কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮২
৮২
সে উনিশ-শো তেতাল্লিশের কলকাতা। কোথায় কত দূরে যুদ্ধ হচ্ছে ঠিক নেই, কিন্তু এখানে এই ইন্ডিয়ায় তখন তার ছোঁয়াচ লেগেছে বড় স্পষ্ট হয়ে। চাল-চিনির জন্যে সকাল থেকে লাইন দিতে হয়। কেরোসিনের জন্যে ধর্না দিতে হয় দোকানে-দোকানে। পাঁচ সের কয়লা পেতে গেলে খোসামোদ করতে হয় দোকানদারকে। কাশী কত দিন ফিরে এসেছে খালি হাতে। হাতে পয়সা নিয়েও কোনও কাজ হয়নি।
এ-সব খবর দীপঙ্কর রাখতো বৈকি। সবই জানতো সে। কিন্তু কোথায় এর প্রতিকার বুঝতে পারতো না। জীবনের কত সমস্যার প্রতিকার করবে সে? নয়নরঞ্জিনী দাসী সব টাকা জমা দিয়ে এসেছেন কোর্টে গিয়ে। এবার মামলা চলছে বাদীর সঙ্গে। দিনের পর দিন মামলা চলছে। যত দিন পড়ছে তত টাকা নিচ্ছে উকীল। কত দিনে কত বছরে যে সে মামলার ফয়শালা হবে কে জানে? তারপর আছে কিরণ। কিরণের কোনও খবরই পায় নি কতদিন। কতদিন কত জায়গায় গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছে। কেউ বলতে পারে না। প্রাণমথবাবুও কোথায় কোন্ জেলে আছে তাও জানার উপায় নেই। প্রত্যেকদিন গড়িয়াহাটের বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসে। লক্ষ্মীদি যেন দিনের পর দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। কিছু আর খায় না তখন।
কিন্তু সেদিন বড় অবস্থা খারাপ হয়ে গেল লক্ষ্মীদির। সন্ধ্যে থেকে কারো আর ফুরসৎ নেই। লক্ষ্মীদি যেন আর স্থির থাকতে পারছে না। সতী বললে—দাতারবাবুর কোনও খবর এল?
দীপঙ্কর বললে— বোধহয় ঠিকানা বদলেছেন তাঁরা—
—কিন্তু লক্ষ্মীদি এখানে আছে কিনা সে খবরটাও তো তারা একবার নেবে? কী রকম মানুষ তারা?
দীপঙ্কর বললে—এখানে চলে এসেছে তা-ই বা তারা কী করে জানবে?
—জানুক আর না-জানুক, তোমাকেও তো একবার একটা চিঠি লিখতে পারতো!
কে জানে! এত লোক থাকতে দীপঙ্করকে লিখবে কী করতে! দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির কে? কিন্তু সতী তো রয়েছে! এ-বাড়িতে সতী রয়েছে, এটা তো জানে দাতারবাবু! সতীর কাছেও তো একটা চিঠি লিখতে পারতো যে লক্ষ্মীদি কলকাতায় এসেছে কি না!
দীপঙ্কর আরো কয়েকটা টেলিগ্রাম করেছিল। তারও কোনও উত্তর আসেনি। প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত ও-বাড়িতে কাটিয়ে শেষকালে চলে আসতো দীপঙ্কর। পা যেন আর চলতে চাইতো না। মনে হতো ওখানে থাকলেই যেন ভালো হতো। ডাক্তার এসে লক্ষ্মীদিকে দেখে যেত। কিন্তু কিছুই ধরতে পারতো না তারা।
সেদিন ডাক্তারবাবুকে দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কি করবো বলতে পারেন?
ডাক্তারবাবু নতুন দেখতে এসেছিলেন। বললেন—এরকম পেসেন্ট আগে আমি কখনও দেখৌন, তবে খুব নার্ভাস শক্ পেয়েছেন মনে হচ্ছে—খুব সাবধানে থাকা দরকার, পাগল হয়ে যেতে পারে—
—কিন্তু একটা কিছু ওষুধ দিন, যাতে অন্তত ঘুমোতে পারে পেসেন্ট—
ডাক্তারবাবুর ঘুমের ওষুধেই যেন শেষকালে একটু ঝিমিয়ে পড়লো লক্ষ্মীদি। দীপঙ্কর বাইরের চেয়ারে তখনও চুপ করে বসেছিল। সতী বাইরে আসতেই হঠাৎ দেখে ফেললে। বললে—একী এখনও যাওনি তুমি?
দীপঙ্কর বললে—এই অবস্থায় তোমাকে একলা ফেলে যাই কী করে?
সতী বললে—কিন্তু কাল তো আপিস আছে তোমার। রাত্রে ঘুমোবে না?
দীপঙ্কর বললে—একটা রাত না ঘুমোলে আর কী হয়?
—কিন্তু এখানেই এমনি করে বসে থাকবে তা বলে!
—বসে থাকবো না তো কী করবো?
সতী বললে-না-না, পাগলামি করো না, বাড়ি যাও—যাও, যাও, আমাদের জন্যে কি তুমিও বাড়িঘর ত্যাগ করবে নাকি?
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু হঠাৎ যদি কোনও দরকার হয়, তখন?
—তুমি যদি না-থাকতে, তোমার সঙ্গে যদি পরিচয়ই না হতো তাহলেই বা কী করতুম? যাদের দীপঙ্কর নেই, তাদের কি চলছে না? তারা কি বেঁচে নেই? সব মরে গেছে?
দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে সোজাসুজি চেয়ে দেখলে। এতদিন সতীর জন্যে এত করেছে। এতদিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিজের সমস্ত কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সতীর সুখের কথা ভাবার পর সতীর মুখ থেকেই এই কথা শুনতে হচ্ছে! সতীর হয়ে যে-টাকা নয়নরঞ্জনী দাসীকে দীপঙ্কর দিয়েছে, সে-টাকা সারা জীবন ধরেই হয়ত শোধ করতে হবে তাকে। মাইনেটা হাতে পেয়ে আগে দিয়ে আসতে হবে মিস্টার হোসেনভাইকে। তারপর তার মুখের দিকেই চেয়ে আছে তিনটি প্রাণী। তাদের কথাও এতদিন দীপঙ্কর একমুহূর্তের জন্যে ভাবেনি। আর তারই প্রতিদান হিসেবে সতী এই কথা বললে তাকে। দীপঙ্কর যেন বিশ্বাস করতে পারলে না নিজের কানকেও।
দীপঙ্কর সতীর মুখের দিকে চেয়ে বললে—তুমি আমাকে চলেই যেতে বলছো সত্যি-সত্যি?
—হ্যাঁ যাও, লক্ষ্মীদির যা হবার হবে, আমারও একদিন যা হবার হবে, তা বলে তুমি তাই ভেবে-ভেবে নিজের শরীর খারাপ করবে নাকি! আমার কপালে যদি শ্বশুর-বাড়ির সুখ না-থাকে, লক্ষ্মীদির কপালে যদি কষ্ট থাকে তাহলে তুমি কী করবে? তুমি তো সব রকম চেষ্টা করে দেখলে?
দীপঙ্কর তখনও চুপ করে রইল। সতী বলতে লাগলো—একদিন ছোটবেলায় দুই বোনে এসেছিলাম কলকাতায়। তখন অনেক সাধ ছিল অনেক স্বপ্ন ছিল। তারপর কত কী ঘটলো, কত জিনিস ওলোটপালোট হয়ে গেল। আমার বিয়ে হলো, আমি আবার ছিটকে কোথায় চলে এলুম, লক্ষ্মীদি কত কান্ড করে কোথায় চলে গিয়েছিল, সে-ও ফিরে এল—সব দেখে-শুনে ভেবে-চিন্তে দেখেছি—কিন্তু এখন থেকে ঠিক করেছি আর ভাবব না, মানুষ ভেবে-চিন্তে সব কিছু ঠিক করলেও, একজন বুঝি আড়াল থেকে সব কিছু উল্টে দেয়—
দীপঙ্কর সতীর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। সতী এত কথাও ভাবে তাহলে?
—ভেবেছিলাম স্বামী শাশুড়ীর ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে পৃথিবীতে যত কিছু অন্যায় আছে সব করে দেখবো, যা প্রাণে চায় সব করবো, কারোর কথা মানবো না। সবই তো করলুম। তুমি কত বারণ করেছিলে, তবু আমি তা শুনিনি। কিন্তু লক্ষ্মীদিকে দেখে আজ আমার আর কোনও ক্ষোভ নেই। আমার কোনও দুঃখ নেই। দু’জনে দু’পথে গিয়েছিলুম, দু’জনেরই এক পরিণতি হয়েছে—! এর পরও তুমি আমাদের ভালো চাইছো? আমাদের ভালো করবার ক্ষমতা তোমার আছে?
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু সনাতনবাবু কেন হতাশ হতে বারণ করেন তাহলে?
সতী বললে—ওঁর কথা ছেড়ে দাও, মানুষের জীবনটা তো পুঁথি নয়, মানুষের জীবন ওঁর পুঁথির নিয়ম-কানুন মেনে তো চলে না! তুমি এখন যাও, তুমি এখানে এলেও যা হবে এখানে না এলেও তাই হবে। তুমি না এলেও আমাদের দুই বোনের কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না—
দীপঙ্কর তবু যেন কথাটার মানে বুঝতে পারলে না। বললে—সত্যিই কোনও ক্ষতি- বৃদ্ধি হবে না তোমাদের?
—কীসের ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে? আসলে যারা আপনার লোক তারা চলে যাবার পরও যখন কোনও ক্ষতি হলো না, তখণ তুমি মনে করছো তুমি চলে গেলে আমাদের মস্ত ক্ষতি হবে? তুমি তো পর ছাড়া কিছু নও!
তারপর সতী দীপঙ্করের দুটো হাত ধরলে। বললে-বললে তুমি কষ্ট পাবে। কিন্তু তোমার ভালোর জন্যেই বলছি, আমাদের সঙ্গে তুমি আর কোনও সম্পর্ক রেখো না। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তোমার কপালেও আমাদের মতন দুর্দশা আছে। যাও—
.
বলতে গেলে দীপঙ্করকে একরকম জোর করেই সতী রাস্তায় বার করে দিলে। কিন্তু সম্পর্ক রাখবো না বললেই কি সম্পর্ক মুছে ফেলা যায়? সম্পর্কটা কি শুধু বাইরের জিনিস? জামা-কাজড়ের মত একেবারে তুচ্ছ সামগ্ৰী? ফেলে দিতে চাইলেই কি ফেলা যায়?
রাস্তায় বেরিয়েই সেদিন দীপঙ্কর ঠিক করেছিল আর সে আসবে না। অন্ততঃ এত ঘন-ঘন, এত সকাল-বিকেল আর আসবে না। কেন সে আসতে যাবে এখানে? কীসের দায়? লক্ষ্মীদির নিজের টাকা আছে, সতীরও নিজের টাকা আছে। টাকার যখন ভাবনা নেই, তখন যেমন করে হোক দু’জনের চলে যাবেই। নয়নরঞ্জিনী দাসী টাকা পেয়ে গেছেন। এর পর তাঁকে আর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে না। মাঝখান থেকে দীপঙ্কর কেন জঞ্জাল হয়ে সকলের মাঝে বাধার সৃষ্টি করবে?
সেদিন ক্রফোর্ড সাহেব ডেকে পাঠালেন। বললেন—বোস সেন, টেক ইওর সীট—
দীপঙ্কর বসলো। সাহেব বললে–সেন, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই; তুমি ভুল বুঝো না—
দীপঙ্কর বললে—বলুন —
সাহেব বললে—রেলওয়েতে আমার চাকরি হয়ে গেল আজ তিরিশ বছর, আমি অনেক রকম লোক দেখলাম, অনেক ইন্ডিয়ান দেখলাম, আই য়্যাম্ এ ম্যান্ অব্ ফিউ ওয়ার্ডস্—কিন্তু আমি তোমাকেও দেখলাম!
সাহেব কী কথা বলতে চায় বুঝতে পারলে না দীপঙ্কর।
—নাউ, আমি জানি না কার এ কাজ, কোত্থেকে দিল্লি বোর্ড এ খবর পেলে, কিন্তু আমাকে তুমি সত্যিই বলো তো, তোমার কি টাকার দরকার খুব?
দীপঙ্কর হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। টাকার দরকার ছিল বটে একদিন। কিন্তু সে দরকার তো তার মিটে গেছে!
জিজ্ঞেস করলে—এ-কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন স্যার?
সাহেব বললে—না, দিল্লি থেকে একটা কফিডেনশিয়াল চিঠি এসেছে জেনারেল ম্যানেজারের নামে, তোমাকে ট্রানস্ফার করে দিতে বলেছে এখান থেকে। ডিস্ট্রিক্টে—
—ট্রানসফার?
সাহেব বললে—ইয়েস, ট্র্যানসফার!
—কিন্তু কেন স্যার? আমি কী দোষ করেছি?
সাহেব বললে—জানি না। সে লেটার আমি দেখিনি। কিন্তু ঘোষালের কেএর পরে আর ও-পোস্টে কোনও জুনিয়ার লোককে রাখা যায় না। বোর্ড থেকে মিস্টার ভার্মা ওখানে আসবে। ইউ আর ভেরি জুনিয়ার—
দীপাঙ্কর হতবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলে না। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে—আমার এগেস্টে কোনও কমপ্লেন্ আছে?
—আমি যতদূর জানি নেই। তবে সন্দেহ আছে। য়্যাস্পারশন্ আছে। তোমারও নাকি অনেক অভাব। তোমারও নাকি অনেক টাকার দরকার হয় মাঝে-মাঝে। তা কোথায় তুমি যেতে চাও? শিলিগুড়ি যাবে? শিলিগুড়িতে একটা ভেকেন্সি আছে—
দীপঙ্কর পাথরের মত চুপ করে রইল। সমস্ত অন্তরাত্মা তার যেন বিদ্রোহ করতে চাইলো। কিন্তু তখনি নিজেকে শান্ত করে নিলে সে। আশ্চর্য! একদিন তো চাকরি ছেড়ে দিতেই চেয়েছিল সে। একদিন তো চাকরি থেকে ঘৃণায় দূরে চলে যেতেই চেয়েছিল সে। তাহলে কেন সে উত্তেজিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। হঠাৎ মনের সামনে প্রাণমথবাবুর মুখটা ভেবে উঠলো তার। চোখের সামনে অমলবাবুর মুখটা ভেসে উঠলো। কিরণের মুখটাও ভেসে উঠলো। মা’র মুখটা ভেবে উঠলো। কত কষ্টে নৃপেনবাবুকে ধরে মা তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিল তাকে। তারপর ধাপে-ধাপে কত বড় হয়েছে। কত মাইনে বেড়েছে তার। দশজনের চোখে কত সম্মান সে পায় এই চাকরিটার জন্যে। আর তা ছাড়া কার জন্যেই বা এই চাকরি করবে সে? সতী, লক্ষ্মীদি, নয়ন- রঞ্জিনী, গাঙ্গুলীবাবু, সবাই চলে গেছে। কিরণও হয় দু’দিন পরে পৃথিবী থেকে চলে যাবে। একটি মাত্র বন্ধন—তার ধার। মিস্টার হোসেনভাই-এর কাছে ধার। কোনও সই নেই, কোনও রসিদ নেই, কোনও ভাউচার নেই। তবু ধার তো ধারই। সে ধার শোধ করতে হলে চাকরি তাকে করতে হবেই। তার চাকরি যদি করতে হয় তো এই কলকাতা থেকে দূরে চলে যাওয়াই ভালো। এমন এক জায়গায় যেখানে প্রতিদিনের এই গ্লানি প্রতি মুহূর্তের এই অপমৃত্যু তাকে নিজের চোখে দেখতে হবে না। সেখান থেকে প্রতি মাসে সে টাকা পাঠিয়ে দেবে মিস্টার হোসেনভাইকে। প্রতি মাসের শৃঙ্খলে সে আবদ্ধ হয়ে থাকবে সতীর কাছে। এই-ই তার বন্ধন। এই-ই তার মুক্তি! এমনি করে সতীর কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েই বন্ধনের মধ্যে মুক্তির স্বাদ খুঁজে পাবে।
দীপঙ্কর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। দাঁড়িয়ে উঠে বললে-অম্লাইট্ স্যার, থ্যাঙ্কিউ—
বলে আর দাঁড়াল না সেখানে। একেবারে সোজা নিজের ঘরে চলে এল। তারপর কিছুক্ষণ কোনও কাজ করতে পারলে না। সমস্ত মন সমস্ত মানসিকতা যেন তার বিকল হয়ে গেছে। কখন ঘন্টায় ঘন্টায় ঘড়ি বেজে গেছে, কখন বিকেল হয়েছে, কখন সন্ধ্যে হয়েছে কিছুই খেয়াল ছিল না।
হঠাৎ মধু এসে ঢুকলো। একটা চিঠি এনে সামনে রাখলে। আপিসের নয়। দীপঙ্করের নামে।
কেমন অবাক হয়ে গেল। তাকে তার নামে আপিসে কে চিঠি দেবে? ওপরে দিল্লির পোস্ট-আপিসের ছাপ। চিঠিখানা হাতে তুলে নিয়ে বার কয়েক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলে। তারপর ছিঁড়ে ফেললে খামের মুখটা।
আশ্চর্য! দাতারবাবুর চিঠি! দাতারবাবু লিখেছে দিল্লি থেকে। দাতারবাবুর নতুন ঠিকানা করলবাগ। সমস্ত চিঠিখানা ইংরিজীতে লেখা। দীপঙ্কর দম বন্ধ করে পড়তে লাগলো—
‘ডিয়ার দীপুবাবু
আমি আজ ভীষণ বিপদাপন্ন। অনন্যোপায় হয়ে অন্য ঠিকানা জানি না বরে তোমার আপিসের ঠিকানায় এই চিঠি লিখছি। জানি না এ চিঠি তোমার হাতে পৌঁছোবে কি না। তোমার লক্ষ্মীদি তোমাদের কলকাতায় গেছে কি না বুঝতে পারছি না। হঠাৎ আমাদের বাড়ি ছেড়ে কাউকে না বলে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আজ একমাস ধরে অনেক জায়গায় চিঠি দিয়েছি, অনেক জায়গায় খোঁজও করেছি। শেষের দিকে তোমার লক্ষ্মীদির মাথাটাও একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবু আমরা সাবধানে রাখতাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তুমি বোধহয় এখানকার খবর জানো না। আমি যে এখনও বেঁচে আছি এ বোধহয় আর এক পরম আশ্চর্য ঘটনা। তোমার লক্ষ্মীদি পালিয়ে গিয়ে হয়ত বেঁচেই গেছে। আমি কিন্তু পালাতে পারিনি। আমাকে এখানেই থাকতে হবে। আমার পালাবার উপায় নেই। আমার ছেলে আজ মানুষ খুন করার অপরাধে জেলে বন্দী হয়ে আছে। বাপ হয়ে তার মামলার তদ্বির করতে হচ্ছে আমাকেই…..
দীপঙ্করের চোখের সামনে চিঠির ছোট-ছোট অরগুলো যেন ঝাপসা হয়ে গেল এক নিমেষে। আরো আলোর তলায় নিয়ে এল চিঠিখানা।
সমস্ত শরীরে তখন অবধারিত রোমাঞ্চ শুরু হয়ে গেছে দীপঙ্করের। চোখের সামনে দীপঙ্কর যেন সমস্ত ঘটনাটা স্পষ্ট দেখতে পেলে। যেন দিল্লির একটা বাড়িতে তখন নাটকের শেষ অঙ্ক শুরু হয়ে গেছে। নিস্তব্ধ রাত। কনট্ প্লেসের একটা বাড়িতে টিপি – টিপি পায়ে এ ঘর থেকে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল একজন বিংশ শতাব্দীর মানুষ। সমস্ত দিল্লি তখন ঘুমিয়ে পড়েছে অকাতরে। টাকার দিল্লি, ব্যাভিচারের দিল্লি, মোগল- সম্রাটদের দিল্লি, ভাইসরয়দের দিল্লি যেন অসাড় হয়ে পড়ে আছে চোখ বুজে। যা খুশী পাপ করো তোমরা, আমরা চোখ বুজে থাকবো। আমাদের অন্য অনেক ভাবনা আছে! আমরা কেউ কিছু দেখতে যাবো না। ঘরের দরজা বন্ধ করে তোমরা এডাল্ট্রি করো, রেপ্ করো, যা-কিছু করো, তবু আমরা চোখ বুজে থাকবো। আমরা শুধু যুদ্ধে জিততে চাই। আমরা শুধু চাই ভিক্টরি। আর কিছু চাই না।
বারান্দা পেরিয়ে মানুষটা টিপি টিপি এগিয়ে এল আর একটা ঘরের সামনে। দরজাটা ভেজানো। মানুষটা ভেজানো দরজার সামনে গিয়ে কী যেন দ্বিধা করলে একবার।
তারপর ঘরের ভেতর ঢুকেই হঠাৎ আচমকা দুম্-দুম্ আওয়াজ করলে দু’বার। একটা মেয়েলি গলার চিৎকার। আলো জ্বলে উঠলো। সেই চিৎকারে সমস্ত দিল্লি আঁকে উঠলো আর্তস্বরে। ভাইসরয়ের দিল্লি কেঁপে উঠলো, চমকে উঠলো।
কিন্তু লক্ষ্মীদি তখন আর চুপ করে থাকতে পারে নি। সমস্ত বাড়ি কাঁপিয়ে সমস্ত পাড়া কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছে গলা ছেড়ে। সে শব্দে ওঘর থেকে ঘুম ভেঙে উঠেছে দাতারবাবু। চাকর-বাকর-ঝি-খানসামা-বাবুর্চি-আর্দালী-সবাই জেগে উঠেছে। হুঁশিয়ার। হুঁশিয়ার সবাই। আসামী পালিয়ে যাবে।
কিন্তু যে আসামী সে পালাবার এতটুকু চেষ্টা করেনি। রিভলবারটা হাতে নিয়ে চুপ করে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছে তখনও। লোকজন সবাই এসে ঘরে ভিড় করেছে। দাতারবাবুও এসে হতবাক হয়ে গেছে। লক্ষ্মীদিও তখন যেন আসামীর মুখের দিকে চেয়ে কাঁদতে ভুলে গেছে।
শুধু একজনই উঠলো না আর। উঠতে পারলো না। লক্ষ্মীদি আর সুধাংশু একই ঘরে একই বিছানায় শুয়ে ছিল। গুলী দুটো গিয়ে সুধাংশুর বুকেই লেগেছিল টিপ্ করে। সুধাংশু বিছানাটার ওপর রক্তের সমুদ্রে যেন ভাসছে তখন। ভাসছে আর অসাড় হয়ে পড়ে আছে। মিলিটারি সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টর তখন সমস্ত সাপ্লাই-এর উর্ধ্বে চলে গেছে—
দাতারবাবুর মুখ দিয়ে শুধু একটা কথা বেরিয়েছিল—মানস, তুমি—
তারপরের ইতিহাস বড় সংক্ষিপ্ত। তারপরের ইতিহাস বড় মর্মান্তিক। পুলিস, দারোগা, কোর্ট, কাছারি, একোয়ারী সে তুচ্ছ জিনিস। কিন্তু তুচ্ছ জিনিস হলেও বাপ হয়ে তার তদ্বির তাকে করতেই হচ্ছে। চিঠির শেষে দাতারবাবু লিখেছে—’যদি তোমার লক্ষ্মীদি তোমার কাছেই গিয়ে থাকে তো তাকে একটু দেখবে। তার আঘাতটাই বড় মর্মান্তিক। এই ছেলের জন্যেই তোমার লক্ষ্মীদি তার সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছিল একদিন, এই ছেলের জন্যেই আমি একদিন সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা বোধহয় তা নয়। তবু লক্ষ্মীদি যদি তোমাদের কাছে আছে জানতে পারি তো কিছুটা নিশ্চিন্ত হবো। আমাকেও একটা খবর দিও—
ইতি তোমার দাতারবাবু