কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৭
৮৭
গড়িয়াহাট লেভেল ক্রিসিং-এর বাড়িতে দীপঙ্কর বাইরের ঘরে চুপ করে তখনও বসে ছিল। সনাতনবাবুকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দীপঙ্কর তুলে দিয়েছিল। সেদিন লক্ষ্মীদির সেই দুর্ঘটনা না-ঘটলে হয়ত সনাতনবাবু থেকেই যেতেন শেষ পর্যন্ত। আরো কিছু কথা হতো সতীর সঙ্গে।
দীপঙ্কর বলেছিল—এদিকে আমি চলে যাচ্ছি কলকাতা ছেড়ে, আমাকে দিয়ে আপনাদের দু’জনের কোনও উপকারই হলো না সনাতনবাবু, আমি কিছুই করতে পারলুম না, অথচ আমি আপনাদের এই অশান্তির মধ্যে নিমিত্তের ভাগী হয়ে রইলুম কেবল—
সনাতনবাবু কথাটা শুনে হেসেছিলেন। বলেছিলেন—সংসারে অশান্তি যদি আমরা সৃষ্টি করতে চাই তো তার জন্যে নিমিত্তের কখনও অভাব হয় না দীপঙ্করবাবু —
দীপঙ্কর বলেছিল—তবু আমার নিজেকেই কেবল অপরাধী মনে হয়। মনে হয় সেই প্রথম দিন আমি বোধহয় আপনাদের বাড়িতে না-গেলেই পারতুম! আমি তখন কিছুই জানতুম না। ভাবতাম সতী খুব সুখেই আছে। তারপর কখন কেমন করে আপনাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলুম আজ আর তা মনে নেই। এদের দুই বোনের সঙ্গে আমার জীবন কেমন করে একাকার হয়ে গেল। কেমন করে সমস্ত কলকাতার সঙ্গেই আমি মিশে গিয়েছিলাম। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সরু গলিটা থেকে শুরু করে প্রিয়নাথ মল্লিক রোড ধরে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট, স্টেশন রোড, আর এই গড়িয়াহাটের সঙ্গে-সঙ্গে আমিও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলুম—সব যেন আজ আমার কাছে উপন্যাস বলে মনে হয়—
তারপর একটু থেমে হঠাৎ দীপঙ্কর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে বললে—আমার একটা শেষ অনুরোধ রাখবেন আপনি?
—শেষই তো! আমি চিরকালের মত এখান থেকে চলে যাবো, কলকাতা আর আসবো কিনা তারও কোনও ঠিক নেই। আপনি আমায় কথা দিন আমার একটা উপকার করবেন!
—বলুন কী উপকার?
দীপঙ্কর বললে—সতীকে আপনি সুখী করবেন, এর চেয়ে বড় কামনা আমার আর নেই। আমি জানি সতী আমার কেউ নয়, তবু মনে হয় অনেকের অনেক দুঃখ আমি দেখেছি, অনেকের অনেক অভাব আমি অনুভব করেছি, কিন্তু সকলের সব দুঃখ সব অভাবের মোচন আমি সতীর মধ্যে দিয়েই দেখতে চাই—
সনাতনবাবু তখনও হাসছিলেন। বললেন—সুখ আপনি কাকে বলেন? সুখের ডেফিনেশন কী আপনার আগে বলুন?
দীপঙ্কর বলেছিল—এ-সব কথা আমি আপনার মুখ থেকে অনেক শুনেছি এখন আর শুনবো না। ছোটবেলায় আমি সোক্রেটিসের একটা কথা পড়েছিলুম – To a good man no evil can happan. আমি চাই সোক্রেটিসের সেই কথাটা সত্যি হোক। আপনার কাছে আমার এইটেই শেষ অনুরোধ,–বলুন, আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন?
সনাতনবাবু শেষ পর্যন্ত কথা দিয়েছিলেন—আমি রাখবো—
—সতীকে সুখী করবেন!
—হ্যাঁ সুখী করবো!
বলে ট্যাক্সিতে ওঠবার সময় এ রহস্যময় হাসি হেসেছিলেন সনাতনবাবু। সেদিন সনাতনবাবুর সে হাসির মানে বুঝতে পারেনি দীপঙ্কর। পরে বুঝেছিল। অনেক পরে। তখন সতী সুখীই হয়েছিল। দীপঙ্কর সে-সুখের মানে না বুঝলেও সতী হয়ত সুখীই হয়েছিল। সনাতনবাবু সুখীই হয়ত করেছিলেন সতীকে। সনাতনবাবু তার অনুরোধ রেখেছিলেন বৈ কি!
সনাতনবাবু চলে যাবার পর দীপঙ্কর আবার লক্ষ্মীদির ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। দাতারবাবু তখনও লক্ষ্মীদির পাশে রয়েছেন। লক্ষ্মীদি তখনও কাঁদছে। সেইদিকে চেয়ে চেয়ে সতী যেন পাথর হয়ে গেছে তখন। কেন এমন কাজ করতে গেল লক্ষ্মীদি! যখন সনাতনবাবু আর সতী কথা বলছে এক মনে, তখন কখন যে লক্ষ্মীদি নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে খিড়কী দরজা দিয়ে এবোরে লেভেল ক্রসিং-এর গুটি-ঘরের নিচেয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউই জানতে পারেনি। অন্ধকার ঝস্সা। রাস্তার লোকরাও কেউ সন্দেহ করেনি। গেট-কীপার ভূষণও সন্দেহ করেনি।
রঘুই হঠাৎ আঁৎকে উঠেছিল প্রথম। সে-ই প্রথম খবর দিয়েছিল সতীকে। সতীও অবাক হয়ে গিয়েছিল। যে-মানুষ এতদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে, সে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যাবে!
সতী বলেছিল—নিশ্চয় ওপরে আছে লক্ষ্মীদি, ওপরের ঘরে দেখেছিস?
রঘু বলেছিল—দেখেছি দিদিমণি, কোথাও নেই——
তারপর যখন বাড়ির ভেতর কোথাও পাওয়া গেল না, তখন খোঁজ পড়লো বাইরে।
একেবারে রাস্তায়। রাস্তায় খুঁজতে খুঁজতে একেবারে লেভেল ক্রসিং-এর গুটি ঘরের মাড়ালে। তখন সিগ্ন্যাল ডাউন হয়ে গিয়েছে। ট্রেন এসে যাবে একটু পরেই। সেই অন্ধকারেই সতী গিয়ে লক্ষ্মদিকে ধরে ফেলেছিল। তারপর টানাটানিতে আরো অনেক লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। সনাতনবাবুও তখন আর কোনও সাড়া-শব্দ না-পেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন ট্যাক্সির খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে লেভেল ক্রসিং-এর কাছে এসে দেখলেন সবাই সেখানেই। আর তারপরেই দীপঙ্কর এসে পড়েছিল, দাতারবাবু এসে পড়েছিল। তখন এক মহা শোরগোল বেধে গিয়েছিল সেইখানে।
ভূষণ শুধু জিজ্ঞেস করেছিল একবার—এ কে হুজুর?
দীপঙ্কর শুধু বলেছিল—এ আমার জানাশোনা, তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না— তুমি ডিউটি করো—
কোথা থেকে সমস্ত কী হয়ে গেল! কিছুই যেন দীপঙ্করের অভিপ্রেত নয়। কিন্তু মানুষের অভিপ্রায়ের ধার ধারবে, মানুষের ঈশ্বর হয়তো এত পরনির্ভরশীল নয়। ইচ্ছে হোক অনিচ্ছে হোক কোথায় কোন অদৃশ্য শক্তির কাছে বার বার হার মানতে হয়েছে তাকে। তবু হার মানবার বেদনাকে সে স্বীকার করেনি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। প্রাণ-পণে অমোঘকে পরাজিত করার বাসনা নিয়ে বুক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। দীপঙ্করের যেন তাই হলো।
দাতারবাবুকে বললে—এখন ঘুমোচ্ছে লক্ষ্মীদি, এখন একটু বাইরে আসুন—
সতীও সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এল। বাইরে এসে সোজাসুজি দাতারবাবুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। বোনের স্বামীকে এই প্রথম ভালো করে দেখবার সুযোগ পেলে। হঠাৎ বললে—আপনিই সেই?
এতক্ষণে যেন দাতারবাবুও সতীর দিকে চেয়ে দেখবার ফুরসৎ পেলে। দুই হাত তুলে বললে—নমস্কার—আমি আপনাকে এতক্ষণ চিনতে পারিনি—আমায় ক্ষমা করবেন!
সতী আরো গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—এত কান্ডর পরেও আপনার লজ্জা হচ্ছে না? আপনি কি মানুষ?
দাতারবাবু বোধহয় হঠাৎ এই আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। বললে—সব দোষ আমি স্বীকার করছি আজ, আমার অন্যায় হয়েছে, আমি ক্ষমারও যোগ্য নই মিসেস ঘোষ—
সতী বললে–আপনি যদি জানতেন আপনি আমাদের সংসারের কী ক্ষতি করেছেন, তাহলে আজ একথা বলতে আপনার মুখে বাধতো! আপনি যদি সেদিন ধূমকেতুর মত আমার লক্ষ্মীদির জীবনে হাজির না হতেন তাহলে হয়ত তার জীবনও এমন নষ্ট হতো না, আমার জীবনও আজ এমন নিষ্ফল হতো না—! আপনি জানেন যে আপনি আমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছেন!
—তাই তো ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে।
সতী ঝাঁজিয়ে উঠলো—আবার ক্ষমা করার কথা বলছেন! রেঙ্গুনের সেই সব দিনের কথা ভাবুন তো! আপনাকে আমি সেদিন সাবধান করে দিইনি? বলিনি যে আমার দিদির সঙ্গে আপনি মিশবেন না, আমার দিদিকে আপনি চিঠি দেবেন না? বলিনি? সাবধান করে দিইনি আপনাকে?
দাতারবাবু এ-কথার কোনও উত্তর দিতে পারলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। দীপঙ্করের মনে হলো দাতারবাবু বুঝি আবার আগেকার মত পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু সতী ছাড়বার পাত্রী নয়। এতদিন পরে এত বছর পরে যখন সামনে পেয়েছে তখন সে যেন তার প্রতিশোধ নেবে বলেই প্রতিজ্ঞা করেছে। বললে—তবু আপনি বার বার দিদিকে চিঠি দিতেন, বার বার দিদির সঙ্গে দেখা করতেন—তার উদ্দেশ্যও কি ছিল এই এইজন্যেই আপনি আমাদের কারোর ভালো চাননি? এমনি করে আমাদের দু’জনকে পথে বসিয়ে আপনি কার্ কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করলেন? নিজেরই বা কী ভালোটা হলো আপনার?
দাতারবাবু এতক্ষণে ক্ষীণ সুরে কথা বললে—আপনি আমাকে আরো কিছু বলুন, আরো গালাগালি দিন,
—আপনাকে গালাগালি দিলে যদি আমাদের সব কষ্টের লাঘব হতো তো গালাগালি দিতেও আমি পেছপাও হতাম না। কিন্তু জিজ্ঞেস করি, কী সুখটা পেলেন আপনি আমাদের এই সর্বনাশ করে! দিদিই বা আপনার কাছে কী অপরাধ করেছিল, আর আমিই বা আপনার কাছে কী দোষ করেছিলুম, বলতে পারেন?
বলতে বলতে সতীর গলা ক্রমেই করুণ হয়ে উঠলো। অভিযোগ নয় এবার, যেন অনুযোগ। যেন নিজেকেই ধিক্কার দিতে লাগলো সতী। বললে—আপনাকে এড়াবার জন্যে দিদি কলকাতায় এল, যাতে আপনি না জানতে পারেন তাই কালিঘাটের গলির মধ্যে বাড়ি-ভাড়া নেওয়া হলো, তবু সেখানেও আপনি কেমন করে দিদিকে খুঁজে বার করলেন, তা ভগবান জানেন! আপনি কি জানেন যে আজ যে শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাকে চলে আসতে হয়েছে তার জন্যেও আপনি দায়ী?
দাতারবাবু বললে—সে শাস্তি আমি নিজেও পাচ্ছি মিসেস ঘোষ!
—আপনি আমাদের তুলনায় কতটুকু শাস্তি পাচ্ছেন, শুনি?
দাতারবাবু তেমনি মাথা নিচু করে বললে—আমার ছেলে আজ খুনের আসামী, তার বোধহয় ফাঁসীই হবে —
সতী রুখে উঠলো—হোক, ফাঁসি হোক, আপনার সঙ্গে যারা মিশেছে, আপনার সংস্রবে যারা এসেছে তাদের সকলের ফাঁসি হোক, তাতেও আমার তৃপ্তি হবে না। আপনার ফাঁসি হলেও আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল বেরুবে না। আমার দিদির ফাঁসি হোক, আমারও ফাঁসি হোক। আমাদের সকলকে ফাঁসি দেয় না কেন বলতে পারেন? আপনার নিজের জীবন নষ্ট হয়েছে, আমাদের জীবন আপনি নষ্ট করেছেন, আর এই দীপু, এই দীপু আমাদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে—এরও জীবন আপনি নষ্ট করেছেন তা জানেন?
দাতারবাবু দীপঙ্করের দিকে চেয়ে হাত জোড় করে বললে—আমাকে তুমি ক্ষম করো দীপুবাবু, —
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি দাতারবাবুর হাত দুটো নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরলে।
সতী বললে—আজ আপনার ছেলের ফাঁসি হবে বলে আমাদের কাছে সহানুভুতি চাইছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, আপনার ছেলের ফাঁসি হবে না তো ফাঁসি কার হবে : তার আত্মসম্মানবোধ ছিল, তার আত্মমর্যাদা ছিল, তাই তার ফাঁসি হচ্ছে, আর আপনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত ব্যাভিচারের সঙ্গে আপোষ করেছেন, তাই আপনি এখনও ভদ্দরলোক সেজে বেড়াচ্ছেন! ফাঁসি তো আপনাদের হবে না, ফাঁসি হয় তাদের যারা সত্যি কথা বলে, যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, যারা অত্যাচারের প্রতিকার করতে চায়!
দীপঙ্কর এতক্ষণে একটু প্রতিবাদ করতে গেল। বললে—থাক সতী, তুমি ভেতরে যাও, লক্ষ্মীদির কাছে গিয়ে বোস একটু—
—কেন থামবো? কেন ভেতরে যাবো? এতদিন পরে মুখোমুখি পেয়েছি, আমি ছেড়ে দেব বলতে চাও? আমার বাবা কি কম কষ্ট পেয়েছেন এই ভদ্রলোকের জন্যে? আমার বাবার মৃত্যুর জন্যেও তো এই ভদ্রলোক দায়ী! এতগুলো মৃত্যু ঘটিয়ে আপনার কী লাভটা হলো? কী সুখটা ভোগ করতে পারলেন? এতগুলো মৃত্যু ঘটিয়ে এখন আপনি আমাদের সহানুভূতি আদায় করতে এসেছেন?
দাতারবাবু বললে—আমার ছেলের যা-হোক একটা কিছু হয়ে যাক, তারপর আমি এর জবাব দেব —
সতী বললে—কিন্তু আপনার ছেলে একটা খুন করে চুপ করে গেল কেন? আপনাকেও খুন করতে পারলে না সে? তার রিভলবারে আর একটা গুলীও বাড়তি ছিল না? তার মাকেও মেরে শেষ করতে পারলো না সে?
দাতারবাবু বললে—এর চেয়ে হয়ত তাই করলেই আরো ভালো হতো! তাতে আমিও হয়ত একটু শান্তি পেতাম!
সতী বললে—কিন্তু শান্তি তো আপনি চাননি! আমি আপনাকে সাবধান করে দিয়েছি, আমার বাবাও আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তবু তো আপনার চৈতন্য হয়নি?
দাতারবাবু যেন ক্রমেই মুষড়ে পড়ছিল। নিজের অসংখ্য ঝঞ্ঝাটের ওপর সতীর এ কথাগুলো তাকে যেন আরো পীড়িত করে তুললো। বললে—কিন্তু এখন আমি কী করতে পারি বলুন? আমি আপনার সামনে আমার মাথা পেতে দিচ্ছি, আপনি যা ইচ্ছে করুন আমাকে নিয়ে! ওদিকে আমার ছেলের মামলা, আর এদিকে আমার স্ত্রীর এই অবস্থা। আমি একদিনের জন্যে শুধু আমার স্ত্রীকে দেখতে এসেছিলুম, আমি আবার কালই ফিরে যাবো বলে এসেছি, এখন আমাকে কী করতে হবে, বলুন?
সতী বললে—কাল নয়, আপনি আজই যান, লক্ষ্মীদিকে আমি একলাই দেখতে পারবো, এবাড়িতে আপনার আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না।
দীপঙ্কর এবার এগিয়ে গেল। বললে—সতী, কী বলছো তুমি?
—তুমি থামো দীপু, আমি ঠিক বলছি, আর এ মুহূর্তও এঁর এখানে থাকা চলবে না!
—তুমি অবুঝ হয়ো না। মাথা গরম করে তুমি কী বলছো তার মানে জানো না।
সতী বললে—আমার মাথা যদি গরম হতো দীপু, তাহলে এর আগেই আমি অনেক কান্ড করে বসতুম। এখনও আমার মাথা ঠান্ডা আছে, এখনও মাথা ঠান্ডা আছে বলেই আমি লক্ষ্মীদির মত রেলের চাকায় মাথা দিতে যাইনি। নইলে এতদিন আমাকে দেখতেই পেতে না এখানে। এই বাড়িতে দিনের পর দিন রাতের পর রাত একলা কাটিয়েছি, রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ট্রেনের চাকার শব্দ শুনেছি, আর নিজের জীবনের কথা ভেবেছি। পাগল যে হয়ে যাইনি, সেও মাথা ঠান্ডা রেখেছি বলে। মাথা গরম আর যারই হোক আমার হবে না।
দাতারবাবু বললে—কিন্তু আজ একটা রাত আমাকে থাকতে দিন আমার স্ত্রীর কাছে—আমি কথা দিচ্ছি কালই চলে যাবো দিল্লিতে—
সতী হেসে উঠলো—এতদিন পরের বিছানায় নিজের স্ত্রীকে শুতে দিতে তো আপত্তি হয়নি আপনার? তখন তো কোনও দুর্ভাবনাই হয়নি আপনার মনে? তখন তো নিজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন? আর আজ স্ত্রীর জন্যে এত দুশ্চিন্তা?
দাতারবাবু যেন চমকে উঠলো। নিজের পরাজয়ের কলঙ্ক যেন এমন করে এর আগে কখনও পরের চোখে ধরা পড়েনি। একটা কথাও মুখ দিয়ে সরলো না। শুধু ফাঁকা দৃষ্টিতে হাবার মত চেয়ে রইল।
দীপঙ্করের আর সহ্য হলো না। বললে—দাতারবাবু আপনি ভেতরে যান, লক্ষ্মীদি একলা রয়েছে, ভেতরে যান—
তারপর দাতারবাবুকে হাত ধরে ভেতরে পাঠিয়ে দিলে। ফিরে এসে দীপঙ্কর আর একটাও কথা বলতে পারলে না। সন্ধ্যের ঘটনার পর থেকেই যেন এ-বাড়ির রুটিন-বাঁধা জীবনে একটা ছেদ পড়েছে। প্রতিদিন এখানে দীপঙ্কর আসে আর প্রতিদিন পাশাপাশি বসে থাকে দু’জনে। আজ আর যেন কোনও কথা বলবার নেই। আজ লক্ষ্মীদির দুর্ঘটনার পর সব যেন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। সনাতনবাবু এসে ফিরে গেছেন রিক্ত হাতে। আর দু’দিন পরে দীপঙ্করকেও কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে। জীবনে কোথাও যেন সামঞ্জস্য ছিল না। সতী তখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। দীপঙ্কর সেদিকে না তাকিয়ে সোজা সদর-দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই পেছন থেকে সতী বললে—কোথায় যাচ্ছো?
দীপঙ্কর ফিরে দাঁড়াল। বললে—এবার যাই—
—না শোন!
দীপঙ্কর আবার ভেতরে এসে দাঁড়াল। সতী বললে—আজ উনি এসেছিলেন—
দীপঙ্কর বললে—জানি!
—আমাকে আবার নিয়ে যেতে এসেছিলেন!
দীপঙ্কর বললে—তাও শুনেছি।
সতী বললে—তুমি শুনেছ তা আমি জানি। আমি তোমাকে সে-জন্যে ডাকিনি! ডেকেছি অন্য কারণে! তুমি এত টাকা কোথা থেকে পেলে?
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। সতীর মুখের দিকে সোজা মুখ তুলে চাইলে।
সতী আবার বললে—বলো, তুমি এত টাকা কোথা থেকে পেলে? তুমি কি ভেবেছ তুমি আমার জন্যে শাশুড়ীকে টাকা দিয়ে আমায় ঋণী করে রাখবে? বলো, উত্তর দাও?
দীপঙ্কর তবু উত্তর দিতে পারল না।
সতী বললে—তোমার সামনেই তো আমি সেদিন বলেছিলুম যে, ঘুষ দিয়ে আমি শাশুড়ীর স্নেহ স্বামীর ভালবাসা পেতে চাই না, তবে জেনেশুনে কেন আমার এ- অপমানটা করলে? আমার মুখ এমনভাবে পোড়াতে হয়?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কে এ-সব বললে তোমাকে?
সতী বললে—যে-ই বলুক, তিনি আর যাই করুন, মিথ্যে কথা বলেন নি! কিন্তু এই সস্তা মহত্ত্ব দেখাতে কে তোমাকে বলেছিল? এ-বাহাদুরি দেখিয়ে আমার কী ভালোটা হলো?
দীপঙ্কর বললে—না দিলে সনাতনবাবুরা রাস্তায় এসে দাঁড়াতেন।
—ওঁরা রাস্তায় দাঁড়ান বা না-দাঁড়ান তাতে তোমার কীসের মাথা-ব্যথা?
দীপঙ্কর বললে—সে তুমি বুঝবে না!
—তবু একবার বুঝিয়েই দেখ না, বুঝতে পারি কি না!
দীপঙ্কর বললে—এত বছর ধরে আমার সঙ্গে এত মেলামেশার পরেও যদি বুঝতে না পেরে থাকো তো আর বুঝে দরকার নেই। আমি যাই—
সতী সামনে পথ আটকে দাঁড়াল বললে-আমার কথার জবাব না দিয়ে তুমি পার পাবে না। বলো, তোমাকে বুঝিয়ে বলতেই হবে। অনেক দিন ধরে অনেক অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছি, তবু তোমার এই হেঁয়ালি আমার কাছে আজো স্পষ্ট হয়নি। বলো, কেন তুমি এত টাকা ওঁদের দিতে গেলে? তোমার এতে কীসের স্বার্থ? তুমি কী চাও আমার কাছে?
দীপঙ্কর চাইলে সতীর দিকে। ঘৃণায় যেন সমস্ত মুখটা কুঁচকে উঠলো! বললে — ছিঃ, পথ ছাড়ো—
সতী পথও ছাড়লো না, মুখও নামালো না। বললে—তুমি তো কলকাতা ছেড়ে চলেই যাচ্ছো?
দীপঙ্কর বললে— হ্যাঁ, সে তো পুরনো খবর!
—কিন্তু কেন চলে যাচ্ছো? কীসের ভয়ে? ভেবেছ আমি তোমার কোনও ক্ষতি করবো?
দীপঙ্কর বললে—ক্ষতি! ক্ষতি তো আমিই করেছি তোমার এতদিন!
—তাই বুঝি এখন ছেড়ে চলে যাচ্ছ আমাকে জব্দ করবে বলে?
দীপঙ্কর বললে-আমি এ-কথার উত্তর দেব না।
—তা উত্তর যদি না দেবে তো কেন টাকা দিতে গেলে ওঁদের? কেন ওঁদের এমন করে বাঁচালে? ওঁদের বাঁচিয়ে তোমারই বা কী লাভ হলো আর আমারই বা কী ভালো হলো? বলো, উত্তর দাও।
দীপঙ্কর চুপ করে রইল। কোনও উত্তর তার মুখ দিয়ে বেরোল না।
সতী হঠাৎ দীপঙ্করের কোটের কলারটা চেপে ধরলো। বললে—বলো, চুপ করে থেকো না, উত্তর দাও—
দীপঙ্করের সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগলো। এক মুহূর্তে তার সমস্ত জীবনটা পরিক্রমা করে এল সে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, সেই ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট, সেই ধর্মদাস মডেল স্কুল, সেই প্রানমথবাবু, সেই মিস্ মাইকেল, সেই কিরণ, সেই লক্ষ্মীদি দাতারবাবু, সমস্ত কিছু যেন এক মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সারা জীবন ধরে সে তো একটা জিনিসই জানতে চেয়েছে। কেন মানুষ দুঃখ পায়, কেন ভালোর এত যন্ত্রণা, কেন সত্যের এত লাঞ্ছনা! তাহলে এই-ই কি তার উত্তর? এই সতীই কি তার মূর্তিমতী জবাব?
—বলো, জবাব দাও, কেন ওঁদের তুমি টাকা দিতে গেলে? চুপ করে থেকো না, বলো—
দীপঙ্কর চাইলে সতীর দিকে। বললে—তোমাকে সুখী দেখতে চাই বলে!
সতী হঠাৎ কোটের কলার থেকে হাতটা ছেড়ে দিলে। তার চোখ দুটো যেন হঠাৎ বড় কালো হয়ে উঠলো!
তারপর জিজ্ঞেস করলে—কোত্থেকে টাকা পেলে তুমি?
দীপঙ্কর কোনও জবাব দিলে না।
সতী বললে—বলো, এত টাকা কোত্থেকে পেলে?
দীপঙ্কর বললে—ধার করেছি!
ধার! সতী যেন চমকে উঠলো। এত টাকা ধার করেছে দীপু তার জন্যে! এ যে অনেক টাকা!
—এ ধার শোধ করবে কেমন করে? কত দিনে শোধ করবে?
—সে যেমন করে হোক আমি শোধ করবো! তোমাকে ভাবতে হবে না! আমাকে যেতে দাও—
সতী বললে—না, আমাকে ঋণী রেখে তুমি আমাকে জব্দ করবে, তা হবে না। তোমার এ-ধার আমি শোধ করে দেব, আমি সব টাকা দিয়ে দেব তোমাকে, তুমি আমার জন্যে মনে-মনে বাহাদুরি নিতে পারবে না।
দীপঙ্কর বললে—তা হয় না। ইচ্ছে হলে তুমি তোমার শাশুড়ীকে দিও, তাঁর উপকার হবে তাতে—
সতী বললে—তা দিলে আগেই দিতে পারতুম! তুমি আজই এ-টাকা নিয়ে যাও—
দীপঙ্কর বললে—তা হয় না—
সতী বললে—খুব হয়, তুমি আমাকে টাকা দিয়ে কিনে রাখবে, তাও আমি সহ্য করবো না। তোমাকে টাকা নিতেই হবে —
দীপঙ্কর তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সতী বললে—তোমার পায়ে পড়ি দীপু। এত বড় অপমান আমাকে কোর না, টাকা নিয়ে তুমি আমাকে আমার অপমান থেকে বাঁচাও, আমি এখনি চেক-বই নিয়ে আসছি, তুমি টাকা না নিলে রাত্রে আমার ঘুম হবে না—তোমার পায়ে পড়ি দীপু, তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এখনি আসছি—
বলে তাড়াতাড়ি সতী ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল। ঘরের আলমারি খুলে তাড়াতাড়ি দুটো ব্যাঙ্কের পাস বই নিয়ে আবার আলমারিটা বন্ধ করলে। পাশেই লক্ষ্মীদির ঘর। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল লক্ষ্মীদি বিছানায় শুয়ে আছে আর দাতারবাবু তার পাশেই একটা চেয়ারে বসে মাথায় হাত বুরিয়ে দিচ্ছে। সতী তাড়াতাড়ি আবার বাইরের ঘরে এসে ঢুকলো। কিন্তু, দীপু কোথায়! সদর দরজাটা খোলা। সতী একবার এদিক ওদিক চাইলে। কোথাও নেই। তারপর সদর দরজা পেরিয়ে বাইরের সিঁড়ির ওপর গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলে। ব্ল্যাক-আউটের অন্ধকার চারদিকে। সতী ডাকলে—দীপু—দীপু—
তারপর সেই অন্ধকার রাস্তা দিয়েই লেভেল ক্রসিং-এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। দীপু—দীপু—
দীপঙ্কর তখন সতীর নাগালের বাইরে সুদূর গ্রহ-নক্ষত্র অতিক্রম করে উর্ধ্বশ্বাসে পা চালিয়ে চলেছে। অন্ধকারের আড়ালে সে তখন নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলেছে।