কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৯
৮৯
দু’দিন অপেক্ষা করলো সতী! সে-রাত্রের পর থেকে বড় খিটখিটে হয়ে গেল সতীর মেজাজ। দাতারবাবু দুদিনের জন্যেই এসেছিল। তার মানসের মামলা রয়েছে দিল্লিতে। ব্যাঙ্কের টাকা দিয়ে যদি তাকে বাঁচতে না পারা যায় তো সম্ভব হলে বাপ তার নিজের জীবন দিয়েও বাঁচবে। মানস পুলিসের কাছে নিজেই স্বীকার করেছে—সে সুস্থ চিত্তে বহাল তবিয়তে সুধাংশুকে খুন করেছে।
—কিন্তু কেন খুন করলে?
মানস উত্তর দিয়েছে—সে আমার থেকেও বড় খুনী বলে!
—কিন্তু কই, সে তো কই কাউকে মার্ডার করেনি! তার মার্ডারের কোনও প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
—আছে!
—দাও! প্রমাণ দাও তুমি?
—প্রমাণ আমার মা। প্রমাণ আমার বাবা। প্রমাণ আমি। আমাকেও সে খুন করেছে। আমাদের ফ্যামিলির সমস্ত প্রেস্টিকে সে খুন করেছে।
—কী ভাবে মার্ডার করেছে?
—অভাবের সময়ে আমার মা’কে টাকা দিয়ে। টাকা দিয়ে আমার মা’র সতীত্ব, বাবার পিতৃত্ব, আর আমার জীবন, সব সে নষ্ট করেছে। আমি শুধু সেই মার্ডারের প্রতিশোধ নিয়েছি তাকে মার্ডার করে। আমি গিল্টী।
লক্ষ্মীদি ছেলেকে মানুষ করেছিল ডেরাডুন স্কুল থেকে পড়িয়ে। কিন্তু আসলে সে মানুষই হয়নি। দিল্লির রাজধানী তার স্টেটমেন্ট পড়ে হেসেই অস্থির। নির্বোধ, ফুলিশ! বিংশ-শতাব্দীর পৃথিবীতে এই সামান্য ক্রাইমের জন্যে কেউ মাথা ঘামায়? আমরা তো চাকরিতে প্রমোশন পাবার জন্যে কত কী করেছি। ঘুষ তো তুচ্ছ কথা। ভেট্ দেওয়াও তো পুরোন হয়ে গেছে। ওতে আর মন ভোলে না কারো। নিজের স্ত্রীকেই আমরা মাঝ- রাত্রে বড়-সাহেবের শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি কতদিন। তাতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে আমাদের শুনি। কেউ তো তা জানতেও পারেনি। মাঝখান থেকে গ্রেড্ পেয়ে গেছি। গেজেটেড্ পোস্টের জন্যে নমিনেশন পর্যন্ত হয়ে গেছে। এবার সেক্রেটারিয়েটে সুপারিন্টেন্ডট হবো। তখন? তখন কি সে-দাগ লেগে থাকবে?
দিল্লির লোক সত্যিই হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে গেল। আর এতদিন ধরে যে তোমাকে লেখাপড়া শেখাবার টাকা জুগিয়েছে, সেটা কিছুই না? তোমার বাবা যখন পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন কে তার চিকিৎসার খরচ দিয়েছে? তোমার মার শাড়ি, গাড়ি, বাড়ি গয়না রেফ্রিজারেটার, রেডিওগ্রাম, ট্রানজিস্টার, সিগ্রেট—এ সমস্ত কার জন্যে? ব্যাঙ্কে যে লক্ষ লক্ষ টাকা তোমার নামে, তোমার বাবার নামে, তোমার মার নামে, সে কার দৌলতে? তার জন্যে তোমার তো গ্রেটফুল থাকা উচিত! তা নয় প্ৰতিশোধ!
দাতারবাবুর যাবার দিন কাছে ঘনিয়ে এল। বললে-আমি চললাম—
সতী সেদিকে মুখ ফিরিয়েও দেখলে না।
—আমার ছেলের মামলার হিয়ারিং আছে সামনে, তাই আর থাকতে পারলুম না, তুমি একটু তোমার লক্ষ্মীদিকে দেখো!
তবু সতী মুখ তুললো না। বাইরে ট্যাক্সি এসে গিয়েছিল। সঙ্গে কিছুই নেবার নেই। বলতে গেলে একেবারে খঅলি হাতেই এসেছিল মিস্টার দাতার।
—দেখবে তো?
তবু সতী এতটুকু মুখ তুললে না। দাতারবাবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সতীর সামনে। কোথাও কোনও সহানুভূতির চিহ্ন দেখা গেল না। দাতারবাবু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের স্ত্রীর ঘরে গিয়েও একবার দাঁড়াল। যেন চিনতেই পারলে না তাকে। লক্ষ্মীদিও ওই রকম হয়ে গেছে। বোকা চাউনি লক্ষ্মীদির চোখে। আজকাল যেন সারাক্ষণই কী ভাবে, কী বলে কিছুই ঠিক নেই। কখনও ঘুমোয়, কখনও জেগে থাকে। কখনও আবোল তাবোল বকে। তাকে কিছু বলাও বৃথা। তবু যাবার সময় দাতারবাবু কথা বলে গেল। বললে-আমি যাচ্ছি, তুমি সাবধানে থেকো, খোকাকে যদি খালাস করতে পারি তো আমি জানবো তোমাকে, কিছু ভেবো না—
তারপর ট্যাক্সি ছেড়ে চলে যাবার শব্দটাও কানে এল সতীর। আর তারপর ও অনেকক্ষণ কেটে গেল। সমস্ত পৃথিবী জোড়া হাহাকারের মধ্যে বসে সতী যেন মুহূর্তের পদধ্বনি শুনতে লাগলো।
রঘু দুপুরবেলা একটুখানির জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর কখন বিকেল হয়েছে টের পায়নি। একলা মানুষ। সারাদিন রান্না-করা, বাজার-করা, সবই করতে হয় তাকে। হঠাৎ ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেছে। ধড়ফড় করে উঠেই সামনে দেখে দিদিমণি। একেবারে বাইরে যাবার জন্যে যেন তৈরি।
সতী বললে—আমি একটু বাইরে যাচ্ছি রঘু, বড়দিদিমণি একলা রইল, একটু দেখিস
—কখন আপনি আসবেন?
সতী বললে—এই এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবো, চোখে চোখে রাখবি বড়দিদিমণিকে, বুঝলি?
—দেখবো।
—দেখিস সেদিনকার মত যেন হঠাৎ আবার বড়দিদিমণি লেভেল ক্রসিং-এর কাছে না যায়। খুব সাবধান—
রঘুকে সাবধঅন করে দিয়ে সতী একলাই বেরোল। হাঁটা-পথ। এমনিতে বিকেল বেলা এদিকে আজকাল অনেক লোকজন থাকে। নিজের হ্যান্ড-ব্যাগের ভেতরে দুটো চেক-বই পুরে নিয়েছে। সোজা লেভেল ক্রসিংটা পার হয়ে একেবারে আরো চওড়া রাস্তাটায় পড়লো। অনেকে লেকের দিকে বেড়াতে চলেছে। বাঁ দিকে লেকে যাবার রাস্তা। বুদ্ধ মন্দির, ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজছে। সতীর মনে হলো যেন ওই শব্দের তালে তালে তার জীবনের উত্থান-পতনের ছন্দটা একটানা মিলে যাচ্ছে। আশ্চর্য! কোথাকার কোন্ বর্মার জীবন, এতদূরে এখানে এসেও ঠিক গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। বিকেল পড়ে আসছে। বড় বড় গাছ। গাছের তলা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিয়ে সোজা রাসবিহারী এভিনিউতে গিয়ে মিশলো। আর তারপর ডাইনে। আর ডাইনে গিয়েই স্টেশন রোড। দীপুর বাড়ি!
বাড়ির সামনে হাজির হতেই সতী অবাক হয়ে গেল। এত বড় একটা তালা ঝুলছে সদর-দরজায়।
তাহলে ভেতরে কেউ নেই নাকি? নাকি, বাড়ি ভুল করেছে? কিন্তু কই, এই তো, এই সিঁড়ি দিয়েই তো একদিন এ-বাড়িতে এসে ঢুকেছিল সতী! এই তো সেই বাইরের রোয়াকটা। সামনেই তো সেই বাইরের ঘরটা। ওপরে ওই তো রেলিং দেওয়া বারান্দা। সবই তো সেই রকম! কোথায় গেল তাহলে তারা?
রাস্তাতেও তেমন লোক চলাচল নেই। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়। সতী বড় মুশকিলে পড়লো। পাশের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলে, তাদের সদর দরজা বন্ধ। জানালা খোলা। কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। কোথায় কাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারা যায় তা বোঝা গেল না। তবে কি দীপঙ্কর এই ক’দিনের মধ্যেই শিলিগুড়ি চলে গেল? যাবার আগে একবার জানিয়েও গেল না? এমন করে ভুল বুঝলো সতীকে! মাথায় ঘোমটা নিচু করে টেনে দিলে। কেউ হয়ত দেখলে অন্য কিছু ভাবতে পারে। ডানদিকের বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এতক্ষণ সতী দেখতে পায়নি তাঁকে। সতীর দিকেই চেয়ে দেখছিলেন।
.
সেখান থেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন—তুমি কাকে খুঁজছো মা?
সতী অসহায়ের মত তাঁর মুখের দিকে চোখ তুললো। বললে—এখানে এই বাড়িতে দীপঙ্কর সেন বলে একজন থাকতেন………
বৃদ্ধ বললেন—হ্যাঁ, এ তো আমারই বাড়ি, তিনি আমার বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন, রেলে চাকরি করতেন—
—তা দরজায় তালা বন্ধ কেন? তাঁরা কোথায়?
—তিনি তো চলে গেছেন। পরশু দিন এবাড়ি ছেড়ে দিয়ে গেছেন। তিনি বদলি হয়ে গেছেন শিলিগুড়িতে—
—তাঁরা এখন কলকাতাতেই নেই?
বৃদ্ধ বললেন—না মা, আমি তো অন্য লোককে এ-বাড়ি ভাড়া দিয়েছি।
সতী আর দাঁড়াল না। তার পায়ের তলার মাটি যেন তখন থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। মাথার ওপর ঘোমটাটা আরো একটু টেনে দিয়ে সতী আবার সেই রাস্তা ধরলে। যে-রাস্তা দিয়ে সে এসেছিল, সেই একই রাস্তা। চলতে চলতে সতীর মনে হলো, মানুষের জীবনে ফেলে-আসা রাস্তায় ফিরে চলার মত দুর্ভোগ বুঝি আর কিছুই নেই। চারিদিকে তখন সন্ধ্যের অন্ধকার আবছা হয়ে নামলো।