Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কন্ট্রোল (বেগ-বাস্টার্ড ৭) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প399 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কন্ট্রোল – ২০

    বনানীর পামরোজ ভিলার নিচতলার পার্কিংলট ছাড়া আর কোথাও সিসিক্যাম নেই।

    ব্যাপারটা স্বাভাবিকই। নিচতলা দিয়েই সবাই ঢোকে, ওখানেই সিঁড়িঘর আর লিফট। কে ঢুকলো, বের হলো সেটা ওখানকার সিসিক্যাম দিয়েই মনিটর করা সম্ভব। যদিও অনেকে নিজেদের ফ্ল্যাটের বাইরেও সিসিক্যাম ইন্সটল করে থাকে। আজকাল কেউ কেউ ফ্ল্যাটের ভেতরেও সিসিক্যাম বসায়, অ্যাপসের মাধ্যমে যেকোনো জায়গা থেকে মনিটরিং করা যায়।

    জেফরি বেগ তার সহকারিকে দায়িত্ব দিয়েছিল এই ভবনের সিসিক্যামের ফুটেজগুলো খতিয়ে দেখার জন্য, জামান সেটা সংগ্রহ করে হোমিসাইডে নিয়ে এসেছে ঐদিন বিকেলেই। এই কাজটা খুবই বিরক্তিকর আর সময়সাপেক্ষ। কখনও কখনও দশ-বারো ঘণ্টার ফুটেজও দেখতে হয়। স্বাভাবিক গতির চেয়ে বাড়িয়ে দিয়ে কাজটা করা হয় বলে রক্ষা। তবে একটা বিষয় কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হয় না-পূর্ণ মনোযোগ।

    জেফরি তাকে বলে দিয়েছিল সন্ধ্যা সাতটার পর থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত ফুটেজগুলো দেখতে।

    জামান এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছে কে কখন ঢুকলো, বের হলো। অস্বাভাবিক কিছুই তার চোখে পড়েনি। ভবন থেকে ঐ সময়ের মধ্যে ঢোকা এবং বের হওয়া প্রতিটি ব্যক্তির ছবি সে আলাদাভাবে সেভ করে রাখছে পরে ভবনের দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে চিহ্নিত করা হবে তারা সবাই অ্যালোটি কি না। যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় যে ঐ ভবনে থাকে না তাহলেই সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে সাব্যস্ত করা হবে।

    কফির মগে চুমুক দিতে দিতে জামান যখন ফুটেজগুলো দেখছে তখনই সেখানে ঢুকলো জেফরি বেগ।

    “কী অবস্থা, কিছু পেলে?” বলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।

    “না, স্যার…ভোরের ফুটেজগুলো দেখবো এখন।”

    “ওটাই দেখো আগে “ জামানের পাশে বসে পড়লো সে। “আমাদের সাসপেক্ট সম্ভবত খুব সকালে ঐ বিল্ডিং থেকে চলে গেছে।”

    একটু অবাক হলো সহকারি। “আপনি কিছু বের করতে পেরেছেন মনে হয়?”

    “হুম। দোতলায় একটা লোকাল এয়ারবিএনবি টাইপের প্রতিষ্ঠানের ফ্ল্যাট আছে, নাম কামারা বিডি। সেখানে একজন রহস্যময় গেস্ট উঠেছিল তিন দিন আগে, আমার ধারণা ঐ লোকই খুনটা করেছে।”

    জামান সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার অপারেটর ছেলেটাকে ভোরের দিকে ফুটেজগুলো দেখানোর জন্য বলল।

    “আমি কিন্তু অনেক সকালে ওখানে গেছিলাম…সাতটারও একটু আগে।”

    “তাহলে ভোর চারটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত দেখলেই হবে, স্যার?”

    “হুম।”

    অপারেটর ছেলেটা বেশ চটপটে, দ্রুত ঐ সময়ের ফুটেজগুলো দেখাতে শুরু করলো। সত্যি বলতে ঐ সময়ের মধ্যে মাত্র চারজন লোক ভবন থেকে বের হয়েছিল, আর তাদের তিনজনের মাথাতেই ছিল টুপি। কিন্তু যে একজনের মাথায় টুপি নেই তার হাতে একটা ব্যাগ, চোখে চশমা, মুখে চাপদাড়ি।

    “আমাদের সম্ভাব্য খুনি বলেছিল সকালে তার ফ্লাইট আছে,” পর্দার দিকে তাকিয়ে বলল জেফরি। ফুটেজের সময়টাও সে কথাই বলছে। জেফরি বেগ জানে, এরপর কী দেখতে পাবে : নামাজ পড়ে লোকগুলো ফিরে আসবে। কেউ হয়তো একটু হাঁটাহাঁটি করে দেরিতে আসবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন ফিরে আসবে না।

    পনেরো মিনিট পর প্রথম লোকটা ফিরে এলো ভবনে। বয়স ষাটের কোঠায় হবে। দাড়ি আছে। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা। আরো সাত-আট মিনিট পর দ্বিতীয় ব্যক্তিও ফিরে এলো। প্রায় কাছাকাছি বয়সের লোক। তবে দাড়ি- গোঁফ কিছুই নেই। একটু পর যুবক বয়সি একজনও ফিরে এলো। এই ছেলের কালো দাড়ি আছে, গোঁফ নেই। পরনে পায়জামা আর বেশ লম্বা পাঞ্জাবি, যেটাকে জোব্বা বলাই ভালো।

    কিন্তু ব্যাগ হাতে মাঝবয়সি লোকটা আর ফিরে এলো না। নিশ্চিত হয়ে গেল এবার। এরপর ফুটেজ টেনে দেখা গেল স্থানীয় থানার এসআই আর জেফরি বেগসহ পুলিশের দলটি পৌণে সাতটা বাজে ঢোকার আগ পর্যন্ত সেই লোক ভবনে ফিরে আসেনি।

    “এটাই আমাদের সাসপেক্ট।”

    জেফরির কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো জামান। তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই।

    “ওর ছবিটা ব্লো-আপ করো।”

    অপারেটর সেটাই করলো কিন্তু লোকটা এমনভাবে মাথা নিচু করে রেখেছে যে, চেহারা পুরোপুরি ভালো করে দেখার উপায় নেই। নিচতলার এই সিসিক্যামটা নয়-দশ ফুট উপরে ইন্সটল করা।

    “এই লোক যেদিন এখানে ঢুকেছে সেদিনের ফুটেজ জোগাড় করে দেখতে হবে চেহারাটা পাওয়া যায় কি না।”

    “মনে হয় না লাভ হবে,” সহকারিকে বলল। “যে লোক বের হবার সময় এতটা সতর্ক ছিল সে ঢোকার সময় আরো বেশি সতর্ক থাকবে।”

    হতাশ হয়ে তাকালো জামান।

    “সমস্যা নেই, আমাদের কাজ হয়ে যাবে,” বলল সে। “কান টানলে মাথা আসে. আর মাথার নাগাল পেয়ে গেলে কান এমনিতেই চলে আসবে। আমরা এখন মাথাকেই টানবো!”

    অধ্যায় ২১

    এদিকে জাহান গ্রুপের মালিক শাহজাহান করিম বুঝতেই পারছে না সোনিয়া নামের মেয়েটি আদৌ সুইসাইড করেছে নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছে।

    এখন তার বয়স আশির মতো, খুব দ্রুতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ব্যবসা- বাণিজ্য নিয়ে তার কোনো রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল না কোনো কালেই। শত বাধা-বিপত্তি শক্ত হাতে, দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। যাকেই বাধা মনে করেছে দরকার পড়লে তাকেই সরিয়ে দিয়েছে হয় মাঠ থেকে নয়তো দুনিয়া থেকে

    কিন্তু তার দুই ছেলে, যারা তার রাজত্বের হাল ধরবে ভেবেছিল, তারা তাকে বার বার হতাশ করেছে, বেইজ্জতি করেছে। বিপদের কথা না হয় বাদই দেয়া গেল।

    সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে ওরা, অভাব কারে কয় জানে না। কিন্তু এত বড় ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য চালানোর জন্য যেটুকু যোগ্যতা না থাকলেই নয়, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না বড়টার মধ্যে। ওর কথা মনে পড়লেই মুখটা বিস্বাদে ভরে ওঠে। বিষাদও জেঁকে বসে মনে। মানুষ কী করে পারে এটা করতে? তার বংশে কেউ তো এমন ছিল না!

    অবশ্য তার শ্বশুড়বাড়ির দিকে এমন কুস্বভাবের মানুষজন ছিল। শ্বশুড়ের বড় ছেলেটা ছিল এমন বদঅভ্যাসের মানুষ!

    একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। ভেবেছিল বিদেশে গিয়ে ভালোই করেছে, দূরে দূরে থাকবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে না। কিন্তু তার বেইজ্জতির শেষ করে ছেড়েছে এই ছেলে। দুনিয়ার এত দেশ থাকতে নেদারল্যান্ডে গিয়ে নাড় গেঁড়েছে। একটা বিয়েও করেছে!

    ছেলের সঙ্গে ছেলের বিয়ে!

    মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো। ছোটোটাকে নিয়ে আশা করেছিল অনেক, তাকেই সিইও বানিয়েছে অল্প বয়সে, যাতে করে তার সঙ্গে থেকে তৈরি হয়ে নিতে পারে। এখন মনে হচ্ছে সবটাই পণ্ডশ্রম। এমন রেডিমেড ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পেয়েও ঠিকঠাকভাবে হাল ধরতে পারছে না।

    জাহান সিটিতে তার এবং দুই ছেলের বিশাল তিনটা প্রাসাদ আছে, বড়জনেরটা বিরাণ পড়ে আছে অনেক বছর ধরে। অনেক বার ভেবেছে জায়গাটা মসজিদের জন্য দিয়ে দেবে কি না। কিন্তু বাড়ির পাশে মসজিদ করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে তাদের সিকিউরিটি চিফ। মসজিদ হলে প্রচুর লোকজন আসবে সেখানে, এটা তাদের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। দ্বিমত করেনি সে। তবে প্রাসাদটার কী করবে এখনও সিদ্ধান্ত পারেনি।

    তাদের বাপ ছেলের দুটো প্রাসাদে অফিসঘর আছে, সেখানে কিছু কর্মচারি থাকে। এরা মালিকের যেমন কাছের তেমনি ক্ষমতাবানও। জাহান গ্রুপের অন্যান্য কর্পোরেট অফিসে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে। এরকমই একজনকে একটু আগে ফোন করে দেখা করতে বলেছে শাহজাহান করিম।

    সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা জাহান গ্রুপ এবং তার পরিবারের সব ধরণের নিরাপত্তা দেখাশোনা করে। আলভীর পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্টকে না ডেকে এই লোককে ডেকে আনার সঙ্গত কারণ আছে-শাহজাহান করিম জানে কার কাছ থেকে কোন তথ্যটা ভালো পাওয়া যাবে।

    “স্লামালেকুম, স্যার,” কায়সার নামের সাবেক পুলিশ বিশাল বড় ঘরটায় ঢুকেই সালাম দিলো। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাকও হলো সে। তবে এটার অর্থ বুঝে নিতে দেরি হলো না : এখনকার কথাবার্তাগুলো খুব গোপনীয় রাখতে চাইছে তার চাকরিদাতা।

    “ওই মাইয়ার সঙ্গে কি আলভীর সম্পর্ক আছিল?” সালামের জবাব না দিয়েই জানতে চাইলো শাহজাহান করিম। কর্মচারিদের দেয়া সালামকে তাদের চাকরির অংশ হিসেবেই মনে করে, কখনও মুখ খুলে, হাত তুলে জবাব দেবার দরকার মনে করে না।

    “জি, স্যার।”

    “ওরে কে মারছে?”

    “ওটা মেবি সুইসাইড, স্যার।”

    অবাক হয়ে তাকালো শাহজাহান করিম। “মেবি বলছো কেন, শিওর না?”

    একটু আমতা আমতা করলো কায়সার আহমেদ, “ইয়ে মানে, আমার ধারণা ওটা সুইসাইডই।”

    “আরে সত্যিটা বলো!” রেগেমেগে বলল জাহান গ্রুপের মালিক। “আমি কি পলিটিশিয়ান নাকি, ইন্টেলিজেন্স থেইক্যা খালি মনপসন্দ খবর চামু!”

    “সরি, স্যার,” ক্ষমা চাইলো কায়সার। “মেবি সুইসাইড না।”

    “আবার মেবি!” বিরক্ত হলো এবার। “তোমরা কি জোর দিয়া কিছু কইতে পারো না?”

    চুপ মেরে রইলো কায়সার।

    “আলভী করাইছে?!”

    “না, স্যার।”

    ভুরু কুঁচকে গেল শাহজাহানের। “তাইলে কে করাইলো?”

    “এখনও বুঝতে পারছি না।”

    “না বুঝলে কেমনে জানলা আলভী করে নাই?” চটে গেল শাহজাহান। আবারো চুপ মেরে রইলো সিকিউরিটি চিফ।

    “কে করাইলো সেই খবরটা নাও!”

    “জি, স্যার।”

    “এখন কী অবস্থা? খবরটা তো নিউজে আইস্যা পড়ছে…কাহিনি কী? তোমরা করোটা কী বুঝি না!”

    “স্যার, বড় কোনো মিডিয়াতে আসেনি, একটা অনলাইন পোর্টালে আসছে শুধু।”

    “বস্তা থিকা একটা আলু বাইর করতে পারলেই কাম হইয়া যায়, পুরা বস্তা ছিঁড়ার দরকার পড়ে না, বুঝছো?”

    “জি, স্যার।”

    “বড় মিডিয়া হইলো হাতি, এইসব পুঁইচক্যাগুলান ইন্দুরের মতো, এরা বেশি ডেঞ্জারাস। মনে রাইখো, হাতি কইলাম বাঁধ ভাঙবার পারে না, ইন্দুর পারে।”

    গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লো কায়সার আহমেদ।

    “এইগুলার সংখ্যা তো গুইণ্যা শ্যাষ করন যায় না, কয়টারে ম্যানেজ করতে হইবো, কিচ্ছু বুঝা যায় না।”

    আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক পুলিশ। “আলভী স্যার করেননি, এই ব্যাপারে আমি শিওর।”

    গভীর করে শ্বাস নিলো শাহজাহান করিম। এই সিকিউরিটি হেডের কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না, আলভীর ছায়াসঙ্গি সে। হয় সশরীরে নিজেই থাকে নয়তো তার অধীনে থাকা লোকজন-যাদেরকে সে পরিচালিত করে। সুতরাং আলভী কার সঙ্গে কখন কোন বিষয়ে কথা বলল, দেখা করলো, সবই জানে এই লোক।

    “তাইলে কি আবুইল্যার কাম এইটা?”

    স্থিরচোখে তাকালো কায়সার। আবুল হোসেন আবুল নামের শাহজাহান সাহেবের পুরনো এক প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ি আছে, এখন অবশ্য তার সঙ্গে বিস্তর ব্যবধান কিন্তু লোকটা নিজের অবস্থান নিয়ে বিভ্রমের মধ্যে রয়ে গেছে। তার মতো শেয়ালের যে বাঘের সঙ্গে লড়াই করা মানায় না, ভুলে যায় প্রায়শই।

    “আমার তা মনে হচ্ছে না,” জোর দিয়েই বলল কায়সার। “আপনার সঙ্গে লাগার ক্ষমতা ঐ লোকের নাই। বিশেষ করে আপনার ফ্যামিলি ম্যাটারে নাক গলানোর কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

    মনে মনে সায় দিলো শাহজাহান। সিকিউরিটি চিফ তাকে খুশি করার জন্য বাড়িয়ে টাড়িয়ে বলেনি। আবুল এখন তার হাঁটুর নিচে পড়ে আছে, এমন দুঃসাহস সে দেখাবে না।

    “তাছাড়া ঐ মেয়েটার কথা ওরা জানবে কী করে?…আমাদের অনেকেই তো জানে না, স্যার।”

    “তুমি জানছো কবে থিকা?” গম্ভীর মুখে বলল শাহজাহান করিম।

    একটু অপ্রস্তুত হলো কায়সার। এই লোকের কাছে মিথ্যে বললে ক্ষতি বেশি হবে। “স্যার, অনেস্টলি বলবো?”

    “হুম!” জোর দিয়ে বলল জাহান গ্রুপের মালিক। “সকাল সকাল আমার লগে ডিসঅনেস্টি দেখাইতে চাও?”

    “জি, না…স্যার,” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো। “শুরু থেকেই জানতাম কিন্তু আমি ভেবেছিলাম রেগুলার কেস…এতটা ইনভল্ভ হয়ে পড়বেন বুঝতে পারিনি।”

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো আলভীর বাপ। “বুঝছি। এখন কী অবস্থা সেইটা বলো?”

    “খবর ভালো না। আলভী স্যার মেয়েটার পোস্ট মর্টেমের রেজাল্ট চেঞ্জ করার জন্য একজনকে অ্যাসাইন করেছিলেন, ঐ লোক টাকা দিতে গিয়ে ডাক্তারসহ ধরা পড়ে গেছে পুলিশের হাতে।”

    “কী!” জাহান গ্রুপের কর্ণধার চটে গেল আবার। “আমি বুঝতাছি না, আলভী যদি কামটা না কইরা থাকে তাইলে এইটা করতে গেল ক্যান? এত কাঁচা কাম কারে দিলো? কী করতাছে ওয়!”

    “স্যার, ঐ মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল…আলভী স্যার চাইছিলেন এই কথাটা যেন রিপোর্টে না আসে।”

    বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো শাহজাহান করিম। তার ছেলের অনেক নারী থাকতে পারে, সেটাকে বড় সড় দোষ মনে করে না, যৌবনে তার ও এমন কিছু অভ্যাস ছিল কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য আর পরিবার ঠিক রেখেই যা করার করেছে, কখনও এই ব্যাপারগুলো আলোচনায়ও আসেনি। পুরুষ মানুষের জন্য এগুলো নিছকই বিনোদন। যাদের অঢেল টাকা আছে তারা একটু ফূর্তি-টুর্তি করবেই। পরকালে গিয়ে বাহাত্তুর হুর পাবার আশায় তসবিহ গুণবে আর এবাদত করবে নাকি? আরে বাবা, বেহেস্ত জুটবে কি না সেই নিশ্চয়তা আছে? এই জীবনে যে পরিমাণ পাপ করেছে, টেনেটুনে তেত্রিশ মার্ক পেয়েও বেহেস্তে যেতে পারবে না। তো ইহকালে একটু বেহেস্তি জীবনের সন্ধান করতেই পারে।

    কিন্তু সমস্যা হলো তার এক ছেলের মেয়েমানুষে রুচি নেই, আরেকজনের আবার মেয়ে ছাড়া চলেই না। সেটাও দোষের ছিল না যদি মেয়েগুলোকে ম্যানেজ করতে পারতো। এইরকম ঢিলা চরিত্র নিয়ে এত বড় সাম্রাজ্য চালাবে কী করে?! চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল তার কপালে।

    “তুমি…তোমরা কী করলা? আমাগো লিগ্যাল কী করলো? এইসব ইয়ে যদি সামলাইতে না পারে তো কীসের চাকরি করে!” রেগেমেগে উষ্মা প্রকাশ করলো।

    “স্যার,” শান্তকণ্ঠে বলল কায়সার। “উনি ব্যাপারটা ম্যানেজ করেই ফেলেছিলেন, মেয়েটাকে রাজি করিয়ে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করছিলেন,” একটু থামলো, তার নিয়োগদাতা বুঝতে পেরেছে কি না দেখার জন্য। মনে হলো বুঝতে পেরেছে। “তার আগেই এটা ঘটে গেল।”

    ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো শাহজাহান করিম। “কারে দিছিল কামটা?”

    “আকবর সাহেবকে।”

    “ওহ্!” আক্ষেপে মাথা দোলালো। আকবর শুধু তাদের কর্মচারিই না, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও বটে। জাহান গ্রুপের খুবই ঘনিষ্ঠ একজন। “ওরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো…আজকের মইদ্যেই! আর খুঁইজ্যা বাইর করো কামটা কে করছে। এইটা জানা খুব জরুরি।”

    কায়সার কী বলবে বুঝতে পারলো না। “স্যার, কেসটা এখন হোমিসাইড দেখভাল করছে।”

    “তো কী হইছে? ওইটা পুলিশের ডিপার্টমেন্ট না?”

    “জি, স্যার কিন্তু…” কথা খুঁজে পেলো না সাবেক পুলিশ। “জেফরি বেগ নামের একজন কেসটা তদন্ত করছে। ওই লোক এফবিআই থেকে ট্রেনিং পাওয়া, খুবই ভালো অফিসার। যতো সমস্যা হয়েছে সেখানেই। থানার ওসিকে ম্যানেজ করা হয়েছিল কিন্তু জেফরি বেগ ঢুকে পড়ায় সব গোলমাল হয়ে গেছে।”

    “আহা!” অধৈর্য হয়ে উঠল শাহজাহান। “ঐ লোকরে টাকা-পয়সা দিয়া মিটমাট কইরা ফালাও তাড়াতাড়ি!”

    “তাকে টাকা সাধতে গেলেই ফাঁস করে দেবে মিডিয়ার কাছে, আর যে সাধতে যাবে তাকে অ্যারেস্ট করবে।”

    “এই দ্যাশে এমন বোকা মানুষও আছে!” জাহান গ্রুপের মালিক অবাকই হলো। “আরে বাবা, কোটি কোটি টাকা নিয়া নিজের ভবিষ্যৎ সিকিউরড কর, আরামে জিন্দেগি গুজরান কর! সন্তান-সন্ততিদের নিয়া নিশ্চিন্তের জীবন পার কর। তা না কইরা আদর্শ, সততা আর নীতি মারায় কোন বোকাচোদা?!”

    কায়সার কিছু বলল না। তার নিয়োগকর্তা যতো ভালো ব্যবসায়ি-ই হোক না কেন, টাকা দিয়ে সব ধরনের সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসি। আর এটা যে কখনও কখনও ব্যর্থ হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণাই রাখে না, বুঝতেও চায় না।

    “ভালা কইরা খোঁজ নাও,” হুকুমের স্বরে বলল এবার। “লাখ খায় না হয়তো…কোটির অফার করো।”

    “আমার মনে হয় এই কাজটা না করলেই ভালো হবে, স্যার,” সাহস করে বলেই ফেলল কথাটা। “হিতে বিপরীত হয়ে যাবে, আরো বড় বিপদে পড়ে যাবো আমরা।”

    হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো শাহজাহান করিম। ভেবেছিল, এমন লোক এ দেশে আর নেই। এরকম লোকের দেখা কখনও পায়নি, পাবেও না। তারপরই মনে পড়ে গেল গোপালের কথা। ওদের মন্দিরের জমিসহ পৈতৃক ভিটে বাড়িটা নিতে চেয়েছিল কিন্তু রাজি হয়নি। জাহান সিটির মাঝখানে পড়ে গেছিল মন্দির আর প্রাচীন ভিটেটা, অন্য কোথাও জায়গা দেবার প্রস্তাব করেছিল, সেই সাথে কিছু নগদ টাকা-পয়সা। বুদ্ধিমান কেউ হলে রাজি হয়ে যেতো কিন্তু প্রস্তাব পেয়ে গোপাল তাকে বলেছিল, এত টাকা দিয়ে সে কী করবে? সুখ তো কেনা যায় না, শান্তিও বিক্রি হয় না কোথাও। এগুলোর দামও তার জানা নেই। শত বছরের পুরনো মন্দির আর বাপ-ঠাকুর্দারদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটের বদলে সে কোনো রাজ প্রাসাদে যেতেও রাজি না। ঠাকুরকে সরানোর ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই তার নাই। জীবন থাকতে সে এটা করতে দেবে না!

    তো ঐ বোকাচোদার তুচ্ছ জীবনটা থাকতে যেহেতু সম্ভব নয়, সবার আগে সেটাই নিয়ে নিয়েছিল!

    বাঁকা হাসি ফুটে উঠল শাহজাহানের মুখে। বোকাচোদারা এসব নিয়ে থাকলেই ভালো! তাদেরকে বুদ্ধিমান করার কোনো দরকার নেই। প্রকৃতিই এইসব বোকা তৈরি করেছে। ফালতু বিষয় নিয়ে দিন গুজরান করবে এরা। জিন্দেগির সত্যিকারের মজা লুটবে বুদ্ধিমানেরা। তাদেরকে বুদ্ধিমান করার দায়িত্ব খোদ স্রষ্টাই নেয়নি, তার মতো বান্দা কেন নিতে যাবে?

    “স্যার?” কায়সার বলল।

    সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো শাহজাহান। “কী?”

    “বিষয়টা অনেক দূর চলে গেছে, আমাদের জন্য এটা ম্যানেজ করা প্রায় অসম্ভব। আপনি যদি হোমমিনিস্টারের সঙ্গে একটু কথা বলতেন?”

    আক্ষেপে মাথা দোলালো জাহান গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। “এই বয়সেও শান্তিতে থাকতে দিবা না তোমরা…এইসবও সামাল দিতে হইবো আমারে!”

    কায়সার আহমেদ কিছু না বলে চুপ মেরে রইলো।

    অধ্যায় ২২

    আর কোনো ব্যবসায়ি বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে বাড়ি থেকে রওনা দেবার আগে হোমমিনিস্টারকে জানায় কি না সন্দেহ আছে, তবে জাহান গ্রুপের কর্ণধার শাহজাহান করিম এটা করতে পারে।

    হোমমিনিস্টারের জরুরি একটা মিটিং ছিল পুলিশের কিছু উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে, সেটা আধঘন্টা পিছিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

    শাহজাহান কেন ফোনে কথাটা না বলে দেখা করতে চায় বুঝতে পারছে। তার ছোটো ছেলের অপকর্মের কথাটা এখন ভাইরাল, পুরো দেশ জেনে গেছে। ইউটিউবের এক নিউজ চ্যানেলে জাহান গ্রুপের সিইও আলভীর গোপন প্রেমিকার রহস্যজনক আত্মহত্যার সংবাদটি প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এটা আসলে সুইসাইড না, হত্যাকাণ্ড। জাহান গ্রুপ তাদের একজনকে দিয়ে পোস্ট মর্টেমের ডাক্তারকে হাত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট তাদেরকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। কেসটা এখন ওরাই তদন্ত করছে।

    হোমমিনিস্টার আক্ষেপে মাথা দোলালো। এই জাহান গ্রুপের অপকর্মের শেষ নেই, মাঝেমধ্যেই তারা বিব্রতকর ঘটনার জন্ম দেয়। সরকারের সঙ্গে সখ্যতা আছে বলে সব সময়ই পার পেয়ে যায় কিন্তু তাদেরকে বাঁচাতে গিয়ে জনগণের কাছে শুধুমাত্র সরকারকেই নয় বরং পুলিশ বাহিনি এবং আদালতকেও হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।

    একটু পরই তার ঘরে ঢুকে পড়লো শাহজাহান করিম। দেখে মনে হলো মুখ ভার, রেগেও আছে। হোমমিনিস্টার উঠে সালাম দিয়ে করমর্দন করলো তার সঙ্গে, সম্ভ্রমের সঙ্গে সোফায় বসতে দিলো তাকে। শাহজাহান বসার পরই সে বসলো। কোনো রকম ধানাই পানাই না করেই কাজের কথায় চলে এলো ব্যবসায়ি।

    “তোমার পুলিশ আলভীর নামে মামলা নিছে, খোঁজ-খবর রাখো কিছু?”

    “জি, বড় ভাই…শুনছি,” হোমমিনিস্টার বলল।

    “এইটা কেমনে হইলো বুঝবার পারতাছি না। যাউকগিয়া, এই মামলা যেন আর না আগায়। অনেক ড্যামেজ হইছে, আর না!”

    “বড় ভাই, কিচ্ছু করার নাই। যে অফিসার এইটা দেখভাল করতাছে সে অনেক পপুলার আর ফেমাস। তারে কী বলুম আমি? ওর হাতে অনেক শক্ত প্রমাণ আছে। কী কাঁচা কামটাই না করছে আপনার লোকজন! ঘুষ দিতে গিয়া ধরা খাইছে হাতেনাতে।”

    রাগে গজ গজ করে উঠল শাহজাহান। “ওরে ঢাকা থিকা বহু দূরে বদলি কইরা দাও। হিলট্র্যাসে গিয়া পাহাড়িগো লগে নীতি-আদর্শ মারাক! মশার কামুড় খাইয়া আর উপজাতিগো সামলাইতে সামলাইতে দুই দিনে সোজা হইয়া যাইবো।”

    “সমস্যা তো সেইখানেই, হোমিসাইডে বদলি করার নিয়ম নাই, ভাই।” শাহজাহান করিম যারপরনাই অবাক হলো। “নিয়ম নাই মাইনে?! ওইটা পুলিশের ডিপার্টমেন্ট না?”

    “হুম কিন্তু একটু আলাদা… বদলি নাই ওইখানে।

    “কী বালের ডিপার্টমেন্ট বানাইছো, বদলি নাই! এগুলারে তাইলে কন্ট্রোল করো ক্যামনে?”

    মিনিস্টার এ কথার জবাব দিলো না। “কেসটা তদন্ত করতাছে জেফরি বেগ, তার হাতেই ঐ ডিপার্টমেন্টটার শুরু হইছে।”

    “খেরেস্তান নাকি?”

    “না, ভাই,” বলল হোমমিনিস্টার। “মনে হয় না। ইয়ে মানে, আসলে আমি জানি না…এক ফাদারের কাছে মানুষ হইছে শুনছি।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাহান গ্রুপের মালিক। “তাইলে খেরেস্তানই। এই খেরেস্তাটারে কিছু একটা করো!”

    “দেখি কী করা যায়।”

    “আরে দেখাদেখির কী আছে?!” অধৈর্য হয়ে উঠল ধনাঢ্য ব্যবসায়ি। “তুমি মিনিস্টার, ওই খেরেস্তানটার ক্ষমতা কি তোমার চায়া বেশি নাকি?”

    “না, ব্যাপার সেইটা না,” মিনিস্টার বুঝতে পারছে না কী করে বোঝাবে পিতৃত্ববোধে বলিয়ান এই ব্যবসায়িকে। “এত ভাবতাছেন কেন, ভাই? মামলা কোর্টে উঠলে আলভী এমনিতেই খালাস পাইয়া যাইবো।”

    কথাটা শুনে আগুন চোখে তাকালো শাহজাহান।

    “আপনে তো বিচারকদের বড় বড় পুট দিছেন, তারা আপনারে দেখবো না?”

    “তোমারেও তো দিছি!” রেগেমেগে বলল শাহজাহান। “খালি ওরা দেখবো? তুমি দেখবা না?”

    কাচুমাচু খেলো মিনিস্টার। খুব করে বলতে চাইলো, যে জমিগুলো দেন সেগুলো কি আপনার বাপ-দাদার? সবই তো মানুষের জমি। কিভাবে ওগুলো লিখে নেন, দখলে নেন, জানা আছে। এমনও নজির আছে, গরীব আর অশিক্ষিত জমির মালিকদেরকে ডেকে এনে টাকার বান্ডিল সামনে রেখে দলিলে সই করার পর পিস্তল দেখিয়ে বের করে দিয়েছে এই লোক।

    “গত বছর তোমার মাইয়া আর তার জামাইরে একটা প্লট গিফট করছি, ভুইল্যা যাইও না।”

    গভীর করে শ্বাস নিলো হোমমিনিস্টার। কথাগুলো তার কাছে খোঁটার মতো লাগছে। বিচারকদের দিয়েছে এক-দুই বিঘা করে আর তার মেয়েকে দিয়েছে মাত্র পাঁচ কাঠার প্লট।

    “ইলেকশনের সময় কম দেই আমি? তোমরা যে রাইতের বেলায় কাম সারলা, আমি কি বিজনেস কমিউনিটি নিয়া ওপেনলি সাপোর্ট দেই নাই? অপোজিশন আইস্যা পড়লে তো আমার ইয়ে মাইরা দিবো!…তারপরও রিস্ক নিছি।”

    বানচোদ! মনে মনে বলল মিনিস্টার। এই হারামজাদা এমনভাবে কথা বলছে যেন এমনিতেই সাপোর্ট দিয়েছে। লুটপাট করার লাইসেন্সের বিনিময়ে সাপোর্ট করেছে তাদেরকে। আবার ঝুঁকির কথা বলে! ঝুঁকি তো নিয়েছে তারা। জেলে গেলে তারা যাবে, দেশ ছেড়ে পালালে তারাই পালাবে, এই হারামজাদা নতুন সরকারের সঙ্গে খাতির করে ফেলবে টাকার বস্তা ঢেলে।

    “চুপ কইরা আছো ক্যান?”

    শাহজাহানের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো মিনিস্টার। “বিষয়টা আপনি বোঝার চেষ্টা করেন, ভাই।”

    “আরে রাখো!” হাত নেড়ে বলল জাহান গ্রুপের মালিক। “আমারে তুমি হাইকোর্ট দেখাইতাছো, মতি।” ইচ্ছে করে হোমমিনিস্টারের ডাক নামটা ধরে ডাকলো। “কোর্ট পর্যন্ত গেলে আমার মান-ইজ্জতের ফালুদা হইয়া যাইবো।”

    ল্যাঙটার আবার ইজ্জতের ভয়! মনে মনে বলল মিনিস্টার। জাহান গ্রুপ আর তার মালিকের পরিবারের কুকীর্তির কথা সারা দেশ জানে। তাদের সম্পর্কে লোকে কী ধারণা করে, নিশ্চয়ই শাহজাহানও অবগত আছে।

    একটু কেশে নিলো মিনিস্টার। “ঘটনাটা আসলে এমন প্যাঁচ খাইয়া গেছে, কী কমু, ভাই! সব সময় টাকা দিয়া, ক্ষমতা দিয়া কাজ করা যায় না।”

    “কী কইলা এইটা!” তাচ্ছিল্যভরে বলল ভূমিদস্যু। “টাকা আর ক্ষমতা ছাড়া আর কী আছে যেইটা দিয়া কাজ হয়?”

    শাহজাহানের প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে মন্ত্রি বলল, “ঐ জেফরি বেগ খুবই ভালো একজন অফিসার। ব্ল্যাক রঞ্জুরে ধরছে কয়দিন আগে, ওর পুরা গ্যাংটারে ধরছে। না ধরলে তো আপনাগোর মতোন ব্যবসায়িরা শান্তিতে থাকতে পারতো না।”

    শাহজাহান রাগ দমন করার চেষ্টা করলো। এই ব্ল্যাক রঞ্জু একটা পাক্কা বদমাশ ছিল, তার মতো লোকের কাছ থেকেও চাঁদা চেয়েছিল। ওর আস্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে গেছিল সে। রেগেমেগে ওর পেছনে কিছু সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়েছিল কিন্তু দু দিন পরই বুঝতে পারে ভুল চাল দিয়ে ফেলেছে। হারামজাদা কী করে যেন জেনে গেছিল এটা, তাকে ফোন করে বলেছিল, চাঁদার পরিমাণ ডাবল হয়ে গেছে জরিমানা হিসেবে। টাকা না দিয়ে ধানাই পানাই করলে তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে। হুমকিটা পাবার পর আর কিছু করেনি, ডাবল টাকাই দিয়ে দিয়েছে চুপচাপ। ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনিকেও জানায়নি।

    “এত ভালো অফিসার পুলিশে কমই আছে,” জোর দিয়ে বলল হোমমিনিস্টার। “পুরা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে সে পপুলার, তারে আইডল মানে।”

    বিকৃত মুখ করে প্রশংসাটা উড়িয়ে দিলো শাহজাহান।

    “কয়দিন বাদে প্রেসিডেন্টের কাছ থিকা মেডেল পাইবো, এইটা অল রেডি এনাউন্সড। সমস্যাটা কী জানেন, তারে উল্টাপাল্টা কোনো অর্ডার দেওন যাইবো না।”

    “আরে দিবা কেমনে?!” তেঁতে উঠল এবার। “ট্রান্সফারের ব্যবস্থাই তো রাখো নাই!”

    মাথার ডানপাশটা চুলকালো মিনিস্টার। “খুবই সৎ অফিসার, আপনেও তারে টাকা দিয়া কিনবার পারবেন না। চেষ্টা কইরা দেখতে পারেন, বুঝবেন তখন কী কঠিন জিনিস।”

    শাহজাহান রাগে গজ গজ করলো। তবে এ-ও জানে, কথাগুলো মিথ্যে নয়, সিকিউরিটি চিফ কায়সারও একই কথা বলেছে, এই অফিসার নাকি কোটি টাকায়ও বিক্রি হয় না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সৎ মানুষকে বাগে আনা খুবই কঠিন কাজ। সে তুলনায় তাদেরকে উপরে পাঠিয়ে দেয়া বেশি সহজ।

    “ভাই, আপনার ছেলের তো মাথা গরম…ওরে বইলা দিয়েন, ওয় যেন আবার মামলার বাদীরে হুমকি-টুমকি না দেয়। দিলে কইলাম ভাইরাল হইয়া যাইবো। আর ভুলেও যেন ঐ অফিসার…জেফরি বেগের কিছু না করে।

    শাহজাহান করিম কটমট চোখে চেয়ে রইলো।

    “ওর কিছু হইলে কিন্তু সামাল দেয়া যাইবো না, পুরা পুলিশ বিভাগ ক্ষেইপ্যা যাইবো। প্রাইম মিনিস্টার তখন ইমেজ বাঁচাইতে যা করার করবো। আমি আপনের ভালো চাই, তাই বললাম।”

    “হুম।” গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো শাহজাহান। “উপদেশ দেওন ছাড়া আর কিছু করতে পারবা না তাইলে?”

    হোমমিনিস্টারও উঠে দাঁড়ালো। “আপনার যে লোকটা ধরা পড়ছে তারে এক সপ্তাহ পর জামিনের ব্যবস্থা কইরা দিমুনে, এহন এইটা করলে হাউকাউ হইবো খুব।”

    আর কোনো কথা না বলে শাহজাহান করিম তিক্তমুখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

    বাইরে রিসেপশনে কায়সার আহমেদ অপেক্ষা করছিল, শাহজাহানকে বের হতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল সে। কর্তার মেজাজ যে খারাপ বুঝতে পারলো। কোনো কথা জিজ্ঞেস না করে বাইরে গাড়ি পর্যন্ত চুপচাপ হেঁটে গেল সে।

    “পলিটিশিয়ানরা হইলো সবচাইতে বড় বাস্টার্ড!” গাড়িতে বসে রেগেমেগে বলল জাহান গ্রুপের মালিক। “আমারে জ্ঞান দেয় বাইনচোদে!”

    “স্যার, এরা একেকটা বেঈমানের বাচ্চা,” তাল দিলো কায়সার আহমেদ। সে জানে, বড় লোকদের রাগের সময় অতি অবশ্যই তাল দিতে হয়। তার রাগটা যে যথার্থ সেটা বুঝিয়ে দিতে হয়। “নিজেরা কখনও স্যাক্রিফাইস করে না, দরকার পড়লে অন্যদের স্যাক্রিফাইস করে দেয়।”

    শাহজাহানও এটা জানে, আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। যারা কোরবানির গরুটা পর্যন্ত তার মতো ব্যবসায়িদের কাছ থেকে নেয়, তারা করবে স্যাক্রিফাইস! এইসব পলিটিশিয়ানরা অতীতে অনেককে বকরা বানিয়েছে। এর আগের সরকারের হোমমিনিস্টার কী করেছিল ভুলে যায়নি। তার বড় ছেলেটা রাগের মাথায় একজনকে খুন করে ফেলেছিল, ইচ্ছাকৃত ছিল না মোটেও কিন্তু এই সামান্য ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্য মিনিস্টার তার কাছ থেকে চল্লিশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। তারপরও শুয়োরটা সুকৌশলে কেস সাজিয়ে রেখেছিল এমনভাবে, জাঁদরেল উকিলের হাতে পড়লে বিরাট বড় বিপদ ঘটে যেতো। যাক, সে যাত্রায় বেঁচে গেছে। পরের সরকারকে যোগ্য “উপঢৌকন দিয়ে ম্যানেজ করা গেছে। এখন ঐ হোমমিনিস্টারই জেলে পচে মরছে। এই জীবনে আর বের হতে পারবে কি না সন্দেহ।

    এই ঘটনা থেকে বিরাট একটা শিক্ষা নিয়েছিল সে-পরের ধনে পোদ্দারি আর করবে না। সে কেন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে? এমন লোকের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে যারা তার টাকায় চলে? পরের ধনে পোদ্দারি করবে তো ঐসব পলিটিশিয়ানরা, যাদের নিজেদের কোনো ধন নাই!

    সেজন্যেই পরের সরকারের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করার পাশাপাশি বিচারকদেরকে হাতে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওদের অনেককে প্লট দিয়ে সহজেই পকেটে পুরে ফেলা গেছে। অন্যের জমি অন্যকে দিয়ে দিয়েছে, মাঝখান থেকে লাভের ফসল তুলে নিয়েছে সে।

    অধ্যায় ২৩

    জেফরি বেগ বনানী থানায় যখন এলো দেখতে পেলো ওসি হাসমত তখনও আসেনি।

    এমনটাই প্রত্যাশা করেছিল সে। হোমিসাইডের তদন্তকারী হলেও থানার পুলিশদের সঙ্গে প্রতিনিয়তই তাকে কাজ করতে হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটানের থানাগুলো কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে ভালোই ধারণা আছে তার। এখানকার থানাগুলোর অফিসার ইন চার্জরা খুব কম সময়ই সকাল নয়টায় আসে। দুপুরের পর এলে বলতে হবে কপাল ভালো। বেশিরভাগই আসে বিকেল কিংবা সন্ধ্যার দিকে। এর কারণও আছে, তাদেরকে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতে হয়। ওসি হাসমত যে এখন নেই সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।

    যে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে এসেছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সোনিয়ার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দারোয়ানকেও এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। ঐ লোক এমন ভাণ করেছিল যেন ঘটনাটা এক যুগ আগের, মনে করতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু জেফরি যখন বলল বনানী থানা থেকে তাকে এ কথা বলা হয়েছে তখন দারোয়ানের স্মৃতিশক্তি দ্রুত ফিরে আসে।

    “হ, স্যার…মনে পড়ছে! রাইতে আইছিল, আমি হপায় ঘুমাইতে গেছি তহন।

    বশির তাকে জানিয়েছে তাদের থানার এক এএসআই সুজন হাওলাদার ঐদিন রাতে সোনিয়ার ব্যাপারটা সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্য একটা টহল টিম নিয়ে গিয়েছিল। তবে ওখানে গিয়ে কী দেখেছে, কী করেছে সেটা কাউকে বলেনি। ওসি হাসমত সম্ভবত তাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য বলে দিয়েছে।

    জেফরি বেগ অবাক হয়ে দেখলো বনানী থানার প্রায় বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যই তাকে চেনে। সম্ভবত এর কারণ ব্ল্যাক রঞ্জুর দলকে গ্রেফতার করার পর মিডিয়া কাভারেজগুলো। কাউকেই সে ইন্টারভিউ দেয়নি কিন্তু তাতে কোনো সমস্যাও হয়নি। এডিটরদের চাপে কিংবা অ্যাসাইনমেন্ট চাপিয়ে দেবার কারণে সংবাদিকেরা বাধ্য হয়েই ফিচার লিখেছে তাকে নিয়ে। এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে কিছু কথা শুনে আর তার “সাফল্য গুলোর বয়ান দিয়ে বেশ কয়েকটি ফিচার প্রকাশ করা হয়েছিল।

    “স্যার!” তাকে চিনতে পেরে এক এসআই ডেস্ক ছেড়ে উঠে এলো। বাকিরা সম্ভ্রমের সঙ্গে সেলুট দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। “আমি আপনার বিরাট বড় ফ্যান!” তারপরই আজকালকার ছেলেপেলেদের মতোন ফোন দিয়ে ফটাফট সেল্ফি তুলে ফেলল সে। তার দেখাদেখি আরো দু-তিনজন একই কাজ করলো।

    কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে সেলিব্রেটি মনে হলো জেফরি বেগের। বিব্রত বোধই করলো সে। মনে হলো “তেমন কিছু না করেই নাম করে ফেলা”দের একজন হয়ে গেছে। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি ধরে রেখে বাকিদের সঙ্গেও হাত মেলালো। তারপর খুব দ্রুতই কাজের কথাটা পাড়লো সে-”এএসআই সুজন হাওলাদার কোথায়?”

    এক কনস্টেবল দৌড়ে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে সুজন নামের এএসআইকে নিয়ে এলো কিন্তু হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটরকে দেখে কেমন চুপসে গেল ছেলেটা। ভীতু আর সতর্ক বলে মনে হলো তাকে। জেফরি নিশ্চিত হয়ে গেল, ওসি হাসমত সুজনকে মুখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

    ছেলেটাকে নিয়ে ওসির খালি রুমেই বসলো জেফরি বেগ। “আমি সোনিয়া মার্ডার কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি,” আলাপের আগেই বলে নিলো। “ভিক্টিমের অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান আমাকে বলেছে ঐদিন রাতে আপনি ওখানে গিয়েছিলেন…” প্রশ্নের মতো শোনালো না কথাটা। ইচ্ছে করেই এটা করলো, যাতে করে সুজন বুঝতে পারে এ বিষয়ে সে পুরোপুরি নিশ্চিত।

    সুজন হাওলাদার স্পষ্টতই ঢোক গিলল।

    “ঐ বিল্ডিংয়ের অ্যালোটিদের দুয়েকজন বেলকনি থেকে দেখেছে আপনি আপনার পেট্রল টিম নিয়ে গিয়েছিলেন,” ছেলেটাকে সিদ্ধান্ত নেবার সুবিধার্থে বলল।

    সুজন হাওলাদারের কাছে আর কোনো অপশন রইলো না কথাটা স্বীকার করা ছাড়া। “জি, স্যার…আমি তখন ঐদিকটায় পেট্রল দিতাসিলাম, থানা থিকা বলল ওইখানে গিয়া একটু খোঁজ নিতে।”

    “কে বলেছে?”

    “এসআই বশির…নাইট ডিউটিতে আছিল তখন।”

    “ওখানে গিয়ে আপনি কী দেখলেন?”

    এবার কাচুমাচু খেলো সুজন। “ভিতরে তো ঢুকি নাই, বাইর থিকা দেখসি, দারোয়ানের লগে কথা কইসি। ওয় কইলো কুনো সমস্যা নাই, সব ঠিক আছে।”

    “দারোয়ান বলেছে ভিক্টিম সোনিয়া ঠিক আছে?”

    মাথা দোলালো সুজন হাওলাদার। “না না, হেয় কইসে বিল্ডিংয়ে কুনো সমস্যা নাই।”

    “কিন্তু আপনি তো বিল্ডিং দেখতে যান নাই, গেছেন ভিক্টিম মেয়েটা সত্যি সত্যি কোনো বিপদে পড়েছে কি না সেটা খতিয়ে দেখতে?”

    আবারো ঢোক গিলল এএসআই সুজন। “জি, স্যার।”

    “আপনি সেটা না করেই চলে এসেছিলেন কেন?”

    চোখ পিট পিট করলো ছেলেটা। বেশিদিন হয়নি চাকরিতে ঢুকেছে, এখনও সবকিছু অনুধাবন করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। তার মতো নতুনদের পক্ষে থানার ওসি হলো মা-বাপ।” ভয়-ও পায় যথেষ্ট।

    “থানা থেকে কেউ আপনাকে বলেছিল চলে আসার জন্য?”

    “জ্-জি, স্যার,” সামান্য তোতলালো।

    “কে বলেছিল?”

    এএসআইকে দেখে মনে হলো উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছে। কী বলবে ভেবে পেলো না।

    “ওসি সাহেব বলেছিলেন?” জেফরি বেগ তাড়া না দিয়ে বরং আরেকটু সাহায্য করলো ছেলেটাকে।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সুজন হাওলাদার।

    “উনি কি তখন থানায় ছিলেন?”

    “না, স্যার…বাসায় ছিলেন।”

    “তাহলে উনি কিভাবে এটা জানতে পারলেন?” অবাক হলো জেফরি।

    মাথা দোলালো সুজন। “স্যার, আমি এইটা জানি না।”

    বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে জেফরির কাছে। “ওসি আপনাকে কী বললেন তখন?”

    “স্যার বললেন আমি যেন বিল্ডিংয়ে না ঢুকি, এক্ষুণি চইল্যা আসি ওইখান থিকা। এত রাইতে একটা ফোন পাইয়া এইভাবে যাওন ঠিক হয় নাই।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “আপনি ভয় পাবেন না, “ আশ্বস্ত করলো ছেলেটাকে। “কেউ কিছু করতে পারবে না কারণ আপনি যা সত্যি তাই বলেছেন।”

    কিন্তু সুজন হাওলাদারকে দেখে মনে হলো না সে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পেরেছে, কেমন ভয়ার্ত দেখাচ্ছে তাকে।

    “আপনার এই স্টেটমেন্টটা কিন্তু আমি মামলায় ইউজ করবো না, আরেকটু স্বস্তি দেবার জন্য বলল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। “আপনি যে আমাকে এটা বলেছেন কেউ জানতে পারবে না।”

    “কিন্তু স্যার…” সুজন বলল।

    “ওসি সাহেব যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে আমি এসে কী জানতে চেয়েছি, তাকে বলবেন আপনি ওইদিন ওখানে গিয়েছিলেন কি না সেটা জানতে চেয়েছিলাম। আপনি আমাকে বলেছেন, আপনি যাননি।” কথাটা শেষ করে হাসিমুখে তাকালো জেফরি।

    একটু অবাক হলো সুজন হাওলাদার। এরকম কথা সে আশা করেনি। যদি তা-ই হয় তাহলে এটা জানতে চাইলো কেন এই ইনভেস্টিগেটর?

    “একটা তদন্তে অনেক কিছু জানতে হয়,” ব্যাখ্যা করলো জেফরি I “সবকিছুকে প্রমাণ হিসেবে, সাক্ষি হিসেবে নেওয়া হয় না। অনেক কিছুই জানতে হয় কেবল বাস্তবে কী ঘটেছিল সেটা ঠিকঠাকভাবে বোঝার জন্য। বুঝতে পেরেছেন?”

    এবার এএসআই সুজনকে অনেকটাই ভারমুক্ত বলে মনে হলো।

    “থ্যাঙ্কস ফর দি কোঅপারেশন, অফিসার,” সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিলো হোমিসাইডের জেফরি বেগ।

    সুজন হাওলাদার কৃতজ্ঞচিত্তে করমর্দন করলো তার সঙ্গে।

    থানা থেকে বের হতেই জেফরি দেখতে পেলো ওসি হাসমতের গাড়িটা থানার সামনে থেমেছে। মুচকি হাসলো সে। এটাও তার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। থানার ইন চার্জ হিসেবে এখানে “অতিঘনিষ্ঠ” অনেকেই থাকার কথা, তার আসার কথাটা ওদের কেউ জানিয়ে দিয়েছে। তবে সে ফোনকল আশা করেছিল। সম্ভবত থানার খুব কাছে থাকে বলে খবর পাওয়ামাত্রই ছুটে এসেছে।

    “ত পনি থানায় আসছেন, স্যার…কী হইছে?” গাড়ি থেকে নেমেই নিঃশব্দে সেলুট দিয়ে জানতে চাইলো।

    “সোনিয়ার কেসটা নিয়ে একটা তথ্য চেক করতে এসেছিলাম,” একটু থেমে আবার বলল, “ ঐদিন রাতে সোনিয়ার বড় বোন ঢাকার বাইরে থেকে বেশ কয়েক বার থানায় ফোন করেছিলেন তার বোনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে…এখান থেকে একটা টহল টিমকে সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্যে বলা হয়েছিল তখন। আপনি কি এ ব্যাপারে কিছু জানেন?”

    কয়েক মুহূর্তের জন্য ওসি কোনো কথা খুঁজে পেলো না। “না…মানে…আমি তো ছিলাম না তখন।”

    “পরে শুনেছেন নিশ্চয়ই?”

    “হ, শুনছি,” ম্রিয়মান কণ্ঠে বলল হাসমত সাহেব।

    “সোনিয়ার অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান আমাকে বলেছে পুলিশের টহল দল গিয়েছিল রাত দুইটার দিকে, এই ব্যাপারটা চেক করতে এসেছিলাম।”

    “কার সাথে কথা বলছেন?”

    “আপনাদের এক এএসআই সুজন হাওলাদার…কিন্তু ও তো স্বীকারণ করছে না। ওকে কি মুখ খুলতে নিষেধ করা হয়েছে?”

    “না, না…” মাথা দোলালো ওসি। একটু নরম সুরে বলল, “ব্যাপারটা আসলে ওই রকম কিছু না। আমি তারে বলছিলাম এইসব কথা যেন বাইরের কাউরে না বলে…জার্নালিস্টগোর কাছে কইতে না করছিলাম। বুঝেনই তো, কী থেইক্যা কী নিউজ বানায়া দেয় তারা, পরে ঝামেলা পোহাইতে হয় আমাগো,” একটু থেমে আবার বলল, “নতুন তো আমার কথাটা বুঝবার পারে নাই।”

    “হুম,” সায় দিলো জেফরি বেগ। “কিন্তু একটা কথা বলুন তো, টহল পুলিশ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে গিয়ে কিছু না করে শুধুমাত্র দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে চলে এলো কেন? ওদের উচিত ছিল না ফ্ল্যাটে গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া? সত্যি সত্যি মেয়েটা কোনো ঝামেলায় পড়েছে কি না?”

    ওসি হাসমত সম্ভবত ভেবে পাচ্ছে না কী বলবে। টহল দলকে সে ফোন করে চলে আসতে বলেছে, আর তার পর পরই ঐ ফ্ল্যাটে একটা খুন হয়ে গেছে। খুনি দেখাতে চেয়েছিল এটা আত্মহত্যা। পুরো ব্যাপারটা যে সন্দেহের সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

    “স্যার, বনানী হইলো ভিআইপিদের এলাকা…কেউ ফোন করলো আর সঙ্গে সঙ্গে রাইত-বিরাইতে সেইখানে গিয়া ডিস্টার্ব করা যায় না, পরে আমাগো অনেক ঝামেলা পোহাইতে হয়। আপনি তো কখনও থানা চালান নাই তাই বুঝবেন না।”

    মুচকি হাসলো জেফরি। কথাটা অবশ্য মিথ্যেও নয়। সে জানে, থানার পুলিশকে সার্কাসের দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হয়-ডান-বাম করে চলতে হয়। তারপরও কথাটা সে বিশ্বাস করলো না। এই ব্যাখ্যাটা খুবই দুর্বল আর সন্দেহজনক।

    “ওই বিল্ডিংটা এক এমপির আত্মীয়ের, তাই সুজনরে বলছিলাম দেইখ্যা টেইখ্যা চইলা আসতে, এত রাইতে ডিস্টার্ব করার দরকার নাই।”

    জেফরি বেগ বুঝতে পারলো ওসি হাসমত নিজের পাছা বাঁচাতে যুতসই ব্যাখ্যা তৈরি করে ফেলেছে। “ঠিক আছে, তাহলে আর এএসআইকে কিছু বলার দরকার নেই, আপনিই তো সব বলে দিলেন।” একটু থেমে আবার বলল, “দুয়েক দিনের মধ্যে একটু সময় করে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। বুঝতে পেরেছেন?”

    নড়ে চড়ে উঠল ওসি হাসমত। কথাটা মার্জিতভাবে বলা হলেও তাকে সম্ভবত ইন্টেরোগেট করা হবে। কী বলবে ভেবে পেলো না। “ঠিক আছে, স্যার।” বিমর্ষ মুখে থানার ভেতরে চলে গেল সে।

    জেফরি বুঝতে পারলো বনানী থানার ওসি বিপদটা আঁচ করতে পেরেছে। এই লোক ভেবেছিল জাহান গ্রুপের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। এখন যখন দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন তাদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা করিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নিয়মমোতাবেক তদন্তও শুরু করে দিয়েছে তখন বাস্তবতা টের পেতে শুরু করেছে। লোকটা যদি এই অপরাধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকে তাহলে খুব দ্রুতই সেটা বেরিয়ে আসবে।

    অধ্যায় ২৪

    সোনিয়ার পোস্ট মর্টেম করা হলো নতুন একজন ডাক্তার দিয়ে। আর প্রসিডিউরের পুরোটা সময় উপস্থিত ছিল রমিজ লস্কর।

    জেফরি বেগ নিজেও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু এই একটা কাজ তার ভীষণ অপছন্দের-মৃত লাশের ব্যবচ্ছেদ করতে দেখা। তার এই দুর্বলতার কথা অবশ্য কেউ জানে না। যে দুয়েক বার কাজটা করেছে, মুখে এমন অভিব্যক্তি ধরে রেখেছিল যেন এগুলোতে সে অভ্যস্ত। রমিজের অবশ্য এই সমস্যা নেই। একজন ফরেনসিক এক্সপার্ট হিসেবে এইসব কাটাছেঁড়া তার কাজেরই অংশ।

    নতুন যে ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করেছে সে জেনে গেছে আগের জনের করুণ পরিণতির কথা। এটাও বুঝে গেছে জাহান গ্রুপের সিইও আলভী করিমের মতো শক্তিশালী লোকজনও বেকায়দায় পড়ে গেছে। সরকারের উপর মহল হাত গুটিয়ে বসে আছে, তাদের হয়ে কিছু করছে না এই মুহূর্তে। তার চেয়েও বড় কথা, ডাক্তার জানতো হোমিসাইডের লোকজন কেবল ময়না তদন্তের সময় উপস্থিতই থাকবে না, প্রতিটি স্যাম্পলের নমুনাও সঙ্গে করে নিয়ে যাবে নিজেদের ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করার জন্য। ফলে এদিক ওদিক করতে গেলেই ধরা পড়তে হবে।

    জেফরি বেগ আগেই ধারণা করেছিল, এবার বাইরে থেকে কেউ কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবে না, কাজটা ঠিকঠাকভাবেই হবে। সেটাই হয়েছে শেষ পর্যন্ত।

    পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটি খুবই দ্রুতগতিতে দেয়া হলো। সেটা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি হৃদয়বিদারক।

    সোনিয়াকে হত্যা করা হয়েছে ঘাড় মটকে, ফাঁসিতে ঝোলানোর আগেই! হত্যার আগে মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে খুনি! ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে মেয়েটার শরীরে, সেই সঙ্গে খুনির স্পার্মও।

    তারা যেমনটা ধারণা করেছিল, হত্যা করার আগে ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করে অজ্ঞান করা হয়েছিল মেয়েটাকে।

    সোনিয়া প্রায় তিন মাসের অন্তঃস্বত্তা ছিল!

    সার্কুমস্টান্সিয়াল এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে জেফরি আগে থেকেই ধরে নিয়েছিল, একজন খুনিই কাজটা করেছে। ক্লোরোফর্মের ব্যবহার সেটাকেই সমর্থন করে।

    এখন হোমিসাইডের কাছে সোনিয়ার পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে-খুনির সিমেন আর তিন মাসের ভ্রূণের টিসু। এই দুটো জিনিস পুরো মামলাটিকে একাই টেনে নিয়ে যেতে পারবে।

    জেফরি বেগ জানে খুনির পেছনে ছুটে ফায়দা নেই, সন্দেহভাজন আলভী করিমের সঙ্গে ভ্রূণের টিসুর ডিএনএ ম্যাচ করালেই হয়ে যাবে। খুনি কে সেটা আলভী আর তার সাঙ্গপাঙ্গরাই ভালো জানে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবর্ন আইডেন্টিটি – রবার্ট লুডলাম
    Next Article অগোচরা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }