?
—আজ্ঞে হুজুর, সে একদম মিথ্যে কথা। সাহেব ভালো লোক বলে সবাই সাহেবকে বিপদে ফেলতে চায়। সাহেব আমার খাঁটি মানুষ। শিবের ক্যারেকটারে তবু দোষ থাকতে পারে, কিন্তু সাহেবের ক্যারেকটারে কোনও দোষ নেই—
—আচ্ছা তুমি যাও। এর পরে কে আছে?
এর পরে মকবুল। মকবুল ফ্রী-স্কুর স্ট্রীটের গুন্ডা। সেও সেই একই কথা বলে গেল। সেও নাকি একজন গরীব লোক। বহুদিন ধরে তার অবস্থা দেখে সাহেব টাকা দিয়ে সাহায্য করে আসছে তাকে। সাহেবের নাকি এই রকম গরীবদের সাহায্য করা অভ্যেস। পরের কষ্ট দেখলে সাহেব আর স্থির থাকতে পারে না। সাহেবের পক্ষে ঘুষ নেওয়া অসম্ভব। সাহেব সবাইকে টাকা দেয়। টাকা দিতে-দিতেই সাহেব ফতুর হয়ে গেছে। সাহেব কাকে কত টাকা দিয়েছে তাও মনে থাকে না সাহেবের। কত লোককে যে সাহেব রেলের আপিসে চাকরি করে দিয়েছে তার ঠিক নেই। মকবুল যদি লেখাপড়া জানতো তো মকবুলকেও সাহেব চাকরি করে দিত।
একে একে সবাই সেই এক-কথাই বলে গিয়েছিল। যতীন, মকবুল, জগন্নাথ। রেলওয়ে আপিস থেকে কে-জি-দাশবাবু এসেছিল সাক্ষী দিতে। কে-জি-দাশ-বাবু বলেছিল—আমি ঘোষাল সাহেবের আন্ডারে কুড়ি বছর কাজ করেছি, আমি জানি সাহেবের মত সৎ অনেস্ট লোক হয় না!
—ঘোষাল সাহেবের চাপরাসী সাহেবের আড়ালে সাহেবকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালাগালি দিত আপনি শোনেননি?
কে-জি-দশবাবু বলেছিল—না!
—আপনি কখনও কোন মার্চেন্টকে আপিসে এসে সাহেবকে ঘুষ দিতে দেখেননি?
—না!
—সাহেব আপনাদের ক্লার্কদের সঙ্গে কী-রকম ব্যবহার করতেন?
—ভদ্রলোক ভদ্রলোকের সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করেন, তেমনি।
—তাহলে কি স্বীকার করবো মিস্টার ঘোষাল একজন এফিসিয়ান্ট অনেস্ট রেলওয়ে অফিসার?
—হ্যাঁ। আমরা তাঁর আন্ডারে কাজ করেছি বলে গর্ব বোধ করি। তাঁর মত অফিসার পেলে রেলওয়ে আরো বেনিফিটেড হবে।
রামলিঙ্গমবাবুও ওই কথাই বলে গেল। আপিস থেকে যারা-যারা সাক্ষ্য দিতে এসেছিল, তারা সবাই ওই এক কথাই বললে। সবাই ঘোষাল সাহেবকে ভালবাসে। মিস্টার গাঙ্গুলী বেছে-বেছে ডিফেন্স ইউটনেস নিয়েছিল। শুধু তাই-ই নয়। মিস্টার রামমনোহর দেশাই, হোসেনভাই-কাশেমভাই-এর পার্টনার মিস্টার হোসেনভাই, সবাই সেই একই কথা বলেছিল। ঘুষ দিয়ে তারা কারবার করে না। ঘুষ হলো হারাম। হারামের কারবার তারা করে না, করবেও না কখনও। ঘুষ দিয়ে যেদিন রেলওয়ের সঙ্গে কারবার করতে হবে, সেদিন তারা কারবার তুলে দেবে।
—এর পর আর কে আছে?
—এবার মিসেস ঘোষ। যিনি মিস্টার ঘোষালের পি-এ হিসেবে কাজ করেছিলেন। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিস্টার ঘোষাল এবার একটু মুখ ফেরালে। দেখলে সতী একটা লাল শাড়ি পড়েছে আজ। ভিজে চুল পিঠের ওপর এলিয়ে দিয়েছে। সিঁথির গোড়ায় সিঁদুরটাও যেন একটু বেশী জ্বল জ্বল করছে আজ। মিস্টার ঘোষাল একদৃষ্টে চেয়ে রইল সেদিকে। সতী কোনওদিকেই দেখছে না। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখ নিচু করে এসে দাঁড়াল সাক্ষীর ডায়াসে। তারপর সেই রকম মুখ নিচু করেই রইল সতী। ‘সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ বাঁধাবুলি আউড়ে গেল। তারপর স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে প্রশ্ন করতে লাগলো। কী নাম তার। কোথায় জন্ম। কোথায় মানুষ হয়েছে। কত বয়েস! কোথায় বিয়ে হয়েছে। স্বামীর না কী। স্বামীর অবস্থা কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। অবান্তর, অসংলগ্ন সব প্রশ্ন। কোর্টে এলে সমস্ত গোপন খবর প্রকাশ হয়ে পড়ার জন্যেই তৈরি থাকা উচিত। সতীও যেন আগের বারের মত তৈরি হয়েই এসেছে। মিস্টার ঘোষাল কান তক্ষ করে শুনতে লাগলো।
—আপনি এই আজকের আসামী মিস্টার ঘোষালকে চেনেন?
সতী ঘাড় নাড়লে—হ্যাঁ।
—আপনি কি রেলওয়েতে মিস্টার ঘোষালের আন্ডারে লেডী পি-এ’র চাকরি করেছেন?
— হ্যাঁ।
—আচ্ছা, এখন আর একটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি তার ঠিক- ঠিক উত্তর দেবেন। আপনি কি দেখেছেন মার্চেন্টরা মিস্টার ঘোষালের আপিস-ঘরে আসতো?
— হ্যাঁ।
—কী জন্যে আসতো তারা?
—আপিসের কাজে!
—আপিসের কী কাজ?
সতী বললে—ওয়াগন চাইতে। ওয়াগন অ্যালমেন্টই ছিল মিস্টার ঘোষালের প্রধান কাজ!
—ওয়াগন যারা চাইতে আসতো তারা কি ঘুষ দিত মিস্টার ঘোষালকে?
–না।
স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর জিজ্ঞেস করলে—মিস্টার ঘোষাল তাদের কাছে ঘুষের জন্যে কখনও পীড়াপীড়ি করেছে?
সতী এবার মাথা তুললো। তারপর হঠাৎ বললে — হ্যাঁ।
আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কোর্টসুদ্ধ লোক চমকে উঠেছে। ডিফেন্স উইটনেস এ কী কথা বলছে! এ সাক্ষী তো হোস্টাইল! একে কেন প্রডিউস করেছে কোর্টে! মিস্টার গাঙ্গুলী, বার-অ্যাট-ল দত্ত, আসামী মিস্টার ঘোষাল সবাই স্তম্ভিত!
—মিস্টার ঘোষাল ঘুষ নিয়েছে তাদের কাছে থেকে?
—হ্যাঁ।
—আপনি ঘুষ নিতে দেখেছেন?
—হ্যাঁ আমি নিজের চোখে দেখেছি। বেশীর ভাগ সময়ে তিনি আমার হাত দিয়ে ঘুষ নিয়েছেন। আমিই মিস্টার ঘোষালের হয়ে লক্ষ-লক্ষ টাকার ঘুষ নিয়েছি।
ওদিকে—হৈ হৈ কান্ড বোধ গেছে। বার-অ্যাট-ল দত্ত চিৎকার করছেন। হোস্টাইল উইটনেস, হোস্টাইল উইটনেস। কিন্তু ততক্ষণে যা-হাবার তা হয়ে গেল। স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর সেই অল্প-সময়ের মধ্যেই নিজের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে।
—আপনি কার-কার কাছে ঘুষ নিতে দেখেছেন মিস্টার ঘোষালকে? কার কার কাছে আপনি ঘুষ নিয়েছেন?
—সকলকে। সকলের কাছ থেকেই নিয়েছি!
ব্যারিস্টার দত্ত মাঝখানে বাধা দেবার চেষ্টা করলে। কথার মধ্যেখানে কথা বলে সতীকে অন্যমনস্ক করে দেবার চেষ্টা করলে। না, এ হতে পারে না। এ অসম্ভব। দিস ইজ অ্যাবসার্ড। ইওর অনার……
—সকলকে মানে কাকে-কাকে?
—প্রত্যেকে! প্রত্যেকটি মার্চেন্ট মিস্টার ঘোষালকে ব্রাইব দিয়ে গেছে। একজনও বাদ নেই। ব্রাইব না দিলে বিজনেস হয় না, ব্রাইব না দিলে রেলওয়ে চলে না। ব্ৰাইব না দিলে গভর্নমেন্ট চলে না। মিস্টার ঘোষালকে একলাই আপনারা ধরেছেন। কিন্তু প্রত্যেকে গিল্টী আমরা। আমরা প্রত্যেকে ডিস-অনেস্ট। আমরা প্রত্যেকে আসামী! আমরা রেলওয়েম্যান হয়ে রেলওয়েম্যানের ডিউটি করি না। আমরা হাজব্যান্ড হয়ে হাজব্যান্ডের ডিউটি করি না। আমরা ওয়াইফ হয়ে ওয়াইফের ডিউটি করি না। আমরা সবাই রটন টু দি কোর। আমরা বাইরে ফরসা জামা কাপড় পড়ে সভ্য হয়েছি বলি, আসলে আমরা আদিম, আসলে আমরা অসভ্য, আসলে আমরা বর্বর!
অনেক বাজে কথা বলে গেল সাক্ষী। সমস্ত কোর্টময় হুলুস্থুল কান্ড বেধে গেছে তখন। কিন্তু সতীকে থামাবে এমন শক্তি তখন কোথাও নেই। সে যেন সমস্ত বলে দেবে বলেই এখানে এসেছে। কারো সামনে বলবার সুযোগ এতদিন হয়নি তার। তার ছোটবেলা থেকে এই এত বয়েস পর্যন্ত যত অভিযোগ জমা হয়েছিল, যত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল সব সে উজাড় করে দেবে। সে জীবনে কিছুই পায়নি। তার লক্ষ্মীদি যা পেয়েছে, সেটুকুও সে পায়নি। বাবা পায়নি, মা পায়নি, স্বামী পায়নি, শাশুড়ী পায়নি, সংসার পায়নি, সন্তান পায়নি, কিছুই পায়নি। শুধু পেয়েছে টাকা। যে টাকা নিয়ে তার জীবনে কোনও উপকারই হবে না, সেই তুচ্ছ টাকাই সে পেয়েছে কেবল। আর সেই টাকার জন্যেই আজ তাকে নিয়ে টানাটানি চলছে। এর চেয়ে অপমান, এর চেয়ে অসম্মান আর কেউ করেনি তাকে!
—কিন্তু আপনিই তো এই আসামীকে সচ্চরিত্র, সাধু বলে একদিন কোর্টে গিয়ে এজাহার দিয়েছেন?
—দিয়েছি। কিন্তু আজ আর দেব না।
—কেন? কেন দেবেন না? সেদিন যদি দয়া হয়েছিল আসামীর জন্যে, তবে আজ কেন এত নিষ্ঠুর হচ্ছেন?
—নিষ্ঠুর? নিষ্ঠুর হওয়ার ক্ষমতা আমার কোথায়? নিষ্ঠুর হতে পারলে তো আমি আজ সবাইকে ফাঁসি দিতুম, সবাইকে জেলে পাঠাতুম! আমার স্বামীকে জেলে পাঠাতুম, আমার শাশুড়ীকে জেলে পাঠাতুম, আমার নিজের বোন, নিজের ভগ্নীপতি সবাইকে জেলে পাঠাতুম। এত লোককে জেলে পাঠাতুম যে তত জায়গা আপনাদের জেলখানাতেও নেই। সবাই গিল্টি। সবাই আসামী। সবাই মিথ্যেবাদী, সবাই জোচ্চার। আজ যে আমরা সাধু-সজ্জন সেজে ভদ্র হয়ে ফর্সা জামা-কাপড় পরে সভ্য হবার অভিনয় করছি, এ জেলখানার ভয়ে নয়, এ ফাঁসীর ভয়ে নয়। এ শুধু টাকার লোভে। আরো টাকা চাই আমাদের, আরো টাকা। নিজামের মত টাকা, রকফেলারের মত টাকা, হেনরি ফোর্ডের মত টাকা, এনডু কার্নেগীর মত টাকা!
—থামুন!
একজন জজ বুঝি আর থাকতে পারেননি। চিৎকার করে উঠেছেন—স্টপ। ন্যায়দন্ড ঠুকে টেবিলে শব্দ করছেন।
বেশী বাজে কথা বলা বে-আইনী। অবান্তর কথা বলা অন্যায়। কিন্তু সতী কথা বলতে পেয়ে যেন সমস্ত দিক-বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।
বার-অ্যাট-ল দত্তসাহেব কী সব বক্তৃতা দিতে লাগলেন অনর্গল। স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটরও কী-সব বলতে আরম্ভ করলেন। দু’জনের তর্ক-বিতর্কের দিকে তখন আর সতীর কান নেই। সতী তখন অন্য কথা ভাবছে। এই মিস্টার ঘোষালই একদিন তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। এই মিস্টার ঘোষালই একদিন তার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল। প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত্রি তখন সতীর দুর্ভাবনায় আর দুশ্চিন্তায় কেটেছে। কিন্তু সে কিসের জন্যে? সে তো তার টাকা নয়। সে তো তার শরীর। তার দেহ! কিন্তু সেও তো প্রকারান্তরে টাকা। সেদিন অগাধ টাকা ছিল মিস্টার ঘোষালের। টাকা ছিল তার বিলাসের বাহন। টাকা দিয়ে মিস্টার ঘোষাল সমস্ত প্যালেস-কোর্ট, সমস্ত কলকাতা, সমস্ত রেলওয়ে, সমস্ত ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট কিনতে চেয়েছিল। মিস্টার ঘোষালের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে সতী।
অদ্ভুত মানুষ। একটু উদ্বেগ নেই। একটু অস্থিরতা নেই। সমস্ত কলকাতাকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। যেন মানুষের গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে ভেবেছিল মিস্টার ঘোষালের কাছে সতী গিয়েছিল আশ্রয়ের লোভে। আসলে আশ্রয় নয়। আসলে সেদিন নিরাশ্রয়ই চেয়েছিল সতী। আসলে নিজের ওপর, নিজের স্বামী শাশুড়ী সকলের ওপরই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। পারলে সতী সেদিন নরকে গিয়ে আশ্রয় নিত। সেদিন নরক খুঁজে পায়নি বলেই তো গিয়েছিল নরকের চেয়ে বড় নরক, নরকের চেয়েও বড় নর্দমায়—প্যালেস-কোর্টে।
—কিন্তু আপনার প্রমাণ আছে?
—আমার মুখের কথাই আমার প্রমাণ!
—কিন্তু মিসেস ঘোষ, আপনি ডিফেন্স উইটনেস, প্রমাণ দিলেই তবে আপনার সাক্ষ্য রেকর্ড হবে। তা না-হলে আপনার এজাহারের কোনও দাম নেই। বুঝবো আপনি কোনও মোটিভ নিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন—এমন কোনও ঘটনা ঘটেছে যাতে আপনি ডিফেন্স উইটনেস হয়েও আসামীর বিপক্ষে এজাহার দিচ্ছেন।
—আপনি প্রমাণ চান?
—নিশ্চয়ই। প্রমাণ না দিতে পারলে বুঝবো আপনি আসামীর ওপর বিরক্ত। যে কোনও কারণেই হোক আপনি আপনার মত বদলেছেন!
—তাহলে এই নিন প্রমাণ! কত প্রমাণ চান আপনি, নিন।
বলে সতী হঠাৎ তার শাড়ির ভেতর থেকে একটা বান্ডিল বার করলে। একতাড়া কাগজের বান্ডিল। যত দিন ধরে যত শিপ পাঠিয়েছে মিস্টার ঘোষাল মিসেস ঘোষের নামে, সেই সমস্ত। কত রামমনোহর দেশাই, হোসেনভাই এন্ড কাশেমভাই-এর পার্টনার কত মিস্টার হোসেনভাই, কত ঝুনঝুনওয়ালা, কত বাঙালী, কত সিন্ধী, কত গুজরাটি, কত পাঞ্জাবী, কেউ বাদ নেই। কোনও প্রভিন্স বাকী নেই। রেলওয়ের ওয়াগন সকলেই নিয়েছে। সকলেই রেলের ওয়াগন নিয়ে টাকা রোজগার করেছে। পাঁচশো টাকা ব্রাইব দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা প্রফিট করেছে। ইন্ডিয়ার মানুষরা সেদিন চাল পায়নি, ওষুধ পায়নি, ফায়ার-উড পায়নি, বাড়ি তৈরী করবার লোহা-কাঠ-সিমেন্ট পায়নি। সেই ১৯৪৩ সালের ইন্ডিয়ার এক চরম চিত্র। সেদিন গভর্নমেন্ট থেকে প্রচারপত্র বিলোন হয়েছে—আরো কম খাও, আরো কম পরো, আরো খরচ কমাও। আর একদিকে গ্রো মোর ফুড। সেদিন ইন্ডিয়ার চাষারা খেত মোটা মোটা রুটি আর নুন। কোনও কোনওদিন রুটিও পেট ভরে খেতে পেত না। তারা আর কত কম খাবে? তারা সেদিন খালি গায়ে থাকতো, খালি পায়ে। তারা আর কত কম পরবে? আর কত কৃচ্ছ্রসাধন করবে? এতদিন তারা জানতো না কাদের জন্যে তাদের এতো কষ্ট। এবার তারা জানলো। এবার জানতে পারলে বোমা যত মানুষ মেরেছে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী মানুষকে মেরেছে মানুষ। এবার তারা জানতে পারলে যে মানুষের চেয়ে বড় শত্রু আর আমাদের নেই। মানুষ বোমার চেয়েও ভীষণ, মানুষ বন্দুকের চেয়েও মারাত্মক। এর আগে কলকাতার মানুষ বোমা দেখেনি, ট্যাঙ্ক দেখেনি, রাইফেল দেখেনি। এবার দেখলে। তার চেয়েও ভীষণ মারাত্মক অস্ত্র দেখলে। দেখলে কোর্ট-প্যান্ট-নেকটাই পরা একজন ভদ্রলোক। অত্যন্ত ভদ্র-সভ্য চেহারা। ঠিক তাদেরই মত তার চোখ-কান-নাক- মুখ। ঠিক তাদেরই মত তার চাল-চলন-কথা-বার্তা। ঠিক তাদেরই মত তার হাবভাব। বাঘ নয়, ভাল্লুক, নয়, সিংহ নয়, কেউটে সাপ নয়। একেবারে খাঁটি মানুষ!
পীরালি, যতীন, মকবুল, জগন্নাথ সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু তারাও শেষ পর্যন্ত সমস্ত শুনে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল।
জগন্নাথ বললে—শালা শুয়োরের বাচ্চা, বেশ হয়েছে—শালার টাকা যেন হাত দিয়ে গলতে চায় না —
যতীন বললে—তাহলে তুই ওই রকম সাক্ষী দিলি কেন?
জগন্নাথ বললে—তুই কেন দিলি শালা?
যতীন বললে—আমি যে পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি রে শালা, মিথ্যে সাক্ষী দেবার জন্যে—
জগন্নাথ পকেট থেকে দশখানা দশ টাকার নোট বার করলে—এই দ্যাখ শালা আমি কত আদায় করেছি—এই দ্যাখ, গুনে দ্যাখ—
কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু কথাগুলো শুনছিল। শুনে এ-ওর দিকে চাইলে। তারা কিছুই পায়নি। মিছিমিছি এতগুলো মিথ্যে কথা বলে এল কোর্টে। শুধু মিছিমিছিই বা কেন? এ মামলায় যদি ছাড়া পায় ঘোষাল সাহেব তো আবার ডি-টি-এস-এর চেয়ারে বসবে। তখন? তখন তো আবার ঘোষাল সাহেবের কাছে গিয়েই তার পায়ে তেল দিতে হবে। আবার তো সেই প্রমোশনের জন্যে ঘোষাল সাহেবকে গিয়েই খোসামোদ করতে হবে। তখন?
সেদিন কেউই ভাবেনি, সেদিন মিস্টার ঘোষাল নিজেও হয়ত কল্পনা করতে পারেনি যে এমন হবে। মিস্টার ঘোষাল বরাবর টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছে পুলিসের, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছে খবরের কাগজের। টাকা দিয়ে সমস্ত রেলওয়েই একদিন কিনে নিয়েছে। কিন্তু একথা হয়ত ভাবেনি যে দৈবাৎ এক-এক সময় মানুষেরও সত্য কথা বলতে ইচ্ছে হয়। মিথ্যের সংসারেও দৈবাৎ এক-এক সময় ন্যায়বিচার হয়। তা না হলে হাজার- হাজার পাপ, হাজার-হাজার অন্যায় সত্ত্বেও এ পৃথিবী আজো চলছে কেন? আজো ইতিহাস তৈরি হচ্ছে কেন?
তাই সেদিন স্পেশ্যাল-ট্রাইব্যুন্যাল-কোর্টের জাজমেন্ট পড়ে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শুধু মিস্টার ঘোষাল নয়। প্যালেস-কোর্টের যত আসামী সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। নয়নরঞ্জিনী দাসী, কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু, যতীন, জগন্নাথ, মকবুল সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। পাড়ায়-পাড়ায় খবরের কাগজ নিয়ে টানাটানি পড়ে গিয়েছিল সেদিন। ক্রফোর্ড সাহেবও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল সমস্ত রেলওয়ে অফিসার। এমন কি দিল্লির রেলওয়ে-বোর্ড পর্যন্ত। দীপঙ্কর, অভয়ঙ্কর সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এমন কি যেদিন ছিটে-ফোঁটা-প্রাণমথবাবুর খবর বেরিয়েছিল সেদিনও এত চমকায়নি কেউ। যেদিন লক্ষ্মীদির খবরটা বেরিয়েছিল, সেদিনও এত অবাক হয়ে যায়নি কেউ। কলকাতার আদালতের বিচারে এ যেন অভূতপূর্ব অভাবনীয় কান্ড!
কিন্তু একমাত্র যে অবাক হয়নি, সে হলো সতী!
আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিস্টার ঘোষালের চোখের দৃষ্টি যেন ক্রমেই কঠোর হয়ে আসছিল। যেন শেকল খোলা পেলে এখুনি নখের আঁচড়ে দাঁতের কামড়ে সতীকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে। এতদিন করুণা করেছে, কৃপা করেছে। এতদিন স্বরূপ প্রকাশ করেনি। এবার উদ্দাম, উন্মাদ হয়ে উঠবে! এবার সতীকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে নিঃশেষ করে দেবে!