কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৯
৭৯
সেদিনের ঘটনাটাও স্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে সেদিন ছিল আরো অন্ধকার। কোথায় যেন সমস্ত গরমিল হয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্কর সনাতনবাবুকে যেদিন এ-বাড়িতে এনেছিল সেইদনি থেকেই। সেদিন থেকেই যেন ছন্নছাড়া চেহারা হয়ে গিয়েছিল এ-সংসারের।
সনাতনবাবু বাইরের চেয়ারে চুপ করে বসেছিলেন। যেন কেমন অস্বস্তি লাগছিল তাঁর। দীপঙ্কর সনাতনবাবুর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিল। একবার ভেতরে যাচ্ছিল, আর একবার বাইরে আসছিল। সতী তখনও আসেনি।
দীপঙ্কর বললে—সতী তো এখনও এল না সনাতনবাবু?
হঠাৎ মনে হলো ভেতরের ঘর থেকে লক্ষ্মীদির কান্নার শব্দ কানে এল আবার। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেল ভেতরে। লক্ষ্মীদি বালিশে মাথা গুঁজে তখন ছটফট করছে। দীপঙ্কর মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করেছিল—কী হলো তোমার লক্ষ্মাদি!
লক্ষ্মীদি শুধু বলেছিল—আমি কী করবো দীপু?
–কেন, কী হয়েছে তোমার বলো না?
লক্ষ্মীদি বলেছিল—আমি কী নিয়ে বাঁচবো দীপু? আমি কার জন্যে বাঁচবো?
তবু কিছুই বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। জিজ্ঞেস করেছিল— দাতারবাবু কোথায়? দাতারবাবু এলেন না কেন?
লক্ষ্মীদি বলেছিল—আমার কেউ নেই দীপু, কেউ নেই—আমাকে ওরা ধরে রেখেছিল। আমি এখানে ছুটে পালিয়ে এসেছি।
—কেন? কেন পালিয়ে এসেছ তুমি?
লক্ষ্মীদি বলেছিল—আমি লুকিয়ে লুকিয়ে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম সতীকে, কিন্তু আসতে পারছিলুম না রে, আসতে গেলেই ওরা আমাকে ধরে রাখছিল—সারা রাস্তা আমি কাঁদতে কাঁদতে এসেছি—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল—কে ধরে রাখছিল? কারা? সুধাংশু? দাতারবাবু? তোমার ছেলে? মানস?
লক্ষ্মীদি ছটফট করছিল তখনও। মুখটা বালিশের ওপর তখনও গুঁজে রেখেছে। রঘু এসে একবার লক্ষ্মীদির দিকে চাইলে। দীপঙ্কর এবার নিচু হলো। মাথায় হাত দিলে। মাথাটা ধরে স্থির করে রাখবার চেষ্টা করলে।
লক্ষ্মীদি দীপঙ্করের হাতটা আঁকড়ে ধরলে জোরে।
বললে—দীপু….
আর কোনও কথা বেরোল না যেন লক্ষ্মীদির মুখ দিয়ে। লক্ষ্মীদি যেন আর কিছু বলবার শক্তিও হারিয়ে ফেললে।
দীপঙ্কর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়েছিল এবার।
বলেছিল—কোনও কষ্ট হচ্ছে তোমার, ডাক্তার ডাকবো?
লক্ষ্মীদি বললে—না রে দীপু, না—এখন ডাক্তারের হাতের বাইরে চলে গেছে একেবারে—
তারপর হঠাৎ মুখটা তুললো। একেবারে দীপঙ্করের মুখের কাছাকাছি। যেন মুখটা ঠেকে যাবে দীপঙ্করের মুখের সঙ্গে। দীপঙ্কর আরো জোরে চেপে ধরলে লক্ষ্মীদিকে। বললে—লক্ষ্মীদি, একটু শান্ত হও, একটু চুপ করো, বলো তোমার কী হয়েছে?
কিন্তু লক্ষ্মীদিকে চেপে ধরে রাখা যাবে, এমন শক্তি বোধহয় দীপঙ্করের ছিল না। দীপঙ্কর খাটের পাশে মাটিতে বসলো। বসে লক্ষ্মীদিকে ধরে রইল। বললে—এমন করলে তুমি পড়ে যাবে লক্ষ্মীদি—চুপ করো, ঠান্ডা হও—
লক্ষ্মীদি তেমনি ছটফট করতে-করতেই বলতে লাগলো—কিন্তু কেন আমার এমন সর্বনাশ হলো বল তো দীপু? তুই তো আমার সব জানিস। ছোটবেলা থেকে তুই তো আমা েদেখে আসছিস, আমি কার জন্যে টাকা চেয়েছি। আমি কার জন্যে বাড়ি কিনেছি। কার জন্যে গাড়ি চেয়েছি, আমি কার সুখের জন্যে এমন করে নিজের ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়েছি?
দীপঙ্কর কী বলবে বুঝতে পারলে না। মাথায় হাত বুলোতে লাগলো শুধু।
লক্ষ্মীদি তখনও বলে চলেছে—আমি আর জন্মে কত পাপ করেছিলুম দীপু, আমার পাপের আর শেষ নেই রে, তাই বুঝি ভগবান আমায় এমন করে শাস্তি দিলে—তাই বুঝি এমন করে আমার সব অহঙ্কার চূর্ণ করলে—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু, কী হয়েছে বলবে তো তুমি? না-বললে আমি কী করবো?
লক্ষ্মীদি তখন অসহায়ের মত আরো কাঁদতে লাগলো। বললে—তুই আমায় মেরে ফেল্ দীপু, আমার গলাটা জোরে টিপে ধরে মেরে ফেল—আমার আর বেঁচে দরকার নেই, আমার মরে যাওয়াই ভালো—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—দেখ লক্ষ্মীদি, শোন, সতী বাড়ি নেই, তোমার কী দরকার বলো, আমি তার ব্যবস্থা করছি—
—তোকে কিচ্ছু ব্যবস্থা করতে হবে না দীপু, তুই যা, তুই চলে যা, তোরা সবাই চলে যা, আর কাউকে আমার দরকার নেই, তোদেরও থেকে দরকার নেই, আমার বেঁচে থেকেও দরকার নেই—যা, তোরা চলে যা। আমি তোদের কী করেছি? কেন তোরা সবাই মিলে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস? আমি তোদের কী করেছি! কী ক্ষতিটা করেছি?
বলতে বলতে হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলো লক্ষ্মীদি। আর তারপর আবার বালিশে মুখ গুঁজে মাথা কুটতে লাগলো।
দীপঙ্কর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেছিল—তুমি থামো লক্ষ্মীদি, থামো, চুপ করো, রঘু কী ভাবছে বলো দিকিনি, বাইরে সনাতনবাবু বসে আছেন, তিনিই বা কী ভাবছেন বলো তো? এমন করলে সবাই কী মনে করবে, বুঝতে পারছো না—
লক্ষ্মীদি তেমনি মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো-তোর পায়ে পড়ি দীপু, তুই চলে যা এখান থেকে, সবাইকে চলে যেতে বল্, কারোর থাকবার দরকার নেই, কাউকে আমার পোড়া-মুখ আমি দেখাতেও চাই না, আমার মুখ পুড়ে গেছে রে, আমার পোড়ামুখ দেখিয়ে আমি কারো অকল্যাণ করতে চাই না—তুই যা, তোর পায়ে পড়ি দীপু, তুই যা—যা—যা—
বলে লক্ষ্মীদি হঠাৎ আবার অস্থির হয়ে উঠলো। দীপঙ্করকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলে। দীপঙ্কর এই অবস্থায় কী করবে বুঝতে পারলে না। ডাকলে—রঘু—
রঘু আসতেই দীপঙ্কর বললে-লক্ষ্মীদিকে একটু ধর তো—ওই পায়ের দিকটা একটু ধরে থাক্—নইলে পড়ে যাবে—
রঘু প্রথমে একটু দ্বিধা করতে লাগলো। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল আস্তে আস্তে।
.
আর ওদিকে বাড়ির সামনে তখন আর একটা নাটকের অভিনয় চলছিল। একটা ট্যাক্সি থামবার শব্দ হলো। সনাতনবাবু তখনও নির্বিকার হয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ কে যেন ঘরে ঢুকলো।
—তুমি?
সনাতনবাবু গলার আওয়াজে মুখ তুলে দেখলেন—সামনেই সতী দাঁড়িয়ে আছে।
—আবার এসেছ?
সনাতনবাবু যেমন চেয়েছিলেন, তেমনিই চেয়ে রইলেন, কোনও কথা বললেন না। – সেদিন অমন করে অপমান করার পরও আবার টাকা চাইতে এসেছো? তোমাদের লজ্জা করে না? যে-বউকে একদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছ তার কাছে টাকা চাইতে আসতে লজ্জা করে না তোমাদের? বলো, আবার এসেছ কেন আমার কাছে? বলো?
সনাতনবাবু বললেন—তুমি টিকই ধরেছ, সতী, টাকা চাইতে। আবার টাকা চাইতেই এসেছি—
—তবু যা-হোক তোমার মুখ দিয়ে সত্যি কথাটা বেরোল। কিন্তু জিজ্ঞেস করি, কোন্ মুখে এসেছো? আসতে লজ্জা করলো না তোমার?
সনাতনবাবু বললেন—কিন্তু তোমার সঙ্গে তো আমার সে-সম্পর্ক নয়, তুমি তা জানো।
সতীর মুখের চেহারাটা গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—এতদিন পরে আজ তুমি সম্পর্কের কথা তুললে!
সনাতনবাবু বললেন—সম্পর্কটা সত্যি বলেই সম্পর্কের কথা তুললাম।
—কিন্তু তাহলে কেন বলছো, টাকা চাইতে এসেছো? আমার সঙ্গে তোমার কোন্ সম্পর্কটা সত্যি? টাকার সম্পর্কটা না বিয়ের সম্পর্কটা?
সনাতনবাবু বললেন—দুটোই সত্যি সতী। তুমি আমার স্ত্রী, এটাও যেমন সত্যি, আমাদের টাকার দরকার সেটাও তেমনি সত্যি!
সতী প্রথমে কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না। তারপর বললে—কিন্তু টাকা তুমি পাবে না, এটা আমি বলেই রাখছি—
সনাতনবাবু বললেন—তাহলে টাকা থাক, তুমিই এসো–তোমাকেই চাই—
সতী অবাক হয়ে গেল সনাতনবাবুর কথা শুনে। ভালো করে চেয়ে দেখলে সনাতনবাবুর মুখের দিকে। কী যেন সন্দেহ হলো।
সনাতনবাবু আবার বললেন—এখনি উত্তর দেবার দরকার নেই, পরে ভেবে উত্তর দিও, কালকে উত্তর দিলেও চলবে, ছ’মাস পরে দিলেও ক্ষতি নেই, আমি হতাশ হবো না—
—কিন্তু তোমার মা? তিনিও কি আমার টাকা চান না, আমাকেই চান?
সনাতনবাবু বললেন—না—
—তিনি আমার টাকা চান?
সনাতনবাবু বললেন—হ্যাঁ—
সতী আবার আগেকার মত রুদ্রমূর্তি হয়ে উঠলো। বললে—তাহলে, এর পরেও আমাকে তোমার কাছে যেতে বলছো? এর পরেও তুমি আমার কাছে এসে সম্পর্কের কথা তুলে আমাকে ভোলাতে চাইছো? আমাকে এত অপমান করেও তোমাদের তৃপ্তি হয়নি? আরো অপমান করতে চাও?
সনাতনবাবু বললেন—এ-কথার উত্তর চাও তুমি?
সতী যেন জ্বলে উঠলো। বললে—না, তোমরা যা উত্তর দেবে তা আমি জানি, তোমাদের উত্তর শুনে-শুনে আমার কান ঝালা-পালা হয়ে গেছে, আমার আর কোনও উত্তর শোনবার ধৈর্য নেই, দয়া করে তুমি আর কখনও এসো না, আর কখনও আমাকে এ-বাড়িতে এসে জ্বালিও না—তোমাদের মুখও দেখতে চাই না আমি, তোমাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না—। যতদিন বেঁচে থাকবো মনে করবো আমার বিয়ে হয়নি, মনে করবো তোমার সঙ্গে কখনও আমার মালাবদল হয়নি, নয় তো মনে করবো তুমি নেই—
সতী অনেকগুলো কথা একসঙ্গে বলে হাঁফিয়ে পড়েছিল। একটু দম নেবার জন্যে বোধহয় খানিক থামলে। সনাতনবাবু কিন্তু তেমনি ধীর স্থির। কথাগুলো শুনে তাঁর কোনও বিকারের লক্ষণ দেখা গেল না।
সনাতনবাবু কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ বাধা পড়লো।
—দিদিমণি!
সতী পেছন ফিরে দেখলে রঘু।
রঘু বললে—বড়দিদিমণি এসেছেন,
—বড়দিদিমণি? দিল্লি থেকে? কখন এল?
বলে আর দাঁড়াল না। ভেতর দিকে চলে গেল দৌড়তে দৌড়তে। রঘুও চলে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর ভেতরে এল। বললে—আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, এদিকে বাড়িতে একটা ভীষণ বিপদ হয়ে গেছে সনাতনবাবু! তাই ব্যস্ত ছিলাম। সতীর সঙ্গে আপনার কথা হলো?
সনাতনবাবু হাসলেন। বললেন—হ্যাঁ হলো—
—কী বললে? আপনি সব কথা ভালো করে বুঝিয়ে বলেছেন তো?
সনাতনবাবু আবার বললেন—হ্যাঁ—
—রাজী হয়েছে টাকা দিতে?
সনাতনবাবু বললেন—না। —তা হলে? তা হলে কী হবে?
বলেই দীপঙ্কর বললে—আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আর একবার বলে ঠিক করবো, আপনি মা-মণিকে ভাবতে বারণ করবেন, যেমন করে পারি আমি টাকার ব্যবস্থা করবোই, তিনি যেন কিছু না ভাবেন, আপনাকে রঘু একটা গাড়ি ডেকে দিচ্ছে, আপনার রাত হয়ে যাচ্ছে। আপনি বাড়ি যান। এদিকে এমন বিপদ হয়েছে, আমি যেতে পারছি না আপনার সঙ্গে—
দীপঙ্কর তারপর সনাতনবাবুকে ট্যাক্সি ডেকে গাড়িতে তুলে দিলে।