কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৩
৮৩
শুধু দিল্লির কনট্ প্লেসেই নয়, শুধু কলকাতার প্যালেস্-কোর্টেই নয়, সমস্ত ইন্ডিয়াতেই তখন আর এক বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। একদিন বাঙলা দেশে স্বদেশী আন্দোলনের সময় যে কটন মিলের পত্তন হয়েছিল, বিলিতী কাপড় পোড়ানোর আন্দোলন শুরু হয়েছিল, উত্তর-পশ্চিম ভারতের গুজরাটীরা তারই সুযোগ নিয়ে তখন কাপড়ের দুর্ভিক্ষ শুরু করে দিলে। প্রথমে ছিল চাল। তারপর হলো কাপড়, বাপ-মাকে পেটের ছেলেরা বিশ্বাস করতে, শ্রদ্ধা করতে ভুলে গিয়েছিল, স্বামীরা স্ত্রীদের ভালবাসতে কার্পণ্য করছিল, শাশুড়ীরা বউদের অত্যাচার করতে আরম্ভ করেছিল, বউরা স্বামীদের নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাইছিল। সমাজে-সংসারে যেমন ভাঙন ধরছিল তেমনি বাইরের জগতেও। বাড়ির ছেলেরা বাড়ি ছেড়ে আলাদা-আলাদা হয়ে গেল। মা-বাবা-স্বামী-স্ত্রী ছেলে-মেয়ে সব ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল চারদিকে। আসল কারণ টাকা। আগে যে-টাকায় সংসার চলতো সে-টাকায় আর সংসার চললো না। আগে যে-ত্যাগ করতে তৈরি ছিল সবাই, সে-ত্যাগ আর করতে চাইল না কেউ। আমি সংসারে মাসে দু’ শো টাকা দিই সুতরাং আমার ছেলে লুচি খাবে। তুমি দিচ্ছ পঞ্চাশ টাকা, তোমার ছেলে খাক মুড়ি। এই চন্ডীদাস, এই চৈতন্যদেব, এই রামামোহন, এই পরমহংসদেবের দেশের লোকই হঠাৎ ১৯৪৩ সালে এসে বলতে শুরু করলো—টাকাই ধর্ম, টাকাই মোক্ষ, টাকাই স্বর্গ। সেদিনকার কলকাতার মানুষ সব জিনিসের দাম বুঝতো, কিন্তু কোনও জিনিসেরই মূল্য দিতে চাইল না আর। একলা দীপঙ্কর শুধু দেখতো আর মনে মনে কষ্ট পেত। আর একজন বুঝেছিলেন। আগা খাঁর প্যালেসের জেলখানার এক কোণে তখন আর একজন একুশ দিনের উপবাস করছেন। সমস্ত দেশের পাপের জন্যে, সমস্ত দেশের অন্যায়ের জন্যে আমি দায়ী। আমি উপবাস করে পরিশুদ্ধ হবো। সমস্ত ইন্ডিয়া আমার পরিশুদ্ধিতে পরিত্রাণ পাবে।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালেই তখন দেখা যেত মানুষের জটলা। মহাত্মা গান্ধী উপবাস করছেন। উপবাস করছেন নিজের জন্যে, ইন্ডিয়ার জন্যে, ওয়ান্ডের জন্যে। মানুষ পরিশুদ্ধ হোক। মানুষ শুদ্ধাত্মা হোক। মানুষ মানুষ হোক।
দীপঙ্করও আপিস থেকে ফেরার পথে অনেকদিন দাঁড়িয়ে শুনতো। কী খবর? শেষ খবর কী? তিনি বেঁচে আছেন? এক দিন, দু’ দিন, তিন দিন। ইন্ডিয়ার মানুষ দিনের পর দিন আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে খবরের জন্যে। কলকাতা ইউনিভার্সিটির ভাইস্ চ্যান্সেলার ডাক্তার বিধান রায় গিয়েছেন গান্ধীজীর কাছে। আরো ছ’জন ডাক্তার পরীক্ষা করছেন তাঁকে। না, কোনও ভয় নেই। একুশ দিনের দিন’ বড় অশান্তিতে কাটলো দীপঙ্করের। মানুষ কি পরিশুদ্ধ হবে সত্যি সত্যি? মহাত্মা গান্ধীর আশা পূর্ণ হবে? দীপঙ্কর যা চায় তা-ই কি হবে শেষ পর্যন্ত?
ডাক্তার বিধান রায় ফিরে এলেন। এসে এক সভায় বক্তৃতা দিলেন। কোনও ভয় নেই। সমস্ত নির্বিঘ্ন। যেদিন উপবাস ভাঙলেন মহাত্মাজী, শেষ মুহূর্তে যখন সমস্ত বিপদ কেটে গেল, মহাত্মাজী চাইলেন তাঁর ট্যাঁকঘড়ির দিকে। ডাক্তার রায় শুনলেন— মহাত্মাজীর প্রথম কথা—
সবাই উদ্গ্রীব হয়ে শুনছিল। জিজ্ঞেস করলে—কী প্রথম কথা?
মহাত্মাজী বললেন—আমি বুঝতে পারছি না ঈশ্বর কেন এ-যাত্রা আমাকে রক্ষা করলেন। হয়ত আমাকে বাঁচিয়ে রেখে তিনি আমাকে দিয়ে তাঁরই কোনও ইচ্ছে পূর্ণ করতে চান—আরো কোনও কাজ করাতে চান আমাকে দিয়ে—
যারা শুনছিল ডাক্তার রায়ের বক্তৃতা, তাদের চোখ এইবার সজল হয়ে উঠলো।
.
বিকেল থেকেই সেদিন লক্ষ্মীদি একটু যেন শান্ত হয়ে এসেছিল। সতী নিয়ম করে ওষুধ খাইয়েছে। শুধু আজ নয়, যেদিন প্রথম লক্ষ্মীদি এসেছিল, সেইদিন থেকেই সতী লক্ষ্মীদিকে নিয়ে পড়েছিল। কখন লক্ষ্মীদি ওষুধ খাবে, কখন স্নান করবে তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো সতীকে। দুই বোন যেন অনেক ঘাটের ঝড়-ঝাপ্টা অতিক্রম করে আবার একই বন্দরে এসে জুটেছে। সতী বোঝাতো—তুমি কেন এত কাঁদছো লক্ষ্মীদি? কার জন্যে কাঁদো এত? সংসারে কে কার? আমার কথাই ভেবে দেখ না! আমার কথা ভেবেও তো তুমি একটু সান্ত্বনা পেতে পারো! স্বামী কেউ নয়, ছেলেও কেউ নয়, সবাই নিজের- নিজের স্বার্থ চায়, কেউ কারো মুখের দিকে চায় না, এ সংসারের এইটেই নিয়ম বলে মনে করে নাও না তুমি!
লক্ষ্মীদি বলতো—ওরে, তা আমি কেমন করে মনে করবো? তুই তো জানিস না আমার সে-সব কী দিন গেছে! একখানা কাপড়ে সাবান দিয়ে কেচে বাইরে বেরিয়েছি, এক-হাতে বাঁ চোখের জল মুছে, ডান চোখ দিয়ে হেসেছি। সে কার জন্যে করেছি, বল্?
সতী বলতো—সে-সব করেছ, ভুল করেছ তুমি! সংসারে কেউ কারো নয়, স্বামী- পুত্র-শ্বশুর-শাশুড়ী-বাবা-মা সবাই স্বার্থপর, স্বার্থ ছাড়া আজকাল কিছুই চলে না, স্বার্থ ছাড়া জগৎ-সংসারে সব কিছু অচল হয়ে যায় লক্ষ্মীদি।
লক্ষ্মীদি বলতো—কিন্তু আমি যে ভুলতে পারি না ভাই! আমার ছেলে যে সে-রকম ছেলে নয়। আমার ছেলে যে মা বলতে অজ্ঞান ছিল—
—সে তোমার মনের ভুল লক্ষ্মীদি! সে-সব মনের ভুল মনে করো। সেই সব ভেবে কি তুমি মরে যাবে বলতে চাও?
লক্ষ্মীদি বলতো—হ্যাঁ ভাই, আমি মরবো। মরাই আমার ভালো—আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? এ-জীবন নিয়ে আমার কী লাভটা হবে?
তারপর সতী অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে লক্ষ্মীদিকে শান্ত করতো। ওষুধ খাওয়াতো। ডাক্তার বলেছির ঘুমোতে-ঘুমোতেই আস্তে আস্তে উনি সব ভুলে যাবেন। যত ঘুমোতে দেবেন ততই ভালো। এ-রোগীর ঘুমই একমাত্র ওষুধ! ওষুধ খেলেই একটু পরে ঘুমিয়ে পড়তো লক্ষ্মীদি। তখন সতীর একটু বিশ্রাম। তখন কিছুক্ষণের জন্যে সতী তার নিজের কথা ভাববার সময় পেত। তখন দীপঙ্কর আপিস থেকে আসতো। দীপঙ্কর বদলি হয়ে যাবে শিলিগুড়িতে, তার কথা বলতো। তার শাশুড়ী টাকা পেয়ে গেছেন, সেই সব কথা বলতো। আর কোনও ভাবনা নেই তাদের। টাকার জন্যেই তো সতীকে এত খোশামোদ। টাকার জন্যেই একদিন শাশুড়ীর এত আদর। সেই টাকাই যখন যোগাড় হয়ে গেছে তখন আার সতীকে তাঁদের দরকার নেই। সতী কেমন আছে তা দেখবারও প্রয়োজন নেই।
দীপঙ্কর বলতো—তোমাকে শ্বশুর-বাড়িতে তুলে দিয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারতুম, কিন্তু তা আর হলো না—
সতী বলতো—তাঁরা টাকা পেয়ে গেছেন যখন, তখন আর কেন আমাকে নেবেন? কীসের দায় পড়েছে তাঁদের?
দীপঙ্কর বলতো—দায় তাঁদের নয়, দায় আমার—
—তোমার দায়? কেন?
দীপঙ্কর অন্য দিকে চোখ রেখে বলতো—কী জানি, কেন? কিন্তু মনে হয়, তোমার এই দুর্ভাগ্যের জন্যে হয়ত আমিই দায়ী, আমার জন্যেই তোমার এই দুর্ভোগ হলো—
—কেন? তুমি দায়ী হতে যাবে কেন? আমারই কপারে দোষ!
দীপঙ্কর বলতো—না, সেই বহুদিন আগে, একদিন আমার জন্মদিন যে কেন মরতে করতে গিয়েছিলে তুমি! সেদিন তুমি তোমার বাড়িতে নেমন্তন্ন না-করলে আজ এই দুর্দশা হতো না তোমার —
—দুর্দশা! সতী হেসে উঠতো। বলতো—একে তুমি দুর্দশা বলো? আমার মত সুখী কে? আমার মত স্বাধীন কে? আমার মত ক’জন মেয়ে এত টাকার মালিক? আমি কার পরোয়া করি আজ? জানো, এখন থেকে কারোর কাছে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি যখন ইচ্ছে ঘুমোতে যাবো, যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠবো, কেউ বলবার নেই! আমি এখন যা খুশি ভাববো, যা খুশি করবো, কারোর মুখ চেয়ে আমাকে চলতে হবে না। কারোর মন যুগিয়ে আমায় শাড়ি-গয়না পড়তে হবে না। একে যদি সুখ না বলি তো সুখ বলবো কাকে?
ইদানীং সতী এই ধরনের কথাই বলতো কেবল। বলতো—তুমি শিলিগুড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, আমার কোনও বিপদ হবে না এখানে। আমি এখানে খুব আরামে থাকবো। আমার জন্যে তুমি কিচ্ছু ভেবো না—
যেদিন থেকে সতী খবর পেয়েছে দীপঙ্কর বলি হয়ে যাচ্ছে, সেইদিন থেকেই সতী এই ধরনের কথা বলছে। বলছে—ভালোই তো হলো দীপু, ভাবছো কেন অত? দূরে গেলে তবু তুমি তোমার চাকরিতে মন দিতে পারবে। দূরে গেলে তবু আমার কথা ভুলতে পারবে! আমার কথা ভুলে যাওয়াই তো তোমার পক্ষে ভালো। আমি তোমার কে বলো না? আমি তো আসলে তোমার কেউই নই। মাঝখান থেকে আমার কথা ভেবে-ভেবে তুমি কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করবে? এ তো ভালোই হলো এক-রকম। তোমার পক্ষেও ভালো হলো, আমার পক্ষেও ভালো হলো—না কি বলো?
দীপঙ্কর এর কিছু উত্তর দিতে পারতো না।
সতী বলতো—তুমি বিয়ে করবে, সংসার করবে, তোমার সংসারকেই না-হয় আমি আমার নিজের সংসার বলে মনে করবো, তাতে দোষ কী বলো? তোমার ছেলেকেই না- হয় আদর করবো, তোমার ছেলেকেই না-হয় আদার করে আমার নিজের ছেলে ভাববো! তাতে তোমার আপত্তি কিসের? আর তোমার ছেলে আর আমার ছেলে কি আলাদা? না- হয় ভাববো আমার মরা ছেলে আবার তোমার ছেলে হয়ে জন্মেছে—। ভাবতে কিছু দোষ আছে, তুমিই বলো না? দোষ আছে?
এ-সব পাগলামির কোনও উত্তর দিত না দীপঙ্কর।
সতী বলে যেত—কিন্তু তুমি যদি বিয়ে করো দীপু তো আমি নিজে তোমার মেয়ে দেখে দেবো। সত্যি! আমাকে মেয়ে দেখিয়ে তবে বিয়ে ক’রো তুমি। শেষকালে হয়ত আমার মত এক অপয়া মেয়েকে বিয়ে করে বসবে, আর ওঁর মতন সারা জীবন জ্বলে পুড়ে মরতে হবে তোমাকে। তুমি জানো না দীপু সে কী জ্বালা। আমার জন্যে যে উনি কত যন্ত্রণা পেয়েছেন, তা তুমি বুঝতে পারবে না—
—জেনে-শুনে তুমি সনাতনবাবুকে যন্ত্রণা দিয়েছ?
—আমি কি দিয়েছি দীপু, দিয়েছে আমার কপাল। আমার মত বউ হয়েছিল বলেই ওঁর এত কষ্ট। আমি ওদের সংসারে ঢোকবার পরদিন থেকেই ওদের আকাল হলো। ওদের টাকা গেল, প্রতিপত্তি গেল, গাড়ি বিক্রি হয়ে গেল, ওদের সংসারে শনি ঢুকলো। আমি শনি হয়েই ঢুকেছিলুম, ওদের বাড়িতে—! সাধে কি আমি বলছি তোমাকে ভালো করে মেয়ে দেখে বিয়ে করতে। খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অনেক বিচার করে তবে বিয়ে করবে ভাই। হুট্ করে যা-তা করে যাকে-তাকে বিয়ে করে ফেল না দীপু, তার চেয়ে বড় ক্ষতি আর নেই। ওঁকে দেখেও তোমার শেখা উচিত—
দীপঙ্কর বলতো—কিন্তু সনাতনবাবু তো তোমার অযোগ্য নন, কিংবা তুমিও তো তাঁর অযোগ্য নও, তবে কেন এমন হলো?
সতী বলতো—সে তো আমিও ভাবি কেন এমন হলো। শুধু কি আমার শাশুড়ীর জন্যে? তাও তো নয়। কত বউয়ের কত খারাপ শাশুড়ী তো থাকে, কই, তারা তো আমার মত এমন করে স্বামী ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় না, এমন করে পরের বাড়িতে বাস করে না! আমারই বা কেন এমন হলো! তাই বলি, এ আমার কপাল।
দীপঙ্কর বলতো—না, হয়ত আমিই এর কারণ, আমি দূরে চলে গেলেই হয়ত আবার সব ঠিক হয়ে যাবে—
সতী বলতো—না দীপু, না, আর ঠিক হবে না কিছু, আর জোড়া লাগবে না। আর সে জোড়া না-ই বা লাগলো, ক্ষতি কী? এই তো ভালো। বেশ স্বাধীন। তারপর তুমি একদিন বিয়ে করবে, সংসার করবে। আমি বছরে এক-একবার করে তোমাদের দেখে আসবো, তোমার বউয়ের জন্যে শাড়ি কিনে নিয়ে যাবো, তোমার ছেলের জন্যে খেলনা কিনে নিয়ে যাবো। আবার ফিরে আসবো, এখানে। লক্ষ্মীদিও তখন ভালো হয়ে উঠবে, আবার দিল্লি চলে যাবে। তখন একেবারে স্বাধীন। সমস্ত বাড়িটাতে একলা! একলা কাটাতে আমার আর খারাপ লাগে না আজকাল, জানো দীপু, একলা একলা আমি বেশ সারা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো। কোনও কষ্ট হবে না আমার—
শেষের দিকে দীপঙ্কর এলেই এমনি সব আজেবাজে কথা সতী এক-নাগাড়ে বলে যেত। সে-কথা যেন আর ফুরোত না। তারপর যখন অনেক রাত হয়ে যেত, তখন দীপঙ্কর উঠতো। আস্তে আস্তে অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়াতো। আর সেই অন্ধকারে দীপঙ্করের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে যেত। কলকাতা, ইন্ডিয়া, এসিয়া, সক্রেটিস, গান্ধী, প্রাণমথবাবু সব মন থেকে মুছে যেত। আপিস, টাকা, ধার, ট্র্যানসফার সব কিছু সে-ভাবনার তলায় তলিয়ে যেত।