কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯০
৯০
সেই সন্ধ্যের অন্ধকারে উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে এক উৎসবের অনুষ্ঠান চলেছে তখন। বহুদিন আগে এই বাড়িতেই সতী থাকতো, লক্ষ্মীদি থাকতো। সতীর কাকাবাবু কাকীমাও থাকতো। সে কি আজকের কথা। এ উপন্যাস যখন শুরু হয়েছে, সে-সব তখনকার ঘটনা। এতদিন পরে এপাড়ার চেহারাও অনেক বদলে গিয়েছে। সেই মধুসূদনের বাড়ির রোয়াকে বসে আড্ডা দিত দুনিকাকা, পঞ্চাদা সবাই। সে রোয়াক এখনও আছে। এখনো সেখানে আড্ডা বসে। খবরের কাগজ নিয়ে টানাটানি পড়ে যায় সকাল বেলা। কংগ্রেস, জিন্না, শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে তুমুল হট্টগোল চলে। আর সামনে ফটিকদের সেই বস্তিটাও ঠিক সেই রকমই আছে পাথরপটির রাস্তার ধারে। কোথায় কোন কারখানায় এখন কাজ করে সে। ভোরবেলা বেরোয়, আর ফেরে রাত্রে। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—আর চন্ডীবাবুর সেই নীতি? সে-কোথায় গেল রে?
ফটিক বললে—জানিস না তুই? সে তো মারা গেছে?
—মারা গেছে? কবে? কী করে?
অত বড় লোকের নাতি। একমাত্র নাতি! স্কুলে তাদের দরোয়ান রামধনি এসে এক গ্লাস দুধ আর চারটে রসগোল্লা খাইয়ে যেত রোজ। একদিন ওই চন্ডীবাবুর বাড়িতেই কিরণ আর দীপঙ্কর ঢুকেছিল পুলিসের ভয়ে। চন্ডীবাবু সেদিন দরোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সে-সব কতদিন আগেকার কথা!
ফটিক বললে—মোটরগাড়ি চড়ে যাচ্ছিল, একটা মিলিটারি ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেখানেই মারা গেছে—
একটু আহা বেরোল দীপঙ্করের মুখ দিয়ে। একমাত্র নাতি চন্ডীবাবুর। একমাত্র বংশধর। ছোটবেলায় ওদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল, তাতেও কিছু ক্ষতি হয়নি। এবার আরো চতুর ডাকাত এসে সব টাকা সব ঐশ্বর্য নিরর্থক করে ছেড়ে দিলে একেবারে।
দীপঙ্কর বললে—ঠিক যাস কিন্তু তুই ফটিক? সব পুরোন বন্ধুদের খুঁজে-খুঁজে নেমতন্ন করেছি, যত বন্ধু ছিল—
—কটার সময় বিয়ে?
দীপঙ্কর বললে—ঠিক সন্ধ্যে ছ’টায়। গোধূলি লগ্নে—
পুরোন বন্ধু বলতে আর কে-ই বা আছে। কিরণই বলতে গেলে আসল। তা সে-ই তো নেই। মধুসূদনকেও বলে এসেছিল। মধুসূদন এতদিন পরে দীপঙ্করকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এখন মধুসূদন ক্যালকাটা কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকেছে। বললে— তুই যে আমাদের চিনতে পারবি তা ভাবিনি, তুই এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস ভাই—
দীপঙ্কর হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—তা বয়েস হচ্ছে, বড়ো হবো না?
—না না, সে বড়ো নয়, তুই খুব মস্ত বড় চাকরি করিস, আমরা কিছুই হতে পার- লাম না।
দীপঙ্কর মধুসূদনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললে—মাইনে দিয়েই তোরা মানুষের বিচার করিস? তা যদি করিস তো আমি প্রাণমথবাবুর চেয়েও যে বড় হয়েছি রে! কিন্তু যাস্ ঠিক, ছ’টার সময় বিয়ে—গোধূলি লগ্নে—মনে থাকবে তো?
আসলে কিন্তু ছিটেই ছিল ভরসা। ছিটেই বলেছিল এই বাড়িতে আসতে। বাড়িটা খালি-পড়েই ছিল সৌভাগ্যক্রমে। ভাড়াও বেশি নয়। তিরিশ টাকা। আগে কুড়ি টাকা ছিল। এখন তিরিশ টাকা। ছিটে বলেছিল—জানিস তো জিনিস-পত্রের দাম কী রকম বাড়ছে? তা তুই যা পারবি দিবি, এর ওপরে তো কথা নেই?
দীপঙ্কর বলেছিল—কিন্তু আমি তো থাকবো না, আমি থাকবো শিলিগুড়িতে—
—তাহলে এবাড়িতে কারা থাকবে?
—এখানে ওরাই থাকবে। ওই কিরণের মা আর ওরা—আমি বিয়ের পরেই চলে যাবো—
সেই ১৯৪৪-এর বাঙলা দেশে তখন ছিটেদেরই অপ্রতিহত ক্ষমতা! কলকাতার লাটসাহেব রাইট অনারেবল আর জি কেসির চেয়েও ক্ষমতাশীল তারা। সমস্ত বাঙলা দেশে তখন ছিটেদের মতন মিলিটারি কনট্রাক্টাররা ইচ্ছে করলে রাতকে দিন করতে পারে। ফজলুল হক, নাজিমুদ্দিন, শরৎ বোস, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যা না করতে পারে, তা পারে ১৯৪৪ সালের একজন মিলিটারি কনট্রাক্টার। তাদের কথায় তখন রাজ্য ওঠে, রাজ্য গড়ে। তারা আইন গড়ে, আবার আইন ভাঙেও। কোথাও যখন চাল নেই, কয়লা নেই, পেট্রল নেই, কেরাসিন নেই, হরলিকস নেই—তখন তাদের ঘরে সব মজুত। তারা ইচ্ছে করলে এক মিনিটে সব সামনে এনে হাজির করতে পারে। তারা কংগ্রেস জানে না, তারা হিন্দু মহাসভা জানে না, মুসলিম লীগ জানে না, কমিউনিস্ট জানে না, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস জানে না, এমন কি র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিও জানে না। তারা জানে শুধু প্রফিট। তারা জানে শুধু টাকা। অঘোরদাদুর যে-টাকা ছিল সেই টাকা দিয়ে তারা অঘোর-সৌধ তৈরি করেছিল। টাকা দিয়ে তারা কংগ্রেসকেও কিনে নিয়েছিল। টাকা উপায়ের জন্যেই ছিটে খদ্দর পরতো। আর টাকা উপায় করবার জন্যেই নিজের ভাইকে জেলে পাঠিয়েছিল। টাকা উপায়ের জন্যেই ফোঁটা কালিঘাটের কংগ্রেসের ভাইস- প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। সুতরাং সেই ছিটেই যখন অভয় দিলে তখন আর কোনও ভাবনা রইল না দীপঙ্করের।
সত্যিই, বিয়ের সব সরঞ্জাম যে এক-দিনের মধ্যে কেমন করে যোগাড় করলে ছিটে, সেটাই আশ্চর্য। বাড়িতে এসে শুধু টেলিফোনেই সব কাজ হাঁসিল হয়ে গেল। ম্যারাপওয়ালারা বাড়ির মাথায় পাল টাঙিয়ে দিয়ে গেল। নেমন্তন্নর চিঠি ছাপিয়ে নিয়ে এল এক ঘন্টার মধ্যে। দান-সামগ্রী, বাসন, খাট, আলমারি গদী তোশক। তারপর কুশাসন, কলাপাতা, খুরী, গেলাস, মাছ, দই সন্দেশ মিহিদানা, পানের খিলি। দেখতে দেখতে একদিনের মধ্যে উনিশের একের-বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে মহা-উৎসব শুরু হয়ে গেল। দীপঙ্করের কাছে মনে হলো যেন একটা আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়ে গেল রাতারাতি।
বাড়ির ভেতরে কিরণের মার সময় নেই। সকাল বেলাই গায়ে হলুদ হয়েছে। কোথায় মাছ কোথায় দই, কোথায় তত্ত্ব, কোথায় লোকজন, কিছুই ভাবতে দেয়নি ছিটে। নিজের ঘরে বসে ছিটে শুধু হুকুম করেছে, আর চোখের পলকে সব কাজ হয়ে গেছে।
আর কাজের লোক বটে লক্কা আর লোটন। দু’জনের যেন দশটা হাত। সারা গায়ে গয়না মোড়া। দামী-দামী বেনারসী ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে, তবু কামাই নেই। মাসীমা কনে সাজাচ্ছিল। লক্কা এসে বললে—মাসীমা, আপনি সরুন, আমরা আছি কী করতে শুনি?
সে লক্কা আর সে লোটনকে দেখে আর চেনবার উপায় নেই। টাকার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমাজের বুকে পা দিয়ে তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। ঝিরা দুই গিন্নীর সঙ্গে সঙ্গে আঠার মত লেগে রয়েছে। দুজনের মুখে পান জুগিয়ে যাচ্ছে অষ্টপ্রহর।
লোটনের হঠাৎ খেয়াল হলো—হ্যাঁ রে এখনও বরণডালা সাজালি না তোরা? যেদিকে দেখবো না আমরা সেদিকেই চিত্তির?
লক্কা বললে—কইরে, বিকেল হলো, এক কাপ চা দিলিনে তোরা? এদিকে এখুনি যে বর এসে যাবে!
সঙ্গে সঙ্গে দশটা ঝি ছুটলো চা আনতে। ছিটের বাড়িতে লোকের অভাব নেই। একবার হুকুম করলে দশ-বিশ জন দৌড়ে গিয়ে হুকুম তামিল করে। বাড়ির উঠোন মস্ত শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। ছিটের বন্ধু-বান্ধব এসে হাজির হয়েছে। দীপঙ্করের বন্ধু- বান্ধব এসে হাজির হয়েছে। যেন ছিটেই বরকর্তা। শামিয়ানার সামনেই খদ্দরের ধূতি, পাঞ্জাবি-চাদর পরে হাত-জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
—আসুন আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক ঠাকুর মশাই।
কাউকে কাউকে পায়ের ধূলো নিয়েও আবার প্রণাম করছে।
—ফটিকবাবুর কোনও খবর পেয়েছ নাকি বাবাজী?
ছিটে বললে—আজ্ঞে আমি আর কী খবর নেব। সে দেশনেতা, দেশের জন্যে প্রাণ দিতে গেছে, দেশের লোকই তার খবর রাখবে, আমি কে?
—কিন্তু গান্ধীকে তো ছেড়ে দিলে?
—আজ্ঞে কী যে বলেন! মহাত্মাজীর সঙ্গে কি আর আমার ভাই-এর তুলনা! যেদিন জওহরলাল, বল্লভভাই প্যাটেল, আজাদ, সরোজিনী নাইডু ছাড়া পাবেন, ফোঁটাও সেদিন ছাড়া পাবে। আর ছাড়া না-পেলেই বা কী করছি বলুন। দেশের জন্যে যাদের প্রাণ কাঁদে তাদের তো আর জেলের ভয় করলে চলে না।
ভেতর-বাড়িতে উঠোনের ওপর চারদিকে কলাগাছ পুঁতে ছাদনাতলা তৈরি হয়েছে। বর আসতেই শাঁখ বেজে উঠলো। অঘোর-সৌধর ওপরে খাটানো মাচা থেকে নবৎ পৌঁ ধরলে বেহাগে। ততক্ষণ বরযাত্রীরা এসে গেছে। চাকর-বাকর ঝি-ঝিউড়িরা ছুটো-ছুটি শুরু করে দিয়েছে চারদিকে। এয়োতীরা বরণ করতে লাগলো বরকে। পিঁড়ির ওপর বসিয়ে কনেকে সাত পাক ঘোরানো হলো। হৈ-চৈ হট্টগোলের মধ্যে নহবতের শব্দের তলায় একটা হৃদয়ের সব অনুভূতি সব অনুরাগ পিষে থেঁতলে গুঁড়িয়ে গেল এক মুহূর্তে।
ছাদের ওপর সার-সার লোক খেতে বসেছে। আর দু’খানা গরম লুচি এ-পাতে! কী হে মন্মথ, তুমি যে কিছুই খাচ্ছো না। আরে দত্তমশাই যে, কতক্ষণ এসেছেন? আর একখানা মাছ নিন। আমি নিজে সুপারভাইজ করে রান্না করিয়েছি। রসময়, তুমি ও- লাইনে পোলাওটা নিযে ঘুরে যাও আর এদিকে পোনামাছের কালিয়াটা একবার রিপিট করে যাক কেশব। কী, আপনার শরীর কেমন বাঁড়ুজ্জে মশাই? ছেলে চিঠি দিয়েছে? তুমি তো ঘরের লোক হে অক্ষয়, চেয়ে খেতে পারো না?
ভেতরে স্ত্রী-আচারের আসরে খিল্ খিল হাসি আর হুলধ্বনি চলেছে। সেখানে একমাত্র পুরুষ পাড়ার নাপিত বঙ্কিম। বঙ্কিম একদিন অঘোরদাদুর দাড়ি কামিয়েছে।
সে তখন ছড়া কাটছে—
কড়ি দিয়ে কিনলাম
দড়ি দিয়ে বাঁধলাম
হাতে দিলাম মাকু…..
তারপর বরযাত্রীরা এক ব্যাচ শেষ হতেই আর এক ব্যাচ বসলো গিয়ে। বাইরে ভিখিরী আর কুকুরের কাড়াকাড়ি পড়ে গেল এঁটো কলাপাতা নিয়ে। বাঁডুজ্জে মশাই চুপি চুপি কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলেন—কই হে ছিটে, শুনলাম পঞ্চাশ জনের বেশি খাওয়ানোর নিয়ম নেই, এ যে দেখছি দু’তিন শো লোক—
ছিটে হাসলো। বললে-ওই দেখুন, সামনে চেয়ে দেখুন—
—কী, সামনে কী! বাঁড়ুজ্জে মশাই সামনে চেয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না-
ছিটে বললে—ওই যে কোণের ঘরে টেবিলে থানার ইন্সপেক্টর খাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন না?
শুধু থানার দারোগাই নয়, কনস্টেবল, জমাদার, সাবই এসে গিয়েছে। হয়ত তাদের সকলের বাড়িতে মিষ্টিও চলে যাবে কাল সকাল বেলা। কেউ কিছু জানতে পারবে না, কেউ কিছু বলবার সাহসও করবে না। ফুড-কন্ট্রোল-অর্ডার বর্ণে বর্ণে পালিত হবে বেঙ্গলে। আইন ভাঙলে তার আর রক্ষে নেই।
আর যে-ঘরে একদিন সতী লক্ষ্মীদি শুতো সেই ঘরেই সম্প্রদানের অনুষ্ঠান চলেছে—
—যদিদং হৃদয়ং মম—
লক্ষ্মণ সরকার টোপর মাথায় দিয়ে মাথা নিচু করে আবৃত্তি করছে—যদিদং হৃদয়ং মম—
পুরুত মশায় আবার বললেন—তদিদং হৃদয়ং তব—
—তদিদং হৃদয়ং তব—
বাইরে তখন অঘোর-সৌধের মাচার ওপর থেকে নহবৎ নতুন রাগ ধরেছে- দরবারী কানাড়া।
আর যখন ভিড় হট্টগোল হে-চৈ, কোথাও কোনও শান্তি নেই, যখন রাত অনেক বাড়লো, বাসর ঘরে ঢুকলো বর-কনে। কে যেন হঠাৎ এসে বললে—মাসীমা, কনে যে কাঁদছে মাসীমা খুব
মাসীমা বললে—তা কাঁদুক, বিয়ের দিনে কনে তো কাঁদবেই বাছা!
—কিন্তু আর যে সামলাতে পারা যাচ্ছে না মাসীমা, কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে একেবারে! তুমি একটু চলো—বুঝিয়ে বলবে!
মাসীমা বললে—আমি বিধবা মানুষ, বাসর-ঘরে আর না-ই বা গেলুম—ও-রকম একটু সবাই কাঁদে, আহা বাপের কথা মনে পড়েছে হয়ত—
হঠাৎ দীপঙ্কর এসে দাঁড়াল। বললে—মাসীমা, আমি তাহলে আসি?
বলে মাসীমার পায়ের ধূলো নিয়ে মাথায় ঠেকাল। মাসীমা দীপুর চিবুকে হাত-ছুঁইয়ে ঠোঁটে ঠেকিয়ে বললে—আজ না-গেলেই কি নয়, বাবা?
—কিন্তু কাল যে আমার শিলিগুড়িতে জয়েন করতে হবে। আপিসে। এদিকে সময়ও তো নেই!
মাসীমা বললে-আমি আর কী বলব বাবা তোমাকে। তুমি বড় হয়েছ, তুমি বুদ্ধিমান বিচক্ষণ, তুমি যা ভাল বুঝবে করবে!
দীপঙ্কর আবার মাসীমার পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক-বাড়ি লোক, চারিদিকে উৎসবের কলকন্ঠ। দীপঙ্করের চোখের সামনে হঠাৎ সব যেন নিঃঝুম নিঃশব্দ হয়ে এল। মা, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তুমি যেখানেই থাকো, আমি ন্যায় করেছি কি অন্যায় করেছি, তা তুমি নিশ্চয়ই জানো। তুমি তো ওপর থেকে সব দেখছো। যদি অন্যায় করে থাকি তো তুমি আমায় ক্ষমা কোর।
দীপঙ্কর আর সেখানে দাঁড়াল না। গাড়ি তৈরিই ছিল। ডাস্টবিনের সামনে যেখানে কুকুরে আর ভিখিরিতে এঁটো কলাপাতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে, সেইখানে শুধু গাড়িটা এক মুহূর্তের জন্যে একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর আবার চলতে লাগলো সেকেন্ড গিয়ারে। যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং তব। লক্ষ্মণ সরকার দীপঙ্করের সব অনুরোধ রক্ষা করেছে। এতটুকু আপত্তি করেনি। এককালে ছোটবেলায় দীপঙ্করের হাত থেকে প্রিন্স অব ওয়েলসের কদ্মা কেড়ে নিয়েছিল, আজকে সে সেই কদ্মার ঋণ বোধহয় এমনি করেই শোধ করলে!
.
নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস। রাত্রিবেলা ট্রেন ছেড়েছে। সেন-সাহেবকে স্টেশনে বিদায় দিতে আপিসের কেউ কেউ এসেছিল। কারোর দিকেই ভালো করে চেয়ে দেখতে পারেনি দীপঙ্কর। রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। তারাও আবার বাড়ি ফিরে যাবে!
কিন্তু মানুষের যিনি ঈশ্বর, তাঁর কাছে তো কিছুই গোপন থাকবার কথা নয়। তিনি তো অন্তরালে বসে সব হিসেবের অঙ্ক মিলিয়ে নিয়ে তবে খালাস দেবেন। সেখানে তো সংসারের চলনসই জিনিসের কারবার নেই, সেখানে এক মুহূর্তে সব মেকি সব খাদ যে ধরা পড়ে যাবে। সেখানে আমি জবাবদিহি করবো কেমন করে? স্বর্গ তো মাথার ওপরে ও নয়, পায়ের তলাতেও নয়। সে যে এই অন্তরের অন্তস্থলে। বাইরে তো আমাদের অনেক বন্ধন, অনেক হিসেব অনেক অঙ্ক। কিন্তু অন্তরে তো সে বালাই নেই। সেখানে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা অখন্ড তাৎপর্যকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। সেই যেদিন উনিশের একের বি’র বাড়িতে প্রথম ঘুঙুরের শব্দ শুনেছিল, সেই যেদিন সি আর দাশের মৃত্যুর খবর কানে এসেছিল, সেই যেদিন জেলের হাজতে গিয়ে বন্দী হয়েছিল, সেই যেদিন মার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেইদিন থেকেই তো তার জীবনের তাৎপর্য নির্ধারিত নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর তারপর যেদিন সতী তার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করেছিল তার বাড়িতে, যেদিন তেত্রিশ টাকা ঘুষ দিয়ে রেলের চাকরিতে ঢুকেছিল, আর তারপর যেদিন…….
তারপর যে কত মাস কত বছর কেটে গেল। বাইরের শক্তির সঙ্গে ভেতরের শক্তির সামঞ্জস্য করতে গিয়ে কত আঘাত কত অত্যাচার সইতে হলো তার বুঝি হিসেব নেই। দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে জানালার ধারে বসে একমনে নিজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দেখতে লাগলো। একমনে কান পেতে শুনতে লাগলো—যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং তব। যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং…….
ট্রেন চলেছে হু হু করে। বাইরের দুর্ভেদ্য অন্ধকারের সঙ্গে ট্রেনের বিদ্যুৎ-গতির তাল রেখে ঊর্ধ্বে-অধেঃ অন্তরীক্ষে দীপঙ্করের একটি প্রার্থনাই শুধু নিঃশব্দে বাড়ময় হয়ে উঠলো—তুমি আমায় ক্ষমা কোর—