কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮০
৮০
লক্ষ্মীদি আসার দিন থেকেই সব বদলে গিয়েছিল এ-বাড়ির। সে রাত্রে সনাতনব-বাবুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার পর দীপঙ্কর একটু বিব্রত হয়ে পড়েছিল।
আর সতীও এসে লক্ষ্মীদিকে নিয়ে পড়েছিল। সতীও ঝুঁকে পড়ে বলেছিল—কী হলো লক্ষ্মীদি! তোমার কী হলো বলো তো?
লক্ষ্মীদি তখনও তেমনি করেই কাঁদছিল শুধু। নিজের বোনকে দেখে দুই হাতে জড়িয়ে ধরেছিল। সতীকে জড়িয়ে ধরেই যেন সান্ত্বনা খুঁজতে চেয়েছিল লক্ষ্মীদি। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি, শুধু বলছিল—আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাই, আমার সব গেছে—
—সব গেছে মানে কী? কী গেছে তোমার? কেন একলা চলে এলে? দাতারবাবু কোথায়? তোমার ছেলে কোথায়?
লক্ষ্মীদি সে-সব কথার কোনও উত্তর দিত না। শুধু কাঁদতো। শেষকালে অনেক রাত্রে বোধহয় একটু কান্তি এল লক্ষ্মীদির। লক্ষ্মীদিকে রেখে সতী বাইরে এল। দীপঙ্কর চুপ করে তখনও বসে ছিল। সতীকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললে—কী হলো? কেমন আছে লক্ষ্মীদি?
সতী বললে—বুঝতে পারছি না, এখন যেন একটু চোখ ঢুলে আসছে-
দীপঙ্কর বললে—কী সর্বনাশ হয়েছে, বলেছে কিছু?
সতী বললে—না, কিছু বলছে না, শুধু কাঁদছে—
—সেদিন যে তোমাকে টেলিগ্রাম করেছিল, তাতে কী লেখা ছিল?
সতী বললে—কিছুই না, শুধু লিখেছিল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে, স্টার্টিং—আর কিছু নয়। কবে আসছে কখন আসছে, তাও জানতাম না—ক’দিন ধরে তাই বড় মন-খারাপ হয়ে গিয়েছিল—
তারপর দীপঙ্করও কী করবে বুঝতে পারেনি।
সতী বললে—তুমি আর বসে কী করবে। তুমি এখন যাও—
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু এই অবস্থায় লক্ষ্মীদিকে নিয়ে তুমি একলা সামলাতে পারবে? সতী বললে—আমি সামলাতে পারি আর না-পারি তুমি তো সারারাত্রি তা বলে এই রকম করে রাত জাগতে পারবে না? তুমিও তো সারাদিন আপিসে খেটেছ, তার ওপর আবার কালকেও তো তোমার আপিস—
দীপঙ্কর বললে-আমি না-হয় আপিসে কাল না-ই যাবো —
না, না, তা বলে আপিস কামাই করতে যাবে কেন মিছিমিছি? অনেক রাত হয়ে গেল তুমি এখন যাও। কাল সকালে যদি পারো তো একবার এসো।
পরের দিন আপিসে যাবার আগেও একবার এসেছিল দীপঙ্কর। সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া সেরেই এসে হাজির হয়েছিল। লক্ষ্মীদি তখন যেন একটু শান্ত হয়েছে। দীপঙ্কর কাছে গিয়ে খাটের ওপর বসলো।
বললে—এখন কেমন আছো লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি এতক্ষণ চুপ করেছিল। এবার দীপঙ্করের কথায় যেন আবার উলে উঠলো। বললে—দীপু, আমি কী করবো বলতে পারিস, আমি কার কাছে যাবো, কোথায় গেলে বাঁচবো?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করেছিল—দাতারবাবু জানে যে তুমি এখানে চলে এসেছ?
লক্ষ্মীদি বললে—কাউকে কিছু বলিনি, সোজা এখানে চলে এসেছি—
—খবর দেব দাতারবাবুকে? টেলিগ্রাম করে দেব আজকে?
লক্ষ্মীদি বলেছিল—না দীপু, তোর পায়ে পড়ি, কাউকে খবর দিনি, আমি কারোর মুখ দেখতে চাই না, আমার কেউ নেই, আমার কিছু নেই—
সতী এসে বললে—তুমি আপিসে চলে যাও, তোমার আপিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে—
তারপর বললে—আজকেই তুমি টেলিগ্রাফ করে দিও দীপু, আমার যেন কেমন ভালো মনে হচ্ছে না—
—সারা রাত কেমন ছিল লক্ষ্মীদি?
সতী বললে—কেবল ছট্ ফট্ করেছে, নিজেও ঘুমোয়নি, আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি—
আপিসে গিয়েই দীপঙ্কর সেদিন টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল। যে-ঠিকানা থেকে লক্ষ্মীদি চিঠি লিখতো, সেই ঠিকানাতেই। আর্জেন্ট।
অভয়ঙ্কর বললে—কী ব্যাপার সেন? কীসের টেলিগ্রাম? হোয়াই ডু ইউ লুক আপসেট্?
সমস্ত দিনই বড় রুক্ষ ছিল দীপঙ্করের মেজাজ। ফাইল নিয়েও যেন পুরোপুরি ম ন বসাতে পারলে না। কারোর সঙ্গেই ভালো করে কথা বলতে পারলে না। সবাই সেন- সাহেবের মেজাজ দেখে হতবাক হয়ে গেল। এমন ব্যবহার তো করে না কখনও সেন- সাহেব। কে-জি-দাশবাবু, রামলিঙ্গমবাবু ফাইল নিয়ে এসেছিল। পুলিনবাবু, হরিশবাবু, সুধীরবাবু সবাই এসে এসে ফিরে গেল।
হরিশবাবু জিজ্ঞেস করলে—কী রে মধু, সেন-সাহেবের কী হয়েছে? এমন গোড়া মুখ কেন?
মধু বললে—সাহেবের আজকে শরীর ভাল নয় হুজুর—
কয়েকদিন ধরেই আপিসে কানাঘুষো চলছিল। কয়েকদিন ধরেই সেকশনে- সেকশনে গুজ্-গুজ্ ফিস্-ফিস্ হচ্ছিল। ঘোষাল-সাহেবের আট মাস জেল হবার পর থেকেই সমস্ত আপিসময় যেন একটা থমথমে ভাব। বাইরের লোক, কোনও বাইরের মার্চেন্ট এলেই সবাই যেন বাঁকা চোখে দেখতো চেয়ে চেয়ে? সবাই যেন সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। আপিসের ফাইল নিয়ে কাজ করতে করতে এদিকে-ওদিকে চেয়ে নিত। কে কোন্ ঘরে ঢুকছে, কে কার সঙ্গে চুপি-চুপি কথা বলছে, তা লক্ষ্য রাখতে। ঘোষাল- সাহেব যেন সকলের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। তবে তো পাপীর সাজা হয় মশাই। তবে যে বলে এটা কলিযুগ। কলিযুগে নাকি পাপের পরাজয় হয় না?
কে-জি-দাশবাবু বললেন— ঘোষাল সাহেব তো তুচ্ছ মশাই, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টই এখন টলোমলো, দেখছেন না?
একজন বললে—পাপ আর পারা কখনও চাপা থাকে না জানবেন, একদিন ফুটে বেরোবেই—
হঠাৎ সকলেই যেন কেমন বাকরোধ হয়ে গেছে ব্যাপার দেখে। তবে এত যে ব্ল্যাক- মার্কেটিং চলেছে, এত যে চুরি, বাটপাড়ি চলছে, সকলেরই তাহলে শাস্তি হবে একদিন? সবাই তাহলে একদিন ঘোষাল সাহেবের মত জেল খাটবে? এতদিন যারা ধর্ম নেই বিচার নেই বলে গলাবাজি করছিল, তারাও মুখ বুজিয়ে ফেলেছে। তাদের আর কিছু বলবার মুখ নেই। কই, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তো তেমন খারাপ লোক নয় মশাই। সেই তো জেল হলো! সেই তো শাস্তি হলো আসামীর! যে মানুষের এত তম্বি ছিল, যে-মানুষটা এতদিন সকলকে গেট-আউট্ বলে গালাগালি দিয়ে এসেছে, তার তো উচিত শাস্তিই হলো! আট মাস জেল! সোজা কথা! কোথায় পাবে চুরোট, কোথায় পাবে ডিঙ্কস্, কোথায় পাবে মেয়েমানুষ? সবাই যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল খবরের কাগজ পড়ে। সেদিন টানাটানি পড়ে গিয়েছিল খবরের কাগজখানা নিয়ে। সেদিন অ্যাংলো- আমেরিকার অতবড় ডেসার্ট-ভিক্টরিও যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিল ঘোষাল-সাহেবের জেলে-যাওয়ার খবরের কাছে। ওয়েন্ডেল্ উইল্কি সেই সময় রাশিয়ায় গিয়েছিলেন সেখানকার অবস্থা দেখতে। সেদিন সে-খবরও বেরিয়েছিল—”Clothing nearly gone. Children work in many of the shops the full 66 – hour week worked by adults. the only food that can be bought in the markets was black bread and potatoes at exhorbitant prices.”
জার্মান সিক্স্থ আর্মি স্ট্যালিনগ্রাড থেকে হটে এসেছে। স্ট্যালিন শেষ হুকুম দিয়েছে Die, but do not retreat. ফজলুল হক্ মিনিস্ট্র চলে গিয়ে নাজিমুদ্দিনের মিনিস্ট্রি হয়েছে। কত খবর কত দিকে। খবরের কাগজ পড়ে শেষ করা যায় না। ছ’পয়সার আনন্দবাজার পত্রিকা কিনলে খবর পড়ে পেটে টইটুম্বুর হয়ে ভরে যায়। কিন্তু সেদিন আপিসের লোকের কাছে অন্য সমস্ত খবর যেন জোলো হয়ে গেল। সবাই খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে পুরে আপিসে নিয়ে এসেছে। চুপি চুপি পড়ো। কেউ যেন হেসো না। কেউ যেন টিকিরি দিও না। ঠাট্টা কোর না। হোক ঘোষাল-সাহেবের জেল, তবু সে তোমাদের ডি-টি-এস। এক্স-ডি-টি-এস। তার বিরুদ্ধে কোনও রিমার্ক করা চলবে না। বি কেয়ারফুল।
এক-একজন খবরটা পড়তে পড়তে আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে পড়লো। এক-একজন তেত্রিশ টাকার ক্লার্ক একলাই এক প্যাকেট সিগ্রেট টেনে শেষ করে ফেললে। সেদিন ক্যান্টিনে দু’মণ রসগোল্লা এক ঘন্টার মধ্যে কাবার হয়ে গেল। শুধু রসগোল্লা নয় সিঙ্গাড়া, পান্তুয়া, চপ্, কাটলেট, ডিম, এমনকি দরবেশ পর্যন্ত লোপাট্। ক্যান্টিন একেবারে ধোয়া-মোছা। কিছু নেই একেবারে সাফ্-সুট। দলে-দলে খদ্দের – বাবুরা এসে খালি পেটে ফিরে গেল। মিষ্টির থালা তখন নিঃশেষ। শুধু মাছি। মাছিরাই তখন রাজত্ব চালাচ্ছে ক্যান্টিনে। এমন ঘটনা রেল-আপিসের ক্যান্টিনে কখনও ঘটেনি। এমন ঘটনা রেলের আপিসের ক্যান্টিনে কেউ দেখেও নি!
যারা জানতো না, যারা খবরের কাগজ পড়তো না, তারাও জেনে গেল। সাউথ্ কেবিন জানিয়ে দিলে নর্থ কেবিনকে। কন্ট্রোল-আপিস জানিয়ে দিলে ডিস্ট্রিক্টকে। ডিস্ট্রিক্ট জানিয়ে দিলে গার্ড, ফায়ারম্যান, ড্রাইভারদের। তারপর সেখান থেকে জেনে গেল কুলী, গ্যাম্যান, খালাসী সকলে। কারোর আর জানতে বাকি রইল না। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা হাতে-পাকানো সিগ্রেট দাঁতে কামড়ে বললে—ব্লাডি বাস্টার্ড—
ক্লার্করা কলম পিষতে পিষতে চুপি চুপি বললে-বেশ জব্দ হয়েছে শালা–
কুলী-জমাদাররা বললে—ঠিক হুয়া বেইমান —
স্টেশন-মাস্টাররা টরে-টক্কা করতে করতে বললে—ভগবান বলে একজন আছেন মশাই—
ট্রাফিক-আপিসের কর্মচারীরা সেদিন চাঁদা তুলে সবাই মিলে ট্রাম-ভাড়া খরচ করে কালিঘাটের মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে এল। মা’র সামনে হাতজোড় করে প্রণাম করে বললে—মা, তুমি আমাদের মুখ রেখেছ মা—