Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কন্ট্রোল (বেগ-বাস্টার্ড ৭) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প399 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কন্ট্রোল – ৪০

    গুলশানে যাওয়ার পথে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে রেবা কেন ফুল কিনেছিল জেফরি বেগ এখনও জানে না, সে শুধু জানে ফুল কিনে ফুটপাত থেকে নেমে আবার যখন গাড়িতে উঠবে তখনই একটা পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেয়েটাকে আঘাত করে।

    নিজের গাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ছিল সে, পিকআপ ভ্যানটি রেবাকে আঘাত করার পর তার গাড়ির পেছন দিকেও আঘাত হানে, এতে করে গাড়িটা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ড্রাইভারের তেমন কিছু হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িটা চালিয়ে আহত রেবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পেরেছে সে।

    কিন্তু হাসপাতালে নেবার পরই রেবা মারা যায়!

    তার মাথার আঘাতটি ছিল মরণঘাতি। জেফরি যখন মেডিকেলে পৌঁছায় ততক্ষণে লাশ হয়ে গেছে জ্বলজ্যান্ত মেয়েটি।

    ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে গেল জেফরি বেগ। যেমনটা হয়েছিল তার দত্তক পিতা জেফরি হোবার্টের মৃত্যুর পর। তার হাতে হাত রেখেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল প্রবীণ হিতৈষী মানুষটি। কিন্তু সেই মৃত্যুর জন্য এক ধরণের প্রস্তুতি ছিল তার। দেড়-দুই বছর ধরেই জানতো ফাদার হোবার্ট আর বেশিদিন বাঁচবেন না।

    রেবার বেলায় এ কথা বলার জো নেই। এটা যেমন আকস্মিক তেমনি তীব্র। মুহূর্তে একজন মানুষ স্মৃতি হয়ে গেছে। এই ধাক্কা শক্তপোক্ত চরিত্রের মানুষকেও নাড়িয়ে দেয়, জেফরিকেও দিলো। তার ভেতরটা ভেঙেচূড়ে নিঃশেষ করে দিলো এক নিমেষে। তাকে দেখে অবশ্য কেউ অনুধাবন করতে পারবে না ভেতরে ভেতরে কী চলছে।

    মেডিকেল হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে একটা মলিন সাদা চাদরে ঢাকা রেবার মৃতদেহের পাশে জেফরি বেগ বসে আছে মাথা নিচু করে। চাদর সরিয়ে ভালোবাসার মানুষটির থেতলে যাওয়া নিষ্প্রাণ মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না তার। তবে খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটার হাত ধরে বসে থাকতে। যে হাত ধরেছিল বহু বছর আগে কোনো এক পহেলা ফাল্গুনের সন্ধ্যায়।

    জেফরি আসার আগেই রেবার ড্রাইভার ওদের বাড়িতে ফোন করে এই ভয়াবহ দুঃসংবাদটি জানিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে অসুস্থ বাবা আর বৃদ্ধ মা ছাড়া কেউ নেই। বাড়ির কাজের লোক ছাড়া এমন কেউ নেই যে ছুটে আসবে এখানে। সঙ্গত কারণেই রেবার নিকটাত্মীয়দের কেউ কেউ খবর পেয়ে ছুটে এলো মেডিকেলে, তাদেরই একজন জানালো ড্রাইভার খবরটা দিয়েছিল বাড়ির এক গৃহকর্মিকে, সেই মেয়ে রেবার মৃত্যুর খবর শুনে হাউমাউ করে কেঁদে বলে দিয়েছে তার মা আর অসুস্থ বাপকে। বয়স্ক দুজন মানুষ এমন খবর সহ্য করতে পারেনি। রেবার এক কাজিন জানালো, ওর বাবা স্ট্রোক করেছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে আত্মীয়স্বজনেরা। অনেকদিন ধরে ক্যান্সোরে ভুগছেন আনজার হোসেন।

    দীর্ঘদিন হোমিসাইডে কাজ করার সুবাদে অন্য যে কারোর চেয়ে মৃত্যুকে একটু বেশিই কাছ থেকে দেখেছে জেফরি বেগ। মৃত্যুর নানান ধরণ আর প্রকার দেখে দেখে এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা কিন্তু সেই অভ্যস্ততা নিকটজনদের বেলায় কাজ করে না। রেবার মৃত্যু তাকে স্তম্ভিত করে দিলো পুরোপুরি, কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল সে।

    রেবার পরিবার আর আত্মীয়দের মধ্যে খুব কম লোকজনই তাকে চেনে। যারা চেনে তাদের সঙ্গেও তার খুব একটা কথাবার্তা হয়নি কখনও। ওরা সবাই তার অতীত সম্পর্কে জানে, জানে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া একজন সে, নরম হৃদয়ের এক খৃস্টান পাদ্রি তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। তার ধর্ম নিয়েও ওদের মনে প্রশ্ন আছে।

    কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার, কারোর কাছ থেকে সান্ত্বনাও পেতে চাইছে না। তবে সে চাইছে তার পাশে কেউ থাকুক, চুপচাপ তাকে সঙ্গ দিক। সম্মোহিতের মতো পকেট থেকে ফোন বের করে জামানকে একটা মেসেজ পাঠালো, অনেকটা পুরনো দিনের টেলিগ্রামের মতো করে : রেবা ইজ নো মোর। কাম মেডিকেল কলেজ হসপিটাল।

    ভালো করেই জানে জামান কী রকম শক্ড হবে। তবে এটাও জানে তার সহকারি তাকে ফোন করে জানতে চাইবে না কী হয়েছে, দৌড়ে ছুটে আসবে সে। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে থেকেছে, অন্য অনেকের চেয়ে ভালো বোঝে তাকে। তার ধারণা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে জামান আর কল করলো না, মেসেজের রিপ্লাইও দিলো না।

    চারপাশে কে আসছে, কী করছে, কে কাঁদছে কোনো কিছুই দেখতে ইচ্ছে করছে না জেফরির। তার চোখ বন্ধ, মাথাটা নিচু করে রাখা। যদি সবটাই দীর্ঘ কোনো দুঃস্বপ্ন হতো, যদি চোখ খুলে দেখতো এতক্ষণ আসলে ঘুমিয়ে ছিল, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ ভাবতো নিজেকে }

    এই জীবনে অনেক বারই এরকম দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সত্যি বলতে রেবার সঙ্গে পরিচয় হবার আগে, সম্পর্কের আগে পরীক্ষা নিয়ে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখতো। পরীক্ষার হলে বসে আছে কিন্তু কিচ্ছু পারছে না! সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে তার খাতা শূন্য! পরক্ষণেই ঘুম ভাঙতো আর হাঁপ ছেড়ে বাঁচতো। মনে হতো কী বাঁচাটাই না বেঁচে গেছে!

    এরপর ফাদার যখন অসুস্থ হলো তাকে নিয়েও অনেক বার এরকম স্বপ্ন দেখেছে—ফাদার মারা গেছে। বুক ফেঁটে কান্না আসছে তার কিন্তু চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না! ঘুম ভাঙতেই পাশের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ফাদারকে দেখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি পেতো।

    এরপর ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক মিলন যখন রেবাকে হত্যা করার চেষ্টা করলো, অল্পের জন্য বেঁচে গেল মেয়েটা, সেই ঘটনার পর মাঝেমধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখতো-রেবাকে কেউ মেরে ফেলেছে, তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেফরি! ঘুম ভাঙতেই অদ্ভুত রকমের নিষ্কৃতি পেতো-বাস্তবে এরকম কিছু ঘটেনি!

    কিন্তু আজকে সে জেগে আছে। কোনো দুঃস্বপ্নের ভেতরে বসবাস করছে না বরং দুঃস্বপ্ন তার চারপাশ ঘিরে আছে এখন। যতো বারই চোখ খুলে দেখুক, দুঃস্বপ্নটা তিরোহিত হয়ে যাবে না। এটা তার বাকি জীবনে চিরস্থায়ীভাবে গেঁড়ে বসেছে। এসবকিছু থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে জেফরি বেগের। কিন্তু বাস্তব থেকে পালানো যায় না, নিজেকে ফাঁকি দেয়া যায় কেবল।

    ফাদার তাকে এমন শিক্ষা দেননি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলো মোকাবেলা করার কথা বলতেন। সাবধান করে বলতেন, পালিয়ে গেলে কঠিন সময় শুধু দীর্ঘই হয় না, ভেঙেচূড়ে ধ্বংসও করে ফেলতে পারে।

    ঠিক কতোক্ষণ পর সে জানে না, কাঁধে একটা উষ্ণ হাতের স্পর্শ টের পেলো। চোখ না খুলেই বুঝতে পারলো জামান চলে এসেছে। আস্তে করে ছেলেটার হাত ধরলো জেফরি বেগ। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না। বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে গুমোট হয়ে যাচ্ছে, ভারাক্রান্ত করে তুলছে তাকে।

    অধ্যায় ৪১

    মৃত্যুর দু দিন পর রেবার দাফন হলো।

    সত্যি বলতে এই দু দিন একটা ঘোরের মধ্যেই কেটে গেল জেফরি বেগের। গুমোট আর স্তব্ধ শোকে নিপতিত হয়ে ঘর থেকেও বের হয়নি সে। জামান এসে তিন বেলা দেখা করে গেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে খাবার-দাবার। সেই খাবারের খুব কমই মুখে দিয়েছে। দু দিনের না কামানো দাড়ি আর রাত জাগার কারণে দ্রুতই চেহারায় সেটার ছাপ পড়ে গেছে।

    আজকেও জামান এসেছে খাবার নিয়ে, এখন কিচেনে কফি বানাচ্ছে তার জন্য।

    রেবার বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় বসবাস করছে, তার জন্যই দুটো দিন পর দাফন করা হয়েছে। গতকাল ছোটো বোনের জানাযা-দাফনে অংশ নিতে দেশে এসেছে সে। এই লোকের সঙ্গে জেফরির কখনও দেখা হয়নি, ফোনেও কথা হয়নি। রেবা খুব কমই তার বড় ভাইয়ের কথা বলতো। তাদের পরিবারে ভাইকে নিয়ে চাপা ক্ষোভ ছিল।

    সচিব থাকা অবস্থায় পড়াশোনার জন্য নিজের ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন আনজার হোসেন, ছেলে সেখানে গিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভালো দেখে একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়, তারপর তাদেরকে না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে। এ ঘটনায় রেবার বাবা এতটাই রেগে গেছিলেন যে, তিন-চার বছর ছেলের সঙ্গে কথা বলেননি। পরে যখন শুনলেন ফুটফুটে সুন্দর একটা নাতনী হয়েছে, তখন তার রাগ পড়ে যায়।

    জেফরি বেগ জানাযায় না গেলেও হোমিসাইড থেকে ফারুক আহমেদ, রমিজ লস্কর আর জামান উপস্থিত ছিল। দাফন শেষে রেবার বড় ভাই জামানকে বলেছে, তার বোন ঐদিন আসলে একটা সুসংবাদ দিতে যাচ্ছিল জেফরিকে। ক-দিন ধরে মৃত্যুশয্যায় থাকা তার বাপ বলছিল একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেখে যাবে, আর সেটা জেফরির সঙ্গেই! তাদের মা খবরটা তাকে ফোনে জানিয়েছিল। বড় ভাই হিসেবে খুবই খুশি হয়েছিল সে। পারিবারিকভাবে অল্প কিছু মানুষের উপস্থিতিতে বিয়েটা সেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। রেবা সম্ভবত চেয়েছিল এই খবরটা সামনাসামনি দিতে, সেজন্যে ফোনে কিছু বলেনি।

    কথাটা শোনার পর জেফরির চোখদুটো ছল ছল করে উঠেছিল। রেবা কেন ফুলের দোকানে থেমেছিল, বুঝতে পারলো। মেয়েটা কতো খুশি ছিল! নতুন জীবনের স্বপ্ন দুচোখে মেখে ছুটে যাচ্ছিল তার দীর্ঘদিনের ভালোবাসার মানুষটির কাছে।

    রেবার মৃত্যু নিয়ে তার মনের কোণে জমা হওয়া সন্দেহের কথাটা জামানকে জানিয়েছে সে। আলভীকে চড় মারার পর তাকে খুন করতে চেয়েছিল, হুমকিও দিয়েছিল। এরপরই রেবার দুর্ঘটনা ঘটলো। এটা তো কাকতালীয় হতে পারে না!

    জামান কিচেন থেকে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এলো এ সময়। নিজের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো জেফরি বেগ।

    “খবরটা শোনার পরই আমার এটা মনে হয়েছিল, স্যার,” জামান সোফায় বসলো তার কফির কাপটা নিয়ে। “সেজন্যেই আমি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখেছি। ঐ পিকআপ ভ্যানটা পুলিশ আটক করতে পারেনি। ফুলের দোকানের কর্মচারির সঙ্গে কথা বলেছি, ও আমাকে বলেছে গাড়িটা আগে থেকেই ওর দোকান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল।”

    ভুরু কুঁচকে গেল জেফরির। যেমনটা আশঙ্কা করেছিল, ঘটনা আসলেই তেমন! “সিসিক্যাম ফুটেজ জোগাড় করার চেষ্টা করোনি?”

    “আজকেই করেছি, স্যার… গাড়িটার নাম্বারপ্লেট ফেইক।”

    নড়ে চড়ে উঠল হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। তার মনে যে সন্দেহটা ছিল এক নিমেষে সত্য হয়ে উদ্ভাসিত হলো এখন। এ নিয়ে আর কোনো সংশয় তার মধ্যে রইলো না। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। “আমি আগেই জানতাম এটা আলভীর কাজ!”

    জামান কফিতে চুমুক দিলো। “গতকালও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু এখন আমিও নিশ্চিত, স্যার।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। তীব্র যন্ত্রণার পর ক্রোধ আর ক্ষোভ জমতে শুরু করলো তার ভেতরে। এখনও শোকে মূহ্যমান, সেই শোকের মধ্যেও তার ভেতরে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। “আমার জন্যই রেবা মারা গেছে! আমার কারণেই ওকে…” বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো তার কণ্ঠ।

    “স্যার, এভাবে ভাববেন না, প্লিজ,” সহকারি তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেলো।

    “এভাবে না ভেবে উপায় নেই, জামান।” একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের ভেতর থেকে। “এটাই হয়েছে, এটাই সত্যি! এই সত্যকে তুমি কী করে ভুলে থাকবে? দিনের আলোর মতো পরিস্কার সবকিছু,” শেষ কথাটা বলার পর উদাস হয়ে গেল।

    চুপচাপ কফিতে চুমুক দিয়ে গেল সহকারি। এ নিয়ে তার মধ্যেও দ্বিমত নেই।

    “আমাকে বাদ দিয়ে ওকে বেছে নিয়েছে…বুঝতে পারছো, কেন?”

    সায় দিলো জামান। “আপনি তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত করছেন, আপনার কিছু করলে সবাই বুঝে যেতো এটা ওরই কাজ।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো জেফরি। কিন্তু তার মনে হয় না জাহান গ্রুপের লোকজন এসব তোয়াক্কা করে। আইন যাদের পকেটে তারা কেন এসব নিয়ে পড়ে থাকবে! নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কারণ আছে।

    “দিলান মামুদ আমাকে ফোন দিয়েছিল, স্যার। আপনার খবর নেবার জন্য… বলল, দুয়েক দিন পর কল দেবে।”

    অন্যমনস্কভাবে তাকালো সহকারির দিকে

    “উনি জানালেন ম্যাডামের ফ্যামিলি কোনো মামলা করেনি এখনও।

    পুলিশ অবশ্য রেগুলার একটা মামলা করেছে…যেমনটা করে সব সময়।”

    উদাস হয়ে কফিতে চুমুক দিতেও ভুলে গেল জেফরি বেগ।

    “আপনি কি মামলা করার কথা ভাবছেন, স্যার?”

    মাথা দোলালো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর।

    অবাক হলো তার সহকারি, কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

    “আমি কিভাবে মামলা করবো? আইনের চেখে তো আমি ওর কেউ না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো ভেতর থেকে। “ধরো মামলা করলাম… কী হবে? কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। ওদের কিচ্ছু করা যাবে না।”

    জামানের কাছে মনে হলো না জেফরি ঐসব হতাশ আর অসহায় নাগরিকের মতো, যারা আজকাল কাছের মানুষজন অপঘাতে মারা যাবার পরও রাষ্ট্রের কাছে বিচায় চায় না।

    কিন্তু যে মানুষটি তার সামনে বসে আছে তাকে প্রায় দীর্ঘদিন থেকে চেনে, তার মনোভাব সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখে, সেজন্যেই মেলাতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে মানুষটা ভেঙেচূড়ে গেছে ভেতরে ভেতরে।

    অধ্যায় ৪২

    রেবার দাফনের দু দিন পরই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে গেল আকবর হাসান। যথারীতি ক্র্যাক্ড নিউজ এটা নিয়ে রিপোর্ট করলো ছোট্ট করে। তবে যা হয়, একটা খবর পুরনো হয়ে গেলে সেটার ফলোআপ করার মতো মানুষের সংখ্যা কমে যায়। সোনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যু এবং একই রকম রহস্যজনক রেবার দুর্ঘটনা আড়ালে চলে গেল। নতুন খবর আর ঘটনা নিয়ে মেতে উঠল মানুষজন।

    তিন-চার দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও জেফরি বেগ শোক কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হতে পারলো না। ব্যাপারটা হোমিসাইডের সবাই বুঝতে পারলো, বিশেষ করে মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ। ভদ্রলোক নিজ থেকেই তার চিফ ইনভেস্টিগেটরকে এক মাসের ছুটি দিয়ে দিলো। খবরটা জামানের কাছ থেকে শুনতে পেয়ে অবাক হলো জেফরি

    “আমি তো ছুটি চাইনি!”

    “ফারুক স্যার নিজে থেকে দিয়েছেন এটা।

    তারা এখন বসে আছে জেফরি বেগের ফ্ল্যাটে। আজকেও শোকগ্রস্ত মানুষটির জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছে জামান।

    এ ক-দিনে কিছুটা ওজন হারিয়েছে হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। হালকা-পাতলা আর মেদহীন শরীরের মানুষ বলে সামান্য একটু ওজন কমাতেই রোগাটে লাগছে। ভালো ঘুম না হবার জন্য তার চোখের চারপাশে কালচে দাগ আর ক্লান্তির ছাপও পড়েছে।

    “কাল হাইকোর্ট থেকে আকবর হাসান জামিন পেলেও ডাক্তার অবশ্য জামিন পায়নি।”

    বাঁকাহাসি ফুটে উঠল জেফরির ঠোঁটে। একটা লোক পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট পাল্টে দেবার জন্য ডাক্তারকে দশ লাখ টাকার ঘুষ দেবার সময় হাতেনাতে ধরা পড়লো, অথচ সেই লোক জামিন পেলেও ডাক্তার বেচারা এখনও জেলে। জাহান গ্রুপ কার পাশে আছে বোঝাই যাচ্ছে। সেই সাথে আরো বোঝা যাচ্ছে সরকারও কার পক্ষে আছে।

    “আমি ভেবেছিলাম আমাদের কোর্ট এত সহজে জামিন দেবে না।”

    মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “তুমি ভুলে গেছো, জাহান গ্রুপের বিরুদ্ধে পুলিশ কয়েক বার মামলা করলেও এ দেশের কোনো কোর্ট সেই সব মামলার ঠিকমতো বিচার করেনি। আসামিকে জামিন দিয়ে দিয়েছে। মামলাগুলো চলে গেছে কোল্ডস্টোরেজে।”

    “তাহলে তো আমাদের আর কোনো আশা ভরসার জায়গা নেই, স্যার।”

    ভারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেফরি বেগ। আগেও যে খুব বেশি আশা ভরসার জায়গা ছিল তা নয় তবে এতটা সর্বগ্রাসী ছিল না কখনও। এখন যেন কালো থাবার মধ্যে পড়ে গেছে সবকিছু। আগে একটু রাখঢাকের চেষ্টা দেখা যেতো, এতটা খোলামেলাভাবে কাজগুলো করা হতো না।

    আরো বুঝতে পারলো, ধীরে ধীরে জাহান গ্রুপ নিজেদের শক্তিমত্তা দেখাতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে কিছুই করা যাবে না। চেয়ে চেয়ে শুধু দেখে যেতে হবে।

    এভাবে হার মেনে নেবে সে? রেবার হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিকার হবে না? ঠুটো জগন্নাথ হয়ে ঘরে বসে থাকবে?

    নিজেকে অসহায় আর অক্ষম ভাবতে ঘেন্না হলো তার।

    অধ্যায় ৪৩

    আজকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরেই থাকে অমূল্যবাবু।

    ইচ্ছে করলে কখনও রাতের শুরুতে ঢাকা ক্লাবে যায়। তবে তার ক্লাব- আসক্তিটা আগের মতো আর নেই, ফিকে হয়ে গেছে। এটা কি তার বয়সের কারণে হচ্ছে নাকি ক্লাবের নতুন মেম্বারদের গাড়লপনার জন্য নিশ্চিত হতে পারেনি।

    আগে ক্লাব থেকে এ দেশের রাজনীতির অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হতো। বড় বড় ঘটনাগুলো ক্লাবে বসেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা আছে তাদের প্রায় সবাই আসতো ওখানে। ওয়ান-ইলিভেনের সবটাই হয়েছিল ক্লাব থেকে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। সেই রামও নেই অযোধ্যাও নেই। ঢাকায় এখন নতুন দুটো ক্লাবের জন্ম হয়েছে, ক্ষমতার কেন্দ্রও বদলে গেছে অনেকটাই। সেই নতুন ক্লাবে নতুন ধরনের ক্ষমতাবানেরা জড়ো হয়, মদ আর নারীতে ভরে থাকে সন্ধ্যা-রাত। সবই চলে খোলামেলাভাবে। কোনো কৌলিন্য নেই, আছে শুধু লুটেরা বেদুইনদের মতো ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঘোট পাকানোর ব্যস্ততা।

    বিকেলের অলস সময়টা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে কাটিয়ে দিতে ভালো লাগে তার। চোখে সমস্যা হচ্ছে বলে ইদানিং পত্রিকা পড়াটাও কমিয়ে দিয়েছে। কোনো কিছু পড়তে গেলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। তাছাড়া ঐসব শৃঙ্খলিত দাসদের কাছ থেকে মহান কোনো সত্য জানা যে সম্ভব নয় সেটাও ভালো করে বুঝে গেছে। চেপেচুপে বলা সত্যগুলো অনেক বেশি বিভ্রান্তিকর হয়ে থাকে।

    নন্দ অবশ্য তাকে অনলাইন পোর্টাল আর ইউটিউবের নিউজ চ্যানেলগুলো থেকে খবর পড়ে শোনায়। বাবু বুঝতে পারছে, যুগ পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত। কতো কিছুই না দেখলো এই জীবনে। ছোটোবেলায় টেলিগ্রাফ-টেলিগ্রামই ছিল তাদের কাছে বিস্ময়। টেলিফোন ছিল সোনার হরিণ। আর এখন, মুহূর্তে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করা যায়।

    হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে মনোযোগ বিঘ্নিত হলো অমূল্যবাবুর। এই অসময়ে কে এলো? এই বাড়িতে সচরাচর কেউ আসে না। সাভার থেকে নন্দর বাবা আসে মাঝেমধ্যে, ছেলেকে দেখে যায়, পড়াশোনার খোঁজ-খবর নেয়, ভালোমন্দ খাবার নিয়ে আসে। কিন্তু দু দিন আগেই সে এসেছিল, আর

    যখন আসে তার আগে ফোন করে জানায়।

    ভেতরের ঘর থেকে বের হয়ে এলো নন্দ। মেইন দরজাটা বেশ পুরনো, কাঠের তৈরি, তাতে কোনো পিপহোল না থাকলেও অসংখ্য ফাঁকফোকর আছে। ছেলেটা সেইসব ছিদ্রে চোখ রাখতেই অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকালো।

    “কী হয়েছে?”

    অমূল্যবাবুর কাছে চলে এলো নন্দ, ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “কাকা, ঐ পুলিশটা আবার আসছে!”

    “কোন পুলিশ?” ভুরু কুঁচকে গেল বাবুর।

    “ওই যে, দাদারে খুঁজতে আসছিল না…তারপর আপনারে তুইল্যা নিয়া গেল?”

    ভীষণ অবাক হলো অমূল্যবাবু। জেফরি বেগ?! “দরজা খোল, ভেতরে আসতে দে।”

    ছেলেটা তারপরও চেয়ে রইলো।

    “সমস্যা নাই,” আশ্বস্ত করলো তাকে।

    নন্দ একান্ত অনিচ্ছায় দরজা খুলে দিতেই অমূল্যবাবু দেখতে পেলো বিধ্বস্ত এক জেফরি বেগকে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার চুলগুলো এলোমেলো, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কাছে এসে নিঃশব্দে সালাম দিলো সে।

    স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বাবু।

    “জানি অবাক হচ্ছেন আমাকে দেখে,” কেমন হতাশ কণ্ঠে বলল। “বসতে পারি?”

    “বসুন।”

    তার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো জেফরি বেগ।

    “আমি একটা কাজে এসেছি, বাবু।”

    “বলুন?”

    কিন্তু চুপ মেরে রইলো জেফরি, কথাটা কিভাবে বলবে ভেবে পেলো না। বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে নন্দ। তার দিকে তাকালো বাবু। “দুই কাপ চা দিস তো… চিনি ছাড়া।”

    জেফরি বেগ অবাক হলো কথাটা শুনে। সে যে চিনি ছাড়া চা খায় এটা বাবু কিভাবে জানলো? কখনও কি তাকে এটা বলেছিল?

    “আপনার খবরটা আমি শুনেছি,” আস্তে করে বলল বাবু। “আপনার মানসিক অবস্থা কেমন বুঝতে পারছি।”

    রেবার খবরটা মেইনস্ট্রিমের খুব বেশি পত্রিকায় আসেনি, এলেও ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে এসেছে। মাত্র একটা টিভি চ্যানেলে দায়সারাগোছের রিপোর্ট দেখানো হয়েছে। বাবুর মতো লোকজনের এসব দেখার কথা নয়।

    “ঐ যে ছেলেটা, ও বলেছে,” ছোট্ট করে বলল বাবু। সত্যি বলতে নন্দই তাকে জানিয়েছিল হোমিসাইডের যে ইনভেস্টিগেটর এসেছিল এই বাড়িতে, তার বাগদত্তা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে। বাবু অবাক হয়েছিল কথাটা শুনে। নন্দ কী করে জানলো জেফরি বেগের বাগদত্তা আছে? ছেলেটা তখন বলেছিল, একটা পত্রিকায় পড়েছে সে।

    বিগত কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকা কিছুই দেখেনি। এমনকি মোবাইলফোনটা পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে। সে চায়নি তার পরিচিতজনেরা ফোন করে সান্ত্বনা দিক। শোকের মধ্যে এটা আরো বেশি শোচনীয় লাগে তার কাছে।

    “আমার জন্যই মেয়েটা মারা গেছে,” বিমর্ষ মুখে বলল হোমিসাইডের জেফরি বেগ। “ওদের একজন আমাকে সতর্ক করেছিল কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। রেবার কথা আমার মাথায়-ই ছিল না!”

    চুপচাপ শুনে গেল অমূল্যবাবু।

    “আমি শুধু আমার কথা-ই মাথায় রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম যা হবার আমার সাথেই হবে।”

    “আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি,” আস্তে করে বলল বাবু। “প্রিয়জন হারানোর কষ্ট কোনো সান্ত্বনায় কমে না। আমিও আপনাকে সান্ত্বনা দেবো না।”

    মাথা নিচু করে রইলো জেফরি বেগ।

    “তবে আপনাকে আড়াই হাজার বছর আগের একটা গল্প বলতে পারি।”

    মুখ তুলে তাকালো সদ্য প্রিয়জন হারানো মানুষটি।

    “আপনার মতোই খুব কাছের একজনকে হারিয়ে এক লোক প্রায় পাগল হয়ে গেছিল, কোনোভাবেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। নিকটজনেরা তাকে বুদ্ধের কাছে নিয়ে গেল, তিনি যেন এই শোকাতুর মানুষটির কষ্ট কিছুটা লাঘব করে দেন।” কয়েক মূহূর্ত চুপ থেকে আবার বলল বাবু, “বুদ্ধ বললেন আমি আপনার শোক লাঘব করতে পারবো তবে একটা শর্তে…এই নগরীর এমন একটি গৃহ থেকে ভিক্ষার চাল এনে দিতে হবে যাদের কোনো নিকটজন মারা যায়নি।”

    জেফরি বেগের কপালে ভাঁজ পড়লো।

    “লোকটা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরীর শত শত দরজায় গিয়েও এমন কোনো পরিবার খুঁজে পেলো না যাদের নিকটজন মারা যায়নি। সে এমনও বাড়িতে গিয়েছিল যেখানে পরিবারের একজন বাদে সবাই মারা গেছে। দিনভর এত স্বজন হারানোর কথা শুনে, মৃত্যুর কথা জানতে পেরে তার শোক অনেকটাই কমে এলো। বুদ্ধের কাছে এসে বলল, তার শোক এখন অনেকটাই কমে গেছে। জগতে তার চেয়েও বেশি স্বজন হারানো মানুষ আছে। প্রসন্নভাবে হেসে বুদ্ধ বললেন, তার আর কিছু বলার নেই।” কথাটা শেষ করে চুপ মেরে রইলো অমূল্যবাবু। এত কথা সে সারাদিনেও বলে না, যতোটা পারে মৌনব্রত পালন করে কিন্তু আজ বলতে হলো সামনে বসে থাকা এই শোকগ্রস্ত মানুষটির জন্য।

    এমন সময় ট্রে হাতে নন্দ চলে এলো, বারান্দার কফি টেবিলের উপরে দু কাপ চা রেখে গেল সে।

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো জেফরি বেগ। কাল রাতে তার মনে পড়ে গেছিল একটা কথা। ফাদার হোবার্টের অনেক বন্ধুবান্ধব একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল নিয়মিত আসতো ফাদারের সঙ্গে আড্ডা মারতে, এরকমই একজন ছিল শুভেন্দু। ছোটোবেলা থেকেই সে শুনেছে, শুভেন্দু কাকা খুবই নরম মনের মানুষ ছিলেন, জীবনে কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলেননি। এই মানুষটা যুদ্ধে গেছিলেন স্রেফ একটা কারণে-তার মা-বাবাসহ পরিবারের বেশিরভাগই নিহত হয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে। জননী-জন্মদাতাসহ পরিবারের সবার হত্যার প্রতিশোধ নিতেই যুদ্ধে যোগ দেন।

    বড় হওয়ার পর জেফরি বেগ বুঝতে পেরেছিল, এটা নিছক প্রতিশোধ ছিল না, এটা ছিল প্রতিবাদ! প্রতিকার! অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়, অত্যাচারের প্রতিকার করতে হয়-শুভেন্দু কাকা সেটাই করেছিলেন, নিজের জীবনের মায়া করেননি তিনি। যুদ্ধে না গিয়ে, পালিয়ে গিয়ে হয়তো বেঁচে থাকতে পারতেন কিন্তু সে পথে যাননি। জেফরিও সে পথে যাবে না। প্রতিকার করবে সে।

    যেভাবেই হোক!

    “গল্পটা যদি এমন হতো…” বলল সে। “বুদ্ধের কাছে এমন একজন গেল যার প্রিয় মানুষটিকে কেবলমাত্র তার কারণে কেউ হত্যা করেছে, তাহলে বুদ্ধ কী করতে বলতেন?”

    অমূল্যবাবু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের লোকটার দিকে।

    “তখনও কি দ্বারে দ্বারে গিয়ে ওভাবে ভিক্ষা আনতে পাঠাতেন?”

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো মৌনব্রত পালনকারী লোকটি। “আপনি মনে হয় আমাকে কিছু বলতে এসেছেন?” নিজের কাপটা তুলে নিলো হাতে।

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল জেফরি, “বাবলুর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি।”

    অমূল্যবাবু নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত, তারপরও কথাটা শুনে একটু অবাক হলো।

    “আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, ওকে ধরার জন্য আসিনি।

    আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাবু, শান্ত কণ্ঠে বলল, “ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ নাই।”

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। তার সামনে যে লোক বসে আছে তার সঙ্গে বাবলুর কেমন সম্পর্ক ভালো করেই জানে।

    “কোথায় আছে জানি না।”

    মাথা দোলালো জেফরি বেগ, বিস্ময়ের চেয়ে হতাশাই বেশি তার চোখেমুখে।

    “বাসায় যান,” আস্তে করে বলল অমূল্যবাবু। “যদি বাবলুর সঙ্গে দেখা হয় আমি ওকে বলবো আপনার কথা।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর উঠে দাঁড়ালো জেফরি। এই কম কথা বলা মানুষটাকে সে ভালো করেই চেনে, একবার যেহেতু বলেছে যোগাযোগ নেই, ভুলেও অন্য কিছু বলবে না। এই লোকের নার্ভ লোহার মতোই শক্ত, তাকে টলানো যাবে না। আর কোনো কথা না বলে বিমর্ষ মুখে চলে গেল সদর দরজাটা খুলে।

    সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমূল্যবাবু। শাহজাহান করিমকে ভালো করেই চেনে সে। আস্ত একটা পিশাচ। এরশাদের সামরিক সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক ছিল, সেই সময়েই সামান্য কাগজ ব্যবসায়ি থেকে রাতারাতি শিল্পপতি আর ভূমিদস্যু বনে যায়। এই লোকের অনেক কাহিনিই জানা আছে তার। ঢাকার পূর্বপ্রান্তে নিচু জমি আর জলাশয়গুলো রীতিমতো গায়ের জোরে, ঠকিয়ে ঠাকিয়ে লোকজনের বাপ-দাদার ভিটেগুলো দখল করেছে। এমনও কাহিনি আছে, জমি দেয়নি বলে জীবন দিতে হয়েছে। ধূর্ত শাহজাহান সবকিছুই ম্যানেজ করে ফেলেছে। এগুলো করতে করতে এক সময় নিজেকে বাদশাহ শাহজাহান ভাবতে শুরু করেছে এই লোক।

    অধ্যায় ৪৪

    সাভারে যে বাড়িতে বাবলু এখন থাকে তার আশেপাশে প্রচুর অনাবাদি জায়গা পড়ে ছিল। নন্দর বাবা এসে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

    অনেক রকমের শাকসব্জি আর ফলমূলের চাষ করা হয়েছে সেখানে। বাস্টার্ড অবশ্য হাতে গোণা কয়েকটার বেশি নাম জানতো না। পুঁই শাক, লাউ শাক আর লাল শাকের বাইরে আর কোনো শাক চিনতো না। নন্দর বাবা তাকে অনেকগুলো শাক-সব্জি চিনিয়ে দিয়েছে।

    নন্দর বাবা মূলতঃ কাজ করে একটি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানে। সম্ভবত অমূল্যবাবুর অংশিদারিত্ব আছে সেখানে। সারাদিন কাজ করার পর বিকেল হলেই লোকটা চলে আসে বাড়ির আশেপাশে শাকসব্জি আর তরিতরকারির গাছগুলোর যত্ন নিতে। প্রথম প্রথম জানালা দিয়ে কিংবা বারান্দায় বসে এসব দেখতো কিন্তু তিতাস পাড় থেকে ফিরে এসে একদিন হুট করেই নন্দর বাবার শাকসব্জি আর তরিতরকারির ছোটো ছোটো ক্ষেতগুলোতে পানি দিতে শুরু করে সে। কাজ থেকে ফিরে এসে এই দৃশ্য দেখে জিভে কামড় দিয়েছিল লোকটা-কর্তা জানলে খুব রাগ করবে।

    বাবলু তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল বাবু জানলে কিচ্ছু বলবে না। এখানে একা একা কাজকর্মহীন থাকতে তার ভালো লাগছে না, একটু শারীরিক পরিশ্রম করার দরকার আছে। নন্দর বাবার এই ছোট্ট ক্ষেতটা তার পছন্দ হয়েছে, এখন থেকে সে-ও হাত লাগাবে। চারপাশে আরো অনেক খালি জায়গা পড়ে আছে, সেগুলোকেও কাজে লাগানো উচিত।

    নন্দর বাবা খুবই সহজ-সরল মানুষ, তার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে দুই তিন দিনের মধ্যে পতিত জমিগুলোর প্রায় সবটাতেই নানা রকমের তরিতরকারি আর শাক-সব্জির চাষাবাদ শুরু করে দেয়।

    “আপনার দাদা কই, দেখছি না যে কয়দিন ধরে?” শাক-সব্জির ছোট্ট ক্ষেতে পাইপ দিয়ে পানি দিতে দিতে জানতে চাইলো বাবলু। সুনীল নামের যে জ্ঞাতি ভাই এসেছিল তাকে কয়দিন ধরে দেখছে না।

    শিশুর মতো সারল্যভরা হাসি দিলো নন্দর বাবা। “ওয় তো গেরামে ফিরা গেছে, দাদা। কারা জানি সেলিম্‌রে মাইরা ফালাইছে…পুরা তিতাস পাড় এখন ঠাণ্ডা। সবাই ফিরা গেছে যার যার ভিটায়।”

    “ওহ।”

    মাটিতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে ফলন কেমন তা পরখ করতে করতে বলল নন্দর বাবা, “মাইনষে কয় হের অ্যাগেইন্‌স্ট পাট্টি মাইরা ফালাইছে। আবার কেউ কেউ কয় হের নিজের লোকই নাকি মারছে। ভগবানই জানে কুনটা সইত্য।”

    বাবলু চুপচাপ পানি দিতে লাগলো আবার। ছোট্ট একটা কাজ করেছে সে, তাতেই অনেকগুলো মানুষ আর তাদের পরিবার ফিরে পেয়েছে স্বাভাবিক জীবন। অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হচ্ছে তার

    “এই মিষ্টি কুমড়াগুলান কিন্তু খাওন যাইবো গ্রহন,” নন্দর বাবা পরখ করতে করতে বলল। “কাইল নন্দর মায়রে কমু রান্না করতে…. ক্ষেতের জিনিসের স্বোয়াদই আলাদা।”

    মুচকি হাসলো বাবলু।

    “কী দিয়া রানতে কমু, দাদা?”

    একটু ভাবলো বাস্টার্ড। ছোটোবেলায় পেয়ারির মা গরুর মাংস দিয়ে মিষ্টি কুমড়া রান্না করতো, খুব মজা করে খেতো সেটা। “গরুর মাংস দিয়ে করতে বলবেন।”

    নন্দর বাবা অবাক হলো কথাটা শুনে, তারপর কাচুমাচু খেয়ে বলল, “আপনের বৌদি তো গরুর মাংস রান্না করতে পারে না, কখনও করে নাই।”

    “ওহ্।” পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল এদের কাছে সে পার্থিব রায় চৌধুরি-অমূল্যবাবুর সন্তান, সনাতন ধর্মের মানুষ, গরুর মাংসের কথা বলা উচিত হয়নি। “উনাকে বলবেন যেটা দিয়ে ভালো হয় সেটা দিয়েই রান্না করতে।”

    “আইচ্ছা।” নন্দর বাবাকে একটু খুশি দেখালো।

    লোকটার দিকে চকিতে তাকালো বাবলু। “ঢাকায় আমার মুসলিম বন্ধুদের বাসায় অনেক খেতাম, বুঝলেন?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটা। “বুঝছি, দাদা।”

    “আপনি আবার নন্দকে এসব বলবেন না, ও বাবুকে বলে দিতে পারে, কথাটা বলেই হেসে ফেলল।

    “কাউরে বলুম না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকবার পারেন।”

    আবারো পানি দিতে যাবে অমনি টের পেলো ফোনটা ভাইব্রেট করছে। পাইপটা নন্দর বাবার হাতে দিয়ে পকেট থেকে সেটা বের করে দেখলো-অমূল্যবাবু! একটু অবাকই হলো সে। সাধারণত তাকে খুব কমই ফোন করে এই লোক। কপালে ভাঁজ পড়লো তার। কলটা রিসিভ করলো।

    “বাইরে নাকি?” ওপাশ থেকে ধীরস্থির কণ্ঠটা জানতে চাইলো।

    “না, বাড়ির সামনে।”

    “কথাটা তোমাকে জানানো দরকার…জেফরি বেগ এসেছিল আমার কাছে।”

    ভুরু কুঁচকে গেল বাস্টার্ডের। “কেন?”

    “তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”

    যারপর নাই বিস্মিত হলো সে। “আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়?!”

    “হ্যাঁ। মনে হয় তোমাকে কন্ট্রাক্ট করতে চাইছে।”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবর্ন আইডেন্টিটি – রবার্ট লুডলাম
    Next Article অগোচরা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }