কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৮
৮৮
সেদিন মাসীমা জেগে বসে ছিল। রোজ রোজ রাত করে আসে দীপু। এত কাজ তার কীসের—সেই কথাটাই জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল। প্রত্যেক দিন দীপু যখন বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে তখন ঘুমে চোখ ঢুলে আসচে মাসীমার। সারা দিন সংসারের কাজে আর বিশ্রাম পায় না মাসীমা। কাজও তো একটা নয়। ছোট সংসার হলে কি হবে। একদিন এই মানুষই রোগী স্বামীর সেবা করেছে, কিরণকে ইস্কুলের ভাত করে দিয়েছে, রান্না করেছে, বাসন মেজেছে, ঘর-দোর-উঠোন সব ঝাঁট দিয়েছে—আবার সব কাজের ফাঁকে পৈতের সুতোও কেটেছে। সুতো না কাটলে চলতো না। মাসীমা ভাবতো চাকর- ঝি থাকলে তার কাজ কমে যেত অনেক। কিন্তু এখন দীপুর বাড়িতে আসার পর চাকর- ঝি থাকা সত্ত্বেও কাজও বেড়ে গেছে। অথচ ক্ষীরিই তো বেশি কাজ করে। রান্না করা থেকে শুরু করে পরিবেশন করা-টরা সব কিছু। ঘর-ঝাঁটাও দিতে হয় না, বাজার করতেও হয় না—তার জন্যে কাশী আছে। বাসন-মাজা কাপড়-কাচা কয়লা-ভাঙার জন্যে ঝি-ও রেখে দিয়েছে দীপু। আসলে কোনও কষ্টই রাখেনি দীপু। কিন্তু তবু দিতে পারবে না ঠিক মত। এক-এক সময় মাসীমার মনে হয় ঝি-চাকর না-থাকলেই যেন ভালো হতো। তাহলেই যেন স্বস্তি পেত মাসীমা। তাই সন্ধ্যে হতে-না-হতেই মাসীমা আর থাকতে পারে না। চোখ দু’টো ঢুলে আসে।
হঠাৎ যেন গায়ে ঠেলা লাগলো। ক্ষীরোদা ঠেলছে। মাসীমা জেগে উঠলো। কে এল? ডাকছিস কেন মা?
ক্ষীরোদাও কিছু কথা বলে না। মুখপুড়ী যেন দিন-দিন বোবা হয়ে যাচ্ছে।
—কে ডাকছে? কী হলো কী?
তখন হঠাৎ খেয়াল হলো রাত অনেক হয়েছে। সদর দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে।
–তা দরজাটাও খুলে দিতে পারিস না তুই মুখপুড়ী?—বলতে বলতে মাসীমা নিজেই উঠলো। তারপর সদর-দরজা খুলতেই দেখে দীপু। দীপঙ্করের চেহারা দেখে মাসীমা যেন থমকে দাঁড়াল। ইচ্ছে ছিল অনেক কথা বলবে। কিন্তু চেহারা দেখে একটু পিছিয়ে এল।
মাসীমা জিজ্ঞেস করলে—তোমায় একটা কথা বলবো বাবা দীপু?
দীপঙ্কর একটু অবাক হয়ে গেল। বললে—কী মাসীমা?
—আমি তোমাকে ধরবো বলেই জেগে বসে আছি। বলি, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও? আমার গলায় পা দিয়ে আমার পিন্ডি চট্কাতে চাও?
দীপঙ্কর বললে—ছি ছি মাসীমা, আপনি আমার মায়ের মতন, আপনি এ-সব কী বলছেন?
—তা বলবো না? তোমার কি মায়া দয়া কিছু থাকতে নেই? দুটো খেতে পরতে দিচ্ছ বলে কি একেবারে মাথা কিনে নিয়েছ? সংসারে খেতে-পরতে দেওয়াটাই কি সব? তুমি না খেতে দিলে কি আমরা কেউ বাঁচতুম না? তুমি মনে করেছ কী? তুমি মনে করেছ সারা দিন-রাত তুমি আপিস নিয়ে থাকবে আর আমরা তোমার ভাত জুগিয়ে যাবো? তোমার আপিসের জন্যেই আমরা আছি?
—কিন্তু মাসীমা……
—তুমি থামো। তোমার অনেক কৈফিয়ৎ শুনিছি, সেই সকাল বেলা আপিসে বেরিয়ে যাও, আর রাত পুইয়ে বাড়ি আসো, সংসারে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, আমরা বেঁচে আছি কি মরে গেছি, তার খোঁজ নেবারও একবার দরকার নেই? চারদিকে কত কি কান্ড চলেছে, বোমা পড়ছে, চালের দোকানে চাল দিচ্ছে না, এ-সব তো তোমারও দেখতে হয়। আপিস কি আর কেউ করে না? তুমি ভেবেছ কী বলো তো? তোমাকে আজ বলতেই হবে। তোমাকে ধরবো বলেই আমি আজ জেগে বসে আছি—
দীপঙ্কর যেন এতদিনে ধরা পড়ে গেছে হাতে-নাতে। যেন তার সব অপরাধ মাসীমা ধরে ফেলেছে। বললে-মাসীমা আপনি আমায় মা করুন, আমি অনেক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছি—
মাসীমার মুখটা হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেল। মাসীমা যেন এতক্ষণে অযথা না-জেনে তার দীপুর মনে ব্যথা দিয়ে ফেলেছে। বললে-তোমার আবার ঝঞ্ঝাট কীসের বাবা? তুমি খঅও-দাও আপিস যাও, আর আপিস থেকে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়ো, তোমার কীসের ঝঞ্ঝাট শুনি?
দীপঙ্কর কিছু বলতে পারলে না। বললেও হয়ত মাসীমা বুঝতে পারবে না। আর বোধহয় সবটা বলবার মতও নয়। সতী, লক্ষ্মীদি, দাতারবাবু, সনাতনবাবুর জন্যে তার এত ভাবনার মানে বুঝতে পারবে না হয়ত মাসীমা। আর শুধু কি তারাই? কিরণ? কিরণের কথাও তো মাথার মধ্যে ভারি হয়ে চেপে আছে সব-সময়। একটা বন্ধ সেলের মধ্যে বসে কিরণ প্রতি-মুহূর্তে ফাঁসির হুকুমের প্রতীক্ষা করছে। সে ব্যাপারে দীপঙ্করের কিছু করবারও নেই। সে-সব কথাই বা মাসীমাকে কেমন করে বলা যায়। নিজের মা যাকে ভুলে গেছে, দীপঙ্কর কেন তাকে ভুলতে পারে না কিছুতেই? এ কেন হয়? কেন এমন হয়—দীপঙ্কর তা বুঝতে পারে না। আর পাঁচজন যেমন সংসারে খায়-দায়-ঘুমোয়- চাকরি করে, বিয়ে করে, তারপর একদিন বুড়ো হয়ে মারা যায়, দীপঙ্কর তেমনি করেই জীবন কাটাতে পারে তো! কেন তা হয় না?
মহাত্মা গান্ধী সেদিন ছাড়া পেয়েছেন। তাঁকে একলাই আগা খাঁ প্যালেস থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লী থেকে প্রেস-কমিউনিক্ বেরিয়েছিল—
In view of the medical reports of Mr. Gandhi’s health, Govt. have decided to release him unconditionally. The release takes place at 8 p.m May 6, 1944.
খবরটা বেরোবার পর থেকেই দীপঙ্করের মনে হয়েছিল একবার মহাত্মাজীর সঙ্গে দেখা করে কিরণের কথা বলবে। বলবে—আপনি ভারতবর্ষের পিতা, সমস্ত লোক তাদের মুক্তির জন্যে আপনার দিকেই চেয়ে আছে। আপনার মতন আরো একজন মানুষ ফাঁসির দিন গুনছে জেলখানায়। সেও ইন্ডিয়ার ভালো চেয়েছিল। সেও আপনার মত নিজের বাবা, নিজের মা, নিজের শরীর, নিজের লেখাপড়া, নিজের স্বার্থ, কিছুর কথাই ভাবেনি। সে ইন্ডিয়ার লোকদের জন্যেই আজ জেলখানায় পচছে। আপনি জওহরলাল নেহরুর কথা ভাবছেন। আপনি আবুল কালাম আজাদ, বল্লভভাই প্যাটেলের কথা ভাবছেন, আপনি সারা ভারতবর্ষের কথা ভাবছেন, বলতে গেলে আপনি সারা পৃথিবীর কথাই ভাবছেন। কিন্তু কিরণের কথা ভাববার যে কেউই নেই। তার আমিও নেই। আমি সতীর কথা, লক্ষ্মীদির কথা ভাবি, তার কথা ভাবিই না। তার মা-ও তার কথা ভাবে না। নিজের বিধবা মা-ও তার কথা ভুলে গেছে। যাদের নাম খবরের কাগজে রোজ বেরোয়, তাদের কেউ-ই নয় সে। তার নাম ইতিহাস থেকে একদিন মুছেই যাবে। আপনার সঙ্গে লর্ড ওয়াভেলের চিঠি-পত্র চলছে, আপনি অনেক কথাই লিখেছেন তাতে, এবার কিরণের হয়ে কিছু লিখুন। তার মা’কে আমার বাড়িতে এনে তুলেছি। তার মা জানেও না যে সে জেলের ভেতর ফাঁসির আসামী। আমি সে খবর দিইনি। দিতে পারিনি। কিরণের ফাঁসি বন্ধ হলে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোনও ক্ষতি হবে না। ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট যদি না ঢেঁকে তো কিরণকে ফাঁসি না দিয়েও টিকবে না।
এমনি অনেক কথা, অনেক ভাবনা মাথার মধ্যে জোট-পাকিয়ে থাকে। কিন্তু দীপঙ্করের কিছুই করবার নেই। দীপঙ্কর মাসীমার মুখের সামনে যেতেই ভয় পায়। যদি মাসীমা জানতে পারে। যদি এতটুকু আভাস পায়। মাসীমাকে দেখলেই তাই দীপঙ্কর এড়িয়ে এড়িয়ে বেড়ায়। কিন্তু আজ সেই জন্যেই একেবারে মাসীমার মুখোমুখি পড়ে যাওয়াতে প্রথমে চমকে উঠেছিল। কিরণের ফাঁসির খবর মাসীমা জানতে পেরেছে নাকি?
মাসীমা আবার বলতে লাগলো-আর আমার কথা একবার ভাবো দিকিনি? আমি কি ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়ে আমার সংসার করেছি? তুমি তখন ছোট, সে-সব কথা হয়ত তোমার মনেও নেই—। আর পরম শত্তুরেরও যেন তেমন ঝঞ্ঝাট না আসে। তার তুলনায় তুমি তো ভাল আছো বাবা! একে তুমি বলো ঝঞ্ঝাট? এইটুকু ঝঞ্ঝাটেই তুমি হয়রান হয়ে যাচ্ছো?
দীপঙ্কর বললে—না মাসীমা, আপনি সে-সব বুঝবেন না—
—আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকলো, ও-সব বুঝেও দরকার নেই। কিন্তু যে রাঁধে সে কি আর চুল বাঁধে না? যে আপিস করে সে কি আর সংসার করে না?
দীপঙ্কর বললে—এবার তো আমি চলে যাচ্ছি মাসীমা, আপনাকে তো বলেছি—
-–তা বাবা, তোমার চাকরির উন্নতি হোক, তাতে তো আমি কিছু বলিনি, কিন্তু আমাদের তুমি এভাবে আর ঝুলিয়ে রেখো না, আমাকে তুমি আবার সেই নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের বস্তিতে রেখে এসো, আমি সেখানে আরামে থাকবো। এর চেয়ে আরামে থাকবো।
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু সন্তোষকাকার মেয়ে একলা এখানে থাকবে, তার কথাটাও তো ভাববেন একবার! তাকে কে দেখবে?
মাসীমা বললে—তার কথা আমি ভাববার কে? আমার পেটের মেয়ে সে, না আমার নিজের কেউ? আমার নিজের ছেলে কথা বলে আমি ভাবি না, আর আমি ভাবতে যাবো পরের মেয়ের কথা? তার বিয়ে হলো না-হলো তা নিয়ে আমার কীসের মাথা-ব্যথা? সে- ই বা আমার কে, আর আমিই বা তার কে? আমি মলে ওই মেয়ে কি আমার মুখোগ্নি করবে যে তার কথা আমি ভাববো?
দীপঙ্কর বললে—মাসীমা, আজকে অনেক রাত হয়ে গেল, কাল এ-সব কথা ভাবা যাবে—
মাসীমা বললে—না, কাল-কাল করে অনেকদিন কাটিয়েছি, আর কাল করবো না। আজই বা হোক একটা হেস্ত নেস্ত করতে হবে তোমাকে—
—কিন্তু আমি কী করবো আপনি বলুন? আমি তো দু’দিন বাদেই চলে যাচ্ছি। আপনি যা বললেন তা-ই করবো!
—কিন্তু আমি বলবো তবে তুমি করবে? তোমার নিজের একটা বুদ্ধি-বিবেচনা নেই?
দীপঙ্কর কী যেন ভাবলে খানিক। তারপর বললে—আচ্ছা মাসীমা, আমি কালই সব ঠিক করে ফেলবো!
—কী ঠিক করবে কাল?
—সন্তোষকাকার মেয়ের বিয়ের একটা যাহোক ব্যবস্থা করে ফেলবোই!
কথাটা শুনে মাসীমা যেন কেমন অবাক হয়ে গেল। এতদিনে যা হলো না, তাই হবে কাল? কালকের মধ্যেই? মাসীমা যেন কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিল আর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের বারান্দায় কী যেন একটা পড়ে যাবার শব্দ হলো। চমকে উঠলো মাসীমা। কী হলো? কী পড়লো ওখানে? কে?
তাড়াতাড়ি দৌড়ে ঘরের বাইরে এসেছে মাসীমা। দীপঙ্করও এসেছে। ঠিক সিঁড়ির গোড়ায়। ক্ষীরোদা সেখানে পড়ে অচৈতন্য হয়ে আছে। ওমা, এ যে আমার ক্ষীরি। হ্যাঁ মা, তুই এখানে এমন করে পড়ে গেলি কেন? কী হলো তোর? অন্ধকারে বুঝি ঠাহর করতে পারিস্ নি? দেখ্ তো কান্ড! আলোটা জ্বেলে আসতে হয় তো?
তাড়াতাড়ি মাসীমা ধরে তুলতে গেল ক্ষীরোদাকে। কিন্তু ক্ষীরোদা তখন অজ্ঞান- অচৈতন্য। মাসীমা তাড়াতাড়ি ক্ষীরোদার গায়ের কাপড়টা ঠিক-ঠাক করে দিলে। বললে—ওমা, এ যে একেবারে জ্ঞান নেই বাবা, একটু জল আনো তো, মাথায় দিই—
কাশী তখন ভেতরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে, দীপঙ্কর সেই অবস্থাতেই চৌবাচ্চা থেকে এক মগ জল এনে দিলে। মাসীমা সেই জল মাথায় থাড়ে দিতে লাগলো। মাসীমা কী যে করবে বুঝতে পারলে না।
দীপঙ্কর বললে-একজন ডাক্তার ডেকে আনবো মাসীমা?
মাসীমা বললে—না বাবা, তুমি এখন যাও, আমি বুঝিছি—
মাসীমা কী বুঝলে কে জানে। দীপঙ্কর বললে—যদি কিছু খারাপ হয়, তখন?
—সে-সব তোমাকে ভাবতে হবে না বাবা, তুমি এখান থেকে সরো দিকিনি। তুমি অনে ভেবেছ আমাদের জন্যে, আর তোমাকে ভাবতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে—এখন যাও এখান থেকে! খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো গে—
দীপঙ্কর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওপরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে ক্ষীরোদার যেন একটু জ্ঞান হবার মত হলো। চোখ তুললো। চোখ তুলেই মাসীমাঝে দেখে নিজের গায়ের কাপড়টা একটু টেনে আব্রু দেবার চেষ্টা করলে। মাসীমা মুখ নিচু করে বললে—কী হয়েছে মা? কী হয়েছিল তোমার? পড়ে গিয়েছিলে কেন? অন্ধকারে পা পিছলে গেছলো? ক্ষীরোদার যেন এতক্ষণে হুঁশ্ হলো। উঠে বসতে গেল। তারপর এদিক-ওদিক চেয়ে কাকে যেন খুজতে লাগলো।
মাসীমা বললে—কাকে খুঁজছো মা? কেউ নেই এখানে। শুধু আমি আছি আর দীপুকে ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমার কোনও ভয় নেই। এখন কেমন বোধ করছো? মুখ নিচু করে মাসীমা প্রশ্ন করছিল। ক্ষীরোদা মাসীমার কথার কোনও উত্তর দিলে না। যেন উত্তর দিতে গিয়ে তার দু’চোখ বেয়ে ঝর-ঝর করে করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মাসীমা দেখতে পেয়েছিল। আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললে— ছিঃ, কাঁদে না, কাঁদতে নেই——
তারপর বললে—চলো মা তোমাকে ঘরে নিয়ে যাই, আস্তে আস্তে চলো, আমি ধরিছি—
ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বললে—সংসার তো এখনো করোনি মা, যখন সংসার করবে তখন বুঝবে। এখনি যতি কেঁদে কেঁদে চোখের জলটুকু সব ফুরিয়ে ফেলো তাহলে পরে কী করবে মা? চলো, কাঁদার দিন তো এখনও আরম্ভ হয় নি মা তোমার, এখনও যে সামনে মস্ত সময় পড়ে রয়েছে! তখন অনেক কাঁদার সময় পাবে—চলো ঘরে চলো—
বলে মাসীমা বিছানার ওপর ক্ষীরোদাকে শুইয়ে দিলে আস্তে আস্তে।
দীপঙ্কর ঘরের মধ্যে গিয়েও তখনও জামা-কাপড় ছাড়েনি। চুপ করে বিছানার ওপরই পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। দীপঙ্কর যেন হিসেব মেলাতে পারছিল না। সকলের ভালো করতে গিয়ে যেন সকলের ওপর অবিচার করে ফেলেছিল সে। কেন এমন হয়? এ কি তার নিজের কোনও দোষের অপরিহার্য ফল? এর কি কোনও প্রতিকার নেই?
হঠাৎ মাসীমা ঘরে ঢুকলো। দীপঙ্কর মাসীমার দিকে চোখ তুলে চাইতেও ভয় পাচ্ছিল।
কিন্তু মাসীমা হঠাৎ যেন ফেটে পড়লো। বললে—তুমি ভেবেছ কি বল দিকিনি দীপু, এমনি করে আর কত শাস্তি দেবে তুমি?
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে—মাসীমা, শেষকালে আপনিও এ-কথা বলবেন?
—তা বলবো না? আমি তো তোমাকে গোড়া থেকেই বলে আসছি, কাজটা তুমি অন্যায় করেছ! কেন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে বাবা? ঘরে পাপ পুষে রেখে দিয়েছ, তার সাক্ষী রেখে দেবার জন্যে?
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু মাসীমা, আমি তো আপনার ভালোর জন্যেই এ করেছিলুম-
—আমার ভালোর কথা ছেড়ে দাও। ওই পোড়ারমুখীটার তুমি কী দশা করতে চাও আমাকে তাই বলো আগে, তবে আমি যাবো এখান থেকে? যদি ওর গলা টিপে ওকে মেরে ফেলতে চাও তো তাও খুলে বলো, আমি আজ শুনে যাই—
দীপঙ্কর বললে— আপনার পায়ে পড়ছি মাসীমা, আমাকে আপনি একটা রাত্তিরের সময় দিন, একটা রাত আমাকে ভাবতে দিন, আমি অনেক ব্যাপার নিয়ে বিব্রত, আমি আর পারছি না—
—আপিস তো সবাই করে, আপিস করে আবার সংসারও করে! কিন্তু আপিস নিয়ে তোমার মত এমন করে ঘর-সংসার জলাঞ্জলি দিতে তো কাউকে দেখিনি।
দীপঙ্কর বললে—না মাসীমা, আপিস নয়, সে আপনাকে বোঝাতে পারবো না, বাইরের লোক কেউ তা বুঝবেও না—সে বোঝবার জিনিসও নয়, আমি আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছি, আর আমাকে শুধু একটা রাতের সময় দিন—
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। মাসীমাও ক্লান্ত, দীপঙ্করও ক্লান্ত। বোধহয় বেশি ক্লান্ত ছিল বলেই দীপঙ্কর সেইভাবে বিছানার ওপর শুধু এপাস-ওপাশ করে কাটাতে লাগলো সে-রাতটা। সে-রাতে দীপঙ্করের মনে হয়েছিল পৃথিবীতে সবাই বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে। সনাতনবাবুও এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। নয়নরঞ্জিনী দাসীও হয়ত ঘুমে অচেতন। লক্ষ্মীদিও হয়ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচৈতন্য। দাতারবাবুও তার মাথার কাছে হয়ত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সতীও হয়ত কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসেছে চেক-বই নিয়ে খুঁজেছে তাকে। সদর-দরজার বাইরের সিঁড়িতে নেমে ‘দীপু’ বলে ডেকেছেও হয়ত। তারপর তাকে দেখতে না-পেয়ে আবার ফিরে গেছে নিজের ঘরে। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে এখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে। হয়ত নিজের ঘরে মাসীমাও এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়লো। সন্তোষকাকার মেয়েও হয়ত মাসীমার বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আর অত কথা কত কী, কিরণ-যে-কিরণ, সেই কিরণও বোধহয় তার সেলের মধ্যে এখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। একলা দীপঙ্করেরই শুধু ঘুম নেই।
কিন্তু দীপঙ্কর জানতো না, সেই ১৯৪৪ সালে সেদিন কেউই ঘুমোয় নি। ফিনল্যান্ড থেকে ইস্ট-এশিয়া পর্যন্ত পোল্যান্ড হাঙ্গারী রুমানিয়া জুড়ে সমস্ত ভূভাগে তখন আগুন জ্বলতে শুরু করেছে সমস্ত দিন-রাত। হিটলার কি ঘুমোতে পারে সেই অবস্থায়? চার্চিল- এরও তখন অনেক ভাবনা। জাপান প্রায় সমস্ত ইস্ট-এশিয়া নিয়ে নিয়েছে। মুসোলিনী মেডিটারেনিয়ান-সী, সিসিলী, সার্ডিনিয়া নিয়ে বসে আছে। কিন্তু আর কতদিন? টিউনিস্ আর বিজার্তা থেকে জার্মান আর্মিকে চলে যেতে হয়েছে, সুতরাং আর কতদিন ইটালীর হাতে থাকবে সে দেশ? পৃথিবীর কোথাও ঘুম নেই। গান্ধীজীরও ঘুম নেই তখন। তিনিও আশ্রমে বসে রাত জেগে-জেগে মহম্মদ আলী জিন্নাকে চিঠি লিখছেন—
Brother Jinnah-There was a day when I could induce you to speak in the mother tongue. Today I take the courage to write to you in the same language. I had invited you to meet me while I was in jail. I have not written to you since my release. But today my heart says I should write to you. We will meet whenever you choose. Don’t regard me as the enemy of Islam or of the Muslims of the country. I am the friend and servant of not only yourself but of the whole world. Do not disappoint me.
Your brother-M. K. Gandhi.
আর শুধু হিটলার, চার্চিল, মুসোলিনী, আইসেনহাওয়ার, গান্ধীজীই নয়, তাদের সঙ্গে মাসীমাও জেগে আছে, ক্ষীরোদাও জেগে আছে। ফাঁসি-সেলের মধ্যে সেদিন প্রত্যেক দিনের মতই সেদিনও জেগে আছে কিরণ। ঘুম আসে না তার। ইন্ডিয়া স্বাধীন না হলে ঘুম আসবেও না তার আর কখনও। আর, আর একজনও জেগে আছে। গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে তার অন্ধকার নিঃসঙ্গ ঘরে সতীও জেগে আছে। তার হয়ে দীপঙ্কর ঘুষ দিয়ে দিয়েছে। দীপঙ্কর তার জীবনের ভবিষ্যতের ভিত্ ঘুষের কংক্রিট দিয়ে পাকা করতে চেয়েছে; এর চেয়ে আর কোন্ অপমান এত মর্মান্তিক হয়ে তাকে আঘাত করতে পারে? তাই সারা পৃথিবীর সঙ্গে সতীও বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে দু’চোখ খুলে।