কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৬
৮৬
ন’দিদি যেন কোত্থেকে খোঁজ পেয়েছিল। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ সেদিন এসে হাজির। সেইদিনই সন্ধ্যোবেলা। সনাতনবাবু তখন গেছেন বউকে আনতে। নয়নরঞ্জিনী শম্ভুকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন—বলি, খুব যে মাইনে মাইনে করেছিলি সবাই এবার সব টাকা বুঝে পেয়েছিস্ তো! সব টাকা গুনে নিয়েছিস্ তো?
শম্ভু মাথা নিচু করে বললে-আজ্ঞে, হ্যাঁ মা-মণি!
—খুব যে তখন পাড়ায়-পাড়ায় বলে বেড়াচ্ছিলি যে ঘোষ-বাড়ি এবার নীলেম হবে, খুব যে তোরা সবাই পাড়ায়-পাড়ায় চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছিলি! দেখি কে তোদের কত কালিয়া-পোলোয়া খেতে দেয়। একবার অন্য বাড়িতে কাজ করে দ্যাখ্ না কেমন সুখটা সেখানে—
শম্ভু প্রতিবাদ করলে—আজ্ঞে, মা-মণি, আমি তো বলিনি—আমি আপনার পা-ছুঁয়ে দিব্যি গালতে পারি —
মা-মণি ধমকে উঠলেন—আলবাৎ বলেছিলিস্। তোরা ভাবিস্ আমি কিছু খবর পাই না, ভাবিস্ বুড়ী মাগী কালা হয়ে গেছে কানে, কিন্তু আমার কাছে সব খবর আসে—
শম্ভু তবু বললে-আজ্ঞে, মা-কালীর দিব্যি বলছি, আমি অমন কথা কখনও বলিনি—
—তা হলে ডাক্ বাতাসীর মা’কে, ডাক্ ভূতির মা’কে, ডাক্ কৈলাসকে, কে কাকে কী বলেছে সব আমার কানে এসেছে। ওরে, এখনও আমি মরিনি! নেমখারামের জাত তোরা, আমার খেয়ে, আমার পরে আমারই গলায় পা দিয়ে আমাকে থ্যালাবি? ডাক্ ওদের সবাইকে, আমি দেখি তাদের কত কেরামতি—
ঝি-চাকর-ঠাকুর মহলে ততদিনে রটে গেছে খবরটা। পাড়াতেও খবর রটে গেছে ঘোষ-বাড়ির গিন্নী আবার চাকর ঝি-দের বকেয়া মাইনে মিটিয়ে দিয়েছে। পুরোন সরকারবাবুরও বকেয়া মাইনে মিটিয়ে দেওয়া হয়ে গিয়েছে, আবার সে এসে কাজ-কর্ম শুরু করে দিয়েছে আবার বাড়িতে মিস্ত্রী লেগেছে। চুন-কাম হচ্ছে দেয়ালে। বাইরে বাঁশের ভারা বাঁধা হয়েছে। অর্থাৎ আবার অবস্থা ফিরে গেছে ঘোষ-বাড়ির। বকেয়া মাইনে হাঁতে পেয়ে ঘোষ-বাড়ির চাকর-বাকররাও আবার দেশে টাকা পাঠিয়েছে।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সবাই এল মা-মণির সামনে। নয়নরঞ্জিনী বললেন—কী গো বাতাসীর মা, তোমাকেই বলি, তুমিই তো দলের পান্ডা, যত দল তুমিই পাকিয়েছ—
বাতাসীর মা’কে আর বেশি বলতে হলো না। সে হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলো। বললে—আমাকেই তুমি দুষলে মা-মণি, আমিই হলুম দলের পান্ডা—
—থামো, ভর সন্ধ্যেবেলায় মড়া কান্না কেঁদো না! বলি, মাইনে সব মিটিয়ে দিয়েছে তো সরকারবাবু?
বাতাসীর মা বললে-আমি তো মাইনের জন্যে কখনও বলিনি মা-মণি তোমাকে—
—বেশি বক্-বক্ কোর না বাতাসীর-মা, নেমখ হারামের দল যত, আমার বাড়িতে খেয়ে-পরে এ্যাদ্দিন আমারই শতেক খোয়ার করেছ, এ্যাদ্দিন কিছু বলিনি, মুখ বুজে সব সহ্য করিছি। শুধু দেখছিলুম হারামজাদীরা কত বাড় বাড়ে! তা হ্যাঁগা এতদিন আমার খেলে-পরলে, মানুষের একটা হায়া বলে তো জিনিস থাকে! তা তোমাদের কি তাও নেই বাছা? পরের বাড়িতে কাজ করতে এয়েছ বলে কি সেটারও মাথা খেয়ে বসে আছো?
নয়নরঞ্জিনীর লম্বা বক্তৃতায় আর কারো মুখে একটা কথা বেরোবার সাহস হলো না।
-–তোমাদের মত নেমখারামের হক্কের টাকা নিয়ে ভেবো না আমি বড়লোক হবো বাতাসীর মা। অমন বাপের জম্মিত্ নই আমি। অমন দুশো-পাঁচশো টাকা আমি খোলামকুচির মত ছুঁড়ে দিতে পারি, তা জানো? এই যে আমার বিপদ গেল এতবড়, সবাই তো হেসেছিল, ভেবেছিল এবার ঘোষ-বাড়ি টকে যাবে, কই, গেল? তোমাদের সব পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে দিলাম তো! সরকারবাবুকে সেই আমার কাছে এসেই দু’ মুঠো ভাতের জন্যে চাকরি করতে হলো তো! ওগো, ভগবান বলে একজন মানুষ মাথার ওপর আছেন, তিনি সব দেখছেন, তিনি দর্পহারী মধুসূদন, তাঁর কাছে কিছু অজানা থাকে না, জানো? কে কী-রকম মানুষ তাঁর খাতায় সব লেখা থাকে, বুঝলে বাছা? নইলে ছেলের বয়ে দিয়ে মোটা টাকা নিতে পারতুম না? বলো না তোমরা, নিতে পারতুম না?
এ-প্রশ্নের কেউ উত্তর দিলে না। উত্তর বোধহয় তিনি চানও নি।
—আর এই যে আমার বৌমা, বৌমাকে কী সুখে রেখেছিলুম, আর কেউ না-দেখুক, তোমরা তো দেখেছ? তোমরা তো জানো, আমার নিজের মেয়ে ছিল না বলে বৌমাকে আমি পেটের মেয়ের মতন আদর করতুম! পাড়ার লোকে যা-ই বলুক, তোমরা তো বাপু সে-আদর দেখেছ! আমার ন’দিদিও বলতো—তুই আদর দিয়ে দিয়ে তোর বৌ-এর মাথাটা খেয়ে ফেলবি নয়ন! তা ন’দিদির কথাই তো সত্যি হলো শেষ-পর্যন্ত! ন’দিদিকে আমি দোষ দিলে কী হবে, ন’দিদি তো মিথ্যে কথা বলবার লোক নয়। তা তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি বাপু, বৌমা আজ আসছে, এতটুকু যদি আদিখ্যেতা দেখি তো আমি কারো হাড়-মাস আর এক ঠাঁই রাখবো না—এই বলে দিলুম—
ভূতির-মা বুঝি খবরটা জানতো না, বললে–বৌদিমণি কি আসবে মা-মণি?
—হ্যাঁ আসবে, কিন্তু এতটুকু আদিখ্যেতা যদি দেখি তোমাদের তো আমি বরদাস্ত করবো না, এই বলে দিলুম, যেমন বড়-মুখ করে গিয়েছিল, তেমনি খোঁতা-মুখ ভোঁতা করে আসছে। তা আসুক্, ছেলের বউ যখন তখন আসবার হক্ থাকবে বৈ কি! কিন্তু খবরদার শম্ভু, তোকেও বলে দিচ্ছি, তোরই বেশি বাড়, তুই যেন বৌদিমণি বলতে আদেখলেপনা করিনি—আমি এখন থেকে সাবধান করে দিচ্ছি—
—বৌদিমণি কি আজই আসবে? কৈলাস জিজ্ঞেস করলে।
নয়নরঞ্জিনী আর থাকতে পারলেন না। বললেন-আসবে না তো যাবে কোথায় শুনি? যাবে কোথায়? কোন্ চুলো আছে তার? বাপ তো পটোল তুলেছে, এক বাউন্ডুলে বোন ছিল, তার কীর্তিতে তো মুখ-দেখানো ভার, এখন আমি না ঠাঁই দিলে কোথায় দাঁড়ায় সে? তা আমি ভাবলাম মরুক গে, হাজার হোক, ছেলের বউ তো, এত করে সাধছে, বাড়িতেই ঠাঁই দিই—
বাতাসীর মা বললে—বেশ করেছ মা-মণি, তুমি শাউড়ীর কাজই করেছ—তোমার জন্যে ভগমান আছে—
—না-বাছা, ভগমানের ভরসা আমি রাখিনে। ভগমানের ভরসায় থাকলে কবে আমি সংসার-ধর্ম ছেড়ে কাশীবাসী হতুম, আমার এ পোড়া সংসার নিয়ে আর এত জ্বালায় জ্বলতে হতো না। এই যে তোমাদের মাইনেকড়ি মিটিয়ে দিলুম, এ কি ভগমান দিলে আমাকে? ভগমান টাকা দিলে? ভগমানের কি দশটা হাত আছে না সিন্ধুক-ভর্তি টাকা আছে যে চাইলেই হুড়-হুড় করে ঢেলে দেবে? ভগমান মানুষকে হাত দিয়েছে, মানুষের মাথায় বুদ্ধি দিয়েছে, মানুষকে বুদ্ধি খাটিয়ে টাকা উপায় করতে হয় গো, তবে টাকা আসে! বুঝলে? টাকা অত সহজ জিনিস নয় বাতাসীর-মা, আমি বুড়ো মানুষ, উকীল- কাছারি করে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি আজ…….
কথা তখন শেষ হয়নি। হঠাৎ সিঁড়ির সামনে ন’দিদির চেহারা দেখা গেল। নয়নরঞ্জিনী বললে—ওমা তুমি?
মোটা মানুষ, হাঁফাচ্ছিলেন। বললেন—বিপদের ওপর বিপদ চলছিল ভাই, কতদিন আসবো-আসবো করে আসতে পারিনি—তা শুনলুম, তোর দেনাটেনা নাকি মিটে গেছে? বাড়িতে ভারা বাঁধা দেখলুম, মিস্ত্রী খাটছে?
বহুদিন নয়নরঞ্জিনীর মনে একটা অভিযোগ ছিল ন’দিদির ব্যবহারে। একবারও দেখা করেনি। টেলিফোন করেও উত্তর পাননি তিনি। যখন টাকার জন্যে স্বর্গ-মর্ত দৌড়োদৌড়ি করছেন, তখন ন’দিদির টিকিটিরও সাক্ষাৎ পাননি। আজ এতদিন পরে কোত্থেকে শুনেছেন, কোর্টের টাকা জমা দেওয়া হয়ে গেছে, ঝি-চাকর-ঠাকুর-সরকারের মাইনে-কড়ি মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর ওমনি এসে ভালবাসা দেখাতে হাজির হয়েছেন। ধন্যি আত্মীয়-স্বজন, ধন্যি জ্ঞাতি-কুটুম!
ন’দিদি বললে—ওরে না রে নয়ন, না, তুই কিনা আমাকে ভুল বুঝলি শেষকালে? আমি কি বেঁচে ছিলুম রে এ্যাদ্দিন? আমি যে কী জ্বালায় জ্বলছিলুম তা আমি জানতুম আর আমার ভগবান জানতো রে। আমার বৌ তো আঁতুড় থেকে উঠে মরো-মরো হয়ে গিয়েছিল—শেষকালে ডাক্তার-বদ্যি, যমে-মানুষে টানাটানি চললো এতদিন, শেষকালে তোর জামাইবাবুকে বললুম—আর নয়, আমি নয়নকে এবার গিয়ে দেখে আসি, তার বিপদের সময় আমি না দাঁড়ালে দাঁড়াবার আর কেউ নেই—! উঃ, তোর জামাইবাবু কি আসতে দেয় আমাকে? শেষে জোর করে চলে এলুম—
নয়নরঞ্জিনী তখনও কথা বলছেন না। ন’দিদির আবির্ভাবের সঙ্গে-সঙ্গেই ঝি-চাকর সবাই চলে গিয়েছিল। ন’দিদি এবার সামনে বসলো। বললে—যাক্, বিপদ থেকে যে উদ্ধার হয়েছিস এই-ই বড় কথা, আমি বৌ-এর সেবা করতুম আর দিনরাত ভগবানকে ডাকতুম। তোর জন্যে কত ঠাকুরকে যে ডেকেছি নয়ন কী বলবো! বলতুম—হে মা কালী, হে মা দুগ্যা, নয়ন আমার বড় দুঃখী, সে যেন সব দুঃখ থেকে রেহাই পায় মা! যাক্, এখন ভালোই হলো, বড় আনন্দ হলো ভাই দেখে—
তখনও নয়নরঞ্জিনী কিছু বলছিলেন না।
ন’দিদি বললে—তা হ্যাঁরে, টাকা তাহলে কে দিলে? তোর বৌ? তোর বৌকে তো ভাল বলতে হবে তবে! এত কান্ডর পরেও তো টাকা দিলে তোকে!
—ছাই দিয়েছে! তুমি ভাবছো আমি বৌ-এর কাছে ভিখ্ মাঙবো? বৌ-এর টাকা নিয়ে আমি দেনা শোধ করবো! গলায় দড়ি আমার!
—তাই বল্। আমি ভাবলুম বউ-এর বুঝি শেষকালে সুমতি হয়েছে!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আমাকে তুমি তেমন মেয়ে পাওনি ন’দিদি! আমি তোমার কাছে হাজারবার যেতে পারি, লক্ষবার খোসামোদ করতে পারি তোমাকে, কিন্তু তা বলে বৌ? তুমি কী বলে ভাবতে পারলে শুনি?
—তা কোত্থেকে টাকা পেলি তুই?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—জুটে গেল ন’দিদি, দীন-দুঃখীরা যার কাছে পায়, আমিও তার কাছ থেকেই পেয়েছি! ভগবান মুখ রেখেছে আমার। নইলে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়ালে তখন তুমিই কি আসতে আর ন’দিদি?
—ওই দ্যাখ, তুই যে কী বলিস্ নয়ন। আমার যে কী-বিপদের মধ্যে দিন কেটেছে তা ভগবানই জানেন। এ ক’মাসে কত টাকা যে জলের মত খরচ হয়ে গেল, তা তোর জামাইবাবুকে তুই জিজ্ঞেস করিস গিয়ে—
—আর জিজ্ঞেস করতে হবে না ন’দিদি, আমি এবার কলকাতাতেই থাকবো না।
—ওমা, কলকাতাতে থাকবি নে কী রে? বাড়ির দেনা মিট্লো, ঝি-চাকরদের মাইনে মিটিয়ে দিলি, বাড়িতে মিস্ত্রি খাটাচ্ছিস, আর তুই চলে যাবি মানে? তোর ছেলে কোথায় থাকবে? ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবি?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—বৌ-এর কাছে—
—ওমা সে কী কথা? এত কষ্টে বাড়ি উদ্ধার করলি, সব বৌ-এর হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—বাড়ি তো এখনও উদ্ধার হয়নি ন’দিদি, এখনও মামলা চালাচ্ছি—
—তাহলে মামলার কী হবে?
—ওরা যদি মামলা চালাতে পারে তো চলবে। ওরা যদি বাড়ি রাখতে পারে তো বাড়িও থাকবে। ওদের সংসার ওরাই বুঝবে, আমি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে কাশী-বাসী হবো ন’দিদি! আমি সংসার চিনে নিয়েছি, আমি সংসারের মানুষকেও চিনে নিয়েছি, আর আমার কিছু চিনতে বাকি নেই। যথেষ্ট হয়েছে। এই দেখ, আজ বৌ এলে বৌ-এর হাতে এই সব চাবির গোছা তুলে দিয়ে আমি কালই বিদেয় নেব—
—আজ আসবে তোর বউ? আজই?
—হ্যাঁ ন’দিদি আজই, এই এখনি এসে পড়লো বলে! সোনা গেছে তাকে আনতে!
–তা জেনে শুনে তুই ছেলেকে আনতে পাঠালি? ছেলেকে বারণ করতে পারলি নে?
নয়নরঞ্জিনীর চোখ দুটো হঠাৎ ছল্ ছল্ করে উঠলো। বললেন—সোনা আর সে- সোনা নেই ন’দিদি, আমার ছেলে আর আমার বশে নেই! বশে থাকলে আমার আজ ভাবনা? তেমন হলে আমি আজই আবার ওই ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌ-কে জব্দ করতে পারতুম, আমার সে পথও গেল! এখন সেই বৌ এসে আমার বুকে ঢেঁকির পাড় দেবে, তা-ও আমাকে সহ্য করতে হবে!
বলে কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়লেন নয়নরঞ্জিনী।
ন’দিদি বললে—এই এত দেনা তোর মাথার ওপর, আর এখন কি না বৌ আনতে গেল ছেলে?
—তুমিই বলো ন’দিদি, তুমিই বলো! এই এত দেনা করে সকলের মাইনে- কড়ি মিটিয়ে দিলুম, বাড়িতে মিস্ত্রি লাগালুম। এ সব বউ এসে ভোগ করবে বলে? সবই আমার বউ-এর ভোগে লাগবে ন’দিদি!
ন’দিদি বললে—তা তোরই দোষ! তুই যদি জানিস যে বউ এসে তোর সব ভোগ করবে তো কেন এত দেনা করতে গেলি? এ কে শুধবে? তোর বউ?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আগে কি জানতুম ন’দিদি যে পেটের ছেলে আমার এত শত্রুতা করবে? তাহলে আমি এত উপকীল-আদালত করে মরি? আমার কীসের দায় বলো না! একটা তো বিধবার পেট, এটার জন্যে কি আর ভাবনা?
ন’দিদি অনেক সান্ত্বনা দিলে। কত বোঝালে। বললে—এ সংসারে কেউ কারো নয় রে নয়ন। তুই কত কষ্ট করে টাকা রেখে গেলি, সেই টাকা তোরই ছেলে-বউতে উড়িয়ে দেবে। এই-ই আছার হচ্ছে সংসারে।
জীবন বড় অনিত্য, আগেই বোঝা উচিত ছিল নয়নরঞ্জিনীর। আগেই নিজের কাজ গোছান উচিত ছিল! ছেলে-বউকে ছেড়ে তীর্থ ধর্মে মতি দেওয়া উচিত ছিল।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—এখন আমি কী করি বলো তো ন’দিদি? নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে, এখন কার কাছে নালিশ করি?
হঠাৎ মনে হলো যেন নিচেয় গাড়ির আওয়াজ হলো। নয়নরঞ্জিনী চমকে উঠলেন। বললেন—ওই বউ এসেছে—
ন’দিদি বললে—তুই চুপ করে থাক, রাগের মুখে হুট্ করে কিছু বলে ফেলিসনি, যা বলবার আমি বলবো—
কিন্তু না, বৌ আসেনি। সনাতনবাবু একলা এসে নামলেন ট্যাক্সি থেকে। সদাশিব মানুষ। মুখ দেখে তার কিছুই বোঝবার উপায় নেই। শম্ভু খবর পেয়েই দৌড়ে এসেছিল। বললে-বউদিমণি আসেনি দাদাবাবু?
সনাতনবাবু বললেন—না—
তারপর সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিজের ঘরে যাচ্ছিলেন। সামনেই ন’দিদি মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে—কী বাবা, বৌমাকে নিয়ে এলে না?
সনাতনবাবু থেমে বললেন—না।
—এল না বুঝি? তা সে যখন নিজে আসতে চায় না তখন অত খোসামোদ করবার দরকার কী বাবা?
—খোসামোদ? সনাতনবাবু যেন কথাটা বুঝতে পারলেন না। বললেন—তার সঙ্গে খোসামোদের সম্পর্ক তো নয় ন’মাসীমা
—খোসামোদের সম্পর্ক যদি নয় তো কেন তাকে আনতে গিয়েছিলে তুমি? তোমার মা’র কথাও তো শুনতে হয় একটু। তোমার বউ এসে তোমার মাকে লাথি-ঝাঁটা মারবে, সেটাই কি ভাল কথা বাবা?
সনাতনবাবু আরো অবাক হয়ে গেলেন। বললেন—লাথি-ঝাঁটা মারবে কেন? লাথি- ঝাঁটা কি কখনও মেরেছে সে? আর তা ছাড়া মা’ই তো আমার বিয়ে দিয়েছিল!
—এই তো তোমার মা’ই বলছিল বউ এলেই কাশী-বাসী হবে। কতখানি দুঃখু হলে নিজের মা হয়ে এমন কথা বলে, ভাবতে পারো? তুমি তো সব বোঝ বাবা। এত লেখা- পড়া করে এত শিখেছ আর এই কথাটা বোঝ না?
সনাতনবাবু বললেন—মা কাশী-বাসী হবে? আপনি ঠিক শুনেছেন?
—হ্যাঁ বাবা, আমি এমন ভুল শুনবো কেন?
সনাতনবাবু বললেন—ভুল যদি না শুনে থাকেন তো মা’কে আপনি বলুন গিয়ে যে এ-বাড়িতে মা যদি থাকে তো সতীও থাকবে, আর সতী যদি না থাকতে পায় তো মারও থাকা দরকার নেই, আমারও থাকা মিথ্যে!
—বলছো কি বাবা? তোমার কি মাথার গোলমাল হয়েছে?
—না ন’মাসীমা, গোলমাল আমার হয়নি। এ-বাড়ির গৃহলক্ষ্মীকে আজ হোক কাল হোক আমি এ-বাড়িতে আনবোই, তাতে এ-বাড়ির কল্যাণই হবে, মা’রও অকল্যাণ হবে না!
বলে আর ন’দিদির উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লেন।
নয়নরঞ্জিনী এতক্ষণ নিজের ঘর থেকে লুকিয়ে-লুকিয়ে সব শুনছিলেন। ন’দিদি আসতেই গলা নামিয়ে বললেন—কী হলো? বৌ আসেনি?
ন’দিদি বললে—কই দেখছিনে তো! তা তোর ছেলের যে-রকম মতি-গতি দেখছি, তাতে কোন্দিন বউকেই এনে তুলতে পারে বাপু, ও-ছেলের ওপর কিছু ভরসা নেই!
নয়নরঞ্জিনী বললেন—তাহলে কী করি বলো তো ন’দিদি!
—কী আবার করবি? তুই গ্যাট্ হয়ে বসে থাক! তোর টাকা, তোর বাড়ি, এখন তো আর টাকার জন্যে তোর বউকে খোসামোদ করতে হবে না—তোর ভাবনা কী শুনি? তুই এ-বাড়ি ভাড়া দে, ভাড়ার টাকায় তোর জীবনটা আয়েস করে চলে যাবে! কথায় আছে—ঝি জব্দ শিলে আর বৌ জব্দ কিলে! আর যদি তেমন কিছু হয়, আমাকে খবর দিবি, আমি আছি কি করতে? কিছু ভাবনা নেই তোর—
বলে সে-দিনের মত ন’দিদি বাড়ি চলে গেক্ষ।