Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প368 Mins Read0
    ⤷

    ০১. ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি

    করাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    [বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের পঞ্চম বই]
    প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫

    [তিনযুগ আগের একটি ঘটনার মীমাংসা করতে হবে বাস্টার্ডকে আর সেজন্যে পাড়ি দিতে হবে বারো শ’ মাইল, যেতে যেতে হবে এ বিশ্বের সবচেয়ে অরাজক আর বিপজ্জনক শহর করাচিতে। অপ্রত্যাশিত সব ঘটনার মুখোমুখি হতে হলো তাকে। একটা সময় মনে হলো তার টার্গেটের নাগাল পাওয়াটা শুধু কঠিনই নয় অনিশ্চিতও বটে। আত্মবিশ্বাসী বাস্টার্ড হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় বুঝতে পারলো দুনিয়া কাঁপানো একটি ঘটনার মধ্যে ঢুকে পড়েছে অযাচিতভাবে!]

    উৎসর্গ :

    ফয়সল কবীর রক্তিম’কে

    রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের। ফটোগ্রাফির নেশা ছিলো কিন্তু সে নিজেই এখন ছবি হয়ে গেছে! শুধুই ছবি!

    মাত্র দুয়েকবার দেখা হয়েছিলো রক্তিমের সাথে। সতেজ প্রাণবন্ত এই ছেলে নিজেকে বাস্টার্ড চরিত্রটির বিরাট বড়ভক্ত দাবি করে হাসতে হাসতে বলেছিলো, আমি যেনো ভবিষ্যতে বেগ-বাস্টার্ড সিরিজের কোনো বই তার নামে উৎসর্গ করি। তার জীবিত অবস্থায় আমি সেটা করতে পারি নি, কিন্তু অকালপ্রয়াত রক্তিম এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার আগে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের কভার-পিক হিসেবে তখন পর্যন্ত প্রকাশিত আমার সবগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ ব্যবহার করে, সেটাই চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। এখনও তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে মাঝমধ্যে ঢুঁ মারি… দেখি… আর অসম্ভব একটি ইচ্ছের জাগে ক্ষণিকের জন্যে, এই বুঝি রক্তিম নক করবে: হাই ভাইয়া!

    ভালো থেকো, রক্তিম।

    মুখ বন্ধ

    গোঙানীটা যে এতো তীব্র হবে সে জানতো না। এখন মনে হচ্ছে ওটাকে গাড়ির বুটে রাখলেই ভালো হতো। এটা যে মাথায় আসেনি তা নয়-সত্যি বলতে প্রথমে তা-ই ভেবেছিলো, পরে বাতিল করে দিয়েছে। এর কারণ ক্লায়েন্টের অদ্ভুত একটি শর্ত-ওটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

    কেনজানি তার মনে হয়েছিলো বুটের ঐ ছোট্ট পরিসরে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে ওটা মরে ভুত হয়ে থাকবে। এখন অবশ্য তা মনে হচ্ছে না। আসলে মানুষ এতো সহজে মরে না, কঠিন অবস্থায়ও টিকে থাকার বিস্ময়কর ক্ষমতা রয়েছে তার। আর অমানুষদের সেই ক্ষমতা থাকে আরো বেশি!

    রাতের এ সময়ে রাস্তাটা একদম ফাঁকা। যতোদূর চোখ যাচ্ছে কোনো যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। ডানহাতে স্টিয়ারিংটা ধরে পেছন ফিরলো। সিটের নীচে হাত-পা-মুখ বাধা এক হারামজাদা হাঁসফাঁস করছে। বন্দীর প্যান্টের জিপারের দিকে নজর গেলো, তারপরই হলো চোখাচোখি। তাকে দেখেই বরফের মতো জমে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো প্রাণীটি।

    বামহাতের তর্জনী ঠোঁটের কাছে এনে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলো সে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না, ফিরে তাকালো রাস্তার দিকে, তার ঠোঁটে আবারো ফুটে উঠলো বাঁকাহাসি। পেছনের সিটে যে আছে সে চুপ মেরে গেছে বলে হাসছে না, ভয়ে প্রস্রাব করে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে ওটা!

    ভয়ঙ্কর খারাপ লোকদেরকে ভয়ে-আতঙ্কে মরে যেতে দেখলে তার মধ্যে এক ধরণের ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। ওদের চোখ দেখে তার মধ্যে কখনও মায়া জেগে ওঠে না, বরং নিজের ভেতরে আটকে রাখা হিংস্রতা যেনো বন্ধনমুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার জন্যে বাকি কাজটা করা আরও সহজ হয়ে যায়। তবে আজকে এসবের কোনো দরকার হবে না। তার কাজ বলতে গেলে শেষ!

    সামনে, মহাসড়ক থেকে ডানদিকে চলে গেছে একটি ইট বিছানো রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো সে। বিশাল বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল গেটটার সামনে আসতেই গাড়িটা থামিয়ে দিলো। হর্ন বাজাবে কিনা বুঝতে পারলো না। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বন্ধ গেটের আশেপাশে কেউ নেই। একটু অপেক্ষা করলো কিন্তু কারোর টিকিটাও দেখতে পেলো না। বাধ্য হয়েই পর পর দু-বার হর্ন বাজালো সে, তারপর আবারো অপেক্ষা। দ্বিতীয়বার যখন হর্ন বাজাতে যাবে দেখতে পেলো গেটটা ঘরঘর শব্দ করে বেশ আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় বলিষ্ঠ দেহের কালোমতো দারোয়ানকে দেখতে পেলো, হাত নেড়ে ভেতরে আসতে বলছে তাকে।

    গাড়িটা নিয়ে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে আবার গোঙানি শুরু হলো কিন্তু এটা আমলেই নিলো না। পারলে ওটা ইচ্ছেমতো চিৎকার করুক, এখন আর সমস্যা নেই।

    গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পেলো প্যান্ট-শার্ট আর মাথায় টুপি দেয়া মাঝবয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে সামনের ডানদিকে চলে যাবার জন্য ইশারা করলো সে।

    “ডানে…গোডাউনের দিকে যান…” গাড়িটা তার পাশ দিয়ে যাবার সময় ভদ্রলোক বললো।

    ফ্যাক্টরির ভেতরটা বেশ আলোকিত। হেডলাইট বন্ধ করে দিলো সে। ডানদিকে মোড় নিতেই উঁচু ছাদের গোডাউনের বিশাল চত্বরে ঢুকে পড়লো। চারপাশে বড় বড় সাইজের অসংখ্য বাক্স স্তূপ করে রাখা, মাঝখানে বেশ ফাঁকা একটি জায়গা, সুট-টাই পরা এক ভদ্রলোক মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

    ক্লায়েন্ট।

    আধা-কাঁচাপাকা চুল আর চাপদাড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রাতের এ সময়েও ঝকঝকে পরিপাটী সুট-টাই পরে আছেন। তিনদিন আগে যখন তার সাথে দেখা হয়েছিলো তখনও এই পোশাকেই ছিলেন ভদ্রলোক।

    ক্লায়েন্টের খুব কাছেই গাড়িটা থামালো সে। ভদ্রলোকের চোখমুখ একদম নির্বিকার, তাতে কোনো অভিব্যক্তি থাকলেও সেটা সফলতার সাথেই পুরোপুরি আড়াল করতে পারছেন তিনি।

    কারোর পায়ের শব্দ শুনে বাস্টার্ড পেছন ফিরে তাকালো। গেটের ভেতরে যে লোকটাকে দেখেছে সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে তাদের দিকে।

    “আপনার আর লোকজন কোথায়?” জানতে চাইলো সে।

    ভুরু কুচকে তাকালেন ক্লায়েন্ট। “লোকজনের কি দরকার?” বেশ গম্ভীর কণ্ঠেই প্রশ্নটা করলেন তিনি।

    মুচকি হেসে কাঁধ তুললো বাস্টার্ড।

    “স্যার…” হাফাতে হাফাতে ছুটে এসে টুপি পরা ভদ্রলোক বললো।

    ক্লায়েন্ট তার কর্মচারির দিকে চকিতে চেয়ে পেশাদার খুনির দিকে ফিরলো। “ওটা কোথায়?”

    “পেছনের সিটে।”

    ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন ক্লায়েন্ট। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দিকে ছুটে গেলো সে। পেছনের দরজা খুলে একটু থমকে গেলো, যেনো

    কাচুমাচু খেলো একটু, ফিরে তাকালো মনিবের দিকে।

    “স্যার, আরেকজনকে ডাকি?”

    “না।” সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন ক্লায়েন্ট।

    ভদ্রলোক আর কোনো কথা না বলে উপুড় হয়ে সিটের নীচ থেকে ওটাকে টেনে-হিঁচড়ে নামাতে লাগলো। হাত-পা-মুখ বাধা যুবকের দিকে ভাবলেশহীনভাবে চেয়ে আছেন ক্লায়েন্ট।

    টুপি পরা ভদ্রলোকের একার পক্ষে এরকম একজন মানুষকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামানোটা একটু কষ্টকরই হলো কারণ বন্দী উদভ্রান্তের মতো হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্ট করছে; চিৎকার দিচ্ছে প্রাণপণে; কিন্তু মুখ বন্ধ থাকার কারণে। সে-আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে।

    বাস্টার্ড চুপচাপ দেখতে লাগলো। সে জানে বন্দী কেন এমন আচরণ করছে। গাড়ি থেকে বের করতেই হারামজাদা দেখে ফেলেছে ক্লায়েন্টকে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে ঘুরপাক খেতে থাকা সেই প্রশ্নটার জবাব পেয়ে গেছে সে-অচেনা এক লোক কেন তাকে পিস্তলের মুখে হাত-পা-মুখ বেধে গাড়িতে করে অজানা পথে পাড়ি দিচ্ছে! এখন তার কাছে সব কিছুই পরিস্কার। এমনকি নিজের পরিণতিটাও!

    “ওর মুখটা খুলে দাও,” ক্লায়েন্ট বেশ শান্তকণ্ঠে বললেন।

    ভদ্রলোক একমুহূর্ত ভেবে ঢোক গিলে কর্তার নির্দেশ পালন করলো।

    “বাঁচাও! বাঁচাও! এরা আমারে মাইরা ফালাইবো! আমারে মাইরা ফালাইবো! বাঁচাও!”

    হারামজাদার আর্তচিৎকার বিশাল গোডাউন প্রকম্পিত করলেও ক্লায়েন্টের নির্বিকার মুখে কোনো পরিবর্তন আনতে পারলো না।

    “আমার কাছে নিয়ে আসো।”

    ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বন্দীর কলার ধরে টেনে নিয়ে এলো ক্লায়েন্টের পায়ের কাছে। হারামজাদা কেঁচোর মতো একবার কুকড়ে ফেলছে নিজের শরীরটা, পরমুহূর্তেই আবার সোজা করে গড়াতে চাইছে। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। কোনো কথাই তাকে শান্ত করতে পারবে না এখন। কোনো চোখ রাঙানিতেও সে দমবে না।

    বাস্টার্ডের মনে হলো তার ক্লায়েন্ট বন্দীর অসহায়ত্ব আর মৃত্যুভয়কে উপভোগ করছে যদিও মুখের অভিব্যক্তিতে এর কোনো প্রতিফলন নেই।

    ক্লায়েন্ট এক পা পিছিয়ে গিয়ে টুপি পরা ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন। চাকরিদাতার মনোভাব বুঝতে একটুও বেগ পেলো না কর্মচারি। হারামজাদার মাথার চুল শক্ত মুঠোয় ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলো সে।

    “চুপ! একদম চুপ থাক। স্যারের সামনে একটুও হাউকাউ করবি না!” তারপর দাঁতমুখ খিচে বললো, “শূয়োরেরবাচ্চা!”

    বন্দী দম ফুরিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো ক্লায়েন্টের দিকে।

    বাস্টার্ড চুপচাপ এই নাটকীয় দৃশ্য দেখছে। এখনকার নাটকে তার কোনো ভূমিকা নেই। সে কেবলই দর্শক।

    “মণিরাম কোথায়?” বেশ শান্তকণ্ঠেই প্রশ্নটা করলেন ক্লায়েন্ট।

    বন্দী নিশ্চুপ। এখনও হাফাচ্ছে।

    “শূয়োরেরবাচ্চা, বল্!” চুলের মুঠি ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকি দিলো টুপি পরা ভদ্রলোক। “তোকে বলতেই হবে। না বলে কোনো উপায় নেই এখন।”

    তারপরও বন্দীর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।

    বাস্টার্ড অবাক হলো তার ক্লায়েন্ট এখনও শান্ত আছে বলে। সে যতোটুকু জানে এই হারামজাদাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে এরকম শান্ত থাকাটা স্বাভাবিক নয়। ন্যায়বিচারের আশায় দীর্ঘ ছয় বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন, তারপর বিচার যখন পেলেন দেখলেন তার কিশোরী মেয়েকে খালি বাড়িতে যারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছে সেই হাসান আর মণিরাম বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে।

    কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। টুপি পরা ভদ্রলোকের দাঁতমুখ খিচে হুমকি ধামকিতে কাজ হচ্ছে না। ক্লায়েন্টের অসহায়ত্ব বুঝতে পারলো বাস্টার্ড। কোমর থেকে সাইলেন্সার পিস্তলটা বের করে বন্দীর কপালে তাক করলো। খেয়াল করলো ক্লায়েন্ট আর তার কর্মচারি আৎকে উঠেছে। মুচকি হাসলো সে, সঙ্গে সঙ্গে ভোতা একটি শব্দ। কাছ থেকে কেউ যেনো সজোরে থুতু ফেলেছে।

    ভদ্রলোক আর ক্লায়েন্ট চমকে উঠলো একটু।

    “আ-আ-আ-আ!” হারামজাদার আর্তনাদে ভরে উঠলো গোডাউনের বিশাল এলাকাটি।

    গুলি করার আগে কপাল থেকে পিস্তলটা বন্দীর বাম হাটুর একটু উপরের দিকে তাক করে গুলি চালিয়েছে সে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। মুহূর্তেই গোডাউনের মেঝে রক্তে লাল হয়ে গেলো। রক্ত দেখে হারামজাদার চুলের মুঠি আলগা করে দিলো ভদ্রলোক। গুলিবিদ্ধ বন্দী মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করলো এবার।

    এই প্রথম বাস্টার্ড দেখতে পেলো তার ক্লায়েন্টের অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন। এসেছে। ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে আছেন। সম্ভবত এর আগে কখনও ভাবলেশহীনভাবে কোনো মানুষকে গুলি করতে দেখেন নি।

    আবারো পিস্তল তাক করলো সে। “আমি তিন গুনবো…এরমধ্যে উনার প্রশ্নের জবাব দিবি…নইলে এবার তোর ডান হাটুতে গুলি করবো,” একেবারে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো। “এক…দুই…”

    “মিরপুরে! মিরপুরে!” যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলে উঠলো গুলিবিদ্ধ বন্দী।

    বাস্টার্ড তাকালো ক্লায়েন্টের দিকে তারপর আবারো পিস্তল তাক করলো। “মিরপুরের কোথায়…ব?”

    ব্যথায় কোঁকাতে লাগলো আহত লোকটি।

    “মণিরামের ঠিকানা বলে দিলে তোকে আর গুলি করবো না।”

    লোকটার মুখ দিয়ে কেবল গোঙানি আর আর্তনাদই বের হচ্ছে।

    “কাজটা তোরা দুজনে মিলে করেছিস…তুই মরবি আর মণিরাম বেঁচে থাকবে…” মাথা দোলালো আফসোসের ভঙ্গি করে। “…এটা হয় না।”

    আহত জানোয়ার কাঁপতে কাঁপতে বাস্টার্ডের দিকে তাকালো।

    “তোর সাথে সাথে মণিরামেরও মরা উচিত…এরচেয়ে কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত…তাই না?”

    লোকটা অঝোরে কাঁদতে লাগলো।

    “ওর ঠিকানাটা দিয়ে দে…তোকে আর টর্চার করবো না।”

    জানোয়ারটা বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু কেউ তার কথা বুঝতে পারলো না। বাস্টার্ড হাটু ভেঙে বসে লোকটার মাথা ধরে তার কানের কাছে নিয়ে এলো।

    ক্লায়েন্ট আর তার কর্মচারি বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।

    উঠে দাঁড়ালো সে। “ওর সাথে আমার কাজ শেষ।”

    আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ক্লায়েন্ট। “এবার জানোয়ারটাকে মেরে ফেলো।”

    “না! না!” চিৎকার দিলো হাত-পা বাধা যুবক।

    বাস্টার্ড তার পিস্তলটা শেষবারের মতো তাক করলো বন্দীর দিকে।

    “দাঁড়ান, টুপি পরা ভদ্রলোক হাত তুলে থামার ইশারা করে চাকরিদাতার উদ্দেশ্যে বললো, “স্যার, এই শূয়োরটাকে এতো সহজে মেরে ফেলা ঠিক হচ্ছে না।”

    ভুরু কুচকে তাকালেন ক্লায়েন্ট। বাস্টার্ড পিস্তল উঁচিয়ে রেখেই অপেক্ষা করলো।

    “ওকে আরো কঠিনভাবে মারা উচিত।”

    বন্দী যুবক চিৎকার থামিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে।

    “কিভাবে?” আস্তে করে জানতে চাইলেন ক্লায়েন্ট।

    “ইয়ে মানে,” একটু দ্বিধা দেখা গেলো লোকটার মধ্যে। মাথার টুপিটা খুলে হাতে রাখলো। “বলছিলাম কি, আমাদের ফ্যাক্টরির বার্নারটা আছে না…ওটার ভেতরে ঢুকিয়ে দেই…দোযখের মতো আজাব পাবে!”

    “না! না! না!” বন্দী আবারো চিৎকার দিতে শুরু করলো।

    ক্লায়েন্টের চেহারা যথারীতি ভাবলেশহীন থাকলেও মনে হচ্ছে বিষয়টা ভেবে দেখছেন। তবে বাস্টার্ড বুঝে গেলো সিদ্ধান্তটা কি হতে পারে। পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিলো সে। তাকে এটা করতে দেখে ক্লায়েন্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে তাকালেন।

    “উনার আইডিয়াটা ভালো। লাশ ডাম্পিং করা খুব ঝামেলার কাজ। তাছাড়া ওর লাশ পাওয়া গেলে আপনাকেই সবাই সন্দেহ করবে।”

    “লাশ পাওয়া না গেলে কি সন্দেহ করবে না?” একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলেন তিনি।

    “তখনও সন্দেহটা আপনার দিকে থাকবে কিন্তু আরো কিছু অপশন তৈরি হয়ে যাবে।”

    “বাঁচাও! বাঁচাও! এরা আমারে মাইরা ফালাইবো! বাঁচাও!” বন্দী তার চিৎকার অব্যাহত রাখছে।

    “ওর মুখটা বন্ধ করো।”

    ক্লায়েন্টের কথা শুনে ভদ্রলোক বন্দীর মাথার চুল শক্ত করে ধরে হাতের টুপিটা দলা পাকিয়ে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। এবার চাপা গোঙানী ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছে না। বন্দী এখন কংক্রিটের মেঝেতে উদভ্রান্তের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছে।

    “কী রকম অপশন তৈরি হবে?”

    “সে পুলিশের খাতায় নিখোঁজ হিসেবে থেকে যাবে। নিখোঁজ কাউকে নিয়ে পুলিশ খুব একটা মাথা ঘামায় না। ওরা হয়তো আপনাকে সন্দেহ করবে কিন্তু লাশ না পাওয়া পর্যন্ত আপনার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অভিযোগ আনতে পারবে না।”

    বাস্টার্ডের দিকে চেয়ে রইলেন ক্লায়েন্ট।

    “স্যার, উনি ঠিকই বলেছেন,” ভদ্রলোক বললো। “লাশ পাওয়া গেলেই ঝামেলা বেশি হয়। একে আমি ঐ বার্নারে ঢুকিয়ে একদম ভ্যানিশ করে দেবো। একটুও ট্রেস থাকবে না।”

    মনে হলো আরেকটু ভেবে দেখছেন ক্লায়েন্ট। অবশেষে বিশ্বস্ত কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে মণিরামকেও একইভাবে ভ্যানিশ করে দিতে হবে।”

    “জি, স্যার। ওদের জন্য একটু কঠিন মৃত্যুই দরকার,” বললো সে। “আগুনে পুড়ে মরার মতো কঠিন মৃত্যু আর হয় না…এজন্যেই আল্লাহপাক দোযখে আগুনের ব্যবস্থা করেছেন।”

    ক্লায়েন্ট গড়াগড়ি খাওয়া বন্দীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। “জদি করো।” সুটের হাতা সরিয়ে রোলেক্স হাতঘড়িটা দেখে নিলেন। “রাত অনেক হয়েছে, আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে।”

    ভদ্রলোকের মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠলো। “স্যার, আরেকটা কথা বলি?”

    ক্লায়েন্ট কিছু বললেন না শুধু তাকিয়ে থাকলেন কর্মচারির দিকে।

    “বার্নারটা ফুল-ফেইজে চালু না করে এই শূয়োরটাকে ওটার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে তারপর চালু করবো…তাহলে আস্তে আস্তে, তিলে তিলে মরবে। একেবারে দোযখের মতো মনে হবে!”

    বাস্টার্ড স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে। সে একটু অবাকই হয়েছে, কারণ একে দেখে মনে হয় নি এতোটা পৈশাচিক চিন্তা করতে পারে।

    ক্লায়েন্ট খুবই আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

    “কিন্তু আরেকজনকে ডাকতে হবে, স্যার…আমি একা এইটাকে বার্নারে তুলতে পারবো না।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্লায়েন্ট। “ঠিক আছে, ডাকো। যা করার জলদি করো।”

    ভদ্রলোক দৌড়ে চলে গেলো গোডাউনের শেষমাথায় থাকা ছোট্ট একটি দরজার দিকে।

    বাস্টার্ডের দিকে ফিরলেন ক্লায়েন্ট। “মণিরামকে কবে পাচ্ছি?”

    “ও যদি ওই ঠিকানায় থেকে থাকে তাহলে কাল বিকেলের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।”

    ক্লায়েন্ট এবার বন্দীর দিকে তাকালেন। আসন্ন মৃত্যুভয়ে কই মাছের মতো আস্ফালন করছে। এই প্রথম তার মুখে হালকা হাসি দেখা গেলো। এই হাসি তিনি ছয়বছর ধরে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন।

    পেটানো শরীরের এক লোককে নিয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারি ছুটে এলো হন্তদন্ত হয়ে। “স্যার?”

    “জলদি করো, শওকত।”

    ভদ্রলোকের নামটা এই প্রথম শুনলো বাস্টার্ড।

    “হানিফ, ওরে শক্ত করে ধ,” পেটানো শরীরের লোকটাকে বললো শওকত সাহেব।

    হানিফ নামের লোকটি একহাতে বন্দীর চুলের মুঠি ধরে তাকে রীতিমতো দাঁড় করিয়ে ফেললো, তারপর অন্যহাত দিয়ে বন্দীর গলাটা পেঁচিয়ে ধরলো সে। শওকত সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বন্দীর বাধা পা-দুটো ধরে তাকে চ্যাংদোলা করে ফেললো। দু-জন মানুষের হাত থেকে ছোটার ব্যর্থ চেষ্টা করে যেতে লাগলো বন্দী।

    “স্যার, আপনি কি দেখবেন?” শওকত সাহেব বন্দীকে নিয়ে যাবার আগে তার কর্তার কাছে জানতে চাইলো।

    ক্লায়েন্ট এ কথার কোনো জবাব না দিলে শওকত আর হানিফ চুপচাপ বন্দীকে নিয়ে চলে গেলো।

    “আমি তাহলে যাই,” ক্লায়েন্টকে বললো বাস্টার্ড।

    আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রলোক।

    আর কিছু না বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো সে। রাত অনেক হয়ে গেছে, ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে যাবে। পথে কোথাও খেয়ে নেয়া দরকার, খুব খিদে পেয়েছে তার। দীর্ঘ সময় গাড়ি চালালেই তার খিদে বেড়ে যায়।

    গাড়ির ভেতরে ঢুকে ইগনিশানে চাবি ঢোকাতে যাবে অমনি দূর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। সম্ভবত ওটাকে বার্নারে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। মাগো-বাবাগো বলে আহাজারি করছে। বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে কিন্তু সবটাই অসাড়।

    বাস্টার্ড গাড়ির ভেতর থেকেই দেখতে পেলো তার ক্লায়েন্ট দু-চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

    পর মুহূর্তেই গমগম করে একটা শব্দ হতেই মারণচিৎকার দিলো বন্দী।

    এই ফ্যাক্টরির বিশাল বার্নারটা চালু করা হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখার তোতা আওয়াজ অনেক বেশি পৈশাচিক শোনাচ্ছে এখন। যেনো প্রকাণ্ড কোনো দানব ক্ষিদের চোটে ঘোৎঘোৎ করছে। বন্দীর আর্তচিৎকার ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এলো। কয়েক মুহূর্ত পর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই, শুধু বার্নারের ভীতিকর শব্দটা ছাড়া।

    বুঝতে পারলো বার্নারে ঢোকানোর আগে বন্দীর মুখের ভেতর থেকে দলা পাকানো কাপড় আবারো খুলে ফেলা হয়েছিলো ঐ পশুটার মরণচিৎকার শোনার জন্য। তার ক্লায়েন্ট শেষ আর্তনাদের শব্দটা শুনতে চেয়েছেন!

    অধ্যায় ১

    ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি ঢোকাতে গিয়েই থেমে গেলো সে। মেঝে আর দরজার মধ্যে যেটুকু ফাঁক আছে সেখানে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। এটা তার সদা-সতর্ক মন, যা কিনা শিকারীর মতোই তীক্ষ্ণ। দরজার নীচে কিছু একটা তার চোখে ধরা পড়েছে।

    আলোর মৃদু তারতম্য!

    ফ্ল্যাটের ভেতরে কেউ আছে?!

    অবিশ্বাসে তার সারা গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। এটা কিভাবে সম্ভব? সে যে এই ফ্ল্যাটে আছে তা কেবল জানে একজন। এই সুরক্ষিত ফ্ল্যাটে তার অনুপস্থিতিতে কে ঢুকতে যাবে?

    টি-শার্টের নীচে হাত দিয়ে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে আনতেই দরজার নীচে আবারো আলোর তারতম্য চোখে পড়লো! স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় এক পা পিছিয়ে গেলো সে। ক্লিক করে মৃদু শব্দ হলো এবার। ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলে দিয়েছে!

    আস্তে করে দরজা খুলে যেতেই দেখা গেলো একটি অবয়ব ঘুরে চলে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। টের পেলো একটা সুগন্ধী ভেসে বেড়াচ্ছে। ফ্ল্যাটটা একদম পরিস্কার আর গোছানো। অবাক না-হয়ে পারলো না।

    “আপনি…কখন এসেছেন?”

    “একটু আগে,” পেছন ফিরে না তাকিয়েই জবাব দিলো অমূল্যবাবু। সোজা চলে গেলো ড্রইংরুমে। চুপচাপ একটি সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়লো। “ফ্ল্যাটটা পরিস্কার করিয়েছি আজ সকালে।”

    তার বুঝতে একটু অসুবিধাই হলো। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মৌব্রত পালন করা লোকটার দিকে।

    “নিট অ্যান্ড ক্লিন নামের এক ক্লিনিং-সার্ভিসকে বলে দিয়েছি…এখন থেকে ওরা মাসে দু-বার এসে ফ্ল্যাটটা পরিস্কার করে দিয়ে যাবে।”

    বাস্টার্ড আর কিছু বললো না।

    “কোথায় গেছিলে?”

    “একটা কাজে বাইরে গেছিলাম,” সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো সে।

    বামপাশের দেয়ালে তাকালো বাবু। ডিজিটাল দেয়ালঘড়িটা বড় বড় সংখ্যায় জানান দিচ্ছে ৮:২৫। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট : এতো সাত-সকালে কী এমন কাজ?

    “ঢাকার বাইরে গেছিলাম…চৌধুরির কাজে…”

    এবার বুঝতে পারলো বাবু। “বসো।”

    পাশের একটি সোফায় বসে পড়লো সে। “কাজ শেষ?”

    “না। দুয়েকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে আশা করছি।”

    “তারপর ফ্রি আছো?”

    “হ্যাঁ।”

    অমূল্যবাবু নিরাবেগ মুখে বললো, “একজন তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে…সে আমার খুব ঘনিষ্ঠ।”

    বাস্টার্ড বুঝতে পারলো একটা কাজের কথা বলা হচ্ছে। বাবু কখনও ‘একটা কাজ আছে কিংবা একজন ক্লায়েন্ট এসব শব্দ ব্যবহার করে না। তার সাথে কেউ দেখা করতে চায় মানে নতুন আরেকটা কাজ, তবে সে খুব অবাকও হচ্ছে। পর পর দুটো কাজ, তাও আবার কোনোরকম বিরতি না দিয়ে!

    “এই কাজটা একটু আলাদা…নইলে এখনই তোমাকে বলতাম না।”

    “সমস্যা নেই। দেখা করবো।”

    পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করে বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। “আমার নাম বললেই হবে।”

    কার্ডটা হাতে নিলো সে। “পরশু দেখা করি?”

    “তুমি ওই কাজটা আগে শেষ করো, তারপর কোথায় কিভাবে দেখা করবে সেটা ওকে বলে দিও।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

    “কাজটা তোমার পছন্দ না-হলে কোনো রকম দ্বিধা না করেই বলে দেবে।”

    “ঠিক আছে।”

    তাদের মধ্যে এরকমটিই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবু কখনও তাকে বলে না এ-কাজটা করতেই হবে। জোর খাটানোর স্বভাব নেই এ লোকের। যদিও এরকমটি করা হলে সে কোনো প্রশ্ন না তুলেই করে দেবে। সম্ভবত অমূল্যবাবু নিজেও তা জানে।

    আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো বাবু।

    কার্ডের নামটার দিকে তাকালো সে। ক্লায়েন্টের নামসহ তিন-চারটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা, ফোন-ফ্যাক্স নাম্বার দেয়া। একটু অবাক হলো। বাবু কখনও শুধুমাত্র ক্লায়েন্টের বিজনেস কার্ড দেয় না। ওখানে যে কন্ট্যাক্ট নাম্বার থাকে সে-সব ব্যবহার করে যোগাযোগ করে না সে। বিশেষ একটি নাম্বার ছাড়া যোগাযোগ করতে বড্ড অনীহা তার। ভদ্রলোকের সাথে কি তাহলে এই নাম্বারেই যোগাযোগ করবে? তিন থেকে চারটা ফোনে?

    মনের মধ্যে খটকা লাগলে কার্ডটা উল্টে দেখতেই মুচকি হাসলো। সেখানে একটা ফোন নাম্বার হাতে লেখা আছে।

    অধ্যায় ২

    করাচি
    অজ্ঞাত এক সেফহোম

    বিশাল ঘরটিতে তেরোজন তরুণ থাকার পরও কেমন সুনশান আর স্তব্ধ একটি পরিবেশ বিরাজ করছে। যেনো ঘুমিয়ে আছে সবাই। আদতে তেরোজনের মধ্যে সবাই সজাগ। একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে তারা। গতরাতের শেষের দিকে গাড়িতে তোলার পর ভোর পর্যন্ত ভ্রমণ করে খুব সকালে এখানে এসে উঠেছে, তারপর গোসল করে ভালোমন্দ খেয়ে ঘুম দেয়। মাঝখানে সাড়ে বারোটার দিকে তাদেরকে ডাকার কথা থাকলেও সম্ভবত ক্লান্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে সেটা করা হয় নি। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করলে কী আর এমন ক্ষতি।

    প্রায় তিনমাস ধরে কি ধকলটাই না গেছে তাদের উপর দিয়ে। প্রতিদিন টানা ছয়-সাত ঘণ্টার কায়িক পরিশ্রম আর অসহ্য খাটুনি। পিঠে দশ কেজি ওজনের শোল্ডারব্যাগ নিয়ে নৌকা বাওয়া, সাঁতার-কাটা, বালুর মধ্যে দৌড়ানো, দেয়াল টপকানো, ক্রলিং করা-সবই ছিলো অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। প্রথম দিন তারা সবাই কাবু হয়ে পড়লেও তিন-চারদিন পর এটা গা সহা হয়ে যায়। তাদেরকে মোট চারজন লোক ট্রেইনিং দিয়েছে, ঐ চারজনকে তারা ছোটোচাচা, বড়চাচা, কমান্ডারচাচা, মেজরচাচা নামে ডাকতো। চাচাঁদের আবার একজন ওস্তাদ ছিলো, তাকে সবাই ‘মেজর জেনারেল’ বলে ডাকলেও তার চেহারা তেরোজনের কেউ দেখে নি।

    মাসখানেক আগে তাদের ট্রেইনিং শেষ হয়ে গেলে ক্লাসের পঁচিশজনের মধ্য থেকে তেরোজনকে আলাদা করে ফেলা হয়। বড়চাচা বলেছিলো, তারা সবাই ‘পাক্কা’ হয়ে গেছে। এরপর দু-জন করে একটি জুড়ি বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয় কিছুদিন। মুজাহিদ আর ইসমাইল সে-রকমই এক জুড়ি। আবু মুজাহিদকে করাচিতে এনে মাছ ধরার ট্রলারে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয় কিছুদিনের জন্য। গতরাতে তেরোজনকে আবারো এক করে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। গাড়ির কালো কাঁচের কারণে তারা বুঝতে পারে নি জায়গাটা কোথায়, কিন্তু পথে কোনো চেকপোস্ট ছিলো না, ফলে এটা করাচিরই কোথাও হবে বলে তাদের অনুমান। করাচি অনেক বড় শহর, একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের দূরত্ব কম নয়।

    এখন তেরোজন তরুণ প্রায় নিঃশব্দে বড় ঘরটায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আসরের ওয়াক্ত কাজা করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না বুজুর্গের। এই লোকটার সাথেই তারা বেশি সময় কাটায়। বলতে গেলে বুজুর্গই এখন তাদের অভিভাবক। আজানের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে ডেকে তোলার পর সহীমতে ওজু। করে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা। আগের মতোই এই নামাজের ইমামতি করছে বুজুর্গ নিজে। আসরের রাকাত শেষ করে জহুরের কাজা পড়ে নিলো সবাই।

    “আল্লাহু আকবার,” প্রায় বিড়বিড় করে বললো বুজুর্গ। বাকিরা নিঃশব্দেই অনুসরণ করলো সেটা।

    এ-ঘরের কর্মকাণ্ড বাইরের লোকজন জেনে যাক এটা তারা চায় না। এমনকি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নীচের রাস্তা দেখাও তাদের জন্য নিষেধ। জানালাগুলো মাকারি কাঁচে ঢাকা। বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। বুজুর্গের অনুমতি ছাড়া তাদের কেউ বাইরেও যেতে পারবে না। অবশ্য বাইরে যাওয়ার দরকারও পড়ে না। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে সবই আছে এখানে। যদিও তাদেরকে বলা হয়েছে বুজুর্গের অনুমতি নিয়ে বাইরে যেতে পারবে কিন্তু অনেকের মনে সন্দেহ, সেই অনুমতি তারা কখনও পাবে না।

    নামাজ শেষ হলে বুজুর্গ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো।

    দলের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়স্ক আবু মুজাহিদ। এটা তার আসল নাম নয়। এখানে তাদের কারোরই আসল নাম নেই। এ পর্যন্ত তিনবার তাদের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। যাকে যখন যে-নাম দেয়া হয় তাদেরকে দে-নামেই ডাকার হুকুম দিয়েছে বুজুর্গ। সে জোর দিয়ে বলেছে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে নাম ধরে এখানে কেউ কাউকে খুব একটা ডাকেও না। এখনও কেউ কারোর সাথে আলাপে মশগুল হয় নি। মনে হয় কেউ কারোর ব্যাপারে আগ্রহীও নয়। এর কারণ তাদেরকে কড়াকড়িভাবে বলা হয়েছে, কেউ যেনো কারো সম্পর্কে জানার চেষ্টা না করে। তবে মুজাহিদ জানে এই নির্দেশটি পুরোপুরি পালিত হবে না। তাদের ট্রেইনিংয়ের সময়ও নিজেদের মধ্যে বেশ আলাপ হতো। কে কোত্থেকে এসেছে, আগে কি করতো এসব নিয়ে কথা বলেছে। তাদের দলে যে দু-তিনজন কথা বলার নিয়মটা প্রথম ভঙ্গ করেছে তার মধ্যে মুজাহিদ অন্যতম। ছেলেটার বয়স বেশি হলে ঊনিশ-বিশ হবে তবে আকারে বেশ ছোটো আর চেহারাটাও বাচ্চা-বাচ্চা। নাকের নীচে সদ্য পাতলা গোঁফ উঠছে। পাঞ্জাবের ফরিদকোটের এক হতদরিদ্র গ্রাম থেকে আসা এই ছেলের সব কিছুইতেই ভীষণ কৌতূহল। খুব অস্থির প্রকৃতির। আজ গাড়িতে করে এখানে আসার সময় বুজুর্গ তাকে ধমক দিয়ে বলেছে এখন থেকে সে যেনো কম কথা বলে। সেই থেকে মুজাহিদ বোবা হয়ে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

    দলের মধ্যে পঁচিশ বছরের ইসমাইলের সাথেই কেবল তার কথাবার্তা হয়। ইসমাইলের আসল নামটাও মুজাহিদ জানে, কিন্তু সে-নামে ডাকার কোনো উপায় নেই। সত্যি বলতে, তাদের সবার আসল নামই তারা জেনে গেছে এতোদিন একসাথে থাকার কারণে। ইসমাইল বলেছে বুজুর্গ এটা শুনলে ভীষণ রাগ করবে।

    নামাজ শেষে সবাই পাশের ঘরে চলে গেলেও মুজাহিদ আর ইসমাইল নামাজঘরেই বসে রইলো।

    “আমরা আসলে কি করবো, বড়ভাই?” উর্দুতে বললো মুজাহিদ।

    “জিহাদ,” একই ভাষায় জবাব দিলো ইসমাইল। “অনেক বড় একটা কাজ। আমাদের দুনিয়াদারির তুচ্ছ আর নান্নতের এই জীবনটা বিশাল কিছু হয়ে যাবে। এটা তুই ভালো করেই জানিস। খামোখা কেন জিজ্ঞেস করছিস?”

    ইসমাইলের কথাগুলো বুজুর্গ কতোবার বলেছে তার কোনো হিসেব নেই। “আমি সেটার কথা বলছি না, বলছি কখন করবো, কোথায় করবো?”

    “জানি না।” ছোট্ট করে বললো তাকে। “এটা আমাদের অনেক পরে জানানো হবে।”

    “পরে কেন?”

    “কারণ আগেভাগে জেনে কোনো লাভ নেই,” চাপদাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললো ইসমাইল। তাকে বলা হয়েছে কয়েকদিন পরই এই দাড়ি শেভ করে ফেলতে হবে। অনেকদিন ধরে রাখতে রাখতে দাড়িটা তার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

    প্রশ্নের জবাব পেতে না পেতেই আবার বলে উঠলো মুজাহিদ, “আমরা এখন যেখানে আছি সেটা কি করাচি?”

    “মনে হয়।”

    “আচ্ছা, আমাদের ট্রেইনিংগুলো কেন রাতেই বেশি হয়েছে?”

    “কারণ যে মানুষ রাতে এসব কাজ ভালোমতো করতে পারবে সে দিনের আলোয় আরো ভালোভাবে করতে পারবে।”

    “ও,” মুজাহিদের চোখেমুখে বিস্ময়। “আচ্ছা, আমরা এখানে কয়দিন থাকবো?”

    “আহ্, এতো প্রশ্ন আমাকে কেন করছিস? আমি তো বুজুর্গ নই। আমি এসব জানিও না। একটু চুপ থাকতে পারিস না?”

    দাঁত বের করে হাসলো মুজাহিদ। ইসমাইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো ছেলেটার দিকে। ওর চেহারায় কেমন একটা মায়া-মায়া ভাব আছে। নাদান একটা বাচ্চা। বয়স যতো কম তারচেয়েও বেশি কম তার পরিপক্কতা। এর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। ছেলেটা সুযোগ পেলেই, বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় নিজের পরিবার, গ্রাম, ভাই-বোন এসব নিয়ে প্রচুর কথা বলে। অভাবের সংসারে বড় হয়েছে। চার ক্লাস পড়াশোনা করার পর ওর বাপ ওকে কাজে লাগিয়ে দেয়। এখানে যোগ দেবার আগে কন্ট্রাকশনের মতো কঠিন কাজ করেছে কিছুদিন। তারপর দাওয়ার লোকজনের কাছে টাকার বিনিময়ে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দিয়েছে তার বাপ। জিহাদ করে ছেলেটা অসামান্য সওয়াব হাসিল করবে, সেই সাথে তাদের গরীবিও দূর হবে। ভাই-বোনদের ভবিষ্যত নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। ইসমাইলের মতো বুঝেশুনে এ কাজে আসে নি সে, তাই তার কথাবার্তায় এর ছাপ পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত। অবশ্য তাদের তেরোজনের দলে এরকম ‘লারকা’ আছে আরো তিনজন। বুজুর্গ চেষ্টা করে যাচ্ছে এইসব ‘লারকাদের সত্যিকারের জিহাদি জোশে উদ্দীপ্ত করতে।

    “ভাই?” অনেকক্ষণ চুপ থেকে হাপিয়ে উঠলো মুজাহিদ।

    “কি?” গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো ইসমাইল।

    “ওরা এখান থেকে আমাদেরকে আর বের হতে দেবে না, তাই না?”

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। আলতো করে মাথা দোলালো অসন্তোষে। “এখানে ঢোকার পর বের হবার চিন্তা মাথায় ঢোকে কী করে?”

    অধ্যায় ৩

    শীতকালের সন্ধ্যা সাতটা মানে প্রায় ঘুটঘুঁটে রাত। মেরি অ্যান্ডারসনের রেলিং ঘেষে নদীর দিকে তাকালে শুধু বুড়িগঙ্গার ওপাড়ের শতশত বৈদ্যুতিক বাতির বিন্দু বিন্দু আলো চোখে পড়ে। বুড়িগঙ্গা নদীতীরে পোস্তগোলা-পাগলা নামক জায়গায় অবস্থিত পর্যটন কপোরেশনের এই রেস্তোরাঁটি আসলে ভাসমান একটি লঞ্চ। এটি বেশ পুরনো। এখনও শহরের অনেক মানুষের আগ্রহ ধরে রেখে ভেসে বেড়াচ্ছে পচে যাওয়া নদীতীরে। পানি কতোটা পচে গেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না তবে মনে হচ্ছে এখানকার নদী এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় নি।

    ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে জ্যাকেটের বোতামগুলো লাগিয়ে নিলো বাস্টার্ড। তার চোখ বার বার চলে যাচ্ছে দূরের একটি খালি টেবিলের দিকে, কিন্তু এমনভাবে তাকাচ্ছে কেউ বুঝতেই পারবে না কারোর জন্য অপেক্ষা করছে সে। তাকে দেখলে মনে হবে অলসভঙ্গিতে বসে আশেপাশের দৃশ্য দেখছে। তার মাথায় সানক্যাপ, একেবারে নীচু করে রাখা। দূর থেকে ভালো করে মুখ দেখার উপায় নেই।

    সাতটা বাজতে এখনও এক মিনিট বাকি। সে এসেছে আরো দশ মিনিট আগে। বিকেলের দিকে ফোনে জামিল আহমেদের সাথে তার কথা হয়েছে। মাত্র চল্লিশ সেকেন্ডের বাক্যালাপেই সন্ধ্যা সাতটায় মেরি অ্যান্ডারসনে তাদের সাক্ষাতের ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়।

    ভুম-ভুম শব্দ করে নদী দিয়ে একটি লঞ্চ চলে গেলো। একটু দুলে উঠলো ভাসমান রেস্টুরেন্টটি। ঠিক এ-সময় প্রবেশপথের দিকে চোখ গেলো তার। মাঝবয়সী এক লোক এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে ঢুকছে। সাত নাম্বার টেবিলটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভদ্রলোক।

    নিজের আসনে বসে রইলো সে।

    সাত নাম্বার টেবিলে বসেই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবারো আশেপাশে কৌতূহল নিয়ে দেখলো জামিল আহমেদ। সে জানে এরকম মিটিংয়ের অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারা একটু নার্ভাস থাকে। মি: আহমেদকেও কিছুটা নার্ভাস দেখাচ্ছে।

    ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের নীচে হবে। শারীরিকভাবে বেশ ফিট। ক্লিনশেভ আর পরিপাটি আচড়ানো চুল। ছাইরঙা ব্লেজার আর কালো প্যান্টে বেশ অভিজাত একটি ভঙ্গি প্রকাশ পাচ্ছে। পায়ের ভ্যাগাবন্ড জুতো। হাতঘড়িটা দূর থেকে দেখেও আন্দাজ করা যাচ্ছে বেশ দামি একটি ব্র্যান্ডের হবে। তবে চেহারায় কেমনজানি বিষণ্ণ-বিষণ্ণ ভাব রয়েছে।

    টেবিলে বসার পর মাত্র দু-তিন মিনিটেই অস্থির হয়ে উঠলো জামিল আহমেদ আন্দোলন। মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। আস্তে করে উঠে সাত নাম্বার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তাকে দেখে ভদ্রলোক একটু চমকে উঠলো। খালি চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো সে।

    “মি: জামিল আহমেদ, আমার সাথেই আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।”

    ভদ্রলোক চোখ পিটপিট করে তাকে দেখতে লাগলো।

    এরকম দৃষ্টির সাথে সে পরিচিত। যারা তাকে কন্ট্রাক্ট করতে আসে তাদের প্রায় সবাই তাকে দেখার পর এমন আচরণ করে খুনি হিসেবে যেরকম ছবি কল্পনা করে তার সাথে একদমই মেলে না বলে। ভেতরে ভেতরে যে ভিরমি খায় সেটা খুব কম লোকজনই লুকোতে পারে।

    “কি-কি খাবেন?” একটু তোতলালো জামিল আহমেদ। কথা শুরু করবে কিভাবে বুঝতে পারছে না।

    “কফি,” ছোট্ট করে বললো সে। “শুধুই কফি।”

    ওয়েটারকে ইশারায় ডেকে দু-কাপ কফির অর্ডার দিলো ভদ্রলোক। “কফি খেতে খেতে কথা বলি, কি বলেন?”

    “আপনি শুরু করুন, কফির জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই।”

    একটু চুপ থেকে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো জামিল আহমেদ। “ইয়ে মানে…কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।”

    “লোকটা কে?” ভদ্রলোককে আমতা আমতা করতে দেখে সরাসরি প্রশ্ন করলো বাস্টার্ড। “আর কেন এটা করতে চাচ্ছেন?”

    স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জামিল আহমেদ। তার সামনে যে খুনি বসে আছে সে কেবল দেখতেই হ্যান্ডসাম নয়, কথাবার্তাও স্মার্ট। গভীর করে দম নিয়ে বললো, “মওলানা ইউসুফ হোসাইনী।”

    বাস্টার্ডের কপাল সামান্য কুচকে গেলো। “মওলানা?”

    আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো মি: আহমেদ।

    “আপনি তো একজন ব্যবসায়ি, এইসব মওলানাদের সাথে কী নিয়ে। লাগলো?”

    গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো ভদ্রলোক। “লম্বা কাহিনী।”

    “ছোট্ট করে বলুন।”

    জামিল আহমেদ আন্দোলন কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো। “ওই বদমাশটা আমার বাবাকে খুন করেছে।”

    “ও।” বুঝতে পেরেছে সে। তার আগের ক্লায়েন্টের মতোই একটি ঘটনা। “কেস করেছিলেন, মামলাও হয়েছিলো কিন্তু আসামী বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে?” মুচকি হাসলো। “প্রথমে আদালতের উপরে আস্থা রেখেছিলেন, পরে দেখলেন কোনো লাভ হলো না?”

    আলতো করে মাথা দোলালো ভদ্রলোক। “না। আমার ঘটনা সে-রকম নয়,” কথাটা বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আবার, “আমরা আসলে কোনো মামলা করি নি…করতে পারি নি।”

    “কেন?”

    “ওটা ১৯৭১ সালের ঘটনা।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো সে। ‘৭১ মানে তার জন্মেরও আগের ঘটনা। মনে মনে মুচকি হাসলো। জন্মের আগের ঘটনা মিমাংসা করতে বলা হচ্ছে তাকে।

    “১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১,” জামিল আহমেদ নির্দিষ্ট করে বললো এবার।

    “ও,” ঘটনাটা শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে বলে অবাকই হলো।

    “আমার বয়স তখন দশ-এগারো,” ভদ্রলোক বলতে শুরু করলো, “আমার বাবা ছিলেন নামকরা চিকিৎসক…টুকটাক রাজনীতি করতেন…মানে সমর্থন করতেন আর কি। চৌদ্দই ডিসেম্বর বিকেলে বাবাকে আমাদের বাসা থেকে মওলানা তুলে নিয়ে যায়।”

    কথাটা বলেই বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে গেলো জামিল আহমেদ আন্দোলন। তিক্ত স্মৃতি স্মরণ করার যন্ত্রণা ফুটে উঠলো তার চোখে মুখে। বাস্টার্ডও কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে শহীদের সন্তানকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করলো। তার নিজের বাবা-মা কে সে জানে না। যাকে বাবা বলে জানে সে আছে জেলে। তাকে ঐ লোক কোত্থেকে নিয়ে এসেছিলো তাও তার অজানা। তারপরও বাবা-মায়ের প্রতি, এমনকি পালক-বাবার প্রতিও তার যে আবেগ সেটা হিসেবে নিয়ে ভেবে দেখলো, মি: আহমেদের জায়গায় সে হলে কেমন অনুভব করতো। ভদ্রলোকের চোখের দিকে ভালো করে তাকালো। আবেগে তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ আন্দোলিত হচ্ছে যেনো।

    “…আমার চোখের সামনেই…” অনেকক্ষণ পর প্রায় অস্ফুটস্বরে বললো জামিল আহমেদ। তার চোখে ভেসে উঠলো বহু পুরনো আর দগদগে ঘায়ের একটি স্মৃতি। তিনযুগেরও বেশি আগের ঘটনা কিন্তু তার কাছে মনে হয় এই সেদিন, এই তো কদিন আগে তার চোখের সামনে ঘটে গেছে। এমনকি ঐদিনের আকাশে বাতাসে যে গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিলো তাও স্পষ্ট মনে করতে পারে।

    অধ্যায় ৪

    অবরুদ্ধ ঢাকা
    ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১

    শীতের পড়ন্ত বিকেলে নিজেদের বাড়ির দোতলায় কী যেনো করছিলো দশ বছরের আন্দোলন, হঠাৎ শোরগোল শুনে বেলকনিতে এসে দেখে তাদের বাড়ির সামনে একটি সাদা রঙের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

    তার বাবার কাছে প্রায়ই বিভিন্ন ধরণের লোকজন আসে। তারা যখন আসে তখন তাকে দোতলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাবা-মা চায় না ছোট্ট আন্দোলন কিছু বুঝুক। কিন্তু সে ঠিকই বোঝে ওরা কারা। তার বয়স কম হতে পারে কিন্তু এটুকু বোঝার ক্ষমতা ঠিকই আছে। সে কি একদিন শুনতে পায় নি তার মা বলছিলো, এভাবে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা খুবই বিপজ্জনক?

    যাহোক, গাড়ির সামনে দু-জন যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট আন্দোলনও মনে করে নি ওরা মুক্তিযোদ্ধা। কারণ ওরা কখনও এভাবে গাড়িতে করে তাদের বাসায় আসে না। ওরা আসে লুকিয়ে লুকিয়ে। আর কখন চলে যায় সেটা সে জানতেও পারে না।

    দু-জনের মধ্যে একজন বেশ লম্বামতো, পরনে কালো প্যান্ট, ঘিয়েরঙা শার্ট। ক্লিনশেভ। মাথার চুলগুলো সুন্দর করে একপাশে আচড়ানো। আয়েশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে। তার চোখেমুখের অভিব্যক্তি মোটেও প্রীতিকর নয়। কেমন চাপা আর উন্মত্ত এক হিংস্রতা ভর করেছে যেনো। লোকটার চোখ দুটো লাল টকটকে, রাতে ঘুম না-হলে যেমন হয়। সিগারেটে টান দিয়ে বার বার তাদের বাড়ির মেইনগেটের দিকে তাকাচ্ছে চাপাক্ষোভের সাথে। তখনই লোকটির শরীরে বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য দশ বছরের আন্দোলনের চোখে পড়লো।

    একটু পরই সে দেখতে পেলো পাঁচ-ছয়জন লোক তার বাবাকে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। বাবার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর প্যান্ট। একটু আগেই চেম্বার থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। বাবার হাত দুটো একটা গামছা দিয়ে পেছনমোড়া করে বাধা। মাথার চুল এলোমেলো। লোকগুলো বাবাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাবার সময় তার মা ছুটে এসে হাতজোর করে মিনতি জানাচ্ছে, চোখের জলে অনুনয়-বিনয় করে স্বামীকে ছেড়ে দেবার আকুতি করছে, কিন্তু যুবকেরা ভাবলেশহীন।

    অবরুদ্ধ ঢাকা। পঁচিশে মার্চের রাত থেকে সবকিছু পাল্টে গেছে। চারপাশে যুদ্ধ-যুদ্ধ আতঙ্ক। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে ঢাকায় যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তাতে করে ছোট্ট আন্দোলনের বুক ধরফর করে উঠলো অজানা আশংকায়। এমন কোনো রাত নেই যে গোলাগুলি আর মানুষজনের চিৎকার শোনা যায় না। পথেঘাটে গুলিবিদ্ধ লাশের দেখা পাওয়াটাও বিরল নয়। সে নিজে এরকম দৃশ্য দেখেছে একবার। তার মা সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলো। প্রায়ই শোনা যায় লোকজন বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসছে না। নিজের বাড়ি থেকেও ডেকে নিয়ে যাবার পর অনেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পাক-সরকার জোর করে স্কুল-কলেজ খোলার হুকুম দেয়। আন্দোলন আবার স্কুলে যেতে শুরু করে কিন্তু ক্লাসের উপস্থিতি অর্ধেকের নীচে নেমে আসে। মাঝে-মধ্যে কয়েকদিনের জন্য বন্ধ থাকলেও নভেম্বর পর্যন্ত স্কুল খোলা ছিলো। এরপর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন চাপাকণ্ঠে বলাবলি করছে মুক্তিযোদ্ধারা নাকি ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছে। সন্ধ্যার পর কাফু, রাস্তায় বের হওয়া নিষেধ। ভীতিকর এক পরিবেশ। এমনকি দিনের বেলায়ও পাড়ার বন্ধুদের সাথে খেলতে পারে না। অবশ্য খুব বেশি পাড়াতোবন্ধু নেই, তাদের অনেকের পরিবারই শহর ছেড়ে চলে গেছে।

    কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে ভারতীয় বিমান হামলা। ঢাকার আশেপাশে বোমা ফেলা হচ্ছে। যখনই বিমান হামলা শুরু হয় তার কানে তুলো খুঁজে দেয় মা। শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানী মিলিটারি নাকি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আর ক-দিন বাদেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।

    আন্দোলন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো, তার মা, দাদি আর বুড়ো কাজের লোক হোসেন মিয়ার অনুনয়-বিনয় আর সমস্ত আকুতি বৃথা হয়ে গেলো। জিপগাড়িটা চলে গেলো তার বাবাকে নিয়ে। জিপে ওঠার আগে কী মনে করে যেনো তার বাবা ঘুরে তার দিকে তাকিয়েছিলো। বাপ-ছেলের মধ্যে কয়েক মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায় তখন। তার বাবার চোখের ভাষা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলো সে। তারপর থেকে এই দৃশ্যটি চিরকালের জন্য তার মনে গেঁথে রইলো। বাবার সেই চোখ, করুণ অভিব্যক্তি এখনও তার স্বপ্নে হানা দেয়। পনেরো-ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত বাবার ঐ চাহনিটা স্বপ্নে দেখে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠতো। বাবা-বাবা বলে কান্না জুড়ে দিতো। মা এসে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতো তাকে। সে-সব কথা মনে পড়লে আজো তার গায়ের রোমকূপ আন্দোলিত হয়। বেদনার এক সুতীব্র আবেগ এসে ভর করে বুকে। মেট্রিক পাশ করার পরও সে এই স্বপ্ন দেখতে কিন্তু তখন আর ঘুম থেকে চিৎকার দিয়ে জেগে উঠতো না, কান্নাও জুড়ে দিতো না। শুধু বিছানায় বসে থাকতো মূর্তির মতো। সত্যি বলতে, আজো, এই বয়সে এসে মাঝেমধ্যে ঐ স্বপ্নটা দেখে। ঘুম ভেঙে যায়। তারপর বাকি রাত আর ঘুমাতে পারে না, চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে।

    পাষণ্ডদের জিপটা তাদের বাড়ির সামনে থেকে চলে যাবার পর আর কোনো দিন তার বাবা ফিরে আসে নি। এমনকি তার লাশটাও পাওয়া যায় নি কোথাও। এ ঘটনার মাত্র দুদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারা কেউ ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় উৎসব করতে পারে নি। তার পরিবার আর আত্মীয়স্বজন বাবাকে খুঁজতে হন্যে হয়ে বেরিয়ে পড়ে ঢাকা শহরে। রাজাকার, আল-বদর আর পাকিস্তানী মিলিটারিদের যতো ক্যাম্প আছে সবখানে তারা খুঁজে দেখেছে কোথাও বাবাকে পাওয়া যায় নি। রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতেও মেলে নি গলিত কোনো লাশ। তারপরও খোঁজার আশা বাদ দেয় নি তার পরিবার-আত্মীয়স্বজন। সে এক অন্তহীন খোঁজা। বড়রা নিজের কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝে গেছিলো তার বাবার পরিণতি কি হয়েছে কিন্তু তাদের মনে ক্ষীণ আশা তখনও নিঃশেষ হয়ে যায় নি।

    সব কিছুর যেমন শেষ আছে তেমনি এই খোঁজাখুঁজিরও শেষ হলো একদিন। সে বুঝে গেলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না তার বাবা। চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার সময় তার জন্য কোনো খেলনা কিংবা লজেন্স, পেস্ট্রি কিংবা মিষ্টি নিয়ে আসবে না। মা আর কোনোদিন বলবে না, সকালে বাবা যখন চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়ে তখন যেনো তাকে বিরক্ত করা না হয়। টিচাররা আর কখনও তার বাবার চেম্বারের টেলিফোন নাম্বারটা চাইবে না। খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাবার ভয়ে বাড়িতে ফেরাটাও হবে না। আর। একাত্তরের অসংখ্য শহীদের দলে তার বাবাও যে যোগ দিয়েছে।

    অধ্যায় ৫

    “আপনার কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

    “ও।” বাস্টার্ডের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো জামিল আহমেদ আন্দোলন। সংক্ষেপে নিজের জীবনের সেই ভয়াল সময়টির কথা বলার পরই আনমনা হয়ে পড়েছে।

    কফির কাপটা তুলে নিলো সে।

    “বুঝলাম। কিন্তু আপনি একটু অপেক্ষা করে দেখতে পারেন…শোনা যাচ্ছে ওদের বিচার করার জন্য ট্রাইবুনাল করা হবে। তখন নিশ্চয় ওখানে কেস ফাইল করতে পারবেন?”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো জামিল আহমেদ। রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করার মতো বোকা সে নয়। এর আগে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত রাজনীতির হিসেব-নিকেশ আর ক্ষমতার লোভের কাছে হেরে যায় সমস্ত আবেগ। এবার যদি সত্যি সত্যি বিচার করা হয়ও তারপরও কথা থেকে যায়। উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতার সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সম্ভাব্য বিজয়ি দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাকে বলেছে নির্বাচনে জয়ি হলে কমপক্ষে বিশ-পঁচিশজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে এবার। কিন্তু…

    উদাসিনতা কাটিয়ে টেবিলের ওপাশে তাকালো। কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে পেশাদার খুনি। যেনো তার আবেগকে সংযত হবার সময় দিচ্ছে। “যে ট্রাইবুনালের কথা বলছেন তার ক্ষমতা হবে না ঐ নরপিশাচের বিচার করা।”

    “ঐ মওলানা কি অনেক শক্তিশালী? কোনো পার্টি করে?”

    স্থির চোখে চেয়ে রইলো আন্দোলন। “না।”

    “তাহলে?”

    “মওলানা দেশে থাকে না।”

    নড়েচড়ে উঠলো সে। “…কোথায় থাকে?”

    দাঁতে দাঁত চেপে বললো ভদ্রলোক, “পাকিস্তানে।”

    ওহ! এই একটি দেশই আছে যেখানে কখনও যাওয়ার ইচ্ছে হয় নি, কোনোদিন যে যেতে হবে কল্পনাও করে নি।

    জামিল আহমেদ কফিতে চুমুক দিয়ে আবারো চুপ মেরে গেলো। দশ বছর বয়স থেকে পিতার হত্যাকারীর মুখটা সে মনে রেখেছে এই আশায়, একদিন নরপশুটাকে দেখে ঠিক ঠিকই চিনতে পারবে। আজ সাইত্রিশ বছর পর হঠাৎ করেই সেটা ঘটে গেলো কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না, কারণ লোকটা পাকিস্তানে থাকে!

    ইসরাইল কি ইহুদি হত্যাকারী নাৎসিদের অন্য দেশ থেকে ধরে ধরে এনে বিচার করে নি? তারা কি তাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি বিশেষ দল তৈরি করে সারাবিশ্বে লুকিয়ে থাকা নাৎসিদের খোঁজার কাজে নিয়োজিত করে নি? যাদের ধরে এনে বিচার করা সম্ভব হয় নি তাদের কি গুপ্তহত্যা করে শেষ করে দেয় নি?

    তার মা দীর্ঘ ত্রিশ বছর অপেক্ষা করেছে স্বামীর হত্যাকারীর বিচারের জন্য। অবশেষে একটা আক্ষেপ নিয়েই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। এখন দেখতে দেখতে তার বয়সও কম হলো না। সেও কি একই আক্ষেপ নিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে?

    অনেক ভেবে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে একেবারে ভিন্নভাবে এটা করবে সে, এরজন্যে যতো টাকাই লাগুক না কেন।

    “পাকিস্তানের করাচিতে…” অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আস্তে করে বললো জামিল আহমেদ।

    একটা শহরই বটে! মনে মনে বললো বাস্টার্ড। মোহাজেরদের সাথে স্থানীয়দের রক্তারক্তি লড়াই, শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা আর শুক্রবার হলেই একদল ঈমানদার লোক জেহাদি জোশ নিয়ে আরেকদল নামাজির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    “আপনি কিভাবে জানলেন মওলানা ওখানে থাকে? চিনলেনই বা কেমন করে?”

    “গত মাসে আমি দুবাই থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম, তখন প্লেনে দেখা হয়, ওয়েটার চলে যাবার পর বললো মি: আহমেদ। “ঘটনাচক্রে আমরা পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম।”

    একটু অবাকই হলো সে। ঘটনাচক্র আর কাকতালীয় ব্যাপারগুলো কতোই না বিস্ময়কর হতে পারে। মানুষের জীবনে এগুলো বিশাল প্রভাব ফেলে। কখনও সেটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করে, আবার কখনও দারুণ সুযোগ তৈরি করে দেয়।

    “আপনার বাবার ঐ ঘটনার পর মওলানাকে আর কখনও দেখেছেন?”

    এ প্রশ্নে অবাক হলো আন্দোলন। “না।”

    “পত্রিকায় তার কোনো ছবি?”

    মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো শহীদের সন্তান। যুদ্ধের পর মওলানার টিকিটাও দেখা যায় নি। তার কোনো ছবিও জোগাড় করতে পারে নি তারা। শুধু ভাসা ভাসা কিছু তথ্য ছাড়া।

    “তাহলে এতোদিন পর লোকটাকে দেখে কিভাবে চিনতে পারলেন?” কফিতে চুমুক দিয়ে সঙ্গত প্রশ্নটিই করলো সে। তার কথায় সন্দেহের আভাস সুস্পষ্ট।

    গভীর করে দম নিলো জামিল আহমেদ আন্দোলন। “তাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয় নি, এ-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত,” বেশ জোর দিয়ে বললো কথাটা।

    “এতোটা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। আপনার তো ভুলও হতে পারে?” বাজিয়ে দেখতে চাইলো।

    মাথা দোলালো ভদ্রলোক। “আমার কোনো ভুল হয় নি।”

    এরকম দৃঢ়তা দেখে অবাক হলো সে। “কিভাবে বুঝলেন ভুল হয় নি? এতোদিন পর নিশ্চয় তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে? তিনযুগ আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলেন…ভুল তো হতেই পারে।”

    জামিল আহমেদ আন্দোলন বাস্টার্ডের দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। ছেলেটা যা বলছে তা একদম যৌক্তিক কিন্তু ঐ লোকটাকে যে সে সঠিকভাবেই চিনতে পেরেছে এটা তার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।

    “কিছু মনে করবেন না, এসব কথা বলছি, কারণ আমি কোনো ভুল মানুষের পেছনে লাগতে চাই না। তাছাড়া ভুল লোককে হত্যা করে আপনারও কোনো ফায়দা হবে না। টাকাগুলো নষ্ট হবে…আপনার আক্ষেপ আরো বেড়ে যাবে।”

    “আপনি ঠিকই বলেছেন,” আস্তে করে বললো জামিল আহমেদ। “এতোগুলো বছরে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু আমি তাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। তার সেই চোখ, সেই চাহনি আর হাতের সেই ছয়টি আঙুল…এটা আমার পক্ষে কখনও ভোলা সম্ভব নয়।”

    “ছয়টি আঙুল?” অবাক হলো সে।

    “হুম। লোকটার ডান হাতে ছয়টি আঙুল। যাকে বলে পলিডাকটাইলি।”

    “শুধু এটা দেখেই আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন? এরকম ছয়-আঙুলের লোকজন আরো অনেক থাকতে পারে।”

    “তা জানি। তবে আরো কিছু ব্যাপার আছে।”

    “যেমন?”

    “সব পলিডাকটাইলি মানুষের কড়ে আঙুলের পাশে বাড়তি আঙুল থাকে না। কারো কারো বুড়ো আঙুলের উপরে থাকে…কারোটা আবার খুব স্বাভাবিক দেখতে হয়।”

    বাস্টার্ড চুপচাপ শুনে যেতে লাগলো কথাগুলো।

    “ঐ লোকের কড়ে আঙুলের পাশে বাড়তি যে আঙুলটা আছে সেটা একটু বিকৃত। কোনো কাজে লাগে না।”

    আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

    “আরেকটা ব্যাপার, একাত্তরে লোকটার নাম ছিলো ইউসুফ আলী, এখন মওলানা ইউসুফ হোসাইনী। অন্য অনেকের মতো নামটা পুরোপুরি পাল্টায় নি। যোগ-বিয়োগ করেছে শুধু।” একটু থেমে আবার বললো শহীদের সন্তান, “এভাবে অনেকেই নিজেদের নাম পাল্টে নিয়েছে। এদের অনেকেই দেশে বসবাস করে। অনেকেই নামের আগে ‘মওলানা’ টাইটেলও জুড়ে দিয়েছে।”

    “হুম,” বললো বাস্টার্ড। এটা সে জানে। নিজেদের জঘন্য অতীত মুছে ফেলার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে পৈতৃক নামটাকে অনেকেই সামান্য বদলে নিয়েছে। নতুন নাম, নতুন পরিচয়, নতুন একজন মানুষ-কুখ্যাত অতীতের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার একটি কৌশলী প্রচেষ্টা।

    “তারচেয়েও বড় কথা কয়েকদিন আগে আমি একটি বই হাতে পেয়েছি,” বললো জামিল আহমেদ, “একাত্তরের ঘাতকেরা কে কোথায় নামের ঐ বইতে উল্লেখ আছে, তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা, বদরবাহিনীর কমান্ডার ইউসুফ আলী বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাস করছে।”

    “হুম, বুঝেছি।”

    জামিল আহমেদ আন্দোলনের মুখে হাসি দেখা গেলো না, নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলো সে।

    “কিন্তু ঐ লোক করাচির কোথায় থাকে তা কি আপনি জানতে পেরেছেন?”

    “না,” জবাব দিলো ভদ্রলোক। “তবে ওর বিজনেস-কার্ড আছে আমার কাছে। মনে হয় ওটা দিয়ে খুব সহজেই ওকে খুঁজে বের করা যাবে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। বিজনেস-কার্ড খুবই ইনফর্মেটিভ হয়ে থাকে। “ঐ লোক কি ধরণের বিজনেস করে ওখানে?”

    “বিজনেস-কার্ডে লেখা আছে ফিশারিজের কথা। আমার সাথে কথাবার্তা বলার সময়ও বলেছে মিডল-ইস্টে মাছ এক্সপোর্ট করে। এ-কারণেই প্রচুর জার্নি করতে হয় তাকে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

    খুনি কিছু বললো না দেখে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে উঠলো আবার, “আমার মনে হয় এই লোকটা টার্গেট হিসেবে খুবই সহজ। বিশেষ করে আপনার মতো কারোর জন্য।”

    নির্বিকার রইলো সে। কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন প্রশংসা রয়েছে। “টার্গেটের কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?” কাজের কথায় চলে গেলো সরাসরি।

    আস্তে করে মাথা দোলালো ভদ্রলোক। “না।”

    “শুধু বিজনেস-কার্ড…কোনো ছবি নেই,” অনেকটা আপন মনে বলে উঠলো। “তার মানে তাকে খুঁজে বের করতে হবে আগে। এটা একটা সমস্যা।”

    “এই সমস্যাটা মনে হয় খুব সহজেই সমাধান করা যাবে,” বললো মি: আহমেদ।

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাস্টার্ড।

    “আপনি আমার রেফারেন্স নিয়ে ওই লোকের সাথে দেখা করতে পারেন।”

    একটু অবাক হলো সে। “আমি ওই লোকের সাথে দেখা করবো?” টার্গেটের সাথে দেখা করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ আর হয় না। এটা তার পদ্ধতিও নয়।

    “এমনি এমনি তো আর যাচ্ছেন না…আপনি যাবেন একটা কাজে।”

    “কি কাজে?”

    “ওর একটা জিনিস আছে আমার কাছে, ওটা ফেরত দিতে যাবেন।”

    “কি জিনিস?”

    “একটা বই।”

    “বই?” আবারো অবাক হলো সে।

    “হুম। প্লেনে আমাদের মধ্যে খুব একটা কথাবার্তা হয় নি। ওই লোক যখনই জানতে পেরেছে আমি বাংলাদেশী তখন থেকেই একটু রিজার্ভ হয়ে গেছিলো। আমিই আগ বাড়িয়ে যা বলার বলেছি, অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেছি। সৌজন্যতার খাতিরে সে কথা বলতে বাধ্য হয়েছে বলতে পারেন, একটু থেমে আবার বললো, “ওর হাতে একটা বই ছিলো…পলিটিক্যাল অ্যানালিসিস টাইপের নন-ফিকশন। আমি ওটা পড়ার কথা বলে ওর কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম, পরে আর ফেরত দেই নি। মানে খেয়াল ছিলো না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওটা ফেরত দেবার কথা বলে আপনি ওর সাথে দেখা করতে পারেন।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। বুঝতে পেরেছে সে। অবশ্য তার কাছে। মনে হচ্ছে না মি: আহমেদ বেখেয়ালে কাজটা করেছে। আর যদি করেও থাকে, টার্গেটের খুব কাছে পৌঁছে যাওয়ার মতো দারুণ একটা জিনিস বাগিয়ে নিতে পেরেছে। “হুম…বইটা কাজে লাগানো যেতে পারে।”

    জামিল আহমেদকে সন্তুষ্ট দেখালো।

    “কিন্তু টার্গেট সহজ হলেও এই মিশনটা খুব কঠিন।”

    ভুরু কুচকালো আন্দোলন। “লোকটা একজন ব্যবসায়ি, নিশ্চিন্তে করাচি শহরে বসবাস করছে…একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ।

    “হুম, তা ঠিক। কিন্তু সমস্যাটা অন্যখানে।”

    জামিল আহমেদ আন্দোলন বুঝতে পারলো দেশটা পাকিস্তান, তার উপরে করাচি শহর। ওরকম একটি জায়গায় গিয়ে কোনো কাজ করাটা সত্যিই কঠিন। “পাকিস্তানের মতো একটি দেশে গিয়ে কাজ করার কথা বলছেন তো?”

    মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “না। একদিক থেকে দেখলে পাকিস্তান বলেই কাজটা করা বরং সহজ হবে। যেখানে আইনের শাসন আছে, সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক চলে সেখানেই বরং এরকম কাজ করা কঠিন। তাছাড়া টার্গেটটাও মনে হচ্ছে সহজই। “

    “তাহলে আপনি কিসের কথা বলছেন?”

    “রিসোর্স,” একটু থেমে বললো বাস্টার্ড, “ওখানে আমার কোনো রিসোর্স নেই।”

    জামিল আহমেদ চুপ মেরে রইলো। বুঝতে পারছে না কী বলবে।

    “বিশ্বস্ত রিসোর্স ছাড়া দেশের ভেতরে কাজ করাই খুব কঠিন, করাচিতে সেটা করা প্রায় অসম্ভব।”

    মি: আহমেদ হতাশ হয়ে চেয়ে রইলো তার সামনে বসা খুনির দিকে। এর সম্পর্কে যা শুনেছে সবটা তাহলে সত্যি নয়। সাধারণত যা হয়, মানুষ একটু বাড়িয়েই বলে। হয়তো সে নিজের কাজে সেরা কিন্তু অতটা নয় যে, করাচিতে গিয়ে কাউকে খুন করে আসতে পারবে।

    “তাই এ মুহূর্তে আমি আপনার প্রস্তাবটায় রাজি হতে পারছি না…আমাকে একটু সময় দিতে হবে,” বললো সে। “তিনদিন পর আপনাকে জানাচ্ছি।”

    আন্দোলনের মুখ থেকে হতাশার কালোছায়া কিছুটা সরে গেলো। ভেবেছিলো সরাসরি না করে দেবে। অস্ফুটস্বরে বললো, “ঠিক আছে। তাহলে আপনি আমাকে কিভাবে জানাচ্ছেন?”

    “ফোনে। তিনদিন পর আমি ফোন করে আবারো দেখা করার সময় বলে দেবো আপনাকে।”

    কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। কোনোরকম সৌজন্যতা না দেখিয়ে চলে গেলো।

    অপলক চোখে চেয়ে রইলো জামিল আহমেদ আন্দোলন। এরকম খুনি জীবনেও দেখে নি। পরক্ষণেই তার মনে হলো, দীর্ঘ এই জীবনে খুব বেশি খুনি দেখেও নি। সত্যি করে বললে, মাত্র দু-জনকে দেখেছে। একজনকে সেই তিনযুগ আগে, আর দ্বিতীয়জনকে এইমাত্র। তবে কোনো খুনির সাথে এক টেবিলে বসে এই প্রথম কথা বললো। অবশ্য একবারের জন্যেও তার মনে হয় নি লোকটা পেশাদার কোনো খুনি হতে পারে।

    আজকাল তাহলে স্মার্ট লোকজনও খুনখারাবিকে প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছে! মনে মনে বলে উঠলো সে।

    অধ্যায় ৬

    করাচি
    অজ্ঞাত সেফহোম

    মুজাহিদ ঘরের এককোণে জড়োসরো হয়ে বসে আছে। বুজুর্গকে সে এর আগে কয়েকবারই রাগতে দেখেছে, বেশিরভাগ সময়ই তার উপরে কিন্তু আজকের মতো কখনও দেখে নি। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো বুজুর্গ আজ তার উপরে রাগ করছে না।

    লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো। চেহারাটা কেমনজানি রাগি-রাগি। দেখতে একদম গাব্বার সিংয়ের মতো লাগছে। শুধু দাড়িটা একটু বড়, মাথার চুল ছোটো ছোটো। চোখ আর কথা বলার ভঙ্গি একদম গাব্বারের মতো! এমন কি শরীরটাও। গাব্বার যেভাবে তার চেলাদের সাথে রেগে রেগে কথা বলে বুজুর্গ এখন ঠিক সেভাবেই তাদের সাথে কথা বলছে। যেনো তারা দশজন এক একটা কালিয়া!

    মুজাহিদ একটু ভয়ে আছে। তিনজন পালানোর ঘটনা সে আগে থেকেই জানতো কিন্তু কাউকে কিছু বলে নি। ঐ তিনজন তাকেও বলেছিলো ওদের সাথে যোগ দিতে, রাজিও হয়েছিলো সে কিন্তু শেষ মুহূর্তে হুট করেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে। তার মনে হয়েছিলো এভাবে পালিয়ে গেলে তার বাবা আর পরিবার হয়তো বিপদে পড়ে যাবে। দাওয়ার লোকজন ওদের উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু করে ফেলতে পারে।

    “আমরা তখন ঘুমিয়ে ছিলাম…সবাই, কাঁচামাচু ভঙ্গি করে দুর্বল উর্দুতে বললো লম্বামতো এক পশতুন। তার এখনকার নাম বাদা।

    “সবাই ঘুমিয়ে ছিলে?!” চেঁচিয়ে উঠলো বুজুর্গ। “দশজন মানুষ মরার মতো পড়ে থাকলো আর তিনজন পালালো, কেউ টেরই পেলে না?!” বুজুর্গ যেনো কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তিনজন মানুষ কি করে দশজনের মধ্য থেকে সটকে পড়তে পারলো। “এই হলো এতোদিনের শিক্ষা!” হাত ছুঁড়ে বললেন তিনি। “এই তোমাদের শিক্ষা দিলাম!” জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন আবার। “আমি কি জবাব দেবো উপরওয়ালার কাছে?”

    সবাই নিরুত্তর রইলো। মুজাহিদ বুঝতে পারলো না ‘উপরওয়ালা’ বলতে বুজুর্গ কি বুঝিয়েছেন। একজন তো অনেক উপরে বসে আছেন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি, সারা-জাহানের মালিক!

    নাকি তাদের দলের উপরমহলে বসে থাকা কারোর কথা বলছে? তার ভাবনায় ছেদ পড়লো বুজুর্গের গমগমে কণ্ঠে।

    “তোমাদের রক্তে জেহাদের জোশ তৈরি করতে পারলাম না…এটা আমারই ব্যর্থতা। মনে হচ্ছে তোমরা কেউ শাহাদাতকে বরণ করতে চাও না! চাও দুনিয়ার মওজ লুটতে!”

    “বুজুর্গ?” মিনমিনে গলায় বললো ছোটোখাটো গড়নের নাজিহ্। যে কিনা ‘হায় ভগবান’ প্র্যাকটিস করা নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে আছে বিগত কয়েকদিন ধরে। সে একজন সাচ্চা মুসলমান। ইসলামের খেদমতে সে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তত। আর তাকে কিনা মালোয়ানদের খোদার নাম জপ করতে দিয়েছে!

    “কি?” চেঁচিয়েই জবাব দিলো বুজুর্গ।

    “যারা গেছে তাদেরকে গালাগালি করেন সমস্যা নেই, আমরা যারা ইসলামের জন্য এখনও জান-কুরবান করতে প্রস্তত তাদের নিয়ত নিয়ে কথা বলাটা কি ঠিক হচ্ছে?”

    বুজুর্গ যেনো বেমক্কা ধাক্কা খেলো। রাগে ফেটে পড়বে কিনা বুঝতে পারলো না। ছেলেটা যা বলেছে তার সবটাই সত্যি, তবে সত্যিটা বেয়াদপের মতো করে বলেছে।

    “তাদেরকে আমি কোথায় পাবো!?” চিৎকার করে দু-হাত ছুঁড়ে বললো অবশেষে।

    সবাই মাথা নীচু করে রাখলো, শুধু প্রশ্নকর্তা বাদে। সে এখনও বুজুর্গের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, যেনো তার প্রশ্নের জবাব এখনও পায় নি।

    “কোথায় পাবো সে ইসব গাদ্দারগুলোকে? না জানি কত বড় ক্ষতি করবে তারা!”

    “ওরা আবার কী ক্ষতি করবে?”

    “কি ক্ষতি করবে?” দাঁতে দাঁত চেপে বললো বুজুর্গ। “এটা বোঝার মতো আল তোমার এখনও হয় নি?” হতাশ দেখালোলোকটাকে। “ওই বেঈমানগুলো যদি পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দেয়?”

    “কার কাছে ফাঁস করবে?” প্রশ্ন কর্তাকে এখন না-বুঝ বলে মনে হচ্ছে। “কার কাছে!” কপালে চাপড় মারলেন বুজুর্গ। “কার কাছে আবার, আমাদের শত্রুদের কাছে! যারা আমাদের ভাইদেরকে পশুপাখির মতো হত্যা করে। নামাজ আদায় করতে দেয় না। আজান দিতে বাধা দেয়। এমন কি যাদের কারণে আমাদের মুসলিম ভায়েরা কোরবানি দিতেও পারে না। তারা চায় মুসলমান হবে হিজড়ারদল! সব সময় তাদের পায়ের নীচে পড়ে থাকবে!”

    সবাই নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কিন্তু ঐ একজন নাছোরবান্দা। “এখানকার দায়িত্বে যারা আছে তারা কি করলো? আমরা তো একটু বাইরে যেতে চাইলেও তারা যেতে দেয় না। এমনকি জানালা খুলতে গেলেও বাধা দেয়। গতকাল ছাদে উঠতে গেছিলাম…তাও দেয় নি, অথচ আজ তিন-তিনজন পালিয়ে গেলো তাদের চোখের সামনে দিয়ে?”

    বুজুর্গ দাঁতে দাঁত চেপে বেয়াদপটার কথা হজম করে নিলো। “তোমরা সবাই প্রস্তত হয়ে নাও, একটু পর গাড়ি আসবে। আমরা সবাই অন্য জায়গায় চলে যাবো।”

    কাউকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই।

    “ওরা পালিয়ে গেলো কেন?” বাকিরা ঘরের বিভিন্ন অংশে জটলা পাকিয়ে নীচুস্বরে কথা বলায় ব্যস্ত হতেই ছোট্ট মুজাহিদ প্রথম সুযোগে প্রশ্নটা করে বসলো ইসমাইলকে।

    “ওরা মরতে ভয় পায় তাই পালিয়েছে, বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো সে।

    “মরতে তো সবাই ভয় পায়, তাই না, ভাইজান?”

    রেগেমেগে তাকালো ইসমাইল। না-বুঝ পোলাপানের সাথে কথা বললে এই এক সমস্যা। “সবাই ভয় পায় পাক। আমরা যারা ইসলামের খেদমতের জন্য জান-কুরবান করবে তাদের এতো মরার ভয় কেন? আমরা কি দোযখের আগুনে পুড়বো? জাহান্নামে পচে মরবো?” মাথা ঝাঁকালো সে। “আমরা তো সোজা জান্নাতে চলে যাবো। আমাদের কেন এতো ভয় থাকবে?”

    নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মুজাহিদ। “আমার কিন্তু মরার কোনো ভয় নেই। আমি তো এগুলো জানি।”

    ইসমাইল তাকালো ছেলেটার দিকে। “ভালো।”

    “আপনার, ভাইজান? আপনি কি মরতে ভয় পান?”

    “চুপ!” ধমক দিয়ে উঠলো ইসমাইল। “খালি বক-বক! এতো কথা কেন বলিস? যা, ব্যাগ গোছাতে শুরু কর। আমরা এখান থেকে চলে যাবো।”

    “আমরা কোথায় যাবো, ভাই?”

    “উফ!” বিরক্ত হলো ইসমাইল। “এটা তুই বুজুর্গকে গিয়ে বল…আমাকে এসব বলে বিরক্ত করিস না তো।”

    “না, বাবা, ঐ গাব্বার সিংকে কিছু বলা যাবে না। আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।”

    ইসমাইল ভুরু কুচকে তাকালো ছেলেটার দিকে। “গাব্বার সিং?”

    জিভ কাটলো মুজাহিদ। বুঝতে পারছে ভুল হয়ে গেছে।

    “তুই খুব সিনেমা দেখতি?”

    গাল চুলকালো সে। গ্রামে থাকতে ভিসিআর-এ কতো সিনেমা দেখেছে। বেশিরভাগই হিন্দি। তার প্রিয় নায়ক অমিতাভ বচ্চন ছিলো কিন্তু এখন সে বুড়ো হয়ে গেছে। হালজমানায় তার ভালো লাগে সালমান খানকে।

    মুখ টিপে হাসলো ইসমাইল। মুজাহিদের পিঠে আলতো করে চাপড় মেরে বললো, “যা, ব্যাগ গোছা। আমিও অনেকবার শোলে দেখেছি!”

    মুজাহিদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ইসমাইলের দিকে।

    “খবরদার, এটা কাউকে বলবি না।” চোখ টিপে বললো সে।

    নির্দোষ হাসি দিলো মুজাহিদ। “আচ্ছা।”

    অধ্যায় ৭

    জামিল আহমেদের সাথে দেখা করার পরদিনই পুরনো ঢাকার নবাবপুরের। আড়াইতলায় গিয়ে অবাক হলো সে। দরজায় বিশাল তালা লাগানো। শুটার সামাদকে ফোনে সব সময় পাওয়া যায় না, এদিকে গতকাল থেকে তার ফোন বন্ধ। ভেবেছিলো সরাসরি লে এলেই দেখা করতে পারবে, এখন দরজায় তালা দেখে বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে আর সেটা অবশ্যই খারাপ। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো সে। সামাদের সাথে যোগাযোগ করাটা ভীষণ জরুরি। তার আশংকা সাবেক শুটার হয়তো ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে কিছুদিনের জন্য। এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। সেটা যদি হয় তাহলে কম।ক্ষে দুয়েক সপ্তাহ লোকটার দেখা পাওয়া যাবে না।

    রাস্তায় নেমে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন এসব ভাবছে তখন হঠাৎ টের পেলো তার বাম বাহুটা স্পর্শ করেছে কেউ, একেবারে আলগোছে। একটু চমকে সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অল্প বয়সি এক ছেলে তাকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাত দিয়ে চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে দেখলেও সে নিশ্চিত এটা ঐ বোবা ছেলেটি। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সেও একদম স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শুরু করলো ওর পিছু পিছু। কেউ তাকে দেখলে বুঝতেই পারবে না একজনকে অনুসরন করছে।

    কিছু দূর যাবার পর বামদিকের একটা গলি দিয়ে ঢুকে পড়লো ছেলেটা। বিভিন্ন ধরণের হার্ডওয়্যার বিক্রির ছোটো-বড় অসংখ্য দোকান সেই গলির দু পাশে। আরেকটু সামনে এগোতেই বোবা আবারো বাম দিকে আরেকটি গলিতে ঢুকে পড়লো, তারপর ডানে। এই গলিটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি। বোবা এবার হাটা থামিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো হাসিমুখে।

    “ঘটনা কি?” জানতে চাইলো সে। এই ছেলেটা জন্ম থেকে বোবা নয় তাই কানে শোনে। “সামাদ ভাই কোথায়?”

    আমার সাথে আসুন, চিন্তার কোনো কারণ নেই, বোবা অঙ্গভঙ্গি করে বোঝানোর চেষ্টা করলো।

    “ঠিক আছে, আর কোনো কথা না বলে বোবার সাথে এগিয়ে চললো গলির আরো ভেতরের দিকে।

    কিছুক্ষণ পর গোলকধাঁধাতুল্য মহল্লার একটি বাড়ির তিনতলায় এসে পৌঁছালো তারা।

    শুটার সামাদ সোফায় পা তুলে টিভি দেখছে। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখে হেসে ফেললো। “আপদকালীন অবস্থায় আছি।”

    “কি হয়েছে?” অস্ত্রব্যবসায়ির পাশে বসে জানতে চাইলো সে।

    “গতকাল আমার একটা বাচ্চা’ ধরা খেয়েছে। এক বাল-পাকনা ছেলে নিয়েছিলো…সম্ভবত ও সব বলে দিয়েছে ডিবিকে।”

    “বলেন কি? তাহলে তো ওরা আপনার ঘরে রেইড দেবে।”

    “খবরটা পাওয়ার সাথে সাথেই সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছি,” হেসে বললো সামাদ। “চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। বাচ্চা মানে ছোটো অস্ত্র, পিস্তল। মাঝেমধ্যে এরকম অস্ত্র ধরা পড়ে, কখনও কখনও মারও খায়। ঘরের চারপাশে তাকালো সে। সম্ভবত এটা সামাদের কোনো আত্মীয়ের কিংবা বন্ধুর বাড়ি হবে। “আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম, আপনি বোধহয় ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন।”

    “বয়স হচ্ছে, ভাই…এখন আর গা ঢাকা দিতে ভালো লাগে না। আশেপাশেই সরে থাকি।” এরপর বোবা ছেলেটার দিকে তাকালো, “ভালো করে দুই কাপ চা নিয়ে আয় তো…ময়নার দোকান থেকে আনবি।”

    ছেলেটা চুপচাপ চলে গেলো ঘর থেকে।

    “এখন বলল, কি নিতে এসেছে। আমার সব জিনিস কিন্তু আশেপাশেই আছে…চাইলেই দেয়া যাবে।”

    “আমি কিছু নিতে আসি নি,” বললো সে। “অন্য একটা দরকারে এসেছি।”

    “কি দরকারে?” সামাদ অবাক হলো একটু।

    “আমি করাচিতে যেতে চাইছি…”

    ভুরু কুচকে ফেললো অস্ত্রব্যবসায়ি। করাচিতে?!”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ওখানে আমাকে হেল্প করতে পারে এমন কেউ আছে আপনার জানামতে?”

    “তুমি ওখানে…?”

    মুচকি হাসলো সে। কথাটা শুনে শুটার সামাদ যে অবাক হবে সেটাই স্বাভাবিক। ওরকম বিপজ্জনক জায়গায় গিয়ে কাজ করাটা কতো ঝুঁকিপূর্ণ তা আর বলে বোঝানোর দরকার নেই।

    “জায়গাটা কঠিন হলেও টার্গেট খুব সহজ,” জানালো সে। “কিন্তু সমস্যা একটাই-ওখানে আমার কোনো রিসোর্স নেই।”

    একটু চুপ থেকে বলে উঠলো অস্ত্রব্যবসায়ি, “কি ধরণের হেল্প চাচ্ছো?”

    “এই তো, আপনি যে-রকম হেল্প করেন আমাকে?”

    কথাটা শুনে একটু ভাবলো সাবেক শুটার। “শুধুই অস্ত্র নাকি তারচেয়েও বেশি কিছু?”।

    “আপনি তো জানেনই আমি একা কাজ করি। একটা অস্ত্র আর রেন্ট-এ কার জোগাড় করে দিলেই হবে।”

    “হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সামাদ। তার সাথে যে করাচির কানেকশান আছে সেটা বাস্টার্ড জানে। সে-কারণেই এমন সাহায্য চাইছে। “ওখানে আমার পরিচিত যে ছেলেটা আছে সে আবার ভালো ড্রাইভও করতে পারে। মানুষ হিসেবেও খুব ভালো, কিন্তু ওর সাথে কথা না-বলে তোমাকে কিছু বলতে পারছি না।”

    আশার আলো দেখতে পেলো বাস্টার্ড।

    “এক সময় ওর বড়ভায়ের কাছ থেকে সিকান্দার বন্দুক কিনতাম। কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে।”

    বাস্টার্ড জানে নব্বই দশকের দিকে পাকিস্তানের তৈরি সিকান্দার বন্দুক বেশ ভালো বিক্রি হতো আন্ডারওয়ার্ল্ডে। নিম্নমানের বন্দুক হলেও দামে খুব সস্তা আর সহজে এর গুলি পাওয়া যেতো বলে ব্যাপক চাহিদা ছিলো। তবে এটাই সামাদের সাথে করাচির একমাত্র কানেকশান নয়। পকিস্তান আমলে শুটার সামাদের বাবা করাচিতে থেকেছে অনেকদিন, ওখানেই এক মোহাজের পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে। স্বাধীনের পর ওরা সপরিবারে চলে আসে ঢাকায়। এখনও দু-তিন বছর পর পর সামাদ করাচিতে যায় ওর বৃদ্ধমাকে নিয়ে। নানার বাড়ির লোকজনের সাথে বেশ ভালোই যোগাযোগ আছে তার। তবে সত্যি বলতে এসব ছাড়াও করাচির সাথে শুটার সামাদের আরেকটি কানেকশান আছে, যেটা বলতে গেলে হাতেগোনা অল্প কিছু মানুষই জানে।

    বহু আগে থেকেই শুটার হিসেবে সামাদের দক্ষতা ছিলো প্রশ্নাতীত। নব্বইর পর স্বৈরাচারের পতন হলে সামাদ বছরখানেক সময়ের জন্য করাচিতে নানা বাড়িতে ছিলো। কারণ নভেম্বরের শেষের দিকে এক ছাত্রনেতার সাথে তারা সদলবলে যোগ দিয়েছিলো তৎকালীন সরকারের পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ছাত্র আন্দোলন নস্যাৎ করতে চেয়েছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়। স্বৈরাচার পতনের পর ডাক্তার মিলন হত্যা-মামলায় আসামী হিসেবে অন্য অনেকের সাথে সামাদের নামও ছিলো।

    যাহোক, একটা গুজব আছে, করাচিতে থাকার সময় মোহাজের কওমি মুভমেন্টের হয়ে সামাদ একজন স্নাইপার হিসেবে কাজ করেছে। তার নানাবাড়ির অনেকেই এই দলটির সাথে যুক্ত। ফলে ওখানকার সশস্ত্র রাজনীতি আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেককে সে ভালো করেই চেনে। বাস্টার্ডের ধারণা করাচির যে ছেলেটার কথা বলছে তার ভায়ের সাথে সেকান্দার বন্দুকের ব্যবসার কথাটা সত্যি নয়। সম্ভবত অন্য কোনো কারণে তাদের মধ্যে এই সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো।

    “কিন্তু এ মুহূর্তে সে তোমাকে ‘বাচ্চা ছাড়া আর কিছু দিতে পারবে বলে মনে হয় না। অবশ্য চাইলে ওখানকার ব্ল্যাক-মার্কেট থেকে তুমি যেকোনো অস্ত্রই কিনে নিতে পারবে। তবে একজন বাইরের লোক হিসেবে সেটা করতে গেলে ঝামেলা হয়ে যেতে পারে।”

    “কি রকম ঝামেলা?”

    “যে বিক্রি করবে সে যদি টের পায় তুমি বিদেশী তাহলে তোমার সাথে দুই নম্বরি করতে পারে। দেখা যাবে টাকা নিয়ে জিনিস দিলো না তোমাকে, সেক্ষেত্রে তুমি কিছুই করতে পারবে না।”

    “আমার অবশ্য হেভি জিনিস লাগবে না। আগেই বলেছি, টার্গেটটা খুব সহজ।”

    “তার মানে মিশনটা কঠিন,” গম্ভীর কণ্ঠে বললো সামাদ। এটা তার বহুদিনের পোড়খাওয়া অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। একমত না-হয়ে পারলো না।

    “টার্গেট আর মিশন দুটোই সহজ, এরকম খুব কমই দেখেছি,” বললো সাবেক শুটার।

    আবারো সহমত পোষণ করতে হলো তাকে। কারণটা খুব সহজ। টার্গেট আর মিশন বেশি সহজ হলে কাজটা প্রফেশনালদের দেয়া হয় না। কে চাইবে সহজ কাজটা করানোর জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে? হয় নিজেরাই করবে নয়তো ছোটোখাটো মাস্তান, চোর-ছ্যাচর আর ছিনতাইকারীদের দিয়ে করিয়ে নেবে। মাথা থেকে এই ভাবনাটা দূর করে দিয়ে কাজের কথায় চলে এলো।

    “একটা অটোমেটিক পিস্তল আর বিশ-ত্রিশ রাউন্ড গুলি আর একটা রেন্ট এ-কারের ব্যবস্থা করে দিতে পারলেই হবে। আর যদি সাইলেন্সার কিনতে হয় ঐ ছেলেটার মাধ্যমেই কিনবো, কি বলেন?”

    সাবেক শুটার ভালো করেই জানে একা একা কাজ করে বলে পিস্তলের সাইলেন্সার তার জন্য বিরাট সুবিধা বয়ে আনে। “অবশ্যই,” বললো অস্ত্র ব্যবসায়ি। ক্লায়েন্টের কাজের ব্যাপারে ডিটেইল জানার আগ্রহ সে কখনও দেখায় না, কিন্তু তার এই ঘনিষ্ঠ ক্লায়েন্ট যেহেতু অন্য ধরণের সাহায্য চাইছে আর করাচির ব্যাপারে তার ভালো ধারণা রয়েছে তাই একটু জেনে নেবার চেষ্টা করলো। “যদি কিছু মনে না করো, তোমার মিশন সম্পর্কে একটু বলতে পারবে? আমি জানি এসব নিয়ে কথা বলা ঠিক না, তবে আমাকে আরেকটু বললে তোমার জন্যই ভালো হবে। বলা তো যায় না, যদি সেম-সাইড হয়ে যায়…বুঝতে পেরেছো?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। অবশ্যই বুঝতে পেরেছে। করাচিতে সামাদের যে সোর্স আছে সে রাজনীতি করে, কাকতালীয়ভাবে যদি টার্গেটের সাথে ঐ সোর্সের পরিচয় থাকে কিংবা তাদের পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে থাকে তাহলে বিরাট সমস্যা দেখা দেবে। এর ফল হতে পারে ভয়াবহ।

    “অবশ্যই বলা যাবে,” মুচকি হেসে বললো। “আসলে আমি নিজেই বলতাম।” একটু থেমে আবার বললো সে, “টার্গেট ওখানকার কেউ না। এ দেশেরই এক লোক।”

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো শুটার।

    “একাত্তরে এখানে সমস্যা হয়েছিলো তাই ওখানে চলে গেছে।”

    আস্তে করে সামাদের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “আচ্ছা…মনে হয়। বুঝতে পেরেছি।”

    “যতোটুকু বুঝতে পারছি টার্গেট সহজই।”

    “হুম, আমারও তাই মনে হচ্ছে,” বললো সামাদ। “কতোদিনের মিশন?”

    “আমার ধারণা দু-সপ্তাহের বেশি লাগবে না।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো শুটার। তবে সে কিছু বলার আগেই বোবা এসে চুপচাপ দু-জনকে দু-কাপ চা দিয়ে গেলো। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বললো শুটার, “আমি যার কথা বলছি সে তোমাকে সাইলেন্সারও জোগাড় করে দিতে পারবে। সম্ভবত গাড়িটার ব্যবস্থাও করতে পারবে।”

    চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা গেলো বাস্টার্ডের, চায়ের কাপ তুল নিলো সে। “আপনি কি দুয়েক দিনের মধ্যে ওর সাথে যোগাযোগ করে আমাকে জানাতে পারবেন?”

    “আমি আজকেই ওর সাথে যোগাযোগ করবো। আশা করি রাতের মধ্যে জানাতে পারবো তোমাকে।”

    “ওই ছেলেটাকে কি পুরোপুরি বিশ্বাস করা যাবে?”

    “তুমি যদি ওকে মূল মিশন থেকে দূরে রাখো…মানে বুঝতেই পারছো, সে কোনো প্রফেশনাল হ্যান্ড নয়…তাহলে কোনো সমস্যা নেই। ছেলেটা খুবই বিশ্বস্ত। ওর দিক থেকে বেঈমানির কোনো সম্ভাবনা নেই। তুমি আমার রেফারেন্সে যাচ্ছো, এটা ওর জন্য বিরাট ব্যাপার। মানে, আমি তোমার ইসুরেন্স হিসেবে কাজ করবো আর কি।”

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। এর অর্থ তার কাছে পরিস্কার। সামাদ ভায়ের লোকের সাথে কিছু করলে পরিণাম হবে ভয়াবহ।

    “গাড়িটা মনে হয় খুব সহজে ম্যানেজ করে দিতে পারবে ও। গাড়ি তো আর ইলিগ্যাল কোনো জিনিস না। তাছাড়া গতবার যখন মাকে নিয়ে ওখানে গেলাম তখন ওকে একটা গাড়ি চালাতে দেখেছি। ওর নিজের না…সম্ভবত ঘনিষ্ঠ কারোর।” একটু থেমে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বললো অস্ত্রব্যবসায়ি, “আশা করি গাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।”

    “তাহলে তো ভালোই হলো।”

    “আচ্ছা, ওখানে কি তুমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইউজ করবে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “হ্যাঁ। কেন, সমস্যা আছে নাকি?”

    “না, ঠিক তা নয়…তবে একটু সাবধানে থাকবে।”

    বাস্টার্ড জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।

    “বোঝোই তো, ওরা আড়ালে-আবডালে আমাদের গাদ্দার বলে। ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না। একটু রির্জাভেশন আছে। বাংলাদেশি কেউ ওখানে পিস্তল নিয়ে ধরা পড়লেই ধরে নেবে ভারতের র-এর এজেন্ট। ওদের ধারণা ‘র’ তাদের এজেন্টদের বাংলাদেশি পাসপোর্টে ওখানে ঢোকায়।”

    শুটার সামাদ ঠিকই বলেছে, সেও এরকম কথা শুনেছে।

    “মিডল-ইস্টের কোনো কান্ট্রির পাসপোর্ট থাকলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে। ওরা আবার আরবের গাধাকেও পয়গম্বর মনে করে। ওদের পুরো শরীরটা উপমহাদেশে পড়ে থাকলে কি হবে, মাথাটা ঘুরিয়ে রেখেছে আরবের দিকে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। শুটার সামাদের এই রাজনৈতিক মূল্যায়নটি নিঃসন্দেহে যথার্থ। “কিন্তু ওইসব দেশের পাসপোর্ট জোগাড় করা তো খুবই কঠিন।”

    “জাল পাসপোর্ট সবখানেই পাওয়া যায়। কাজটা কঠিন কিন্তু টাকা থাকলে সহজ।”

    “জাল পাসপোর্ট দিয়ে পাকিস্তানে ঢোকাটা রিস্কি হয়ে যাবে না?”

    “তুমি বাংলাদেশের পাসপোর্টেই ঢুকবে কিন্তু ওখানে নামার পর ওইসব দেশের কোনো জাল পাসপোর্ট নিয়ে চলাফেরা করবে। বুঝতে পেরেছো?”

    “বুঝলাম, কিন্তু এটা আমি কিভাবে জোগাড় করবো?”

    “আমি যে ছেলেটার কথা বলছি সে হয়তো এটারও ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।”

    “গ্রেট,” বলে উঠলো বাস্টার্ড। তার বিশ্বাস ছিলো শুটার সামাদ তাকে সাহায্য করতে পারবে। এখন মনে হচ্ছে করাচি মিশনটা নিয়ে যদি মাঠে নামে তাহলে শুটার সামাদই হবে তার সবচেয়ে বড় রিসোর্স। “তবে এটা অপশনাল। ওখানে গিয়ে আগে দেখি, যদি সমস্যা হয় তাহলে অন্য পাসপোর্ট নিয়ে নেবো। ওসব জোগাড় করতে কি খুব বেশি সময় লাগবে?”

    “না। মিনিমাম তিন-চারদিন,” বললো অস্ত্রব্যবসায়ি, “তুমি চিন্তা কোরো না, ওখানে তোমার যেকোনো ধরণের সাহায্য লাগলে আমাকে জানাবে।”

    উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। “আজ তাহলে যাই, রাতে আমাকে জানিয়েন।”

    “অবশ্যই।” কথাটা বলেই ডানহাত বাড়িয়ে দিলো সে, তারপর হুট করে একটা কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বললো, “ভালো কথা, ঐ ছেলেটা কিন্তু টুকটাক বাংলা জানে।”

    “বলেন কি?” বাস্টার্ড অবাক না-হয়ে পারলো না।

    হেসে বললো সামাদ, “কয়েক বছর আগে ওখানে এমকিউএম-এর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে ও ঢাকায় এসে আমার কাছে ছিলো চার-পাঁচমাস।”

    “দারুণ,” বলে উঠলো সে। “আমি জানতাম আপনি ছাড়া আমাকে এরকম সাহায্য আর কেউ করতে পারবে না। থ্যাঙ্কস, ভাই।”

    মুচকি হেসে সাবেক শুটারের সাথে করমর্দন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

    অধ্যায় ৮

    মুজাহিদের চারপাশটা ঘুরছে আর লেপ্টে যাচ্ছে যেনো!

    একটু আগে ‘ডাক্তার এসে তাদের সবাইকে ভিটামিন ইনজেকশান দিয়ে যাবার পর থেকেই এরকম শুরু হয়েছে। অনেক কষ্টে চোখ টেনে পাশে বসা ইসমাইলের দিকে তাকালো। তাকে দেখে স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে তার কাছে। ঝিম মেরে বসে আছে ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। বাকিদের দিকে তাকালো। কাউকে দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। অন্য সময় যেমন সবাই চুপ মেরে থাকে আজো তাই আছে।

    “ইসমাইল ভাই?” আস্তে করে ডাকলো সে।

    “কি?”

    “আমার কেমনজানি লাগছে!”

    ভুরু কুচকে তাকালো বড়জন। “কেমন লাগছে?”

    “মাথা ঘোরাচ্ছে…চোখেও ঝাপসা দেখছি।”

    হাসলো ইসমাইল। “ভিটামিন ইনজেকশান দিলে এরকম একটু লাগে। চিন্তার কিছু নেই, ঠিক হয়ে যাবে। সবারই এমন হচ্ছে।”

    মুজাহিদ অবাক হলো, সেইসাথে আশ্বস্তও। “তাই নাকি?”

    আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ইসমাইল। “আপনারও হচ্ছে?”

    “হুম।”

    “সবার হচ্ছে?”

    “বললাম তো হচ্ছে।”

    মুজাহিদ হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। “ওহ…আমি তো মনে করেছিলাম শুধু আমারই এরকম হচ্ছে।”

    মুচকি হাসলো ইসমাইল। তার খুব ভালো লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

    “আচ্ছা, আমাদেরকে ভিটামিন ইনজেকশান দিচ্ছে কেন?”

    “শক্তি বাড়ানোর জন্য,” অনিচ্ছায় জবা দিলো বড়জন।

    “আমাদের শক্তি কি কম?”

    “হুম।”

    “তাহলে এতো কঠিন ট্রেইনিং করলাম কিভাবে?”

    “উফ!” বিরক্ত হলো ইসমাইল। “নাদানের মতো কথা বলিস কেন সব সময়? একটু বেশি শক্তির দরকার আছে না?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মুজাহিদ। “আলবৎ দরকার আছে।”

    “তাহলে এবার চুপ থাক,” আবারো ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো ইসমাইল।

    “আচ্ছা,” কয়েক মুহূর্ত পর পুণরায় সরব হয়ে উঠলো ঊনিশ বছরের ছেলেটি, “ওই লোকটা কি ডাক্তার ছিলো?”

    তার দিকে তাকালো ইসমাইল। “কার কথা বলছিস?”

    “ওই যে…আমাদের ইনজেকশান দিলো যে?”

    “হুম…ডাক্তার।”

    “কিন্তু তাকে দেখে আমার ডাক্তার মনে হয় নি।”

    “তাহলে কি মনে হয়েছে?”

    “কি জানি…তা তো বলতে পারবো না…তবে তাকে আমার ডাক্তার মনে হয় নি।”

    “শোন, তোকে একটা কথা বলি।”

    মুজাহিদ উদগ্রীব হয়ে উঠলো কথাটা শোনার জন্য।

    “ভিটামিন ইনজেকশান দেবার পর এতো কথা বলতে নেই। বুঝলি? বেশি কথা বললে ভিটামিনের পাওয়ার কমে যায়।”

    “বলেন কি,” নিষ্পাপ বিস্ময় নিয়েই বলে উঠলো সে। “তাহলে কি করবো?”

    “আমার মতো চুপ মেরে বসে থাক, দেখবি অনেক ভালো লাগছে।”

    “ঠিক আছে, ভাই।”

    সেও দেয়ালে হেলান দিয়ে ইসমাইলের অনুকরণে বসে রইলো। এভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সত্যি সত্যি টের পেলো তার মধ্যে ভালো লাগার একটি অনুভূতি তৈরি হচ্ছে। যেনো ক্লান্তি বলে কিছু নেই। দুশ্চিন্তা বলেও কিছু নেই মাথায়। অথচ শরীরে কী রকম এক তেজ অনুভব করছে। বিশাল একটা মাঠে যদি তাকে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে বোধহয় বাইশ চক্কর দিয়ে দিতে পারবে এখন!

    অধ্যায় ৯

    ধানমণ্ডির একটি বারো তলায় অবস্থিত অ্যাট দি টপ রেস্টুরেন্টে বসে আছে জামিল আহমেদ আন্দোলন। টপফ্লোরের এই রেস্টুরেন্টটি বিভিন্ন কারণে তার প্রিয়। তবে আজকে এই প্রিয় জায়গাটি সে নিজে বেছে নেয় নি।

    তিনদিনের কথা বলা হলেও ঐ স্মার্ট খুনি দু-দিন পরই দেখা করার জন্য তাকে ফোন করেছে। যদিও বিস্তারিত কিছুই বলে নি, তারপরও ধরে নেয়া যায় প্রস্তাবটায় সে রাজি হয়েছে। দেখা যাক কি হয়-এমনটা ভেবে কফির কাপে চুমুক দিয়ে হাতঘড়িটা একটু দেখলো। কথা ছিলো বিকেল পাঁচটায় আসবে, এখন বাজে পাঁচটা পাঁচ। সে একটু আগে এসে পড়াতে এক কাপ কফির অর্ডার দিয়েছে। আরেকটা চুমুক দিতেই দেখতে পেলো যার জন্য অপেক্ষা করছে সে এগিয়ে আসছে তার টেবিলের দিকে।

    “সরি, পাঁচ মিনিট লেট,” চেয়ারে বসতে বসতে বললো বাস্টার্ড। জামিল আহমেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারও বললো সে, “লিফটা খুব রাশ ছিলো…আর এটা একদম টপ ফ্লোরে…তাই লেট হয়েছে।”

    মি. আহমেদ বুঝতে পারলো না সামান্য পাঁচ মিনিট লেটের জন্য এদেশে কেউ সরি বলে। তাও আবার পেশাদার খুনির মতো কোনো মানুষ! “ইটস ওকে।” হেসে বললো সে। “কি অর্ডার দেবো?”

    “এক কাপ কফি।”

    “আর কিছু?”

    “না।”

    ওয়েটারকে ডেকে আরো এক কাপ কফির অর্ডার দিতে বললো জামিল আহমেদ। ওয়েটার ছেলেটা শুধু কফির অর্ডার পেয়ে মুখ কালো করে চলে গেলো। সে জানতেও পারলো না, এই রেস্টুরেন্টটির সরভাগ মালিক তার সামনে বসে আছে। তারা যাকে মালিক বলে সব সময় দেখে সেই লোক ওয়ার্কিং-পার্টনার হিসেবে মাত্র বিশ শতাংশের অধিকারী। বাকি দশ শতাংশ এই রেস্টুরেন্টের অভিজ্ঞ শেফের। ছেলেটার এমন ভঙ্গি দেখে মনে মনে খুব মজাই পেলো। আরেকটা ব্যাপারও সে উপভোগ করেছে। পেশাদার এই খুনিও জানে না সে এই রেস্টুরেন্টের মালিক। খুনি খুবই সতর্ক একজন মানুষ, এক জায়গায় দু-বার দেখা করে না। কাকতালীয়ভাবে সে নিজে থেকেই প্রস্তাব করেছে এখানে দেখা করার জন্য। প্রস্তাবটা শুনে মনে মনে হেসেছিলো জামিল।

    “আপনার কাজটা করা যাবে,” আস্তে করে বললো বাস্টার্ড।

    শুটার সামাদ তাকে গতপরশু রাতেই জানিয়েছে করাচিতে যে ছেলেটা আছে তার সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে। তার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। আর তার পরিচিত এক লোক জানিয়েছে অতি দরকারি একটি জিনিস

    সে সেট করে দিতে পারবে, সুতরাং কাজটা নেয়া যায় এখন।

    কথাটা শুনে স্বস্তি পেলো মি: জামিল।

    “কিন্তু একটা ব্যাপার খোলাখুলি বলে নেয়া দরকার।”

    বাস্টার্ডের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো জামিল আহমেদ। “বলুন?”

    “আমাকে যে বিজনেস কার্ড দিয়েছেন ওটা ব্যবহার করে যদি লোকটার ঠিকানা খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে কাজটা বাদ দিয়ে দিতে হবে।”

    জামিল আহমেদের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। বুঝলাম না?”

    “বিজনেস কার্ডটা থেকে ঐ লোকের ঠিকানা বের করা না-ও যেতে পারে,” বললো সে, “সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার থাকবে না। করাচির মতো শহরে করে ঠিকানা খুঁজে বের করাটা খুবই কঠিন কাজ হবে।”

    ঢোক গিললো জামিল। “আমার মনে হয় কার্ডটা ভুয়া নয়। আপনি ঐ ঠিকানায় গিয়ে মওলানার সাথে ঠিকই দেখা করতে পারবেন।”

    “আমিও সে-রকম আশা করছি। কিন্তু যদি না-হয়, তখন আমার পক্ষে ওখানে দীর্ঘদিন থাকা সম্ভব হবে না।”

    চুপ মেরে রইলো শহীদের সন্তান।

    “সেক্ষেত্রে আপনার কিছু টাকা নষ্ট হবে, কারণ ওখানে যাওয়ার আগে আমাকে কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিতে হবে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জামিল আহমেদ। “বুঝতে পেরেছি।”

    ‘আরেকটা কথা, কোনো কারণে যদি পাকিস্তান হাই-কমিশন থেকে আমার ভিসা ইস্যু করা না হয় সেক্ষেত্রেও আমার কিছু করার থাকবে না।”

    জামিল আহমেদ কিছু বললো না। সে জানে ভিসার ব্যাপারটা আসলেই অনিশ্চিত। এটা নির্ভর করে পাসপোর্টের উপর।

    “তবে আমার মনে হয় ওরা আমাকে ভিসা দেবে,” আশ্বস্ত করে বললো সে। সম্ভবত ভিসা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তারপরও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

    “আপনার পাসপোর্টে প্রফেশনের জায়গায় কি আছে…বিজনেস নাকি সার্ভিস?” জানতে চাইলো ব্যবসায়ি।

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। তার পাসপোর্টের সংখ্যা একাধিক। এরমধ্যে বিজনেস আর সার্ভিস দুটো প্রফেশনই রয়েছে। “এটা কেন জানতে চাইছেন?”

    “না মানে, যদি সার্ভিস হয়ে থাকে তাহলে আমি আপনাকে ভিসা পেতে হেল্প করতে পারবো হয়তো।”

    “কিভাবে?”

    “আমার প্রতিষ্ঠানের একজন এম্প্রয়ি হিসেবে দেখালাম…ম্যানেজারিয়াল কোনো পোস্ট?”

    একটু ভেবে দেখলো সে। “ঠিক আছে, আগে আমি ট্রাই করে দেখি। না হলে এটা ভেবে দেখা যাবে।”

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে জামিল আহমেদ বললো, “ধরুন বিজনেস কার্ড দিয়ে ঐ লোককে খুঁজে পেলেন না…ইন দ্যাট কেস, আমি যদি আপনাকে বাড়তি কিছু টাকা দেই তাহলে কি আপনি ওই লোককে খুঁজে বের করার কাজটা করতে পারবেন?” একেবারে ব্যবসায়ির মতোই প্রস্তাব দিলো।

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। “শুনুন, এটা টাকার ব্যাপার নয়,” বেশ শান্তকণ্ঠেই বললো সে। “বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন। করাচি শহরে একজন বিদেশী, বিশেষ করে বাংলাদেশী কেউ ঘুরে ঘুরে একটা ঠিকানা খুঁজছে, এটা খুবই বিপজ্জনক কাজ হয়ে যাবে।”

    “কেন?”

    “কারণ ওই শহরে হাজার-হাজার ইন্টেলিজেন্স আর টিকটিকি ঘুরে বেড়ায়। আরো আছে অসংখ্য মিলিট্যান্ট গ্রুপ। তাদেরও নিজস্ব স্পাই রয়েছে। ওদের যে কারোর চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা নব্বই ভাগ। তারা যখন দেখবে আমি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানে ঢুকেছি তখন আরো বেশি করে সন্দেহ করবে।”

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ব্যবসায়ি।

    “ওরা মনে করে ভারতের র-এর অনেক এজেন্ট এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানে ঢোকে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জামিল আহমেদ। “বুঝতে পেরেছি। আমি রাজি।”

    এমন সময় ওয়েটার এসে এক কাপ কফি দিয়ে গেলো, ছেলেটার মুখ এখনও বেজার। জামিল আহমেদকে দেখে তার মনে হয়েছিলো বিরাট কিছু অর্ডার দেবে। দু-কাপ কফির অর্ডার পেয়ে তাই হতাশ। এরা যে আর কিছু খাবে না সেটা বুঝে গেছে। আদৌ কোনো টিপস পাবে কিনা কে জানে।

    স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড। “এতো দ্রুত রাজি হবেন না। আমরা কিন্তু এখনও পেমেন্ট নিয়ে কোনো কথা বলি নি।”

    মুচকি হাসলো মি: আহমেদ। “বলুন, কতত দিতে হবে?”

    “কাজটা সফার করছেন আপনি, সুতরাং আপনিই বলুন, কতো টাকা দিয়ে এ কাজটা করাতে রাজি আছেন।”

    জামিল আহমেদ অবাক হলো। পেশাদার খুনি এভাবে ডিল করে তা আগে জানা ছিলো না। সে নিজে বলবে কতো টাকা দিয়ে কাজটা করাতে চাইছে? আজব! সে কি জীবনে কখনও কাউকে টাকা দিয়ে খুন করিয়েছে? নাকি খুনখারাবির এই অন্ধকার জগতের বাজারদরের কোনো চার্ট আছে যে জেনে নেবে?

    “আমার এ ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই।”

    জামিল আহমেদের কথা শুনে অবাক হলো না বাস্টার্ড। এমনটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে। ক্লায়েন্টের পক্ষে সব সময় নিজে থেকে রেট বলাটা সহজ হয় না। “আন্দাজ করে বলুন?”

    মাথা দোলালো শহীদের সন্তান। “আই ডোন্ট হ্যাভ এনি আইডিয়া অ্যাট অল। আর আমি ওয়াইল্ড গেস্ করতে ভীষণ অপছন্দ করি। “

    মুচকি হাসলো সে। “আমার মনে হয় কথাটা সত্যি নয়।”

    “কোন্ কথাটা?”।

    “একদম না জেনে আপনি আমার সাথে দেখা করেন নি। একটা ধারণা ঠিকই করে নিয়েছেন…আমি সেটাই শুনতে চাইছি।”

    জামিল আহমেদ চুপ মেরে ভেবে যেতে লাগলো। এটা তার ব্যবসায়িক সত্তা। দ্রুত হিসেব করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার গুণ তার রয়েছে।

    “পঞ্চাশ লাখ?” কফির কাপটা তুলে নিয়ে আস্তে করে চুমুক দিয়ে বললো।

    অপেক্ষা করলো বাস্টার্ড। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝার উপায় নেই টাকার অঙ্কটা তাকে খুশি করেছে নাকি করে নি।

    “প্লাস, আপনার প্লেন ফেয়ার, হোটেলে থাকা?…” যোগ করলো জামিল আহমেদ, “…যে কয় দিন লাগে আর কি।”

    এতোটা আশা করে নি সে। ক্লায়েন্টকে দিয়ে রেট বলানোর এই এক সুবিধা! কখনও কখনও প্রত্যাশার চেয়ে বেশিও পাওয়া যায়। “ওকে।”

    জামিল আহমেদের চেহারায় প্রশান্তি নেমে এলো যেনো।

    “এর মধ্যে অ্যাডভান্স দশ লাখ দিতে হবে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো শহীদের সন্তান।

    “জায়গাটা করাচি বলে একটু বেশিই অ্যাডভান্স লাগছে। ওখানে যে রিসোর্স আছে তাকে বেশ ভালো টাকা দিতে হবে।”

    আলতো করে মাথা নাড়লো মি: জামিল। “তাহলে কবে থেকে কাজ শুরু করছেন?”

    কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে একটু ভেবে নিলো। “ভিসা নিতে যতো সময় লাগে…তারপর বড়জোর তিন-চারদিনের মধ্যেই রওনা দিয়ে দেবো।”

    “অ্যাডভান্স টাকাটা কবে দিতে হবে?”

    “ভিসা হবার পর।”

    “কিভাবে দেবো?”

    “আমাদের কমন ট্রাস্টির কাছে দিয়ে দিলেই হবে।”

    “ঠিক আছে।”

    তাদের কমন ট্রাস্টি অমূল্যবাবুর সাথে পেশাদার খুনির সম্পর্কটা কি বুঝতে পারছে না জামিল আহমেদ। বাবুর সাথে তার বেশ ভালো খাতির। সম্পর্কটা নিছক ব্যবসায়িক নয়। বাবার হত্যাকারীকে চিনতে পারার পর একমাত্র তার সাথেই এ নিয়ে কথা বলেছে। তারপর যখন জানতে চাইলো, দেশে এমন কেউ কি আছে, যে পাকিস্তানের করাচিতে গিয়ে লোকটাকে খুন করতে পারে-তখন বাবু অনেকক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে মাথা নেড়ে জানিয়েছিলো। একজন আছে, সম্ভবত তার পক্ষেই এটা করা সম্ভব। এরপর পেশাদার এই খুনির সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে বাবু তাকে শুধু বলেছিলো, কাজের কথার বাইরে তার সম্পর্কে কিছু জানার দরকার নেই। জামিল তখন বলেছিলো, তার হয়ে যেনো খুনিকে এই কাজটা দেয়া হয়, কিন্তু অমূল্যবাবু রাজি হয় নি তাতে। পেশাদার এই খুনি নাকি ক্লায়েন্টের সাথে সরাসরি দেখা না করে কোনো কাজ করে না। প্রক্সি-ক্লায়েন্টের হয়ে কাজ করে না সে।

    “ঠিক আছে, নাইস টু মিট ইউ,” স্মার্ট-খুনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

    জামিল আহমেদ বুঝতে পারছে না পেশাদার কোনো খুনির সাথে করমর্দন করাটা ঠিক হবে কিনা। শেষ পর্যন্ত নিজের হাতটা গুটিয়েই রাখলো। “তাহলে আমি বাবুর সাথে দেখা করে সব সেটেল করে নেবো।”

    বাস্টার্ড চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই থেমে গেলো, ফিরে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। “আপনার রেস্টুরেন্টের কফিটা বেশ ভালো। আই থিঙ্ক, বেস্ট কফি ইন দ্য টাউন।”

    জামিল আহমেদ ভিরমি খেলো। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। তাকে হতবুদ্ধিকর অবস্থায় রেখেই চলে গেলো দেবদূতের মতো দেখতে পেশাদার খুনি।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেক্সট (বেগ-বাস্টার্ড – ৬) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }