Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কন্যা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প155 Mins Read0

    ০১. অন্বেষণের পূর্বাহ্ণ

    ১৯২৪ সালের গ্রীষ্মকালটা যাঁরা পুরীতে কাটিয়েছিলেন তাঁদের কারও কারও হয়তো মনে আছে, লাটসাহেবের বাড়ির কাছে বালুর উপর একটা নৌকোর ছায়ায় একসঙ্গে বসে থাকতে বা হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতে প্রায়ই দেখা যেত চারজন তরুণকে। কী সকাল কী সন্ধ্যা কী দিন কী রাত।

    ওই যার পরনে পট্টবস্ত্র আর ফিনফিনে রেশমি পিরান তার নাম কান্তি। গৌরবরণ সুপুরুষ। মাথায় বাবরি চুল, সুঠাম সুমিত গড়ন, প্রাণের চাঞ্চল্য প্রতি অঙ্গে। চলে যখন, চরণপাতের ছন্দে নাচের লহর ওঠে। ও যেন রূপকথার রাজপুত্র। হাতে চাঁদ কপালে সূয্যি।

    আর ওই যার পোশাক সাদা জিনের ট্রাউজার্স, সাদা টেনিস শার্ট, অথচ গায়ের রং শামলা তার নাম তন্ময়। তন্ময়কে বোধ হয় সুপুরুষ বলতে বাধে, কিন্তু পুরুষোচিত চেহারা বটে ওই ছ-ফুট লম্বা চল্লিশ ইঞ্চি ছাতি নওজোয়ানের। তন্ময় না-হয়ে বিনোদ যদি হত তার নাম তা হলেই মানাত। একটা বিনোদ-বিনোদ ভাব ছিল তার চোখে-মুখে চালচলনে। কান্তিকে রাজপুত্র বললে তন্ময়কে বলতে হয় কোটালপুত্র।

    ন-হাত খদ্দরের ধুতি খদ্দরের ফতুয়া যার গায়ে তার নাম অনুত্তম। দিন নেই রাত নেই সবসময় একজোড়া নীল চশমা তার চোখে। ইস্পাতের মতো কঠিন উজ্জ্বল ধারালো তার মুখ। পদক্ষেপে দৃঢ়তা। কাঁধ থেকে পৈতের মতো ঝোলানো থাকে একটা খদ্দরের ঝোলা। তাতে তকলি পাঁজ ও লাটাই। যখন খেয়াল হয় সুতো কাটে। বলা যাক মন্ত্রীপুত্র।

    আর একজনের হাতে কালো ছাতা। বেলা পড়ে গেছে, মাথায় রোদ লাগছে না, সুজন তবু ছাতাবন্ধ করবে না। যেন ওটা ছাতা নয়, ঘোমটা বা বোরখা। মানুষটি মুখচোরা, লাজুক। নয়ানসুকের পাঞ্জাবি ও মিহি শান্তিপুরী ধুতি পরে। গোলগাল নরম নধর নন্দদুলালকে সওদাগরপুত্র বলব না তো বলব কাকে! অবশ্য রূপকথার সওদাগরপুত্র। সত্যিকারের নয়।

    বি এ পরীক্ষা দিয়ে চার বন্ধু এসেছিল হাওয়াবদল করতে। হাওয়াবদলটা উপলক্ষ্য। আসলে ওরা এসেছিল ওদের জীবনের একটা চৌমাথায়। কয়েকটা মাস একসঙ্গে কাটিয়ে চারজন চার দিকে যাত্রা করবে। কান্তি বেরিয়ে পড়বে নাচ শিখতে, মণিপুরী দক্ষিণী গুজরাতী উত্তরভারতী। নাচের দলে যোগ দিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরবে। নিজের দল গড়বে। তন্ময় তো বিলেতফেরতা ক-ভাইয়ের ন-ভাই। বিলেত না গেলে তার জাত যাবে। অক্সফোর্ডে তার জন্যে জায়গা পাওয়া গেছে। জাহাজেও। টেনিস ব্লু হতে তার শখ। জীবিকার পক্ষে ওর উপযোগিতা নেই বলে কষ্ট করে পড়াশোনাও করতে হবে। অনুত্তম ফিরে যাবে জেলে। গান্ধীজি সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। খুব সম্ভব তিনি কর্মীদের ডাক দেবেন গণ-সত্যাগ্রহের জন্যে প্রস্তুত হতে। অনুত্তম আবার পড়া বন্ধ করবে অনির্দিষ্টকাল। দেশ স্বাধীন না-হওয়া পর্যন্ত সেও স্বাধীন নয়। জীবিকার জন্যে তৈরি হবার স্বাধীনতা তার নেই। সুজন ফিরে যাবে কলকাতা। এম এ পড়বে। তার পরে হবে সম্পাদক ও সাহিত্যিক। তার ধারণা সংসার চালানোর পক্ষে ওই যথেষ্ট। নিজের লেখনীর ’পর অসীম বিশ্বাস। কলম নাকি তলোয়ারের চেয়ে জোরালো।

    বিদায়ের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল ততই তাদের চার জনের মন কেমন করছিল চার জন্যের জন্যে। ততই যেন তারা পরস্পরকে কাছে টানছিল চার জোড়া হাত দিয়ে চার গুণ করে। কেউ কাউকে ছেড়ে একদন্ড থাকবে না, একজন অনুপস্থিত হলে বাকি তিন জন অস্থির হয়ে ছুটবে তার সন্ধানে। তন্ময় উঠেছে এক ইউরোপীয় হোটেলে। কান্তি তার মাসিমার বাড়ি। অনুত্তম ও সুজন ধর্মশালায়। বলাবাহুল্য তাদের দু-জনের অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। সুজন পড়ে স্কলারশিপের টাকায়। আর অনুত্তম চালায় ছেলে পড়িয়ে। একসঙ্গে থাকতে পারে না বলে তাদের চার জনের মনে খেদ আছে। ধর্মশালাতেই চারজন উঠত, কিন্তু তন্ময়রা ব্রাহ্ম, আর কান্তির মাসির বাড়ি থাকতে সে কী করে ধর্মশালায় ওঠে! সম্ভব হলে সে-ই বরং তার মাসির ওখানে সদলবলে উঠত। কিন্তু হপ্তার পর হপ্তা মাসের পর মাস দলবল নিয়ে থাকলে মাসির উপর উৎপাত করা হয়। এক ধর্মশালা থেকে আর এক ধর্মশালায় বদলি হতে হতে চললে তিন-চার মাস কাউকে কষ্ট না দিয়ে দিব্যি কাটানো যায়। অনুত্তম জেল খাটিয়ে মানুষ। নিজে কষ্ট পেতে জানে ও চায়। ওটা তার প্রস্তুতির অঙ্গ। কিন্তু সুজনের হয়েছে মুশকিল। সে একটু যত্ন-আত্তি ভালোবাসে। একটি মাসি কি পিসি কি দিদি পেলে সে বর্তে যায়। অথচ এমন মুখচোরা যে যাঁদের সঙ্গে তার পরিচয় তাঁদের কাউকে মুখ ফুটে একবার মাসিমা কি দিদি বলে ডাকবে না।

    আর কান্তি? কান্তি ঠিক তার বিপরীত? ওই যে মাসিমা উনি কি তার আপন মাসিমা নাকি? আরে না। পাতানো মাসিমা। কবে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এই পুরীতেই। তারপর যতবার পুরী এসেছে প্রত্যেক বার তাঁর ওখানে উঠেছে, তিনিও তাকে অন্যত্র উঠতে দেননি। হোটেলের খাওয়া তার মুখে রোচে না। ধর্মশালায় থেকে মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে বেশ একরকম তৃপ্তি পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে রোজ নতুন লোক আসছে রোজ নতুন লোক যাচ্ছে সেখানে বেশি দিন থাকতে মন লাগে না, মন চায় ওদের সঙ্গে পালাতে। কিংবা ওদের সঙ্গ এড়াতে। কান্তি সেইজন্যে মাসিমা-পিসিমার খোঁজে থাকে। পেয়েও যায়। তার আলাপ করার পদ্ধতি হল এই। হঠাৎ দেখতে পেল মন্দিরের পথ দিয়ে কে একজন মহিলা যাচ্ছেন। সঙ্গে একটি ছোটো ছেলে কি মেয়ে। পায়ের ধুলো নিয়ে বলল, ‘এই যে মাসিমা। কবে এলেন? আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি কান্তি।’ আশ্চয্যি! দশটা ঢিল ছুঁড়লে একটা লেগে যায়। মহিলাটিও বলে ওঠেন, ‘অ! কান্তি! কবে এলি?’ দেখতে দেখতে আলাপ জমে ওঠে। আত্মীয়তা হয়ে যায়।

    জীবনের একটা চৌমাথায় এসে পৌঁছেছে তারা চার বন্ধু। যেমন পৌঁছেছিল রূপকথার রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সওদাগরপুত্র, কোটালপুত্র। তেপান্তরের মাঠের সীমায় চার দিকে চার পথ। চার পথে চার ঘোড়া ছুটবে। আর কত দেরি? প্রত্যেকে অধীর। কেবল সুজন অধীর নয়। সে ধীর স্থির আত্মস্থ প্রকৃতির মানুষ। তার জীবনযাত্রা দু-দিন পরে বদলে যাচ্ছে না, বদলে যাক এটাও সে চায় না। চলতে চলতে যেটুকু বদলাবে সেটুকুর জন্যে সে প্রস্তুত। কিন্তু তার জন্যে তাকে কলকাতা ছাড়তে হবে না। এমনকী তাকে তার ট্যামার লেনের বাসা ছাড়তে হবে না। তার পথ কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসিকপত্রের অফিসে। সেই পথে ছুটবে তার ঘোড়া। ছুটবে, কিন্তু কদম চালে নয়, দুলকি চালে।

    চার ঘোড়া চার দিকে ছুটবে, দিগবলয়ে মিলিয়ে যাবে তাদের ছায়া। কেউ কি কাউকে দেখতে পাবে আর এ জীবনে? একজনের সঙ্গে একজনের দেখা হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু সকলের সঙ্গে সকলের দেখা হওয়া একটা অর্ধোদয়যোগ কি চূড়ামণিযোগ-বিশেষ। হবে না তা নয়। হবে, কিন্তু কবে? হয়তো বিশ বছর বাদে। হয়তো শেষজীবনে। তখনকার সেই চৌমাথায় পৌঁছে গাছতলায় ঘোড়া বাঁধবে চার কুমার। গল্প করবে সারা রাত। কে কী হয়েছে, কে কী পেয়েছে, কে কী করেছে, তার গল্প। আবার চার জনে একসঙ্গে বাস করবে, একসঙ্গে বেড়াবে বসবে ও শোবে। সে তাদের দ্বিতীয় যৌবন। দ্বিতীয় যৌবনে উপনীত হয়ে প্রথম যৌবনের দিকে ফিরে তাকাবে তারা। কিন্তু তার আগে নয়। তার আগে ফিরে তাকাতে মানা।

    তন্ময় বলল, ‘ভাই, আবার আমরা এক জায়গায় মিলব তা আমি জানি। কিন্তু তার আগে আমাদের কৃতী হতে হবে সফল হতে হবে। জীবনটা তো হেলাফেলার জন্যে নয়। আর জীবনের সেরা সময় তো এই প্রথম যৌবন।’

    কান্তি বলল, ‘সত্যি। আবার যখন আমরা মিলব তার আগে যেন যে যার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে থাকি। তখন যেন বলতে না হয় যে পরিকল্পনায় খুঁত ছিল।’

    অনুত্তম বলল, ‘না, পরিকল্পনায় খুঁত নেই। চিন্তা করতে করতে, আলোচনা করতে করতে রাতকে দিন করে দিয়েছি, দিনকে রাত করে দিয়েছি, মাসের পর মাস। খুঁত থাকলে নিশ্চয় ধরা পড়ত। হয়তো কাজ করতে করতে ধরা পড়বে। তার জন্যে ফাঁক রাখতে হবে।’

    সুজন বলল, ‘ফাঁক রাখতে হবে না। ফাঁক আপনি রয়ে গেছে।’

    বিস্মিত হয়ে কান্তি বলল, ‘সে কী!’ তন্ময় বলল, ‘সে কী!’ অনুত্তম বলল, ‘তার মানে?’ কেবল বিস্মিত নয়, বিরক্ত। কেবল বিরক্ত নয়, ক্ষুব্ধ। যাবার বেলা পিছু ডাকলে যেমন বিশ্রী লাগে। অযাত্রা ঘটে গেল।

    সুজন বলল, ‘কী করে বোঝাব! কীসের একটা অভাববোধ করছি কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। তোরা যদি বোধ না করিস তোরা এগিয়ে যা।’

    স্তম্ভিত হল তন্ময়, কান্তি, অনুত্তম। এই যদি তার মনে ছিল এত দিন খুলে বলল না কেন সুজন? এখন ওরা করে কী। জীবনের সমস্ত পরিকল্পনা কি ঢেলে সাজাতে হবে? তার সময় কোথায়!

    সুজনকে যদি বিশ্বাস করতে না পারি তবে কান্তিকে বিশ্বাস কী! তাই ভেবে তন্ময় শুধোলো কান্তিকে, ‘তুইও কি কীসের একটা অভাব বোধ করিস?’

    কান্তি এর উত্তর না দিয়ে পালটা সুধোলো তন্ময়কে, ‘তুইও কী—’

    অনুত্তম অন্যমনস্ক ছিল। ঠাওরালো তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছে। বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও।’

    বিচলিত হল তন্ময় ও কান্তি। সামলে নিয়ে তন্ময় বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়।’

    তখন কান্তি পড়ে গেল একলা। অভিভূত হয়ে বলল, ‘তা হলে তাই হবে।’

    সকলেই বুঝতে পেরেছিল এর পরে কী আসছে। এর পরে পরিকল্পনায় রদবদল। তাতে সুজনের তেমন কিছু আসে যায় না। কিন্তু বাকি তিন জনের যাত্রাভঙ্গ। ওহ! কী পাষন্ড এই সুজনটা! অভাববোধ করিস তো কর না, বাপু। বলতে যাস কেন?

    অনুত্তম ওদের মধ্যে বয়সে বড়ো। নীল চশমা চোখে থাকায় তাকে প্রবীণের মতো দেখায়। পরামর্শের জন্যে অন্যেরা তার দিকে তাকাচ্ছে দেখে সে একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ভয় আমাদের এই যে চরম মুহূর্তে আমাদের জীবনের পরিকল্পনা বুঝি ভেস্তে যায়। কিন্তু পরিকল্পনা তো আমাদের তাসের কেল্লা নয়। কত কাল ধরে আমরা জীবনের মূলসূত্রগুলো নিয়ে অবিশ্রান্ত আলোচনা করেছি। কোনোখানে এতটুকু কাঁচা রাখিনি। ভিত আমাদের পাথরের মতো পাকা। তারই উপর দাঁড়িয়েছে আমাদের পরিকল্পনা। গড়তে গেলে অদলবদল হয়েই থাকে। গড়ছি তো আমরাই। তবে এত ভাবনা কীসের?’

    তন্ময় বলল, ‘ভাবনা কীসের তা কি তুই জানিসনে? যে অভাববোধ একদিন আগেও ছিল না সে যে অনাহূত অতিথির মতো এসে উপস্থিত হয়েছে। এসে বলছে আমার জন্যে কী ব্যবস্থা করেছ দেখি। ব্যবস্থা করা কি এতই সহজ যে জীবনটা যেমনভাবে কাটাব স্থির করেছিলুম তেমনিভাবে কাটাতে পারব বলে ভরসা হয়?’

    কান্তি বলল, ‘না, ভরসা হয় না। তবে জীবনের মূলসূত্রগুলোর উপর একবার হাত বুলিয়ে যাওয়া যাক অর্গ্যানের কীবোর্ডের মতো। প্রাণের কানে ঠিক বাজে কি না পরখ করা যাক।’

    এবার ওরা তাকাল সুজনের দিকে। সুজন যেন জীবনের কীবোর্ডের উপর আঙুল বুলিয়ে বলে দিতে পারে কোন চাবিটা বাজছে, কোনটা বেসুর, কোনটা অসাড়। বন্ধুদের দশা দেখে সে দুঃখিত হয়েছিল। সে তো ইচ্ছা করে তাদের এ দশা ঘটায়নি। উদ্ধারের পন্থা যদি জানত তবে নিশ্চয় জানাত। কান্তি যা করতে বলছে তাই করে দেখা যাক। জীবনের মূলসূত্রগুলো স্থির আছে না অবোধ্য এক অভাববোধের টানে বিপর্যস্ত হয়েছে।

    সুজন তখন ধ্যান করতে বসল। চোখ মেলে।

    ধ্যানযোগে উপলব্ধি করল, করতে করতে বলতে লাগল, ‘আদি নেই, অন্ত নেই এ বিশ্বজগতের। কেউ যে কোনোদিন একে সৃষ্টি করেছে বা কোনোদিন একে ধ্বংস করবে আমাদের তা বিশ্বাস হয় না। নাস্তি থেকে এ আসেনি, নাস্তিতে ফিরে যাবে না। এর সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। নিঃসংশয় হতে পারছিনে কেবল আমাদের নিজেদের বেলা। আমরাও কি এসেছি অস্তি থেকে অস্তিতে, ফিরে যাব অস্তিতে? আমাদের ইন্টেলেক্ট বলছে, কী জানি! কিন্তু ইনটুইশন বলছে, হ্যাঁ। আমরা অস্তি থেকে অস্তিতে এসেছি, অস্তিতে রয়েছি, অস্তিতেই অস্ত যাব সন্ধ্যারবির মতো। এক্ষেত্রে আমরা ইনটুইশনের উক্তি বিশ্বাস করব। বহির্জগতের মতো অন্তর্জগৎ সত্য। বহির্জগতের নিয়মকানুন বুঝে নেবার জন্যে ইন্টেলেক্ট, আর অন্তর্জগতের তল পাবার জন্যে ইনটুইশন। অন্তর্জগতের দিকে যখন তাকাই তখন দেখতে পাই তারও আদি নেই, অন্ত নেই। যখন তাতে ডুব দিই তখন দেখি জরা নেই, মৃত্যু নেই, বিকার নেই, বিচ্ছেদ নেই, নিত্য বসন্ত, নিত্য যৌবন। বহির্জগতের সমস্ত প্রতিবাদ সত্ত্বেও অন্তর্জগতের বা অন্তর্জীবনের আদি নেই, ব্যাধি নেই, ভয় নেই, উদ্বেগ নেই, কিছুই সেখানে হারায় না, ফুরোয় না, পালায় না, ঝরে না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দেখি অমৃতময় দেবতা। দর্শন করি তাঁর মহিমা। দীনের মধ্যে দেখি লক্ষ্মীশ্রী, হীনের মধ্যে নারায়ণ। পীড়িতের মধ্যে, আর্তের মধ্যে শান্তম শিবম। বিপন্নের মধ্যে দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। সবাইকে আমরা শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। সেই আমাদের দেবপূজা। আমাদের পূজা আমাদেরই কাছে ফিরে আসে। আমরাও পূজা পাই। হাঁ, আমরাও দেবতা। আমাদের কীসের অভাব! আমরা কি—’

    ‘এই বার ধরা পড়ে গেছে সুজন।’ কান্তি বলল স্মিত হেসে। ‘কে যেন বলছিল কীসের একটা অভাববোধ করছে! সুজন নয় তো!’

    তন্ময় হো-হো করে হেসে উঠল। ‘মূলসূত্র শিকেয় তোলা থাক। এখন বল, তোর কীসের অভাব। এই, সুজন।’

    ‘ডুবে ডুবে জল খেতে কবে শিখলি রে!’ বলল অনুত্তম। ‘তোর কীসের অভাব তা আগে থেকে জানতে দিলি নে কেন!’

    মূলসূত্রের খেই ছিঁড়ে গেল। সুজন বেচারি করে কী! চুপ করে সহ্য করল হাসি মশকরা। তার দশা দেখে কান্তি বলল, ‘থাক, ওকে আর ঘাঁটিয়ে কী হবে। অভাব নেই সে-কথা ঠিক। অভাব আছে একথাও বেঠিক নয়। ইনটুইশন তো সবসময় খাটে না। ইনস্টিংক্ট যখন বলে খিদে পাচ্ছে তখন খিদেটাই সত্য। সাপ দেখলে সুজনও ভয় পায়।’

    হাসির হররা উঠল। কিন্তু তাতে সুজন যোগ দিল না। লক্ষ করে নিরস্ত হল কান্তি। বলল, ‘থাক, সুজনের কথাটা হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। আমার একটা প্রস্তাব আছে। অবধান করো তো নিবেদন করি।’

    অনুত্তম বলল, ‘উত্তম!’

    ‘কাল চিঠি পেয়েছি,’ কান্তি বলল, অধ্যাপক জীবনমোহন আসছেন এখানে। তাঁর হোটেলের ঠিকানা দিয়েছেন। সকলের তিনি অধ্যাপক, আমাদের তিনি সখা, দার্শনিক ও দিশারি। তিনি এলে পরে একদিন তাঁর ওখানে গিয়ে দেখা করতে হবে, খুলে বলতে হবে, কার মনে কী আছে। যা আমাদের একজনের কাছেও স্পষ্ট নয় তা হয়তো তাঁর কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কেমন? রাজি?’

    তন্ময় বলল, ‘নিশ্চয়।’ অনুত্তম বলল, ‘আচ্ছা।’ সুজন বলল, ‘দেখি।’

    জীবনমোহন তাঁর অর্ধেক জীবন দেশ-দেশান্তরে কাটিয়ে অল্প দিন হল অধ্যাপনার কাজ নিয়েছেন। ক-দিন টিকতে পারবেন বলা যায় না। ছাত্ররা সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদের সিগারেট অফার করেন। এই নিয়ে কথা উঠলে বলেন, ‘কেন, আমিও তো ছাত্র।’ কর্তারা তাঁর অধ্যাপনায় সন্তুষ্ট, কিন্তু তাঁর বেহায়াপনায় রুষ্ট। ছাত্ররাও প্রসন্ন নয়। কারণ তিনি পলিটিকসের ধার ধারেন না, ধর্মের ধার দিয়ে যান না। অনুযোগ করলে বলেন, ‘মদ আমি খাইনে, অহিফেন ছুঁইনে।’

    বয়স চল্লিশের ওপারে। বিয়ের ফুল ফুটল না এখনও। মাথার মাঝখানে টাক। দু-দিকের কেশ কাঁচা-পাকা। জহরলালের মতো সাজপোশাক। তেমনি তরুণ দেখায়। তবে টুপিটা আরও শৌখিন। চাউনিতে এমন কিছু আছে যার থেকে মনে হয় তিনি অনেক দূরের মানুষ। কে জানে কোন সূদূর মানস সরোবরের হংস।

    জীবনমোহনের হোটেলে দেখা করতে গেল চার বন্ধু। তিনি তাদের ডেকে নিয়ে গেলেন ছাদের উপরে। সেখানে বেশ নিরিবিলি। পায়ের তলায় সাগরের ঢেউ ফেনায় ফেনায় ফেটে পড়ছে, ছুটে আসছে, লুটিয়ে যাচ্ছে। আবার পা টিপে টিপে পিছু হটছে। ঝাঁপ দেবার আগে দম নিচ্ছে। দম নেবার সময় মুখে শব্দ নেই, ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তর্জন-গর্জন, ফিরে যাবার সময় সে কী মধুর মর্মর!

    যত দূর দৃষ্টি যায় অসীম নীল। তার সঙ্গে মিশে গেছে অসীম কালো। অন্ধকার রাত। কিন্তু অন্ধকারও ফেনিয়ে উঠছে, ফেটে পড়ছে, ভেঙে যাচ্ছে মুঠো মুঠো তারায়, ফোঁটা ফোঁটা তারায়। তবে তার মুখে সোর নেই। থাকলেও শোনা যায় না, এত অস্ফুট ধ্বনি।

    জীবনমোহন হাতজোড় করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারা বলে যেতে লাগল যা বলতে এসেছিল। বলল প্রধানত কান্তি। মাঝে মাঝে তন্ময়। ক্কচিৎ অনুত্তম। একবারও না সুজন। তবে তার নীরবতাও বাঙ্খয়।

    এরপরে যখন জীবনমোহনের পালা এল তিনি ছোটোখাটো দুটো একটা প্রশ্ন করতে করতে কখন এক সময় শুরু করে দিলেন তাঁর বক্তব্য। বললেন কথাবার্তার মতো করে। সহজভাবে। বিনা আড়ম্বরে।

    বললেন, ‘বিশ্বাস করবে কি না জানিনে, তোমাদের বয়সে আমারও মনে হত কীসের যেন অভাব। সব কিছু থেকেও কী যেন নেই। কী যেন না হলে সব কিছু বিস্বাদ। পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের কোনোটাতে নেই লবণ। আমারও একজন অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যাপকের অধিক। তাঁর কাছে গেলুম উপদেশ চাইতে। তিনি বললেন, জীবনমোহন, রত্ন কারও অন্বেষণ করে না। রত্নেরই অন্বেষণ করতে হয়। যাকে হাতের কাছে পাওয়া যায় না, যা সুদূর, তোমার জীবনকে করো সেই সুদূরের অন্বেষণ। জানতে চাইলুম, কী সে নিধি? কী তার নাম? তিনি বললেন, খুঁজতে খুঁজতে আপনি জানতে পাবে।’

    সমস্ত মন দিয়ে শুনছিল তারা চার জন। জীবনমোহন আর কিছু বলবেন ভেবে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু তিনি উচ্চবাচ্য করলেন না।

    তখন তন্ময় জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি আপত্তি না থাকে তবে জানতে পারি কি স্যার, কী সে নিধি!’

    ‘না, আপত্তি কীসের?’ তিনি একটু থামলেন। একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন, ‘The Eternal Feminine.’

    চমক লাগল তাদের চার বন্ধুর। আনন্দের হিল্লোল খেলে গেল তাদের বুকে ও মুখে। দেখতে পেল না কেউ।

    স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন স্বয়ং জীবনমোহন। বললেন, ‘তোমরা হয়তো ভাবছ এটা এমন কী অসামান্য কথা, কী এমন বিশেষত্ব আছে এটার! অসামান্য এইজন্য যে এর সন্ধান রাখে এমন লোক ‘লাখে না মিলল এক’। বিশেষত্ব এইখানে যে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক দেশে এমন দু-পাঁচজন তরুণ পাওয়া গেছে যারা এ অন্বেষণ বরণ করেছে, এ অন্বেষণে বাহির হয়েছে। তারা সিদ্ধার্থ হয়েছে একথা বলতে পারলে সুখী হতুম। কিন্তু একেবারে ব্যর্থ হয়েছে একথাও বলব না। তারা আর কিছু পারুক না-পারুক আদিকাল থেকে চলে আসতে থাকা একটা অন্বেষণের ধারাকে আজ অবধি বহমান রাখতে পেরেছে।’

    অভিভূত হয়েছিল চার জনেই। উচ্ছ্বসিত স্বরে কান্তি বলে উঠল, ‘এ অন্বেষণ আমি বরণ করব। আমি বাহির হব। আমি ব্যর্থ হতেও প্রস্তুত।’

    আবেগভরে তন্ময় বলে বসল, ‘ব্যর্থ হব জেনেও আমি তৈরি।’

    মুখচোরা সুজন, সেও মুখর হল। ‘ব্যর্থতাই আমার শ্রেয়।’

    দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল অনুত্তম। ‘হায়! আমি যে স্বাধীন নই। দেশ যতদিন না স্বাধীনতা পেয়েছে ততদিন আমার আর কোনো অন্বেষণ অঙ্গীকার করার স্বাধীনতা নেই।’

    তার ব্যথায় ব্যথী হয়ে জীবনমোহন বললেন, ‘বেচারা অনুত্তম!’ তাঁর প্রতিধ্বনি করে তন্ময় কান্তি সুজন এরাও বলল, ‘বেচারা অনুত্তম!’

    ফেরবার সময় দেখা গেল মাটিতে পা পড়ে না তাদের চার জনের। অনুত্তমেরও? হ্যাঁ, অনুত্তমেরও। থাক, আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙব না, শুধু এইটুকু ফাঁস করলে চলবে যে অনুত্তমের নীল চশমা সূর্যের ভয়ে নয়, বালুর ভয়ে নয়, ধরা পড়ার ভয়ে। সুজনের কালো ছাতাও তাই।

    তন্ময় সারা পথটা ‘আহ’ ‘ওহ’ করে কাটাল। যেন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিন্তু যন্ত্রণায় নয়। আনন্দে।

    কান্তি বলল, ‘এতদিন পরে জীবনের একটা তাৎপর্য মিলল। জীবনটা একটা অন্বেষণ। হয়তো নিষ্ফল অন্বেষণ। তবু নিষ্ফলতাও শ্রেয়।’

    ‘অবিকল আমার কথা।’ বলল সুজন।

    ‘আমারও।’ তন্ময় সায় দিল।

    অনুত্তম বলল, ‘মাটি করেছে দেশটা পরাধীন হয়ে। নইলে আমিও—’

    কান্তি বলল, ‘দেশ স্বাধীন হোক পরাধীন হোক, এ অন্বেষণ স্বীকার করতে ও একে জীবনের কাজ করতে প্রতি জেনারেশনে দু-চার জন লোক থাকবে। নয়তো অন্বেষকদের পরম্পরা লোপ পাবে। আমাদের জেনারেশনে আমরাই সে দু-চার জন লোক। আমি আর তন্ময় আর সুজন।’

    অনুত্তম অনুযোগ করে বলল, ‘কেন? আমি কী দোষ করেছি? যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না? যে স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করে সে কি শাশ্বতী নারীর ধ্যান করতে পারে না?’

    কান্তি খুশি হয়ে বলল, ‘এই তো চাই। তোকে বাদ দিতে চায় কে?’

    তন্ময় বলল, ‘কেউ না।’

    সুজন বলল, ‘তোকে নিয়ে আমরা চতুরঙ্গ।’

    পরের দিন আবার জীবনমোহনের সঙ্গে ছাদের উপর বৈঠক। আবার সন্ধ্যার পরে। অনুত্তমকে তিনি প্রত্যাশা করেননি। বিস্মিত ও সস্মিত হলেন। বললেন, ‘আমি তো ভেবেছিলুম তোমরা হবে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স।’

    কান্তি বলল, ‘না, স্যার, আমরা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স হব না। হব রূপকথার রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সওদাগরপুত্র, কোটালপুত্র। তবে যার অন্বেষণে যাব সে হবে রাজকন্যা।’

    ‘যার নয়, যাদের। সে নয়, তারা।’ সংশোধন করল অনুত্তম।

    ‘তাদের একজনের নাম হবে রূপমতী।’ তন্ময় বলল উত্তেজনাভরে।

    ‘আর একজনের নাম কলাবতী।’ সুজন বলল মুখ নীচু করে।

    ‘আর একজনের নাম’, অনুত্তম বলল, ‘পদ্মাবতী। পদ্মিনী।’

    ‘হায়!’ কপট দুঃখ প্রকট করল কান্তি। ‘সব ক-টি ভালো ভালো নাম তোরাই লুটে-পুটে নিলি। আমার জন্যে বাকি রইল কী! কান্তিমতী!’

    ‘বা!’ জীবনমোহন তারিফ করে বললেন, ‘তোমাদের চার বন্ধুর প্রত্যেকের পছন্দ খাসা। কিন্তু চার জনের কোন জন রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র কোন জন, সওদাগরপুত্রটি কে, কোটালপুত্র কোনটি?’

    এর উত্তরে ওরা চার জনেই নীরব। কিছুক্ষণ পরে অনুত্তম আমতা আমতা করে বলল, ‘স্যার, আমি ঠিক জানিনে।’

    জীবনমোহন হেসে বললেন, ‘উত্তর দেবার দায় পরীক্ষকের উপর চাপালে! কিন্তু উত্তর তো একরকম দেওয়াই আছে। কান্তি, তোমার পছন্দ রাজপুত্রের মতো। আর অনুত্তম, তোমার পছন্দ মন্ত্রীতনয়ের যোগ্য। আর সুজন, তোমার পছন্দ সওদাগরসুতের উপযুক্ত। আর তন্ময়, তোমার পছন্দ কোটালনন্দনের অনুরূপ। তা বলে তোমরা কেউ কারও চেয়ে খাটো নও। তোমাদের কন্যারাও সকলে সকলের সমতুল।’

    তাঁর আশঙ্কা ছিল অনুত্তম সুজন তন্ময়—বিশেষ করে তন্ময়—হয়তো আঘাত পাবে। কিন্তু তন্ময় হল স্পোর্টসম্যান। সে কান্তির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘অভিনন্দন! কিন্তু একালের রাজপুত্রদের দৌড় কতটুকু! কোটালনন্দনেরই দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ।’

    ‘আর মন্ত্রীতনয়দের হাতেই আসল ক্ষমতা।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল অনুত্তম।

    ‘আর সওদাগরসুতদের হাতেই পুতুলনাচের অদৃশ্য তার।’ সুজন বলল হাত বাড়িয়ে দিয়ে।

    কান্তি কপট দুঃখে বিগলিত হয়ে বলল, ‘তাই তো, আমি তো খুব ঠকে গেছি।’

    জীবনমোহন উপভোগ করছিলেন তাদের অভিনয়। বললেন, ‘কেউ ঠকে যায়নি। কেউ ঠকে যাবে না। এটা এমন একটা অন্বেষণ যে অন্বিষ্ট যদি না-ও মেলে, যদি মেলে কিন্তু মিলে হারিয়ে যায়, যদি মেলে কিন্তু ভুল মেলে, তা হলেও পরিতাপের কিছু নেই। এটা এমন একটা দিল্লিকা লাড্ডু যা খেলেও কেউ পস্তায় না, না খেলেও কেউ পস্তায় না।’

    ‘তার পরে,’ তিনি আরও বললেন, ‘ক্ষমতার ক্ষেত্র এ নয়। ক্ষমতার কথা অপ্রাসঙ্গিক। তোমার হাজার ক্ষমতা থাকলেও তাকে তুমি পাবে না, অনুত্তম। তাকে অধিকার করতে গেলেই তাকে হারাবে, তন্ময়। সুজন, ইটার্নাল ফেমিনিন যাকে বলেছি তার অন্য নাম ইটার্নাল বিউটি। কান্তি, তুমি চিরসৌন্দর্যের অভিসারে চলেছ।’

    চিরসৌন্দর্যের অভিসার! কী গুরুভার তাদের উপর ন্যস্ত! শাশ্বতী নারীর অন্বেষণ! কী ক্ষুরধার পন্থা! জীবনমোহন তাদের কাছে যে অসাধ্যসাধন আশা করছেন সে কি তাদের সাধ্য! কেন তবে তারা ক্ষমতার কথা মুখে আনে! না, ক্ষমতা তাদের নেই। উদ্দীপ্ত অথচ বিনম্র বোধ করছিল চার বন্ধু। নিয়তি তাদের চার জনকেই মনোনয়ন করেছে তাদের যুগে ও দেশে। কী বিস্ময়কর সৌভাগ্য! কিন্তু সেই সঙ্গে কী দুশ্চর ব্রত!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীলনয়নীর উপাখ্যান
    Next Article পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.