কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮১
৮১
কিন্তু সংসারী মানুষ যেমন অল্পতে ভয় পায়, তেমনি বোধহয় বড় অল্পতে খুশীও হয়। মানুষের ঈশ্বর তার খুশী-অখুশীর ধার ধারুক আর না-ই ধারুক, তাতে তার ভয় পাওয়ার যেমন আটকায় না, তেমনি তার খুশী হওয়াও আটকায় না। ফরাসী বিপ্লবের পর লুই- দি-সিক্সটিকেও এমনি করেই গালাগালি দিয়েছিল ফরাসীরা, রাশিয়ার বিপ্লবের পর নিকোলাস দি সেকেণ্ডকেও এমনি করেই গালাগালি দিয়েছিল রাশিয়ানরা। এমনি করেই চার্চে গিয়ে পূজো দিয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু ইতিহাস জানে মানুষের ঈশ্বর তাদের সে- পূজো গ্রহণ করেছে কি করেনি। ইতিহাসই কেবল সাক্ষী আছে সে বিবর্তনের। ইতিহাস বলতে পারে কখন কার পূজো ঈশ্বর গ্রহণ করবে আর কার করবে না।
মিস্টার ঘোষালকে জেলে পাঠিয়ে সেদিনকার কলকাতার মানুষ যদি খুশীই হয়ে থাকে তো সে-সুখ বড় ক্ষণিক। বড় সাময়িক। মাত্র আটমাসের সুখ। আট তিরিশ দু’শো চল্লিশ দিনের সুখ। পাঁচ হাজার সাত শো ষাট ঘন্টার সুখ। কিন্তু দীপঙ্করের একত্রিশ-বছর জীবনের পটভূমিকায় সে-সুখ আর কতটুকু? কিন্তু সে-ঘটনা আরো পরের।
সেদিনও দীপঙ্কর একমনে ফাইল দেখছিল। হঠাৎ মধু এসে একটা শ্লিপ্ নিয়ে এল। দীপঙ্কর বললে—ভেতরে পাঠিয়ে দে—
আর একজন মার্চেন্ট। দীপঙ্কর ভেবেছিল যেমন আর পাঁচজন মার্চেন্ট আসে তেমনি। ভালো করে নামটা পড়েও দেখেনি। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই দীপঙ্কর দেখলে হোসেনভাই কাশেমভাই-এর পার্টনার—মিস্টার হোসেনভাই।
—আবার কী মিস্টার হোসেনভাই? এ-মাসের অ্যালটমেন্ট্ তো নিয়ে গেলেন সেদিন?
—না, ওয়াগন নয় সাহাব। এসেছি অন্য কাজে।
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না। বললে—কী কাজ?
হোসেনভাই পকেট থেকে একটা চেক-বই বার করলে।—আপনি সেদিন কিছু টাকা চেয়েছিলেন?
টাকা! দীপঙ্কর ভালো করে চেয়ে দেখলে সোজাসুজি!
হোসেনভাই বললে—আপনি বলেছিলেন আপনার টাকার দরকার, আমি সেই টাকা এনেছি—
দীপঙ্করের সমস্ত শিরা-উপশিরায় যেন হঠাৎ রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। নিজের শরীরটা যেন নিজেরই বশে রইল না আর। একেবারে একদৃষ্টে চেয়ে রইল হোসেনভাই- এর দিকে। মুখ দিয়ে কথা বেরোতে গিয়েও যেন আটকে গেল।
হোসেনভাই ততক্ষণে চেক্-বই বার করে ফেলেছে। ফেলে একেবারে লিখতে শুরু করেছে। তারপর লিখতে গিয়ে বললে—কত টাকা দরকার আপনার? এক লাখ?
দীপঙ্কর যেন বোবা হয়ে গেছে। তার সমস্ত শরীরে জামার ভেতরে সে ঘামতে আরম্ভ করেছে। দর-দর করে ঘাম ঝরছে। মুখ দিয়ে একটাও উত্তর বেরোল না তার। হাজার চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলে না। হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সতীর মুখখানা। সতী আবার সুখী হবে। সনাতনবাবু আবার স্ত্রী পাবে। নয়নরঞ্জিনী দাসী আবার তার বাড়ি খালাস করতে পারবে।
—আমি তিনটে বেয়ারার চেক্ লিখে দিচ্ছি—তিনটে ব্যাঙ্কের।
—আর ইন্টারেস্ট্?
হোসেনভাই হাসতে লাগলো। বললে—ইন্টারেস্ট কিছু লাগবে না সেন-সাহেব, ইন্টারেস্ট আপনার কাছ থেকে নেব না আমি আপনি অনেক ওয়াগন দিয়েছেন
আমাদের—
দীপঙ্কর আপত্তি করলে—সে কি? ইন্টারেস্ট ছাড়া আপনার কাছ থেকে টাকা নেব কেন আমি, আমি মিছিমিছি আপনার কাছ থেকে এত টাকা……
কিন্তু হোসেনভাই অনেক সাহেব দেখেছে জীবনে। শুধু এই রেল নয়। অনেক রেলের হেড়-আপিসে তাকে যেতে হয়। অনেক সাহেবদের চরিয়ে আসছে আজ অনেক দিন ধরে। অমায়িক হাসতে হাসতে সেলাম জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিস্টার হোসেনভাই। তখনও যেন দীপঙ্কর নিজেকে নিয়ে সামলে উঠতে পারেনি। তখনও যেন সে স্থাণুর মত চুপ করে বসে আছে।
অনেকক্ষণ পরে যেন খেয়াল হলো। তাড়াতাড়ি ডাকলে—মধু!
ঘড়িতে তখন একটা বেজেছে। আর সময় নেই। মধুকে বললে—আমি আজ এখুনি বেরোচ্ছি—কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি চলে গেছি—
থাক্ রেলওয়ের কাজ। থাক সব কিছু ফাইল। পৃথিবী রসাতলে যাক। কারোর কিছু দরকার নেই। দীপঙ্কর যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো এক মুহূর্তে। কে-জি-দাশবাবু ফাইল নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আসছিল। এসে সুইং-ডোরটা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে। মধু বললে—সাহেব নেই হুজুর—
—কে কী রে? সাহেব কোথায় গেল?
—বাইরে—
—কখন আসবে?
মধু বললে—তা বলে যায়নি আমাকে—
দীপঙ্কর তখন আর দাঁড়ায়নি কোথাও। সোজা ব্যাঙ্ক থেকে চেক্ ভাঙিয়ে নিয়ে একেবারে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে গিয়ে হাজির। দুপুর বেলা। এমন সময়ে কখনও আসেনি দীপঙ্কর এ-বাড়িতে। দু’একটা পায়রা কার্নিশের ধারে বকম্ করছে। যেন ভূতের বাড়ি মনে হলো দীপঙ্করের কাছে। যেন ঝিমিয়ে পড়েছে সমস্ত বাড়িখানা। ভেতরে ঢুকে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কোন দিকে যাবে ঠিক করতে না পেরে ওপরে উঠতে লাগলো। একেবারে তেতলায়। জুতোর আওয়াজেই বোধহয় নয়নরঞ্জিনী কান খাড়া করেছিলেন। বললেন—কে?
দীপঙ্কর কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। বললে—আমি, আমি আপনার সেই টাকাটা পেয়েছি—
টাকা! নয়নরঞ্জিনী সোজা হয়ে বসলেন। দীপঙ্কর তখন এ-পকেট ও-পকেট থেকে টাকাগুলো বার করছে। হাজার টাকার নোট সব। ব্যাঙ্ক থেকে পিন-আপ করা তাড়া তাড়া নোট। নোটের বান্ডিল। বান্ডিল বান্ডিল নোটের গাড়া বিছানার ওপর রাখলে দীপঙ্কর। এত নোট দীপঙ্করও একসঙ্গে কখনও দেখেনি। হয়ত নয়নরঞ্জিনী দাসী এককালে দেখেছেন। কিন্তু তখন সে-সব কথা ভুলে গেছেন। সে-সব শ্বশুরের আমলের কথা। তখন এমনি নোটের বান্ডিল এসে এ-বাড়ির সিন্দুকে জমা হতো। সে-সিন্দুকের চাবি থাকতো তাঁরই কাছে।
দীপঙ্কর বললে—আপনাকে আর গুনতে হবে না, আমি ব্যাঙ্ক থেকে গুনেই এনেছি—
নয়নরঞ্জিনী দাসীর তখন মনের কী অবস্থা তা তিনিই বলতে পারেন। বললেন—তা হ্যাঁ বাবা, বৌমা শেষ পর্যন্ত রাজী হলো দিতে?
দীপঙ্কর সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে—এতেই হবে তো আপনার? এতেই আপনার বাড়ি খালাস হয়ে যাবে তো?
নয়নরঞ্জিনী নোটের তাড়াগুলোর গায়ে তখন হাত বুলোচ্ছেন। বললেন—খুব হবে বাবা, খুব হবে! উকীলবাবু তো বলেছিল এক লাখ টাকা জমা দিলেই হবে আপাততঃ, তারপরে মামলায় যা হয় হবে। এখন রাস্তায় দাঁড়ানোটা তো বন্ধ হলো।
তারপরেই হঠাৎ বললেন—ওমা, তুমি উঠছো নাকি?
দীপঙ্কর বললে—আমি উঠি এবার, আমার কাজ আছে—
ব্যাঙ্ক থেকে অনেক ভিড় ঠেলে বেরোতেই আড়াইটে বেজে গিয়েছিল। তারপর এই ভবানীপুর এসেছে। অনেক বেলা হয়ে গেয়ে। তারপরে এখান থেকে আর আপিসে গিয়ে কোন লাভ নেই। তারপর যেতে হবে লক্ষ্মীদির বাড়িতে। লক্ষ্মীদি ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না। কিছু কথা বলছে না। শুধু কাঁদে, আর অনেক সময় আবার চুপ করেও থাকে। এখন গিয়ে লক্ষ্মীদিকেও দেখে আসতে হবে।
—তা একটু মিষ্টিমুখ করে গেলে না? এই দুপুর রদ্দুরে তেতে-পুড়ে এলে?
নয়নরঞ্জিনী দাসীর মুখে এ-কথা শুনে দীপঙ্করের অবাক হওয়ারই কথা। কিন্তু তখন আর সে-দিকে মন দেবার সময় ছিল না দীপঙ্করের। দীপঙ্কর তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে এসে রাস্তায় পড়লো।