কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯১
৯১
কলকাতার দিন তখন থম-থমে, রাত তখন নিথর। দীপঙ্কর কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু কলকাতা থেমে থাকেনি। তখনও ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে মিলিটারি-কন্ট্রাক্টারের বাড়ির সিন্ধুকে লক্ষ লক্ষ টাকা এসে জমছে। টাকার স্রোত বয়ে চলেছে। অঘোরদাদুর লক্ষ টাকার সোনা-জহরত ছিল, তাতে এসে মিশলো মিলিটারি ক্যাপিট্যাল। সেই ক্যাপিট্যাল সোনা হয়ে হীরে হয়ে মুক্তো হয়ে জমতে লাগলো দিনের পর দিন রাতের পর রাত। দীপঙ্করের নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের ইস্পাতের চাকার শব্দের মত তাতে ঠুং-ঠাং শব্দ হতে লাগলো। কলকাতার অন্ধকার নিথর রাতে কান পেতে থাকলে শোনা যেত সেই অদ্ভুত শব্দ। কিসের শব্দ বোঝা যেত না। কিন্তু মনে হতো—কেউ যেন অতি সন্তর্পণে ধারালো ছুরিতে আরো ধারালো শান দিচ্ছে—
আর শেষ হয়ে গেল মানুষের হাতে গড়া এক ভয়াবহ যুদ্ধ ছ’বছর একুশ ঘন্টা তেইশ মিনিটের লড়াই। চার্চিল সাহেব সখেদে বললে—
What is Europe now? It is a rubble heap, a charnel house, a breed- ing place of pestilence and hate.
লক্ষ লক্ষ টন ঘৃণা আর কোটি-কোটি টন প্রতিশোধ-স্পৃহার ভারে মানুষের মনের দরজায় এসে নামলো শান্তি। কবররে শান্তি। কোথাও যুদ্ধ নেই, কোথাও গুলী-বারুদ- বোমার শব্দ নেই, তবু চারিদিকে ধূমায়িত হাহাকার আর আক্রোশ। রুজভেল্ট সাহেব বিবৃতি দিলে—
—The mere conquest of our enemies is not enough. We must go on to do all in our powers to conquer the doubts and fears, the ignorance and the greed, which made this horror possible.
সেই সন্দেহ আর ভয়, অজ্ঞতা আর লোভ দূর করতেই একদিন ওয়ার্ধার আশ্রমের সামনে এসে দাঁড়াল একজন অচেনা মানুষ। কোমরে তার রিভলবার কিন্তু হাতে একটা চিঠি।
—কে চিঠি লিখেছে?
লিখেছে এইচ-ই ফিল্ড মার্শাল দি রাইট অনারেবল ভাইকাউন্ট ওয়াভেল অফ সাইরেনাইকা এন্ড উইনচেস্টার পি সি, জি-সি-বি, জি-এম-এস-আই, জি-এম-আই-ই, সি-এস-জি। ইত্যাদি ইত্যাদি। নামের চেয়েও বড় তার পদবী। আর তার পরদিন দেখা গেল একজন ন্যাংটা ফকির ভাইসরয়ের উঁচু সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে। ইন্দ্রপ্রস্থের ময়ূর সিংহাসনের সামনে গিয়ে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন—আমার নাম—এম-কে-গান্ধী!
আর ওদিকে পুণা জেলখানা থেকে ছাড়া পেলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল, আচার্য নরেন্দ্র দেও, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট আবুল কালাম আজাদ, প্রাণমথবাবু। আর ছাড়া পেলেন ফটিক ভট্টাচার্য। ফোঁটা। কালিঘাট কংগ্রেসের ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
ইতিহাসের নিয়ম বড় অদ্ভুত। সে নিয়ম বাইরে থেকে দেখা যায় না। বাইরে থেকে তাকে বদলানোও যায় না। সে নিয়ম যখন বাইরে প্রকাশ হয় তখন অবাক হয়ে লোকে ভাবে এ কেমন করে হলো। নেপোলিয়নের নিয়মে হিটলার কি চার্চিল কি রুজভেল্টের বিচার করতে তাই ভুল হয়। অথচ শাস্ত্রে বলে বিধাতার নিয়ম বড় যথাযথ, বড় অমোঘ, বড় শাশ্বত। ইতিহাস-বিধাতার সেই নিয়মের যেখানে ব্যতিক্রম করবার চেষ্টা হয়েছে, সেখানেই ঘটেছে বিরোধ। একজন মানুষ যখনই সমস্ত পৃথিবীর মুখের চেহারা বদলে দিতে গিয়েছে, সেই অমোঘ ইতিহাস-বিধাতার বিধানে কখন যে সে নিজেই পৃথিবী থেকে মুছে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে তার হিসেব কোথাও লেখা নেই। একদিন ইন্ডিয়ার লোক প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়বার সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ দিয়েছে চার্চিলকে, অভিশাপ দিয়েছে হিটলারকে, অভিশাপ দিয়েছে মুসোলিনী তোজো সকলকে। তাদের সকলেরই বিচার হয়েছে নুরেমবুর্গ কোর্টে। গোয়েবলস গোয়েরিং রিবেট্রপ—তারাই হয়ে গেল পৃথিবীর এনিমি নাম্বার ওয়ান। আর চার্চিল হলেন পৃথিবীর রক্ষাকর্তা। মানুষের পৃথিবীর ইতিহাস তাই শুধু বিজেতাদের ইতিহাস, সার্থকনামাদের ইতিহাস, সাকসেসফুলদের ইতিহাস। কিন্তু যারা হেরে গেল? সেই হেরে যাওয়া মানুষদের প্রতিনিধি হারম্যান গোয়েরিং বললেন—আর কেউ দোষী নয়, পৃথিবীর যা কিছু অপকর্ম সমস্তর জন্যেই আমি একলা দায়ী।
I am responsible for German rearmament. I always wanted bombers for bombing the United States, I personally gave the orders to bomb Warsaw, Rotterdam and Conventry. I do not propose in any way to hide behind the fuehrer.
কলকাতার রোয়াকে আবার জটলা। দীপঙ্কর কলকাতায় নেই বলে তো কলকাতা থেমে থাকতে পারে না! মধুসূদনের রোয়াকে দুনিকাকা, পঞ্চাদা, মধুসূদনের বড়দা আবার খবরের কাগজ নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। গান্ধী-জিন্না-ওয়াভেল-এর ব্যাপার নিয়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে আড্ডায়-আড্ডায়। ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট কি চলে যাবে নাকি! বলে কি? দুনিকাকা যেন কেমন ঘাবড়ে গিয়েছে ব্যাপার-স্যাপার দেখে। শেষকালে কি সত্যিই চলে যাবে সাহেবরা আমাদের অনাথ করে?
পঞ্চাদা বলে—এইবার? এইবার কী হবে দুনিকাকা? সাহেবরা যে চলে যাচ্ছে, তোমার কী হবে?
দুনিকাকা বিরস মুখে কাগজ পড়ছিল। বললে—ভালোই তো, ভালোই তো! গেলে তো ভালোই! আমি কি আর স্বরাজ চাই না বলতে চাস? কংগ্রেস যদি দেশ চালাতে পারে তো চালাক না—আমি কি খারাপ বলছি?
মধুসূদনের বড়দা বললে—আলবাৎ চালাবে! চালানোটা কী এমন হাতী-ঘোড়া কাজ শুনি? সব তো করবে আই সি এস্’রা, দেখবে সব শালাদের মুখ চুন হয়ে যাবে এবারে। এবার গান্ধী আবার চালের দাম তিন টাকা করে দেবে, ভাইয়ের মাইনে হয়ে যাবে পাঁচ শো টাকা মাসে—
—ভাইসরয় কে হবে তাহলে?
—যে-ই হোক, নেহরুই হোক আর গান্ধীই হোক আর বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদই হোক, পাঁচশো টাকার বেশি মাইনে নিতে কংগ্রেস অ্যালাও করবে না—আর যারা অ্যাদ্দিন ব্ল্যাক্-মার্কেট করেছে তাদের কী করবে জানো তো?
—কী করবে?
কী করবে তা জওহরলাল নেহরু বলেই দিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৫ই অক্টোবর লখনৌতে পন্ডিতজী বক্তৃতা দিয়েছেন—
There is much talk about war-criminals. The time is not far off when we shall prepare one list of anti-national criminals, those who mercilessly crushed the spirit of our patriots, who opened fire on them, who accepted bribes and sucked the blood of the poor. We shall never forget them.
রেলের আপিসেও সবাই লাফিয়ে উঠেছে। এবার? এবার সাহেবদের পাতাড়ি গুটোতে হবে ইন্ডিয়া থেকে। তিন হাজার চার হাজার টাকা মাইনে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে বসে আর হুকুম করা চলবে না বাছাধনদের। দিনের পর দিন ওয়াগন ভর্তি করে বোমা-বারুদ পাঠিয়েছে আসাম ফ্রন্টে। সেখানে জাপানীরা মণিপুরে এসে ঢুকে পড়েছে। দিন নেই রাত নেই কন্ট্রোলাররা ট্রেন পাঠিয়েছে সোজার ভর্তি করে। তোজোকে আসতে দেওয়া হবে না। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার লটকে দিয়েছে— জাপানকে রুখতে হবে। কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরেও সেদিন কেউ জানতে পারেনি—সে তোজো নয়, সে সুভাষ বোস। সেই সুভাষ বোসই তখন নেতাজী হয়ে গেছেন।
একদিন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন আবার জমজমাট হয়ে উঠলো। অঘোর-সৌধের সামনের রাস্তায় গাড়ির পর গাড়ি জমে ঠাসাঠাসি হয়ে গেল। ফুলের মালা হাতে করে কালিঘাট ব্যায়াম সমিতির ছেলেরা ভিড় সরাতে লাগলো। কালিঘাট কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, নহেরু দেও, সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে প্রাণমথবাবুও ছাড়া পেয়েছে। আর ছাড়া পেয়েছেন কালিঘাটের ছেলেদের ফোঁটাদা!
ফুলের মালায়-মালায় ফোঁটাদাকে ভালো করে দেখাই যায় না। স্টেশন থেকে গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আসতে আসতে চারদিকের জনতাকে মাথা নিচু করে প্রণাম করেছে। বাড়ির সামনে আসতেই ভিড়ের চাপ আর রোখা গেল না। সবাই একসঙ্গে দেখতে চায় শহীদকে। প্রাণমথবাবু বুড়ো মানুষ। তিনি নিজের বাড়ির সামনেই নেমে গিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির সামনে অত ভিড় নেই। তবু সবাই জানতে চায়—মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা। জিন্নার সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে?
.
সেদিন সবাই মিলে ধরে বসলো-ফোঁটাদা, আপনি দাঁড়িয়ে উঠে কিছু বলুন আমাদের—
ফোঁটা অগত্যা দাঁড়িয়ে উঠলো। সেই ফুলের মালা গলায় দিয়ে নিজের বাড়ির উঠোনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে উঠে বললে—ভাই, আমি আজকে ক্লান্ত। তবু আপনাদের অনুরোধ না রেখে পারছি না। কিছু আমাকে বলতেই হচ্ছে। আমি আজ পঁচিশ বছর ধরেই জেল খেটে আসছি। জেল খাটাতে আমি ভয় পাই না। কিন্তু আজ জেল থেকে বেরিয়ে আমি আপনাদের যে একটা সুখবর শোনাতে পারবো, এইটেই আনন্দের কথা। আমি আজ আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি আমাদের এই আত্মত্যাগে ব্রিটিশ-সিংহ ভয় পেয়ে আজ স্বাধীনতা দিতে প্রস্থত হয়েছে। যে স্বাধীনতার জন্যে দেশবন্ধু সি আর দাশ, বালগঙ্গাধর তিলক, মহামতি গোখলে, লাল লাজপত রায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু যে স্বাধীনতা অর্জন হয়নি, সেই স্বাধীনতা আমরা আজ আনতে পেরেছি, অহিংস-সংগ্রাম করে। অহিংসার প্রতিমূর্তি গান্ধীজীর কাছে আজকের ব্রিটিশ-সিংহ নতি স্বীকার করেছে। এখন মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হলেই ব্রিটিশরা এখঅন থেকে চলে যাবে। মহাত্মা গান্ধীকে লর্ড ওয়াভেল যে চিঠি লিখেছে, সে চিঠিও আমাকে দেখিয়েছেন গান্ধীজী। আমি নিজের চোখে সে চিঠি দেখেছি। আপনারা আর কিছুদিন ধৈর্য ধরুন। অহিংসায় বিশ্বাস রাখুন। তারপরে আমি দিল্লিতে যাবো। তখন আপনারা সমস্ত জানতে পারবেন—বন্দে মাতরম্—
সবাই ফোঁটাদার গলায় সুর মিলিয়ে এক-সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো—বন্দে মাতরম্—
প্রাণমথবাবুর বাড়ির ঘরখানার ভেতরেও লোক-জনের আনাগোনার শেষ নেই। পাড়ার কংগ্রেসীরা সামনে এসে ভিড় করে থাকে দিনরাত। প্রাণমথবাবু কিছু বলেন। আবার কিছু বলেনও না। বলেন—কিন্তু আমার মনে হয় এর অন্য কারণ। এত লোক জেল খেটেছে বলেই যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টই ইন্ডিপেন্ডেন্স দিচ্ছে তাও ঠিক নয়—
সবাই জিজ্ঞেস করে—তাহলে আসল কারণটা কি?
প্রাণথমবাবু বলেন—আসল কারণটা সন্দেহ করি অন্য। এতদিনের যুদ্ধের পর আমাদের ইন্ডিয়ান আর্মির পঁচিশ লক্ষ লোক দেশে ফিরে আসছে, তারা বেকার হয়ে যাবে তখন, তাদের ভয়েই চক্ষে যাচ্ছে ওরা। আজকাল আর্মির ভেতরেও যে স্বদেশীর বিষ ঢুকেছে। সে ওরা সার্ভে করে দেখেছে। আর তা ছাড়া……
—তা ছাড়া কী?
—তা ছাড়া, সুভাষবাবুকেই ওদের আসল ভয়। সুভাষবাবুই গান্ধীজীর কাজটা আরও সহজ করে দিয়েছেন! জেনারেল অকিন্লেকের বক্তৃতা পড়েও তাই মনে হয়।
—তাহলে যারা ওয়ার প্রিজনার তাদের কী হবে? অরুণা আসফ আলীর কী হবে? জয়প্রকাশ নারায়ণের কী হবে? তারাও তো ফর্টি-টু থেকে হিংসার পথ বেছে নিয়েছিল? প্রত্যেক কংগ্রেসী-আড্ডায় এমনি আলোচনা চলেছে। তখন সমস্ত দেশের লোক গান্ধীজীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। প্রাণমথবাবু বলেন—গান্ধীজী কনডিশন দিয়েছেন লর্ড ওয়াভেলকে যে যে-সব লোককে ধরা হয়েছে, তাদের বিচার করতে হবে ওপন্ কোর্টে, তবে তিনি গভর্নমেন্টের সঙ্গে কথা শুরু করবেন—
সে-সব দিন বড় থমথমে, রাতগুলো বড় নিথর। যারা সুভাষবাবুর দলে যোগ দিয়েছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে? শা নওয়াজ খাঁ, ক্যাপ্টেন ধীলন, লক্ষ্মীবাঈ, সর্দার জীবন সিং—সকলকে? সুভাষ বোস যদি ধরা পড়ে—তাকেও?
কলকাতা থেকে ওয়ার্ধা, মাদ্রাস থেকে ওয়ার্ধা, বোম্বাই থেকে ওয়ার্ধা, লন্ডন থেকে ওয়ার্ধা। সমস্ত ইন্ডিয়া তখন ওয়ার্ধায় এসে মিশেছে। সেখানে চার্চিলের ন্যাংটো ফকির চরকায় সুতো কাটতে কাটতে টেলিগ্রাফ আর চিঠিগুলো পড়ে। লন্ডনের খবরের কাগজের লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করে—চার্চিল আপনাকে কী বলেছে, আপনি দেখেছেন?
— দেখেছি।
তারপর চরকায় সুতো কাটতে কাটতে চিঠির খসড়া লিখলেন,—
Dear Mr. Churchill, you are reported to have a desire to crush the simple “Naked Fakir.” I have been long trying to be a Fakir and that naked a more difficult task. I ap-proach you to trust and use me for the sake of your people and mine and through them. those of the whole world.
প্রাণমথবাবু ওয়ার্ধা যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। ওদিক থেকে টেলিগ্রাম এসেছে। প্রাণমথবাবুর আর সে-শরীর নেই। সেই পান-ভর্তি মুখ, সেই গোড়ালি দোমড়ানো জুতো। হঠাৎ দৌড়তে দৌড়তে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো গোবিন্দ। বললে-একটা টেলিগ্রাম আছে বাবু—
~টেলিগ্রাম? আবার কার টেলিগ্রাম রে?
তাড়াতাড়ি খামটা খুলে দেখলেন—নিচেয় নাম লেখা: দীপঙ্কর।
দীপঙ্কর মস্ত টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে শিলিগুড়ি থেকে। লিখেছে—স্যার, কাগজে দেখলাম আপনি গান্ধীজীর কাছে যাচ্ছেন। আপনার সেখানে অনেক কাজ জানি। কিন্তু আমার একটা কাজের ভার দিলাম আপনাকে। আপনি কিরণকে চেনেন। সে কংগ্রেসের কেউ নয়, কিন্তু আপনার ছাত্র, আর আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সে আজ ফাঁসির আসামী। জানি গান্ধীজী অহিংসার পূজারী। কিন্তু তিনি হিম্মতের কদর বোঝেন। তার কথাটাও একবার তুলবেন তাঁর কাছে। তুললে তিনি নিশ্চয় তাকে ক্ষমা করবেন। সে-ও আপনাদের মত দেশকে ভালোবেসেছিল—ইতি, দীপঙ্কর।
প্রাণমথবাবুর সব মনে পড়লো। বললেন,—চলো—
গাড়ি চলতে লাগলো। হাওড়া স্টেশনের দিকে চলেছেন প্রাণমথবাবু। সঙ্গে অনেক কংগ্রেসের ফাইল। সেই ফাইলের মধ্যেই টেলিগ্রামখানা ঢুকিয়ে নিলেন। তীর্থে সবই পূণ্য। তীর্থযাত্রীর কাছে পাপ-পুণ্য সব সমান। প্রাণমথবাবু আর একটা পানের খিলি মুখে পুরে দিলেন।
কিন্তু হাওড়া স্টেশনের কাছে গাড়িটা যেতেই হঠাৎ ভিড়ের সামনে গাড়িখানা থমকে থেমে গেল। কী হয়েছে? ট্রেন মিস্ করবেন নাকি? এত ভিড় কীসের হে এখানে? কিন্তু কে-কার কথা শুনছে। হৈ-চৈ হট্টগোল, ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি সমস্ত অচল হয়ে গেছে। হঠাৎ যেন বোঝা গেল। আরো কয়েকটা লোক ওদিক থেকে দৌড়ে এল হাত উঁচু করে। টেলিগ্রাম। টেলিগ্রাম।
—কীসের টেলিগ্রাম?
অনেকগুলো হকার চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এল—নেতাজী মর গিয়া, নেতাজী মর গিয়া……
সেই আর্তনাদ কলকাতার থমথমে দিন যেন আরো থমথমে হয়ে গেল। কলকাতা এতদিনে সত্যিই যেন থেমে অচল হয়ে গেল। নির্বাক হতবুদ্ধি প্রাণহীন কলকাতার মানুষ ভাবতে ভুলে গেল, কাঁদতে ভুলে গেল। যে-সুভাষ বোসের জন্যে এতদিন প্রতীক্ষা করেছে ইন্ডিয়ার মানুষ, তার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমস্ত কলকাতাও নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। কান্নায় নিস্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। আর্তনাদ করে উঠলো সমস্ত মানুষের অন্তরাত্মা!