Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প340 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩০. ঝিম মেরে বসে আছে রাজন

    অধ্যায় ৩০

    অনেকক্ষণ ধরে ঝিম মেরে বসে আছে রাজন। একটু আগে তারা সবাই একটা করে ‘ডাইল’ মেরেছে। বাকি তিনজন তার থেকে একটু দূরে বসে চাপাস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। একটা বিরক্তিকর রাত কাটাবে তারপরই এক কোটি টাকা। ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে করে মনে হয় না উল্টাপাল্টা কিছু ঘটবে। আর যদি শেষ মুহূর্তে ঐ মেয়েটার বাবা-মা কোনো কুমতলব এঁটে থাকে তাতেও সমস্যা নেই। সবুজ আছে। সে সব খবর জানিয়ে দেবে তাকে।

    হাতের সিগারেটের দিকে নজর দিলো রাজন। পর পর কয়েকটা টান দিয়ে ধোয়া ছেড়ে তিন যুবকের উদ্দেশ্যে বললো, “খাওন-টাওন কিছু আনছোস?”

    তিনজনের কেউ কথা বললো না। কাচুমাচু খেলো তারা।

    “টুন্ডা, মুরগির ঝালাই আর পরোটা নিয়া আয়। দেরি করবি না। অনেক ক্ষিদা লাগছে।”

    টুন্ডা নামের যুবক গাল চুলকাতে চুলকাতে চলে গেলো।

    “ভাই, পুরা টাকা দিতে রাজি হইছে?” জিপো লাইটার আগ্রহী হয়ে বললো। তার চোখ দুটো চকচক করছে যেনো।

    সিগারেটে লম্বা করে টান দিলো রাজন। “হুম।”

    জিপো লাইটার তাকালো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ষণ্ডামাকা যুবকের দিকে। ষণ্ডা শুধু মুচকি হাসি দিলো।

    “উল্টাপাল্টা কিছু করবো না তো?”

    ছাদের দিকে মুখ করে হাসলো রাজন। হাতের পিস্তলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। নিজেদেরকে ডাকাইত শফিকের লোক হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। পুলিশকে জানালে তারা ডাকাইতের পেছনেই ছুটবে। মুচকি হেেস তাকালো সঙ্গির দিকে।

    “উল্টাপাল্টা কইরা হেগো কোনো লাভ হইবো নি?” বললো জিপো।

    “কোনো লাভ হইবো না,” ছাদের দিকে তাকিয়েই বললো রাজন।

    “সবুজ তো কইলো সব ঠিক আছে, না?”

    জিপোর দিকে তাকালো এবার। এই ছেলেটা সব সময় বেশি কথা বলে। কিন্তু কামাল ছেলেটা ভালো। কাজও করে দারুণ। তাকে দেখেলেই লোকজনের বুক শুকিয়ে যায়। যেমন শরীর তেমনি তার সাহস। সারাদিনে তার মুখ থেকে দশটা কথা বের হয় কিনা সন্দেহ আছে, আর করিমার মুখ সারাদিনই চলে। সব ব্যাপারে তার কৌতূহল।

    “সব ঠিক আছে, চিন্তার কিছু-”

    অমনি রাজনের ফোনটা বেজে উঠলে পকেট থেকে বের করতেই তার মুখে ফুটে উঠলো হাসি। কলটা রিসিভ করে বললো, “হ্যাঁ, বলো।” ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। “হ্যালো?” কান থেকে ফোনটা সরিয়ে ডিসপ্লের দিকে তাকালো সে। লাইনটা এখনও সচল আছে। আবারো কানে দিলো। “হ্যালো?”

    কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারপরই লাইনটা কেটে গেলো।

    চুপ মেরে রইলো রাজন।

    “কে ফোন দিছিলো, ভাই?” জানতে চাইলো করিমা।

    “সবুজ।”

    “কথা কইলো না?”

    “না। মনে হয় নেটওয়ার্কে প্রবলেম।” কিন্তু রাজনের মনে হচ্ছে ঘটনা অন্য কিছু। সবুজ ঐ বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তার কাছে ফোন করে। হয়তো এখন ফোন করার পর কেউ এসে গেছিলো, তাই সে আর কথা বলে নি, লাইন কেটে দিয়েছে।

    “সমস্যা নাই, আবার করবো,” বললো রাজন।

    ঠিক তাই হলো। কয়েক সেকেন্ড পর আবারো বেজে উঠলো তার ফোনটা।

    মুচকি হেসে রাজন ফোনটা কানের কাছে চেপে ধরতেই থুতু ফেলার মতো একটা শব্দ হলো কেবল। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার উল্টে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলো সে। তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বের হলেও সেটা চাপা পড়ে গেলো পর পর আরো তিন-চারটা ভোতা শব্দের কারণে।

    কিছু বুঝে ওঠার আগেই করিমার দেহটা ছিটকে পড়লো মেঝেতে। জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। তার পকেট থেকে জিপো লাইটারটা পড়ে গেলো।

    কিন্তু কামাল তার ষণ্ডামাকা শরীরটা নিয়ে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়লো পাশের একটা মোটা পিলারের আড়ালে।

    করিমার শরীরটা বেঁকিয়ে থরথর করে কাঁপছে। তার বুকে আর পেটে দুটো ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

    কোমর থেকে পিস্তলটা হাতে নিয়ে পকেট থেকে ম্যাগাজিন বের করলো কামাল। ওটা লোড করে নিলো দ্রুত, কিন্তু গুলি করতে গিয়ে থেমে গেলো সে। পিলারের আড়াল থেকে গুলি করলেই অবস্থান জেনে ফেলবে আততায়ী। তারচেয়ে বরং অপেক্ষা করাই ভালো। নিশ্চিত না হয়ে কিছুই করবে না সে।

    কঙ্কালের মতো শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভবনটিতে ছাদ, পিলার আর সিঁড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। চারপাশ একদম খোলা। কোনো দেয়ালও নেই। কামাল জানে এখানে ঢোকার জন্য দুটো সিঁড়ি রয়েছে। একটা ভবনের সামনের দিকে, অন্যটা মাঝখানে। সে নিশ্চিত মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে তাদেরকে গুলি করছে। কারণ তারা অবস্থান করছে এই ভবনের একেবারে পেছন দিকে। এ দিকটায় গাছপালা আর ডোবানালা ছাড়া কিছু নেই।

    কামাল খুব অবাক, আততায়ীর গুলিগুলোর কোনো শব্দই হয় নি! সে যদি সাইলেন্সারের কথা শুনতো, জানতো, তাহলে এতোটা অবাক হতো না। ধরে নিলো, এটা র‍্যাবের কাজ। শুনেছে ওদের কাছে অত্যাধুনিক সব জিনিস রয়েছে। হয়তো এমন অস্ত্রও আছে যা থেকে গুলি বের হলে কোনো শব্দ হয় না। যাইহোক, তাকে এখন জীবন নিয়ে পালাতে হবে। রাজন আর করিমা শেষ। হোটেল থেকে খাবার আনতে গিয়ে টুণ্ডা বদমাইশটা বেঁচে গেছে। এখন যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে তাকে। তার কাছে থাকা নাইন এমএম-এর পিস্তলটায় চুমু খেলো কামাল। এটা যতোক্ষণ তার কাছে আছে ততোক্ষণ কারো কাছে ধরা দেবে না।

    মোটা পিলারের আড়াল থেকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো সে। কিছুই শুনতে পেলো না। বিশাল এই ফ্লোরটায় একটামাত্র বাতি জ্বলছে। মাত্র একশ’ ওয়াটের লালচে আলোয় পুরো ফ্লোরের খুব কম অংশই আলোকিত করতে পেরেছে। বাতিটা জ্বলছে ঠিক যেখানে রাজনের দেহটা চেয়ার উল্টে পড়ে আছে তার উপর। তার থেকে একটু দূরে পড়ে আছে করিমা, এখনও সে মরে নি। মৃদু খিচুনি দিচ্ছে। পিলারের আড়াল থেকে কামাল শুধু তার পা দুটো দেখতে পাচ্ছে এখন। তবে কোনো শব্দ করছে না করিমা।

    কামাল যেখানে আছে তার আশেপাশে বেশ অন্ধকার। ঐ বারে আলো এতোদূর পর্যন্ত আসে নি। কামালের ধারণা, গুলি করা হয়েছে। সামনের একটা পিলারের আড়াল থেকে। প্রথম গুলিটা লেগেছে রাজনের কপালে ডান চোখের উপরে। আর করিমার গুলি লেগেছে বুকে আর পেটে। সেই থেকে ধারণা করলো সামনের একটা পিলারের আড়াল থেকে সম্ভবত গুলিগুলো করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, আক্রমণকারী কি এখনও ঐ পিলারের আড়ালেই আছে?

    কামালের ধারণা, নেই। লোকটা সরে গেছে অন্য কোথাও। এই কয়েক মূহূর্তের নীরবতা আর বিরতি বলে দিচ্ছে সম্ভবত একজন ব্যক্তিই আছে পিলারের আড়ালে। একাধিক থাকলে কিছু না কিছু শব্দ তার কানে যেতো। ঠিক করলো যেখানে আছে সেখানেই ঘাপটি মেরে থাকবে। আক্রমণকারী কোথায় আছে সেটা নিশ্চিতভাবে না জেনে কিছু করবে না। পায়ের কাছে তাকিয়ে দেখলো একটা আধলা ইট পড়ে আছে। বাম হাতে সেটা তুলে নিলো কামাল।

    .

    আন্ডার কন্ট্রাকশন ভবনের চার তলার উপরে অন্য একটা পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু। এখন চলছে স্নায়ুর খেলা। তার থেকে পঞ্চাশ-ষাট ফুট দূরে অন্য একটা পিলারের আড়ালে এক অস্ত্রধারী লুকিয়ে আছে। সে নিশ্চত, ঐ হারামজাদার কাছে একটা অটোমেটিক পিস্তল রয়েছে। একটু আগেই গুলির ম্যাগাজিন ভরার মৃদু শব্দটা তার কানে গেছে। এই শব্দটা তার এতো বেশি পরিচিত যে ভুল হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

    অস্ত্রধারী এখন ঘাপটি মেরে আছে পিলারের আড়ালে। হয়তো তার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে, কিংবা পালাবার পথ খুঁজছে। এক নিমেষে তার দলের দু’জন ঘায়েল হয়ে যাওয়ায় কিছুটা ভড়কে গেছে হয়তো।

    এই আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবনে ঢোকাটা ছিলো খুবই সহজ কাজ। কোনো দাড়োয়ান নেই। নীচতলাটা একেবারে বিরান। প্রথমে সে নীচতলাটা ভালো করে দেখে নেয়। ওখানকার মতোই হবে সবগুলো তলার ফ্লোরপ্ল্যান। কারণ এখনও ভবনের কঙ্কাল দাঁড়িয়েছে মাত্র। কোনো দেয়াল নেই। অসংখ্যা পিলার আর মাথার উপর বিশাল ছাদ। বাবলু দেখেছে, এই ভবনের দুটো সিঁড়ি, দুটো লিফট শ্যাফট। সবুজ শুধু জানে এই ভবনে রাজন তার লোকজন নিয়ে অবস্থান করছে মেঘলার মেয়েসহ। কিন্তু বিশাল এই ভবনের কোন তলায় কোথায় তারা আছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিলো না।

    তবে নীচতলাটা রেকি করার সময় দারুণ একটা সুযোগ এসে পড়ে। হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে ওঠে সে। মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির কাছে একটি পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই দেখতে পায় খাটোমতো এক যুবক নেমে আসছে। ঠিক তার পিলারের কাছ দিয়েই ছেলেটা চলে যাবার সময় তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে পিস্তল ঠেকায় বাবলু। ছেলেটা চিৎকার দেবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারে নি। পিস্তলের নলের শীতলতা টের পেয়ে চুপ মেরে যায়।

    তারপর মাত্র দু’তিন মিনিটেই তার কাছ থেকে সব জেনে নেয় সে। কারা কোথায় অবস্থান করছে, মেঘলার মেয়েটা কোথায় আছে, সব। কাজ শেষে যথারীতি পুরস্কার পেয়েছে রাজন বাহিনীর ছেলেটা। মৃত্যু যন্ত্রণা একটুও টের পায় নি। এ ব্যাপারে বাবলু নিশ্চিত। নাইন এমএম ক্যালিবারের পিস্তল দিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করলে সেটাই হবার কথা।

    লালচে বাল্বের আলোয় সে দেখতে পেয়েছে, দু’জন ঘায়েল হয়েছে তার গুলিতে। তারমধ্যে দলনেতা রাজন আছে। দূরে, একটা পিলারের আড়ালে থেকে সে নিশ্চিত হয়েছে। প্রথমে সবুজের মোবাইল থেকে ফোন করে পিলারের আড়াল থেকে দেখতে পায় চেয়ারে বসা লোকটি কল রিসিভ করে। তার অন্যহাতে একটি পিস্তল ছিলো। একটু দূরে ছিলো আরো দু’জন। তাদের মধ্যে কার কাছে অস্ত্র আছে সে জানতো না। তারপর লাইন কেটে দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় সে। কয়েক মুহূর্ত পর আবারো কল করে। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো, তার কলটা রিসিভ করা মাত্র পর পর তিন-চারটা গুলি করবে। এক লহমায় ঘায়েল করবে তিনজনকে। কিডন্যাপারদের অগোচরে পিলারের আড়ালে থেকে বেশ ভালো সময় পেয়েছিলো টার্গেট করার জন্য। বাম হাতে ফোনটা কানে চেপে ধরে ডান হাতে পিস্তল তাক করে রাখে। চেয়ারে বসা রাজন কলটা রিসিভ করা মাত্রই দ্রুত টুগার টিপে দেয় সে। চেয়ার উল্টে পড়ে যায় রাজন, তার হাত থেকে পিস্তল আর মোবাইলফোনটা ছিটকে পড়ে যায় মেঝেতে।

    অন্যজন প্রথম গুলিটা খেয়ে ছিটকে পড়ে বিশালদেহী একজনের সামনে। ফলে বেচারিকে দুটো গুলি হজম করতে হয়, আর ভাগ্যের জোরে বেঁচে যায় ঐ ষণ্ডাটা। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা পিলারের আড়ালে চলে গেলে তাকে গুলি করার সুযোগ পায় নি।

    একটা শব্দ হলে নড়েচড়ে উঠলো বাবলু। তবে গুলি চালালো না। দূরে, বাম দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে মারা হয়েছে। সম্ভবত ইটের টুকরো। এখানে এরকম ইটের টুকরো প্রচুর আছে। বাঁকা হাসি হাসলো সে। পিলারের আড়ালে যে আছে সে চেয়েছিলো বাবলু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে গুলি চালাবে শব্দের উৎসের দিকে। এই ফাঁকে দুষ্কৃতিকারী সটকে পড়ার সুযোগ নেবে কিংবা বুঝে যাবে তার অবস্থান। সিনেমা দেখে দেখে এইসব চালাকি শিখেছে, ভাবলো সে। বোকাচোদা, আমিও সিনেমা দেখি! মনে মনে।

    বললো বাবলু।

    তার পায়ের কাছে অনেকগুলো আধলা ইটের টুকরো পড়ে আছে কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। রুমাল বের করে নাক মুখের উপর বেধে নিলো সে। তারপর পকেট থেকে গ্যাস-গ্রেনেডটা বের করে আনলো। পিস্তল ধরা হাতে পিনটা খুলে ছুঁড়ে মারলো পিলারের দিকে।

    হিস্ করে শব্দ তুলে ছোট্ট জিনিসটা থেকে পোয়া বের হতে লাগলো।

    এবার তোমাকে বের হয়ে আসতেই হবে!

    অধ্যায় ৩১

    আন্ডারকস্ট্রাকশন ভবন থেকে একটু দূরে থামলো হোমিসাইডের দুটো প্রাইভেটকার। পরের পুটে যে আন্ডারকন্সট্রাকশন ভবনটি দেখা যাচ্ছে সেটাই তাদের টার্গেট। পাশের দুটো ভবনের নাম্বার দেখে তারা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিলো। গাড়ি থেকে নেমেই জেফরি বেগের চোখে পড়লো অদূরে পার্ক করে রাখা কালো রঙের স্টেশনওয়াগনটি। আঙ্কেল নামের ভিক্ষুক বলেছিলো কিডন্যাপাররা কালো রঙের গাড়িতে ব্যবহার করেছিলো।

    এটাই কি সেই গাড়িটা?

    ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবলো না জেফরি। এটা পরে খতিয়ে দেখা যাবে।

    দুটো গাড়ি থেকে তারা পাঁচজন বেরিয়ে এলো। জেফরি বেগ ভবনের কাঠামোটির দিকে ভালো করে তাকালো। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পরিত্যাক্ত একটি ভবন। কেউ থাকে বলে মনে হয় না। মেইনগেট বলেও কিছু নেই। একসারি পুরনো ঢেউটিনের বাউন্ডারি রয়েছে চারদিকে, তবে ঢোকার জন্য সামনের কিছু অংশ ফাঁকা।

    জেফরি সবাইকে ইশারা করলো ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য। সবার আগে থাকলো সৈকত। তাদের সবার হাতে অস্ত্র। তবে তিনজন র‍্যাট সদস্যের হাতে অত্যাধুনিক সাব-মেশিনগান উজি রয়েছে। ওদের পরনে একই রকম ইউনিফর্ম।

    সতর্কভাবে ভবনের ভেতরে ঢুকে চারপাশটা দেখে নিলো তারা। এটা ভবনের পার্কিংলট। সামনের দিকে একটা সিঁড়ি আর লিফটের শ্যাফট চোখে পড়লো তার। জায়গাটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোনো বাতি নেই। তারা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই জামান হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। একটু ভড়কে গিয়ে শব্দ করে ফেললো সে। জেফরি আর বাকি দুজন র‍্যাট সদস্য সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র উঁচিয়ে চারপাশটা দেখে নিলো।

    “কি হয়েছে, জামান?” বললো জেফরি।

    “স্যার!” জামানের কণ্ঠে আতঙ্ক। “এখানে মনে হয় একটা লাশ পড়ে আছে…”

    একজন র‍্যাট সদস্য পেন্সিল লাইট জ্বালিয়ে আলো ফেললে সেখানে।

    খাটোমতো এক যুবক উপুড় হয়ে পড়ে আছে মুখ থুবরে। তার মাথায় গুলি করা হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রক্ত আর ঘিলু।

    সেই র‍্যাট আঙুল দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে বললো, “একটু আগে গুলি করা হয়েছে। রক্ত এখনও জমাট বাধে নি।”

    “ঘটনা কি, স্যার?” জেফরির দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বললো সৈকত।

    মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বললো সে। ভবনের যে আকার আর লে-আউট তা থেকে আন্দাজ করতে পারলো ভেতরের দিকে আরেকটা সিঁড়ি থাকতে পারে। একজন র‍্যাটকে দ্বিতীয় সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের সামনে। পজিশন নিতে বললো। আরেকজনকে প্রবেশপথের সামনে যে সিঁড়িটা রয়েছে সেখানে থাকার ইশারা করে জামান আর সৈকতকে নিয়ে প্রথম সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। যে-ই না উঠতে যাবে অমনি ধুপধাপ একটা শব্দ হলো উপর থেকে, তারপরই অস্ফুট গলার স্বর। সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারি চিৎকার। তারা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে ভারি কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেলো।

    একজন মানুষ!

    জেফরি একদম নিশ্চিত। হাঁড় আর মাংস থেতলে যাবার পৈশাচিক শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে, সেইসাথে আর্তচিৎকার। একটাই গোঙানি। তারপর আর কোনো আওয়াজ নেই। জেফরি, জামান আর সৈকত যে যেখানে ছিলো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। উপর থেকে কাউকে ফেলে দেয়া হয়েছে নীচে!

    দ্বিতীয় সিঁড়ির কাছে যে র‍্যাট ছিলো সে দৌড়ে চলে এলো তাদের কাছে।

    “স্যার!” ভয়ার্ত চাপাকণ্ঠে বললো অল্পবয়সী ছেলেটা। “উপর থেকে একজন মানুষ নীচে পড়ে গেছে…দুই নাম্বার লিফটের শ্যাফটের ভেতর!”

    তারা সবাই দ্বিতীয় লিফটের শ্যাফটের কাছে যেতেই একটা কিছু চোখে পড়লো। অন্ধকারেও বোঝা গেলো একদলা মাংসপিণ্ড যেনো পড়ে আছে!

    দ্বিতীয় সিঁড়িটা যে কভার দিচ্ছিলো সেই র‍্যাট সদস্যকে নিজের পজিশনে থাকার ইশারা করলো সৈকত। পেন্সিল লাইটের আলো ফেললো সে। দেখা গেলো বিশ দেহী এক যুবক পড়ে আছে। মাথাটা মেঝেতে পড়ে এমনভাবে থেতলে গেছে যে, সেটা আর চেনার উপায় নেই।

    একে অন্যের দিকে তাকালো। ঘটনা কী, কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা এসেছে কিছু অপহরণকারীকে ধরতে; একটা বাচ্চামেয়েকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে কিন্তু এই ভবনে ঢোকার পথে একজনকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে, এখন আবার উপর থেকে আরেকজনকে ফেলে দেয়া হলো। এসব কী হচ্ছে!

    মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পারলেও বেশ সতর্ক হয়ে উঠলো জেফরিসহ বাকিরা। পরিস্থিতি এমনই যে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব দ্রুত। তাই করলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

    সৈকতের নেতৃত্বে প্রথম সিঁড়ি দিয়ে সতর্ক পদক্ষেপে উপরে উঠতে শুরু করলো তারা। দ্বিতীয় তলায় এসে তিনজনেই থামলো। চারপাশটা দেখে নিলো ভালো করে। অন্ধকার আর একদম ফাঁকা। সৈকত তার উজিটা তাক করে ফ্লোরের ভেতরে ঢু মেরে দেখে এলো।

    “ক্লিয়ার!” চাপাকণ্ঠে বললো সে।

    তারা সবাই এবার তৃতীয় তলায় উঠে গেলো। এখানকার অবস্থা দ্বিতীয় তলার মতোই।

    চতুর্থ তলায় আসতেই ভড়কে গেলো। ধোয়া আর ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে আছে ফ্লোরটা। এক হাতে নাক চাপা দিয়ে কাছের বড় বড় পিলারের আড়ালে কভার নিলো তিনজন।

    টিয়ারগ্যাস!

    জেফরি বেগের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো। এসব কী হচ্ছে। কেউ টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করেছে এই ফ্লোরে! এরা কারা?!

    কিছুক্ষণ থাকলো পিলারের আড়ালে। গ্যাসের প্রকোপ কমে এলে দেখতে পেলো দুটো লাশ পড়ে আছে মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠলো তারা। সৈকত একটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা বড় পিলারের আড়ালে কভার নিলো। একই কাজ করলো জেফরি আর জামান। তাদের সবার অস্ত্র সামনের দিকে তাক করা। সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াতে লাগলো চারপাশে। এখানে নিশ্চয় অস্ত্রধারী কোনো ঘাতক রয়েছে। সংখ্যাটা একাধিক হবার সম্ভাবনাই বেশি।

    তারা যখন বুঝতে পারলো এই ফ্লোরে কেউ নেই তখন পিলারের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে মৃতদেহ দুটো ভালো করে দেখলো। ছাদের উপর থেকে ঝুলে থাকা লালচে বাল্বের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চেয়ার উল্টে একজন পড়ে আছে। তার কপালের বাম দিকে একটা ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে প্রচুর রক্ত গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। দ্বিতীয় লাশটা কয়েক ফিট দূরে। বুকে আর পেটে দুটো গুলি।

    তাদের তিনজনের চোখাচোখি হলো। এই হত্যাযজ্ঞ কে বা কারা ঘটালো-সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তবে এটা নিশ্চিত, যারাই ঘটিয়ে থাকুক না কেন তারা এখনও এই ভবনের ভেতরেই আছে। এবং সেটা উপরের কোনো ফ্লোরে। আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠলো তারা সবাই। উপরের তলায় যাবার আগেই হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ শোেনা গেলো। খুবই মৃদু। কিন্তু তারা নিশ্চিত, এটা মানুষের পায়ের আওয়াজ। উপর তলা থেকে আসছে।

    সৈকতকে দ্বিতীয় সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যেতে ইশারা করলো জেফরি, তারপর জামানকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম সিঁড়িটা দিয়ে চতুর্থ তলায় যে-ই না উঠতে যাবে সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ালো সে। কারোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। তার ধারণা আওয়াজটা তাদের দিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে এলো জেফরি বেগ। জামানকে ইশারা করলো ল্যান্ডিংয়ের ডান দিকে দেয়ালের আড়ালে পজিশন নিতে। সে পজিশন নিলো বাম দিকে।

    পায়ের আওয়াজটা ক্রমশ জোরালো হলো। জেফরি নিশ্চিত, একজন মানুষের পদক্ষেপ এটি। সৈকত? সে তো দ্বিতীয় সিঁড়িটা দিয়ে উপর তলায় গেছে। ভালো করেই জানে এই সিঁড়ি দিয়ে জেফরি আর জামান উঠবে। তাছাড়া এতো তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসার কথাও নয়। জেফরির মনে হলো না এটা সৈকতের পদক্ষেপ। বেশ নিশ্চিন্ত আর অসতর্ক। এখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে!

    হাতের অস্ত্রটা দু’হাতে শক্ত করে ধরলো সে। সিঁড়ি দিয়ে যে-ই নেমে আসুক সে সৈকত নয়।

    ল্যান্ডিংয়ের ডান দিকে জামানের দিকে তাকালো, দেয়ালে পিঠ দিয়ে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চোখেমুখে সুতীব্র ভীতি আর উত্তেজনা মিলে মিশে একাকার।

    কয়েক মুহূর্ত পরই দেখা গেলো কালো পোশাকের একজনকে। সিঁড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। তার কোলে একটি বাচ্চামেয়ে! হাতে কোনো অস্ত্র নেই। পেছন থেকেও জেফরি বুঝতে পারলো বাচ্চামেয়েটির দেহ নিশ্চল হয়ে আছে।

    আর দেরি করলো না। পিস্তল তাক করে গর্জে উঠলো সে। “একদম নড়বে না!”

    জামানও আগন্তুকের দিকে পিস্তল তাক করলো তবে সে কিছু বললো না।

    আগন্তুক থমকে দাঁড়ালো। যেনো অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যে চমকে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। এমনকি চট করে ঘুরে পেছন ফিরেও তাকালো না।

    “আমরা দু’জন আছি এখানে…তোমার দুদিকে…কোনো রকম চালাকি করবে না!” ধমকের সুরে বললো জেফরি বেগ।

    আগন্তুক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। জেফরি বেগের কোনো ধারণাই নেই এই লোকটা বাবলু। ঠিক যেমন বাবলু জানে না তার পেছনে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

    ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে বাবলু। পুরো অভিযানটি ধারণার চেয়েও বেশি দ্রুত আর সহজে সেরে ফেলেছে। কোনো বাধা পায় নি। সামান্য একটু প্রতিরোধের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছিলো একটু আগে তবে খুব সহজেই সেটা জয় করা গেছে। রাজন গ্রুপের এক ষণ্ডামাকা যুবক পিলারের আড়ালে লুকিয়েছিলো, তাকে আর গুলি করার সুযোগ দেয় নি। পকেট থেকে গ্যাস-গ্রেনেডটা বের করে সেদিকে ছুঁড়ে মারতেই দৌড়ে পালাতে গিয়েছিলো অস্ত্রধারী কিন্তু তার ভাগ্য ভালো ছিলো না। টিয়ার-সেলের ধোঁয়ার কারণে সিঁড়ি ভেবে লিফটের শ্যাফটের দিকে চলে গেলে সোজা নীচে পড়ে যায়। পুরো অভিযানটি তার জন্যে এক কথায় ছিলো : এলাম, দেখলাম আর উদ্ধার করলাম। কিন্তু এখন যখন বের হতে যাবে তখন আচমকা এসব কী হলো! এরা কারা?

    জেফরি বেগ দেখতে পেলো আগন্তুকের কোমরের পেছনে একটা অটোম্যাটিক পিস্তল গুঁজে রাখা।

    “একদম নড়বে না! যেখানে আছে সেখানেই থাকো!” আবারো সতর্ক করে বললো সে। তারপর জামানকে ইশারা করলো, তবে মনে হলো না সে বুঝতে পেরেছে। “বাচ্চাটাকে ওর হাতে তুলে দাও,” আদেশ করলো জেফরি।

    জামান এবার বুঝতে পারলো তার বসের ইঙ্গিতটা। নিজের পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিলো চটজলদি। তারপর চলে এলো বাবলুর পাশে।

    একই সময় জেফরি বেগ দু’পা এগিয়ে এসে তার কোমরের পেছন থেকে পিস্তলটা তুলে নিতে উদ্যত হলো।

    বেশ শান্তভাবেই একটু ঘুরে বাচ্চামেয়েটাকে জামানের হাতে তুলে দিলো বাবলু। জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হবার কারণে জেফরির সহকারী তার চেহারা দেখতে পেলো না।

    জামান বাচ্চাটা নিজের কোলে তুলে নেবার সময়ই জেফরি বেগ পেছন থেকে তার পিস্তলটা নিয়ে নিলো। ঠিক তখনই বাবলু মেঝের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার পেছনে যে আছে তার অবস্থানটা কোথায়। তাদের পেছনে, একটু দূরে লালচে বালের টিমটিমে আলোয় তিনজনেরই কালচে অবয়বের ছায়া পড়েছে মেঝেতে।

    “হাটু গেড়ে বসো!” আদেশ করলো জেফরি বেগ। “দু’হাত মাথার উপরে তোলো।”

    কথামতোই কাজ করলো বাবলু। হাটু গেড়ে বসে দু’হাত মাথার উপরে রাখলো সে। তার চোখ মেঝের দিকে।

    আচমকা কাঁধ ঘুরিয়ে ফেললো বাবলু। পুরো একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়াবার সময়টাতেই ভাঁজ করে রাখা ডান হাত জেফরির বাম হাতের নীচ দিয়ে গলিয়ে দিলো, খপ করে ধরে ফেললো সেটার কব্জি। একইসাথে ক্ষিপ্রগতিতে বাম হাত দিয়ে ইনভেস্টিগেটরের পিস্তল ধরা ডান হাতটার কব্জি ধরে পিস্তলের নলটা সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করলো। তারপর মাথা দিয়ে ইনভেস্টিগেটরের কপাল বরাবর প্রচণ্ড জোরে আঘাত হেনে বসলো সে।

    পুরো ঘটনাটা ঘটলো দুই সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে।

    কয়েক মুহূর্তের জন্যে টলে গেলো জেফরি বেগ। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই টের পেলো তার পেটে সজোরে লাথি মারা হয়েছে। আঘাতের তোড়ে বসে পড়লো সে। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো পিস্তল দুটো। সঙ্গে সঙ্গে থুতনী লক্ষ্য করে একটা পাঞ্চ করলো বাবলু।

    থুতনীর নীচে আঘাতটা বেশ জোরে হওয়াতে ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়ে গেলো সে।

    বাবলু চকিতে ডান দিকে তাকালো। বাচ্চাটা কোলে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জামান। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কোলের বাচ্চাটাকে মেঝেতে রেখে পিস্তল হাতে নেবার কথা মাথায় এলেও সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি করে ফেললো।

    বাবলু বিদ্যুৎগতিতে বাচ্চাটাকে দুহাতে ধরে জামানের ডান হাটু লক্ষ্য করে লাথি মেরে বসলো। আর্তনাদ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা চলে এলো বাবলুর কোলে। দেরি না করে ডান পা দিয়ে আবারো লাথি মারলো সে, এবার সরাসরি তার কান বরাবর।

    জামান ছিটকে পড়লো মেঝেতে। বাবলু দেরি না করে ছোট্ট দিহানকে মেঝেতে আস্তে করে শুইয়ে দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো জেফরি বেগের উপর। আঘাত সামলে উঠে সে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের পিস্তলটা তুলে নেবার চেষ্টা করেছিলো মাত্র।

    শুরু হয়ে গেলো তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি।

    জেফরি বেগ উপুড় হয়ে থাকার কারণে কোনো সুবিধা পেলোলা না। বাবলু তার গলাটা বাম হাতে পেচিয়ে ধরে ডান হাতে কিডনি লক্ষ্য করে পর পর দুটো ঘুষি চালালো। যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে উঠলো ইনভেস্টিগেটর।

    এরপরই দেখতে পেলো তার নিজের পিস্তলটা বাম দিকে হাতের নাগালের মধ্যেই পড়ে আছে। জেফরির গলাটা ছেড়ে দিয়ে পিস্তলটা তুলে নিয়ে তার দিকে তাক করলো সে।

    জামান এখনও তার বাম কান ধরে মাটিতে পড়ে কাতড়াচ্ছে। তার মাথা এলোমেলো, কানেও কিছু শুনতে পাচ্ছে না।

    টৃগারে চাপ দিতে যাবে যখন ঠিক তখনই জেফরি বেগ তার শরীরটা আস্তে করে ঘুরিয়ে চিৎ হয়ে দেখলো নিজের আক্রমণকারীকে।

    বিস্ময়ে ভুরু কুচকে গেলো দুজনেরই। তারা উভয়েই যারপরনাই বিস্মিত।

    “তুমি!” আৎকে উঠে বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

    বাবলু অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো ভুপাতিত জেফরির দিকে। কোনো হিসেব মেলাতে পারছে না সে। যেনো ভুত দেখলেও এরচেয়ে কম বিস্মিত হতো।

    জেফরি বেগের অবস্থাও একইরকম। সেও কোনোভাবে বুঝতে পারছে না এখানে বাবলু এলো কী করে।

    খুব বেশি হলে তিন-চার সেকেন্ড হবে। তারা দু’জনেই স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পরই আচমকা প্রচণ্ড শব্দে প্রকম্পিত হলো আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবনটি।

    গুলির ধাক্কায় কয়েক পা পেছনে টলে গেলো বাবলু। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো চারপাশ। ছিটকে পড়ে গেলো পাশে স্তূপ করে রাখা বালির উপর।

    তখনও বাবলু জ্ঞান হারায় নি। ঝাপসা দৃষ্টিতে শুধু দেখতে পেলো মাথায় সানক্যাপ পরা কালচে একটি অবয়ব অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছে তার দিকে।

    লোকটা কাছে এসেই তাকে লাথি মারলো। এরপর আরেকজন যোগ দিলো তার সাথে। কিন্তু একে চিনতে পারলো না বাবলু, এরইমধ্যে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে।

    জামান আর সৈকত মিলে এলোপাতারি লাথি আর ঘুষি মারতে লাগলো বাবলুকে।

    দুহাত দিয়ে মারগুলো আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো সে। গুলির আঘাতে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড জোরে বুটের আঘাত লাগতেই তার দৃষ্টি অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেলো।

    জ্ঞান হারানোর আগে শুনতে পেলো কেউ একজন চিৎকার করে বলছে : “থামো! থামো!”

    একজন পেশাদার খুনির কনফেশন

    “It is not the criminal things that are hardest to confess, but the ridiculous and the shameful.”

    -Jean Jacques Rousseau

    অধ্যায় ৩২

    তীব্র আলোতে দু’চোখ ঝল্‌সে গেলো তার। পিটপিট করে তাকালো। সামনে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। চিনতে পারলো। মি: বেগের সহকারী। তবে নামটা মনে করতে পারলো না। একটু আগে এই ছেলেটাকে বেদম মার দিয়েছিলো, তারপর কোত্থেকে যেনো হাজির হয় অন্য একজন। পর পর দুটো গুলি করে তাকে। এই মার খাওয়া ছেলেটা তখন যোগ দেয় ঐ অস্ত্রধারীর সাথে। তার উপর চড়াও হয়ে মনের আক্রোশ মিটিয়ে নেয়।

    এখন বাম কানের উপর একটি আইসব্যাগ চেপে ধরে রেখেছে সে। তার বাম চোখের নীচে কালশিটে পড়ে গেছে। কটমট চোখে চেয়ে আছে। তার দিকে। যেনো শোল্ডার হোলস্টারে থাকা পিস্তলটা দিয়ে এক্ষুণি গুলি করে মেরে ফেলবে তাকে।

    ছেলেটার দিক থেকে অবজ্ঞাভরে মুখ সরিয়ে নিলো।

    প্রায় ফাঁকা একটি ঘর। আকারে বিশালই হবে। চারপাশের দেয়াল দেখতে পেলো না। পুরো ঘরটাই অন্ধকারে ঢাকা শুধু মাথার উপরে ঝুলে থাকা একটি শক্তিশালী স্পটলাইট জ্বলছে।

    একটু আগে দু’জন লোক তাকে নিয়ে আসে এই ঘরে। এরপর কতোক্ষণ কেটে গেছে সে জানে না। অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি চলে এসেছিলো। তারপরই এই উজ্জ্বল আলোটা জ্বলে ওঠে।

    সে বসে আছে একটা চেয়ারে। তার দু’হাত পেছন মোড়া করে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা। সামনে লম্বা আর বিশাল একটি টেবিল। তার ঠিক বিপরীতে দুটো চেয়ার টেবিলের উপর আছে একটি ল্যাপটপ আর প্রিন্টারের মতো দেখতে মেশিন।

    জিনিসটা চিনতে পারলো সে।

    এর আগে প্রথমবার যখন এখানে এসেছিলো তখন এই যন্ত্রটার কিছু ক্যাবল তার শরীরের সাথে লাগিয়ে মি: বেগ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। এটা নাকি সত্যি-মিথ্যা ধরতে পারে!

    দু’চোখ আবার বন্ধ করে ফেললো। বুকের দু জায়গায় তীব্র ব্যথা টের পেলো। যেনো পাঁজরের হাঁড় ভেঙে গেছে। ব্যথার তীব্রতায় একটু কেশেও উঠলো। কাশতে গিয়ে বুঝতে পারলো চোয়াল দুটো কেমন আড়ষ্ট আছে। সেখানেও হালকা ব্যথা হচ্ছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটো চেটে নিলো। তার ঠোঁটের ডানকোণটা কেটে গিয়ে বেশ ফুলে আছে।

    নাকে হাত না দিয়েই বুঝতে পারলো সেখান থেকে রক্ত পড়ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। ঠিক তার ঠোঁটের উপর এসে যেনো থেমে গেছে রক্তের চিকন প্রবাহটা।

    হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলেও কাউকে দেখতে পেলো না। তারপরই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলো আরেকজন। অবয়বটি এগিয়ে এলো টেবিলের সামনে। এবার সে পরিস্কার দেখতে পেলো।

    জেফরি বেগ।

    তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই বিপরীত দিকের একটি চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে একটি ফাইল। তবে সহকারী ছেলেটার মতো তার শোল্ডারহোলস্টার নেই।

    চোখ সরিয়ে নিলো বাবলু।

    এই ইনভেস্টিগেটর লোকটির সাথে তার বার বার যোগাযোগ ঘটে যাচ্ছে। কোনো না কোনোভাবে এই লোক তার জীবনে এসে হাজির হয়। এটা শুরু হয়েছে লেখক জায়েদ রেহমানকে খুন করার পর থেকে। ঘটনাচক্রে তারা একই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। সে জানে তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে ছিলো এই লোক।

    অবশ্য কয়েক মাস আগে যখন দিল্লিতে অবস্থান করছিলো তখন আচমকা একদিন ইনভেস্টিগেটর তাকে ফোন করে। তার ফোন পেয়ে বাবলু যারপরনাই অবাক হয়েছিলো। প্রথমে সন্দেহ করেছিলো এই লোক বুঝি তাকে ধরার জন্য নতুন একটা ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু মি: বেগ যখন জানালো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একমাত্র ছেলেকে অপহরণ করে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেছে ব্ল্যাক রঞ্জু, সেইসাথে মন্ত্রীর কাছ থেকে তার দিল্লির অবস্থানের তথ্যও জেনে নিয়েছে তখন তার কাছে পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছিলো।

    রঞ্জুর লোকজন তাকে হত্যা করার জন্য দিল্লিতে আসছে!

    তারপরই মনে হয়েছিলো, ঘটনা যদি সত্যি হয়েও থাকে জেফরি বেগ কেন তাকে এসব জানাচ্ছে? কেন তাকে বাঁচাতে চাচ্ছে? এই লোক কি তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছে না?

    এসব প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুতই পেয়ে গেছিলো।

    জেফরি বেগ তাকে সব জানানোর পর একটা অনুরোধ করে, সে যেনো রঞ্জুর লোকজনের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের অবস্থান জেনে নিয়ে তাকে জানিয়ে দেয়। মন্ত্রীর উপর তার যতোই রাগ থাকুক, সে যেনো ঐ অল্পবয়সী ছেলেটাকে উদ্ধার করতে সহায়তা করে। ইনভেস্টিগেটরের বিশ্বাস ছিলো সব শুনে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে পালাবে না, বরং ব্ল্যাক রঞ্জুর লোকজনের পেছনে লাগবে। সত্যি বলতে তা-ই হয়েছিলো।

    মিঃ বেগের ঐ সতর্কবাণী তাকে শুধু ব্ল্যাক রঞ্জুর লোকজনের হাত থেকেই বাঁচায় নি, রঞ্জুসহ পুরো দলটাকেই শেষ করে দিতে সাহায্য করেছিলো। তবে রঞ্জুর লোকজনকে হত্যা করার আগে মন্ত্রীর ছেলেকে তারা কোথায় আটকে রেখেছে সেটাও জেনে নিতে ভুল করে নি। শেষ পর্যন্ত তার কাছ থেকে তথ্য পেয়েই জেফরি বেগ ছেলেটাকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। তারচেয়েও বড় কথা, উমাকেও অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছিলো ইনভেস্টিগেটর ভদ্রলোক। রঙুর লোকজন মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেছিলো তার উপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে।

    বাবলু মুখ তুলে তাকালো। জেফরি বেগ তার বিপরীতে এখনও দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। চোখে চোখ পড়তেই তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা গেলো।

    ইনভেস্টিগেটর টেবিলটা ঘুরে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ালো এবার। বাবলু বুঝতে পারলো না কিছু। জেফরি বেগ পকেট থেকে রুমাল বের করে তার নাকের নীচে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছতে গেলে প্রথমে মুখটা একটু সরিয়ে নিলো সে। জেফরি মুচকি হেসে তার নাকের নীচে জমে থাকা রক্ত পরিস্কার করে দিলো। বাবলু স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার দিকে।

    এ দৃশ্য দেখে জামানের ভুরু কুচকে গেলো। বোঝাই যাচ্ছে তার এটা পছন্দ হয় নি। এখনও বাবলুর মারের আঘাত তাকে ভোগাচ্ছে, বাম কানের উপর ছোট্ট একটা আইসব্যাগ ধরে রেখেছে সে।

    “অবশেষে আমাদের আবার দেখা হলো!” নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বললো জেফরি।

    আহত বাবলু শুধু মুচকি হাসলো।

    “সেই যে জেল থেকে জামিন নিয়ে ছাড়া পেলে তারপর আর তোমার নাগাল পাই নি,” বললো সে।

    জেফরি এখন নিশ্চিত, বাবলুর পেছনে আরো একটি অদৃশ্য শক্তি আছে। খুবই ক্ষমতাধর কেউ। বার বার তাকে রক্ষা করে এই শক্তি। যাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের ওঠাবসা রয়েছে। এমন কি এখনও তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে সেগুলো তুলে নেবার জন্য পর্দার আড়াল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।

    “অবশ্য দিল্লি থেকে যে তুমি দেশে ফিরে এসেছে সেটা আমি জানতাম। কিন্তু সত্যি বলছি, তোমাকে ধরার কোনো চেষ্টাই আমি করি নি। আমার বিশ্বাস ছিলো তুমি নিজেকে বদলে ফেলেছে। এসব কাজ আর করো না।”

    তার বিপরীতে বসা পেশাদার খুনির দিকে তাকালো সে। বুকের কাছে মাথাটা ঝুঁকে রেখেছে। জেফরির কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। যেনো এক চিলতে পরিহাসের হাসি লেগে রয়েছে তার ঠোঁটে। জেফরি বেগের এসব কথাবাতা তার কাছে অর্থহীন শোনাচ্ছে।

    “কিন্তু তুমি যে এভাবে ধরা পড়বে কল্পনাও করি নি,” বললো জেফরি।

    মুখ তুলে তাকালো বাবলু।

    “আমি তো হিসেব মেলাতে পারছি না, তুমি একজন প্রফেশনাল কিলার…যতোদূর জানি কিডন্যাপিং করার কোনো রেকর্ড তোমার নেই, তাহলে এসবের সাথে কিভাবে জড়িয়ে পড়লে?”

    স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে, তারপর আস্তে করে বললো, “বাচ্চাটার কি অবস্থা?”

    জেফরি বেগ ভুরু কুচকে তাকালো।

    “সম্ভবত প্যাথেড্রিন ইনজেকশন দিয়েছিলো ওরা। ওভার ডোজ…” আপন মনে বললো সে।

    “ওরা মানে? কাদের কথা বলছো?” জানতে চাইলো ইনভেস্টিগেটর।

    “আরেকটু দেরি হলেই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতো!” এবারও জেফরির প্রশ্নটাকে আমলে না নিয়ে বললো।

    জামানের দিকে তাকালে জেফরি। ছেলেটা এখন আরো বেশি রেগে আছে। বাস্টার্ড নামে পরিচিত খুনির আচরণে সে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। বাম কানের উপর আইসব্যাগ ধরে রেখে ভুরু কুচকে চেয়ে আছে বন্দীর দিকে। নিজের রাগ আর দমন করতে পারলো না। আচমকা বেশ জোরে টেবিলে চাপড় মেরে বলে উঠলো সে, “শাট-আপ! কোনো চালাকি করবে না। তুমি বলতে চাচ্ছো বাচ্চাটাকে তুমি কিডন্যাপ করো নি?”

    বাবলু দু’পাশে মাথা দুলিয়ে হেসে উঠলো শুধু। জামানের কথাটা পাত্তাই দিলো না তাচ্ছিল্যভরে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার তাকালো জেফরি বেগের দিকে।

    “তাহলে ওখানে তুমি কি করতে গেছিলে?” সহকারীকে শান্ত হবার ইশারা করে বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

    বাবলু চুপ মেরে রইলো।

    “কে তোমাকে ওখানে পাঠিয়েছে?”

    “আমি আমার কাজ আর ক্লায়েন্টের কথা কাউকে বলি না,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো বাবলু।

    “তোমার ক্লায়েন্ট?” জামান কিছু বলতে যাচ্ছিলো, জেফরি আবারো তাকে বিরত করলো। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো সে, “আচ্ছা। তাহলে ক্লায়েন্টের নাম বলতে চাচ্ছো না?”

    নিরুত্তর।

    “কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমাকে এটা স্বীকার করতেই হবে,” বেশ জোর দিয়ে বললো ইনভেস্টিগেটর।

    বাঁকা হাসি হাসলো বাবলু। “আপনি আপনার টর্চার শুরু করতে পারেন। চেষ্টা করে দেখেন…আমি কিছুই বলবো না।” আহত আর বিধ্বস্ত দেখালেও তার কথার মধ্যে দৃঢ়তা আছে।

    “আমি টর্চার করি না। ওভাবে ইন্টেরোগেশন করে কারো কাছ থেকে কথা আদায় করা আমার স্বভাব নয়।”

    “মেয়েটা এখন কেমন আছে?” আবারো জানতে চাইলো পেশাদার খুনি।

    “হাসপাতালে আছে।”

    জামান তাকালো জেফরির দিকে। এই খুনির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে তার বস্!

    বাবলুর চোখেমুখে কিছুটা উদ্বিগ্নতা দেখা দিলো।

    “তেমন কিছু হয় নি, একটু চেকআপ করানো হচ্ছে। প্রচণ্ড ট্রমার মধ্যে আছে এখনও। আশা করি শিগ্নিরই রিলিজ দিয়ে দেবে।”

    মনে হলো বেশ স্বস্তি পেলো বাবলু। তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এবার।

    একটু চুপ থেকে বললো ইনভেস্টিগেটর, “যদি মনে করে থাকো মুখ বন্ধ রাখলে বেঁচে যাবে তাহলে ভুল করছো। চারজন কিডন্যাপারকে খুন করেছে। কেন করেছে সেটা তো বলতে হবে, নইলে ফেঁসে যাবে তুমি।”

    “ভালো,” ছোট্ট করে বললো সে।

    জেফরি বেগ জানে তার সামনে বসে থাকা এই খুনি কেন এতো নির্বিকার। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো খুনের অভিযোগ থাকলেও প্রয়োজনীয় সাক্ষী আর প্রমাণ খুব বেশি নেই। ব্ল্যাক রঞ্জুসহ তার দলের অনেক সদস্যকে হত্যা করার ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা যায় নি রাজনৈতিক কারণে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে রক্ষা করেছিলেন আবার নিজের ছেলেকে ফিরে পাবার জন্যে রঞ্জুর হাতে তুলে দিতেও কার্পন্য করে নি। অবশ্য, জেফরির উদ্যোগ আর বাবলুর সাহায্যে শেষ পর্যন্ত রঞ্জুর দলের হাত থেকে ছেলেটাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সেই ঘটনায়ও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা যায় নি ঘটনার জটিলতার কারণে। রঞ্জুসহ তার দলের অনেককে সে খুন করেছে সুদুর দিল্লিতে। আর জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমানের কেসটা তো এখন জগাখিচুরি অবস্থায় আছে। এই একটা কেসের ব্যাপারেই জেফরি বেগ ভালো অবস্থানে ছিলো। অনেকগুলো প্রমাণও জোগার করতে পেরেছিলো কিন্তু এখন সেগুলোও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

    গত মাসে হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তিন-চারজন ডাকাত পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর জবানবন্দীতে জানায় তারা জায়েদ রেহমানের বাড়িতে ডাকাতি করেছিলো। ঐ সময় পক্ষাঘাতগ্রস্ত লেখক চিল্লাফাল্লা করতে গেলে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলে।

    একেবারেই বানোয়াট! জায়েদ রেহমানের বাড়িতে কোনো ডাকাতির ঘটনা ঘটে নি। জেফরির চেয়ে এটা আর কে ভালো জানে।

    তারচেয়েও বড় কথা, ভিটা নুভার যে দাড়োয়ানকে চাক্ষুস সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করেছিলো জেফরি-সত্যি সত্যি যে জবানবন্দী দিয়েছিলো, বাবলুকে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে দেখেছে-সেও গত মাসে বিদেশ চলে গেছে।

    তার ধারণা, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সিইএ সিদ্দিকী পর্দার আড়াল থেকে এসব করেছেন। সিদ্দিকী সাহেব তাকে কথা দিয়েছিলেন লেখকের তরুণী স্ত্রী আর তার প্রেমিককে রক্ষা করবেন। ঐ দু’জন একেবারেই নির্দোষ। ভদ্রলোক হয়তো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে শুরু করেছেন।

    আর এই কিডন্যাপের কেসটা তো রীতিমতো অদ্ভুত। হোমিসাইডের টিম ওখানে পৌঁছানোর আগেই চারজন অপহরণকারী খুন হয়ে যায়।

    হাতের ফাইলটা খুলে সেটার ভেতর থেকে জেম্‌ ক্লিপ দিয়ে আটকানো কিছু কাগজ বাবলুর সামনে রাখলো সে।

    “আমাদের জানামতে এ পর্যন্ত তুমি অনেকগুলো খুনখারাবি করেছে। আমাদের হাতে অবশ্য খুব বেশি প্রমাণ নেই। তবে একদমই যে নেই সেটা বলবো না।” একটু থেমে আবার বললো, “এই যে, এখানে বেশ কয়েকটি কেসের কথা বলা আছে। তোমার সম্পর্কে ছোটোখাটো একটি প্রোফাইলও রয়েছে আমাদের কাছে…” জেম ক্লিপে আটকানো কাগজটাতে টোকা মেরে বললো সে।

    বাঁকা হাসি হাসলো বাবলু। ফাইলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো। তার একটা ছবিও আছে। জেম ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা আছে ফুলস্কেপ কাগজের উপরের ডান দিকে। খুব সম্ভবত দূর থেকে তোলা। পরে হয়তো কম্পিউটারে ঘষামাজা করে ছবিটা স্পষ্ট করা হয়েছে।

    এই ছবিটা কোত্থেকে জোগার করেছে সে-চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য একটা ভাবনা খেলতে শুরু করলো তার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেলো তার অভিব্যক্তি। আস্তে করে চোখটা সরিয়ে নিলো সে।

    “আপনার এসব কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না।”

    জামানের ইচ্ছে করলো উঠে গিয়ে কষে একটা চড় মারবে। হারামজাদার সাহস কতো বড়! তোর ভালো লাগার গুষ্টি মারি!

    জেফরি বেগ ভুরু কুচকে তাকালো। “ভালো লাগছে না!” তারপর মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “আচ্ছা, তো কী করলে তোমার ভালো লাগবে?”

    “একটু চা খেতে পারলে!”

    জেফরি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

    জামানের বিস্ময় আর ক্রোধ যেনো বাধ ভেঙে যাবার পর্যায়ে চলে গেলো। এই বদশামটা বলে কী!

    তার দিকে ফিরে তাকালো জেফরি। মাথা নেড়ে ইশারা করলো তাকে। ছেলেটা যারপরনাই বিস্মিত হলেও আইসব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো চুপচাপ। রাতের বেলায় হোমিসাইডে কোনো পিয়ন-আরদার্লি ডিউটি দেয় না, তাই তাকেই যেতে হলো।

    জামান দরজার নবে হাত রাখতেই বাবলু বলে উঠলো, “দুধ চা…লিকার বেশি…চিনি কম!”

    রেগেমেগে পেছন ফিরে তাকালো সহকারী।

    আলতো করে দু’পাশে মাথা দুলিয়ে ক্ষুব্ধ জামানকে ইশারা করলো জেফরি। দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে চলে গেলো সে।

    “আই লাইক ইওর স্টাইল…ভেরি স্মার্ট!” বললো ইনভেস্টিগেটর।

    বাবলু শুধু মুচকি হাসলো।

    জেফরি বেগ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে কিছুক্ষণ। “তোমার মতো ঠাণ্ডা মাথার খুনিকে টর্চার করে কোনো লাভ হবে না জানি…অযথাই সময় নষ্ট।”

    “তাহলে আমাকে খামোখা বসিয়ে রেখেছেন কেন? জেলখানায় পাঠিয়ে দিন?”

    “অবশ্যই পাঠাবো…সময় হলেই পাঠাবো।”

    “সেই সময় এখনও আসে নি?”

    জেফরি বেগ দু’পাশে মাথা দোলালো।

    “কখন আসবে?”

    “চা খাবো…তোমার সাথে একটু গল্পগুজব করবো…তারপর।”

    “গল্পগুজব করবেন!…আমার সাথে?” বাবলু একটু বিস্মিত হলো যেনো।

    “হ্যাঁ।”

    “আপনার ধারনা আমি আপনার সাথে গল্প করবো?”

    স্থির চোখে চেয়ে রইলো জেফরি। “করতেও তো পারো।”

    বাঁকা হাসি হাসলো সে।

    “আইন অনুযায়ী তোমাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়া উচিত…আমি সেটা করবো। তারা তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করবে, কিন্তু তার আগে তোমার কাছ থেকে তোমার নিজের কিছু কথা শুনতে চাই।”

    বাবলু কিছু বললো না। তার দৃষ্টি যেনো আটকে আছে। ইনভেস্টিগেটরের উপর।

    “সত্যি বলতে, এই ফাইলে তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তেমন কিছু নেই।”

    বাবলু ফাইলটার দিকে তাকালো আবার।

    “আমাদের জানামতে যতোগুলো খুন করেছে তার একটা হিসেব আর তোমার সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য।”

    “এই সামান্য তথ্যে আপনার মন ভরছে না?”

    জেফরি বেগ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো।

    “নাকি এসব তথ্যের উপর আপনার নিজেরই কোনো বিশ্বাস নেই?”

    “আমি বলছি না এখানে যা আছে তার সবটাই সত্যি…তবে যতোদূর সম্ভব সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি।” ফাইলটা হাতে তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলো সে। “এখানে তোমার অতীত জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য নেই। আমি খুব অবাক হয়েছি, তোমার ব্যাপারে লোকজন খুব বেশি কিছু জানে না। যারা জানে তাদের কাছে হয়তো আমরা পৌঁছাতেই পারি নি।”

    নির্বিকার রইলো বাবলু।

    “তবে আমার মনে হয়, তুমি একা একা কাজ করলেও তোমার পেছনে শক্তিশালী কেউ আছে। তারা তোমাকে বার বার রক্ষা করে।”

    এবার একটু হাসলো বন্দী। “আপনার ধারণা সে-রকম কেউ থাকলে আমি আপনাকে সেটা বলে দেবো?”

    “বললেও সমস্যা নেই,” বললো ইনভেস্টিগেটর। “আজকে তুমি যা-ই বলো না কেন সেগুলো জবানবন্দী হিসেবে ব্যবহার করবো না।” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “আমি শুধু জানতে চাই কিভাবে তুমি এ পথে এলে; কেন এলে। “

    “আমার কনফেশন নিতে চাচ্ছেন?”

    জেফরি কিছু বললো না।

    নিঃশব্দে আবারো হাসলো বাবলু। বাঁকা হাসি হেসে বললো, “কনফেশন অব অ্যা কিলার?”

    অধ্যায় ৩৩

    হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে আছে এহসান চৌধুরি আর তার স্ত্রী। তাদের একমাত্র সন্তান দিহানকে পুলিশ উদ্ধার করার পর পরই এই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় ছোট্ট দিহানকে। কিডন্যাপাররা পর পর দুটো হাই-ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছিলো তাদের মেয়েকে। সেই ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়ায় দিহানের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। যদিও ডাক্তাররা বলছে ভয়ের কিছু নেই, একটু অবজার্ভেশনে রাখতে হবে, এই যা। ইচ্ছে করলে তারা বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারে। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর কেউই সেটা করে নি। সেই থেকে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে আছে তারা।

    মেয়েকে জীবিত ফিরে পাবার পর এহসান চৌধুরির যে কী রকম অনুভূতি হচ্ছিলো সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এ জীবনে যতোগুলো সুখের মুহূর্ত আছে তার মধ্যে এটাই সেরা। এমনকি তাদের মেয়ের জন্মের কথাটা শোনার পর যে অনুভূতি হয়েছিলো তারচেয়েও তীব্র ছিলো এটা।

    তবে এহসান চৌধুরি ভেবে পাচ্ছে না, তার স্ত্রী আনিকা কিভাবে কি করলো! যদিও পুলিশ বলছে তারা তাদের মেয়েকে উদ্ধার করেছে, কিডন্যাপারদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তার মন বলছে এসবের পেছনে আনিকার কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে। এদিকে তাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত কাজের লোক সবুজও লাপাত্তা। আনিকাকে জিজ্ঞেস করেছিলো তার ব্যাপারে। যে জবাব পেয়েছে তাতে করে মনে হচ্ছে সবুজ বোধহয় এই কিডন্যাপিংয়ের সাথে জড়িত। কিন্তু সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। সবুজ কিভাবে তাদের ছোট্ট দিহানকে ঐসব লোকের হাতে তুলে দেবে? অসম্ভব।

    আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দিহানকে ফিরে পাবার পর স্ত্রীর মধ্যে যে তাৎক্ষণিক আনন্দ আর স্বস্তির বহিপ্রকাশ দেখেছিলো সেটা যেনো আস্তে আস্তে মিইয়ে গেছে। এখন আনিকার চোখেমুখে অজানা আশংকা জেঁকে বসেছে। বিমর্ষ হয়ে ওয়েটিংরুমের এককোণে চুপচাপ বসে আছে সে। স্বামীর সাথেও খুব একটা কথা বলছে না। শুধু একটু পর পর নার্সের কাছে গিয়ে দিহানের অবস্থা জেনে আসছে।

    একটু আগে স্ত্রীকে বলেছিলো সে, কি হয়েছে। জবাবে দিহানের মা জানিয়েছিলো কিছুই হয় নি। সে কেবল ক্লান্ত বোধ করছে, আর কিছু না। বুঝতে পেরেছিলো তার স্ত্রী কথা বলতে চাচ্ছে না। তাকে আর বিরক্ত না করে এহসান চৌধুরিও চুপচাপ বসে আছে। আজ রাতটা তারা দুজন হাসপাতালেই কাটিয়ে দেবে। সুস্থ মেয়েকে বাড়িতে নেবার আগে তারা এখান থেকে নড়ছে না।

    আনিকা বুঝতে পারছে তার ভেতরে ক্রমবর্ধমান উদ্বিগ্নতা লুকাতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা লুকিয়ে ফেলার জন্য যেটুকু অভিনয় না করলেই নয় সেটুকু কিছুতেই করতে পারছে না। তার এই উদ্বিগ্নতা দিহানকে নিয়ে নয়। মেয়েকে তারা জীবিতই ফিরে পেয়েছে। ডাক্তার বলেছে চিন্তার কোনো কারণ নেই, আগামীকালের মধ্যেই মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে।

    আনিকা তাবাসসুম দিলশাদের এখনকার সবটুকু উদ্বেগ বাবলুর জন্য। ছেলেটার কী হলো, কোথায় আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা কিছুই সে জানে না। তার সাথে শেষ যোগাযোগ হয়েছিলো ফোনে, সবুজকে তার হাতে তুলে দেবার পর। তখন সে জানিয়েছিলো, খুব শীঘ্রই দিহানকে উদ্ধার করে তার কোলে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এর বেশি কিছু বলে নি। আনিকাও কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায় নি।

    তারপর এক ঘণ্টা অসহ্য অপেক্ষা শেষ হয় একটা ফোন কলে।

    না। কলটা বাবলু করে নি। করেছিলো পুলিশ। তাদের একমাত্র সন্তান দিহানকে উদ্ধার করেছে তারা। মেয়েকে একটু চেকআপ করানোর জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

    পুলিশের এসব কথা শুনে তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জন আগুপিছু না ভেবেই চলে আসে হাসপাতালে। সেই থেকে এখানেই আছে।

    কিন্তু একটা বিষয় আনিকার মাথায় ঢুকছে না, তার মেয়েকে পুলিশ কিভাবে উদ্ধার করলো? তারা তো জানেই না তাদের মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে!

    পুরো ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

    বাবলু কোথায়? তার কি হয়েছে? এ প্রশ্নগুলোই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে।

    তার ধারণা বাবলুর খারাপ কিছু হয়েছে। নিজের মেয়েকে ফিরে পাবার জন্য তাকে ব্যবহার করেছে সে। এখন যদি দেখা যায় সত্যি সত্যি তার খারাপ কিছু হয়েছে তাহলে সারাটা জীবন অপরাধবোধে ভুগতে হবে।

    আনিকার ভালোর জন্য বাবলু নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো। কোনো রকম যোগাযোগ করে নি। আনিকাও এক পর্যায়ে সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করে। পড়ালেখা শেষ করে বিরাট ধনী পরিবারে তার বিয়ে হয়। তার কোল জুড়ে আসে দিহান। প্রকারান্তরে আনিকার জীবন থেকে বাবলু বিস্মৃতই হয়ে গেছিলো, কিন্তু ঘটনাচক্রে কয়েক দিন আগে তাদের আবার দেখা হয়ে যায়। এরপরই দিহানের জীবন বাঁচাতে বাবলুর শরণাপন্ন হয় সে।

    যে কারণে বাবলুর সাথে তার বিচ্ছেদ, যে পথে চলে যাবার জন্য তার আর বাবলুর মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব সেটাই কিনা দরকার হয়ে পড়লো আনিকার।

    মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে, বাবলুর যেনো কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে। যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক ছেলেটা যেন ভালো থাকে। তার জীবনটা যেনো সুন্দর হয়ে ওঠে।

    আনিকা টের পেলো তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো মুছে নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে।

    অধ্যায় ৩৪

    চা নিয়ে ফিরে এসেছে জামান। এখন আর আইসব্যাগটা নেই। তার চোখেমুখে অসন্তোষের চিহ্ন কিন্তু জেফরি বেগের কারণে সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

    এখন আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে খুনি। একটু আগে জেফরির নির্দেশে তার হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়া হয়েছে। এখন শুধু বাম হাতটা চেয়ারের হাতলের সাথে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে, ডান হাতটা মুক্ত।

    চারটা খুন, দুটো অবৈধ অস্ত্র, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট-একেবারে হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছে এই পেশাদার খুনি। এ দেশের কোনো সন্ত্রাসী কিংবা পেশাদার খুনি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ব্যবহার করে বলেও তার জানা ছিলো না। তার বস দীর্ঘদিন ধরে একে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের পর একে ধরা সম্ভব হয় নি। অল্পের জন্য হাত ফসকে যায়। ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের অনেককে খুন করার পর রঞ্জুর হাতে মরতে বসেছিলো সে। জেফরি বেগ ঠিক সময় না পৌঁছালে বেঁচে থাকতো কিনা সন্দেহ। জামান তখন ভেবেছিলো হাসপাতালে নেবার আগেই মারা যাবে, কিন্তু কই মাছের প্রাণ এই খুনির। খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হবার পর জেফরি তাকে ইন্টেরোগেট করে। তার বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করায়। আর তাদেরকে অবাক করে দিয়ে কয়েকমাস পরই সে জেল থেকে বেরিয়ে। আসে। তারা যাকে ধরেছে সে নাকি বাস্টার্ড না! ভুল মানুষকে ধরা হয়েছে!

    স্বয়ং হোমমিনিস্টার তার পক্ষ নিয়েছিলো। এ ঘটনার পর রেগেমেগে হোমিসাইডের চাকরিই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো তার বস। ফারুক স্যার অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাকে নিবৃত্ত করে। এরপরই ঘটে উল্টো ঘটনা। হোমমিনিস্টারের ছেলে অপহৃত হয় ব্ল্যাক রঞ্জুদের হাতে। ছেলেটাকে জিম্মি করে জেল থেকে বেরিয়ে আসে পঙ্গু সন্ত্রাসী। তার দলকে মোকাবেলা করতে গিয়ে হোমিসাইড রীতিমতো নাকানিচুবানি খায়। জেফরি বেগ আর জামানসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় তারা।

    যাইহোক, অবশেষে তার বস্ মিনিস্টারের ছেলেকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পরিহাসের ব্যাপার হলো, এ কাজে দারুণ সাহায্য করেছে এই খুনি!

    কথাটা যখন সে শুনেছিলো একদমই বিশ্বাস করতে পারে নি। এটা কী করে সম্ভব? তার বস্ নিজেই তো ঐ খুনিকে ধরার জন্য তক্কে তক্কে ছিলো!

    এখন সেই খুনি হঠাৎ করেই তাদের হাতে ধরা পড়ে গেছে। ঘুণাক্ষরেও তারা কেউ বুঝতে পারে নি চৌধুরি সাহেবের অপহৃত মেয়েকে উদ্ধার করার সময় এর দেখা পাবে।

    জামান নিশ্চিত, এর পেছনে বিরাট কাহিনী আছে, ঠিকমতো ইন্টেরোগেট করলে এই খুনির কাছ থেকে সেসব জানা যাবে। অথচ তার বস্ এসব বাদ দিয়ে আজাইরা প্যাচাল পাড়ছে! খুনির সাথে এমন ব্যবহার করছে যেনো সে কোনো আসামী নয়, হোমিসাইডে বেড়াতে এসেছে! রীতিমতো চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে তাকে।

    রাগেক্ষোভে চুপ মেরে বসে আছে জামান।

    জেফরি বেগ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। তারপর আস্তে করে বললো, “যে চারজন কিডন্যাপারকে খুন করেছে তার জন্যে তোমার কাছে আমি ঋণী। তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।”

    কথাটা শুনে অবাক হলো বাবলু, তবে কিছু বললো না। চায়ের কাপ নমিয়ে রাখলো সে।

    তবে জামানের অভিব্যক্তি দেখার মতো হলো। তার বস্ এসব কী বলছে! দাঁতে দাঁত পিষে নিজের রাগ দমন করলো আবার।

    ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর, “কারণ তুমি কাজটা না করলে আমি নিজেই সেটা করতাম।”

    স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বাবলু। কথাটা যে জেফরি বেগ মিন করে বলেছে সেটা আঁচ করতে পারলো তার অভিব্যক্তি দেখে।

    জামানও জানে কথাটা সত্যি। তাহলে এজন্যেই এতো খাতির করা হচ্ছে? মনে মনে বললো সে।

    একটু চুপ থেকে বাবলু বললো, “আপনি আমার গল্প শুনতে চাইছেন কেন?”

    “কৌতূহল,” বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। “তোমার বাবা-মা কে; তোমার ছেলেবেলা কেমন কেটেছে; কিভাবে এ পথে এলে; এ সব। মানে, একজন স্বাভাবিক মানুষ কি করে খুনি হয় সেটা জানতে চাই।”

    “আপনার কেন মনে হলো আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম?” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো সে। “আপনার এই ফাইলে নিশ্চয় আছে, আমার বাবা একজন পেশাদার খুনি ছিলো।”

    “তা আছে, এর বেশি কিছু নেই,” জবাব দিলো জেফরি। “কিন্তু আমরা কেউই খুনি হয়ে জন্মাই না। তুমিও এর ব্যতিক্রম ছিলে না। হতে পারে তোমার বাবা খুনি ছিলো, তাতে কি? আমরা সবাই কি সবসময় আমাদের বাবা-মায়ের মতো হই?”

    চুপচাপ ইনভেস্টিগেটরের কথা শুনে গেলো সে।

    “লোকে তোমাকে বাস্টার্ড নামে চেনে কিন্তু তারা কেন তোমাকে এ নামে ডাকে তা জানি না।” একটু থেমে আবার বললো, “যদি কারোর বাবার পরিচয় না থাকে তাকে আমাদের সমাজ এ রকম গালি দেয় কিন্তু তোমার তো বাবা ছিলো, তোমাকে কেন এ নামে ডাকবে? আমি নিশ্চিত এর পেছনে একটি গল্প আছে।”

    একবার জেফরি বেগের দিকে আরেকবার টেবিলের উপর রাখা ফাইলটার দিকে তাকালো সে। তারপর আপন মনে আস্তে করে বলে উঠলো, “গল্প!”

    অধ্যায় ৩৫

    বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিলো এতোক্ষণ, এখন একটু কমে এসেছে। সুরতুন্নেসা হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার ভয় হচ্ছিলো ঝুপরি ঘরটা বুঝি ভেঙে পড়বে। একে তো বৃষ্টি তার সাথে দমকা বাতাস। বস্তির এই ঝুপরি ঘরটার অবস্থা এমনিতেই নাজুক। টিনের চালে কমপক্ষে দশ-বারো জায়গায় ফুটো আছে। তার সাত-আট বছরের মেয়ে পেয়ারি মগ, বালতি আর বোল নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছাদের পানি ধরে রাখার জন্য। তাদের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। এই বস্তির সদারের ঘর ছাড়া আর কারো ঘরে সেই সুবিধা এখনও পৌঁছায় নি। টিমটিমে আলোয় একটা হারিকেন জ্বলছে শুধু।

    সুরতুন্নেসা বুকের কাছে ছয় মাসের এক শিশুকে আগলে রেখেছে। আমকাঠের সস্তা খাটে বসে আছে মা-মেয়ে। এই বাচ্চাটা হবার সময় বেশ ধকল গেছে তার। এখন অবশ্য সেরে উঠেছে।

    পর পর দুটো মেয়ে জন্ম দিয়ে স্বামীর বিরাগভাজন হয়েছে। পেয়ারির বাপ এই নবজাতক মেয়েকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। জন্মের পর দু’মাস পেরিয়ে গেলেও নাম রাখা নিয়ে বাপের মধ্যে কোনো তাড়া দেখা যায় নি। অগত্যা সেই কাজটা সুরতুন্নেসাকেই করতে হয়। কিন্তু তার দেয়া নাম পছন্দ হয় নি ছোট্ট পেয়ারির। সে নিজেই ছোটো বোনের নাম রেখেছে আঙ্গুরি। ঐটুকুন ছোট্ট মেয়ে ‘আঙ্গুরি’ বলতে কী বুঝিয়েছে কে জানে। হয়তো এই নামের অন্য কোনো বাচ্চাকে দেখে থাকবে সে।

    ছোট্ট আঙ্গুরি একটু কেঁদে উঠলো। বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আদর করলো সুরতুন্নেসা।

    পেয়ারি এখন পানি খাওয়ার এলুমিনিয়ামের একটি মগ নিয়ে বসে আছে তার পাশে। ছাদের ফুটো দিয়ে এখানটায় বৃষ্টির পানি পড়ছে। সেই পানি যেনো কোনোমতে খাটের উপর পড়তে না পারে সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মেয়েটা।

    এমন সময় দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা মারার শব্দ হলো। সুরতুন্নেসা ভাবলো পেয়ারিরর বাপ বোধহয় আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। বৃষ্টির কারণে হয়তো আজ আর রিক্সা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

    সুরতুন্নেসা কোলের বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলে পেয়ারি বলে উঠলো, “আমি দ্যাখতাছি, মা।”

    হাতের মগটা বিছানার উপর রেখে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো সে। তার ধারণা বাপ এসেছে। দরজার হুড়কোটা খুলে দিতেই হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো একজন। মাথা গামছা দিয়ে পেচানো, লুঙ্গি আর শার্ট পরা লোকটার কোলে চাদরে মোড়া পুটলির মতো একটি জিনিস।

    হারিকেনের আলোয় সুরতুন্নেসা লোকটার চেহারা দেখে চিনতে পারলো।

    খুইন্যা বাবুল!

    একটু অবাক হলো সে, সত্যি বলতে, কিছুটা ভয়ও পেলো। এই বস্তির সবাই জানে বাবুল একজন পেশাদার খুনি। টাকার বিনিময়ে খুনখারাবি করাই তার পেশা।

    “ধুর। পুরা ভিজা গেলাম। কথা নাই বার্তা নাই বৃষ্টি আয়া পড়লো,” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো খুইন্যা বাবুল।

    পেয়ারির মা অনেকটা ভয়ে আৎকে উঠে বলেই ফেললো, “বাবুল…তুমি! এতো রাইতে?”

    বাবুলের কোলে পুটলিটার দিকে তাকালো এবার। জ্বলজ্যান্ত ফুটফুটে একটি বাচ্চা! দু’এক সপ্তাহের বেশি বয়সী হবে না। নবজাতক শিশুটি পিটপিট করে ঘরের চারদিকে তাকাচ্ছে।

    “ধর তো,” বাচ্চাটা পেয়ারির হাতে তুলে দিয়ে চৌকিতে বসে পড়লো খুইন্যা বাবুল। তারপর মাথার গামছাটা খুলে শরীরের ভেজা অংশ মুছতে মুছতে বললো, “পেয়ারির বাপে কই?”

    “এহনও ফিরে নাই। আইজকা তো সন্ধ্যার পর কামে বাইর হইছে, একটু থেমে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললো, “ও বাবুল, বাচ্চা পাইলা কই?”

    “পাইছি…” আর বেশি কিছু জানালো না খুইন্যা বাবুল।

    সুরতুন্নেসা পেয়ারির দিকে তাকালো। সে এরইমধ্যে বাচ্চাটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। “কার বাচ্চা?”

    খুইন্যা বাবুল একটু ঝাঁঝের সাথে বললো, “কারোর না কারোর তো অইবোই…নাকি?”

    পেয়ারির মা ভয়ে আর কিছু বললো না। খুনখারাবি করা লোকজনের মেজাজ বিগড়ে দেবার মতো বোকা সে নয়। তাছাড়া যেরকম আকালের দিন পড়েছে কতো মানুষ যে নিজের আদরের সন্তান বিক্রি করে দিচ্ছে, ফেলে চলে যাচ্ছে তার কোনো হিসেব আছে?

    একটু ঢোক গিলে সুরতুন্নেসা বললো, “আমার কাছে নিয়া আসছো ক্যান…ভাই?”

    খুইন্যা বাবুল একটু চুপ থেকে বললো, “আমি তো বিয়াশাদি করি নাই। আত্মীয়স্বজনও নাই…” কথাটা বলে একটু থামলো সে। যেনো অদৃশ্য একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “আমি ওরে কেমনে পালমু।”

    পেয়ারির মা ঢোক গিললো।

    “তুমি ওরে পালবা, ওর দুধমা হইবা,” স্থিরচোখে সুরতুন্নেসার দিকে চেয়ে বললো বাবুল। “চিন্তার কোনো কারণ নাই, এরজন্য মাসে মাসে আমি তোমারে টাকা-পয়সা দিমু। একটু বেশিই দিমু।”

    “আ-আমার তো নিজেরই একটা দুধের বাচ্চা…পালতে জান বাইর অয়া যাইতাছে, তার মইদ্যে অন্যের বাচ্চা…” খুইন্যা বাবুলের লাল টকটকে চোখের দিকে তাকাতেই পেয়ারির মা আর কিছু বলতে পারলো না।

    “একটা বাচ্চা পালন যা দুইটা পালনও একই কথা। মাইনষের ভাত রাইনধ্যা আর কতো পাও…তোমাগো সংসারের যা অবস্থা। পেয়ারির বাপ তো ঠিকমতো রিক্সা চালাইতে পারে না। প্রায়ই অসুখে থাকে। হের শরীরে আর কুলায় না। বাচ্চাটারে রাখো। তোমাগো লাভই হইবো,” একদমে বলে গেলো বাবুল।– সুরতুন্নেসা কিছুই বললো না। কথা সত্য। পেয়ারির বাপে প্রায়ই অসুখে ভোগে। নিয়মিত রিক্সা চালাতে পারে না। এ জন্যে সংসার চালাতে এই বস্তির কয়েকজন লোকের ভাত বেঁধে দেয়ার কাজ করে সে, এরমধ্যে খুইন্যা বাবুলও আছে। এই কাজ করে হাতে কিছু পয়সা-কড়ি আসে। নইলে ঢাকা শহরে ডাল-ভাত খেয়ে থাকার উপায় নেই। তারমধ্যে এখন আবার শুরু হয়েছে দুর্ভিক্ষ। মাত্র কয়েক বছর আগে দেশ স্বাধীন হলো। লক্ষ-লক্ষ মানুষ মরেছে, আর ধনসম্পদের ক্ষতির তো কোনো হিসেবই নেই। তার নিজেরও কি কম হয়েছে? সুরতুন্নেসা সব গহনা বিক্রি করে আর সংসারের খরচ বাঁচিয়ে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলো জমি কেনার জন্য। পেয়ারির বাপ পরের জমিতে বগা খাটে। খুব বেশি লাভ হতো না তাতে। ইচ্ছে ছিলো জমি কিনে চাষবাস করবে, কিন্তু যুদ্ধ তার ঐটুকু সম্বলও শেষ করে দেয়।

    যুদ্ধের পর কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর আগেই এই আকালের ঘা এসে লাগে তাদের উপর। গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয় অচেনা এই শহরে। এখন তো সচ্ছল ঘরের লোকজনই অভাবে পড়ে গেছে, আর তারা হলো চিরঅভাবী। তারপরও পরের বাচ্চা মানুষ করার মতো ঝামেলায় পড়তে চায় না সে। কে জানে খুইন্যা বাবুল যদি বাচ্চাটা চুরি করে এনে থাকে তাহলে তো বিপদ। পরে আবার পুলিশের ঝামেলা হতে পারে।

    সে কিছু বলতে যাবে অমনি পেয়ারি বলে উঠলো, “ও মা, তোমার না পোলার শখ? আমাগো তো কোনো ভাই নাই। বাবুটারে রাইখ্যা দাও না?”

    সুরতুন্নেসা একবার মেয়ের দিকে আরেকবার খুইন্যা বাবুলের দিকে তাকালো ভয়ে ভয়ে।

    *

    হামিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। জেফরি বেগ চুপ মেরে বসে আছে। তার চোখমুখ বিষণ্ণ। পাশে বসে আছে জামান। সেও কিছু বলছে না। জেফরির ভেতরে কি আলোড়ন তুলছে সেটা তার সহকারীর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তার নিজের অতীত সম্পর্কে পরিচিতজনেরাও খুব বেশি কিছু জানে না। একজন মিশনারী-শিক্ষক ফাদার হোবার্টের কাছে মানুষ হয়েছে সে-এর বেশি তথ্য খুব কম মানুষই জানে।

    তার সামনে বসা পেশাদার খুনির গল্পটা তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

    উনিশ শ’ চুয়াত্তর! দুর্ভিক্ষ! নবজাতক একটি শিশু! কী আশ্চর্য মিল!

    কয়েক মুহূর্তের জন্য জেফরি বেগ কিছুই বলতে পারলো না। তার চোখে ভেসে উঠলো একটি কল্পিত দৃশ্য : তরুণ এক ফাদারের কোলে এক নবজাতক। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছেন।

    বড় হবার পর ফাদার হোবার্টের কাছ থেকে এটা শুনেছে সে। তার আগে সে জানতো না তার জন্মপরিচয়। ফাদার ছিলেন অন্য রকম মানুষ। তিনি জানতেন, শ্বেতাঙ্গ বাবার ঘরে বাদামি গায়ের রঙের ছেলে-এই প্রশ্নটা একদিন জেফরির মনে উদয় হবে। তারচেয়েও বড় কথা, চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে সে নিজের গল্পটা শোনার আগেই সব বলে দেয়া ভালো।

    একদিন জেফরিকে ডেকে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গল্পটা বলেছিলেন ফাদার। শুরুটা করেছিলেন মানুষের উৎপত্তি, ধর্মের আর্বিভাব, দর্শন আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব, ইতিহাস এসব দিয়ে। তারপর এই দৃশ্যটা।

    জেফরি বেগ অবাক হয়ে ভাবলো, তার নিজের গল্পের সাথে অদ্ভুতভাবেই মিলে যাচ্ছে! একই সময়, একই রকম পরিস্থিতি। তারপর তাদের দু’জনের নিয়তি যেনো আলাদা হয়ে গেছে দু’জন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাতে পড়ে।

    কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হলো, এই খুনির সাথে তার কি কোনো সম্পর্ক আছে?

    জেফরি বেগ জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা বাদ দেবার চেষ্টা করলো। এটা সিনেমা নয়, জীবন। ফাদার হোবার্ট তাকে বলেছিলেন, সে একাই ছিলো-অসহায় এক মায়ের ছেলে! সামনে বসে থাকা এই খুনির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অসম্ভব।

    হয়তো তাদের দুজনের শুরুটা একই সময়ে, একই প্রেক্ষাপটে। এর বেশি কিছু না।

    নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছে বাবলু। তার মধ্যে কোনো ভাবালুতা নেই। যেনো নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছে।

    “তাহলে ঐ পেয়ারির মা’র কাছেই তুমি মানুষ হয়েছে?” অবশেষে অনেকটা আপন মনে বলে উঠলো জেফরি বেগ।

    শুধু আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।

    “তোমার নিজের মা কে? কোত্থেকে তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে…কিছুই জানো না?”

    বাবলু মাথা দোলালো। সে কিছু জানে না। “যা বললাম তা পেয়ারির মায়ের কাছ থেকে শোনা। আমার বাবা আমাকে কখনও এসব কথা বলেন নি।” চায়ে চুমুক দিতে লাগলো আবার।

    জেফরি বেগ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো পেশাদার খুনির দিকে। নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে সে। শব্দ করে চা খাওয়া যে অসভ্যতা এটা সে জানে। জেফরি আবারো অবাক হলো। তার সামনে যে বসে আছে তাকে দেখে, তার কথা শুনে কেউই বিশ্বাস করবে না, এই মানুষটা বস্তিতে বড় হয়েছে। অনেক শিক্ষিতের চেয়েও তার আচার-ব্যবহারের মধ্যে মার্জিত একটা ভাব রয়েছে। তার অদ্ভুত পেশার সাথে এটা কোনোভাবেই যায় না।

    “পড়াশোনা করো নি?” অবশেষে বললো সে।

    “আমার বাবা আমাকে বেশ ভালো একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। এ নিয়ে বস্তির লোকজন হাসাহাসি করতো,” আস্তে করে বললো বাবলু। “বাবা হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। পেশাদার খুনি হলেও আমাকে কখনও ধমক পর্যন্ত দেন নি। যা চাইতাম তা-ই দিতেন। বস্তির অন্যসব ছেলেদের চাইতে আমার অবস্থা ছিলো একদম আলাদা। ভালো জামাকাপড়, নামিদামি স্কুল, খাওয়াদাওয়া, সব…শুধু একটা প্রশ্ন করলেই তিনি রেগে যেতেন।”

    জেফরির মনে হলো বাবলু হঠাৎ করেই যেনো নিজের সব কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হয়তো তার মন পাল্টেছে এখন। “কি, সেটা?” জানতে চাইলো সে।

    “আমার মা কে-এই প্রশ্নের কোনো জবাব তার কাছ থেকে কখনও পাই নি।”

    “আর পেয়ারির মা?”

    “বাবার ভয়ে আমাকে লালন-পালন করার কাজটা নিলেও উনি আমাকে মায়ের মতোই আদর করতেন। পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তার কাছেই ছিলাম। বাবা মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতেন।”

    “এরপর?”

    “আমাদের ঘরের পাশেই পেয়ারিরা চলে আসে। বাবাই ব্যবস্থা করেছিলেন। সারাদিন আমি পেয়ারি আপা আর তার ছোটো বোন আঙ্গুরি একসাথে খেলতাম। আঙ্গুরি ছিলো আমার সমবয়সী…”

    বাবলু একটু থামলে জেফরি তাকে কথা চালিয়ে যাবার ইশারা করলো।

    “…রাতে কখনও কখনও বাবা বাসায় ফিরে না এলে আমি পেয়ারিদের ঘরে গিয়েই ঘুমাতাম। আমাকে খুব আদর করতে পেয়ারি আপা। একেবারে বড় বোনের মতো আগলে রাখতো সব সময়।”

    “তোমাকে ওরা কি নামে ডাকতো?”

    জেফরি বেগের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। “বাবলু।”

    “কে রেখেছিলো?”

    “বাবা।” বলেই মুচকি হেসে ফেললো। “তার নিজের নামের সাথে মিলিয়ে।”

    জেফরি বেগ একটু চুপ থেকে বললো, “তো মি: বাবলু, সবকিছুই তো ঠিকমতো চলছিলো…সমস্যাটা হলো কখন থেকে?”

    “সমস্যা মানে?” বুঝতে না পেরে বললো সে।

    “মানে…ধরে নিচ্ছি তুমি যখন থেকে জানতে পারলে তোমার বাবা একজন পেশাদার খুনি তখন থেকে তোমার মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন আসে, তাই না? সেটা কখন ঘটলো?”

    বাবলু মাথা দোলালো। “আমার বাবা যে একজন পেশাদার খুনি সেটা আমি স্কুলে পড়ার সময়ই জেনে যাই।”

    “কিভাবে জানতে পারলে?”

    জেফরির এ প্রশ্নে চেয়ে রইলো বাবলু।

    অধ্যায় ৩৬

    স্কুল থেকে ফিরে পেয়ারিদের ঘরে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে আর খেলাধুলা করে নি। শরীরটা ভালো লাগছে না। স্কুলের পড়ার অনেক চাপ। একগাদা হোমওয়ার্ক করতে হবে। এগোরো-বারো বছরের বাবল নিজের ঘরে এসে কম্বল মুড়িয়ে ঘুম দিয়েছিলো একটু আগে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে গেলো।

    ঘুমানোর আগে ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলো সে। অবশ্য এতে কোনো সমস্যা নেই। তাদের ঘরে চুরি করবে এমন সাহস এই বস্তিতে খুব কম মানুষেরই আছে। তারচেয়েও বড় কথা চুরি করার মতো তেমন কিছু নেইও।

    বাবলু জোর করে চোখ খুলে কম্বলের নীচ থেকে দেখলো তার বাবা ঘরে ঢুকছে। কেন জানি ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করলো না তার। সে জানে বাবা তাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলে জাগিয়ে তুলবে না।’

    তাই হলো, খুইন্যা বাবুল ছেলের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো না। কোনো রকম শব্দ করার চেষ্টাও করলো না। চুপচাপ ঘরের এককোণে রাখা ট্রাঙ্কের কাছে চলে গেলো সে। ট্রাঙ্কটা রাখা আছে একটুকরো প্লাস্টিক শিটের উপর। কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে ট্রাঙ্কটা সাবধানে সরিয়ে পাস্টিক শিটটা তুলে একটা গর্তের মধ্যে রেখে দিলো। শব্দ না করেই ট্রাঙ্কটা আবার আগের জায়গায় রেখে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলো সে।

    ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকালো আবার। মুচকি হেসে কম্বলটা ঠিক করে দিয়ে কপালে একটা চুমু খেলো। আলনা থেকে একটা মাফলার নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো বাবুল।

    কিছুক্ষণ পর কম্বলের নীচ থেকে চোখ খুলে তাকালো বাবলু। ঘুমের ভান করে সবই দেখেছে সে। আস্তে করে বিছানা থেকে উঠে দরজাটা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকালো। শীতকালের সন্ধ্যা, খুব দ্রুতই ঘনিয়ে আসে। তার বাবাকে দেখতে পেলো না আশেপাশে।

    দরজাটা বন্ধ করে ফিরে গেলো সেই ট্রাঙ্কের কাছে। ওটা সরিয়ে প্লাস্টিকের শিট তুলে দেখতে পেলো মাটির মেঝেতে একটা গর্ত। সেখানে রাখা আছে জলপাই রঙের একটি পিস্তল। জিনিসটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সে।

    ছোটোবেলায় যেসব খেলনার পিস্তল আর রিভলবার নিয়ে খেলতে এটা দেখতে ঠিক সেরকম হলেও সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ভারি আর কেমন

    জানি আসল আসল বলে মনে হলো তার কাছে।

    *

    “এর আগেই বস্তির লোকজনের কাছে শুনেছি, আমার বাবা একেবারে ভিন্ন একটি পেশায় জড়িত,” বলতে লাগলো বাবলু।

    তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে জেফরি বেগ।

    “তবে আপনাকে বলে রাখি, তার জন্যে আমি এই লাইনে আসি নি।”

    জেফরি বেগ ভুরু কুচকে তাকালো। “তাহলে?”

    আস্তে করে চায়ে চুমুক দিলো সে। “আমি তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি। আমাদের বস্তিতে এক অদ্ভুত লোক এসে আস্তানা গেড়েছিলো।”

    “অদ্ভুত মানে?”

    “লোকটার সারা শরীরে কোনো লোম বা পশম ছিলো না। এমনকি ভুরুও না। টাইফয়েডের কারণে নাকি এরকম হয়েছিলো।”

    জেফরি বেগ কিছু বললো না। বাবলুর পরবর্তী কথা শোনার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে সে।

    “বস্তির লোকজন তাকে লোম্বাছুট বলে ডাকতো। কারো সাথে তেমন একটা মিশতো না। কথাও বলতো না। অনেকে বলতে লোকটা নাকি কবি। আবার কেউ বলতো লোকটার মাথায় সমস্যা আছে।” একটু থেমে আবার বললো, “একদিন আমাদের ঘরের সামনে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। আসলে ওটা পত্রিকা ছিলো না, বিভিন্ন ধরণের বাইসাইকেলের একটি ক্যাটালগ। আমাদের বস্তিতে পুরনো পত্রিকার ব্যবসা করতো এক লোক, তার কাছ থেকে ওটা নিয়েছিলাম। লোম্বাছুট তখন আমার কাছে এসে কথা বলতে শুরু করলো…”

    কথা বলতে বলতেই চায়ের কাপটা আস্তে করে রেখে দিলো ফাইলটার পাশে। জেফরি সেটা খেয়ালই করলো না। তার দৃষ্টি আটকে আছে বাবলুর উপর। জামান ভুরু কুচকে চেয়ে আছে। এই খুনির কাছ থেকে এসব গল্প শুনে কী লাভ সে বুঝতে পারছে না।

    “…আমার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলো সে। আমার হাতে ঐ ক্যাটালগটা দেখে বুঝে গেলো সাইকেল আমার খুব প্রিয়। লোকটা তখন। হেসে বললো তার ঘরে চমৎকার একটি সাইকেল আছে। ইচ্ছে করলে আমি সেটা চালাতে পারি…”

    কথাটা বলেই একটু উদাস হয়ে গেলো বাবলু।

    অধ্যায় ৩৭

    সাইকেল চালানোর লোভে বাবলু চলে এলো লোম্বাছুটের ঘরে। তাদের বস্তির শেষ মাথায়, যেখানে খেলার মাঠ আর ভোবাটা আছে ঠিক তার পাশেই লোম্বাছুটের ঘর। অন্যসব ঘরের মতোই বেড়া আর টিনের ছাদ। রঙচটা আমকাঠের দরজায় তালা মারা।

    লোম্বাছুট পকেট থেকে চাবি বের করে বললো, “সব সময় তালা মেরে রাখি। বস্তির লোকজনের স্বভাব ভালো না। দামি সাইকেলটা যদি চুরি করে নিয়ে যায়…”।

    দরজা খুলে গেলে বাবলুকে ভেতরে ঢুকতে বললো সে। ঘরে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। ভয় পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো বাবলু। দেখতে পেলো লোম্বাছুট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

    “দরজা বন্ধ করলেন কেন?” জিজ্ঞেস করলো সে।

    “ভয় পাচ্ছো তুমি?” লোম্বাছুট হেসে বললো তাকে।

    বাবলু ঢোক গিললো। “না, ভয় পাবো কেন?”

    কবি বাবলুর থুতনিটা ধরে দাঁত বের করে হাসলো। “লক্ষ্মীছেলে!”

    বাবলুর সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো। আসলে সে ভয় পাচ্ছে। “ইয়ে মানে…” টের পেলো তার গলা শুকিয়ে আসছে।

    “আমি আমার ঘরের দরজা সব সময় বন্ধই রাখি। বস্তির ছেলেগুলো যদি দেখে তোমাকে সাইকেলটা দেখাচ্ছি তাহলে তো ওরাও সাইকেল চালানোর আব্দার করবে।”

    “দরজাটা খুলে রাখুন,” মিনতির সুরে বললো সে।

    লোম্বাছুট কবি নিঃশব্দে হেসেই যাচ্ছে।

    এক পা পিছিয়ে গিয়ে ঘরের চারপাশটা দেখলো বাবলু। একটা ট্রাঙ্ক, লাগেজব্যাগ, কিছু বইপত্র আর মেঝেতে বিছানো শীতল পাটি। কোনো সাইকেল নেই!

    “সাইকেল কোথায়?”

    “আছে আছে…এতো অস্থির হচ্ছো কেন?” কবি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো।

    বাবলু আবারো ঘরের চারপাশে তাকালো, সাইকেলের কোনো চিহ্ন নেই সেখানে। তার ভেতরে অজানা এক আশংকা জেঁকে বসলো মুহূর্তে। লোকটার শব্দহীন হাসি আর ভাবভঙ্গি তার কাছে ভালো ঠেকলো না।

    “দরজা খুলুন…আমি চলে যাবো,” সাহস সঞ্চয় করে বললো সে।

    কবি যেনো আশাহত হলো। “আহ্…তুমি এমন করছো কেন?” কথাটা বলেই বাবলুর হাতটা খপ করে ধরে ফেললো।

    এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে ছুটে গেলো সে দরজার কাছে এসেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। তাদেরটার মতো এখানে কোনো হুরকো নেই। একেবারে উপরে একটা শেকল দিয়ে আঙটার সাথে আটকানো। ছোট্ট বাবলুর পক্ষে সেটার নাগাল পাওয়া সম্ভব হলো না। শেকলটা ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করলো, সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো পেছন থেকে তার মুখটা শক্ত করে ধরে ফেলেছে কবি। চিৎকার করার চেষ্টা করলো সে কিন্তু চাপা গোঙানি ছাড়া আর কিছু বের হলো না।

    ভয়ে হৃদস্পন্দন থেমে যাবার উপক্রম হলো। লোম্বাছুট তাকে জাপটে ধরে নিয়ে এলো দরজার কাছ থেকে। পাটির উপর উপুড় করে ফেলে চেপে বসলো তার উপর।

    হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার দেবার চেষ্টা করে গেলো বাবলু কিন্তু ছোট্ট শরীরটা নিয়ে বেশি কিছু করতে পারলো না। লোকটা তার শরীরের সমস্ত ওজন নিয়ে চেপে ধরেছে। একহাতে মুখ চাপা দিয়ে অন্য হাতে বাবলুর ডান হাতটা ধরে রেখেছে শক্ত করে। বাবলু তার বাম হাত দিয়ে লোকটার হাত ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছোটার জন্য, পারছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার।

    তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো লোম্বাছুট, “চিৎকার কোরো না সোনালি! আমি তোমাকে অনেক আদর করবো!”

    সোনালি! এই লোকটা এসব কী বলছে! কিন্তু এসব প্রশ্নের চেয়েও জরুরি হলো শয়তানটার খপ্পর থেকে নিস্তার পেতে হবে তাকে।

    কানের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় করে কী যেনো বললো আবার, কিন্তু বাবলু বুঝতে পারলো না। তার মাথা ভো ভো করছে। কথাগুলো একদম অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে। কেমন জানি খাপছাড়া।

    কবিতা!

    বাবলু জানে না। লোকটার ভেজা জিভ স্পর্শ করলো তার ডান কান। মাথাটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো সে কিন্তু যে শক্ত হাতটা তার মুখ চেপে রেখেছে সেটা নিবৃত্ত করলো তাকে।

    একটু পর প্রচণ্ড আতঙ্কের সাথে টের পেলো লোকটা তার প্যান্টের জিপার খুলছে!

    শরীরের সবটুকু শক্তি নিয়ে ছোটার জন্য হাসফাস করলো সে। কোনো লাভ হলো না। লোকটার তেলতেলে হাত দুটো যেনো আঙটার মতো আটকে রেখেছে তাকে। বাবলুর গা গুলিয়ে উঠলো।

    সে বুঝতে পারছে এই লোক তার সাথে খারাপ কিছু করতে যাচ্ছে। ভয় আর আতঙ্ক বদলে প্রচণ্ড রাগের জন্ম হলো। ইচ্ছে করলে লোকটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। ঠিক এমন সময় দেখতে পেলো তার ঠিক সামনে একটি খাতা আর বলপেন পড়ে আছে। একেবারে হাতের নাগালে।

    এবার টের পেলোলোকটা তার হাফপ্যান্ট টেনে নামিয়ে দিচ্ছে!

    কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না বাবলু। হঠাৎ টের পেলো তার ডান হাতটা মুক্ত। লোম্বাছুট এখন ব্যস্ত আছে তার হাফপ্যান্টটা টেনে নীচে নামাতে।

    এক ঝটকায় বলপেনটা তুলে নিলো হাতে। তারপর আন্দাজ করে পেছন দিকে ঘাড়ের উপর দিয়ে আঘাত হানলো কলমটা।

    “আহ!”

    লোম্বাছুটের গগনবিদারি চিৎকারটা শুনতেই আবারো একই জায়গা লক্ষ্য করে দ্বিতীয়বার আঘাত হানলো সে। এবার তার কলমটা বেহাত হয়ে গেলো। বাবলু কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুঝতে পারলো লোম্বাছুট তার উপর থেকে সরে গেছে।

    দ্রুত ঘুরে চিৎ হয়ে গেলো সে। দেখতে পেলো লোম্বাছুট এক হাতে তার কলমটা ধরে রেখেছে!

    বলপেনটা গেথে আছে খচ্চরটার ডান চোখে!

    গলগল করে রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। লোম্বাছুট কলমটা টেনে বের করতেই বাবলু কষে একটা লাথি মারলো তার মুখ বরাবর। লোম্বাছুট চিৎকার দিয়ে উঠলো আবার। তার হাত থেকে রক্তমাখা কলমটা পড়ে গেলো। সে তার ডান চোখটা একহাতে চেপে রেখেছে।

    বাবলু আর দেরি করলো না। কলমটা তুলে নিয়ে ছুরির মতো ব্যবহার করলো। পর পর আরো কয়েকটা আঘাত হানলো লোম্বাছুটের মুখ আর ঘাড় লক্ষ্য করে।

    চিৎ হয়ে পড়ে গেলো তেলতেলে শরীরের কবি।

    বাবলুর মধ্যে রাগের বিস্ফোরণ ঘটলো এবার। ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটার উপর। এলোপাতারি আঘাত হানতে লাগলো কলম দিয়ে। উদভ্রান্ত হয়ে গেলো সে। কানে কিছুই শুনতে পেলো না শুধু ভো ভো শব্দ ছাড়া। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো। সমানে আঘাতের পর আঘাত করে গেলো লোকটাকে।

    হঠাৎ টের পেলো পেছন থেকে কেউ তাকে শক্ত করে জাপটে ধরেছে।

    “আর না বাবা! আর না!”

    *

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো জেফরি বেগ। বাবলু নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। তার মধ্যে কোনো আবেগ নেই যেনো। জামানও চুপচাপ বসে আছে এখন। হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে নেমে এসেছে অসহ্য নীরবতা।

    “আমার বাবা আমাকে ঘরে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছিলো কবির ঘরে,” অবশেষে বললো বাবলু। “হয়তো বস্তির কেউ ঐ লোকটার সাথে আমাকে দেখেছিলো…”

    “তোমার বাবা এসে দেখলো তুমি ঐ লোকটাকে খুন করে ফেলেছো?”

    “হ্যাঁ। ততোক্ষণে পশুটা শেষ!”

    মাথা দোলালো জেফরি।

    “একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম…কোন্ ফাঁকে বাবা দরজা ভেঙে ভেতরে চলে এসেছিলো আমি টেরও পাই নি।”

    “তারপর সবাই জেনে গেলো তুমি ঐ কবিকে-”

    “না। কেউ কিছু জানতে পারে নি!”

    জেফরি বেগ অবাক হলো। “স্ট্রেঞ্জ…কেউ কিছু জানতে পারলো না?”

    মুচকি হাসলো বাবলু। “ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমার বাবা একজন পেশাদার খুনি ছিলো।”

    “তোমার বাবা কি করলেন তখন?” জানতে চাইলো জেফরি।

    বাবলু গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “ঐ লোকটার ঘরের দরজা বন্ধ করে আমাকে নিয়ে চুপচাপ চলে এলেন আমাদের ঘরে। তারপর আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বললেন উনি না আসা পর্যন্ত আমি যেনো ঘরের বাইরে না যাই। ঠিক কততক্ষণ পর বলতে পারবো না, আমি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, হঠাৎ শুনতে পেলাম বস্তির লোকজন হৈহল্লা করছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে কেউ কেউ। বিছানায় উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি লোকজন ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক। একটু পরই বাবা ফিরে এলেন। তার হাতে বিরানির প্যাকেট। একদম নির্বিকার। যেনো কিছুই হয় নি।”

    উদাস হয়ে গেলো বাবলু। তার কানে এখনও সেই কথাটা বাজে : “তোর প্রিয় খাবার নিয়া আসছি, বাবা…আয় দুজনে মিলা খাই।”

    “তুমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করো নি?” বললো জেফরি।

    “না।”

    “তোমার বাবাও কিছু বলেন নি?”

    মাথা দোলালো সে। “আমরা দু’জন চুপচাপ বিরানি খেতে শুরু করলাম। তখনও লোকজন চিৎকার করছে আগুন আগুন বলে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে তারা। আমি ঠিকই বুঝে গেছিলাম আমার বাবা ঐ বদশামটার ঘরে আগুন দিয়েছে। খুনের প্রমাণ আর আলামত নষ্ট করে দিয়েছে খুব সহজেই।”

    “তোমার বাবা কিছু বললো না?” জেফরি বেগ বিস্মিত হলো। “অদ্ভুত!” আপন মনে বলেই জানতে চাইলো, “তাহলে ঐ কবিকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই তোমার খুনখারাবির হাতেখড়ি হলো?”

    “হাতেখড়ি?!” কথাটা বলেই মুচকি হাসলো বাবলু। “ভালোই বলেছেন।”

    “এরপর থেকে শুরু হলো তোমার অন্য রকম একটি জীবন, তাই না?”

    আবারো মাথা দোলালো সে। “না। মোটেই না। ঐ খুনের ঘটনার পরও আমার জীবনটা আগের মতোই ছিলো। হয়তো অবচেতন মনে কিছু প্রভাব পড়েছিলো কিন্তু তখনও আট-দশটা ছেলের মতো স্বাভাবিক ছিলাম। প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। বন্ধুবান্ধবের সাথে খেলতাম। মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্নে ঐ খুনের ঘটনাটি দেখতাম, তখন একটু খারাপ লাগতো, এই যা…”

    “তুমি বলতে চাচ্ছো ঐ খুনের ঘটনার পরও তোমার জীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিলো?”

    “হ্যা…প্রায় স্বাভাবিক ছিলো।”

    “প্রায় স্বাভাবিক?”

    “হ্যাঁ,” কথাটা বলেই চুপ মেরে গেলো বাবলু।

    জেফরি বেগ কোনো প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করলো।

    “এরপর আমি আরেকটা খুন করি…” আস্তে করে বললো পেশাদার খুনি।

    কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে থাকলো জেফরি। “সেটাও কি ঘটনাচক্রে পড়ে?”

    মাথা দোলালো। “না।”

    “তাহলে?”

    “ওটা আমি পরিকল্পনা করে করেছিলাম।”

    জেফরি বেগ ভুরু কুচকে তাকালো। “ঐটুকু বয়সেই?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।

    “ঘটনাটা কি ছিলো?”

    “আমার এক বন্ধু ছিলো…ইরফান। সে এক হুজুরের কাছে গিয়ে আরবি পড়তো। একদিন আমাকে জানালো ঐ হুজুর তার সাথে ভয়ানক খারাপ কাজ করেছে। লজ্জায় সে কাউকে বলতে পারছে না…” কথাটা বলেই বাবলু একটু চুপ মেরে গেলো।

    আক্ষেপে মাথা দোলালো জেফরি বেগ। কেন যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত লোকজন এসব করে সে জানে না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, খৃস্টান চার্চের পাদ্রি, মিশনারির ব্রাদার, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক আর মন্দিরের পুরোহিতদের মধ্যে এই একটা বিষয়ে দারুণ মিল : তাদের অনেকেই শিশু যৌননিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাথলিক চার্চের এসব কেলেংকারীর খবর তো সারা দুনিয়াতেই আলোচিত হচ্ছে।

    “তারপর তুমি ঐ হুজুরকে মেরে ফেললে?” জিজ্ঞেস করলো জেফরি।

    “হ্যাঁ।” স্থিরচোখে তাকালো সে। “ইরফানকে আমি কথা দিয়েছিলাম, ঐ হুজুর আর তার সাথে খারাপ কাজ করবে না।”

    “কিভাবে মারলে তাকে?”

    “বাবার পিস্তলটা চুরি করে নিয়ে গেছিলাম কিন্তু ওটা ব্যবহার করতে হয় নি।”

    “পিস্তল ছাড়াই মেরে ফেললে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “লোকটা ছিলো বস্তির কাছেই এক মসজিদের মুয়াজ্জিন। মসজিদের তিনতলার উপর একটা চিলেকোঠায় থাকত। দুয়েক দিন খোঁজ নিয়ে বুঝলাম দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করার পর সে একটু ঘুমায়।”

    “ঐ বয়সে তুমি এভাবে রেকি করে সব জেনে নিলে?” জেফরির বিশ্বাস করতেও কষ্ট হলো।

    এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলতে লাগলো বাবলু, “আমি সেই সুযোগটা নিলাম। লোকটা যখন ঘুমিয়ে ছিলো তখন তার ঘরে ঢুকে পড়লাম। দরজা সব সময় ভোলাই রাখতো।” একটু থেমে আপন মনে হাসলো সে। “তার ঘরে ইনহেলার দেখে বুঝে গেলাম সে হাপানির রোগি। ব্যস, পরিকল্পনা বদলে ফেললাম। গুলি করলে তো শব্দ হবে, পালানোটা কঠিন হয়ে যেতে পারে, তাই বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেললাম।”

    মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “ঐটুকু বয়সের একটা ছেলে তুমি…বালিশ চাপা দিয়ে মুয়াজ্জিনকে মেরে ফেললে!”

    “হ্যাঁ। আমার বয়স কম হলেও হাতে-পায়ে বেশ লম্বা ছিলাম তখন। গায়ে শক্তিও নিশ্চয় ভালো ছিলো। আর হুজুর ছিলো রোগাপটকা, বেটে। ছোটার জন্য হাত-পা ছুড়লেও সুবিধা করতে পারে নি। আমি অবশ্য কৌশল করে তার মাথার পেছনে ছিলাম।”

    “এই খুনের ঘটনাটাও কেউ জানতে পারলো না?”

    জেফরি বেগের কথাটা শুনে মুচকি হাসলো বাবলু। “না।”

    ঠোঁট উল্টালো ইনভেস্টিগেটর।

    “সবাই মনে করেছে ঘুমের মধ্যে হুজুরের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।” একটু থেমে আবার বললো সে, “অবশ্য কথাটা তো মিথ্যে নয়…শেষ পর্যন্ত সবার মৃত্যু হার্ট ফেইলিউরেই হয়, তাই না?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। হুজুরকে বালিশ চাপা দিয়ে মারার কথা শুনে তার মনে পড়ে গেলো লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের কথা। ঠিক এভাবেই বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেছিলো এই খুনি। তবে লেখকের নাজুক বুকের উপর প্রচণ্ড জোরে আঘাতও করেছিলো সে। ইচ্ছে করেই ঐ কথাটা আর তুললো না, পাছে বাবলু তার গল্প বলার মেজাজ হারিয়ে ফেলে।

    “তাহলে পর পর দুটো খুনের ঘটনা কেউ বুঝতেই পারলো না?”

    “তিনটি,” নির্বিকারভাবে বললো বাবলু।

    অবাক হয়ে তাকালো জেফরি বেগ।

    “এটা পরের বছরের ঘটনা, আমি তখন ক্লাশে টেনে উঠেছি মাত্র,” কথাটা বলেই চুপ মেরে গেলো সে।

    “কি হলো?”

    “সিগারেট খাবো।”

    জেফরি বেগ মুচকি হেসে পাশে বসা জামানকে ইশারা করলো।

    “আমি নন স্মোকার…কিন্তু ও মাঝেমধ্যে খায়।”

    জামান একটু লজ্জা পেলো। এতোদিন সে জানতো তার সিগারেট খাওয়ার কথাটা বস্ জানে না। ইতস্তত করলেও পকেট থেকে একটা সিগারেট আর লাইটার বের করে বাবলুর দিকে ঠেলে দিলো সে।

    এক হাতে সিগারেটটা মুখে নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরালো বাবলু। “পেয়ারি আপার তখন বিয়ের বয়স হয়েছে…আপা দেখতে খুব সুন্দর ছিলো।” কথা বলতে বলতেই লাইটারটা জামানের সামনে রেখে দিলো সে। “ঐ সময় বস্তির এক উঠতি মাস্তান আপার পেছনে লাগলো…”

    অধ্যায় ৩৮

    স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সোজা পেয়ারিদের ঘরে চলে এলো বাবলু। তাদের থেকে কয়েকটা ঘর পরই পেয়ারিদের ঘর। খুইন্যা বাবুল নিজের পেশার কারণেই সব সময় বাড়িতে থাকতো না। এমনও হয় পর পর তিন-চারদিন তার কোনো খবর থাকে না। সেজন্যে বাবলুর দুধমা সুরতুন্নেসাকে সপরিবারে নিজের ঘরের কাছে এনে রাখার ব্যবস্থা করে সে। এই বস্তিতুল্য এলাকায় তার অনেক প্রভাব। এখানকার মা-বাপ হিসেবে যারা পরিচিত, যাদের কাছে মাসে মাসে টাকা তুলে দিতে হয় ভাড়াটেদের, তাদের সাথে বাবলুর বাপের দারুণ সখ্যতা।

    বলতে গেলে ছোট্ট বাবলু পেয়ারিদের সাথেই বেড়ে উঠছে। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করে পেয়ারিদের সাথে। এমনকি মাঝেমধ্যে বাবুল যখন উধাও হয়ে যায় কয়েক দিনের জন্য তখন নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে পেয়ারি আর আঙ্গুরিদের সাথেই থাকে সে।

    তার বাবা খুইন্যা বাবুল এখন পলাতক। কয়েকবার পুলিশ এসে তাকে খুঁজে গেছে। বস্তির সবাই কানাঘুষা করছে, বাবুল এবার ফেঁসে গেছে। কী একটা খুনের ঘটনায় নাকি তার নাম এসে গেছে। চাক্ষুস সাক্ষীও আছে। এবার তার রেহাই নেই।

    বাবুলের অনুপস্থিতিতে ছোট্ট বাবলুর একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো পেয়ারিদের পরিবার। নিজের তো বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। এটাই তার পরিবার। পেয়ারির মাকেই সে মা বলে জানে, যদিও তাকে কখনও মা বলে ডাকে না। ছোটোবেলা থেকেই তাকে খালাম্মা বলে ডাকে সে।

    খুইন্যা বাবুল পলাতক হবার পর থেকে বাবলুর মন খুব খারাপ। সে টের পেয়েছে বস্তির কিছু লোকজন তার দিকে কেমন কেমন করে যেনো তাকায়। তাদের সেই তাকানোর মধ্যে শত্রু শত্রু ভাব রয়েছে। তাকে দেখলে লোকজন এখন ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, বাবলু সেসব আমলে না নিয়ে মাথা নীচু করে চলে আসে ঘরে।

    তাদের আর কী দোষ। তার বাপ যে পেশাদার খুনি এটা তো সে জানেই। এতোদিন ভয়ে বাবুলের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতো না। এখন তারা হয়তো বুঝে গেছে, তার বাবার আর রক্ষা নেই।

    পেয়ারির মাকে বাবলু জিজ্ঞেস করেছিলো তার বাপের ব্যাপারে কিন্তু এ ব্যাপারে সে কিছু বলতে পারে নি। শুধু বলেছিলো চিন্তা না করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তার বাপ হয়তো একটা ঝামেলায় পড়েছে। কয়েক দিন পর ঝামেলা মিটে গেলে বাবুল ঠিকই ফিরে আসবে।

    পেয়ারিদের ঘরে ঢুকতেই বাবলু দেখতে পেলো সবার মুখ থমথমে। পেয়ারি আর তার মা, ছোটো বোন আঙ্গুরি আর পেয়ারির অসুস্থ বাবা, সবাই চুপচাপ বসে আছে সামনের ঘরটায়।

    বাবলুকে দেখে পেয়ারির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন হাসি দিলো। “বাজান, হাত-মুখ ধুইয়া আসো…আমি তোমার খানা দিতাছি।” কথাটা বলেই ভেতরের ঘরে চলে গেলো সে।

    বাবলু কোনো কথা না বলে চুপচাপ হাত-মুখ ধুতে চলে গেলো ঘরের পেছনে খোলা বাথরুমে। ওখানে একটা টিউবওয়েল আছে। সে যখনই টিউবওয়েলটা ব্যবহার করতে আসে তখনই তার সমবয়সী আঙ্গুরি এসে চাপ দিয়ে দিয়ে পানি বের করে দেয়। যখন থেকে তারা এখানে এসেছে তখন থেকে এটাই হয়ে আসছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

    আঙ্গুরি চুপচাপ তার পিছু পিছু টিউবওয়েলের সামনে এসে হাতল চাপতে লাগলো। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কী হয়েছে জানতে চেয়ে ইশারা করলো বাবলু।

    “পেয়ারি আপারে নসু গুণ্ডা বিয়া করবার চায়,” চাপাকণ্ঠে বললো সে। “আম্মা-আব্বারে খুব চাপ দিতাছে। আমি যে এ কথা তুমারে কইছি কাউরে কিন্তু কইও না।”

    নসু গুণ্ডা! বাবলু একে চেনে। বস্তির এক উঠতি রংবাজ। হ্যাংলা পাতলা গড়ন। মাঝারি উচ্চতা। কিন্তু বস্তির সবাই তাকে ভয় করে। হেনো কোনো খারাপ কাজ নেই যে সে করে না। প্রতিদিনই বস্তির পেছনে ডোবার পাশে যে খেলার মাঠ আছে, রাত হলেই সেখানে নসু গুণ্ডা তার সঙ্গিসাথী নিয়ে জুয়া আর মদ-গাঁজার আসর বসায়। ইদানিং এই বস্তির মা-বাপ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় এমপির খাস লোক হয়ে উঠেছে সে। কাউকে পরোয়া করে না। তার ভাবভঙ্গি দিনকে দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

    “নসুর এতো বড় সাহস!” টিউবওয়েলের পানিতে মুখ ধুতে ধুতে বাবলু বললো। “আব্বায় খালি আসুক…ওর বিয়ের মজা বুঝিয়ে দেবে। খালাম্মাকে চিন্তা করতে না করে দিও।”।

    “বাবুল কাকা থাকলে তো আমরা কুনো চিন্তাই করতাম না,” টিউবওয়েলের হাতা চাপতে চাপতে বললো আঙ্গুরি। “মা কইতাছে, কাকা নাকি নিজেই বিপদে আছে।”

    বাবলু উপুড় হয়ে হাত-মুখ ধুচ্ছিলো, কথাটা শুনে থেমে গেলো। আসলেই তার বাপ বিপদে আছে।

    “তুমি স্কুল থিকা আহনের একটু আগে নসু আইছিলো…” আঙ্গুরি থেমে গেলো। “কইছে, দুই-তিনদিনের মইদ্যে আপারে বিয়া দিতে হইবো।”

    “কি?” বাবলুর বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এটা কি মগের মুলুক নাকি? দেশে কি আইন-আদালত নাই”

    “কী যে কও তুমি,” সমবয়সী আঙ্গুরি আবারো টিউবওয়েল চাপতে চাপতে বললো। “এই বস্তিতে আইন আছে নি? হেরা যা কইবো তা-ই আইন। হেগো লগে পারা যাইবো?” হাপিয়ে উঠলো আঙ্গুরি। টিউবওয়েল চাপায় বিরতি দিয়ে আবার বললো, “কইছে, হের লগে বিয়া না দিলে আপারে নাকি তুইলা নিয়া যাইবো।”

    নসু গুণ্ডার এতো বড় দুঃসাহস? বাবলুর খুব রাগ হলো। রাগে গা রি রি করে উঠলো তার। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করলো না। চুপচাপ হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছে করলো না। ভাত খাওয়ার সময় পেয়ারির থমথমে মুখটা দেখে খুব কষ্ট হলে তার। ভয়ে কেমন জড়োসরো হয়ে গেছে।

    বাবলুর খুব বলতে ইচ্ছে করলো : “তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি আছি। ঐ নসু গুণ্ডাকে আমি এমন শিক্ষা দেবো যে বিয়ে করা তো দূরের কথা, এরপর থেকে মেয়ে দেখলে আপা ডাকবে।”

    কিন্তু সে কিছুই বলতে পারলো না। তার মতো বাচ্চাছেলের কথায় পেয়ারিদের পুরো পরিবার যে আশ্বস্ত হতে পারবে না এটা ভালো করেই জানে।

    *

    “পেয়ারির মা-বাবা কি করলো তখন?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

    সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো বাবলু। জামানের দিকে তাকালো সে। নিজের জীবনের গল্প বলা শুরু করতেই এই ছেলেটা ঘরের আসবাবপত্রের মতো হয়ে উঠেছে।

    “সাধারণ নিরীহ মানুষ যা করে…” জেফরি বেগের দিকে ফিরে বললো সে।

    “ঐ রংবাজের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলো?”

    মাথা দুলিয়ে আবারো সিগারেটে টান দিলো বাবলু। তার এভাবে সিগারেট খাওয়াটা সহজে মেনে নিতে পারছে না জামান। চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে।

    “তাহলে?”

    একটু উদাস হয়ে গেলো সে। শূন্যদৃষ্টিতে বললো, “কাউকে না জানিয়ে দুদিন পর তারা বস্তি ছেড়ে চলে যায়।”

    “ওহ,” আক্ষেপে বলে উঠলো জেফরি বেগ। “তোমাকেও জানায় নি?”

    “না।” দু’চোখ বন্ধ করে ফেললো। “আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি তারা নেই।”

    “তোমাকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে গেলো?”

    মাথা দোলালো বাবলু। “বস্তিতে আমার বাবার একজন ঘনিষ্ঠ লোক ছিলো, আতাউল চাচা, পেয়ারির মা তাকে বলে গেছিলো আমার দেখভাল করার জন্য।” একটু চুপ থেকে আবার বললো সে, “আমি এসব কিছুই জানতাম না। পরে জেনেছি। মজার ব্যাপার কি জানেন…তারা চলে যাবার আগের দিন রাতে আমার জন্য পোলাও রান্না করেছিলো। আমি যা যা পছন্দ করি…পোলাও, পায়েস, সবকিছু রান্না করেছিলো।”

    “তুমি জানতে চাও নি কেন?” জেফরি বেগ প্রশ্ন করলো।

    “না। আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। ভালো রান্না-বান্না করেছে…আমরা সবাই খেয়েছি…ব্যস। তারা যে চলে যাবে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি নি।”

    “তারা কোথায় চলে গেছিলো?”

    “সম্ভবত অনেক দূরে। তখন ভেবেছিলাম ওরা হয়তো গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে।”

    “এরপর তাদের সাথে তোমার আর কখনও দেখা হয় নি?”

    “না।”

    পুরোপুরি সত্যি বললো না সে। এইতো কদিন আগে পেয়ারির এসিডদগ্ধ মেয়েকে হাসপাতালে দেখতে গেছিলো। সেটা অবশ্য দূর থেকে। তাদের সামনে যায় নি। কেন যায় নি সে জানে না। পেয়ারিকে তার মেয়ের বেডের পাশে বসে থাকতে দেখেছিলো। তার দুধমায়ের বড় মেয়ে। কতো স্মৃতি আর আবেগ জড়িয়ে আছে তার সাথে। সেইসব আবেগের মুখোমুখি হতে অদ্ভুত রকম সংকোচ হয়েছিলো তার।

    পেয়ারির কিশোরী মেয়েকে এক বদমাশ এসিড মেরে ঝলসে দিয়েছে। খবরটা পত্রিকায় পড়ে জানতে পারে সে। ঝলসানো মুখের চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরীর বীভৎস মুখের ছবির সাথে পেয়ারির আহাজারি করা ছবিটা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারে, যদিও দীর্ঘ আঠারো-উনিশ বছর আগে তাদেরকে হারিয়ে ফেলেছিলো কিন্তু পেয়ারি আপার সেই মায়াভরা মুখটা তার স্মৃতিতে তরতাজা। এখন মাঝবয়সী এক মহিলা। দু দুটো বাচ্চার মা। ছবির ক্যাপশনে পেয়ারি বেগম নামটা না থাকলেও চিনতে পারতো। খবরটা পড়ার পর থেকে রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করে। এক অনির্বচনীয় অস্থিরতায় আক্রান্ত হয় সে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় আর সবার মতো ঝলসানো মুখের মেয়ে আর তার মাকে কোনো সান্ত্বনা দেবে না। বরং যে নরপশু এই জঘন্য কাজটা করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।

    “ভেরি স্যাড,” বললো জেফরি বেগ।

    সম্বিত ফিরে পেলো বাবলু।

    “তুমি তখন একা হয়ে পড়লে?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “হ্যাঁ।”

    “খুব রেগে গেছিলে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “ভীষণ!” তার খোলা হাতটা মুষ্টি পাকিয়ে ফেললো। “পলাতক অবস্থা থেকেই বাবা সব জানতে পেরেছিলেন। তিনি আতাউল চাচার মাধ্যমে আরেকজন মহিলাকে ঠিক করে দিয়েছিলেন আমার খাওয়াদাওয়াসহ সব কাজ করে দেবার জন্য কিন্তু পেয়ারিদের ওভাবে চলে যাওয়াটা আমি সহজভাবে মেনে নিতে পারি নি।”

    “সেটাই স্বাভাবিক। ওরাই তো ছিলো তোমার পরিবার।”

    “আমি জীবনেও কোনো মানুষের উপর এতোটা ক্ষুব্ধ হই নি। ঐ নসু রংবাজকে বস্তিতে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে মাথায় খুন চেপে গেলো…”

    ভুরু কুচকে তাকালো জেফরি বেগ। “তুমি কি করলে?”

    একগাল ধোয়া ছেড়ে বাঁকা হাসি হাসলো বাবলু। “এটা পেয়ারিদের বস্তি ছেড়ে চলে যাবার এক সপ্তাহ পরের ঘটনা…”

    অধ্যায় ৩৯

    রাত নেমে এসেছে বস্তিতে। সবাই যার যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। বস্তির পেছনে যে বিশাল মাঠ আর ডোবা আছে সেখানকার ভুতুরে পরিবেশ একেবারে অন্যরকম। খারাপ ছেলেপেলেরা ওখানে মদ-জুয়ার আসর বসায় প্রতি রাতে। এসব উঠতি ছেলেদের কেউ কিছু বলে না। বলার সাহস হয় না কারোর। বস্তির মা-বাপদের ঘনিষ্ঠ এরা। এখানকার সবাই ওই জায়গাটা এড়িয়ে চলে। এ কারণে আশেপাশে যেসব বাড়িঘরে সেয়ানা মেয়ে আছে তারা সরে গিয়ে বস্তির ভেতরে ঘর নিয়েছে।

    আজও যথারীতি আসর বসেছিলো। রাত ২টার পর পরই সেই আসর ভেঙেছে। মদ খেয়ে টলতে টলতে নিজেদের ডেরায় ফিরে যাচ্ছে কিছু বখাটে যুবক। এদের মধ্যে কারো কারো মেজাজ খুব খারাপ। জুয়া খেলায় ধরা খেয়েছে। কিন্তু একজনের মেজাজ খুব ভালো। আজ ভালো দান মেরেছে। এটাই তো জুয়া। বেশিরভাগ লোক হারবে, জিতবে অল্পকয়জন।

    চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এক হ্যাংলামতোন ছেলে নেশাগ্রস্ত হয়ে টলতে টলতে বস্তির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আজ অনেক মাল টেনেছে সে। দানও মেরেছে বেশ। অবশ্য খেলার এক পর্যায়ে দেলু নামের একজনের সাথে তার ঝগড়াঝাটি হয়েছিলো। কষে একটা চড় মেরে দেলুর সমস্ত বাহাদুরি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। হারামজাদার এতো বড় সাহস, নসুর সাথে মুখে মুখে তর্ক করে!

    বস্তির একটা নিরিবিল গলিতে ঢুকে বেসুরে গান গাইবার চেষ্টা করলো।

    “সোনার চান্দের মতিমহলের সুন্দরি…বন্দী করে আমায় করছো বাহাদুরি…” ওয়াক করে ঢেকুর তুললো। বাংলামদের জঘন্য দুগন্ধ বের হয়ে এলো মুখ দিয়ে। মুচকি হেসে আবার গানটা ধরলো, “…জেনে রেখো বদলা নেবো,..তোমায় রাণী বানাবো…আল্লাহর কসম তোমায় আমি-”

    হঠাৎ গান থামিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। আধো-আলো-অন্ধকারে পিটপিট করে তাকালো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাবলু। তার চোখেমুখে কিছু একটা আছে। ভুরু কুচকে তাকালো নেশাগ্রস্ত রংবাজ।

    “ওই…তুই খুইন্যা বাবুলের পোলা না??” টেনে টেনে বললো নসু গুণ্ডা।

    বাবলু কিছু বললো না। দু’চোখ থেকে যেনো আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। তার একটা হাত পেছনে।

    “ওই…এমনে চায়া আছোস ক্যান?” ধমকের সুরে বললো সে। তার পর পরই নসুর ভাবভঙ্গি বদলে গেলো। বাবলুর চোখেমুখে যে ক্রোধ আছে সেটা যেনো আঁচ করতে পারলো সে।

    পেছনের হাতটা সামনে আনতেই দেখা গেলো সেই হাতে একটা পিস্তল।

    নসু যারপরনাই বিস্মিত। “তুই! তুই আমারে!…জাউরার বাচ্চা জাউরা!..”।

    পিস্তলটা উঠে এলো রংবাজের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গুলি। পর পর দুটো। নসুর বুকে। কয়েক পা পেছনে টলে গিয়ে ছিটকে পড়লো সে।

    আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো বাবলু। তারপর পিস্তলটা কোমরে গুঁজে আস্তে করে উল্টো দিকে হাটা ধরলো। একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো। তার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। ভয় নেই।

    *

    “তুমি বলতে চাচ্ছো এই খুনটার ব্যাপারেও কেউ কিছু বুঝতে পারলো না? মানে, তোমাকে কেউই সন্দেহ করলো না?”

    জেফরি বেগের প্রশ্ন শুনে নির্বিকার রইলো বাবলু। “বস্তির সবাই মনে করেছিলো খুনটা করেছে ঐ রংবাজের নিজের লোকজনই। চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি করতে গিয়ে হয়তো একটা ঘাপলা হয়েছে। পুলিশও তাই মনে করেছিলো। বস্তির এক নেশাখোর রংবাজ খুন হলে কে আর মাথা ঘামাতে যাবে। লোকজন মনে মনে খুশিই হয়েছিলো।” বাঁকা হাসি হাসলো সে। “আর আমার কথা বলছেন? লোকজন হয়তো আড়ালে আবডালে আমার জন্মপরিচয় নিয়ে আজেবাজে কথা বলতো কিন্তু আমি কাউকে খুন করবো এ কথা বিশ্বাস করার মতো লোক ঐ বস্তিতে ছিলো না।”

    “তাহলে এই খুনটা করার পর থেকেই তোমার জীবন পাল্টে যেতে শুরু করে?”

    “না।”

    জেফরি বেগ আবারো অবাক হলো। “না?”

    “এরপর পরই আরেকটা ঘটনা ঘটে।”

    “সেটা কি?”

    বাবলুর চোখে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য : এসএসসি পাশ করে সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। কলেজের প্রথমদিন ক্লাশ করে খুশিমনে বাড়ি ফিরে এসে দেখতে পেলো তাদের ঘরের সামনে প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে আছে। পাশে তাকাতেই চোখে পড়লো পুলিশের একটা গাড়ি। এক অজানা আশংকায় তার বুকটা কেঁপে উঠলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়।

    একটু পরই দেখতে পেলো তাদের ঘর থেকে কয়েকজন পুলিশ বের হয়ে আসছে। সঙ্গে তার বাবা। হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

    জড়ো হওয়া লোকজন ফিসফাস করে বলাবলি করছিলো ঘটনাটি নিয়ে। খুইন্যা বাবুল অনেকদিন পলাতক থেকে আজ নিজের ঘরে আসতেই কে বা কারা পুলিশে খবর দিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে তার ঘর ঘিরে ফেলে।

    সত্যি বলতে, পলাতক অবস্থায় থেকেও প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে খুইন্যা বাবুল তার ছেলের সাথে দেখা করতে আসতো। কথাটা জানতো শুধু বাবলু আর আতাউল চাচা।

    বাবলু দেখতে পেলো তার বাবাকে পুলিশ গাড়িতে তুলছে। মাথা নীচু করে পরাজিতের মতো গাড়িতে উঠে বসলো বাবুল। চারপাশের জটলার মধ্যে যে তার ছেলেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছে সেটা তার জানা ছিলো না।

    বাস্তবে ফিরে এসে বললো বাবলু, “বাবা জেলে যাবার পর একদম একা হয়ে পড়লাম। সবাই বলাবলি করতে শুরু করলো আমার বাবা আর জেল থেকে ছাড়া পাবে না, ফাঁসি হয়ে যাবে। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খুনের অভিযোগ ছিলো। শক্ত প্রমাণও ছিলো।” এক নাগারে বলে থামলো সে।

    “তার কি সাজা হয়েছিলো?” জিজ্ঞেস করলো জেফরি বেগ। সে জানে কয়েক মাস আগে ব্ল্যাক রঞ্জুর হাতে বাবলুর বাবা নিহত হয়েছে নিজ বাড়িতে।

    “হ্যাঁ। যাবজ্জীবন। প্রথমে ভেবেছিলাম যাবজ্জীবন মানে সারা জীবন জেলে থাকা, পরে জানতে পারি বারো বছর পর জেল থেকে বের হয়ে আসবেন বাবা।”

    “তোমার বাবার জেল হয়ে গেলে তুমি কি করলে?”

    “ধরা পড়ার বছরখানেক পরই বাবার সাজা হয় কিন্তু তার আগেই পাল্টে যায় আমার জীবন।”

    “কিভাবে?”

    একটু সময় নিয়ে বলতে শুরু করলো বাবলু।

    “বাবাকে পুলিশে ধরার একমাস পরই আমার অবস্থা কঠিন হয়ে পড়ে। আমার বাবার কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছিলো না। থাকলেও আমি তাদের চিনতাম না। এরকম কাউকে কখনও দেখি নি। যে মহিলা আমার দেখাশোনার কাজ করতো, একমাস যেতে না যেতেই সে কাজ ছেড়ে দিলো। সবার মতো সেও বুঝে গেছিলো আমার বাবা আর জেল থেকে বের হয়ে আসবে না। মাস শেষে কোনো টাকাও পাবে না। আমার অবস্থাটা তখন ভাবুন,..”

    জেফরি বেগ মাথা নেড়ে সায় দিলো।

    “একেবারে একা। অসহায় একটা ছেলে। ঘরে কোনো টাকাপয়সা নেই। কিভাবে কী করবো কিছুই মাথায় আসছিলো না।”

    “তোমার ঐ আতাউল চাচা?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাবলু। “বাবা গ্রেফতার হবার পনেরো বিশদিন পর মামলার চার্জশিটে আতাউল চাচার নামও দেয়া হয় বাবার সহযোগী হিসেবে। উনি তখন বস্তি ছেড়ে পালিয়ে যান।”

    “হুম,” আর কিছু বললো না জেফরি।

    “এদিকে বাবা জেলে যাবার পর থেকে বস্তির লোকজনের কাছে আমি আচ্যুত হয়ে গেলাম। তারা আমাকে দেখলেই জাউরা, জারজ, বাস্টার্ড বলে গালি দিতো, হাসাহাসি করতো।” একটু থামলো সে। যেনো স্মৃতির পাতা ওল্টাচ্ছে। “পর পর তিন দিন না খেয়ে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে পড়লো। ক্ষিদের কষ্ট কতো বড় কষ্ট তখন আমি টের পেলাম। ঘরে এমন কিছু ছিলো না যে ওগুলো বিক্রি করে খাবার কিনতে পারবো। ঠিক তখনই একটা কথা মনে পড়লো আমার…”

    জেফরি বেগ উৎসুক হয়ে উঠলো। “কি?”

    “বাবার পিস্তলটা!”

    “তোমার বাবা পুলিশে ধরা পড়ার পরও ওটা তোমাদের ঘরেই ছিলো? পুলিশ তোমাদের ঘরে তল্লাশী করে নি?”

    “আপনাকে আগেই বলেছি, পিস্তলটা বাবা কোথায় রাখতো সেটা আমি জানতাম।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।

    “পুলিশ ঘর তল্লাশি করলেও ওটা খুঁজে পায় নি। আমিও ওটার কথা ভুলে গেছিলাম কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষিদের জ্বালায় মনে পড়ে গেলো। জানতাম না ওটা দিয়ে কী করবো, শুধু জানতাম ওটা ব্যবহার করে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।”

    জেফরি বেগ উঠে দাঁড়ালো। এতোক্ষণ বসে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গেছে। টেবিলের সামনে একটু পায়চারি করতে করতে বললো সে, “পিস্তলটা নিয়ে তুমি কি করলে?”

    “ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ালাম বস্তির আশেপাশে…”

    এমন সময় জামান আস্তে করে বললো তার বসুকে, “স্যার, আমি একটু আসছি।”

    জেফরি বেগ সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালো, তারপর বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু।

    ওয়াশরুমের কথা বলে ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হয়ে গেলো জামান। সত্যি বলতে তার সিগারেট খাওয়ার তেষ্টা পেয়েছে। এখানে বসে বসে জঘন্য খুনির কাছ থেকে তার সিনেমাটিক গল্প শুনতে একটুও ভালো লাগছে না।

    বাবলুর দিকে ফিরলো জেফরি। “তারপর?”

    “পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেলো। ক্ষিদের চোটে আমার অবস্থা তখন আরো খারাপ, ঠিক তখনই দেখতে পেলাম নির্জন পথে এক ভদ্রলোক গাড়ির বনেট খুলে উপুড় হয়ে কী যেনো দেখছে। তার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছিলো…”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকরাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }