Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প368 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫০. সুদীর্ঘ একটি ড্রাইভওয়ে

    অধ্যায় ৫০

    মেইনগেট থেকে সুদীর্ঘ একটি ড্রাইভওয়ে চলে গেছে বাড়ির ভেতরে। ড্রাইভওয়ের বামপাশে বেশ উঁচু দেয়ালটি শুধু সীমানাপ্রাচীর হিসেবেই কাজ করে নি, পাশের বাড়ি থেকে অনেকটা আড়ালও তৈরি করেছে, কারণ দেয়াল ঘেষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি নাম-না-জানা গাছ।

    মেইনগেটের পরই ড্রাইভওয়ের ডানপাশে বিশাল একটি লন। সেই লনের পরেই একটি তিনতলা বাড়ি। ড্রাইভওয়ের একটি শাখা চলে গেছে ডানদিকের সেই বাড়ির সদরদরজা পর্যন্ত। আর ড্রাইভওয়েটি শেষ হয়েছে সোজাসুজি আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে মাঝারি আকারের দোতলা একটি বাড়ির ঠিক সামনে গিয়ে। আইনাত বলেছে, এটাকে তারা ছোটোবাড়ি বলে। এখানে তার মা, মওলানার ছোটোবিবি থাকতো। ছোটোবিবির জন্য ছোটোবাড়ি!

    এই ছোটোবাড়িটির দোতলা এখন আইনাতের ঠিকানা। নীচতলার একটি ঘরে থাকে তার মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই, বাকি ঘরগুলো কাজের লোকজনের জন্য বরাদ্দ। ছোটোবাড়ির সদর-দরজা ড্রাইভওয়ের ডানদিকে।

    “তুমি ডানপাশের দরজা খুলে নামবে…ওকে?” গাড়িটা ছোটোবাড়ির সদর-দরজার সামনে থামলে পেছনে ফিরে বললো আইনাত।

    “ওকে,” সিটের উপরে শুয়ে থেকেই জবাব দিলো সে।

    “উপরে ওঠার সিঁড়িটা দরজার বামপাশে…আমি গাড়ি থেকে নেমে গেলে তুমি বের হয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাবে আমার পেছন পেছন। নীচতলায় যারা আছে তারা ভেতরের ঘরে থাকে, আর ডানপাশের দরজা দিয়ে বের হলে মেইনগেট থেকে দারোয়ানও দেখতে পাবে না। সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সে, মেয়েটির কথা শুনে আশ্বস্ত হয়েছে। আজকের রাতটা মুম্বাইবাসীর জন্য যতোই খারাপ হোক না কেন তার জন্য সৌভাগ্যের রজনীই বটে। হঠাৎ করে সবকিছুই তার অনুকূলে চলে যাচ্ছে।

    আইনাত গাড়ি থেকে নেমে গেলে সেও আস্তে করে ডানপাশের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। ছোটোবাড়িটার পোর্চের দু-পাশে দুটো কলাম আছে। কলাম দুটোর পাশে আছে বড়সর দুটো লতানোগাছ, সে-কারণেই পোর্চের শেডের নীচে গাড়ি থামালে, আর সেই গাড়ির ডানপাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে এলে মেইনগেট থেকে দেখা যায় না।

    একটু আগে আইনাত ঢুকে পড়ার কারণে সদর-দরজাটা খোলাই আছে। সিঁড়িতে তার হিলের শব্দ শুনতে পেয়ে দ্রুত উঠে পড়লো সে।

    দোতলায় উঠে আইনাত ভ্যানিটিব্যাগ থেকে চাবি বের করে তার ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বললো, “ওয়াও, ভালোই হলো!”

    মেয়েটার পেছনে এসে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে খুশি হবার কারণটা কি।

    “হুইস্কির বোতলটা যে ব্যাগে আছে ভুলেই গেছিলাম,” হাসিহাসি মুখে বললো মওলানার মেয়ে।

    দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো আইনাত। “আসো।”

    বাস্টার্ড ভেতরে পা রাখতেই দরজা বন্ধ করে দিলো আবার। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। সুইচটিপে মৃদু আলোর বাতি জ্বালিয়ে দিলো মেয়েটি।

    চমৎকার ছিমছাম একটি ফ্ল্যাট। বেশ বড়সর ড্রইংরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ঘরটি সাজানো হয়েছে সুন্দর করে। আধুনিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায়।

    “কেমন?” হাসিমুখেই জানতে চাইলো সে। মেয়েটার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “খুব সুন্দর!” বাঁকাহাসি দিলো সে। “কোনটা?”

    “সব।”

    হা-হা-হা করে হেসে উঠলো আইনাত। “আসো…ভেতরে আসো।”

    বাস্টার্ড ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার পেছন পেছন।

    “বাবা থাকেন দোতলায়…ভাই তিনতলায়।”

    “আর নীচতলায়?”

    “ওটা আব্বার অফিস কিংবা মিটিংঘর বলতে পারো,” একটা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। “এটা আমার বেডরুম।”

    মাঝারি আকারের একটি ঘর। সম্ভবত নতুন রঙ করা হয়েছে। একদম ফিটফাট। একটা সেমি-ডাবল বেড আছে ঘরের ঠিক মাঝখানে। বামদিকে অ্যাটাচড বাথরুমের দরজা। ড্রেসিংটেবিল আর ওয়াড্রব ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব নেই।

    “হুম…খুব সুন্দর।” চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললো, “তোমার বাবা, ভাই…ওরা কি এখানে আসে না?”

    মাথা দোলালো সে। “না। ওদের দরকার পড়লে আমাকে ডেকে পাঠায় বড়বাড়িতে।”

    গুড, মনে মনে বললো বাস্টার্ড। “আর কাজের লোকজন?”

    “বললাম না, আমি ডাকলেই কেবল আসে। নীচের তলায় আমার ছোটোভাইটা থাকে, ওকে দেখাশোনা করে দু-জন কাজের লোক। একজন ওর কেয়ার-টেকার, অন্যজন রান্নাবান্না করে। ঘরদোর পরিস্কার করার লোক আলাদা। ওরা থাকে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে।”

    “সার্ভেন্ট কোয়ার্টার…ওটা কোথায়?”

    “নীচতলার দুটো ঘরই সার্ভেন্ট কোয়ার্টার।”

    “ও,” আর কিছু বললো না সে।

    “এসব নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, বুঝলে?”

    “হুম। কিন্তু আগামীকাল সকালে এখান থেকে বের হবো কিভাবে?”

    “আজব,” কাঁধ তুললো আইনাত, “যেভাবে ঢুকেছো সেভাবে।”

    “ও।” বাস্টার্ড অবশ্য জানে তার বের হবার ধরণটা অন্যরকম হবে। এতো বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়-তার কাছে কোনো পিস্তল নেই। একটা সাইলেন্সর পিস্তল কতো সহজেই না তার মিশনটা সফল করে দিতো। ওটা সঙ্গে থাকলে রাতের মধ্যেই মওলানার ভবের লীলা সাঙ্গ করে দিয়ে চলে যেতো এখান থেকে। তাই বলে সে দমে যাবার পাত্র নয়। এই সুযোগটা নষ্ট করা ঠিক হবে না। যেভাবেই হোক একটা উপায় বের করতেই হবে। আর সে ভালো করেই জানে, মাথা ঠাণ্ডা রাখলে একটা উপায় ঠিকই বের করতে পারবে।

    “কি ভাবছো?”

    আইনাতের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো। “না, ভাবছিলাম এই ব্যাপারটা কতোই না রোমাঞ্চকর।”

    “হুম। আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

    “আমি কখনও এই রাতটার কথা ভুলবো না।”

    বাঁকা চোখে তাকালো মেয়েটি। “মিস্টার তওফিক, রাত এখনও অনেক বাকি…এতো তাড়াতাড়ি উপসংহারে পৌঁছাবে না,” কথাটা বলেই হা-হা-হা করে হেসে ফেললো সে।

    “বাকি রাতটার কথা ভেবেই বলেছি।”

    ভুরু কুচকে তাকালো আইনাত। “এক সাথে ড্রিঙ্ক করা ছাড়া আর কোনো বাড়তি সুবিধা তুমি পাবে না। ওকে?”।

    কাঁধ তুললো সে। “কে জানে। এটা পুরোপুরি বাকি রাতটার উপরে ছেড়ে দিলেই ভালো হয়!”

    অধ্যায় ৫১

    সারাবিশ্ব টিভির সামনে হুমড়ি খেয়ে দেখছে কতিপয় সন্ত্রাসী ভারতের বাণিজ্যিক শহর মুম্বাইয়ে বীভৎস ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।

    বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে অজ্ঞাতনামা কিছু সন্ত্রাসী মুম্বাইর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। এখনও তারা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর। ভারতের ইতিহাসে এমন হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। মুম্বাই, যার সাবেক নাম বোম্বাই, সেটা কেবল সিনেমার জন্যই বর্হিবিশ্বের কাছে পরিচিত ছিলো এতোদিন, কিন্তু আজ বুধবার, ২৬শে নভেম্বরের রাত সাড়ে নটার পর থেকে এটি পরিচিত হয়ে উঠেছে অভাবনীয় সন্ত্রাসের শিকার একটি জনপদ হিসেবে।

    মুম্বাইর কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুলিশ, যাদের কাছে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত গৃ নট-রাইফেল আর লাঠি ছাড়া কিছু নেই, তারা ভীত সন্ত্রস্ত আর দিশেহারা হয়ে পড়েছে। শত্রু কে, কয়জন, কি তাদের উদ্দেশ্য, কোত্থেকে তারা এসেছে, কেন তারা এমনটা করছে–কোনো কিছু সম্পর্কেই তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই।

    তবে এটা নিশ্চিত, ঘটনার শুরু মুম্বাইর বিখ্যাত ক্যাফে লিওপোল্ড থেকে। ওখানেই প্রথম আঘাত হানে সন্ত্রাসীর দল। গ্রেনেড ছুঁড়ে, এলোপাথারি গুলি চালিয়ে দশ-বারোজনের মতো মানুষ হত্যা করেছে তারা। আহত করেছে। ত্রিশজনের মতো। তারপরই শোনা যায়, নরিমান হাউজ আক্রান্ত হবার খবর। এরপর ছত্রপতি শিবাজী রেলস্টেশনেও একই কায়দায় হামলা চালানো হয়। ওখানে ব্যাপক প্রাণহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে জানা গেছে। সন্ত্রাসী দলটি ঢুকে পড়েছে মুম্বাইর বিখ্যাত হোটেল তাজ-এ।

    কেউ কেউ বলছে, সন্ত্রাসীর সংখ্যা পনেরোজন হতে পারে। কখনও খবর আসছে হামলাকারীর সংখ্যা বিশ, কখনও শোনা যাচ্ছে কমপক্ষে পঞ্চাশজন অংশ নিয়েছে এই আক্রমণে। তবে কতিপয় প্রত্যক্ষদর্শী জোর দিয়ে বলেছে এ সংখ্যা দশ-বারোজনের বেশি হবে না। কোনো তথ্যই বিশ্বাস করতে পারছে না পুলিশ কিংবা সংবাদমাধ্যমের লোকজন।

    সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত আর আতঙ্কিত শহরে গুজব ছড়াচ্ছে দ্রুত। ঘটনার অভিঘাতে মুম্বাইর পুলিশবাহিনী, ছত্রভঙ্গ যোদ্ধার মতো এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে বিভ্রান্ত আর বিপর্যস্ত।

    মওলানা ইউসুফ হোসাইনী টিভির সামনে বসে নিজের দাড়িতে হাত বুলাচ্ছে। আক্রমণের পর থেকেই টিভির সামনে জেঁকে বসেছে সে। এক মুহূর্তও মিস করে নি লাইভ রিপোটিং। একবার ভারতীয় কোনো চ্যানেলে সুইচ করছে তো পরেরবারই চলে যাচ্ছে সিএনএন-এ। বিবিসি আর আল-জাজিরাও বাদ দিচ্ছে না। ঘুরে ঘুরে দেখছে কারা বেশি ভালো কাভারেজ দিচ্ছে। সত্যি বলতে সে কোনো পাকিস্তানি চ্যানেল দেখছে না। এরা তোতাপাখির মতো ঐ একটা কথাই বলে যাচ্ছে বার বার, যা তারা সব সময় বলে-এটা ভারতীয়দেরই কাজ।

    মুচকি হাসলো মওলানা। হিন্দুস্তান এমন জিনিস পয়দা করতে পারে নি যে, লক্ষ-লক্ষ মানুষকে ইঁদুর বানিয়ে গর্তে ঢুকিয়ে দেবে; পাখির মতো হত্যা করবে। তবে তাকে একটা সত্য মানতেই হলো, ভারতীয় চ্যানেলগুলোই এই ঘটনার সবচেয়ে ভালো কাভারেজ দিচ্ছে। আজকের জন্য বিবিসি-সিএনএনও ফেল।

    নাটক এখন বেশ জমে উঠেছে। হোটেল তাজ-এ জিম্মি করা হয়েছে। কয়েক শ পর্যটককে। পুরো মুম্বাই নয়, সমগ্র হিন্দুস্তান আজ ভয়ে থরথর করে কাঁপছে হাতেগোনা কয়েকজন সন্ত্রাসীর ভয়ে। হিন্দুস্তান বিপদে পড়লে মওলানার দারুণ ভালো লাগে। এক ধরণের পুলকানুভূতি হয়।

    ঠিক এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠলে পাশ ফিরে তাকালো। এই ফোনটার জন্যই প্রতীক্ষায় ছিলো সে। আস্তে করে ফোনটা তুলে নিলো।

    “আসোলামু ওয়ালাইকুম…ওয়ারাহমাতুল্লাহ…” মনোযোগ দিয়ে ওপাশের কথা শুনে গেলো মওলানা ইউসুফ হোসাইনী। “হুম…” মাথা নেড়ে সায় দিলো আস্তে করে।

    *

    সারাবিশ্বে যে খবরটা নিয়ে তোলপার সেটা করাচিতেও বেশ সাড়া ফেলেছে। নিজেদের ঘরে বসে সন্ত্রাসী হামলার লাইভ সম্প্রচার দেখছে শহরের লোকজন। কিন্তু করাচির গুলজার-এ-হিজরির তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ির একটি কক্ষে এই ঘটনার কোনো প্রভাবই পড়ে নি। এখানে যে দু-জন মদ্যপান করে যাচ্ছে তাদের কারোর মাথায় এ নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা কাজ করছে না। সত্যি বলতে তারা টিভি দেখছে না বলে খুব বেশি কিছু জানেও না। শুধু জানে মুম্বাইতে কিছু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে।

    দু-জন মানুষ একই ছাদের নীচে থাকলেও তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন দুটো চিন্তা।

    আইনাতের বেডরুমে নীলচে ডিমলাইট জ্বলছে। তিনটি জানালার সবগুলো বন্ধ করে পর্দা টেনে দেয়া হয়েছে যাতে বাইরে থেকে কেউ টের না পায় ঘরের ভেতরে দু-জন মানুষ আছে।

    মেঝের পুরু কার্পেটের উপর বসে আছে বাস্টার্ড। তার হাতে মদের গ্লাস। আইনাত বসেছে বিছানার উপর। তার হাতে কোনো গ্লাস নেই, বোতল থেকে সরাসরি পান করছে সে।

    “এই যে বাড়িটা দেখছো…এটা একটা জেলখানা…” মদের প্রভাবে তার কথাবাতা কিছুটা মাতলামির মতো হয়ে পড়েছে। “…আমি সেই জেলখানার কয়েদি…আর আমার বাবা এখানকার ওয়ার্ডেন…হা-হা-হা!”

    “আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে কি করতাম, জানো?”

    ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকালো মেয়েটি। “কি-ই-ই?”

    “জেল থেকে পালাতাম।”

    “হা-হা-হা!” আইনাতের হাসিটা করুণ শোনালো। “তুমি আসলেই তাই করতে…কিন্তু আমি এটা করতে পারবো না মনে হয়।”

    “একবার চেষ্টা করেই দেখো না?”

    “পালিয়ে কোথায় যাবো?”

    “বিদেশে।”

    “লন্ডনে?”

    “হুম।”

    “আর আমার ভাই?”

    “ওর কিচ্ছু হবে না। ভুলে যাচ্ছো কেন, ও তোমার বাবারই সন্তান…নিজের সন্তানকে উনি কিছু করবেন না।”

    “বাবা কিছু করবেন না জানি কিন্তু ইয়াকুব?…ওকে আমি বিশ্বাস করি না। ও অনেকটা মানসুরের মতো।”

    “ইয়াকুব?” চিনতে না পেরে বললো বাস্টার্ড।

    “আমার সত্তাই…বড়বাড়ির তিনতলায় থাকে…তাকে আব্বার ডানহাত বলতে পারো।”

    “ও।” এই ইয়াকুবকেই তাহলে আমার গাড়িতে দেখেছিলো। “ও কি করবে?”

    “ও আমার ভাইকে মেরেই ফেলবে।”

    “কি বলো?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত।

    “সম্পত্তির লোভে?”

    “না। বোঝা…ঝামেলা মনে করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে।”

    “তোমার বাবা জীবিত থাকতে ও এরকম কিছু করতে পারবে না। আমি নিশ্চিত।”

    বাঁকাহাসি দিলো মেয়েটি। “আব্বার বয়স হয়েছে, উনি আর ক-দিন বাঁচবেন।” একটু থেমে আবার বললো সে, “ইয়াকুব যদি ওরকম কিছু করে ফেলে তাহলে আব্বা হয়তো রাগ করবেন কিন্তু এর বেশি কিছু না। শেষপর্যন্ত ওকে ঠিকই মাফ করে দেবেন।”

    “আমার তা মনে হয় না।”

    “অ্যাই?” তর্জনি তুলে ঢুলু ঢুলু চোখে বললো আইনাত, “তুমি ওকে আমার চেয়ে বেশি চেনো?”

    “মোটেও না।”

    “আমি যখন লন্ডনে ছিলাম তখন ও একবার ইউনুসকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলো…জানো?”

    চুপ মেরে রইলো বাস্টার্ড। সে এসব করুণ আর অসুস্থ গল্প শুনতে চাচ্ছে না।

    “আব্বা এটা জানার পর কি করেছেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললো সে, “ধমক দিয়েছেন। আর বলে দিয়েছেন ইউনুসের ধারে কাছেও যেনো সে কখনও না যায়। ব্যস! শাস্তি মওকুফ!”।

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললো বাস্টার্ড, “তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

    তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আইনাত।

    “এতো সুন্দর আর স্মার্ট একটি মেয়ে…সে কিনা এভাবে তার জীবনটা নষ্ট করছে!” মাথা দোলালো। “আমি এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোতল থেকে হুইস্কি গিলতে লাগলো মেয়েটি।

    “এটা তো পুরোপুরি অপচয়!”

    বোতলটা মুখ থেকে নামিয়ে বাঁকাহাসি দিলো আইনাত। “তুমি বলছো আমি অপচয় করছি?”

    “হুম।”

    “এরকম অপচয় করা ঠিক হচ্ছে না?”

    “একদমই ঠিক হচ্ছে না।”

    মুচকি হেসে বাস্টর্ডের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে বললো সে, “তাহলে তুমি কেন সেটা করছো…এখন?”

    অধ্যায় ৫২।

    একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আজমল। তার সঙ্গি বড়ভাই ইসমাইলও কেমন ঘোরের মধ্যে আছে। প্রায় তিনঘণ্টা ধরে তারা অপারেশন করে যাচ্ছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্লান্তি একটুও গ্রাস করে নি।

    সিএসটি-তে অপারেশনটি ছিলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু। টয়লেট থেকে বের হয়েই তারা গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। লোকজন জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে হট্টগোল বেঁধে যায় সেখানে। পুলিশ পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর দুজনে মিলে নেমে পড়ে হত্যালীলায়। কতোজনকে মেরেছে তারা জানে না। সামনে যাদেরকেই পেয়েছে হত্যা করেছে। পাখির মতো মানুষ মেরেছে তারা।

    না। কাফির!

    ওরা সবাই কাফির। ইসলামের শত্রু। ওদের খতম করার দায়িত্ব নিয়েই নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে এসেছে এখানে।

    আজমল আর ইসমাইল ভাবতে পারে নি সিএসটি থেকে জীবন নিয়ে বের হতে পারবে, কিন্তু তাই হয়েছে। হৈহট্টগোলের মধ্যে তারা দুজন সেখান থেকে বের হয়ে যায়। এ-পথ ও-পথ হয়ে চলে যায় কামা হাসপাতালে। সেখানে দুয়েকজনকে হত্যা করার পরই পুলিশ তাদেরকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু তাদের সাহস আর আক্রমণের কাছে পরাজিত হয় তারা। ছয়-সাতজন পুলিশকে হত্যা করে পুলিশের একটা গাড়ি ছিনতাই করে ফেলে। কয়েক মুহূর্তে জন্য আজমলের মনে হয়েছিলো পালিয়ে যাবার একটা সুযোগ এসে গেছে তাদের। তারা যা করেছে তাতে করে শহীদ না-হয়ে গাজি হলেও তো কম হয় না। কথাটা ইসমাইলকে বললে সেও একটু ধন্দে পড়ে যায়। কিন্তু মোবাইলফোনে উপরওয়ালাদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে রওনা দেয় তাজ হোটেলের উদ্দেশ্যে। এ মুহূর্তে ওখানে তাদের দলের অনেকেই যোগ দিয়েছে।

    কিন্তু ছিনতাই করা পুলিশের গাড়ির চাকা পাঙ্কচার হয়ে যাওয়াতে পথে সেটা পরিত্যাগ করে আরেকটি প্রাইভেটকার বাগিয়ে নেয়। আতঙ্কিত মুম্বাই শহরের পথঘাট কেমন ভুতুরে হয়ে আছে রাত বারোটার পর পরই। ফাঁকা রাস্তায় ইসমাইল গাড়ি ছুটিয়ে তাজ-এর দিকে যাচ্ছে। তাদের দুজনের চোখেমুখেই দৃঢ় সঙ্কল্প।

    “আজমল!” হঠাৎ ইসমাইল চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো।

    *

    বেহুঁশের মতো বিছানায় পড়ে আছে আইনাত। অন্ধকার শোবারঘরের জানালার সামনে বসে আছে বাস্টার্ড। এই জানালা দিয়ে শুধু বড়বাড়িটাই দেখা যায় না, নীচের মেইনগেটটাও দেখা যায়। এর কারণ বড়বাড়িটার সামনে ছোটোখাটো একটি লন আছে। লনের পরেই মেইনগেটটা।

    জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে ভালো করে দেখছে সে। বড়বাড়ির দোতলার একটি ঘরের জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। মওলানা এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছে দেখে সে অবাকই হলো। এখন রাত প্রায় তিনটা। তিনতলা আর নীচতলা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে আছে। মেইনগেটের পাশে বসে ঝিমুচ্ছে দারোয়ান। বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এটাই স্বাভাবিক। একটু পর এই লোক পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লেও সে অবাক হবে না।

    প্রায় বিশ মিনিট ধরে সে চারপাশটা দেখে গেলো। সব দেখে তার মনে হচেচ্ছ মওলানাকে শিকার করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে এই বাড়িটাই। কিন্তু এই সহজ কাজটা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে একটা পিস্তলের অভাবে।

    সাইলেন্সারসহ একটা পিস্তল কতো সহজেই না তার মিশন সফল করে দিতে পারতো আজরাতে!

    এখন আর আক্ষেপ করে কোনো লাভ নেই। ঘটনাচক্রে যেমন অনেক সুবিধা পাওয়া যায় তেমনি অসুবিধাগুলোও মেনে নিতে হয়। সন্দেহ নেই, এখানে এভাবে চলে আসাটা অভাবনীয় একটি ঘটনা, কিন্তু পিস্তল ছাড়া এসেই বা কী করবে বুঝতে পারছে না। চেষ্টা করলে খালিহাতেও একজন মানুষ মারা যেতে পারে। এই বাড়িতে হাতেগোনা কিছু মানুষ বাস করলেও কাজের লোক আছে বেশ কয়েকজন। খালিহাতে মওলানার কাছে যাওয়াটা সম্ভব হবে কিনা ভেবে দেখলো।

    একটা চাকু? কিচেন নাইফ?

    মাথা দোলালো সে। আইনাতের ফ্ল্যাটে কোনো কিচেন নেই, ওটা আছে নীচতলায়। ঘরে খোঁজাখুঁজি করলে একটা কেচি কিংবা ধারালো কিছু হয়তো জোগাড় করা যাবে কিন্তু সেটা তার প্রয়োজন মেটাতে পারবে না।

    জানালার পাশে বসে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভেবে যেতে লাগলো বাস্টার্ড। একটা না একটা উপায় বের করতেই হবে তাকে। এভাবে এতো বড় একটা সুযোগ নষ্ট করতে পারে না সে। দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে ঢোকাটা একদম অনিশ্চিত।

    একটা শব্দে চমকে উঠলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো মেইনগেটটা খুলে যাচ্ছে। এতো রাতে এ বাড়িতে কে ঢুকছে?! নড়েচড়ে বসলো সে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস ঢুকছে

    ঘটনা কি! মনে মনে বলে উঠলো সে। অজানা আশংকায় তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো বাস্টার্ড। মেইনগেটের দিকে চোখ কুচকে তাকালো। লনের উপরে লাইটের আলোয় গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দারোয়ান দ্রুত মেইনগেটটা লাগিয়ে দিতেই তিনজন লোক গাড়ি থেকে নেমে বড়বাড়িটার ভেতরে ঢুকে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত পর মজবুত শরীরের এক যুবক বড়বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে হাত নেড়ে কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে দারোয়ানকে।

    বাস্টার্ড আরো বিস্ময় আর আতঙ্কের সাথে দেখতে পেলো ঐ যুবক মেইনগেটের মধ্যে ছোট্ট একটা পকেট খুলে সেটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। রাস্তায় কাউকে দেখছে? আরো গাড়ি আসবে?

    জবাবটা সে পেয়ে গেলো দশ মিনিট পরই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যুবকটি গেটের খোপ দিয়ে তাকিয়ে আছে একেবারে মূর্তির মতো। যেনো সামান্যতমও নড়নচড়ন হচ্ছে না।

    ওয়াচার?

    আতঙ্কের সাথেই বুঝতে পারলো, মওলানার বাড়িতে ঢোকার সুযোগ নষ্ট হয়ে গেছে।

    পরক্ষণেই কতোগুলো প্রশ্ন তাকে জেঁকে ধরলো : এরা কারা? এখানে কেন এসেছে?

    তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে উঠলো, এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

    অধ্যায় ৫৩

    মুজাহিদ নামের ছেলেটি, যার আসল নাম আজমল আমের কাসাব, সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার চারপাশে ঘিরে আছে সশস্ত্র পুলিশ। তার মাথার কাছে বসে আছে সৌম্যকান্তির এক ভদ্রলোক। পুলিশের সবাই তাকে স্যার-স্যার বলছে সম্ভ্রমের সাথে। লোকটা অনেকক্ষণ ধরে চুপ মেরে তাকে দেখছে, কোনো কথা বলছে না।

    রাত একটার সামান্য কিছু আগে ছিনতাই করা একটি প্রাইভেটকার নিয়ে তাজ-এ যাবার সময় অপ্রত্যাশিতভাবে পুলিশ-ব্যারিকেডের মুখে পড়ে যায় তারা। ব্যাপক গোলাগুলিতে বড়ভাই ইসমাইল ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। তবে মৃত্যুর আগেও সে সত্যিকারের জিহাদির মতো লড়াই করে গেছে। আজমলও চেষ্টা করেছিলো কিন্তু ধরা পড়ে যায় পুলিশের হাতে।

    ধরা পড়ার পর বার কয়েক হায় ভগবান-হায় ভগবান বলেছিলো সে কিন্তু পুলিশের হৈ-হট্টগোলে সেটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তাকে ধরতে গিয়ে তার রাইফেলের গুলিতে একজন পুলিশ মারা যায় ফলে বাকিরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে কিল-ঘুষি চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে। এ কারণে শেখানো বুলিটা আর আওড়াতে পারে নি বেশিক্ষণ।

    একটু আগে তাকে এক লোক ইনজেকশন দিয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে এটাও এক ধরণের ভিটামিন ইনজেকশান। কিন্তু এখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরে। যেনো জাহান্নামের আজাব শুরু হয়ে গেছে। অথচ এমনটা হবার কথা ছিলো না। তারা তো জান্নাতী! তাদের মুখ দিয়ে নূরের জ্যোতি বের হবার কথা। তাদের শরীরে কেন মৃত্যুর আজাব হবে!?

    “তোমার নাম কি?” মাথার কাছে বসে থাকা পুলিশের লোকটি মুখ খুললো এই প্রথম। “কোত্থেকে এসেছো? ক-জন এসেছে তোমরা?”

    আজমল চুপ মেরে পড়ে থাকলো।

    “তোমাকে কথা বলতেই হবে…না-বলে কোনো উপায় নেই।”

    লোকটা এতো দৃঢ়ভাবে বলাতে আজমল একটু অবাকই হলো, আবার ভয়ও পেলো। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো তার শরীরের যন্ত্রণা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে, যেনো প্রতিটি শিরা-ধমনী তীব্র চাপে ফেটে পড়বে এক্ষুণি!

    “আম্মি!” প্রাণপণে চিৎকার দিলো আজমল আমের কাসাব।

    *

    আতঙ্কের সাথেই সে দেখতে পাচ্ছে পাঁচ-ছয়জন লোক ড্রাইভওয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে ছোটোবাড়িটার দিকে। তারপরই দরজায় জোরে জোরে আঘাতের শব্দ! ভয়ে তার সারা শরীর অসাড় হয়ে গেলো।

    একটা পিস্তল!

    আবারো সেই আক্ষেপ। খালি হাতে লোকগুলোর সাথে কিভাবে মোকাবেলা করবে? আর ঐ মেইন দরজা ছাড়া এই ঘর থেকে বের হওয়ারই বা উপায় কি?

    দরজার ধাক্কা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে, যেনো তার বুকে এসে মারছে! ঘরের মাঝখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ভালো করেই জানে কিছু করার নেই। এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে যতোই ভেবে যাক কোনো লাভ হবে না। ফাঁদে পড়ে গেছে সে। কঠিন এক ফাঁদে। এই ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায়ই নেই, আর ঐ দরজাটাও বেশিক্ষণ বন্ধ করে রাখা যাবে না। দরজার বাইরে যারা আছে তারা একটু পরই মরিয়া হয়ে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়বে ভেতরে। কিন্তু তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না এই বাড়িতে তার অবস্থানের কথা ওরা কিভাবে জানতে পারলো!

    বিছানার দিকে তাকালো। আইনাত এখনও বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে দরজায় ধাক্কা মারা হচ্ছে তাতে এই গাঢ় ঘুমও যেকোনো সময় ভেঙে যাবে। মেয়েটা উঠে গেলে কি হবে? ওকে কিভারে আটকে রাখবে সে? আদৌ কি আটকে রাখতে পারবে?

    যা হবার তা-ই হলো। আইনাতের ঘুম ভেঙে গেলো একটু পরই। দরজা ধাক্কানোর শব্দে সেও বিস্মিত। কয়েক মুহূর্ত লাগলো ব্যাপারটা বোঝার জন্য। তার সাথে চোখাচোখি হলো।

    “বোকা কোথাকার! বিছানার নীচে লুকাও!” চাপা কণ্ঠে আদেশের সুরে বললো সে। “আমি দেখছি ঘটনা কি।”

    মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও জায়গা থেকে নড়তে পারলো না বাস্টার্ড। এরকম নার্ভাস কখনও হয় নি। যেনো তার সমস্ত বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখতে পাচ্ছে আইনাত চলে যাচ্ছে দরজার কাছে। মেয়েটা আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দরজা খুলে দিলো!

    সঙ্গে সঙ্গে হুরমুর করে ঘরে ঢুকে পড়লো পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র যুবক। ওদের প্রত্যেকের হাতে অটোমেটিক অস্ত্র। কালো পোশাকের যুবকেরা তাকে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুও সময় নষ্ট করতে চাইলো না। একসঙ্গে দু-তিনজন গুলি ছুঁড়ে বসলো। বুলেটের আঘাতে কয়েক হাত পেছনে ছিটকে পড়ে গেলো সে।

    “না!” চিৎকার দিয়ে উঠলো বাস্টার্ড।

    “অ্যাই, কি হয়েছে?”

    হতভম্ব হয়ে দেখতে পেলো তার মুখের কাছে ঝুঁকে আছে একটা মুখ।

    আইনাত!

    “আজব! তুমি এখানে কেন? সারারাত কি এখানেই বসেছিলে নাকি?”

    ধাতস্থ হতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেলো তার। হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। বুঝতে পারলো ঘটনাটা কি।

    “দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?”

    ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

    মুখ টিপে হাসলো আইনাত। “কি দুঃস্বপ্ন দেখলে? মানসুর তোমাকে ধরে পিটাই দিচ্ছে?”

    এবার তার মুখে স্মিতহাসি দেখা গেলো। “আমার বুকে পিস্তল তাক করে বলছে, তুই আমার লিগ্যাল ওয়াইফের সাথে ইলিগ্যাল কাজ করেছিস! আমি তোকে গুলি করে মারবো! “

    “হা-হা-হা,” হাসিতে ফেটে পড়লো আইনাত। “দারুণ তো। মনে হচ্ছে কোনো দুঃস্বপ্ন….মনে হচ্ছে সিনেমা।”

    উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। তার মনে পড়ে গেলো ভোর পর্যন্ত জানালার সামনে বসে বসে বাইরে চোখ রাখছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায় নি। হতাশা আর হুইস্কি তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে কখন টেরই পায় নি!

    আইনাত তার গলা জড়িয়ে ধরলো। “আমি তোমাকে আবারো এরকম দুঃস্বপ্ন দেখাতে চাই!”

    “তার আগে তুমি আমাকে এই বাড়ি থেকে বের হবার রাস্তাটা তো দেখাবে, নাকি?”

    ভুরু কুচকে তাকালো মেয়েটি। “এতো সকালেই চলে যাবে? জরুরি কোনো কাজ আছে নাকি?”

    “না, তা নেই…কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা নিশ্চয় ঠিক হবে না।”

    “কতোবার বলবো, আমি না ডাকলে কেউ আমার ফ্ল্যাটে আসে না। এ নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম ভালো হয় নি। মুখটা দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”

    কথাটা সত্যি, কিন্তু মুখে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো, “ক্লান্ত হবো না? ভুলে গেছো, ম্যাডামকে কি কঠিন সার্ভিসটাই না দিলাম?”

    “ইউ নটিবয়,” বলেই বাস্টার্ডের বুকে জোরে জোরে দুটো ঘুষি মারলো আইনাত।

    “হা-হা-হা,” করে হেসে উঠলো সে।

    “অ্যাই, চুপ!” মুখে আঙুল দিয়ে তার হাসি থামিয়ে দিলো। “এখন সবাই উঠে গেছে…এতো জোরে জোরে হেসো না।”

    “সরি সরি,” বলে উঠলো সে। “ভুল হয়ে গেছে।”

    মেয়েটা শুধু হাসলো।

    “তাহলে আমরা বের হচ্ছি কখন?”

    “তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। দশটার পর বের হবো। আব্বা আর ভাই। অফিসে চলে যাবে তখন।”

    “এখন কটা বাজে?”

    দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো আইনাত, “সাড়ে আটটা…তুমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি ব্রাশ করে আসি।”

    আইনাত বাথরুমের দিকে চলে গেলো।

    গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালো সে। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে দুঃস্বপ্নটা অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠতে পারে। জানালার সামনে চলে গেলো। পর্দা সরিয়ে বাইরে দেখতে পেলো মেইনগেটের পাশে দারোয়ান নেই, কিন্তু অন্য একজন দাঁড়িয়ে আছে। ভোর পর্যন্ত এই লোকটাকেই দেখেছে গেটের কাছে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে। এখন সে গেটের পাশে চুপচাপ বসে আছে।

    আবারো সেই প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করলো-মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর কাছে এরা কেন অতো রাতে চলে এলো? এরা কারা?

    অধ্যায় ৫৪

    মুম্বাই
    অ্যান্টি টেররিস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টার
    রাত: ২-১৫

    এমন অসময়ে অশোক মিত্র হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসায় রাত্রিকালীন ডিউটিতে থাকা নিম্নপদস্থ কর্মচারিরা একটুও অবাক হলো না। রাত দশটার দিকে মুম্বাইতে সন্ত্রাসী আক্রমণ শুরু হবার পর পর গোটা ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে, সুতরাং এটিপি’র কর্তাব্যক্তিরা যে মাঝরাতে অফিসে ছুটে আসবে সেটা তারা ধারণা করতে পেরেছিলো।

    এটিপি’র সমস্ত কর্মীবাহিনী যে যেখানে ছিলো যতো দ্রুত সম্ভব ছুটে এসেছে। তাদের অনেককেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ফোন করে ডেকে এনেছে, বাকিরা নিজের কাণ্ডজ্ঞানেই এই অসময়ে ছুটে এসেছে সদরদফতরে।

    এক অধস্তনকে নিয়ে নিজের অফিসে ঢুকেই ফাইল-ক্যাবিনেটটা খুলে বিশেষ একটি ফাইল নিয়ে অশোক চলে গেলো নীচতলার কমিউনিকেশন্স রুমের দিকে। একটু আগে মুম্বাইর পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার রাকেশ মারিয়া তাকে ফোন করে জানিয়েছে রাত একটার দিকে জীবিত অবস্থায় এক সন্ত্রাসীকে ধরতে সক্ষম হয়েছে তারা। সময়ক্ষেপন না করেই সেই সন্ত্রাসীর কাছ থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য জানতে পেরেছে :

    পাকিস্তানী জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-এ-তৈয়বার দশজন প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী করাচি থেকে ট্রলারে করে আরব-সাগর পাড়ি দিয়ে মুম্বাই এসে হামলা করেছে। দশজনের দলটি দু-জন করে জুটি বেধে পাঁচটি টিম তৈরি করে হামলা শুরু করে। এখনও নরিমান হাউজ, হোটেল তাজ আর হোটেল ওবেরয়-এ সন্ত্রাসী দল রক্তের গঙ্গা বয়ে দিচ্ছে।

    জীবিত সন্ত্রাসীর কাছ থেকে রাকেশ মারিয়া আরো জানতে পেরেছে, তাদের দলের পাঁচজন সিনিয়রের সাথে টেলিফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে করাচিতে থাকা লস্করের হ্যান্ডলাররা। ওদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে দলটি। এখন আটজন সন্ত্রাসী তিনটি স্পটে সক্রিয় আছে। এরইমধ্যে পুলিশ ঘিরে রেখেছে ঐসব জায়গা।

    রাকেশ মারিয়া চাইছে ঐসব সন্ত্রাসীদের সেলফোনের ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যানিং করে কলগুলো যেনো ইন্টারসেপ্ট করা হয়।

    অশোকের জায়গায় অন্য কেউ হলে কথাটা শোনামাত্রই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিতো-লক্ষ-লক্ষ ফোনকল থেকে তিন-চারটা কল ডিটেক্ট করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার জানামতে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেঞ্জার্সদের বিশেষ একটি বিমান আর সেই বিমানে থাকা অত্যাধুনিক একটি ডিভাইস এই কাজটা করতে পারে। এরকম উচ্চপ্রযুক্তির কোনো ডিভাইস এটিপি’র হাতে নেই। তাদের কাছে ফোন নাম্বারগুলো থাকলেই কেবলমাত্র ইন্টারসেপ্ট করা সম্ভব হয়।

    তবে রাকেশ মারিয়ার অনুরোধটি শোনার পরই অশোক মিত্র বুঝতে পেরেছিলো একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

    গত সপ্তাহে করাচিতে থাকা র-এর এক দক্ষ আন্ডারকভার এজেন্ট লস্কর এ-তৈয়বার একজনকে অনুসরণ করে দারুণ একটি তথ্য লাভ করে। লস্করের ঐ লোকটি এক দোকান থেকে বত্রিশটি সিম কিনেছিলো। জাগদীশ নামের এজেন্ট সুকৌশলে ঐ বত্রিশটি সিমের নাম্বার জোগাড় করে দিল্লির হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলে এই গুরুত্বপূর্ণ ইন্টেলটি এটিপি’র সাথে শেয়ার করে তারা। কিন্তু দুভার্গের ব্যাপার, এটিপি’র কর্তাব্যক্তিরা তেমন কিছু না করে ফাইলবন্দী করে রাখে এটি। অথচ ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার ছিলো। কেননা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে অন্য আরেকটি ফোনকল ইন্টারসেপ্ট করে তারা জানতে পেরেছিলো লস্কর-এ-তৈয়বা মুম্বাই শহরে হামলার পরিকল্পনা করছে। এটা জানার পরই করাচিতে থাকা আন্ডারকভার এজেন্টদের দায়িত্ব দেয়া হয় বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্য। ফলস্বরূপ গতসপ্তাহে তারা জানতে পারে বত্রিশটি সিম কেনার কথা।

    কমিউনিকেশন্স রুমে রাত্রিকালীন ডিউটিতে থাকা দু-জন অপারেটরকে ফাইলটা দিয়ে অশোক বলে দিলো এই বত্রিশটি সিমের মধ্যে কতোগুলো এখন অ্যাক্টিভ আছে সেটা যেনো দ্রুত চেক করে দেখে তারা।

    নিতিন আর যোগেশ নামের দু-জন অপারেটর কাজে লেগে গেলে অশোক এক কাপ কফি নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে রইলো।

    পনেরো মিনিটের মধ্যেই জানা গেলো বত্রিশটি সিমের মধ্যে তিনটি সিম এ মুহূর্তে সচল আছে। অশোক নড়েচড়ে বসলো তথ্যটা জেনে। ঐ তিনটি সিমের সেলফোন ফ্রিকোয়েন্সি স্ক্যান করে ইন্টারসেপ্ট করার নির্দেশ দিলো সে।

    নিতিন আর যোগেশ সাত-আট মিনিটের মধ্যেই কাজটা সফলভাবে করতে পারলে বিস্ময়ের সাথে অশোক আবিষ্কার করলো, সুদূর করাচিতে বসে লস্করের দু-জন হ্যান্ডলার তিনটি সন্ত্রাসী টিমকে ‘গাইড’ করছে।

    ইয়ারফোনটা কানে চেপে কিছুক্ষণ শুনে গেলো সে। কখন কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে সব নির্দেশ দেয়া হচ্ছে মুম্বাইর সন্ত্রাসীদের। আর হ্যান্ডলারদের নির্দেশ পেয়ে খুন-খারাবি করে যাচ্ছে হামলাকারীরা।

    কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে ফোনালাপগুলো রেকর্ড করার নির্দেশ দিলো সে, তারপর সিকিউর একটি ফোন তুলে নিয়ে একে একে ফোন করে গেলো বেশ কয়েকটি জায়গায়। ভালো করেই জানে এই খবরটি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। রাত যতোই হোক, দেরি না করে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আর কর্তাব্যক্তিকে জানাতে হবে এটা।

    *

    ২৭শে নভেম্বর সকালে করাচিবাসী দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলো।

    অধিকাংশ বাসিন্দা রাতভর টিভি পর্দায় মুম্বাই হামলার লাইভ টেলিকাস্ট দেখে ভোরের দিকে ঘুমাতে যায়। পরিহাসের বিষয় হলো প্রতিবেশি দেশের একটি শহরে এই দানবীয় হামলায় অনেক পাকিস্তানির মতো করাচির কিছু অধিবাসীও খুশি। তবে কা-জ্ঞান আর মানবিকতা বোধসম্পন্ন মানুষ যে একদমই নেই তা নয়। এই ঘনবসতি শহরে তারাও রয়েছে, তবে বরাবরের মতোই অশুভদের আস্ফালনে তাদের কণ্ঠস্বর খুব ক্ষীণ শোনাচ্ছে এখন।

    ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে যে আক্রমণ শুরু হয়েছে গতরাত সাড়ে-নয়টার পর থেকে সেটা এখনও অব্যাহত আছে। সন্ত্রাসীদল নরিমান হাউজ আর হোটেল তাজ-এ জিম্মি করে রেখেছে কয়েক শ’ মানুষ। শিবাজি রেলস্টেশনের গণহত্যা রাতেই সম্পন্ন হয়েছে ৫৮জন নিরীহ ভারতবাসীর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। মুম্বাই শহর এখন আতঙ্কের নগরী। টিভিতে লাইভ সম্প্রচার দেখে ভারত সরকারের মতোই সারাবিশ্ব জেনে গেছে সন্ত্রাসীর সংখ্যা পঞ্চাশ-বিশ কিংবা পনেরো নয়, মাত্র দশজন! আর তারা এসেছে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি থেকে।

    পাকিস্তান রাষ্ট্রটি আরো একবার বিশ্ববাসীর সামনে নিজের ভ্ৰষ্টনীতি আর মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা উলঙ্গভাবে প্রকাশ করে ফেললো এ ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাদের সমস্ত বক্তব্য মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে কাসাবের ধরা পড়ে যাওয়ার ঘটনায়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পঞ্চমযুদ্ধের আশংকা করা হচ্ছে এখন। আর এরকম যুদ্ধ বেঁধে গেলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে শহরটি সেটা অবশ্যই করাচি। এর আগে একাত্তরের শেষের দিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন ভারতের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে তখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো করাচি বন্দর। সেই স্মৃতি প্রবীণ করাচিবাসীর মনে এখনও দগদগে ঘায়ের মতো অক্ষত আছে।

    সারাবিশ্বে নিন্দার ঝড় গায়ে মেখেও পাকিস্তানি শাসকদের কিছু অংশ আর বিরাট সংখ্যক জনগণ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে পাল্টা হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের মধ্যে সবাই এরকম মনোভাব পোষণ না করলেও মুখে কিছু বলছে না। তারা ভালো করেই জানে আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণাম দু-দেশের জন্য কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে। দুটো পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ক এমন বিপজ্জনক চিন্তা পশ্চিমাবিশ্ব করছে না। তারা উঠে পড়ে লেগেছে, যে করেই হোক পঞ্চমযুদ্ধটি যেনো সংঘটিত না-হয়।

    করাচি এখন চাপা উল্লাস আর আতঙ্কের নগরী। পথেঘাটে একটু কান পেতে লোকজনের কথাবার্তা শুনলে যে কেউ হতভম্ব হয়ে যাবে। বর্বর এই আক্রমণে অনেকে শুধু খুশিই হয় নি, সন্ত্রাসীদের কাজকর্মকে বীরোচিত বলেও মনে করছে কেউ কেউ। মাত্র দশজন পুচকে ছেলের ভয়ে গোটা ভারত নাকি হিজড়ার মতো আচরণ করছে, তাই তাদের একরকম বিকৃত আনন্দ!

    ভারত যখন তাজ হোটেল আর নরিমান হাউজের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জিম্মি উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত তখন করাচি শহরে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী টহলে নেমেছে। পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে জায়গায় জায়গায় বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। আসন্ন বিমানহামলা মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান বসানোর কাজও চলছে সমানতালে।

    পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মি দেশগুলোর কিছু ধর্মান্ধ জ্ঞানপাপী নানারকম কন্সপিরেসি থিওরি’ নিয়ে হাজির হচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়।

    ভারতের অভ্যন্তরে বিচ্ছন্নতাবাদী কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর কাজ এটি।

    ইরাক আর আফগানিস্তানের পর পাকিস্তানকে টার্গেট করেছে পশ্চিমাবিশ্ব আর তাদের মোড়ল আমেরিকা। এই ঘটনা সেই নীলনক্সারই প্রথম ধাপ।

    ভারত সরকার পাকিস্তানকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এই ঘটনা সাজিয়েছে।

    এটা ভারতীয় র-এর একটি ভয়াবহ চাল। তারা পাকিস্তানের কিছু বিপথগামী তরুণকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে।

    পাকিস্তানকে আমেরিকা তার নতুন যুদ্ধক্ষেত্র বানাবার পায়তারা করছে।

    কাশ্মিরি জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য ভারত এ কাজ করেছে। সবটাই নাটক। সন্ত্রাসীরা কেউই পাকিস্তানের নয়। এমন কি তারা কেউ উর্দুও বলতে পারে না! কাসাবের পরিচয় নিয়ে রহস্য আছে। ভারত সরকার তার সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে সেটা খতিয়ে দেখা হয়েছে। পাঞ্জাবের ঐ গ্রামে গিয়ে কাসাবের পরিবারের কোনো হদিশ তারা পায় নি।

    অধ্যায় ৫৫

    মানসুর রাঙ্গুওয়ালা তার নাক নিয়ে যারপরনাই পেরেসানে আছে। গতরাতে ডাক্তারের কাছে গেলে জানা যায়, তার নাকের হাড় ভেঙে গেছে। রাত দুটো পর্যন্ত হাসপাতালে ছিলো, তারপর নাকে বিরাট বড় ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে-পরিবারে লোকজনদের কাছে এই মিথ্যেটা বলতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাদের হাবভাবে সে বুঝতে পেরেছে মিথ্যেটা কাজে লাগে নি। শরীরের আর কোথাও চোট না পেয়ে শুধু। নাকে! মানসুরের মতো তাদের সবার মাথা অতো মোটা নয়।

    যাহোক, তার নাকের এই যন্ত্রণা অনেকটাই ভুলে যেতে মুম্বাই হামলার খবরটা শুনে কিন্তু যে হারামিটা এ কাজ করেছে তাকে না পেয়ে একটুও শান্তি পাচ্ছে না সে। হাবিব ছেলেটা অবশ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে যদিও এখন পর্যন্ত হারামজাদার টিকিটাও খুঁজে পাচ্ছে না। সকালে ফোন করে সে জানিয়েছে, কুত্তাটা নাকি হোটেলেই ফেরে নি। তার দু-জন লোক সারারাত হোটেলেই ছিলো। ম্যানেজারও জানিয়েছে তাদের ঐ গেস্ট আর ফিরে আসে নি। তবে কি শূয়োরটা পালিয়ে গেলো?

    কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! ওর লাগেজ, পাসপোর্ট সব তো রুমেই আছে। ওগুলো ছাড়া অন্য কোথাও সটকে পড়বে কিভাবে? সম্ভবত টাকা-পয়সাও রুমেই রেখে গেছে। নিশ্চয় সব টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না?

    হাবিবকে সে বলে দিয়েছে, টাকা-পয়সা নিয়ে যেনো চিন্তা না করে। যতো টাকা লাগুক সে দেবে কিন্তু তার হারানো পৌরুষ ফিরে পেতে হলে ঐ লোকটাকে চাই-ই চাই। ওকে নিজের কজায় নিয়ে মনের আশ মিটিয়ে হাড্ডি মাংস এক করবে। এমন শিক্ষা দেবে যে, এই জীবনে কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে না। এমন কি মশা-মাছি মারতে গেলেও দশবার চিন্তা করবে।

    হাবিব ছেলেটার মাথা খুব ভালো। সে একবার কোনো কাজ হাতে নিলে ব্যর্থ হয় না। হয়তো একটু দেরি হবে কিন্তু কাজটা সে ঠিকই করতে পারবে। একটু আগে যখন ওর সাথে কথা হলো তখনও জোর দিয়ে বলেছে, চিড়িয়া তাদের হাতের মুঠোয়ই আছে, ওকে সামুনাবাদ হোটেলে ফিরে আসতেই হবে, না এসে উপায় নেই। তাছাড়া, ইয়াসিন নামের ছেলেটা তো আছেই। দরকার হলে ওকে তুলে এনে এমন হালুয়া টাইট করবে যে বাপ-বাপ বলে সব কিছু জানিয়ে দেবে।

    নাকের প্রচ- ব্যথা সত্ত্বেও মনে মনে জুলুম করার অভিনব কিছু কায়দা নিয়ে ভেবেছে মানসুর। কি করে বাহেনচোদ্দটাকে শাস্তি দিলে বেশি যন্ত্রণা পাবে সেটা নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছে। সকালের নাস্তা করার সময় এসব ভাবতে ভাবতে একটা উদ্ভট কায়দার কথা তার মাথায় চলে এলো। সে ঠিক করলো এটা করবেই। তার সাথে পা- মতো এক ছেলে আছে, নাম রুস্তম, সে জানে ছেলেটার ওই বদঅভ্যেস রয়েছে। হাবিবই তাকে বলেছিলো এটা। খচ্চরটার নাকি মেয়েমানুষের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। ঠিক আছে, রুস্তমকে তার মদানি দেখানোর একটা সুযোগ দেয়া হবে। নিশ্চয় দৃশ্যটা হবে খুবই উপভোগ্য। নারী ধর্ষণ কেমন হয় সে তা ভালো করেই জানে। পনেরো বছর বয়সেই এক কাজিনকে ধর্ষণ করেছিলো। এই ছোট্ট জীবনে কাজটা তো আর কম করে নি। কিন্তু পুরুষ ধর্ষণ? তাও আবার পুরুষের হাতে? না, এমন বিরল দৃশ্য দেখা হয় নি এখনও।

    সে আরো ঠিক করলো, ঐ বিরল দৃশ্য দেখার পর পরই হারামজাদাকে খাসি করে ফেলবে। একেবারে খোঁজ-দাস! যা, এবার মেয়েমানুষের সাথে ওসব কর গিয়ে!

    চিন্তাটা মাথায় আসতেই হাসতে হাসতে নাস্তার টেবিল থেকে উঠে গেলো মানসুর রাঙ্গুওয়ালা।

    *

    সাড়ে দশটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো তার। উঠে দেখে আইনাত নেই। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো সে। ড্রইংরুমেও মেয়েটা নেই। এই ফ্ল্যাটে আরো দুটো ঘর আছে, ওগুলোর দরজায় বাইরে থেকে তালা মারা।

    জানালার সামনে গিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে মেইনগেটের দিকে তাকালো। এখন দারোয়ান ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে গেটের পাশে ছোট্ট একটা টুলের উপর কিন্তু তার সাথে শেষরাতে যোগ দেয়া যুবকটি নেই। মওলানার ঘরের জানালার দিকে তাকালো। কাঁচের ওপাশে যে বাতি জ্বলছে বুঝতে পারলো সে। দিনের বেলায়ও বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে, তার মানে দরজা-জানালা সব বন্ধ। একটা মানুষের অবয়বও দেখতে পেলো জানালার সামনে, তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। মওলানা আর গভীর রাতে আসা কিছু লোকজন সারারাত জেগে ছিলো। এখনও তারা ঘরের মধ্যে হাটাহাটি করছে।

    দরজায় খুট করে শব্দ হতেই সে সতর্ক হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে সরে এলো জানালা থেকে। আস্তে করে চলে গেলো ড্রইংরুমের দরজার কাছে। অবশ্য তার মনের একটা অংশ বলছে এটা আইনাত। কয়েক মুহূর্ত পরই তার ধারণা সত্যি প্রমাণ করে ঘরে ঢুকলো মেয়েটি।

    “তুমি উঠে গেছো?” আইনাতের হাতে খাবারের ট্রে। “নীচে গেছিলাম…ছোটোভায়ের খাঁজখবর নিয়ে এলাম…আমি ছাড়া তো ওর খোঁজ খবর কেউ নেয় না।” ট্রে-টা টেবিলের উপরে রেখে আবার বললো, “নাস্তা নিয়ে এলাম। মেহমানকে নাস্তা না করিয়ে কিভাবে বিদায় করি?” হাসতে হাসতে বললো। “তাও আবার যেই-সেই মেহমান নয়…”

    “মানে?”

    “দারুণ সার্ভিস দেয়া মেহমান!”

    হেসে ফেললো সে।

    নাস্তার ট্রেটা ড্রইংরুমের একটি নীচু টেবিলে রেখে দিলো মেয়েটি। “খবর জানো? বোম্বাইর হামলা তো বিরাট ঘটনা হয়ে গেছে।”

    হামলার ঘটনা তারা জেনেছিলো রাত দশটার দিকে। তখন অবশ্য দৌড়ের উপরে ছিলো, এরপর আর টিভি দেখা হয় নি বলে সে কিছুই জানে।। ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টের হামলার মতো কোনো ঘটনা বলে মনে করেছিলো।

    “টিভিতে লাইভ দেখাচ্ছে…নীচে গিয়ে দেখে এলাম। বোম্বের রেলস্টেশন, হাসপাতাল, ইহুদিদের একটি বাড়ি আর তাজ হোটেলে হামলা করা হয়েছে। মারাত্মক ঘটনা। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। সন্ত্রাসীরা নাকি পাকিস্তানি। সিএনএন, বিবিসিও তাই বলছে। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।”

    “বলো কি?” অবাকই হলো বাস্টার্ড।

    “কাজের লোকেরা বলাবলি করছে, শহরের রাস্তায় নাকি মিলিটারি নেমে গেছে।”

    “কেন?”

    “আহা, যুদ্ধ বেধে গেলে তো এই করাচিই সবার আগে আক্রান্ত হবে।”

    “ও,” আর কিছু বললো না সে। করাচি তাকে বার বার চমকে দিচ্ছে, তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, যেনো ছিনিমিনি খেলা শুরু করে দিয়েছে তার সাথে। একবার সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দিচ্ছে তো পরক্ষণেই এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে যা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে।

    “কি ভাবছো?”

    আইনাতের কথায় তার দিকে ফিরে তাকালো। “না, মানে বেডরুমের জানালা দিয়ে তোমাদের মেইনগেটে দেখলাম দারোয়ানের সাথে আরেকজন লোক পাহারা দিচ্ছে…সে কে?”।

    “ও…আব্বা মনে হয় বাড়তি দারোয়ানের ব্যবস্থা করেছে…অফিসের সিকিউরিটি হবে হয়তো।”

    “বাড়তি পাহারা কেন?”

    ঠোঁট ওল্টালো সে। “ঠিক জানি না। তবে মনে হচ্ছে শহরের অবস্থা। ভালো নয় তাই। করাচিতে কিন্তু প্রচুর চুরি-ডাকাতি হয়। পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে ওরা সুযোগ নিতে একটুও দেরি করে না।”

    কিছু বললো না বাস্টার্ড। তার কাছে অবশ্য এটা মনে হচ্ছে না।

    “গত ইলেকশনের সময়ও অবস্থা খুব খারাপ ছিলো। এমকিউএম-এর সাথে পিপিপি আর মুসলিমলিগারদের সে কি মারামারি। তখনও আব্বা এরকম পাহারা বসিয়েছিলো।”

    “ও”।

    “তুমি এসব নিয়ে চিন্তা কোরো না। চলো দু-জনে মিলে নাস্তা করে ফেলি, তারপর আমি তোমাকে গাড়িতে করে হোটেলে পৌঁছে দেবো।”

    “আজকের পর আমাদের দেখা হবে কবে?”

    “খুব জলদিই হবে, যদি না তুমি যুদ্ধের ভয়ে পাকিস্তান থেকে লেজ গুটিয়ে লন্ডনে চলে যাও।” কথাটা শেষে করেই মুখ টিপে হাসলো মেয়েটি।

    হাসতে হাসতে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “তুমি আমার লেজও দেখে ফেলেছো?”

    আইনাত ভুরু কুচকে দুষ্টুমিসুলভ অভিব্যক্তি দিলো। “তোমার কি মনে হয় গতরাতে আমি ওটা দেখি নি?” তারপর চোখ নাচিয়ে বললো, “তুমি এমন একটা জানোয়ার যার লেজ সামনের দিকে!”

    হা-হা-হা করে হাসতে গিয়ে থমকে গেলো সে, মুখে আঙুল এনে নিজেকে চুপ করালো।

    “আস্তে!” আইনাত জিভে কামড় দিয়ে বললো।

    “সরি।”

    “ইটস ওকে। এখন আসো, নাস্তা করে নাও।”

    “তার আগে আমাকে বাথরুমে যেতে হবে।”

    “ওকে।“

    বাস্টার্ড বেডরুমের অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে চলে গেলো।

    অধ্যায় ৫৬

    হাবিব চুপচাপ বসে আছে গাড়িতে। তাকে এই গাড়িসহ পঞ্চাশ হাজার রুপি দেয়া হয়েছে গতরাতের শেষের দিকে। মানসুর একটা মাথামোটা ছেলে, টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না। দুনিয়ার সবকিছু টাকা দিয়ে কিনতে চায়, সমাধান করতে চায়।

    বাহেনচোদ্দ, মনে মনে মুচকি হেসে বললো সে। টাকা দিয়ে যে সব কিছু সমাধান করা যায় না সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারে নি এই বেকুব। আরে, তুই তো নিজের বিবিকে কিছু করতে পারলি না এখন পর্যন্ত। দরজা-বন্ধ ঘরে ধর্ষণ করার চেয়ে আর কী পৌরুষ দেখিয়েছিস? তোর বউ পরপুরুষের সাথে নষ্টামি করে বেড়ায়, ডিসকোতে গিয়ে নাচে, মদ খায়। কয়জনের সাথে শোয় তার নেই ঠিক। আর তুই কিনা এমন বিবিকে তালাক না দিয়ে এখনও ঝুলিয়ে রেখেছিস!

    একদলা থুতু ফেললো গাড়ির বাইরে। হোটেল সামুনাবাদের কাছে তার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে এখন। যে দু-জন লোককে সারারাত হোটেলে রেখেছিলো তারা জানিয়েছে ঐ ইবলিশটা এখনও রুমে ফিরে আসে নি। হাবিব জানে, রাতটা হয়তো অন্য কোথাও কাটিয়েছে হারামজাদা কিন্তু সকালের পর ঠিকই ফিরে আসবে। না এসে উপায় আছে?

    এই স্থিরবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও আরেকটি বিকল্প ঠিক করে রেখেছে সে। কিছুটা সময় দেখার পর ওটাই করবে। সামুনাবাদ হোটেলের ম্যানেজারকে দিয়ে ওই কাজটা করাতে বড়জোর পাঁচ হাজার রুপি খসাতে হবে। তারপরও বাকি পয়তাল্লিশ হাজার থেকে যাবে তার পকেটে। ওখান থেকে তিন-চার হাজার দিয়ে দেবে রাতভর পাহারা দেয়া দুই পা-কে। ওরা তাতেই খুশি হবে। যেমন কাজ তেমন পারিশ্রমিক। ওরা তো আর হাবিবের মতো মাথা নিয়ে জন্মায় নি।

    সে ভালো করেই জানে, তওফিক নামের হারামজাদাকে মানসুরের হাতে তুলে দিতে পারলে আরো কিছু নগদ মিলবে। মানসুরের এই নাক ফাঁটানোর কা-ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে সে-ই। ওর মতো মাথামোটা আর দিলখোলা মানুষ না থাকলে হাবিবের মতো বুদ্ধিমানেরা কিভাবে চলতো?

    মুচকি হাসলো সে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। আল্লাহপাক সবকিছু সুন্দর করেই সাজিয়ে দেন। বুদ্ধিমানদের জন্য এক রাস্তা, বোকাদের জন্য অন্য রাস্তা। সবকিছু ঠিকঠাক মতো করতে পারলে দু-জনেই দু-জনের কাছ থেকে লাভবান হতে পারে। আর আল্লাহর দুনিয়াতে যে কেউই খামোখা পয়দা হয় নি সেটা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়।

    “তুমি থাকো…আমি একটু আসছি,” বললো মানসুরের দেয়া ড্রাইভারকে।

    গাড়ি থেকে নেমে গেলো হাবিব। যথেষ্ট সময় গড়িয়েছে। আর বেশি দেরি করলে মানসুর অস্থির হয়ে যাবে। গাধা বলেই ওর ধৈর্য আবার কম। সময় নষ্ট না করে এখন দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করতে হবে।

    বেশ হেলেদুলে ধীরপায়ে হোটেল সামুনাবাদে ঢুকে পড়লো সে।

    *

    আইনাতের সাথে নাস্তা সেরে এক কাপ কফিও খেয়ে নিলো বাস্টার্ড। সঙ্গত কারণেই নাস্তার পরিমাণ ছিলো খুব কম। নীচতলা থেকে মাত্র একজনের নাস্তা নিয়ে এসেছে মেয়েটি। সে এতোটা বোকা নয় যে, দু-জনের জন্য নাস্তা নিয়ে এসে কাজের লোকদের সন্দেহের উদ্রেক করবে। তবে একজনের জন্যে হলেও তারা দু-জন ভালোমতোই খেতে পেরেছে। একেবারে ঐতিহ্যবাহী পাকিস্তানী নাস্তা।

    আটার রুটি পাঠার গোস্ত!

    মনে মনে হাসলো বাস্টার্ড। মোল্লাভায়ের সাথে থাকার সময় এক বিহারী ছেলের সাথে তার খুব বন্ধুত্ব হয়েছিলো, এ কথাটা সে প্রায়ই বলতো।

    আইনাত জামা পাল্টে সালোয়ার-কামিজ পরে নিয়েছে। বেডরুম থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলো। “আমি আগে বের হবো, ঠিক আছে?”

    মন দিয়ে তার কথা শুনে গেলো সে।

    “গাড়িতে ঢুকেই পেছনের ডানদিকের দরজা খুলে রাখবো। তারপর নীচতলার পরিস্থিতি দেখে তোমাকে কল দিয়ে বলে দেবো কখন সিঁড়ি দিয়ে নামবে।”

    মুচকি হেসে বললো সে, “ওকে।”

    তারপরই হুট করেই বাস্টার্ডকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় চুম্বনে ডুবিয়ে দিলো আইনাত।

    মেয়েটার চুম্বনে সাড়া না দিয়ে পারলো না সে। গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে দুদান্তভাবে চুম্বনের সাড়া দিলো। “ওকে,” মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বললো। “আগামীকালের জন্য কিছু রেখে দাও, ডার্লিং।”

    মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত। “তুমি অনেক ভালো। একেবারে স্বপ্নের একজন পুরুষ। আমি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি, তওফিক…বুঝলে?”

    মেয়েটার নাকে টোকা মেরে সে বললো, “আমিও।”

    আবারো আইনাত তাকে জড়িয়ে ধরলো, তবে এবার কোনো চুমু খেলো, শুধুই আলিঙ্গন। “অ্যাকচুয়ালি…আই কান্ট হেল্প ফলিং ইন লাভ উইথ

    ওহ্, মনে মনে আৎকে উঠলো সে। মেয়েটার হৃদয় ভাঙার কোনো ইচ্ছে তার নেই। আইনাতের জন্য তার হৃদয় কিছুটা আর্দ্র হয়ে উঠলো। খুব মায়া হলো তার জন্য।

    ওকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে নিয়ে এলো সে। “আমি গাড়িতে উঠেই তোমাকে কল দিচ্ছি…তুমি এখানেই থেকো, ঠিক আছে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

    অধ্যায় ৫৭

    সামুনাবাদ হোটেলের ম্যানেজার লোকটি দেখতে নিরীহগোছের হলেও আদতে মহাধরিবাজ। টাকার গন্ধ পেয়ে গেছে সে। বুঝে গেছে সামান্য কাজের জন্য যারা হাজার রুপি দিতে পারে এরকম বড় কাজের জন্য নিশ্চয় একটু বেশিই দেবে।

    হাবিব তাকে প্রস্তাবটা দেয়ামাত্রই কাচুমাচু খেতে লাগলো, নানান নিয়ম কানুন আর অজুহাত দেখাতে শুরু করলো সে। কতো নিয়মে যে দুনিয়া চলে! হোটেলের নিয়ম। রাষ্ট্রের নিয়ম। আরে শালা, এতো নিয়মে দুনিয়া চললে অনিয়মগুলো হয় কোত্থেকে! তাছাড়া নিয়ম তো আকাশ থেকে পড়ে না, মানুষই বানায়, আবার মানুষই ভাঙে, বদলে ফেলে। তুই ব্যাটা পাঁচহাজার রুপি পকেটে ঢুকিয়ে নিয়মটা একটু স্থগিত করে রাখ না, সমস্যা কোথায়? যে লোকের প্রাইভেসি নিয়ে এতো সবক দিচ্ছিস সে আর তোর হোটেলে ফিরে আসবে না। এ-ব্যাপারে গ্যারান্টি দেয়া যায়।

    সে নিছকই একজন ম্যানেজার, মালিক জানতে পারলে সমস্যা হবে না?

    হাবিব বুঝতে পারে লোকটা আসলে না-বুঝের মতো কথা বলছে অন্য উদ্দেশ্যে। তার রেট বাড়াতে হবে। ঠিক আছে, ছয়?

    চাকরি হারানোর ঝুঁকিটাও কিন্তু বিবেচনায় নেয়া উচিত।

    বাপরে! হারামজাদা তো দেখি কঠিন মাল! ওকে, সাত?

    পুরো দশ হলে ভালো হতো না? তাকে তো অনেক কাঠখরও পোড়াতে। হবে। আরো কয়েকজন স্টাফের মুখ বন্ধ রাখার জন্যও কিছু খরচা করতে হবে। তাছাড়া হোটেল মালিককে একদিনের পাওনা তিনহাজার রুপিও তো। দিতে হবে, নাকি?

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবশেষে হাবিব রাজি হয়ে গেছে। এই বাহেনচোদ্দ তার সাথে মাছের বাজারের মতো দরদাম শুরু করে দিয়েছে। এর সাথে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

    তবে দশ হাজার রুপি নিলেও লোকটার কাজের ধরণ দেখে প্রশংসা করতেই হলো। এই বুদ্ধি নিয়ে সে সামুনাবাদে পড়ে আছে কেন? করাচিতে কতো বড় বড় হোটেল আছে। ক্লিফটন বিচের কাছকাছি ফাইভস্টার হোটেলই হলো তার যোগ্য জায়গা।

    তওফিক আহমেদ নামের লোকটা সামুনাবাদ ছেড়ে চলে গেছে গতকাল রাতেই! তার কাছে হোটেলের কোনো পাওনা নেই। বিল ক্লিয়ার। রুম খালি। ঠিক আছে?

    ম্যানেজারের দাঁত না দেখিয়ে চওড়া হাসিটা মনে রাখার মতোই ছিলো।

    হাবিব খান এখন তওফিক আহমেদের একমাত্র লাগেজটি নিয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছে। সিটের পাশে রাখা লাগেজের দিকে তাকালো। এটা মানসুরের হাতে তুলে দেবার সময় আরো কিছু টাকা খসানো যাবে কিনা ভেবে দেখলো সে।

    না, থাক। যথেষ্ট হয়েছে। বাড়াবাড়ি করার ফল ভালো হয় না। সীমার মধ্যে থাকাটা আল্লাহ তা-আলা-ও পছন্দ করেন। ইলাস্টিকও বেশি টানলে ছিঁড়ে যায়।

    পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো। লাগেজটা খুলেও দেখে নি। নিশ্চিত করেই জানে অন্য অনেক কিছুর সাথে এর ভেতরে বেশ ভালো পরিমাণের টাকা-পয়সা আছে। তারপরও মানসুর রাওয়ালা নিজের হাতে এ জিনিস খুলে দেখলেই ভালো হবে। এতো টাকা খরচ করেছে বেচারা, এইটুকু করার অধিকার নিশ্চয়ই তার আছে।

    *

    আইনাতের গাড়িতে উঠে বসতে তেমন কোনো সমস্যাই হলো না।

    মেয়েটা খুব স্মার্ট। গাড়িতে উঠে তাকে ফোনে জানায় নীচতলা থেকে কেউ বের হয়ে আসছে না। আর মেইনগেটের দারোয়ান দুজনকে নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই। ডানদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লে ওখান থেকে তাকে দেখা যাবে না। তাই হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে সে।

    এখন সিটের উপরে শুয়ে আছে। ইগনিশানে চাবি ঘোরালো আইনাত কিন্তু ইঞ্জিনটা স্টার্ট নিয়েও বন্ধ হয়ে গেলো। আবারও চাবি ঘোরালো সে। একই ফল।

    “শিট!”

    মেয়েটার বিরক্তি শুনতে পেলো পেছনের সিট থেকে। অভয় দিয়ে বললো, “ইজি, ইজি…আরেকবার ট্রাই করো।”

    আইনাত আবারো চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল একই। এবার বাস্টার্ড নিজেও মনে মনে প্রমাদ গুণলো। দরকারের সময় কেন যে গাড়িগুলোর ইঞ্জিন স্টার্ট নেয় না সেটা এক রহস্যই। এরকম অভিজ্ঞতা তারও আছে।

    “ফাক!” আইনাত তার প্রিয় স্ন্যাংটা ব্যবহার না করে পারলো না।

    “টেক ইট ইজি…গভীর করে দম নিয়ে আস্তে করে স্টার্ট নাও, ওকে?”

    “হোয়াট দ্য হেল ইউ আর টকিং!!” বিরক্ত হয়ে বললো মেয়েটি। “ইগনিশানের সাথে গভীর করে দম নেবার কী সম্পর্ক? আজব!”

    “যা বলছি তাই করো, ডার্লিং। কী সম্পর্ক সেটা আমি তোমাকে পরে বলবো…আগে এই বাড়ি থেকে বের হও।”

    “ওকে ওকে!”

    পেছনের সিটে শুয়ে থেকেই সে শুনতে পেলো মেয়েটা গভীর করে দম নিয়ে ইগনিশানে চাবি ঘোরালো। তাদের দুজনকে স্বস্তি দিয়ে ইঞ্জিনটা শব্দ করে চালু হয়ে গেলো এবার।

    “থ্যাঙ্কস গড!” বলে উঠলো আইনাত।

    থ্যাঙ্কস গড, মনে মনে সেও বলে উঠলো।

    কিন্তু গাড়িটা ব্যাক-গিয়ারে মাত্র একহাত পিছিয়েছে অমনি একটা

    পুরুষকণ্ঠ শোনা গেলো।

    “আইনাত?”

    যেমন কর্কশ তেমনি কর্তৃত্বপরায়ন। সঙ্গে সঙ্গে ব্রেকে পা দিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিলো মেয়েটি।

    “কে?” আতঙ্কের সাথে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো বাস্টার্ড।

    “মাই গড!” আৎকে উঠলো মওলানার মেয়ে। “ইয়াকুব!” রিয়ার-মিররে তাকিয়ে দেখলো তার সভাই ইয়াকুব হোসাইনী এগিয়ে আসছে গাড়ির দিকে। বোঝাই যাচ্ছে, এইমাত্র সে বড়বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে। “তুমি শুয়ে থাকো…আমি দেখছি,” ফিসফিসিয়ে বলেই তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে গেলো সে।

    বাস্টার্ড বুঝতে পারলো মেয়েটা দারুণ স্মার্ট। সে যদি গাড়িতে বসে থাকতো তাহলে তার ভাই ড্রাইভিং ডোরের কাছে চলে আসতো, আর সেখানে আসামাত্রই দেখতে পেতো পেছনের সিটে একজন শুয়ে আছে। এই গাড়ির কাঁচ একদম স্বচ্ছ।

    “কি হয়েছে?”

    সে শুনতে পেলো একদম খাঁটি উর্দুতে বলে উঠলো আইনাত।

    “গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?” জেরা করার ভঙ্গিতে বললো ইয়াকুব।

    “আমি কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে?” ঝাঁঝের সাথে পাল্টা বললো মওলানার মেয়ে।

    “বেয়াদ্দপ! বেলাহাজ?” উর্দুতে চেঁচিয়ে উঠলো ইয়াকুব হোসাইনী। “দিন দিন তোমার সাহস বেড়ে যাচ্ছে। কাউকে তোয়াক্কা করো না। যখন খুশি বের হও, বেরিয়ে যাও…পেয়েছেটা কি? আব্বা না তোমাকে বলেছে গাড়ি না চালাতে?”।

    মুখ ঝামটা দিলো আইনাত। রাগে তার গা রি রি করছে।

    “এটা লন্ডন নয়, পাকিস্তান…বুঝলে? আর তুমি কোনো বেদ্বীনের বেটি নও…একজন সম্ভ্রান্ত পরহেজগার মাওলানার বেটি…কথাটা মনে থাকে না কেন?”

    “আমাকে লেকচার দেবে না। তোমার এইসব ফালতু কথা শোনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।”

    “তা হবে কেন? বড়দের কথা শোনার খাসলত তো তোমার না। লন্ডনে পড়াশোনা করতে পাঠানোটাই বিরাট ভুল হয়ে গেছে।”

    “ভুল তো করেছো তোমরা! তোমাদের কথা শুনে আমি আমার জীবনটাই নষ্ট করেছি।

    রাগে ফুঁসে উঠলো ইয়াকুব, বাস্টার্ড সেটা না দেখলেও টের পেলো।

    “আর শুনছি না! বুঝলে?”

    “জাহান্নামে যাও তুমি…তোমার সাথে কথা বলাটাই উচিত হয় নি আমার।”

    “ঠিক বলেছো!” চেঁচিয়ে উঠলো আইনাত। “আমার সাথে কথা বলতে এসো না। আমি তোমাদের কাউকে পরোয়া করি না। বুলশিট!”

    তারপর কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। বাস্টার্ড বুঝতে পারলো ইয়াকুব নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করছে।

    “তুমি যেখানে খুশি সেখানে যাও…জাহান্নামে যাও…আমিও পরোয়া করি …কিন্তু গাড়ি নিয়ে বের হতে পারবে না।”

    সর্বনাশ! আৎকে উঠলো বাস্টার্ড।

    “কি!” আইনাত যেনো আকাশ থেকে পড়লো।

    “এই গাড়িটা আমার লাগবে। তুমি বাইরে গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে নাও।”

    “আজব!”

    না দেখেও আইনাতের অসহায়ত্ব টের পাচ্ছে সে। তার অবস্থাও মেয়েটার মতোই। এ কোন্ বিপদে পড়লো!

    “আমাকে গাড়ির চাবি দাও!” আদেশের সুরে বললো মওলানার ছেলে।

    “এ-এটা তো…তোমার গাড়ি না…আব্বার।”

    “হ্যাঁ, জানি। আব্বার কাজেই গাড়িটা নিচ্ছি।”

    “আশ্চর্য!”

    “আরে, কানে কথা যায় না দেখি!”

    তারপরই আইনাতের মৃদু আর্তনাদ। “অ্যাই! অ্যাই…কি করছো?”

    বাস্টার্ড দেখতে পেলো না ইয়াকুব তার সৎবোনের হাত থেকে গাড়ির চাবিটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়েছে।

    “চাবিটা আমাকে দাও! দাও বলছি!”

    কিন্তু আইনাতের কণ্ঠটা শুনতেই বুঝতে পারলো কি ঘটে গেছে। মাই গড!

    অধ্যায় ৫৮

    নাকের ব্যান্ডেজের কারণে মানসুরকে দেখে সার্কাসের ক্লাউন মনে হচ্ছে। হাবিবের। দশাসই এই লোক তার থেকে হালকা-পাতলা গড়ন আর কম উচ্চতার এক বিদেশীর কাছে কি মারটাই না খেয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঐ লোক বিদ্যুৎগতিতে কাবু করে ফেলেছে গর্দভটাকে।

    “লাগেজের চাবি কোথায়?”

    “চাবি তো ঐ লোকের কাছে, ভাই।”

    “তাহলে এটা কিভাবে খুলবো?”

    আগে তোর দিমাগের তালা খোল, বাহেনচোদ্দ! মানসুরের প্রশ্নটা শুনে মনে মনে বললো হাবিব। “ভাই, লাগেজটা তো আপনি ব্যবহার করবেন না…এটা নিয়ে এতো ভাবাভাবির কি আছে? তালা ভেঙে ফেলুন।”

    “ও,” এবার যেনো তার আক্কেল হলো। লাগেজের ঢাকনাটা দু-হাতে ধরে হুউউম্’ বলে জোরে টান দিলো, ফাঁক করার চেষ্টা করলো সে।

    তুমি শুধু এটাই পারো, বেলেগ! শব্দটা শুনে হাবিবের অন্য কিছুর কথা মনে পড়ে গেলো তার। ন্যাপিয়ের রোডের মুজরাওয়ালির ঘরে ঢোকার পর মানসুরের মুখ থেকে এমন আওয়াজ সে বহুত শুনেছে। মুখ টিপে হেসে ফেললো হাবিব।

    দু-তিনবার হুউউম করার পরই সফল হলো মানসুর। কটকট শব্দ করে খুলে গেলো লাগেজটা। ভেতর থেকে কাপড়চোপড় বেরিয়ে এলো, সেইসাথে একটা হ্যান্ডব্যাগ। মানসুর হ্যান্ডব্যাগটা খুলে দেখলো সবার আগে। একে একে বের করে আনলো ডলার আর রুপির বান্ডিল, প্লেনের ফিরতি টিকেট একটা মোবাইলফোন, আর কিছু কাগজপত্র।

    “বলেছিলাম না, লোকটা সব কিছু রুমে রেখে গেছে,” আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললো হাবিব খান। “হারামিটার সবকিছু এখন আপনার হাতের ভাই।”

    মুচকি হাসি দিলো রাঙ্গুওয়ালা কিন্তু কাগজপত্রের মধ্যে একটা সবুজ রঙের পাসপোর্ট খুঁজে পেয়ে তার সেই হাসি উবে গেলো মুহূর্তে। “হাবিব, শূয়োরের বাচ্চা তো দেখি একটা গাদ্দার?”

    সামনের দিকে ঝুঁকে এলো মানসুরের সহচর। “দেখি?”

    পাসপোর্টটা তার হাতে তুলে দিলো সে।

    “হায় খোদা! ইয়াসিন বলেছিলো এই লোক লন্ডন থেকে এসেছে…নাম তওফিক, আহমেদ…কিন্তু এ তো দেখি মাশরেকি-পাকিস্তানের!” ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করে ফেললো সে, “মানে বাংলাদেশ থেকে এসেছে! হারামখোর গাদ্দার!”

    মানসুর কাগজপত্রের দিকে মনোযোগ দিলো।

    “অবশ্য নামটা ঠিকই বলেছে ইয়াসিন,” বিড়বিড় করে বললো হাবিব। “মনে হয় গাদ্দারটাই ইয়াসিনকে লন্ডনের কথা বলেছে। ইয়াসিন সত্যিটা জানলে অবশ্যই আমাকে বলতো।” তবে হাবিব বুঝতে পারলো সামুনাবাদের ম্যানেজার ইচ্ছে করেই এই তথ্যটা লুকিয়ে গেছে। লোকটা ঐ কিসিমের আদমি যাদেরকে জিজ্ঞেস না করলে নিজে থেকে টু শব্দটিও বের করে না।

    আইনাতের স্বামী একটা ছোট্ট কাগজ তুলে ধরলো। “দেখো এটা!”

    হাবিব ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “এটা তো আপনার শ্বশুড়ের বিজনেস কার্ড!”

    “হুম…কিন্তু এটা ওর কাছে গেলো কিভাবে?”

    থুতনিতে হাত বোলালো হাবিব খান। “বাকি কাগজগুলো দেখি?”

    মানসুর তার হাতে কাগজগুলো তুলে দিয়ে ডলার আর রুপিগুলোর দিকে মনোযোগ দিলো। অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়েও আর কিছু পেলো না সে।

    “ভাই, লাগেজটা আমি চেক করে দেখি?”

    হাবিবের দিকে তাকালো মানসুর। “আরে, এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি, আজব কথা বললে তো!”

    সঙ্গে সঙ্গে লাগেজের মধ্যে থাকা কাপড়-চোপড়গুলো সরিয়ে একটা জিনিস বের করে আনলো হাবিব খান। “দেখেন, ভাই?”

    ডলার আর রুপির বান্ডিল থেকে মুখ তুলে তাকালো মানসুর। “এটা কি?”

    হাবিব এই জিনিসটা দেখেই চিনতে পেরেছে। মানসুর যখন তার বিবির উপরে নজরদারি করার ভার দিলো তখন সে করাচির এক স্পাই-গেজেটের দোকানে গিয়ে এরকম একটা জিনিস কিনতে চেয়েছিলো, কিন্তু পরে ভেবে দেখলো, এইসব আধুনিক যন্ত্রপাতির খোঁজ পেলে গাধাটার কাছে তার মাহাত্ম কমে যাবে। সে যে অসাধ্য সাধন করতে পারে সেই বিশ্বাস আর থাকবে না। ভাববে, সবই যন্ত্রপাতির কাজকারবার। তাই অনেক ভেবে জিনিসটা আর কেনে নি। কী দরকার। মানসুরের বিবিকে তালাশ করার জন্য, পেছনে লেগে থাকার জন্য দুয়েকটা দিন নজরদারি করাই যথেষ্ট। এরজন্য কয়েক হাজার রুপি দিয়ে জিপিএস ট্র্যাকার কিনে কোনো ফায়দা নেই। এটা যদি কিনতে হয় তাহলে নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হবে। মানসুরকে তো আর বলা যাবে না, পাঁচ হাজার রুপি দিয়ে একটা যন্ত্র কিনতে হয়েছে।

    “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…এটা কি?”

    মানসুরের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো হাবিব। “এটা মোবাইলফোনের মতো একটা যন্ত্র।”

    “ও,” যেনো বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করলো রাজুওয়ালাদের কুলাঙ্গারটা। “আজব কিসিমের সব মোবাইলফোন বের হচ্ছে আজকাল।”

    হাবিব কিছু না বলে ডিভাইসটি চালু করে দিয়ে উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইলো ডিসপ্লের দিকে কিন্তু মানসুরের নজর ডলার আর রুপিতে। রীতিমতো গুণতে

    শুরু করে দিয়েছে সে।

    “ভাই, আপনার শ্বশুড়বাড়ি গুলজার-এ-হিজরিতে না?” হাবিব খান জিজ্ঞেস করলো।

    “হ্যা…কেন?” ডলারের নোটগুলো গুণতে গুণতে জবাব দিলো মানসুর।

    “এই লোক তো আপনার বিবির পেছনে লাগে নি…আপনার শ্বশুড়ের পেছনে লেগেছে, ভাই!”

    অধ্যায় ৫৯

    “আই অ্যাম ফিনিশড!”

    অস্কুটস্বরে বলে উঠলো আইনাত। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভওয়ের উপর। ইয়াকুবকে সে কোনোভাবেই থামাতে পারে নি। তার কাছ থেকে চাবিটা রীতিমতো কেড়ে নেয়া হয়েছে, তারপর শাসানোর মতো করে বলেছে, সে যেনো এ নিয়ে চিল্লাফাল্লা না করে। আব্বার কাজে গাড়িটা দরকার। এ নিয়ে যদি বেশি কিছু বলার থাকে তাহলে যেনো তার আব্বার কাছে গিয়ে নালিশ করে। তারপরও একটা চেষ্টা করেছিলো ভাইকে থামাতে। বলেছিলো মাত্র দশ-পনেরো মিনিটের জন্য গাড়িটা দিতে। এই তো কাছেই, এক ব্লক দূরে যাবে পিজ্জাহাটে। একটু পরই ফিরে আসবে সে। ইয়াকুব এ কথা শুনে অবাক হয়ে বলেছে, এখান থেকে পিজ্জাহাট খুবই কাছে, সে হেঁটে যাচ্ছে না কেন? ওদের হোমডেলিভারির সার্ভিস আছে। চাইলে ঘরে বসেই অর্ডার দিতে পারে।

    মোক্ষম প্রশ্ন।

    আইনাত আরেকটা অজুহাত দাঁড় করানোর আগেই তার ভাই গটগট করে চলে গেলো গাড়ির দিকে। পেছন পেছন ছুটে গিয়ে যে কিছু বলবে সেই ক্ষমতা আর রইলো না। ভয়ে-আতঙ্কে বরফের মতো জমে গেলো সে।

    এখন দেখতে পাচ্ছে ইয়াকুব বাঁকাহাসি হাসতে হাসতে গাড়ির ড্রাইভিং ডোরটায় হাত রাখলো। আইনাতের মনে হলো তার মাথাটা বুঝি চক্কর দিয়ে উঠেছে। সম্ভবত হৃদস্পন্দন থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।

    ইয়াকুব গাড়ির ভেতরে ঢুকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ব্যাক-গিয়ারে তার কাছে চলে এলে ড্রাইভওয়ে থেকে সরে লনের উপরে দাঁড়াতে বাধ্য হলো সে। হতভম্ব হয়ে সে অপেক্ষা করছে কখন তওফিককে আবিষ্কার করে তার সৎভাইটি।

    ঠিক তার সামনে আসতেই ঘ্যাচ করে ব্রেক করলো ইয়াকুব। হতবুদ্ধিকর বোনের দিকে তাকিয়ে বাঁকাহাসি হাসলে সে, তারপরই একটা ভ্যানিটি ব্যাগ ছুঁড়ে মারলে আইনাতের দিকে।

    “শালার মেয়েমানুষের জাতটাই হারামি!” বলেই দ্রুত মেইনগেটের কাছে চলে গেলো।

    গাড়িটা বের হতে দেখে গেটটা আগেভাগেই খুলে রেখেছিলো দারোয়ান। পেছন ফিরে দেখে নিয়ে আবারো ব্যাক-গিয়ারে গাড়িটা চালিয়ে বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

    ভ্যানিটি ব্যাগটা মাটি থেকে তুলে দু-হাতে ধরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আইনাত।

    “আপনি কি বের হবেন?” দারোয়ান গেট লাগানোর আগে জিজ্ঞেস করলো তাকে।

    মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো সে। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেলো নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। ভালো করেই জানে, একটু পরই কেলেংকারিটা চাউর হবে। ইয়াকুব তার এরকম একটি দুর্বলতা পেলে কী যে করবে খোদা মালুম! তার বাবাও নিশ্চয় কম করবে না। বকা-ঝকা এমনকি গায়ে হাত তোলার মধ্যেও যদি এটা শেষ হয় তাহলে ভাগ্যই বলতে হবে, কিন্তু সে জানে তার বেলায় সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটাই ঘটবে। ঐ নরপশুটার কাছে তুল দেবে তার বাপ-ভাই! কোনো আকুতি-মিনতিতেও কাজ হবে না। তোমাকে তোমার মতো থাকতে দেয়া হয়েছিলো তুমি সেই সুযোগটা জঘন্যভাবে নষ্ট করেছে। এক পরপুরুষকে নিজের ঘরে লুকিয়ে এনেছে। তার সাথে রাত কাটিয়েছো। ছি ছি! এটা তো জেনা! কবিরা গুনাহ্!

    অনেকটা যন্ত্রের মতো হাঁটতে হাঁটতে ছোটোবাড়িটার সিঁড়ির কাছে চলে এলো সে। স্বামী ছেড়ে থাকাটা মেয়েদের জন্য খুব খারাপ কাজ-তার বাবার এ কথাটা এখন শক্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মানসুরের জাহান্নামে ঠাঁই হবে তার। আবারো সেই নান্নতের জীবন। ধর্ষণ হয়ে উঠবে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঝগড়া, গালাগালি, গায়ে হাততোলা। অসহ্য!

    এসব ভাবতেই আইনাতের কান্না চলে এলো, আর ঠিক তখনই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে, তার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তওফিক!

    *

    একেবারে শেষ সময়ে উপস্থিত বুদ্ধির কারণে সে আজ ধরা খায় নি। বলতে গেলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিলো ওটা। আরেকটু দেরি করলেই সর্বনাশ হয়ে যেতো। করাচি মিশনটা তো ভেস্তে যেতোই, নিজের জীবন নিয়েও ফিরে যেতে পারতো কিনা সন্দেহ। তার সাথে সাথে আইনাতও ভীষণ বিপদে পড়ে যেতো।

    গাড়ির পেছনে সিটে শুয়ে থেকে যখন সে বুঝতে পারলো আইনাতের কাছে গাড়িটা চাইছে তখনই সে বুঝে যায় ঘটনা কোনদিকে যাচ্ছে। মেয়েটা যে তার সৎভাইকে বিমুখ করতে পারবে না তা বোঝা গেছে লোকটার চাছাছোলা কথাবার্তায়। কর্তৃত্বপরায়ণ কণ্ঠে সে গাড়ির চাবি চেয়েছিলো ছোটো বোনের কাছ থেকে। এরকম লোকজনকে বিমুখ করা যায় না। তারা যা চাইবে তা-ই দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে।

    গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে থাকলে যে ধরা খেতে হবে তা ছিলো একদম নিশ্চিত। যতোদ্রুত সম্ভব তাকে বের হতে হবে-এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই শুনতে পায় আইনাত তার ভায়ের সাথে বাদানুবাদ করছে। এরফলে বের হয়ে যাবার জন্য কিছুটা সময় পায় সে।

    প্রথমে মাথাটা একটু তুলে রিয়ার-মিরর দিয়ে দেখে নেয় আইনাতের ভায়ের অবস্থান। বুঝতে পারে শব্দ না করে দ্রুত বের হয়ে গেলে তাকে দেখতে পাবে না। তাই যেভাবে ঢুকেছিলো সেভাবেই গাড়ির ডানদিকের দরজাটা খুলে নীচু হয়ে নেমে যায়, তারপর চট করে ঢুকে পড়ে ছোটোবাড়ির সদর-দরজা দিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে বুঝে যায় আইনাতের ভাই ইয়াকুব গাড়ির কাছে চলে এসেছে। এক পদক্ষেপে তিন-চারটা সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলার ল্যান্ডিংয়ে উঠে অপেক্ষা করতে থাকে। গাড়িটা মেইনগেট দিয়ে বের হয়ে যাবার শব্দ শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।

    অনেকটা পেন্ডুলামের মতো সৌভাগ্য আর দুর্বিপাকের দোলাচালে দুলছে তার সময়। শেষ পর্যন্ত কোটা তাকে আলিঙ্গন করে কোন্ ধরণের পরিণতি দান করবে সে জানে না। তবে সব সমস্যার যেমন ভিন্ন একটা দিক থাকে আজকের এই ঘটনাটিও তেমনি অন্য একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ওইটুকু সময়ে দাঁড়িয়ে থেকেই সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। শুধু সিদ্ধান্ত বললে ভুল বলা হবে, সত্যি বলতে একটা পরিকল্পনাও করে ফেলেছে চট জলদি। সম্ভবত তার করাচি মিশনটির সফলতা এই পরিকল্পনার উপরেই নির্ভর করছে এখন।

    আইনাতের দিকে তাকালো সে। মেয়েটা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে পুরো ঘটনাটি।

    “তুমি যে আমাকে কতো বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে বোঝাতে পারবো না। থ্যাঙ্কস অ্যা লট, তওফিক।”

    তারা এখন বসে আছে আইনাতের বেডরুমে।

    “তোমাকেও থ্যাঙ্কস…তুমি যদি ইয়াকুবের সাথে কিছুক্ষণ তর্ক না করতে তাহলে আমি বের হবার সময়ই পেতাম না।”

    “যাহোক, এখন তো তুমি দেখলেই পরিস্থিতিটা…তোমাকে কিভাবে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে পারবো বুঝতে পারছি না। মানে, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”

    মুচকি হাসি দিলো বাস্টার্ড। এ নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবলে একটা না একটা উপায় বের করা যাবে।”

    “তোমার হোটেল? ওখানে আজকের মধ্যে ফিরে না গেলে সমস্যা হবে না? তোমার সবকিছু তো ওখানেই?”

    “আমি অ্যাডভান্স বুকিং দিয়ে রেখেছি। আরো তিনদিন রুমটা আমারই থাকবে।”

    “উফ!” হাফ ছেড়ে বাঁচললা মেয়েটি। “বাঁচালে। আমি তো ভাবছিলাম তুমি এজন্যেই বের হবার জন্য অস্থির হয়ে আছে।”

    আইনাতের দিকে তাকয়ে দুষ্টুমির হাসি দিলো সে। “একটা সত্যি কথা বলবো?”

    “কি?”

    “এখানে আরো একটা দিন যদি থেকে যেতে হয় তাহলে দারুণই হবে। ব্যাপারটা।”

    বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো মেয়েটি। “সত্যি?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

    “মাই গড!” বলেই তাকে জড়িয়ে ধরলো সে। “আই জাস্ট লাভ ইট!” তারপরই চোখেমুখে চুমু খেতে শুরু করলো।

    “ওগুলো সারাদিনের জন্য বাঁচিয়ে রাখো…” মেয়েটার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো সে। “এখন সত্যি করে একটা কথা বললো,

    আমি যদি আরেকটা দিন থাকি তাহলে কি সমস্যা হতে পারে?”

    একটু ভাবলো আইনাত। “তুমি যদি এই ফ্ল্যাটের বাইরে না যাও…আমার জেলখানায় বন্দী থাকো তাহলে কোনো সমস্যাই হবে না। একটুও না।”

    “এরকম জেলখানায় একদিন কেন, অনেকদিন বন্দী থাকতে রাজি আছি।”

    “নটি বয়!” উঠে দাঁড়ালো আইনাত। “তাহলে আমরা সারাদিন অনেক মাস্তি করছি, ওকে?”

    “ওকে।”

    “আর বাড়ি থেকে বের হওয়া নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা কোরো না। আগামীকাল যে-করেই হোক আব্বার ঐ গাড়িটা আমি কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ম্যানেজ করে নিতে পারবো।”

    “আমি জানি তুমি এটা করতে পারবে।”

    “অ্যাই, শোনো?” একেবারে আত্নাদি কণ্ঠে বললো আইনাত।

    “কি?”

    “আমরা আজকের দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখবো, ওকে?”

    ভুরু কপালে তুললো সে। “মনে হচ্ছে এ নিয়ে তোমার মাথায় দারুণ কোনো পরিকল্পনা আছে?”

    “অবশ্যই।” বলেই তার গলা জড়িয়ে ধরলো মেয়েটি। “এখন একটা কুইকি হয়ে যাক…কি বলো?”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেক্সট (বেগ-বাস্টার্ড – ৬) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }