Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প368 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩০. মুজাহিদ আবার সমুদ্র দেখছে

    অধ্যায় ৩০

    অনেকদিন পর মুজাহিদ আবার সমুদ্র দেখছে, তাও দিনের বেলায়। আনন্দে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। দু-মাস আগে সমুদ্রেই কাজ করতো। ট্রেইনার চাচা যখন বলে দিলো ‘লারকা পাক্কা’ তারপরই করাচির একটি সমুদ্রতীরে তাকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। কাজ বলতে মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো। কঠিন কিছুই না। পাঞ্জাব আর লাহোরে থাকার সময় কন্ট্রাকশনের যে কাজ করতো তার চেয়ে ওটা পানির মতোই সহজ ছিলো। সেই সময় প্রচুর মাছও খেয়েছে। নাম না-জানা বড় বড় সব মাছ। দিনের বেলায় যখন ওগুলো জাল থেকে তুলে আনা হতো তখন চান্দির মতো চকচক করতো।

    তার ট্রেইনিংয়ের সময়ও রাতের বেলায় সমুদ্র দেখেছে কিন্তু ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ছিলো বলে বুঝতে পারে নি ওটা করাচির কোন্ জায়গা ছিলো। অনেকদিন পর আবারো সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, এমন কি সেই পরিচিত গন্ধটাও টের পাচ্ছে নাকে!

    আজ খুব সকালে, ভোরের আজান দেবার পরই তাদের জানিয়ে দেয়া হয় ফজরের নামাজ পড়ার পর তারা অন্য এক জায়গায় রওনা দেবে। সবাই যেনো গোছগাছ করে নেয়। মনে মনে আশংকা করেছিলো আগের দু-জায়গার তুলনায় এটা বোধহয় আরো খারাপ কিছু হবে। যেভাবে তাদের থাকার জায়গা ক্রমশ বদ্ধঘর হতে হতে মালঘর হয়ে গেছে তাতে অমন ভাবনা সঙ্গতই ছিলো। কিন্তু এখানে আসার পর সবার চোখেমুখে বিস্ময়। জায়গাটা নিরিবিলি এক সমুদ্রতীর। আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। মনে হয় বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে আছে তারা।

    “এই জায়গাটার নাম কি, ভাই?”

    যথারীতি প্রশ্নটা করলো ইসমাইলকে। সে তার পাশেই দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছে। বাকিরাও আছে ধারেকাছে। কেউ কেউ গোড়ালি পর্যন্ত পা ডুবিয়ে রেখেছে নোনাজলে।

    “জানি না।”

    “এই আরব-সাগর দিয়ে কি আরবে যাওয়া যাবে?”

    “হুম, যাবে।”

    সাগরের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মুজাহিদ।

    “আজকে আমরা সবাই এই আরব-সাগরে গোসল করবো,” বললো ইসমাইল।

    “তাই?” খুশিতে বলে উঠলো দশজনের দলে সবচাইতে কনিষ্ঠজন। পরক্ষণেই বুজুর্গের কথা মনে পড়ে গেলো তার। “বুজুর্গ কি আমাদের এটা করতে দেবেন?”

    “উনি এখানে নেই। আমাদের সঙ্গে আসেন নি।”

    খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মুজাহিদ। “উনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন?”

    “জানি না। মনে হয় কয়েকদিনের জন্য অন্য জায়গায় গেছেন।

    “তাহলে আমরা এখানে অনেকদিন থাকবো?”

    “তাও জানি না।”

    “আমাদের কাজটা কবে, ভাই?”

    “খুব জলদি।”

    “তাহলে আমাদেরকে মালসামান’ দিচ্ছে না কেন?”

    “ওগুলো দেয়া হবে একদিন আগে।”

    “ও।” মুজাহিদ আর কিছু বললো না। অনেকক্ষণ চুপ থাকাও তার স্বভাবে নেই। তাই মুখ খুললো আবার। “ইসমাইল ভাই, আপনি কখনও মাছ ধরেছেন?”

    তার দিকে তাকালো বড়জন। “আহ্, চুপ থাক তো। আল্লাহর ওয়াস্তে মুখটা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখবি?”

    কাচুমাচু খেলো মুজাহিদ। চিঠি লেখার পর থেকে ইসমাইল ভাই সব সময় মুখ থমথম করে থাকে।

    অগত্যা কাউকে কিছু না বলে সমুদ্রসৈকত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো। সে এতো কিছু বোঝে না কিন্তু এটা বুঝতে পারছে ইসমাইলকে এখন একটু একা থাকতে দেয়া উচিত। বুজুর্গ নেই। কঠিন নজরদারিও নেই। তার বদলে আছে নতুন দু-জন মানুষ, যাদের আগে কখনও দেখে নি। এদের মধ্যে একজন আছে যাকে দেখে মনে হয় হোমরাচোমরা কেউ হবে। লোকটা খুবই কম কথা বলে। তাদের দিকে তেমন কড়া নজর রাখছে না ওই দু-জন, সুতরাং একটু ঘুরে বেড়ালে কেউ বাধা দেবে না।

    মুজাহিদ বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা দূরে চলে এলো। তাদের দলের বাকিদের দিকে ফিরে তাকালো সে। কেউ খেয়াল করছে না তাকে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকের কাছে চলে এলো এবার। জায়গাটা তার কাছে একদমই অচেনা। আশেপাশে কেন লোকজন নেই ভেবে পেলো না। এরকম বিরাণ জায়গাও আছে করাচিতে।

    বাঁকের পরে কি আছে দেখার জন্য একটু জোরে জোরে পা চালালো। তার পরনে ট্রাউজার আর সোয়েটার, পাযে কেস। মাথার চুলগুলো ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ছে। সমুদ্রের গর্জনকে কোলাহল মনে হলেও চারপাশে কোনো মানুষজন নেই।

    কিন্তু বাম দিকে বাঁক নিতেই দেখতে পেলো তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল!

    *

    অস্ত্র আর গুলিগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় নি তার। এমনকি সাইলেন্সারটা ঠিকমতো কাজ করে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার ফুরসত পায় নি। এটা তার কাজের ধরণ নয়। এভাবে সে কাজ করে না। যদিও জাভেদ তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে কোনো সমস্যা হবে না, সবগুলো জিনিসই সচল আছে। এ ব্যাপারে সে যেনো নিশ্চিত থাকে, তারপরও ছেলেটাকে চলে আসতে বলে দেয় আজ সকালে। জাভেদ ওয়ার্সি শুটার সামাদ নয়। তাকে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। শেষ মুহূর্তে পিস্তল, গুলি কিংবা সাইলেন্সর ‘বিট্রে’ করে বসলে শুধু বিপদেই পড়বে না, পুরো মিশনটাই ভেস্তে যেতে পারে।

    আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকার সময় এরকম বিট্রে করার কারণে অনেককেই বিপদে পড়তে দেখেছে, মরতেও দেখেছে। একেবারে দরকারের সময় অস্ত্র থেকে গুলি বের না-হলে ফলাফল কতোটা ভয়াবহ হতে পারে তাও জানা আছে। পিস্তলের সমস্যা থাকতে পারে। গুলিগুলো পোতানো থাকতে পারে, কতো সমস্যাই তো হয়।

    এনায়েত নামে মোল্লাভায়ের এক ঘনিষ্ঠ লোক ছিলো, তারা সবাই ডাকতো এনুমামা বলে। সেই লোকের কাজই ছিলো একটা-অস্ত্র আর গুলিগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা চেক করে দেখা। সমস্যা থাকলে সে নিজেই ঠিক করতো ওগুলো। এমনকি ড্যাম্প গুলিগুলোও সে বড় কড়াইতে বালু গরম করে বাদামের মতো ভেঁজে কড়কড়ে করে ফেলতো! লোকটার সাহস ছিলো। গ্রেনেড নিয়েও নাড়াচাড়া করতে দেখেছে তাকে।

    এই এনুমামা তাকে খুব আদর করতো। গুলি আর অস্ত্র সম্পর্কে অনেক কিছু তার কাছ থেকে শিখেছে। মামার একটা কথা তার মনে আছে : “সব সময় নিজের মেশিন আর বিচি নিজেই টেস্ট করবা, ভাইগনা।”

    সে সব সময় তা-ই করে আসছে। এমন কি শুটার সামাদের কাছ থেকে অস্ত্র ভাড়া নিলেও পরীক্ষা না-করে কাজে নামে না। অবশ্য এটা সামাদের সামনে কখনও করে না। করলে লোকটা কষ্ট পায়।

    গতকাল ডিসকো থেকে বের হবার সময় ছেলেটাকে বলেছিলো দুপুরের পর চলে আসতে কিন্তু আজ সকালে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফোন করে জানায় সে ওগুলো টেস্ট করে দেখতে চাইছে, সেজন্যে নিরিবিলি একটি জায়গায় যাওয়া দরকার। তার অনুরোধে জাভেদ করাচির অ্যারাবিয়ান সি-রোডের পাশে হাব চৌকি নামক এক জনবিরল জায়গায় নিয়ে এসেছে এখন।

    আরব-সাগর তীরের এই এলাকাটি একেবারে বিরাণ, জায়গায় জায়গায়। প্রচুর পাথর পড়ে আছে। থোকা থোকা গাছপালাও রয়েছে এখানে-সেখানে। অনেক জায়গা হাটাচলার অনুপযোগী। লোকজন নেই বললেই চলে। জাভেদ বলেছে খুব কাছেই জেলেপল্লী আছে। ওখানকার সব পুরুষ সমুদ্রে মাছ ধরতে গেছে, বাচ্চারা গেছে স্কুলে, মেয়েমানুষেরা রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। গাড়িটা দৃষ্টির গোচরে পার্ক করে রেখে তারা চলে এসেছে সমুদ্র তীরের এমন একটি জায়গায় যেখানে বেশ উঁচু উঁচু পাথর আছে। কিছু কিছু পাঁচ-ছয় ফুটেরও বেশি।

    “এখানে টেস্ট করুন…সমস্যা হবে না,” বললো জাভেদ।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। সাইলেন্সর ব্যবহার করবে সে, সুতরাং আশেপাশে কেউ থাকলেও শব্দ শুনতে পাবে না। ভোতা যে শব্দ হবে সেটা সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে ঢাকা পড়ে যাবে। দুটো উঁচু-উঁচু পাথরের মাঝখানে ঢুকে পড়লো। জাভেদ দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। জ্যাকেটের ভেতর থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা বের করে সেফটি-লক অফ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। তার সামনে বিশ-ত্রিশ গজ দূরে বালির সৈকতে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সৈকতে পড়ে আছে ছোটো ছোটো অনেক পাথর, মরাঝিনুক, শামুক আর অজানা সব জিনিস।

    পর পর তিনটি গুলি করলো সে। সবগুলোই আঘাত হানলো সৈকতে পড়ে থাকা শামুক আর ঝিনুকের উপরে। গুলির আঘাতে ওগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গেলো।

    প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালো জাভেদ। “নিশানা তো দারুণ!”

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। আরো একটা ফায়ার করলো। সাইলেন্সারটা বেশ ভালো। এটা নিয়েই তার সন্দেহ ছিলো বেশি। গুলিগুলো সব তাজা। আর পিস্তলটা পুরনো হলেও বেশ ভালো অবস্থায় আছে। শাটার টেনে চেম্বারে গুলি লোড করার সময় খেয়াল করেছে বেশ মসৃণভাবেই কাজ করে ওটা। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, এই পিস্তলের আগের মালিকদের মধ্যে কমপক্ষে একজন এটা যেমন ব্যবহার করেছে তেমনি যত্নও নিয়েছে।

    “জিনিসটা খুবই ভালো,” জাভেদের কাছে এসে বললো সে।

    ছেলেটা তার কথায় হাসলো কেবল।

    জাভেদকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় কিছু একটা তার চোখের কোণে ধরা পড়লো। ডানদিকে, আনুমানিক ত্রিশ-চল্লিশ গজ দূরে বিশাল আকৃতির একটি পাথরের আড়ালে কেউ লুকিয়ে আছে। পিস্তলটা সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেটের ভেতরে রেখে দিলো।

    “কি হয়েছে?” জাভেদ বলে উঠলো।

    “কেউ আছে ওখানে।” পাথরটা দেখিয়ে চাপাস্বরে বললো সে।

    “কি বলেন!” বিস্মিত হলো ছেলেটা। “আপনি শিওর?”

    “হুম।” জোর দিয়ে বললো। “এখনও আছে পাথরটার আড়ালে।”

    জাভেদ সেদিকে যাবার জন্য পা বাড়াতেই তার হাতটা ধরে ফেললো। “তুমি এখানেই থাকো।” সে নিজেই এগিয়ে গেলো পাথরটার দিকে। ওটার কাছে গিয়ে বামদিকে ঘুরে পেছনে চলে আসতেই দেখতে পেলো এক কিশোর গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তাকে দেখেই চমকে উঠলো। ছেলেটা উঠে যে-ই

    দৌড় দেবে অমনি তার সোয়েটারের কলারটা খপ করে ধরে ফেললো সে।

    “অ্যাই, তুই কে?” জাভেদ দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো উর্দুতে। “এখানে কি করছিস?”

    “আ-আমি…” ছেলেটা তোতলালো। “আ-আমাকে ছাড়ো! ছাড়ো!” চিৎকার দিলো প্রাণপনে।

    বাস্টার্ড ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটাকে। জিন্স প্যান্ট, সোয়েটার আর পায়ের কেড়স দেখে জেলেপল্লীর কেউ মনে হচ্ছে না।

    “চুপ! কোনো আওয়াজ করবি না।” ধমক দিয়ে উঠলো জাভেদ। “এখানে তুই কি করতে এসেছিস? আর কে কে আছে তোর সঙ্গে?”

    “আমাকে ছাড়ো, নইলে কিন্তু তোমাদের দুজনকে একদম শেষ করে দেবে ওরা!”

    ভুরু কুচকে গেলো জাভেদের। “ওরা?”

    বাস্টার্ডও অবাক হলো। “ওরা কারা? কাদের কথা বলছে?” ছেলেটা তার হাত থেকে ছোটার জন্য জোরাজুরি করলে কলারটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো সে।

    “ভাই!” জাভেদ চাপাস্বরে বলে উঠলো। “আরেকজন আসছে!”

    বাস্টার্ড তাকালো বামদিকে। মাঝবয়সি এক লোক হনহন করে হেঁটে আসছে, দূর থেকে চোখ কুচকে দেখার চেষ্টা করছে সে।

    হঠাৎ লোকটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো আবু মুজাহিদ, “ভাই, এদের কাছে পিস্তল আছে!”

    থমকে দাঁড়ালো মাঝবয়সি লোকটা। যেনো কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাস্টার্ডের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো তার। বড়জোর বিশ-পঁচিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

    মাত্র কয়েক মুহূর্ত, তারপরই লোকটা ঘুরে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার দিলো, “কাফা! বন্দুক নিয়ে আসো!”

    মুজাহিদের কলারটা ছেড়ে দিলো বাস্টার্ড। তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রাণপনে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করলো ছেলেটি।

    “জলদি চলল,” জাভেদকে তাড়া দিয়ে বললো সে। “এখানে থাকাটা ঠিক হবে না।”

    তারা দুজন দৌড়ে চলে গেলো গাড়ির কাছে।

    “এরা কারা, ভাই?” গাড়ির কাছে এসে হাফাতে হাফাতে বললো জাভেদ।

    বাস্টার্ড কিছু বলার আগেই দেখতে পেলো দূরের সৈকত দিয়ে তিনজন লোক ছুটে আসছে তাদের দিকে। একজনের হাতে পিস্তল!

    “গাড়িতে ওঠো! জলদি!” জাভেদকে তাড়া দিয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লো সে। যদি দরকার পড়ে সেজন্যে পিস্তলটা বের করে হাতে রাখলো।

    জাভেদ ইঞ্জিন চালু করেই দ্রুত রাস্তার উপরে উঠিয়ে দিলো গাড়িটা।

    পেছনে তাকিয়ে বাস্টার্ড দেখতে পেলোলোকগুলো হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওরা বুঝে গেছে দৌড়ে আর ধরতে পারবে না।

    “এরা কারা?” আবারো প্রশ্নটা করলো জাভেদ। “আমারও তো একই প্রশ্ন।”

    চুপ মেরে গেলো জাভেদ ওয়ার্সি। সে বুঝতে পারছে না এমন নির্জন জায়গায় ঐ লোকগুলো কি করছে।

    “তোমাদের জেলেপল্লীর লোকজন বন্দুক-পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় নাকি?” বিস্মিত বাস্টার্ড বলে উঠলো।

    রিয়ার-মিররে তাকলো জাভেদ। “এদের দেখে জেলে মনে হচ্ছে না, ভাই।”

    ভুরু কুচকে গেলো তার। “তাহলে এরা কারা?”

    কাঁধ তুললো সে। “বুঝতে পারছি না।”

    “ওকে, বাদ দাও। মনে হয় আমাদের মতোই কেউ হবে।”

    মুখে কিছু না বললেও মনে মনে জাভেদ ওয়ার্সি একমত হতে পারলো না। সে এ জায়গাটা ভালো করেই চেনে। এটা একেবারেই জনবিরল একটি জায়গা। আশেপাশের জেলেপল্লীর কেউ খুব একটা আসেও না এখানে। আর ঐ লোকগুলো তো কেনোভাবেই জেলে হতে পারে না।

    অধ্যায় ৩২

    মুজাহিদ আর মাঝবয়সি লোকটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতেই তাদের দেখভাল করা কাফা নামের লোকটি পিস্তল হাতে ছুটে আসে। তাকে পেয়ে তিনজনে মিলে দৌড়ে যায় আবার পাথরের কাছে কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ঐ দু-জন ততোক্ষণে সৈকত থেকে একটু দূরে একটা গাড়িতে উঠে দ্রুত সটকে পড়ে।

    হাল ছেড়ে দিয়ে থমকে দাঁড়ায় তিনজন।

    “এরা কারা, ওয়াসি?” কাফা জিজ্ঞেস করলো। “এখানে কি করছিলো?”

    “আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না,” বললো সে। “ওকে খুঁজতে গিয়ে এখানে এসে দেখি ঐ দু-জন ওকে ধরে রেখেছে।”

    “তুমি এখানে কি করতে এসেছিলে?” চেঁচিয়ে বললো পিস্তল হাতের লোকটি।

    “কিচ্ছু না,” মুজাহিদ জানালো। “এমনি হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে দেখি…” একটু থেমে ঢোক গিললো সে, “…দু-জন লোক কী যেনো করছে।”

    “তুমি যে বললে ওদের কাছে পিস্তল ছিলো?”

    ওয়াসির দিকে তাকালো মুজাহিদ। “হ্যা…আমাকে যে ধরেছিলো তার কাছে পিস্তল ছিলো।”

    “কি বলে!” কাফা অবিশ্বাসে বলে উঠলো। “আসো…যেতে যেতে বলো তো ঘটনাটা আসলে কি।”

    “হুম, সেটাই ভালো,” মাঝবয়সি বললো। “এখানে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।”

    মুজাহিদকে নিয়ে তারা দু-জন নিজেদের আস্তানার দিকে পা বাড়ালো।

    একটু আগে সৈকতের বাঁকে এসে দু-জন মানুষকে দেখে অবাক হয়েছিলো মুজাহিদ। এই জনবিরল জায়গায় দু-জন যুবককে দেখে তার মনে কৌতূহল জাগে। সে আরেকটু কাছে এগিয়ে যায়। তারপরই খেয়াল করে জ্যাকেট পরা এক লোকের হাতে পিস্তল। তবে জিনিসটার নল অস্বাভাবিক বড়। সিনেমায় দেখেছে ওরকম পিস্তল থেকে গুলি করলেও কোনো আওয়াজ হয় না। লোক দুটো পিস্তল নিয়ে এরকম জায়গায় কি করছে-কৌতূহলি হয়ে সে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। জ্যাকেট পরা লোকটি এরপর চলে যায় বড় বড় দুটো পাথরের আড়ালে। ওগুলো এতো বড় পাথর যে, কিছুই দেখতে পায় নি সে, তবে একটু পরই দেখে সৈকতে কিছু মরাঝিনুক আর শামুক আপনাআপনি ছিটকে যাচ্ছে! খুঁড়িয়ে যাচ্ছে।

    বুঝতে পারে, যেমনটি ভেবেছিলো, ঐ বড় নলওয়ালা পিস্তল দিয়ে গুলি করা হচ্ছে। তারপরই বড় পাথরের আড়াল থেকে জ্যাকেট পরা লোকটি বের হয়ে এসে সঙ্গির সাথে কথা বলতে শুরু করে। ঠিক তখনই লোকটা টের পেয়ে যায়। চট করে ঘুরতেই বসে পড়ে সে কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। লোকটা পাথরের কাছে এসে খপ করে ধরে ফেলে তাকে।

    “ওদের একজনের কাছেই পিস্তল ছিলো?” সব শুনে ওয়াসি জানতে চাইলো।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মুজাহিদ। “লম্বা নলের পিস্তল।”

    “কি হয়েছে?” ওদের দলের বাকি নয়জনের কাছে আসতেই ইসমাইল : বলে উঠলো।

    “তোমরা সবাই ঘরে চলে যাও!” চিৎকার করে বললো কাফা। “এক্ষুণি!”

    *

    জাভেদ গাড়ি চালাচ্ছে। পেছনে বসে আছে বাস্টার্ড। তারা এখন গুলশান-এ ইকবালে ফিরে যাচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টার পথ।

    “আমি ভাবতেই পারছি না এরকম নিরিবিলি জায়গায় ওরা কি করছিলো।” গাড়ি চালাতে চালাতে বললো ছেলেটা।

    “চিন্তার কিছু নেই। ওরা আর আমাদের এ জীবনে দেখবে না,” বললো বাস্টার্ড।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। কথাটা মিথ্যে নয়। এর আগে ওখানে সে নিজেই গেছে মাত্র দু-বার, তাও বিশেষ প্রয়োজনে। মজার ব্যাপার হলো তিনবারই অস্ত্র পরীক্ষা করার জন্য। আগের দু-বার অবশ্য এমকিউএম-এর হয়ে।

    পেছনের সিটে বসে বাস্টার্ড বাইরে তাকালো। প্রচুর খালি জায়গা পড়ে আছে সড়কের দু-পাশে। মাঝেমধ্যে নতুন নতুন কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভবন চোখে পড়ছে। শত শত আন্ডারকন্ট্রাকশন গজিয়ে উঠছে শহরের বুকে। জায়গাটা খালিই ছিলো, এখন আবাসিক চাহিদা মেটাতে নতুন করে বসতি তৈরি করা হচ্ছে।

    “লাঞ্চ করবেন কখন?”

    জাভেদের কথায় সামনের দিকে তাকালো। “গুলশানের আগে ভালো কোথাও খেয়ে নেয়া যেতে পারে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “মেলা রেস্টুরেন্টের খাবার বেশ ভালো। ওটা যাওয়ার পথেই পড়বে।”

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। করাচির কোন্ রেস্টুরেন্টের খাবার ভালো নয়? “ওকে।” জাভেদ যেটার কথা বলে সেটাই ভালো। হয় সে ভালো জায়গার নাম বলে নয়তো সব জায়গাই তার কাছে ভালো। নিজের শহর বলে কথা।

    দীর্ঘ ভ্রমনের পর অবশেষে মেলা রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো তাদের গাড়িটা।

    অধ্যায় ৩৩

    সমুদ্রের তীরবর্তী জায়গায় এসে তাদের খুব ভালো লাগছিলো। বুজুর্গ নেই বলে ভেবেছিলো দুপুরে আরব-সাগরে অবগাহন করবে। সমুদ্রে গোসল করার মজাই আলাদা। সবই ঠিক ছিলো কিন্তু মুজাহিদের একটা ভুলে পণ্ড হয়ে গেছে। তাদের সমুদ্র-স্নান। আবারো তারা গৃহবন্দী। যদিও সমুদ্র তীরবর্তী বলে ঢেউয়ের গর্জন কানে যাচ্ছে কিন্তু জানালা খুলে সে-দৃশ্য দেখার কোনো উপায় নেই। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে তাদেরকে বলা হয়েছে ঘর থেকে যেনো কেউ বের না-হয়। খারাপ কিছুর আশংকা করছে তাদের মুরুব্বিরা।

    ঘরের সবাই মুজাহিদের দিকে কটমট চোখে চেয়ে আছে। কী দরকার ছিলো একা একা হেঁটে অতো দূরে যাওয়ার! ছেলেটার এই বাড়তি কৌতূহল না-জানি আর কতো মুসিবত ডেকে আনে।

    দশ জনের দলটি সমুদ্রের কাছাকাছি থেকেও এখন বন্দী। তাদের দেখাশোনা করে যে দু-জন তারা বলছে মুজাহিদ যে জায়গার কথা বলেছিলো সেখানে গিয়ে তিনটি গুলির খোসা পেয়েছে। ওগুলো সঙ্গে করে নিয়েও এসেছে দেখানোর জন্য। তার মানে ঘটনা মোটেও ভালো নয়। এখানে ফিরে এসে ওরা বুজুর্গসহ আরো কয়েকজনকে ফোন করেছে। পুরো ঘটনাটা জানিয়ে দিয়েছে উপর মহলে।

    “কি দরকার ছিলো ওখানে যাওয়ার?” বিরক্ত হয়ে বললো পশতুন ছেলেটা।

    একে ভালো লাগে না মুজাহিদের। কথাবার্তা কেমনজানি চাড়ালের মতো। সে কোনো জবাব দিলো না।

    “সব সময় তুমি বাড়াবাড়ি করো।”

    “ও যদি ওখানে না যেতো তাহলে তো ঘটনা আরো বড় কিছু হতে পারতো,” শীতলকণ্ঠে বললো ইসমাইল। ঘরে আসার পর এই প্রথম সে মুখ খুললো। “এখন বরং ভালোই হয়েছে। সবাই জানতে পেরেছে আমাদের পেছনে ফেউ লেগেছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে। ও না দেখেলে কি হতো, একবার ভেবে দেখো?”

    ইসমাইলভাই তার পক্ষে কথা বলছে দেখে খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করলো। মুজাহিদের কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। চুপ মেরে মেঝের দিকে চেয়ে রইলো সে।

    পশতুন ছেলেটা আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। ঘরে নেমে এলো কঠিন নীরবতা। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট কেটে গেলো এভাবে। তারপর দরজা খোলার শব্দ। ঘরে ঢুকলো দেখভাল করা দু-জনের একজন কাফা।

    “এই যে তুমি,” মুজাহিদের দিকে আঙুল তুলে বললো সে। “আমার সাথে আসো।”

    একবার লোকটা, আরেকবার ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে মুজাহিদ ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালো।

    “যা। কোনো ভয় নেই,” ইসমাইল বললো। সে জানে কেন ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। “উনারা যা যা জানতে চাইবেন সব বলবি। ঠিক আছে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো আবু মুজাহিদ।

    ঘরের বাইরে অপরিচিত এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। মুজাহিদ এর আগে কখনও লোকটাকে দেখে নি। চেহারা কেমন কঠিন। “আস্স্লামালেকুম,” বললো সে।

    “ওয়ালাইকুম আসোলাম।” হাত না তুলেই সালামের জবাব নিলো লোকটা। “তুমি যা যা দেখেছো সব বলো।”

    ঢোক গিলে আরো একবার সব বলতে শুরু করলো ছেলেটি।

    *

    আইনাতের সাথে মওলানা ইউসুফের কি সম্পর্ক সেটা এখনও জানা যায় নি। তবে বাস্টার্ড ধারণা করছে মেয়ে হবার সম্ভাবনাই বেশি। তাকে দেখে মনে হয় না বিবাহিত, লন্ডনে পড়াশোনা করেছে, বয়স আনুমানিক সাতাশ-আঠাশের মতো হবে। সুতরাং ছেলের বৌ হিসেবে বাদ দেয়া যেতে পারে।

    মেয়েটার সাথে ভাব জমিয়ে কিছু তথ্য আদায় করা যাবে। এমন কিছু তথ্য যা অন্য কোথাও থেকে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং বাকি দিনগুলো মওলানাকে রেকি করার পাশাপাশি মেয়েটার সাথেও দেখা-সাক্ষাত চালিয়ে যেতে হবে। ঘটনাচক্রে আইনাতের সাথে তার পরিচয়টা অভাবনীয় সৌভাগ্যেরই কিন্তু সমস্যাও আছে একটা-এরপর থেকে মওলানার বাড়ির সামনে রেকি করতে হবে খুব সতর্কতার সাথে। মেয়েটা তাকে দেখে ফেললে অন্যকিছু সন্দেহ করে সতে পারে।

    ঐদিন বিকেলের পর পর জাভেদের জন্য অপেক্ষা করার সময় কি মনে করে যেনো জিপিএস ট্র্যাকারটি চালু করে দেখলো। সে জানে কিছুই পাবে না। আধুনিক প্রযুক্তি তাকে কোনো সাহায্যই করতে পারছে না এ কাজে। কিন্তু চমকে যাবার মতো অবস্থা হলো একটু পরই। ট্র্যাকারে দেখতে পেলো ঐ বইটা মুভ করছে! তার মানে মওলানা ওটা নিয়ে কোথাও যাচ্ছে? নড়েচড়ে উঠলো সে। এখনও গুলশান টাওয়ার থেকে বের হয় নি। সঙ্গে সঙ্গে ট্র্যাকারটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। লিফটে করে নীচে নামার সময় জাভেদের ফোন পেয়ে খুশিই হলো সে। হোটেল সামুনাবাদের বাইরে জাভেদ অপেক্ষা করছে। তাকে নিয়ে সোজা চলে গেলো গুলজার-এ-হিজরিতে।

    আজ সে মাথায় সানক্যাপ আর চোখে জিরো পাওয়ারের চশমা পরেছে। তার বেশভুষাও কিছুটা আলাদা। গতকাল আলীর ডিসকো’তে যে-রকম জামা কাপড় পরেছিলো তার থেকে ভিন্ন। জ্যাকেটের বদলে আজ গায়ে চাপিয়েছে ব্লেজার-তার সবচেয়ে অপ্রিয় পোশাক। সকালের দিকে হোটেলের খুব কাছে একটা দোকান থেকে কিনে নিয়েছে এটা। জিন্সপ্যান্টের বদলে গ্যাবাডিনের যে প্যান্টটি পরেছে সেটাও ঐ দোকান থেকে কেনা। বলতে গেলে আজকের জন্য তাকে পুরোপুরি আলাদা একসেট পোশাক কিনে নিতে হয়েছে।

    সকালে উঠে প্রতিদিন যে শেভ করে আজ তারও ব্যতিক্রম করেছে। এসব করার একটাই উদ্দেশ্য, আইনাত তাকে কোনোভাবে দেখে ফেললেও যেনো চিনতে না পারে। তবে পোশাকের চেয়েও বেশি যে কাজটা করলো, সেটা একেবারেই ভিন্নরকম। নিজের হাটা-চলার ভঙ্গি পাল্টে ফেললো। অন্তত মওলানার বাড়ির সামনে যতোক্ষণ থাকবে ততোক্ষণ অন্য একটি ভঙ্গিতেই হাটবে।

    ওখানে যাবার আগে এক প্যাকেট চুইংগামও নিয়ে নিলো। যখনই বাড়ির সামনে হাটাহাটি করার দরকার পড়বে তখন একদলা চুইংগাম গালের দু-পাশে রেখে দেবে মুখায়ব বদলে ফেলার জন্য। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, জামা কাপড় পাল্টে ফেলার চেয়ে হাটার ভঙ্গি আর মুখায়বের সামান্য পরিবর্তন অনেক বেশি কাজে দেয়। বিশেষ করে দূর থেকে কোনো মানুষকে চেনা যায়, অনেক মানুষের ভীড়ে একজনকে চিহ্নিত করা যায় হাটার ভঙ্গি দেখেই।

    তার এইটুকু পরিবর্তন জাভেদের চোখ এড়ালো না। ছেলেটা অবশ্য এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করলেও তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা তার নজর এড়ায় নি।

    জিপিএস ট্র্যাকারের দিকে চেয়ে থেকে বললো সে, “একটু জোরে চালাও।”

    মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলো জাভেদ।

    নিঃসন্দেহে মওলানা এখন গাড়িতে। ট্র্যাকার বলছে গাড়িটা টাওয়ার থেকে বের হয়েছে। বাস্টার্ডের ধারণা মওলানা ওখানে পৌঁছার আগেই তাদের গাড়ি পৌঁছে যাবে।

    গাড়িটা যখন গুলজার-এ-হিজরিতে প্রবেশ করলো তখন ঘড়িতে দেখলো ৫টা ০৫। দিনটা মেঘাচ্ছন্ন বলে সন্ধ্যা নেমে গেছে তাড়াতাড়ি। অন্যসব দিনের মতোই অভিজাত আবাসিক এলাকাটি নিরিবিলি। ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকার মতো এখানে কোনো বাণিজ্যিক অফিস, স্কুল-কলেজ নেই। এরকম একটি জায়গা তাকে বাড়তি একটা সুবিধা দেবে : ঝটপট কাজটা করে সটকে পড়তে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

    “ভাই, এখানে রাখবো?” মওলানার বাড়ির উল্টোদিকে গাড়িটা থামিয়ে জানতে চাইলে জাভেদ।

    গাড়ির বাইরে তাকালো সে। “হুম। ইউ-টার্ন করে আবার এখানে চলে আসো।” ফিরে যাবার প্রস্ততিটা আগেই নিয়ে রাখলো সে।

    জাভেদ ফাঁকা রাস্তার বামপাশে গাড়িটা এনে গতি কমিয়ে একটু সামনে এগিয়েই ইউ-টার্ন করে যে লো সুন্দরভাবে। তার চমৎকার ইউ-টার্নই বলে দিচ্ছে চালক হিসেবে সে দারুণ দক্ষ।

    গুলজার-এ-হিজরির তিন নাম্বার বাড়ির সামনে যে রাস্তাটা আছে তার বিপরীত দিকে গাড়িটা পার্ক করা হলো। চারপাশ জুড়ে নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। দামি দামি সব প্রাইভেটকার ঢুকতে শুরু করছে গুলজার-এ-হিজরিতে। কাজ সেরে বাসিন্দারা ফিরে আসছে নিজেদের ঘরে।

    জিপিএস ট্র্যাকার বলছে মওলানার গাড়িটা মাঝপথে কোথাও থেমেছে।

    একটা সিগারেট ধরালো জাভেদ। সে জিপিএস ট্র্যাকারের সাথে পরিচিত নয়। রিয়ার-মিররে দেখে বুঝতে পারছে না এরকম জিনিস এতো মনোযোগ দিয়ে দেখার কারণটা কি। উঠতি বয়সি ছেলেপেলেরা যখন মোবাইলফোনে গেমস খেলে তখন এভাবে মাথা নীচু করে রাখে।

    হঠাৎ পেছনের সিট থেকে বাস্টার্ড বলে উঠলো, “পিস্তলটা দাও।”

    রিয়ার-মিররে সে দেখতে পেলো জাভেদ একটু অবাকই হয়েছে। ড্যাশবোর্ডের নীচে গোপন কম্পার্টমেন্ট থেকে অস্ত্রটা বের করে তার হাতে তুলে দিলো সে।

    সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা ব্লেজারের ভেতরের পকেটে রেখে দিলো বাস্টার্ড। সিগারেট টানতে থাকলেও জাভেদের চোখ রিয়ার-মিররে নিবদ্ধ। পেছনের যাত্রির মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে সে। তবে মুখটা বরাবরের মতোই বন্ধ রাখলো।

    “ইঞ্জিন বন্ধ কোরো না…আমি এক্ষুণি চলে আসবো,” বলেই দরজা খুলে নেমে পড়লো সে।

    জাভেদ ওয়ার্সি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না এই লোক পিস্তল নিয়ে এখন কি করতে যাচ্ছে। নিশ্চয় ঐ বাড়িতে ঢুকে কাউকে খুন করতে যাচ্ছে না, নাকি তাই করবে?

    অ্যায়সা কুছ নেহি, মনে মনে বলে উঠলো সে, অনেকটা নিজেকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে। পেছন ফিরে তীক্ষ্ণচোখে চেয়ে রইলো তওফিক আহমেদের দিকে। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে গতকালের ঐ ঝোঁপের দিকে এগিয়ে গেলেও তার মনে হচ্ছে না প্রস্রাব করতে যাচ্ছে।

    যাহোক, সামনের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে জোরে জোরে টান দিলো কয়েকটা। রেডিওটা ছেড়ে দিলো গান শোনার জন্য, তবে ভলিউম একদম কমিয়ে রাখলো। একটা পুরনো সিনেমার গান বাজছে। সেটার সাথে গুন গুন করতে শুরু করলো সে। গানটা যখন মাঝপথে তখনই অবাক হয়ে দেখলো সামনের বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকা থেকে আসা লোকটি!

    অধ্যায় ৩৪

    মওলানা ইউসুফের বাড়ি দু-তিনদিন পর্যবেক্ষণ করে সে দেখেছে, মেইনগেটটা সব সময় বন্ধই থাকে। একজন দারোয়ান আছে তবে সে থাকে গেটের ওপাশে। মেইনগেটের ঠিক পাশে মানুষজন চলাচলের জন্য যে ছোট্ট আরেকটি গেট আছে ওটাও সারাক্ষণ বন্ধ করেই রাখা হয়। এ কয়দিনে ওই গেটটা দিয়ে কাউকে আসা-যাওয়া করতেও দেখে নি।

    চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ করে ওয়াকওয়েতে উপুড় হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে লাগলো সে।

    জাভেদ গাড়িতে বসে দেখছে। সামাদভায়ের লোকটার কাজকর্ম কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রথমে ভেবেছিলো কাউকে খুন করার পায়তারা করছে, পরে দেখলো এক মেয়ের পেছনে লেগেছে। সাইলেন্সর পিস্তল দিয়ে একটা মেয়ের সাথে এই লোক কি করবে–হিসেব মেলাতে পারে নি কোনোভাবেই। এখন আবার মেয়েটার বাড়ির সামনে জুতোর ফিতে বাঁধছে, তাও সঙ্গে পিস্তল নিয়ে!

    জুতোর ফিতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও বাস্টার্ডের চোখ রাস্তার দিকে। একটু আগে সে জিপিএস ট্র্যাকারে দেখেছে মওলানার গাড়িটা গুলজার-এ হিজরিতে প্রবেশ করেছে। জাভেদের সামনে কাজটা করার কোনো প্ল্যান ছিলো না তার কিন্তু সব সময় প্ল্যানমতো সবকিছু করা যায় না। এখন হুট করে পেয়ে যাওয়া এই সুযোগ হাতছাড়া করার বিলাসিতা দেখাতে পারে না। বারো শ’ মাইল দূরে, করাচির মতো শহরে এমন সুযোগ সে বার বার পাবে না। জুতোর ফিতে বাঁধার ভঙ্গি করতে করতে একটু পর কি করবে সেটা ঠিক করে নিলো।

    মওলানার গাড়িটা মেইনগেটের সামনে এসে থামবে। হর্ন বাজাবে ড্রাইভার। বন্ধ গেটের ওপাশে দারোয়ান ছোট্ট একটা খুপরি দিয়ে দেখে নেবে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেবে গেটটা। আস্তে করে গাড়িটা ঢুকে পড়বে ভেতরে।

    পুরো ব্যাপারটা ঘটতে কমপক্ষে এক মিনিট লাগবেই। তার জন্য এক মিনিট অনেক বেশি সময়। ব্লেজারের ভেতরের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকা মওলানাকে দুটো কিংবা তিনটে গুলি করতে দশ সেকেন্ডও লাগবে না।

    গাড়িটা থামতেই এগিয়ে যাবে ঠাণ্ডা মাথায়। প্যাসেঞ্জার ডোরের কাঁচ গুঁড়িয়ে ঢুকে পড়বে তার পিস্তলের গুলি। তোতা শব্দ আর একটা চিৎকার-এছাড়া কিছু হবে না। এলাকাটা নিরিবিলি বলে এই শব্দ শুনে সঙ্গে সঙ্গে কেউ এগিয়ে আসবে না সেটা নিশ্চিত। আর যদি কেউ এগিয়ে আসেও ততোক্ষণে রাস্তার ওপাড়ে পার্ক করা জাভেদের গাড়িতে করে চলে যেতে পারবে।

    একটা শব্দ শুনে সামনের মোড়ের দিকে তাকালো। সামনের মোড়ের বামদিক দিয়ে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি।

    কালো রঙের সেই হামারটি!

    সাইড-ডোরে খিদমত-এ-খালাক লেখাটা তার চোখ পড়লো! উপুড় হয়েই রইলো সে। হাত জুতোর ফিতায় থাকলেও চোখ গাড়িটার দিকে নিবদ্ধ।

    হামারটা তাকে অতিক্রম করে ডানদিকে মোড় নিয়ে মওলানার মেইনগেটের সামনে থামতেই উঠে দাঁড়ালো সে। ড্রাইভার হর্ন বাজালো পর পর দু-বার। ঘুরে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। ডানহাতটা চলে গেলো ব্লেজারের ভেতরে। গাড়িটা তার থেকে মাত্র দশ-বারো ফুট দূরে। বেশ ধীর-স্থির কিন্তু মোটেও ধীরগতির নয়, এমনভাবে দু-পা এগিয়ে যেতেই পিস্তলটা যে-ই না বের করবে অমনি বিশাল একটা ধাক্কা খেলো সে।

    হামারের ইনসাইড লাইটের মৃদু আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এক তরুণ আয়েশ করে বসে আছে, কানে ফোন চেপে হাসি-হাসি মুখে কথা বলছে সে। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।

    এ তো মওলানা নয়!

    মাত্র কয়েকদিন আগে খুব কাছ থেকে মওলানাকে দেখেছে, ভুল হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে বামদিকে সরে গেলো সে। ব্লেজারের ভেতর থেকে খালি হাতটা বের করে আনলো। দ্রুত পায়ে রাস্তা পার হয়ে জাভেদের গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ঢুকে পড়লো।

    তার এই অবস্থা দেখে জাভেদ যারপরনাই অবাক। গাড়ির ভেতর থেকে সবটাই দেখেছে সে। “কি হয়েছে, ভাই?”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাস্টার্ড। “কিছু না।” চুপ মেরে গেলো জাভেদ ওয়ার্সি। খুব বেশি প্রশ্ন করার কথা নয় তার। রিয়ার-মিররে তাকিয়ে দেখলো পেছনের যাত্রি কি করছে। ঢাকা থেকে আসা লোকটির চোখেমুখে এই প্রথম ভড়কে যাবার চিহ্ন দেখতে পেলো।

    কয়েক মুহূর্তের অসহ্য নীরবতার পর মুখ খুললো বাস্টার্ড। “চলো, এখানে থেকে আর লাভ নেই।”

    জাভেদ চুপচাপ আদেশ পালন করলো আরো একবার। কিছু একটা যে গড়বড় হয়েছে সেটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।

    ওদিকে পেছনের সিটে বসে হাফ ছাড়লো বাস্টার্ড। আরেকটুর জন্য সবকিছু ভেস্তে যেতে বসেছিলো।

    অধ্যায় ৩৫

    করাচি
    আরব-সাগরতীরে অজ্ঞাত একস্থান

    ঘরটা সৈকতের এততটাই কাছে যে ঢেউয়ের গর্জন শোনা যাচ্ছে। জানালা খুলে রাখলে অবশ্য আরব-সাগরের মনোরম দৃশ্য দেখা যেতো কিন্তু সে উপায় নেই।

    দরজা-জানালা বন্ধ ঘরে তিনজন ভিন্ন ভিন্ন বয়স আর বেশভুষার মানুষ বসে আছে মুখ ভার করে। তারা সবাই সময়মতো চলে এলেও একজন এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায় নি। সেটা কোনো সমস্যা হতো না যদি লোকটা অন্য কেউ হতো। কিন্তু যে প্রজেক্ট নিয়ে এই মিটিং তার ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে আলোচনা শুরু করা যায় না। অপেক্ষার এই সময়টাতে একদফা চা পান করে নিয়েছে সবাই।

    তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক হলো মুফতি নামের একজন। আগে সে জামাত-উল-দাওয়া করতো, পরে লস্করে যোগ দিয়েছে। বয়সের কারণেই ধৈর্যের পরীক্ষায় তাকে কেউ হারাতে পারবে না। মেজর জেনারেলকে নিয়েও কোনো সমস্যা নেই। দীর্ঘদিন সে সামরিক বাহিনীতে ছিলো। অধৈর্য হওয়াটা তার পেশার সাথে বেমানান। জাঁদরেল এই মানুষটি চুপচাপ কী যেনো ভেবে যাচ্ছে। ঘরের বাকি দু-জন একে খুব সমীহ করে। তবে জিন্স প্যান্ট আর লেদার জ্যাকেট পরা ঘরের তৃতীয় ব্যক্তিটি বার বার ঘড়ি দেখছে। ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে আছে কোনো কারণে। বয়স চল্লিশ পেরোয় নি। মুখের চাপদাড়ি সুন্দর করে ছাটা। ঘরের সবাই একে আড়ালে আবডালে ‘ডিসকো মুজাহিদ নামে ডাকে। এর কারণ, সে অন্যদের মতো নয়; সব সময় ওয়েস্টার্ন আউটফিটে থাকে। প্রচুর দেশ-বিদেশ ঘুরতে হয় বলে সন্দেহের উর্ধ্বে থেকে চলাফেরা করতে হয়। একজন মোল্লা কিংবা সন্ত্রাসীর মতো দেখা যাক এটা সে কখনও চায় না। কয়েক বছর আগে এ-ঘরের বাকিদের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের সময় ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলো তাকে নাকি পরিচিতজনেরা ডিসকো মুজাহিদ বলে ডাকে। সেই থেকে এরাও নামটা ব্যবহার করে আসছে।

    “মীর এতো দেরি করছে কেন?” চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললো সেই ডিসকো মুজাহিদ।

    “ও সব সময়ই দেরি করে আসে,” মুফতি গম্ভীরমুখে বললো। সে জানে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই অল্পবয়সি করিৎকর্মা ছোকরা এ-কাজটা ইচ্ছেকৃতভাবেই করে।

    মেজর জেনারেল তার কথাটা শুনে শুধু একপলক তাকালো তারপর আবারো ডুবে রইলো নিজের ভাবনায়। এমন সময় ঘরের বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেলে সবাই একে অন্যের দিকে তাকালো। তারা বুঝতে পারছে মীর চলে এসেছে।

    মুফতি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

    “মাফ করবেন আমায়, একটু দেরি হয়ে গেলো,” ঘরে ঢুকেই নিপাট ভদ্রলোকের মতো বিনয় দেখিয়ে বললো মীর। তার চাপদাড়ি সব সময়ই সুন্দর করে ট্রিম করা থাকে।

    সাজিদ মীরের আগমনে স্বস্তি নেমে এলো ঘরে। ডিসকো মুজাহিদ কিছু না বলে আলতো করে বাঁকা হাসি দিলো কেবল। এই মীর হলো তাদের সংগঠনেরে মধ্যে সবচাইতে স্মার্ট লোক। যেখানেই যাক না কেন দু-জন দেহরক্ষি নিয়ে যায়। সব সময় সঙ্গে রাখে মাকারভ পিস্তল।

    খালি চেয়ারটায় বসেই মীর বললো, “মেজর জেনারেল আমাকে ফোনে সব জানিয়েছেন। আজকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি লাখভিসাহাব আর হাফিজ সঈদের সাথে কথা বলেছি।”

    ঘরের সবাই নড়েচড়ে বসলো। তাদের সংগঠনের এই শীর্ষ দু-জনের কথা শোনার জন্য উদগ্রীব তারা।

    “উনারা বলেছেন আপনাদের সাথে এ নিয়ে যেনো শলাপরামর্শ করি। উনি আপনাদের মতামতকে বেশ গুরুত্ব দেন।”

    মুফতি আর ডিসকো গর্বিত বোধ করলো।

    “তো, আপনারা সন্দেহ করছেন ঐ দু-জন হিন্দুস্তানী এজেন্ট, তাই তো?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো ঘরের সবচাইতে বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি। এছাড়া অন্য কোনো কারণ তো থাকতে পারে না। ছেলেটা বলছে পিস্তলহাতের লোকটা নাকি ভুলভাল উর্দু বলছিলো।”

    “আমার তা মনে হচ্ছে না,” মেজর জেনারেল বললো। করাচিতে ওদের লোকবল খুব কম। তাছাড়া সদলবলে হামলা করার মতো সাহস ওরা কখনও দেখায় নি। আর ভুলভাল উর্দু বলার অনেক কারণ রয়েছে,” একটু বাঁকা হাসি দিলো সে, “ভুলে যাবেন না পাকিস্তানের খুব কম লোকেই উর্দুতে কথা বলে।

    এখানে আরো কয়েকটা ভাষা আছে।”

    “যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে বিচে গুলি করছিলো কেন? তাও আবার ঝিনুক আর শামুকের খোলসে?” ডিসকো মুজাহিদ জানতে চাইলো।

    “সম্ভবত অস্ত্রটা পরীক্ষা করছিলো…একটা সাইলেন্সার পিস্তল…ঐ ছেলেটা যদি ঠিকমতো দেখে থাকে আর কি,” জেনারেল যোগ করলো।

    “ওরা যদি হিন্দুস্তানী এজেন্ট না-হয়ে থাকে তাহলে অস্ত্র পরীক্ষা করতে কেন ওখানে এলো?” জানতে চাইলো মুফতি।

    কাঁধ তুললো মীর। “ওরা কারা ছিলো সেটা জানি না। তবে হিন্দুস্তানী এজেন্ট ছিলো না সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মেজর জেনারেল। সে আর মীর ছাড়া এই ঘরে বাকি দু-জনের মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, সেজন্যেই তারা অনেক কিছু বুঝতে পারে না। ব্যাখ্যা করলেও যে বুঝবে সে নিশ্চয়তা নেই।

    “আমাদের অপারেশনের সময় যখন ঘনিয়ে আসছে তখন এরকম ঘটনাকে হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না,” বললো ডিসকো মুজাহিদ।

    “তাহলে আমরা কি করবো?” মেজর জেনারেল জানতে চাইলো। “ঐ দু জনের খোঁজে পুরো শহর চষে বেড়াবো?”

    মুফতি আর ডিসকো মুজাহিদ কিছু বললো না।

    “আপনারা বুঝতে পারছেন না, এটা করতে গেলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে।”

    জোনারেলসাবের এ কথাটা বুঝতে পারলো না মুফতি। “কেন?”

    মুচকি হাসলো সাজিদ মীর। সে কথাটার মানে পুরোপুরি ধরতে পেরেছে, তবে কিছু না বলে চুপ থাকলো।

    করাচিতে ওদের যে-কয়জন এজেন্ট আছে ওরা যখন জানতে পারবে আমরা হন্যে হয়ে উঠেছি…ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছি তখন ওরা যেটা জানে না সেটাও অনুমান করে নেবে।”

    ডিসকো মুজাহিদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো মেজর জেনালের দিকে।

    “ওরা তখন দুয়ে দুয়ে চার মেলাবে। বুঝে যাবে আমরা বড় কিছু করতে যাচ্ছি।”

    আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো মীর। সে জানে জেনারেলের এই ধারণা একদম ঠিক।

    “তাই বলে ওই দু-জনের ব্যাপারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো মুফতি। “সেপ্টেম্বরের কথা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না।”

    “আ-হা,” মাথা দোলালো মেজর জেনারেল। “সেপ্টেম্বরের ঘটনাটা অন্য কারণে হয়েছে।”

    “কি কারণে সেটা কি আপনি একটু বলবেন?” ডিসকো মুজাহিদ বিনয়ের সাথে জানতে চাইলো। “আমি কিন্তু এখনও জানি না কেন ওরকম হয়েছিলো।”

    “কিছু নাদান লোকজনের কারণে ওটা হয়েছে।”

    মীর ছাড়া ঘরের অন্য দু-জন ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো।

    “একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?” অবশেষে জানতে চাইলো মুফতি।

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেজর জেনারেল। “আপনাদের এক নাদান লোক মুজাম্মিল…সে ইনসিকিউর ফোনে আরেকজনের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছিলো। ওরা ওর ফোন ইন্টারসেপ্ট করে ঘটনাটা জেনে যায়।”

    আবারো মাথা নেড়ে সায় দিলো মীর।

    ডিসকো মুজাহিদ কথাটা শুনে থ বনে গেলো। সে ভেবেছিলো রিক্রুটমেন্টের সমস্যা ছিলো ওটা। ট্রেইনিং পাওয়া অনেকেই পালিয়ে যায়, ওরকমই পালিয়ে যাওয়া একজন হয়তো ওদের জানিয়ে দিয়েছিলো। “আপনি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?” জানতে চাইলো সে।

    “হুম।” মেজর জেনারেল দৃঢ়ভাবে বললো। “যারা পালিয়ে গেছিলো ওরা জানতো না আমাদের প্ল্যানটা কি। ওরা কিভাবে এসব জানাবে?”

    কথাটা সত্যি। আগের চেয়ে তারা অনেক বেশি সাবধান আর সতর্ক হয়ে উঠেছে। এখন ট্রেইনিং শেষ হলেও কিছু জানানো হয় না। একদম শেষমুহূর্তে বলা হয় কোথায় গিয়ে কি করতে হবে।

    “ওই দু-জন হয়তো কোনো গুণ্ডা-বদমাশ হয়ে থাকবে,” আবারো বেশ জোর দিয়ে বললো মেজর জেনারেল। “নিরিবিলি জায়গা এসে অস্ত্র কেনাবেচা করছিলো…তখন হয়তো অস্ত্রটা পরীক্ষা করেও দেখেছে।”

    “আপনি বলতে চাইছেন, ঐ দু-জন নিছক অস্ত্রব্যবসায়ি?” মুফতি নিশ্চিত হতে চাইছে।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো জেনারেল। এছাড়া আর কিছু মনে করতে পারছি না।”

    “আমিও তাই মনে করি,” মীর বললো এবার।

    “আমার মনে হয় ওরা আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু জানে না ঠিকই কিন্তু স্পেশাল ট্রেইনিংয়ের খবর জেনে গেছে কোনোভাবে,” ডিসকো মুজাহিদ বললো সমর্থন পাবার আশায়, “তাই হয়তো ফেউ লাগিয়ে জানার চেষ্টা করছে। ওই দু-জন হলো ফেউ।”

    “সামান্য ফেউ পিস্তল নিয়ে পরীক্ষা করবে, তাও আবার আমাদের সেফহোমের কাছকাছি এসে?” জেনারেল সন্দিহান এখনও। “জীবনেও করবে না। ওরা নিছক গুণ্ডা-বদমাশ ছিলো। ভুলে যাচ্ছেন কেন, এটা করাচি…শহরটা এরকম লোকজনে গিজগিজ করছে।”

    “তাহলে কি আমরা ঠিক সময়েই অপারেশনটা করবো?” মুফতিকে খুব উদ্বিগ্ন দেখালো।

    “হ্যাঁ। অপারেশন ঠিক সময়েই হবে,” জবাব দিলো মীর।

    মনে মনে মুচকি হাসলো মেজর জেনারেল। এই মুফতির উদ্বিগ্নতার কারণ সে ভালো করেই জানে। অচিরেই বড় কোনো ‘হল্লা’ না ঘটালে ওর সংগঠনের ডোনেশনে টান পড়বে। সারা দুনিয়াব্যাপী, বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য ধনী শেখ-আমির-বিত্তবান লোকজন তাদের সম্পদের একটি অংশ বিভিন্ন জেহাদি সংগঠনকে অনুদান হিসেবে দিয়ে থাকে। এরা যে সবাই খুব ধার্মিক তা নয়। এদের অনেকেই এমনসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত যে সাচ্চা কোনো মুসলমান সত্যিটা জানতে পারলে জ্ঞান হারাবে! তবে আর সবার মতোই এরা নিজেদের পাপের ভার একটু কমানোর জন্য অপরাধবোধ থেকে কিংবা পরকাল বেহাত হবার ভয় থেকে প্রচুর অনুদান দিয়ে থাকে। ডোনারদের এই তালিকায় সত্যিকারের উগ্রপন্থী, বিক্ষুব্ধ ধনী মুসলিমও আছে। এরা নিজেরা জেহাদ না করে অনুদান দিয়ে দায়িত্ব সেরে ফেলে। ইরাক আফগানিস্তানে আমেরিকা জড়িয়ে পড়ার পর থেকে এইসব প্রক্সি-জিহাদিস্ট’ এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

    তো, ডোনাররা যখন দেখে তাদের অনুদান পেয়েও সংগঠনগুলো তেমন কিছু করতে পারছে না তখন নিজেদের উদারহাত গুটিয়ে নেয়। মুফতিদের সংগঠন অনেকদিন ধরে বড়সড় কিছু করতে পারছে না। ডোনেশনে টান পড়ছে। এখন তারা মরিয়া। বিরাট একটা ঘটনা ঘটাতে পারলে খরচের দশগুন ডোনেশন পাওয়া যাবে। এইসব লোকজনের কাছে জিহাদ একটি লাভজনক ব্যবসা!

    “জেনারেল ঠিকই বলেছেন। আমি বরং বলবো অপারেশনের সময় আরেকটু এগিয়ে আনা হোক,” আস্তে করে বললো মীর।

    “ঠিক। দেরি করলে থলে থেকে আরো কিছু বেড়াল বেরিয়ে যেতে পারে। আমার মনে হয়, হিন্দুস্তানী এজেন্ট নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবা উচিত।” মেজর জেনারেলের শেষ কথাটায় যে শ্লেষ আছে সেটা ঘরের বাকি সবাই বুঝতে পারলো। “এরইমধ্যে তিনজন পালিয়েছে…বেশি দেরি করলে আরো অনেকেই পালাবে,” আবারো বলতে লাগলো সে। “মনে রাখবেন, বুজুর্গের ‘ডোজ বেশিদিন কাজ করবে না। তাছাড়া ঐ দশজনের মধ্যে পাঁচজন কিন্তু এখন সব জেনে গেছে…তাদের মধ্যে কেউ যদি পালিয়ে যায় তাহলে অপারেশনটা পুরোপুরি পণ্ড হয়ে যেতে পারে।”

    “আমারও মনে হয় জেনারেলের কথাই ঠিক,” বললো ডিসকো মুজাহিদ। “অপারেশনের ডেট আর পেছানো ঠিক হবে না।”

    মুফতি সায় দিলো। “ঠিক আছে, ঠিক সময়েই তাহলে সব কাজ হবে।”

    “হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে,” সায় দিয়ে বললো ডিসকো মুজাহিদ। এরপর থেকে আমাদেরকে রিক্রুটমেন্টের ব্যাপারে আরো সতর্ক হতে হবে। এভাবে ট্রেইনিং নেবার পর পালানোর ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। নইলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।”

    “আমরা রিক্রুটের ব্যাপারে সব সময়ই সতর্ক থাকি,” জোর দিয়ে বললো মুফতি। “অন্য দুটো ডিপার্টমেন্টের চেয়ে অনেক বেশি।”

    জেনারেলসাব পরিচিত একটি দ্বন্দ্বের গন্ধ পেলো। সে বাইরের মানুষ হলেও দীর্ঘদিন এদের সাথে কাজ করছে, এদের তিনটি বিভাগের মধ্যে যে এক ধরণের দ্বন্দ্ব কাজ করে সে-ব্যাপারে ভালো ধারণা আছে তার। দাওয়াত-খিদমাত-জিহাদের মধ্যে দ্বন্দ্বটা সহজে চোখে পড়ে না, তবে কখনও কখনও প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কঠিন সময়গুলোতে।

    “রিক্রুটে যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে বাকিরা কি করলো এতোদিনে?” মুফতি আবার মুখ খুললো। কারণ বদনামটা তার বিভাগ দাওয়াতের উপরেই দেয়া হয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। “আমার মনে হয় টাকার বিনিময়ে জেহাদি রিক্রুট করাটাই যতো গোণ্ডগোলের কারণ।”।

    “আমরা কিন্তু সরাসরি টাকা দিয়ে কোনো জেহাদি কিনে নেই না,” খিদমাতের প্রধান ডিসকো মুজাহিদ বললো। “টাকা-পয়সা দেবার ব্যাপারগুলো খুবই সতর্কভাবে করা হয়। যাকে তাকে তো আর এরকম প্রস্তাব দেয়া হয় না।”

    “আমরাও সবার ব্যাপারে খোঁজ নেই,” বললো মীর। জিহাদ বিভাগের দায়িত্বে আছে সে। তাদের সংগঠনের প্রাণ এই বিভাগটিই।”একেবারে বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত।”

    “যে তিনজন পালিয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র একজনের পরিবারকে টাকা দেয়া হয়েছে,” ডিসকো মুজাহিদ বললো। “বাকিরা ঈমানি-জোশে এখানে এসেছে। সুতরাং পালিয়ে যাবার কারণ অন্য কিছু।”

    “আমিও তাই মনে করি,” মেজর জেনারেল বললো। “ঐ তিনজন ভীতু আর দুর্বলচিত্তের যুবক। যাদের স্বপ্ন আছে জিহাদ করার কিন্তু মুরোদ নেই। এরকম ঘটনা সব সময়ই ঘটে। যুদ্ধের ময়দানেও ফৌজ পালায়। ট্রেইনিংয়ের সময়েও অনেকে কুলোতে না পেরে কেটে পড়ে।”

    এ কথার পর ঘরের কেউ আর এই বিষয়টা নিয়ে কিছু বললো না। তারা জানে এসব ব্যাপারে জেনারেলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে।

    “তাহলে আমরা অপারেশন নিয়ে এগিয়ে যাই?” মীর বললো।

    “হ্যাঁ,” সায় দিলো মেজর জেনারেল। “আর র-এর ব্যাপারটা আমি দেখছি। ওদের দিক থেকে আদৌ কোনো হুমকি আসতে পারে কিনা সেটা খতিয়ে দেখবো। তবে আমার মনে হয় ওদের নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। আমরা যদি একটু সতর্ক থাকি, তাহলে ওরা তেমন কিছুই করতে পারবে না।”

    “এ জায়গাটা কি ছেড়ে দিতে হবে?” জানতে চাইলো ডিসকো মুজাহিদ।

    “না,” জোর দিয়ে বললো মীর, “এটা ছেড়ে দেবার দরকার নেই।”

    “তাহলে?” মুফতি আবারো মুখ খুললো।

    “একটা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিন ওদের।”

    “কোথায় সরিয়ে নেবেন?” জানতে চাইলো ডিসকো মুজাহিদ।

    বাঁকাহাসি দিলো মীর। “এইটুকু খিদমত করার তওফিক নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে দিয়েছে…কি বলেন?”

    চুপ মেরে গেলো খিদমাতের লোকটি।

    মেজর জেনারেল বললো, “ওদের সবাইকে আজই সরিয়ে ফেলুন। আমি এখানে কিছু ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখন থেকে কয়েকটা দিন ওরাই থাকবে এখানে।”

    মীর ছাড়া বাকি দু-জন বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো জেনারেলের দিকে।

    “নতুন ছেলে?” অবশেষে ডিসকো মুজাহিদই বললো।

    “হুম।”

    “এদের বাইরে আরো ছেলেকে ট্রেইনিং দেয়া হয়েছে নাকি?”

    মীর এমনভাবে ডিসকো মুজাহিদের দিকে তাকালো যেনো সে একটা বোকা। “আপনি যেরকম ভাবছেন তেমনটা নয়…এই ছেলেগুলো ওদের জন্য অপেক্ষা করবে…আদৌ যদি ওই দু-জন মালোয়ানের বাচ্চা হয়ে থাকে তো!”

    অধ্যায় ৩৬

    মওলানা ইউসুফ অসুস্থ? গতকাল দুপুরের পর বাসায় ফিরে গেছেন-কয়েকটা দিন বিশ্রাম নেবেন তিনি?

    একটু আগে মওলানার অফিসে ফোন করেছিলো সে। রিসেপশনিস্ট ফোন ধরলে বলেছিলো, আল-কোরান অ্যাকাডেমি অব লন্ডন থেকে হাফেজ মুনির বলছে, মওলানা ইউসুফের সাথে কথা বলতে চায়। ওপাশ থেকে মওলানার রিসেপশনিস্ট জানায় তার বস্ অফিসে নেই। কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। মওলানার বয়স হয়েছে। প্রায়ই অফিসের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে একটু বিশ্রাম নেন। সে চাইলে তার বড় ছেলে ইয়াকুব হোসাইনীর সাথে কথা বলতে পারে। উনি এখন অফিস করছেন।

    না। তার কোনো দরকার নেই। আলাপটা মওলানার সাথেই। উনি কবে ফিরতে পারেন?

    এটা সে জানে না।

    ও। ঠিক আছে। ধন্যবাদ।

    ফোনটা রেখে সে বুঝতে পারলো গতকাল কেন গাড়িতে মওলানা ছিলো না। তাহলে ঐ যুবক মওলানার ছেলে, পিতার অবর্তমানে অফিস করছে। একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত, বইটা নিয়েই বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো মওলানা ইউসুফ, তবে ভুল করে গাড়িতে রেখে গেছে। আর সেই গাড়িটাই এখন ব্যবহার করছে তার ছেলে।

    তার মানে মওলানা এখন বাড়িতেই বিশ্রাম নিচ্ছে। গুলজার-এ-হিজরিতে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আজকের জন্য রেকির কাজ স্থগিত অথচ এ কাজটি খুবই জরুরি তার জন্য। মওলানার গতিবিধি সম্পর্কে এখনও সামান্য ধারণাও পায় নি। আরেকটু সময় ব্যয় না করলে দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটি মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো ভাগ্য তার সহায় থাকবে না, যেমনটি গতকাল ছিলো। আর মাত্র দুয়েক সেকেন্ড এদিক ওদিক হলেই সব ভজঘট লেগে যেতো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাস্টার্ড। পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কিছু করা যাবে না। সময় যতোই লাগুক, তাকে নিশ্চিত হয়েই আঘাত হানতে হবে।

    সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বের করে জাভেদকে কল করলো সে। বিকেলের আগে দিয়ে তার গাড়ি নিয়ে আসার কথা। ছেলেটাকে বলে দেয়া দরকার এখন এসে সন্ধ্যার পর যেনো চলে আসে।

    “সন্ধ্যার পর কি হিজরি’তেই যাবেন ভাই?” জাভেদ জানতে চাইলো।

    “না…আলীর ডিসকোতে।”

    কয়েক মুহূর্তের জন্য ফোনের ওপাশে নীরবতা নেমে এলো। “ঠিক আছে, ভাই,” অবশেষে বললো ছেলেটি।

    মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিলো বাস্টার্ড।

    *

    প্রায় আধঘণ্টা ধরে আলীর ডিসকোতে আজ একাই বসে আছে সে। উদ্দেশ্য একটাই, মওলানার মেয়ে আইনাতের সাথে ভাব জমানো। মওলানা ইউসুফ নিজের বাড়িতে আছে। কতোদিন বিশ্রামে থাকবে সে জানে না। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তার পরিকল্পনা আবারো বদলে নিতে হবে। মেইনগেটের সামনে কাজটা কখন করা যাবে সেটা এখন অনিশ্চিত। আর ঐ বাড়ির ভেতরে ঢুকে খুন করাটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু সে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না, তাই বিকল্প পথ বের করার আশায় ডিসকোতে চলে এসেছে। তাকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েই বাইরে চলে গেছে জাভেদ। যতোক্ষণ সময় লাগে বাইরেই অপেক্ষা করবে সে। অবশ্য বের হয়ে যাবার সময় তাকে দুই পেগ ভদকা কিনে দিয়েছে।

    অন্যদিনের মতো আজো ফ্লোরে গিয়ে নাচানাচি না করে ঘরের এককোণে সোফায় বসে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে বাস্টার্ড। আইনাতকে এখনও দেখছে না। তবে সে নিশ্চিত মেয়েটা আসবে। ঘরে এখনও প্রচুর ফুর্তিবাজ লোকজন রয়েছে। রাত যতোই গম্ভীর হবে ততোই বাড়বে এদের সংখ্যা। এখানে যারা আছে তাদের বেশিরভাগই ফ্লোরে গিয়ে নাচানাচি করছে। যারা করছে না তারা হয় অপেক্ষা করছে নয়তো নেচে-টেচে ক্লান্ত, এখন ঠাণ্ডা বিয়ার কিংবা হুইস্কি ভদকা পান করছে। বেশিরভাগই বয়সে তরুণ তবে কিছু মাঝবয়সি লোকও আছে। ডিসকো’তে এসে মনপ্রান উজার করে নেচে যাচ্ছে তারা।

    করাচির এই ডিসকো তাকে যতোটা না বিস্মিত করেছে তারচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে বেগম নওয়াজিশ আলী। পুরুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে নিজের লিঙ্গ পাল্টে মেয়ে সেজে এই রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে, টিভি’তে টকশো করছে, অভিজাত এলাকায় ডিসকো চালাচ্ছে-ধর্মের ধ্বজাধারী তালিবানরা কোথায়?! স্কুলের বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েদের যারা রেহাই দেয় না তারা কিভাবে এটা সহ্য করছে!

    একটু পরই আলী এসে ডিসকোতে বাড়তি প্রাণ সঞ্চার করলো। যথারীতি একদল ছেলে-মেয়ে তাকে ঘিরে আছে। আজ সে পরেছে জর্জেটের কাজ করা শাড়ি, মুখে কড়া মেকআপ, চোখে মাসকারা। এমনকি স্বর্ণের অলঙ্কারও আছে তার গায়ে। একেবারে চোখ ধাঁধানো সুন্দরি! এই বেশে মেয়েদেরকেও হার মানাচ্ছে সে!

    সরাসরি ডান্সফ্লোরে চলে গেলো আলী। তাকে জায়গা করে দেবার জন্য অনেকে যেমন সরে গেলো তেমনি কেউ কেউ তার সাথে একটু নাচার জন্য এগিয়ে এলো। আলী কাউকে নিরাশ করছে না। একটু একটু করে অনেকের সাথে নেচে চলে গেলো ঘরের অন্য এককোণে। যেনো ডান্সফ্লোরে সবাইকে উৎসাহ দিয়ে গেলো সে।

    বাস্টার্ডের হাতে বিয়ার শেষ হতেই দেখতে পেলো আইনাত চলে এসেছে। ককটেল ড্রেস আর সঙ্গি গতরাতের ঐ মেয়েটি। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো আইনাত লেসবো না-তো! মওলানার মেয়ে ডিসকো’তে যায় এটাই শকিং ব্যাপার, তার উপরে সমকামী হলে বিস্ময়ের সীমা থাকবে না।

    ডান্সফ্লোরে গিয়ে উদ্দাম নাচতে শুরু করলো আইনাত আর তার সঙ্গি। ড্রাফট পাঙ্কের পাগলা সঙ্গিতের তালে তালে ফ্লোরের সবাই যেনো উদ্দাম হয়ে উঠলো মুহূর্তে। ডিসকো লাইটের ঝলকানিতে ভালো করে দেখারও উপায় নেই। মাথার উপরে নানা রঙের লাইটগুলো এমনভাবে প্রক্ষেপিত হচ্ছে যে, নর-নারীর প্রতিটি অঙ্গ-ভঙ্গি আর নাচের মুদ্রাগুলো অপার্থিব মনে হচ্ছে এখন।

    খালি বিয়ারের ক্যানটা মুখের সামনে ধরে রেখে বাস্টার্ড সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না কি করবে। আইনাতের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে হলে ফ্লোরে গিয়ে নাচতে হবে তাকে। তাছাড়া এখানে প্রতিদিন এসে ফ্লোরে না গিয়ে বসে বসে বিয়ার গিললে যে কারোর সন্দেহের শিকার হতে পারে।

    অবশেষে বিয়ারের ক্যানটা সোফার পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। উঠোনে নেমে না-নাচলে কী হয়!

    শরীরটা সামান্য হেলেদুলে ডান্সফ্লোরের দিকে এগিয়ে গেলো। তার লক্ষ্য আইনাতের চোখে পড়া, কিন্তু মেয়েটাকে ঘিরে রেখেছে একদল নৃত্যরত তরুণ-তরুণী। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাত-পা দুলিয়ে নাচার ভান করলো সে। নিজেকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো জোকার। একটাই সান্ত্বনা, এটা নিছকই আপদকালীন স্ট্রাটেজি!

    নাচ চলছে তো চলছেই, চারপাশে তাকানোর ফুরসত নেই আইনাতের। সে যেনো ডুবে গেছে অন্য এক জগতে। আস্তে আস্তে উন্মাদ নাচুনেদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলো বাস্টার্ড। যেনো নীরব এক ঘাতক সে, নিজের শিকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সবার অলক্ষ্যে।

    সমস্ত আড়ষ্টতা ঝেরে ফেলে উন্মাতাল ডান্সবিটে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো। আইনাত এখন তার খুব কাছেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ টের পেলো কেউ তার কাঁধে টোকা মারছে। ফিরে তাকালো সে। নৃত্যরত এক তরুণ হাসিমুখে চেয়ে আছে তার দিকে।

    “হাই…তোমার নাচ আমার খুব ভালো লাগছে,” ইংরেজিতে বললো সেই তরুণ।

    ফাক! মনে মনে বললো বাস্টার্ড কিন্তু মুখে হাসি ধরে রাখলো। “থ্যাঙ্কস।”

    “আমি কি তোমার সাথে একটু নাচতে পারি?”

    নিঃশব্দে হাসি দিয়ে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলো সে। এক হ্যাঁচকা টানে কাছে টেনে আনতেই ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আমি শুধু স্ট্রেইটকাটই না…স্ট্রেইটও!” কানের কাছে মুখ এনে বললো সে। “আমাকে বিরক্ত কোরো না, বিচ! ফাঁক ইউর-সেলফ। এখন ভাগো!” ছেলেটাকে ছেড়ে দিতেই আস্তে করে সটকে পড়লো সে।

    শালার হোমো! মনে মনে বললো সে।

    “হাই?”

    একটা নারী কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকালো। আইনাত! মুখে হাসি ফুটিয়ে জবাব দিলো, “হ্যালো!”

    “কেমন আছেন, মিস্টার?”

    “তওফিক! জাস্ট তাওফিক।”

    “ওকে…তওফিক। কেমন লাগছে এই ডিসকো?”

    “মনে হচ্ছে অন্য কোনো দুনিয়াতে আছি। বোঝাতে পারবো না।”

    “ঠিক বলেছো। এটা করাচির মধ্যে অন্য একটা জগৎ।”

    “এখানে আসার পর ভাবি নি এরকম কোনো জায়গা থাকতে পারে…করাচিতে ভীষণ বোর হয়ে যাচ্ছিলাম।”

    “আমিও,” আইনাত নাচতে নাচতে বললো।

    মেয়েটা যে নিয়মিত এখানে আসে তার প্রমাণ এততক্ষণ নেচেও ক্লান্ত হচ্ছে না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস্টার্ড টের পেলো তার পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে আসছে। এমন নয় যে, তার স্ট্যামিনা কম, আসলে হুট করে নাচতে গেলে এমনটি হয়, হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে আসে। “তুমি দারুণ নাচো।”

    আইনাত কিছু বললো না। সে নাচের মধ্যেই ডুবে আছে।

    “সত্যি বলছি।”

    “জানি।” মুখ টিপে হেসে বললো মেয়েটা।

    “আমি একেবারেই আনাড়ি…হাস্যকর নাচি।”

    আবারো হাসি, এবার সশব্দে। “নাচার সময় এতো কিছু ভাবতে নেই। জাস্ট ডান্স!”

    “তুমি আমাকে শেখাতে পারো।”

    ভুরু বাঁকা করে তাকালো সে।

    “সত্যি বলছি…অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই,” হেসে বললো কথাটা।

    “তাহলে আমাকে ফলো করো…আর কিছু করতে হবে না।”

    “ওকে।” বলেই আইনাতের সাথে একইভাবে নাচার চেষ্টা করলো সে। “হচ্ছে?” জানতে চাইলো মেয়েটার কাছে।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত। “চালিয়ে যাও।”

    “ওকে।”

    ক্লান্ত হয়ে পড়লেও জোর করে আরো কিছুটা সময় ফ্লোরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। এরকম সুযোগ আর আসবে না। সে দেখতে পাচ্ছে আইনাতের কপাল ঘেমে একাকার। তার শরীরের আঁটোসাঁটো ককটেইল ড্রেসটার জায়গায় জায়গায় ঘেমে ভিজে আছে কিন্তু ক্লান্তিহীনভাবে নেচে চলেছে সে।

    “তুমি কি প্রতিদিনই আসো এখানে?”

    মাথা দোলালো মেয়েটি। “আরে না। সেটা সম্ভব না ‘হা-হা-হা করে হেসে উঠলো তারপর। “মাঝেমধ্যে আসি…যখন সুযোগ পাই আর কি।”

    “আগামীকাল আসবে?”

    নাচার গতি কমিয়ে দিলো আইনাত। “আগামীকাল তো শুক্রবার। আলীর ডিসকো বন্ধ থাকে।”

    “ওহ্,” আশাহত হলো।

    “জুম্মাবার নো ডান্স! আলী’স ল।” কথাটা বলেই আবার নাচে ডুবে গেলো সে। “হতাশ হলে নাকি?” একটু পর বাস্টার্ডের মুখভার দেখে জানতে চাইলো।

    “বলতে পারো,” হেসে বললো। “এখানে কারো সাথে আমার তেমন একটা পরিচয় নেই…শুধু তোমার সাথে অ্যাকসিডেন্টলি পরিচয় হয়েছে…”

    “এক গ্লাস ভদকা নষ্ট করে!” মুখ টিপে হাসলো মেয়েটি।

    “তা ঠিক, কিন্তু এরজন্যে আমার কোনো অনুশোচনা নেই।”

    “তাই নাকি?”

    “হুম।”

    হা-হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি দিলো আইনাত।

    এমন সময় এক লম্বা-চওড়া যুবক এসে নাচতে শুরু করে দিলো তাদের দু-জনের মাঝখানে। আইনাত একটু বিব্রত হলেও যুবকের সাথে সৌজন্যতার খাতিরে হাই-হ্যালো করলো। বাস্টার্ড বুঝতে পারছে ছেলেটা আইনাতের পূর্বপরিচিত। এরপর আরো কয়েকজন ছেলেমেয়ে চলে এলো সেখানে। তাদের নাচানাচি আর দাপাদাপির কারণে আস্তে করে ফ্লোর থেকে নেমে ঘরের এককোণে চলে গেলো, বুঝতে পারলো আর সুবিধা করতে পারবে না। এদের একটা সার্কেল আছে, সেই সার্কেলের বাইরের কেউ টুকটাক কথাবাতা ছাড়া তেমন সুবিধা করতে পারবে না। অনেক ভেবে-চিন্তে দেখলো, আজকের রাতের মতো এখান থেকে বের হয়ে গেলেই ভালো হবে।

    চুপচাপ ডিসকো থেকে বের হয়ে গেলো সে। বাইরে এসে দেখতে পেলো জাভেদ ড্রাইভিং সিটে বসে সিগারেট টানছে।

    “চলো,” ড্রাইভিং ডোরের সামনে ঝুঁকে বললো বাস্টার্ড।

    সিগারেটে আরো কয়েকটা টান মেরে ফেলে দিলো ছেলেটা।

    আগামীকাল আরেকটি নিষ্ফলা দিন যাবে। শুক্র-শনিবার আলীর ডিসকো বন্ধ থাকে। ওদিকে মওলানাও অফিসে যাচ্ছে না, বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে। উদাস হয়ে গাড়ির বাইরে তাকাতেই দ্রুত তার মাথায় একটা আইডিয়া চলে এলো। শুক্রবার মানে জুম্মাবার! মুচকি হেসে ছেলেটাকে বললো, “জাভেদ, আগামীকাল সকালে তোমার কাজ কি?”

    কাঁধ তুলে রিয়ার-মিররে তাকালো সে। “তেমন কোনো কাজ নেই…কেন?”

    “তাহলে জুম্মার আগে হোটেলে চলে এসো।”

    “আগে?”

    “হুম।”

    “নামাজের পর আসি? আমি আবার জুম্মা মিস করি না, ভাই।”

    মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। “আমিও করি না!”

    অধ্যায় ৩৭

    মুজাহিদ তার পাঞ্জাবিটা পরে খুশি হতে পারছে না। বুজুর্গ তাদের দশজনের জন্য গতকাল রাতে নতুন পায়জামা আর পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছিলো। ওগুলো পরে জুম্মার নামাজ পড়বে তারা কিন্তু সমস্যা হলো পায়জামা আর পাঞ্জাবি দুটো তার সাইজের চেয়ে অনেক বড়। পরার পর কেমন বেখাপ্পা লাগছে। নতুন জামা যদি ঠিকমতো গায়ে না লাগে তাহলে মেজাজ ভালো থাকে কী করে।

    ইসমাইলের দিকে তাকালো সে। কি সুন্দর সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে এখন কানের মধ্যে তুলো দিয়ে মাক-এ-আমার লাগাচ্ছে। পাঞ্জাবিটা একদম ঠিকঠাকমতো লেগেছে তার গায়ে। দেখতেও খুব ভালো লাগছে।

    “আমারটার সাইজ অনেক বড়, ভাই,” অভিযোগের সুরে বললো সে।

    আতর লাগাতে লাগাতে তার দিকে তাকালো ইসমাইল। “হুম।” আর কিছু না বলে এবার চোখে সুরমা লাগাতে শুরু করলো।

    মুজাহিদের এটা পছন্দ হলো না। মনে হলো সে অবহেলিত আজকের দিনের জন্য। “এরকম লম্বা পাঞ্জাবি আমি জীবনেও পরি নি…দেখেন না হাটুর কতো নীচে নেমে গেছে…আরেকটু হলে গোড়ালিতে গিয়ে ঠেকতো।”

    “চালিয়ে নে, কিছু করার নেই। ওরা সব এক সাইজের কিনেছে। বুঝতে পারে নি আমাদের মধ্যে তোর মতো পিচ্চিও আছে।” সতর্কভাবে চোখে সুরমা লাগাতে লাগাতে বললো।

    “ওরা বুঝতে পারবে না কেন?” সে একটু চটে গেলো। “কয়েক মাস ধরে এদের সাথে আছি…এতোদিনেও বুঝতে পারলো না কার সাইজ কেমন?”

    “আরে বুদু, চালিয়ে নে না, বাপ!” বললো ইসমাইল। এগুলো তো এখানকার লোকজন কেনে নি…অন্য জায়গা থেকে এসেছে।”

    “কোত্থেকে এসেছে?”।

    “তা জানি না। তবে এখানকার কেউ এসব কেনে নি। সবগুলোই একই সাইজের পাঠিয়েছে, বুঝলি?”

    হতাশ হলো মুজাহিদ। “আপনিই বলেন, কতোদিন পর নতুন জামা পেলাম…অথচ সাইজ কতো বড়…মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।”

    “ধুর, পাগল,” সান্ত্বনা দিলো ইসমাইল। “মন খারাপ করছিস কেন? এটা পরে তো তুই বাইরে যাবি না, ঘরেই থাকবি। আমরা ছাড়া কেউ দেখবে না।” একটু থেমে মুচকি হাসলো সে। “তোর মতো বে-সাইজ কিন্তু আরেকজনের হয়েছে…” তাদের দলে আরেকজন বেটে আছে তার কথা ইঙ্গিত করলো সে। “…ও তো কিছু বলছে না। তুই খামোখা কেন যে বেজার হচ্ছিস…” একটু থেমে মুজাহিদের মাথায় আলতো করে টোকা মারলো। “আয়, আতর লাগিয়ে দেই…চোখে সুরমাও লাগিয়ে দেবো।”

    ছেলেটা খুশি হলো। তাকে যখন কেউ আদর করে, একটু গুরুত্ব দেয় তখন কী যে ভালো লাগে। তার ছোট্ট এই জীবনে এরকম ঘটনা ঘটে নি বললেই চলে।

    ইসমাইল আতরের তুলো তার কানের পেছনে ঘষে দিলে মুজাহিদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

    “খুশবুটা খুব সুন্দর, ভাইজান।”

    নিঃশব্দে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো ইসমাইল। “মাশক-এ-আম্মার’র খুশবু একদম বেহেস্তি খুশবুর মতো, বুঝলি?”

    *

    দুপুর বারোটার আগেই মওলানার বাড়ির সামনে এসে থামলো জাভেদের গাড়ি। আজো পেছনের সিটে বসেছে বাস্টার্ড তবে তার পরনে সাদা পাঞ্জারি পাজামা আর মাথায় টুপি। পাঞ্জাবির উপরে ঐতিহ্যবাহী সিন্ধি কোটি। এই পোশাক সে সকালে কিনে নিয়েছে হোটেল সামুনাবাদের কাছে একটি দোকান থেকে। এরকম পোশাক করাচির পথেঘাটে প্রচুর দেখা যায়। জাভেদও পাজামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরেছে, তবে তার পায়জামা-পাঞ্জাবির রঙ সাদা নয়, কটকটে খয়েরি।

    গুলজার-এ-হিজরি আজ একেবারেই অন্যরকম। রাস্তায় প্রচুর লোজন দেখা যাচ্ছে। কেউ পায়ে হেঁটে কাছের মসজিদে যাচ্ছে, তবে বেশিরভাগই নিজেদের গাড়িতে করে রওনা হয়েছে জুম্মায় শামিল হবার জন্য।

    মওলানার বাড়ির দিকে তাকালো বাস্টার্ড। সে জানে আজ তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। মওলানার শরীর এতো খারাপ হয় নি যে জুম্মার দিন মসজিদে যাবে না।

    সময় ঘনিয়ে আসছে। জুম্মার নামাজ শুরু হতে বেশি বাকি নেই। আর কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে বের হয়ে না এলে ধরে নিতে হবে মওলানা মসজিদে যাচ্ছে না। প্রায় দশ মিনিট পর, তার অপেক্ষা যখন শেষ পর্যায়ে ঠিক তখনই মেইনগেটটা খুলে গেলে কাঙ্খিত গাড়িটা বের হয়ে এলো।

    “চলো,” আস্তে করে বললো বাস্টার্ড।

    জাভেদ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে দিলো।

    কালো রঙের হামারটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে সে। গাড়ির ভেতরে কে আছে বোঝা যাচ্ছে না কালো কাঁচের কারণে তবে আজ নিশ্চয় মওলানা আছে, সম্ভবত সঙ্গে আছে তার ঐ ছেলে।

    বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই ফলো করতে শুরু করলো জাভেদ। সুপারকো রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে হামারটা।

    “ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছে,” জাভেদ বলে উঠলো।

    “ওখানে কি মসজিদ আছে?”

    “হুম। ক্যাম্পাসের ভেতরে বড় একটা মসজিদ আছে। ওটাই এখান থেকে সবচেয়ে কাছে।”

    বাস্টার্ড বুঝতে পারছে ওই মসজিদেই যাবে মওলানা। সে অবাক হয়েছে গুলজার-এ-হিজরি এতো বড় আবাসিক এলাকা হলেও সেখানে কোনো মসজিদ নেই। অথচ ঢাকায় এরকমটি চিন্তাও করা যায় না। ঢাকা শহরে একটু পর পরই চোখে পড়বে নতুন-পুরাতন আর ছোটোবড় অসংখ্য মসজিদ।

    করাচি ইউনিভার্সিটি রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছে হামারটা। ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঢুকতেই হাতের ডান দিকে বিশাল একটি মসজিদ। মওলানার বাড়ি থেকে মাত্র আট মিনিটের পথ।

    মসজিদটির স্থাপত্য বেশ আধুনিক, জাঁকজমকের দিক থেকে মোটামুটি। করাচির অন্যসব বড় মসজিদের তুলনায় তেমন কিছু না, তবে চারপাশে বেশ খোলামেলা জায়গা রয়েছে।

    কালো হামার মসজিদের বাইরে খোলা জায়গায় আরো অসংখ্য গাড়ির সাথে পার্ক করা হলো। একটু পরই ছেলেকে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলে দ্বিতীয়বারের মতো মওলানাকে দেখতে পেলো সে।

    জাভেদ গাড়িটা পার্ক করলো আরেকটু দূরত্ব বজায় রেখে, রাস্তার দিকে মুখ করে, যেনো নামাজ শেষে দ্রুত রাস্তায় নেমে যাওয়া যায়।

    “এখানে সিকিউরিটি কেমন?” জানতে চাইলো বাস্টার্ড।

    “এর আগে এখানে কখনও এখানে আসি নি,” বললো সে। “তবে দেখে মনে হচ্ছে কোনো সিকিউরিটি নেই। এটা তেমন বিখ্যাত মসজিদ না, ভাই…গেটে মেটাল ডিটেক্টরও দেখছি না।”

    “ওকে। তুমি নামাজ পড়ে আসো…আমি এখানেই থাকি।”

    জাভেদ কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

    বাইরে তাকালো সে। বড় একটা সাইনে দেখতে পেলো করাচি ক্যাম্পাস মসজিদ লেখা। জাভেদকে দেখলো ভেতরে ঢুকে পড়তে। মওলানা আর তার ছেলেও একটু আগে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মনে পড়ে গেলো আজ অনেক। বছর পর মসজিদে এসেছে। শেষবার গিয়েছিলো পুরনো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার মোল্লাভায়ের সাথে। তখনও তার সঙ্গে পিস্তল ছিলো ঠিক যেমন এখন আছে।

    ভালো করে চারপাশে তাকালো। মওলানাকে ঘায়েল করার জন্য জায়গাটি একদম বেমানান। প্রচুর লোকজন এখানে। ঘায়েল করার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে সে জানে, নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাবার সময় সুযোগটা চলে আসতে পারে আজ। এবার সে নিশ্চিত মওলানা গাড়িতে করে বাড়ি ফিরে যাবে একটু পর। সঙ্গে তার ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। দারুণ একটা সুযোগ। এটাকে কাজে লাগাতেই হবে। মনে মনে প্রস্ততি নিয়ে রাখলো সে।

    এরইমধ্যে খতিবের খুতবা শুরু হয়ে গেছে। মসজিদের বাইরে থেকেও শুনতে পাচ্ছে সে। উর্দুতে বেশ আবেগী আর চড়াসুরে বলে যাচ্ছে খতিব, যার বেশিরভাগই বুঝতে পারছে। খুতবার বিষয়বস্তু শুনে একটু অবাকই হলো। ইসলামে আত্মঘাতি বোমাবাজি আর জঙ্গিবাদের যে কোনো স্থান নেই সে কথাই বলা হচ্ছে। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ বলেই এমন কথা বলতে পারছে খতিব।

    খুতবা শেষে নামাজ শুরু হয়ে গেলে শত-শত লোক উঠে দাঁড়ালো এক সঙ্গে। মসজিদের বাইরের প্রাঙ্গণেও প্রচুর লোক নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

    “আল্লাহু আকবার!” মাইকে শোনা গেলো ইমামের কণ্ঠ।

    বাস্টার্ডের মনে হলো নামাজের সময় গাড়িতে এভাবে বসে থাকাটা ঠিক হবে না। বাইরে থেকে কেউ দেখলে সন্দেহ করতে পারে। জুম্মাবার মসজিদের সামনে গাড়িতে বসে তুমি কি করছো, বাবা?

    তার উচিত পেছনের সিটে শুয়ে পড়া। নামাজ শেষ হলে উঠে বসা যাবে আবার। যে-ই না সিটের উপরে শুয়ে পড়তে যাবে অমনি প্রচণ্ড শব্দে তার গাড়িটা কেঁপে উঠলো। কানে তালা লেগে গেলো তার।

    অধ্যায় ৩৮

    মেজর জেনারেল বসে বসে হুইস্কিতে চুমুক দিচ্ছে। ভরসন্ধ্যায় এ জিনিস না হলে তার চলে না। অবশ্য একমাত্র মেহমান মীর হুইস্কি ছুঁয়েও দেখছে না। ইসলামে মদ্যপান হারাম, তার পক্ষে হারাম জিনিস গ্রহণ করা অকল্পনীয় ব্যাপার। মেজর জেনারেল একজন জাঁদরেল মানুষ। সবাই তাকে সমীহ করে কিন্তু মীর সাজিদ নামের ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যে লোকটা তার সামনে বসে আছে তাকে বেশ হিসেবের মধ্যে রাখতে হয়। আসন্ন অপারেশনটির প্রজেক্ট ম্যানেজার সে।

    আজকে যে করাচির একটি মসজিদে আত্মঘাতি হামলার ঘটনা নিয়ে দু জনের মধ্যে কোনো উদ্বেগ নেই। তাদের সমস্ত চিন্তা আসন্ন অপারেশনটি নিয়ে।

    “অপারেশনের আগে ওদের ব্যাপারটা মাথায় রাখা উচিত,” বললো মীর।

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মেজর জেনারেল। করাচিতে র-এর যেসব এজেন্ট আছে তাদের কড়া নজরে রাখা দরকার। মুফতি আর ডিসকো মুজাহিদের সামনে তারা যতোই এই ব্যাপারটা নিয়ে লা-পরোয়া মনোভাব দেখিয়ে থাকুক না কেন, অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সবদিক বিবেচনায় রাখতে হয়। দূরবর্তী সম্ভাবনাকেও আমলে নিতে হয়। নইলে ভাঙা শামুকে পা কেঁটে যেতে পারে।

    “এ মুহূর্তে করাচিতে ওদের যে চারজন কাজ করছে তারা আমার নজরদারিতেই আছে।”

    অবাক হলো মীর। “আপনার লোক কি ওদের আগে থেকেই নজরদারির মধ্যে রেখেছে?”

    “আলবৎ,” হুইস্কিতে চুমুক দিলো মেজর জেনারেল। “সেপ্টেম্বরের ঘটনা জানাজানি হবার পর থেকেই আমি ওদের চিহ্নিত করে ফেলি, তারপর থেকেই নজর রাখছি। বলতে পারেন ওদের আমি হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলছি।”

    “শত্রুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলছেন?” বাঁকাহাসি দিলো সাজিদ মীর।

    “হুম।” বেশ জোর দিয়ে বললো জেনারেল। এই মীর অনেক ঘাগু হতে পারে, হতে পারে বুদ্ধিমান কিন্তু ইন্টেলিজেন্স কিভাবে কাজ করে সে-সম্পর্কে তার ধারণা আর যাহোক তারচেয়ে বেশি নয়। সে কখনও ইন্টেলিজেন্সে ছিলো না, ঐ সোসাইটি সম্পর্কে তার সম্যক ধারণাও যৎসামান্য। “হঁদুরকে মারার আগে ঠিক যেভাবে বিলি একটু খেলা করে…” আবারো চুমুক দিলো হুইস্কিতে। “আমিও ওদের নিয়ে সেভাবে খেলছি।”

    “আমার মনে হয় প্যাকেজ’ পাঠানোর আগে ওদের উপরে পাঠিয়ে দেয়াটাই ভালো হবে। বলা তো যায় না, কখন কি করে বসে।”

    মাথা দোলালো মেজর জেনারেল। “প্যাকেজ পাঠানোর আগে এরকম কিছু করা যাবে না। একদমই না।”

    “আপনার স্ট্রাটেজিটা কি?” আগ্রহী হয়ে উঠলো মীর।

    “অপারেশন শেষ হবার পর পর ইঁদুরগুলো বিল্লির পেটে চলে যাবে…” গ্লাসটা একঢেকে শেষ করে ফেললো এবার, “…ঠিক এভাবে।”

    “ঠিক আছে,” আশ্বস্ত হলো সাজিদ মীর। “এটা তাহলে আপনার উপরেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু হ্যান্ডলারদের ব্যাপারটা কি করবেন? ওরা কোত্থেকে অপারেট করবে?”

    মেজর জেনারেল একটু ভেবে বললো, “অবশ্যই করাচির কোথাও, তবে রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া থেকে করলেই বেশি ভালো হয়। আপনাদের নিজেদের জায়গাগুলোতে করার দরকার নেই।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মেহমান। সেও মনে মনে ঠিক এমনটি ভেবে রেখেছিলো। তাদের জায়গাগুলো প্রতিপক্ষ গোয়েন্দাদের কাছে অচেনা নয় হয়তো। “ঠিক আছে। এটা আমি দেখছি।”

    মেজর জেনারেল বোতল থেকে আবারো হুইস্কি ঢালতে শুরু করলো খালি গ্লাসে।

    “তাহলে আমরা প্যাকেজ কবে পাঠাচ্ছি?” আস্তে করে জানতে চাইলে মীর।

    গ্লাসে চুমুক দেবার আগে একটু ভাবলো সাবেক মিলিটারি অফিসার। ‘প্যাকেজ’ পাঠানোর কাজে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেক জায়গায় ক্লিয়ারেন্সের দরকার হবে। সামান্যতম ভুল বোঝাবুঝি কিংবা এদিক ওদিক হলেই বিপদ। এতোদিনের পরিশ্রম, পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যাবে এক লহমায়। সেজন্যে এই ব্যাপারটা নিয়ে মীরের উদ্বেগ একদম যৌক্তিক। অপারেশনের ম্যানেজার হিসেবে শেষ মুহূর্তের এই কাজটার জন্য তাকে এখন পুরোপুরি মেজর জেনারেলের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে।

    মুচকি হাসলো জেনারেল। “আগামী পরশুর পর যেকোনো দিন প্যাকেজ পাঠানো যাবে। দু-দিনের মধ্যে কুরিয়ার একদম রেডি করে ফেলবো আশা করি!”

    মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো মীর। “মাশাল্লাহ!”

    “আপনার কমান্ডার…লাখভি সাহেবকে খোশ খবরটা জানিয়ে দিতে পারেন। প্যাকেজ’ পাঠানোর বন্দোবস্ত একদম পাক্কা!”

    *

    অবশেষে আসল করাচির দেখা পেয়েছে সে।

    এই ক-দিনে যা দেখেছে তার সাথে মিডিয়ার মারফতে জানা করাচির খুব কমই মিল খুঁজে পেয়েছিলো। তবে আজ হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো সে এমন এক শহরে আছে যেখানে বোমা, গোলাগুলি আর আত্মঘাতি হামলা। নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।

    ভাগ্য ভালো, অল্পের জন্যে সে আহত হয় নি। তবে ভাগ্যবান সে একা নয়, জাভেদ ওয়ার্সিও প্রায় অক্ষত অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হয়ে এসেছে। দৌড়াদৌড়ি আর হট্টগোলের মধ্যেই ছেলেটা বাইরে এসে দেখতে পায় তার গাড়ির পেছনের সিটে অক্ষত অবস্থায় বসে আছে সে। চারপাশের হট্টগোলের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। জাভেদকে দেখামাত্র হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। তারপর দেরি না করে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে গাড়ি নিয়ে সটকে পড়ে।

    মওলানা ইউসুফের কি অবস্থা-সে আহত, নিহত নাকি অক্ষত আছে সেটা জানতে পারে নি। হোটেলে ফিরে এসে টিভিতে বোমা হামলার খবর শুনতে থাকে সে। যদিও সেখানে নিহত-আহত কারোর পরিচয় দেয়া হয় নি। তবে এই বোমা হামলার কথা স্বীকার করে নিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী তেহেরিক-এ তালেবান। নির্ভরযোগ্য সূত্র দাবি করেছে, করাচি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস মসজিদের খতিব দীর্ঘদিন ধরে তালেবানদের বিরুদ্ধে যে খুতবা দিয়ে যাচ্ছিলেন তার জের ধরেই এই হামলা।

    শুক্রবার হোটেলে ফিরে সারাদিন আর বের হলো না। খবরে বার বার বলা হচ্ছে, আত্মঘাতি বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত আটজন মুসল্লি নিহত আর পঞ্চাশজনের মতো আহত হয়েছে। আত্মঘাতি বোমাবাজ লোকটি মুসল্লিদের সাথে নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলো। আল্লাহু আকবর ধ্বণি উচ্চারিত হবার পর পরই সে উগড়ে দিয়েছে তার নৃশংস জেহাদ!

    জাভেদ তাকে বলেছে আগামী দুয়েকটা দিন শহরের পরিস্থিতি বেশ খারাপ থাকবে। প্রচুর ধরপাকড় হবে। পুলিশি টহলও থাকবে পথে পথে। এরইমধ্যে পুরো শহরে চিরুণী অভিযান শুরু করে দিয়েছে পুলিশ আর গোয়েন্দার দল। এমন সময় করাচির পথে বের হলে নির্ঘাত তল্লাশীর শিকার হতে হবে।

    বাস্টার্ড ভালো করেই জানে একজন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীকে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কিভাবে নেবে-ভারতীয় র-এর এজেন্ট! ওরা এখনও এদেশের লোকদের গাদ্দার হিসেবেই মনে করে। আর একজন গাদ্দারকে বিশ্বাস করার মতো বোকা পাকিস্তানিরা হতে পারে না! এ-ব্যাপারে শুটার সামাদ তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলো দেশ ছাড়ার আগেই।

    সবকিছু বিবেচনা করে সে ঠিক করলো পরিস্থিতি ভালো না-হওয়া পর্যন্ত বিরক্তিকর প্রতীক্ষায় থাকতে হবে। সুতরাং আগামী কয়েকটা দিন জাভেদের আসার দরকার নেই।

    অধ্যায় ৩৯

    করাচি
    অজ্ঞাত একটি সেফহোম

    সকাল সকাল তাদের সবাইকে সৈকতের পাশে যে ঘরটা আছে সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে করাচির অন্য একপ্রান্তে। কিন্তু গাড়ির কাঁচ যথারীতি কালচে আর ভেতর থেকে কালো কাগজে আটকানো ছিলো বলে বাইরের কিছু তাদের চোখে পড়ে নি।

    দুটো মাইক্রোবাসে করে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে। মাইক্রো দুটো কে চালাচ্ছে সেটাও দেখার উপায় ছিলো না ড্রাইভিং আর প্যাসেঞ্জার সিটের মাঝখানে পার্টিশান দেয়া ছিলো বলে। তবে ভ্রমণের সময় হিসেব করে তারা দূরত্বটা বুঝতে পেরেছে : এটা করাচির কোথাও হবে।

    গাড়ি থেকে যখন তারা নামলো দেখতে পেলো জায়গাটা আসলে একটি বে-সরকারি হাসপাতাল। তাদেরকে সোজা সেই হাসপাতালের উপরে নিয়ে যাওয়া হলো। একেবারে ছাদের উপরে এনে দশজনকে বসিয়ে রেখে চলে গেলো হ্যান্ডলার দু-জন। বুজুর্গ নিজেও আছে তাদের সাথে, তবে ছাদে আসে নি।

    প্রায় দশ মিনিট ছাদে চুপচাপ বসে থাকার পর দু-জন হ্যান্ডলার চারটা ব্যাক-প্যাক নিয়ে এলো। ব্যাগগুলো দেখেই চিনতে পারলো আবু মুজাহিদ। এরকম ব্যাগের ভেতর ইটের টুকরো ভরে পাঞ্জাবের মানসেরার বাট্টাল নামক পাহাড়ি এলাকায় তাদেরকে ট্রেইনিং দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে বাট্টাল ছাড়াও আরো তিনটি জায়গায় তারা ট্রেইনিং নিয়েছে। তবে বাট্টালের কথা বেশি মনে আছে কারণ ওখানে ট্রেইনিং নেবার সময়েই জানতে পারে বেনজীর ভুট্টোকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের ট্রেইনার চাচারা এ নিয়ে দারুণ খুশিও হয়েছিলো। একে অন্যেকে মোবারকবাদ জানাচ্ছিলো তারা।

    ঐ সময়ে তাদের পঁচিশজন ছিলো ট্রেইনিং ক্লাসে। কাউকে কোনো প্রশ্ন করার অনুমতি দেয়া হতো না। এমনকি একে অন্যের সাথে দরকারের বাইরে কথা বলাও ছিলো নিষিদ্ধ। তারপরও পঁচিশজনের দলটি সুযোগ পেলেই ফিসফাস করে কথা বলতো। এভাবে তারা অনেকেই অনেকের কথা জেনে যায়।

    একটু পর বুজুর্গও চলে এলো আরো দুটো ব্যাক-প্যাক নিয়ে। তারপর কাফা আর ওয়াসি চলে এলো বাকি চারটা ব্যাক-প্যাকসহ। তাদের দশজনকে এক সারিতে বসিয়ে দিয়ে প্রত্যেককে একটি করে ব্যাক-প্যাক বুঝিয়ে দেয়া হলো।

    প্রতি ব্যাগে একটি একে-৪৭ রাইফেল, দুশো বুলেট, দুটো ম্যাগাজিন, মাকারভ পিস্তল, চায়নার সরকারি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি নরিনকোর টাইপ-৮৬ মডেলের আটটি হ্যান্ড-গ্রেনেড, এককেজি আরডিএক্স এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর এবং মিনারেল ওয়াটারের বোতল আর কিছু শুকনো খাবার আছে। প্রতিটি জিনিসের ব্যবহার করার ট্রেইনিং তাদের দেয়া হয়েছে দীর্ঘ তিনমাস ধরে সুতরাং নতুন করে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই।

    মুজাহিদের পাশে বসা ইসমাইলের ব্যাগে বাড়তি একটা জিনিসও আছে : একটি সেলফোন। একটু পর বাকিরা বুঝে গেলো দশজনের দলে পাঁচটি জুড়ির কাছেই একটি করে সেলফোন দেয়া আছে। ওগুলো ব্যবহার করবে সিনিয়ররা।

    “সবাই সবার ব্যাগ তুলে নাও,” বুজুর্গ বললো। “আজকে তোমরা এখানেই থাকবে।

    “আমরা রওনা দেবো কখন?” ফাহাদুল্লাহ জানতে চাইলো।

    “এখন থেকে যেকোনো সময়।”

    *

    তিনদিন হোটেলে বন্দী হয়ে বিরক্তিকর সময় পার করে হাপিয়ে উঠলো সে। হোটেলের বাইরে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এদিক ওদিক হাটাহাটি করে একঘেয়েমি কাটানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু খুব একটা কাজ হয় নি। তার কাছে মনে হচ্ছে করাচি মিশনটার সময় আরো বেড়ে যাবে। সম্ভবত বিশ-পঁচিশদিনের মতো থাকতে হতে পারে এখানে। এরকম আরো কিছু নিষ্ফলা দিন অতিবাহিত করতে হবে হয়তো। তবে তিনটা দিন হাতে পেয়ে অন্যভাবে কাজে লাগিয়ে নিয়েছে। অনেকদিন পর সকালে উঠে জগিং আর হোটলের জিমে গিয়ে এক্সারসাইজ করেছে। কে জানে, করাচির মিশনে হয়তো এগুলোর দরকার হতে পারে।

    যাহোক, অবশেষে মঙ্গলবার পরিস্থিতি একটু ভালো হলে বিকেলের আগেভাগে জাভেদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তবে ছেলেটাকে আগেই বলে দিয়েছিলো, গাড়িতে যেনো পিস্তল না রাখে। আপাতত তার কোনো দরকার নেই।

    চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে জাভেদ। আজ তার মুখে খুব একটা কথা নেই। সম্ভবত করাচি নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু বলার নেই এখন।

    “এ নিয়ে দু-বার বেঁচে গেলাম,” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো জাভেদ ওয়ার্সি।

    রিয়ার-মিররে তাকালো বাস্টার্ড। “প্রথমটাও কি আত্মঘাতি বোমা হামলা ছিলো?”

    মাথা ঝাঁকালো ছেলেটি। “না। গত ইলেকশানের সময় আমার নেতার উপরে হামলা চালিয়েছিলো কিছু সন্ত্রাসী। আমি তখন নেতার সঙ্গেই ছিলাম।”

    বাস্টার্ড চুপ মেরে রইলো। পাকিস্তানের মতো দেশে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। পত্রিকায়, টিভি নিউজে এরকম খবর সেও দেখেছে।

    “করাচির পরিস্থিতি তো ভালো না…আলীর ডিসকো কি বুধবার খুলবে?” সে জানে ডিসকো ভোলা থাকে রবি থেকে বুধবার।

    “ইয়াসিনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে…ও বললো বুধবার ডিসকো খুলতে পারে, তবে এন্ট্রির ব্যাপারে একটু কড়াকড়ি করা হবে। একদম পরিচিত লোকজন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না।”

    “ঐদিন আমি কি ঢুকতে পারবো?”

    ছেলেটা হাসলো। “আলবৎ। ইয়াসিন আছে না।”

    আশ্বস্ত হলো সে। জাভেদ ছেলেটা বেশ কাজে দিচ্ছে। এরকম একজন। রিসোর্স ছাড়া এই অপারেশনটি করার কথা চিন্তাই করা যেতো না। শুটার সামাদ যদি এর খোঁজ না দিতো তবে কাজটা ফিরিয়ে দিতে হতো তাকে।

    “ভাই, যাবো?”

    জাভেদের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে, আস্তে করে বললো, “হ্যাঁ। চলো।”

    তাদের গাড়িটা গুলজার-এ-হিজরির দিকে এগিয়ে গেলে তার কাছে মনে হলো, ওখানে গিয়ে আরেকটি হতাশাজনক দিন পার করতে হতে পারে। তবে এ মুহূর্তে ওখানে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেইও।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেক্সট (বেগ-বাস্টার্ড – ৬) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }