কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৮
৭৮
পরের দিন সকাল-সকালই এল দীপঙ্কর। শম্ভু ছিল সামনে। দীপঙ্করের চেহারা দেখে শম্ভুও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বললে—কী হয়েছে দাদাবাবু আপনার?
দীপঙ্কর বললে—কেন?
শম্ভু বললে–আপনার চেহারা এমন হয়েছে কেন?
সে-কথার উত্তর না-দিয়ে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—মা-মণি আছেন বাড়িতে?
ক’দিন থেকেই দীপঙ্কর যেন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। আসতে পারেনি প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে। লক্ষ্মীদি আসার পর থেকেই জিনিসটা হয়েছিল। সব সুর সব তাল কেটে গিয়েছিল জীবনের। এতদিন ছিল এক-রকম। আপিসে গিয়েছে। আপিসের কাজও বেড়ে গিয়েছিল। আপিস সুদ্ধ লোক মিলিটারিতে নাম লিখেয়েছিল। আগে ভয় হতো তাদের কোথায় নিয়ে যাবে ওয়ার-ফ্রন্টে। খাকি পোশাক দিয়েছে, কম্বল দিয়েছে, জলের ব্যাগ দিয়েছে। কিট্-ব্যাগ দিয়েছে। তারপর একদিন হয়ত বললে—চলো সিঙ্গাপুর, কিংবা চলো বার্মা। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে ভয়টা কেটে গেল। মাস গেলে অনেকগুলো ফাল্গু টাকা আসছে হাতে। অথচ কোনও ঝক্কি নেই। আগে যারা ডিফেন্স- অব্-ইন্ডিয়ার বন্ডে সই করেনি, তারা দেখলে তারা ঠকে গেছে। কিন্তু তখন নতুন করে নাম সই করতে চাইলেও আর উপায় নেই। আর রিক্রুট করা হবে না। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। স্ট্যালিনগ্র্যাভ্ থেকে সেই যে শীতের সময় জার্মান-আর্মি সরে এলো, তখন থেকেই মোড় ঘুরে গেছে যুদ্ধের। ইজিপ্টের ফ্রন্টেও জার্মান জেনারেল কম্যান্ডার রোমেল হটে এসেছে। কলকাতার সাহেবদের হাসি-হাসি মুখ আবার। কলকাতার মার্কেন্টাইল ফার্মে আবার সাহেবদের কালো মুখ লাল হয়ে উঠেছে। আবার হুইস্কি উড়ছে চৌরঙ্গীর হোটেলে-হোটেলে। আবার জ্যাজ্, আবার ফক্স-ট্রট্, আবার ওয়ালজ্ চলছে জোরদার হয়ে। আমেরিকান সোলজারদের সঙ্গে কালো-কালো নিগ্রো-হাসী সোলজারে ভর্তি হয়ে গেছে কলকাতা। চৌরঙ্গীর রাস্তায় বেরোতে ভয় করে মেয়েদের। বিশেষ করে সন্ধ্যেবেলা। বাসে ধারের সীটে বসলে বাইরে থেকে গায়ে হাত দেয় তারা। মেয়েমানুষ দেখলে আর জ্ঞান থাকে না। হৈ হৈ শব্দ করে ওঠে। ভিখিরির মেয়ে, ছেঁড়া ময়লা কাপড় পরে রাস্তায় ভিক্ষে করছে। তাই-ই সই। তাকেই জিপ্ গাড়িতে তুলে নিয়ে সোঁ সোঁ করে উধাও হয়ে যায়। তারপর লেকের মাঠের তাঁবুর সামনে নিয়ে গিয়ে তাকে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দিয়ে মজা দেখে। ক্যামেরা নিয়ে ফোটো তোলে। কাঁটা তারের বাইরে দাঁড়িয়ে বাঙালীরাও মজা দেখে। বিনা পয়সার মজা। মেয়েটাকে প্রচুর হুইস্কি খাইয়ে দিয়েছে। সে ন্যাংটো হয়ে খোলা আকাশের নিচেয় দাঁড়িয়ে হাসে, গান গায়, নাচে। আর ফোটো তুলে নেয় ইয়াঙ্কিরা সব আঙ্গেল থেকে। সে-ফোটো হয়ত নিজেদের দেশেও পাঠায়। দ্যাখো, ইন্ডিয়া মেয়েদের কান্ড দ্যাখো। দিস্ ইজ্ ইন্ডিয়া। দিস্ ইজ্ ক্যালকাটা। দিস্ ইজ্ বেঙ্গলী-গার্ল।
এমনি কত মেয়ে, কত পুরুষ কত দালাল সেদিন ঘুষ নিয়েছে ইয়াঙ্কিদের কাছ থেকে। টাকা নিয়েছে। টাকা নিয়ে ইন্ডিয়ার সুনাম, সম্ভ্রম, ইজ্জত সব বেচে দিয়েছে। তারা সশরীরে এখনও বেঁচে আছে কলকাতা শহরে। তারা এখন ইয়াঙ্কিদের টাকায় বাড়ি করেছে, গাড়ি করেছে। সেই টাকা খরচ করে ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছে। খদ্দরের ধুতি- পাঞ্জাবি পরে বক্তৃতা দিচ্ছে মাঠে মাঠে। আর তাদের চেনার উপায় নেই।
কিন্তু ভিক্টরির সঙ্গে সঙ্গে এল ভাইস্। এল খাবার নিয়ে ফাটকা-বাজি। চলের দাম চড়ে গেল পঞ্চাশ ষাট টাকায়। চাল, ডাল, কয়লা, তরি-তরকারি সব আগুন হয়ে উঠলো। আর ছোঁয়া যায় না হাত দিয়ে।
ক্রফোর্ড সাহেব বেশি কথা বলবার লোক নয়। অফিসে দিল্লির রেলওয়ে বোর্ড থেকে যখন ডি-ও লেটার আসে তখন অফিসসুদ্ধ তোলপাড় পড়ে যায়। হৈ-চৈ পড়ে যায় একটা লেটার খুঁজে না পাওয়া গেলে। কিন্তু ক্রফোর্ড সাহেব ধীর-স্থির হয়ে বসে থাকে নিজের ঘরে। তাকে দেখতেই পায় না কেউ সচরাচর। রবিনসন সাহেবের ফেয়ারওয়েলের দিনেও সবাই বক্তৃতা দিয়েছিল, মিস্টার ক্রফোর্ড চুপ করে সমস্ত শুনে গিয়েছিল শুধু। যেদিন কলকাতায় বোমা পড়েছিল সেদিন তো অফিসে কাজই করেনি সাহেব।
কিন্তু সেদিন হঠাৎ ডেকে পাঠালে দীপঙ্করকে।
—ডু ইউ নো সেন? তুমি শুনেছ?
দীপঙ্কর বুঝতে পারেনি কীসের কথা বলছে মিস্টার ক্রফোর্ড। অন্য দিনের চেয়ে যেন বেশি হাসি-হাসি মুখ। হাসির কারণটা বুঝতে পারলে না দীপঙ্কর।
—আমাদের ভিক্টরি হয়েছে, শুনেছ? রোমেল্ পালিয়ে গেছে ডেসার্ট ছেড়ে। ইজিপ্ট এখন ব্রিটিশের কন্ট্রোল? গ্রীস্ আমরা আবার নিয়ে নিয়েছি—
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ পেপারে দেখেছি—
—তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বোস না, বোস। টেক্ ইওর সীট্!
কিন্তু সাহেব কী বলছে? দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল! কোথায় ভিক্টরি? সমস্ত কলকাতার লোক খেতে পাচ্ছে না। রেশন-শপ্ হয়েছে সমস্ত কলকাতায়। রেলওয়ে থেকেও স্টাফদের রেশন দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চাশ-ষাট টাকা মণ চাল, দশ-আনা বারো- আনা সের ডাল, আলু দেড়-টাকায় আড়াই পো, এর নাম ভিক্টরি? সেই কলকাতায় বোমা পড়বার পর থেকেই জিনিস-পত্রের দাম হু-হু করে বাড়তে লাগলো। ওদিকে মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে পাঁউরুটি আর পচা আলু পাহাড় হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। কলকাতার মানুষ সেইখানে গিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে আসে। তারপর রাস্তার ধারে মাটির হাঁড়িতে রান্না করে খেয়ে নেয়। হোক তারা ভিখিরি। কিন্তু ভিখিরি হলেও এতদিন মানুষের ইজ্জত নিয়ে তারা বেঁচে ছিল। মানুষের মতই এতদিন তাদের চাল-চলন ছিল। এবার সেই মানুষ গরু শেয়াল সব-কিছু একাকার হয়ে গেল একেবারে।
মানুষের ভিক্টরি যদি হয় তো কেন কলকাতার মানুষ খেতে পায় না? কেন রেশনের চালের জন্যে রাত থাকতে দোকানের সামনে লাইন দেয়? আপিসের মানুষরা আর তেমন কাজ করে না। এখন আপিসের কাজ ফেলে রেখে আপিসের দোকানে রেশন নিতে যায়। সেখানেও লাইন। আপিসের ফাইল পড়ে রইল। কাজ-কর্ম সব সিকেয় উঠলো। ছুটলো রেশনের দোকানে। রেলওয়ে আপিসও চাল-ডাল-তোল-নুনের দোকান খুলেছে। সারাদিনই সেখানে কাটে তাদের। আপিসে আসবার সময় ঝোল-ঝুলি নিয়ে আসে। তারপর আপিসে এসেই দোকানে ছোটে। সেখানে একবার গেলে আর দু’ঘন্টার আগে ফিরে আসবার উপায় নেই। সস্তার সব জিনিস। সেই জিনিস সঙ্গে নিয়ে আবার বাড়ি যাবার হুজ্জতও আছে।
দীপঙ্কর সব লক্ষ্য করে। আপিসের ফাইল-এ একটা আঁচড়ও পড়ে না কারো। আপিসের কাজ পড়ে থাকে। ওদিকে দিল্লির বোর্ড থেকে জরুরী চিঠি আসে। সে-চিঠি নিয়েও আগেকার মতন কেউ আর মাথা ঘামায় না। সবাই যেন অসাড় হয়ে গেছে। চোখের সামনে টাটকা মৃত্যু দেখে দেখে মৃত্যুর ওপরও যেন লোকে মমতা হারিয়ে ফেলেছে। লোকে বলে—মরতে তো একদিন হবেই মশাই!
আগে মরা এত সহজ ছিল না। আগে মরা দেখলে লোকে ভয় পেত, সাবধান হতো, চমকে উঠতো। কিন্তু তখন মৃত্যু সারা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। রাস্তা দিয়ে চলতে-চলতে মৃত্যু দেখলে লোকে মড়া ডিঙিয়ে যায়। শেষকালে মৃত্যুর বিভীষিকার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর দুর্গন্ধটাও সহ্য হয়ে গেল। মড়ার দুর্গন্ধ পেলে নাকে রুমাল দেওয়াও উঠে গেল।
ক্রফোর্ড সাহেব বলে—ওদের এখন কিছু বোল না সেন! আমাদের তো ভিক্টরি হচ্ছে—
আপিসের ক্লার্কদের কাছে কৈফিয়ৎ চাইলে বলে—এখনও হয়নি স্যার-
-–কেন হয়নি?
সঙ্গে সঙ্গে বলে—রেশনের দোকানে গিয়েছিলুম স্যার—
রেশনের দোকানে যাক্ আর না-যাক্, রেশনটা একটা ওজর হয়ে দাঁড়ালো। রেশনের নাম করে ক্যাটিনে গিয়ে গল্প করতে লাগলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে লাগলো সময়, উড়িয়ে দিতে লাগলো সংসার, উড়িয়ে দিতে লাগলো জীবন। জীবন, মৃত্যু, জন্ম, সেক্স সম্বন্ধে মানুষ নির্বিকার হয়ে উঠলো। আর একদিকে লোভ, পাপ, হিংসেকে ক্যাপিটাল করে আর একদল মুষ্টিমেয় মানুষ ফেঁপে উঠতে লাগলো ফানুসের মত। এই হলো ১৯৪৩ সালের কলকাতার মানুষের কাহিনী। ঠিক এই সময়েই নয়নরঞ্জিনী দাসী নীলেমের নোটিশ পেলেন। ঠিক এই সময়েই নির্মল পালিত পাগল হয়ে গেল। ঠিক এই সময়েই দিল্লি থেকে লক্ষ্মীদি কলকাতায় এসে পৌছাল। আর ঠিক এই সময়েই দীপঙ্কর ছট্ফট্ করে বেড়াতে লাগলো টাকার জন্যে
এতদিন টাকার কোনও প্রয়োজন হয়নি দীপঙ্করের। এতদিন মাইনে পেয়েছে। মাইনে পেয়ে সংসার চলেছে। শুধু সংসার নয়। যে এসেছে হাত পেতেছে। আপিসের পিওন মধু থেকে শুরু করে বাড়ির চাকর কাশী পর্যন্ত কারোর অভাব রাখেনি দীপঙ্কর। কত টাকা হাতে এসেছে আর কত টাকা হাত থেকে গেছে সে আয়-ব্যয়ের হিসেব কখনও রাখেনি। কিন্তু এবার হিসেব করবার প্রয়োজন হলো। প্রভিডেন্ড ফান্ডে কিছু টাকা নিশ্চয় হয়েছে।
একদিন প্রভিডেন্ট ফান্ড সেকশনের বড়বাবুকে দীপঙ্কর ডাকলে। জিজ্ঞেস করলে— আমার কত টাকা জমেছে একবার আমাকে জেনে বলবেন?
বড়বাবু বললে—আমি আপনাকে লেটেস্ট ফিগার জানিয়ে দেব আজই—
ক্রফোর্ড সাহেবও অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—তুমি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন্ নেবে? কেন? হোয়াই?
দীপঙ্কর ব্যাচেলর লোক। সংসারে তার কেউ নেই, অথচ এই পোস্টে থেকে কত লোক কত টাকা ঘুষ নিয়ে বড়লোক হয়েছে। নৃপেনবাবু সামান্য অফিস-সুপারভাইজারের কাজ করে তিনখানা বাড়ি করেছে কালিঘাটে। এখন বেশ নিশ্চিন্তে গঙ্গাস্নান করে আর ভগবানের নাম করে। অথচ দীপঙ্করের এত টাকার প্রয়োজন কেন? তবে কি ভেতরে- ভেতরে মদ খায়? ভেতরে-ভেতরে মেয়েমানুষ রেখেছে?
আপিসেও সেকশনে-সেকশনে আলোচনা হয়।
কে-জি-দাশবাবু বলে—আরে মশাই, সকলকেই চেনা হয়ে গেল—
—কী বড়বাবু? কার কথা বলছেন?
কে-জি-দাশবাবু বলে—আরে ভাই, এ-সব বলবার জিনিস নয়, এ-সব খবর চেপে যাওয়াই ভালো—যত দোষ করেছে ঘোষাল—সাহেব!
তবু ক্লার্করা বুঝতে পারে না। বলে—কেন বড়বাবু, কী হয়েছে?
—আরে এই যে আমাদের সেন-সাহেব, সেন-সাহেবের কথা ভাবছিলুম, ভেবেছে ডুবে-ডুবে জল খেলে শিবের বাবারও জানার সাধ্যি নেই। এক্ষুণি হোসেনভাই এসেছিল, বলে গেল—
—কী বললে?
—বললে আর কী? বললে—কে-জি-দাশবাবু, তোমাদের সেন-সাহেবও কি আজকাল ব্রাইব্ নিচ্ছে নাকি?
কে-জি-দাশবাবু ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে। বললে—আমি প্রথমে কথাটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলুম ভাই, জিজ্ঞেস করলুম—কেন? ও-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন হোসেনভাই সাহেব?
হোসেনভাই বললে–সেন-সাহেব হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলে—বড়লোকরা এত টাকা দিয়ে কী করে? বড়লোকরা কিছু টাকা দিয়ে দিলেই তো পারে গরীবদের। বড়লোকরা গরীবদের দুঃখ বুঝতে পারে কি না—এই সব!
—তা আপনি কী বললেন!
হোসেনভাই বললে—আমি প্রথমটায় তাজ্জব হয়ে গেলুম কে-জি-দাশবাবু, ভাবলুম এতদিন ওয়াগন চাইতে আসছি, সেন-সাহেব তো কখনও টাকার কথা তোলে নি! সেন- সাহেবও কি ব্রাইব্ চায় নাকি?
কে-জি-দাশবাবু উদ্দ্গ্রীব হয়ে শুনছিল। বললে—তারপর?
হোসেনভাই বললে—তারপর আর কী! ব্রাইব তো কেউ খোলাখুলি চায় না, ব্ৰাইব্ তো সবাই ইন্ডাইরেক্ট-ওয়েতে চায়, আমি আর কিছু কথা বাড়ালাম না, চলে এলুম—
—ওয়াগন পেলেন?
—হ্যাঁ, ওয়াগন পেলুম। এর পরের দিন বোধহয় চাইবে। সেদিন দিতেই হবে। ব্রাইব্ তো আমরা দিয়েই থাকি কে-জি-দাশবাবু। ব্রাইব্ না-দিলে আমাদের কারবার চলে না। পরের দিন টাকা সঙ্গে করে নিয়ে আসবো—জেন্টেলম্যানরা তো আর সোজাসুজি ঘুষ চাইতে পারে না। এইরকম এঁকিয়ে বেঁকিয়ে চায়। তা দেব!
কে-জি-দাশবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলো। বললে—না, না হোসেনভাই সাহেব, ঘুষ দেবেন না আপনি, কিছুতেই ঘুষ দেবেন না। কেন মিছিমিছি দিতে যাবেন?
হোসেনভাই বললে—না কে-জি-দাশবাবু, আমি ব্রাইব্ দেবই। রেলের অফিসার ব্রাইব্ নিলে তো আমাদের সুবিধে। ব্রাইব্ দিলেই তো আমাদের কারবার ভালো চলে। ব্রাইব্ দিলে চাঁদির জুতো মেরে কাম্ আদায় করতে পারি—ঘুষ আমি দেবই—
—না না হোসেনভাই সাহেব, আপনি ঘুষ দেবেন না। আপনি এক কাজ করুন-
—কী কাজ?
কে-জি-দাশবাবু বললেন—আপনি য়্যান্টি-করাপশন অফিসের পুলিসকে খবরটা দিয়ে দিন, তাতে রেলেরও ভাল, আপনারও ভাল—
হোসেনভাই বললে—কিন্তু আমার কারবার চলবে কী করে? আমাকে কি আর কেউ কখন বিশোআস করবে?
—করবে হোসেনভাই সাহেব, করবে! আমি সেন-সাহেবকে নিজে জানি যে ভাল করে, আমার আন্ডারে এতদিন কাজ করেছে ক্লার্ক হয়ে। আমিই যে হাতে ধরে ইংরিজী ড্রাফট করতে শিখিয়েছি। এখন আমাকেই মানতে চায় না সেন-সাহেব।
—তা এত টাকার কীসের দরকার পড়লো? সেন-সাহেব মদ খায়?
—আরে মদ খায়, মেয়েমানুষ রেখেছে। কী না-করে। ডুবে ডুবে সবই করে। কেউ জানতে পারে না তাই। ঝি-এর ছেলে। ওর মা পরের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করতো, জানো সাহেব? তারপর রবিনসন সাহেবের কুকুরকে বিস্কুট খাইয়ে খাইয়ে এই অফিসার হয়েছে। তেত্রিশ টাকায় কেরানীর চাকরিতে ঢুকেছিল, এখন ন’শো টাকার গ্রেড— আঙুল ফুলে একেবারে কলাগাছ—বুঝেছ সাহেব? তুমি পুলিসে ধরিয়ে দাও—জব্দ হোক! জার্নাল সেকশনে এইসব গল্প সবিস্তারে বলছিল কে-জি-দাশবাবু। লক্ষ্মণ সরকার চুপ করে শুনছিল সব
কে-জি-দাশবাবু লক্ষ্মণ সরকারের দিকে চেয়ে হঠাৎ বললে—আপনি আবার যেন বলে দেবেন না লক্ষ্মণবাবু, আপনি তো সেন-সাহেবেরই লোক আবার-বাঙালীদের তো এই-ই স্বভাব, কেবল পরের নামে লাগানি-ভাঙানি—
লক্ষ্মণ সরকারের বলবার দরকার নেই। দীপঙ্কর সবই জানতো। জানতো তাকে নিয়ে সেকশনে কী আলোচনা হয়। জানতো তার সম্বন্ধে কে-কী বলে। আপিসের কাজ করতে করতে এক-একবার মনে হতো—চাকরি ছেড়ে দেয়। এই চাকরি না করলে তো তাকে নিয়ে এত মাথা ঘামায় না কেউ। এই চাকরি না করলে তো তার সম্বন্ধে এত আলোচনা ওঠে না। মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথাও কোনও গ্রামের মধ্যে গিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়। যায় আবার সেই ব্যাঁটায়। যেখানে দীপঙ্কর জন্মেছিল। যেখান থেকে মা তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল। প্রভিডেন্ট ফন্ডের যে-টাকা ক’টা আছে তাই নিয়ে এক-রকম করে শেষ-জীবনটা কাটিয়ে দেবে। চোদ্দ-পনেরো হাজার টাকায় একটা খামার কিনে চাষ-বাস করবে। তাতে বোধহয় অনেক শান্তি। অনেক আরাম। কারো সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। কোনও সম্বন্ধ রাখবে না। সতী, লক্ষ্মীদি, সনাতনবাবু, মিস্টার ঘোষাল, ছিটে-ফোঁটা সকলের কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। পাপ থেকে দূরে চলে যাবে। পুণ্য থেকেও দূরে চলে যাবে। আসলে হয়ত জীবন থেকেও দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করতো দীপঙ্করের।
প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে এসে শম্ভুকে দেখে আবার সে-ভাবনাটা খানিকক্ষণের জন্যে দূরে চলে গেল।
মা-মণি নিজের ঘরেই বসেছিলেন। সেই তখুনি নির্মল পালিতকে দেখে এসেছেন। মনটা খিঁচড়ে ছিল। দীপঙ্করকে দেখে যেন একটু উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বললেন—কী বাবা? কী হলো?
দীপঙ্কর সামনের চেয়ারটায় বসলো। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যেন হাঁফাচ্ছিল। বললে—আপনি সনাতনবাবুর কাছে কিছু শোনেন নি?
মা-মণি বললেন—ওর কথা ছেড়ে দাও বাবা, ও কি একটা মানুষ? বলছিল, কী যেন বৌমার বোন এসেছে নাকি দিল্লি থেকে
দীপঙ্কর বললে—সে এক ভীষণ কান্ড হয়েছে সেখানে, সেই জন্যেই তো আপনার কাছে আসতে পারিনি এ ক’দিন!
—কিন্তু বৌমার বোনেরও তো টাকা আছে? সে-ও তো বাপের আদ্দেক টাকা পেয়েছে?
—তাতো পেয়েছে। কিন্তু এখন লক্ষ্মীদির যা অবস্থা, তাতে টাকার কথা বলাই যাচ্ছে না। টাকা তো টাকা, তার জীবন নিয়েই এখন টানাটানি—
নয়নরঞ্জিনী জিজ্ঞেস করলেন—কী রকম?
দীপঙ্কর বললে—সনাতনবাবু আপনাকে কিছু বলেন নি? লক্ষ্মীদি যেদিন এল দিল্লি থেকে সেদিন তো সনাতনবাবু বসে আছেন? সেদিন সনাতনবাবুকে নিয়ে গিয়ে খুব মুশকিলে পড়েছিলুম আমি। এদিকে কোনও কাজই হলো না, ওদিকে সতীও তখন বাড়ি ছিল না—
—বৌমা আবার কোথায় গিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে?
দীপঙ্কর বললে—সেই আমাদের ঘোষাল সাহেবের মামলাতে সাক্ষী দিতে। মা-মণি কিছু জানতেন না। বললেন—আহা, ছেলেটি খুব ভালো, তার আবার কীসের মামলা!
দীপঙ্কর বললে—সে অনেক কান্ড! সতী তো তার আন্ডারেই চাকরি করেছে এককালে, সে তো জানেন? সেই মামলায় আটকে পড়েছিল ঘোষাল-সাহেব, সেদিন ছিল শুনানীর দিন। সতীর সাক্ষীতেই শেষ পর্যন্ত জেল হয়ে গেছে ঘোষাল-সাহেবের, শুনেছেন বোধহয়?
মা-মণি অবাক হয়ে গেলেন। বললেন—জেল?
দীপঙ্কর বললে— হ্যাঁ, আট মাসের।
—আট মাস! আহা গো, আপীল করতে বলো বাবা! এই মামলা মকদ্দমা নিয়ে’ হয়েছে ভালমানুষদের জ্বালা। এই দেখ না, কোথাও কিছু নেই, আমি কিছু জানলুম না শুনলুম না, আমার নামে ডিক্রি হয়ে গেল, আমার বাড়ি নীলেমের নোটিশ এসে গেল। এ-সব গা-জুয়ারি নয়? আপীল করতে বলো বাবা। আপীলে ও ঠিক খালাস হয়ে যাবে— আহা গো—
কিন্তু তা বোধহয় হবার নয়। নয়নরঞ্জিনী দাসী তা জানতেন না। তিনি তখন নিজের ভাবনাতেই অস্থির। তাঁর ভাবনা কে ভাবে, তারই ঠিক নেই। সে-সব দিনগুলোর কথা ভাবলে দীপঙ্করেরও কেমন সমস্ত গোলমাল হয়ে যেত। সমস্ত জীবন, সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত কলকাতা যেন জটিল হয়ে উঠেছিল সে-সময়ে। মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে দীপঙ্করও যেন জড়িয়ে গিয়েছিল এক জালে। সমস্ত কলকাতা সেদিন সে মামলার রায় মনোযোগ দিয়ে পড়েছিল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কলকাতার লোক আনন্দে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সেই খবর পড়ে। খবরের কাগজে বড় বড় হেডিং দিয়ে লেখা হয়েছিল—ঘুষ লওয়ার অপরাধে রেলওয়ে অফিসারের আট মাস কারাদন্ড।’
স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যালের রায়-এর কিছুটা অংশ তুলে দিয়েছিল খবরের কাগজে। তাতে লেখা ছিল—’এই মামলার আসামী। একজন গবর্নমেন্টের উচ্চপদস্থ গেজেটেড অফিসার। একজন গেজেটেড অফিসার হইয়া আসামী যে-অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছিলেন, তাহা নিখুঁতভাবেই প্রমাণিত হইয়াছে। আসামী শুধু যে যুদ্ধের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেন তাহাই নহে, তাহার নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের চোখে দৃষ্টান্তরূপে প্রতিভাত হইয়াছেন। সেই হিসাবে আসামী শুধু দেশের শত্রু নহেন, শুধু সমাজের শত্রু নহেন, সমগ্র মানব-সমাজের শত্রু। আসামীর ন্যায় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই এখন জাতির মাথা। তাঁহারা নিজেরা অসচ্চরিত্র হইলে নিম্নপদস্থ অধস্তন কর্মচারীদের দোষ দিয়া লাভ নাই। আসামী শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বলিয়া এজাহার দিয়াছেন। কিন্তু কার্যত তিনি অশিক্ষিত ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করিয়াছেন। অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি হইলে আসামীকে লঘু দন্ড দেওয়া যাইত। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে সে-যুক্তি সম্পূর্ণ অসমীচীন। শিক্ষিত ব্যক্তির অপরাধ অশিক্ষিত ব্যক্তির অপরাধের অপেক্ষা অনেক দোষণীয়। সম্পূর্ণ সুস্থ চিত্তে বহাল তবিয়তে আসামী যে অপরাধ করিয়াছেন তাহার ক্ষমা নাই। এই সমস্ত দিক ধীরভাবে বিচার করিয়া আমরা আসামীকে দীর্ঘ আট মাস কারাদন্ডে দন্ডিত করিলাম।
মনে আছে দীপঙ্কর যেদিন খবরটা প্রথম শুনেছিল সেদিন যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। খুশী হওয়ার প্রশ্ন নয়। অখুশী হওয়ারও প্রশ্ন নয়। বিশ্বাস করতে পারেনি অন্য কারণে। তবে কি সত্যিই দোষীর শাস্তি হয় সংসারে? পাপের পরাজয় কথাটা তো বই- এ লেখা থাকে। ও-কথা বইতেই শোভা পায়। ন্যায়-বিচার কথাটা কি ঘটে সত্যি সত্যি? ছোটবেলা থেকে এতদিন ধরে এত দেখে এত শিখেও যেন হঠাৎ কেমন অবাক লেগেছিল খবরটা। তাই প্রথমে নিজেকে নিয়ে সামলাতে পারেনি আর। তবে কি সতীও তার জীবনে সুখ পাবে? লক্ষ্মীদিকেও তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে? তাহলে কি সক্রেটিসের সেই কথাটাই সত্যি? তাহলে সেই আশুতোষ কলেজের অমলবাবু যা বলেছিলেন—সেসব সত্যি? এমনি করে এতদিন ধরে এত অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে এসে দীপঙ্কর সত্যের সন্ধান পেলে? এরই নাম কি জীবন দিয়ে সন্ধান করা?
আরো মনে আছে দীপঙ্কর সে-কদিন ছটফট করে বেড়িয়েছিল কেবল! আপিসে তার দুর্নাম, সতীর সেই অবস্থা, লক্ষ্মীদির সেই সর্বনাশ—সব কিছু নিয়ে দীপঙ্কর যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কোথায় সে যাবে? কার কাছে যাবে? কার কাছে গিয়ে সে মনের সব ভার নামাবে? কোথায় তার মা? কোথায় রইলেন প্রাণমথবাবু? কোথায় রইল সেই কিরণ?
এমনি অবস্থাতেই দীপঙ্কর আর কোনও জায়গায় আশ্রয় না-পেয়ে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে এসে হাজির হয়েছিল। তাই শম্ভু তার চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
আসলে এসেছির সনাতনবাবুর কাছে। কিন্তু শম্ভু একেবারে নিয়ে গিয়ে তুলেছিল নয়নরঞ্জিনীর কাছে।
—তোমার কি কোনও অসুখ করেছে নাকি বাবা? শরীর খারাপ?
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে-আমি উঠি মা-মণি!
—কিন্তু আমার টাকার কোনও ব্যবস্থা করতে পারলে? উকীল তো আমায় খেয়ে ফেললে বাবা। আমার গয়নাগাঁটি যা আছে তা বেচে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা হবে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে—কিন্তু বাকীটা?
দীপঙ্কর বললে—আমার প্রভিডেন্ট ফন্ডে চোদ্দ-পনেরো হাজার টাকা জমেছে, তার থেকে আমি সবই তুলে দিতে পারি। তাতে হবে আপনার?
—সে তো পঞ্চান্ন হাজার হলো। কিন্তু বাকীটা? বাকীটা কোত্থেকে পাই?
—আমার কাছে তো আর কিছু নেই। আমার হাতে কিছুই থাকে না। আপনার কোনও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নিতে পারবেন না?
—আত্মীয়-স্বজনের নাম কোর না। তারা তো এই খবর শোনার পর থেকে ধেই ধেই করে নাচছে—আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে তারা কালিঘাটের মন্দিরে গিয়ে মা-কালীর কাছে পুজো দেবে, জানো? এই হচ্ছে আত্মীয়-স্বজন।
দীপঙ্কর হঠাৎ বললে—আপনি ভাববেন না, আমি দেখি কী করতে পারি!
—করতে পারি না বাবা! তোমাকে করতেই হবে! তুমি বললেই বৌমা শুনবে! তোমার কথা বৌমা ফেলবে না—। তুমি একবার ভালো করে বউমাকে বুঝিয়ে বলো না!
দীপঙ্কর কী ভেবে বললে—তাহলে সনাতনবাবুকে আর একবার নিয়ে যাই—
—না বাবা, সোনাকে নিয়ে গিয়ে কোনও কাজ হবে না। সেদিন তো সোনাকে নিয়ে গিয়েছিলে, কাজ হলো? তবে আবার কেন মিছিমিছি নিয়ে যাবে? তুমিই কায়দা করে একবার বলো গিয়ে, নিশ্চয়ই কাজ হবে—
—আচ্ছা দেখি—বলে দীপঙ্কর সেদিন উঠে পড়ছিল।
মা-মণি আবার ডাকলেন। বললেন—তা হ্যাঁ বাবা, বউমার বোনের কাছে চাইলে হয় না? তার কাছেই না-হয় একবার চেয়ে দেখ না?
দীপঙ্কর মুখ ফেরাল। বললে—কিন্তু তার অবস্থা তো বললুম আপনাকে—
—কেন, কী-রকম অবস্থা?
—লক্ষ্মীদি বোধহয় পাগল হয়ে যাবে।
—পাগল হয়ে যাবে? কেন কী হয়েছে তার আবার? সেই কাকে যেন বিয়ে করেছিল
বাপের অমতে? আবার কী হলো তার? সে তো ব্যবসা-ট্যাবসা করে অনেক টাকা-কড়ি করেছে শুনিছি। আর আমি তো তার টাকা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না!
দীপঙ্কর বললে—পালিয়ে যাবার কথা হচ্ছে না, তার এখন মানসিক অবস্থা খুব খারাপ, তার ছেলেকে নিয়ে বড় মুশকিলে পড়েছে—
—কী মুকিলে পড়েছে ছেলেকে নিয়ে?
দীপঙ্কর বললে—তার ছেলে একজনকে খুন করেছে—
নয়নরঞ্জিনী আঁতকে উঠলেন, বললেন—ওমা কী সর্বনাশ! কাকে খুন করেছে গো?
দীপঙ্কর বললে—সে আপনি চিনবেন না—পরে সব জানতে পারবেন—
বলে দীপঙ্কর আর দাঁড়াল না সেখানে। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো।