কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৭
৯৭
প্যালেস-কোর্টের পৃথিবীতে আবার উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। উদয়াস্ত খেটেও পীরালি ঘোষাল-সাহেবের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না। সাহেবের মেজাজ যেন আরো গরম আবার খানা ঠান্ডা হলে বিরক্ত হয়ে ওঠে। আট মাস ছিল না সাহেব। আট মাস যেন ঝিমিয়ে ছিল প্যালেস-কোর্ট। আবার হুইস্কি বীয়ার ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ খেয়ে খেয়ে প্যালেস-কোর্টের চেহারা ফিরে গেছে। বড় খিট্-খিটে, বড় মেজাজী! মকবুল যতীন জগন্নাথের আমদানি-রপ্তানি আবার বেড়েছে। তারা আসে যায় আর সেলাম করে। দেখলেই বোঝা যায় তারা খুশী। ক’দিন গোলমালের চোটে সাহেব বেরোতে পারেনি। দিশী পাড়াতেই ট্রাবটা বেশি। এ-পাড়ায় কিছু হয়নি, কিন্তু তবু গা ছম্-ছমে ভাব। রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিলই, এখন আরো ফাঁকা হয়ে গেছে। রোজ সকালে কোম্পানীর বিরাট গাড়িখানা এসে দাঁড়ায় পোর্টিকোতে, তারপর মিস্টার ঘোষালকে নিয়ে অনেক রাস্তা ঘুরে আপিসে পৌঁছে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় পুলিস-ভ্যান টহল দেয়। ওয়্যারলেস্ ভ্যানের ভেতরে আর্মড্ পুলিস রাইফেল্ উঁচিয়ে বাইরের দিকে তাগ্ করে থাকে। লালবাজারে পুলিস-ব্রিগেড্ রেডি থাকে দিন-রাত। এমনি করেই সব কাজ-কর্ম চলে শহরের। খিল্- আঁটা মুখে রাস্তার দু’একজন লোক চলাফেরা করে। ব্ল্যাক্-আউট উঠে গেছে, কিন্তু তবু শহরের ব্ল্যাক্-আউট বন্ধ হয়নি। সিভিক্-গার্ড, এ-আর-পি সব উঠে গেছে। তবু তারাই ইউনিফর্ম পরে রাত্রির অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়। পাড়ায়-পাড়ায় ডিফেন্স পার্টি-হয়েছে। তারা সারা দিন-রাত পালা করে নিজের-নিজের পাড়া পাহারা দেয়।
—পীরালি!
—হুজুর!
সন্ধ্যেবেলা আপিস থেকে এসে আবার বেরোয় সাহেব। গোলমালের জন্যে কয়েকদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু আবার সন্ধ্যেবেলা বেরোচ্ছে। ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটে আরো অনেক মিস্ মাইকেলের আমদানি হয়েছে। হোটেলে হোটেলে আরো অনেক ‘বার’ হয়েছে। সেখান থেকে অনেক রাতে পেলে সাহেব। তারপর সাহেব ডাকে—পীরালি—
পীরালি বলে—হুজুর!
হুমুক দিতে হয় না। পীরালি জানে। ডাকলেই পীরালি বুঝতে পারে। শোবার পর ঘরের আলো নিবিয়ে দিতে হয়, স্লিপার-জোড়া পায়ের কাছে রাখতে হয়, টেবল- ল্যাম্পটা বালিশের পেছন গুছিয়ে রাখতে হয়। অ্যাশ-ট্রে, সিগারেট, ম্যাচেস্—সব কিছু টিপয়ের ওপর রেখে দিয়ে তখন ছুটি। তারপর ভোর চারটে থেকেই পীরালির কাজ শুরু হয়। তখন হট্-ওয়াটার, টুথ-ব্রাশ, সিগারেট, ম্যাচেস্, কফি, সব কিছু রেডি করতে হবে।
কিন্তু সেদিন বিকেল বেলা আপিস থেকে এসে সাহেব বেরোল না আর। বললে—জাগন্নাথকে ডাক্—
জগন্নাথ এল। একেবারে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। বললে—তৈরি?
—হ্যাঁ হুজুর।
—কে কে আছে দেখলি?
—দু’জন আছে হুজুর, দু’বোন। আর একটা চাকর। বড় বোনটা পাগলের মতন। মাথা-খারাপের রোগ, প্রায়ই তো রেলের লাইনে মাথা দিতে যায়। তাকে ঘরে পুরে চোখে-চোখে রাখে!
—আর কেউ নেই বাড়িতে?
—না হুজুর, আর কেউ নেই।
মিস্টার ঘোষাল চুরোট ধরালে একটা। বললে—আচ্ছা তোকে আজ আমার সঙ্গে যেতে হবে সেখানে, এখন যা তুই—আর মল কোথায়?
মল তৈরিই ছিল। ঘরে ঢুকেই সেলাম করলে। সাহেব বললে—শিলিগুড়ি গিছলি?
—গিয়েছিলুম হুজুর। সব দেখে এসেছি
—পারবি তো?
মকবুল বললে—খুব পারবো হুজুর। বাঙলোর সামনে বাগান আছে হুজুর, পেছনেও বাগান আছে, লুকিয়ে থাকবার জায়গা আছে, জঙ্গল আছে, মাঠ আছে, কেউ ধরতে পারবে না—
—তাহলে ঠিক আছে, সঙ্গে কোনও লোক লাগবে তোর?
—না হুজুর, লোক কী হবে, আমি একলাই ফরসা করে দেব।
মিস্টার ঘোষাল যেন খুশী হলো। বললে—যা তা হলে এখন। কাল তোকে খবর দেব—
মল চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার বাইরে যেন কীসের হল্লা উঠলো।
সাহেব জিজ্ঞেস করলে—ও হল্লা কীসের রে?
—হুজুর, কাল থেকে ওই হল্লা শুরু হয়েছে। গুন্ডারা কোতোয়ালীতে ঢুকে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছে—
সত্যিই দাঙ্গা বটে। শ্যামবাজারের মোড়ে লক্ষ-লক্ষ লোক জড়ো হয়েছে। মিলিটারি ট্রাক দেখলেই কোথা থেকে ঝাঁকে-ঝাকে ঢিল এসে পড়ে তাদের গায়ে, তারা যেদিকে পারে গুলী চালায়। সেন্ট্রাল এভিনিউ আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে পাঁচখানা মিলিটারি-ভ্যানকে ধরে কারা আগুন জ্বালিয়ে দিলে। আগুন জ্বলতে লাগলো দাউ দাউ করে। কোথা থেকে আর্মির লোক এসে যাকে সামনে পেলে তাকেই গুলী করে রাস্তা ফাঁকা করে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার এসে জড়ো হয়েছে সবাই। জগুবাবুর বাজারের মোড়ে ট্রাম রাস্তার মোড়ে ডাস্টবিন জড়ো করে ট্র্যাফিক বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথমে পুলিস টিয়ার-গ্যাস ছুঁড়লো কয়েক-রাউন্ড, কিছু ফল হলো না। তখন গুলী চললো। একজন মরে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। হাজরা পার্কের মোড়ে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলো। আগুনের আলো দেখেই সবাই উঁকি মারলে আশে-পাশের বাড়ি থেকে দেখলে দাউ-দাউ করে আগুন জ্বলছে একটা মিলিটারি-গাড়িতে। কলকাতার কোনও জায়গা বাকি নেই। বড়বাজার, ডালহৌসী-স্কোয়ার, হাতীবাগান, কালীঘাট—সর্বত্র শুধু আগুন আর ভিড়। শহরের জীবন অচল হয়ে গেছে একেবারে। ট্রাম-বাস চলে না। কালীঘাট ট্রাম-ডিপোটাই একদিন সন্ধ্যেবেলা আগুনে পুরে গেল। ন’খানা ট্রাম ছাই হয়ে গেল আগুনে পুড়ে। ধর্মতলার মেথডিস্ট চার্চটায় একদিন আগুন জ্বলে উঠলো—চারদিকে অত লোক, অত ট্রাম-বাস-রিক্সা-ট্যাক্সি, তারই মধ্যে কখন যে কে গীর্জাটার ভেতর ঢুকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ জানতে পারেনি। আলিপুরের ডিস্টিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার স্টুয়ার্ট কোর্টে যাচ্ছিল। তাকে ধরে গাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দিলে লোকে।
মিস্টার ঘোষাল টেলিফোনটা তুললে, পুলিস কমিশনারকে জিজ্ঞেস করতে হবে- ট্রাবলটা কী? কেন এ-সব হচ্ছে?
কিন্তু একচেঞ্জ থেকে কোনও উত্তর নেই। কেউ ধরছে না। ঝপাং করে নামিয়ে রাখলে রিসিভারটা। তারপর স্টেট্সম্যানখানা টেনে নিলে। তার ওপর বড় বড় করে লেখা রয়েছে—মিলিটারি ওপন্ ফায়ার অন্ ক্রাউড্।
আর পড়া হলো না। কাগজখানাকে টেনে ফেলে দিয়ে মিস্টার ঘোষাল উঠলো। বললে—তুই জগন্নাথকে ডেকে দে—
জগন্নাথ আসতেই সাহেব বললে-চল্ আমার সঙ্গে—
—কোথায় হুজুর?
—গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে। গাড়ি রাখতে বল্—
জগন্নাথ বাইরে চলে গেল। মিস্টার ঘোষাল তৈরি হয়ে নিলে। সমস্ত কলকাতা পুড়ে যাক্, পুড়ে ছাই হয়ে যাক্, তাতে কিছু দুঃখ নেই। এর পেছনে আসে সেন। দ্যাট্ ব্যাস্টার্ড। দ্যাট্ রোগ। সেই-ই এতদিন প্যালেস-কোর্ট থেকে মিসেস ঘোষকে গড়িয়াহাটের বাড়িতে শেল্টার দিয়েছে। সেই সেনই আবার হয়ত একদিন মিসেস ঘোষকে শিলিগুড়ি নিয়ে যাবে। তার পথ বন্ধ করতে হবে! রিভলবারটা নিজের পকেটে পুরে নিলে। জেলে যাবার পরে লাইসেন্স ক্যাসেলড্ হয়ে গিয়েছিল, সেটা আবার পাওয়া গেছে।
গট্ গট্ করে মিস্টার ঘোষাল সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে এল। বিকেল হয়ে আসছে। চৌরঙ্গী দিয়ে বিরাট লম্বা প্রোসেসন্ চলেছে। মিস্টার ঘোষালের গাড়িটা এসে আটকে পড়লো। কিন্তু আর যেন দেরি সইছে না। সাহেব বললে—ভেতর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে চলো-পার্ক স্ট্রীটসে গাড়ি ঘুরাও —
পেট্রল কোম্পানীর ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিল। বললে—জী হুজুর—