Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করাচি (বেগ-বাস্টার্ড ৫) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প368 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৬০. অদ্ভুত আর কঠিন কিছু কাজ

    অধ্যায় ৬০

    জীবনে কতো রকম কাজই তো করেছে জাভেদ ওয়ার্সি, তার মধ্যে অদ্ভুত আর কঠিন কিছু কাজও আছে। সেগুলো অবশ্য নেতার নির্দেশে করেছে, কিন্তু পিৎজা ডেলিভারি দেবার কাজ এই প্রথম। তাও আবার যে-ই সে-ই নয়, একটা স্পেশাল ডেলিভারি!

    সত্যি বলতে, এর আগে পিজা নামের ফালতু খাবারটা মাত্র একবারই খেয়ে দেখেছে সে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপেলে আর টাকাওয়ালাদের ছেলেপেলেদের কাছে এই জিনিসটা বেশ লোভনীয় বলে তারও খেয়ে দেখার ইচ্ছে জেগেছিলো একদিন।

    করাচিতে অনেকগুলো পিৎজাহাট আছে, ওগুলো সব সময়ই কাস্টমারে উপচে পড়ে। সেইসব কাস্টমারদের দেখলে মনে হবে তারা বুঝি দুনিয়ার সবচাইতে সুস্বাদু খাবারটি খেতে এসেছে। কিন্তু প্রথমবার পিঞ্জা খেয়ে তার যে অনুভূতি হয়েছিলো সেটা এখনও মনে আছে : এই জিনিস খাওয়ার জন্য এতো পেরেসান কেন মানুষ! মোটা তার রুটির উপরে কিছু তরকারি-ভাজি সাজিয়ে দিলেই হলো! ধুর! এতো দাম দিয়ে কেউ এই জিনিস খায়! এরচেয়ে করাচির রাস্তায় যেসব খাবার পাওয়া যায় তা অনেক ভালো।

    যাহোক, আজকে অবশ্য জাভেদ নিজের জন্যে পিৎজা কেনে নি। সে কেবলই ডেলিভারি-ম্যান। গাড়ি চালাতে চালাতে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। এটা তো পিজ্জা নয়, মৃত্যুর পয়গাম!

    তওফিকভাই তাকে ফোন করে প্রথমেই জানতে চেয়েছে এই কাজটা সে করতে পারবে কিনা। জাভেদ সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছে পারবে। তারপর ফোনেই বলে দিয়েছে কি কি কিনতে হবে, কিভাবে সব ব্যবস্থা করতে হবে। যেনো এরকম কাজ অনেকবার অনেককে দিয়ে করিয়েছে লোকটা।

    পাশের সিটের উপরে রাখা একটু আগে কেনা লাল টকটকে সানক্যাপটা মাথায় পরে নিলো। এই অল্প সময়ে তাকে অনেক কিছু করতে হয়েছে, লাল ক্যাপটি তার মধ্যে একটি। পিৎজা হাটের ডেলিভারি-ম্যানদের আদলে পোশাক জোগাড় করাটা একদিক থেকে খুব সহজ ছিলো। তওফিক আহমেদ তাকে বলেছে, টি-শার্টে পিৎজাহাটের লোগোসহ কোনো ড্রেস সে পাবে না মার্কেটে। তবে এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, গেটের দারোয়ান অতকিছু খেয়ালও করবে না।

    কড়া পাওয়ারের ঘুমের ওষুধটা জাভেদ কিনেছে পুরনো করাচির এক পরিচিত দোকান থেকে। তার শেষ কাজটা ছিলো পিজা কেনা।

    গুলজার-এ-হিজরি’তে তার গাড়িটা ঢুকতেই বেশিদূর এগোলো না। রাস্তার পাশে সুবিধাজনক একটি জায়গায় গাড়ি রেখে পিৎজার বড় প্যাকেটটা নিয়ে হাটা শুরু করলো। তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ি। জায়গাটা তার মুখস্ত। পর পর কয়েকদিন সে এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরক্তিকর সময় পার করেছে। তখন এক পর্যায়ে তার মনে হয়েছিলো তওফিক নামের লোকটা খামোখাই সময় নষ্ট করছে। কিন্তু লোকটাকে দেখে যতোটুকু বোঝা যায় বাস্তবে সে অনেক অনেক গভীর জলের মাছ! তওফিকভাই কিভাবে ঐ বাড়িতে ঢুকে পড়লো সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। ইয়াসিনের বেঈমানির পর সে ভেবেছিলো লোকটা করাচি ছেড়ে পালাবে, তার সাথে আর যোগাযোগ করবে না। কিন্তু দু-ঘণ্টা আগে তাকে ফোন করে যখন এই ডেলিভারিটা দিতে বললো তখন বুঝতে পারলো ইয়াসিনের কারণে তাকে অবিশ্বাস করে নি সামাদ ভায়ের লোকটি। সত্যি বলতে তওফিকভায়ের কাছ থেকে ফোনটা পেয়ে তার ভালোই লেগেছে। কেউ যদি তাকে বিশ্বাস করে তাহলে অন্যরকম এক ভালোলাগা তৈরি হয় তার মধ্যে। ছোটোবেলা থেকেই সে খুব বিশ্বস্ত। কাউকে কখনও পিঠ দেখায় নি, আর এজন্যেই তার নেতার মতো ক্ষমতাবান মানুষ তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।

    দুই নাম্বার বাড়িটার সামনে এসে গভীর করে দম নিয়ে নিলো। গেটের পাশে কলিংবেলের কোনো সুইচ নেই। বুঝতে পারলো হাত দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করতে হবে কিন্তু সেটা করার আগেই মেইনগেটের ছোট্ট একটি খোপ খুলে গেলো। একজোড়া চোখ ভালো করে দেখে নিলো তাকে।

    “কি চাই?” বললো গেটের ওপাশ থেকে।

    “আমি পিৎজাহাট থেকে এসেছি। আইনাত হোসাইনীর একটা হোম ডেলিভারি আছে।”

    খোপটা বন্ধ হয়ে গেলো। পাশের ছোটো গেটটা খোলার শব্দ শুনতে পেলো জাভেদ। সে জানে মেইনগেটে তাকে তেমন কিছুই করতে হবে না, তওফিক আহমেদ সেরকমই বলেছে।

    গেট খুলে যেতেই দারোয়ানকে দেখতে পেলো। তার পাশে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি।

    দারোয়ান পিৎজার প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তাকে পাঁচ শ রুপির একটা নোট দিয়ে দিলো। টাকাটা পকেটে নিয়ে আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো সে।

    তওফিক আহমেদ তাকে ঠিক এমনটাই করতে বলেছে। এর একটু বেশিও নয়, কমও নয়। কাজটা ভালোমতো করতে পেরে স্বস্তি পেলো জাভেদ। ইয়াসিন যে ক্ষতি করেছে তার কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেয়া গেলো।

    অধ্যায় ৬১

    একটু আগে জানালা দিয়ে মেইনগেটের দৃশ্যটা দেখেছে। সে যেভাবে বলেছিলো জাভেদ ছেলেটা ঠিক সেভাবেই কাজ করেছে। পিৎজার টাকা পরিশোধ করে প্যাকেটটা বুঝে নিয়েছে দারোয়ান। নতুন যে লোকটা দারোয়ানের সাথে গেট পাহারা দিচ্ছে সে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করে নি। মওলানার মেয়ে পিৎজা খেতে চেয়েছে। কিছুক্ষণ আগে কাজের লোককে দিয়ে পাঁচ শ’ টাকা পাঠিয়ে বলেও দিয়েছে পিৎজাহাট থেকে একটি হোম-ডেলিভারি আসবে তার নামে, টাকাটা দিয়ে পিঞ্জাটা যেনো বুঝে নেয়, ছোটোবাড়ির দোতলায় পাঠিয়ে দেয়।

    বাস্টার্ড দেখতে পেলো দারোয়ান গেট বন্ধ করে পিজার প্যাকেটটা নিয়ে এই বাড়ির নীচতলার দিকে এগিয়ে আসছে।

    আইনাতের কুইকির আব্দার সে রেখেছে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুবিধার্থে। ওর সাথে দ্বিতীয়বারের মতো মিলনের পরই মেয়েটাকে বিছানায় রেখে বাথরুমে চলে যায়। ওখান থেকে ফোন করে জাভেদকে সব বুঝিয়ে দেয়। তারপর ফিরে এসে মেয়েটাকে বলে, “তোমার কি খুব পিৎজা খেতে ইচ্ছে করছে?”

    কথাটা শুনে আইনাত অবাক হয়। “না। তোমার কেন এটা মনে হলো?”

    “বাহ, তুমি তোমার ভাইকে বললে না, পিৎজা খেতে যাবে?”

    কথাটা শুনে হেসে ওঠে মেয়েটি। “আরে, ওটা তো বলেছি অজুহাত হিসেবে। ইয়াকুব আমার কাছ থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে নিতে চাইছিলো দেখে চট করে এটা মাথায় আসে।”

    আইনাতের এ কথা শুনে সে বলে, “ঠিক আছে, তা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু সত্যি সত্যি পিৎজা খেলে কেমন হয়, বলো তো? আসলে আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে এখন।”

    মুখ টিপে হেসে ফেলে আইনাত। “সেটা বলল, তোমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে।”

    “হুম। পিৎজাহাটের কথা শোনার পর থেকেই খুব খেতে ইচ্ছে করছে। আমি আবার পিৎজা খুব পছন্দ করি। রীতিমতো আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে এটা। লন্ডনে প্রায় প্রতিদিনই পিৎজা খেতাম।”

    হা-হা-হা করে হেসে ফেলে আইনাত। “অন্য কিছু না…পিঞ্জা অ্যাডিকশন? অদ্ভুত তো?”।

    বাস্টার্ডও বোকার মতো হাসে। “আচ্ছা, ওরা তো হোম-ডেলিভারি দেয়…তোমার নামে একটা পিজার অর্ডার করে দেই, কি বলো?”

    “হাজার হলেও মেহমান, কি আর বলবো। ওকে, অডার দাও।”

    “গুড। তুমি দারোয়ানের কাছে পাঁচ শ’ রুপি দিয়ে বলে রাখবে তোমার নামে একটা পিৎজা হোম-ডেলিভারি দিতে আসবে। পেমেন্ট দিয়ে যেনো জিনিসটা বুঝে নেয় সে।”

    “ঠিক আছে।”

    “পেমেন্ট অবশ্যই আমি করবো…এ নিয়ে কোনো কথা হবে না।”

    “ওকে ওকে।” হাসতে হাসতে বলে মেয়েটি।

    তারপর সে ফোন বের করে পিৎজা-হাটে একটি অর্ডার দেয়। বলা বাহুল্য, ওটা ছিলো ভুয়া ফোন। কোথাও কোনো কল না দিয়ে নিখুঁত অভিনয় করে একটা স্পেশাল পিজার অর্ডার দেয়।

    মুচকি হাসলো সে। আইনাত এখন নীচতলায় চলে গেছে পিৎজার প্যাকেটটা নিয়ে আসতে। ইচ্ছে করলে কাজের লোককে এখানে ডেকে এনেও নিতে পারতো কিন্তু তার নীচে যাবার আরেকটি কারণ হলো ছোটোভাইটিকে দেখে আসা। ওর গোসল করে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কাজের লোকদের উপরে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়াটা ঠিক না। এরা কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। নীচে গিয়ে পিৎজাটাও নিয়ে এলো, ভাইকেও দেখে এলো।

    দরজা খোলার শব্দ পেলো সে। একটু পরই আইনাত ঢুকলো পিঞ্জার পাকেটটা নিয়ে।

    “এই যে তোমার প্রিয় পিঞ্জা!” দরজা বন্ধ করে প্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে এলো তার কাছে। “কতোবড় পিৎজার অর্ডার দিয়েছো, অ্যাঁ? এতো ভারি কেন?”

    প্যাকেটটা দ্রুত মেয়েটার হাত থেকে নিয়ে নিলো সে। হেসে বললো, “স্পেশাল পিজ্জা, ডার্লিং।”

    “ওয়াও,” হেসে বললো মেয়েটি। “ভালোই হলো, আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

    “কিন্তু এটা তো এখন খাওয়া যাবে না।”

    অবাক হলো আইনাত। “কেন?”

    “আমাদের দুজনকেই শাওয়ার নিতে হবে আবার। ভুলে গেছো, একটু আগে কি করেছি?”

    “ও,” মিটিমিটি হাসলো মওলানার মেয়ে। “তাও তো ঠিক। তাহলে বসে আছো কেন…জলদি যাও, শাওয়ার নিয়ে এসো।”

    লেডিস ফার্স্ট, বাথরুমের দিকে ইঙ্গিত করে বললো সে। “তুমি যাও, আমি আমার হোটেলে একটা ফোন করবো। ওদের বলতে হবে, আমি আজও ফিরছি না, করাচির বাইরে আছি। আগামীকাল ব্যাক করবো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত, তারপর টেনে টেনে বললো, “ও-কে।”

    তার গালে আলতো করে একটা চাপড় মেরে চলে গেলো বাথরুমে। বাস্টার্ড আর দেরি করলো না, দ্রুত পিজ্জার প্যাকেটটা খুলে ফেললো। বড়সড় পিৎজার নীচে স্বচ্ছ পলিথিনে মোড়ানো একটা প্যাকেটের ভেতরে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল, এক্সট্রা ম্যাগাজিন আর ছোট্ট একটা ওষুধের প্যাকেট। পলিথিনের প্যাকেটটা হাতে নিতেই টের পেলো গরম হয়ে আছে। বেডরুমের ক্লোজেটে রাখা তার জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে ওটা রেখে দেয়ার সময় টের পেলো সেই পরিচিত আত্মবিশ্বাসটি আবার ফিরে এসেছে তার মধ্যে। এখন মনে হচ্ছে কোনোভাবেই ঐ মওলানা তার হাত থেকে রেহাই পাবে না।

    অধ্যায় ৬২

    মানসুরের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। রাগলে তার নাকের পাতি ফুলে ওঠে অনেকটা ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো, কিন্তু ব্যান্ডেজ করা ভাঙা নাকে সেটা হচ্ছে। কিনা সন্দেহ।

    এটা তো অপমান। মারাত্মক অপমান। তার ফোনটা পর্যন্ত ধরছে না মওলানা ইউসুফ! একবার নয় দু-বার নয়, পর পর তিন-চারবার ফোন করেছে, কিন্তু কলটা রিসিভ করা হয় নি। সে কি এতোটাই ফালতু হয়ে গেছে? তার কি কোনো মানসম্মান নেই? আরে, করাচিতে যে-কয়টি খানদানি পরিবার আছে তার মধ্যে তাদের পরিবার অন্যতম। মাশরেকি-পাকিস্তান থেকে আসা মওলানার হিম্মত কতো বড় যে, এই পরিবারের একজন ছেলের ফোন ধরছে না? মেয়ের জামাইর কথা না-হয় বাদই দেয়া গেলো।

    “গাদ্দারের জাত…কতোবড় আস্পর্ধা, আমার ফোন ধরছে না!” রেগেমেগে বলে উঠলো সে।

    “ভাই, মওলানা কিন্তু গাদ্দার নয়,” আস্তে করে বললো হাবিব। “আপনি ভুলে গেছেন, লোকটা পাকিস্তান রক্ষার জন্য অনেক কিছু করেছে। খুন-খারাবি থেকে শুরু করে কোনো কিছুই বাদ দেয় নি। শেষে নিজের দেশ ছেড়ে চলে এসেছে এখানে।”

    লাল টকটকে চোখে হাবিবের দিকে তাকালো মানসুর, কিছু বলতে গিয়েও বললো না। কথা সত্যি। এ কারণে মওলানা বাঙালি হলেও পাকিস্তান সরকারের অনেক উচ্চপর্যায়ের সাথে তার দারুণ খাতির। এদের মতো আরো কিছু মানুষ মাশরেকি পাকিস্তানে থাকলে দেশটা আর ভাঙতো না। মানসুরের বাবাও মওলানাকে খুব সমীহ করতো।

    “উনার উপরে রাগ করে লাভ নেই। উনি ভেবেছেন আপনি হয়তো আপনার বিবির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাইছেন। উনি তো আর জানেন না, আসল ঘটনা কি।”

    হাবিবের কথায় কোনো প্রতিবাদ করলো না মানসুর। এই ছেলেটার বিচার-বিবেচনার উপরে তার অগাধ আস্থা রয়েছে। ওর মাথাটাও বেশ ঠাণ্ডা, পাকিস্তানে এটা খুবই বিরল ব্যাপার। ছেলেটা সহজে রাগে না। কিন্তু তার নিজের রাগ বেশি। অল্পতেই মাথায় খুন চেপে যায়।

    “তাহলে এখন কি করবো?”

    হাবিব মুচকি হাসলো। “এটা নিয়ে মাথা গরম করার কিছু নেই। একটু ভেবে দেখি কি করা যায়।”

    “ঠিক আছে, তাই করো,” রেগেমেগে বললো মানসুর।

    হাবিবউল্লাহ খান আসলে কোনো কিছুই ভাবছে না। এরপর সে কি বুদ্ধি দেবে এই গর্দভটাকে তা এখনই বলে দিতে পারে কিন্তু তার বুদ্ধি এতো সস্তা নয়, একটু রয়েসয়ে দিলেই ভালো। তাতে করে বুদ্ধির দাম বাড়ে। তার মাথায় এখন ঘুরছে অন্য চিন্তা। পকেট বেশ ভারি। আজকের রাতটা একটু ভিন্নভাবে কাটাতে ইচ্ছে করছে। কতোদিন হলো ন্যাপিয়ের রোডে যায় না। গুলবাহারের উত্তেজক মুজরা দেখার পর উদ্দাম রাত্রিযাপন…

    “কিছু বলো?” অধৈর্য হয়ে বললো মানসুর।

    মাথামোটা বাহেনচোদ্দ! বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে উঠলো হাবিব। একটুও ধৈর্য নেই। এজন্যেই তো কোনো মেয়েকে খুশি করতে পারে না। আরে, সব কাজে কি তাড়াহুড়া করতে হয়?

    “আমার মনে হয় মওলানাকে ফোন করে লাভ নেই,” অবশেষে গম্ভীরমুখে বললো সে।

    “তাহলে?”

    “আপনি ইয়াকুবকে ফোন করে সব খুলে বলেন…সে তো আপনার বন্ধুর মতোই, তাই না?”

    কথাটা বেকুবের মনে ধরলো। “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ইয়াকুবকে সব খুলে বলবো তাহলে?”

    “ওকে আপনি বলবেন, খুবই জরুরি একটা কাজে মওলানার সঙ্গে দেখা করা দরকার…এর সাথে আপনার বিবির ঝগড়া-ফ্যাসাদের কোনো সম্পর্ক নেই।”

    “হুম, ঠিক আছে। কিন্তু ইয়াকুব তো জানতে চাইবে ঘটনাটা কি?”

    “তা চাইবে, আপনি বলবেন, কথাটা তার বাবাকে বলাই ভালো হবে।”

    “এতে কাজ হবে?”

    “কাজ না-হলে একটু ইশারা দেবেন…বুঝিয়ে দেবেন ঘটনা কতোটা সিরিয়াস।”

    “কি রকম ইশারা দেবো?”

    হারামখোরের মাথায় দেখি কিছুই নেই। মনে মনে গজগজ করে বললো হাবিব। “বলবেন, তার বাবার পেছনে এক ফেউ লেগেছে। লোকটা এসেছে মাশরেকি পাকিস্তান থেকে। তার মেয়ে আইনাতের সাথে খাতিরও করে ফেলেছে সে।”

    “এটা বললে কাজ হবে?”

    “আলবৎ হবে। আপনি বলবেন, এ ব্যাপারে আপনার কাছে শক্ত প্রমাণ আছে।” একটু থেমে আবার বললো, “যার চুলকানি সে ঠিকই চুলকাবে। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। দেখবেন, একটু পরই মওলানা ফোন দিয়েছে আপনাকে। জামাই আদর করে ডেকে নিয়ে যাবে ওই বাড়িতে।”

    মানসুরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “বুঝতে পেরেছি।” পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করে কানে চেপে ধরে মুচকি হাসতে লাগলো।

    হাবিব খানের মনোযোগ অবশ্য এদিকে নেই। তার মাথায় ঘুরছে আজরাতে সে কি করবে। মুজরাওয়ালিকে মোটা অঙ্কের বখশিস দিলে সে কি করবে, নিজেকে কতোটা উজাড় করে দেবে তার জন্য, ভাবতেই এক ধরণের উত্তেজনা বোধ করলো। হঠাৎ মানসুরের চিৎকারে চমকে তাকালো সে।

    “কুত্তে কি বাচ্চে!”

    “কি হয়েছে?”

    “ইয়াকুবও আমার ফোন ধরছে না!”

    মনে মনে মুখ টিপে হাসলো হাবিব। খানদানি বড়লোকদের এই এক দোষ। তাদেরকে কেউ অবহেলা করলে, অবজ্ঞা করলে মাথা আউলা-ঝাউলা হয়ে যায়। যেনো দুনিয়ার সবাই নিজেদের ফোন মুখের কাছে নিয়ে বসে আছে। কখন কোন্ জমিদারপুত্র তাদেরকে ফোন করবে!

    “সমস্যা নেই, একটু পর করেন। হয়তো ব্যস্ত আছে।”

    রাগে ফুঁসতে লাগলো মানসুর। “একটু পরও যদি ফোন না ধরে?”

    হাবিব মুচকি হাসলো। “হ্যাঁ, সেটা হতেই পারে। তারা তো আর জানে আপনি কেন ফোন করছেন।”

    “এতো কথা না বলে কিছু একটা বলো? ফোন না ধরলে আমি কি করবো?”

    মনে মনে মুচকি হাসলো হাবিব। মানুষ এতোটা বোকা কিভাবে হয় ভেবে পেলো না।

    অধ্যায় ৬৩

    মুম্বাইর তাজ হোটেল আগুনে পুড়ছে। তার থেকে কয়েক ব্লক দূরে ইহুদিদের একটি ডরমিটরি নরিমান হাউজে সন্ত্রাসীরা জিম্মি করে রেখেছে বেশ কিছু ইহুদি নারী-পুরুষকে। মুম্বাই হামলার দ্বিতীয় দিনটিও টিভির সামনে বসে সারাবিশ্বের মানুষ দেখছে কি করে মাত্র দশজন সন্ত্রাসী তিনকোটি মানুষের শহরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

    গতকালের পৈশাচিকতার শিকার শুধুমাত্র শিবাজি রেল স্টেশনেই ৫৮জন নারী-শিশু-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে দুশ’রও বেশি। ক্যাফে লিওপোল্ডে নিহত হয়েছে এগারো জন। ভাগ্যবান ৩৮জন মানুষ প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে তারা। পাঁচ-তারকার ওবেরয় হোটেলের ম্যাসাকারে নিহত হয়েছে আরো ১৫জন। এছাড়াও কামা হাসপাতালের সামনে ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়, তাদের মধ্যে মুম্বাইর পুলিশ কমিশনার কারকারও আছে। সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ট্যাক্সিটি বোমা বিস্ফোরণে চূর্ণবিচূর্ণ হলে ড্রাইভারসহ আরো তিনজন পথচারি নিহত হয়। চুরি করে গাড়ি নিয়ে পালাবার সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে কমপক্ষে ১৫জন পথচারি মারা গেছে বলে এখন পর্যন্ত রিপোর্ট করা হয়েছে।

    এতোসব দুঃসংবাদের মধ্যে একটাই ভালো খবর : একজন সন্ত্রাসীকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়েছে। আহত সন্ত্রাসী আজমল আমের কাসাব বর্তমানে কড়া পুলিশ প্রহরার মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি আছে। সে নিজেকে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অধিবাসী বলে পরিচয় দিয়েছে। মুম্বাইর পুলিশ তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলেও এখন পর্যন্ত মিডিয়ার কাছে কোনো কিছু প্রকাশ করে নি। তবে পাকিস্তান সরকার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। তাদের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সন্ত্রাসী ঘটনাটি নন-স্টেট অ্যাটাক।

    ভারতীয় কমান্ডোরা হোটেল তাজ এবং নরিমান হাউজ ঘিরে রেখেছে। আশা করা যাচ্ছে অচিরেই সেখানকার জিম্মি পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটবে।

    অসমর্থিত একটি সূত্র বলেছে, সন্ত্রাসীরা পাকিস্তান থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে নির্দেশনা পেয়ে গেছে প্রতিনিয়ত, এখনও সেটা অব্যাহত আছে। ভারতীয় গোয়েন্দারা তাদের ফোনালাপ ইন্টারসেপ্ট করতে পেরেছে সৌভাগ্যক্রমে। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য। করে নি।

    *

    জাগদীশ নামের লোকটি গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে, তার পাশে বসে আছে সুরাইয়া। ন্যাপিয়ের রোডই যার ঠিকানা। মেয়েটি কোনো কথা না বলে চুপচাপ চুইংগাম চিবোচ্ছে আর মোবাইলফোনে গেম খেলে যাচ্ছে।

    আড়চোখে মেয়েটির দিকে তাকালো জাগদীশ। ন্যাপিয়ের রোডের মেয়েগুলোর তুলনায় সুরাইয়া বেশ আধুনিক। ফলে গাহাগদের কাছে তার কদরও বেশি। সব সময় জিন্স-শার্ট পরে থাকে। কথাবার্তায় বেশ স্মার্ট। আজকে অবশ্য সাধারণ সালোয়ার-কামিজ পরেছে, আর তার উপরে জড়িয়ে নিয়েছে লাল টকটকে একটি শাল। এর কারণ অবশ্যই নভেম্বরের ঠাণ্ডা আবহাওয়া নয়-পাকিস্তানি মেয়েরা যতোই বেলেল্লাপনা করুক, বাইরে বেরুবার সময় একটু রেখেঢেকেই বের হয়। মেহমুদ আর সুরাইয়া দম্পতি তাদের বাচ্চাদের জন্য খেলনা কিনে নিয়ে যাচ্ছে-এখানে সন্দেহের কিছু নেই।

    গুলজার-এ-হিজরিতে গাড়িটা প্রবেশ করতেই পেছনের সিট থেকে বলে উঠলো সে, “দু-নাম্বার রোডের প্রথম বাড়িটার উল্টোদিকে একটু রাখবে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো কুনাল, করাচিতে অবশ্য সুলতান নামেই সে পরিচিত, যেমন মেহমুদ নামে পরিচিত জাগদীশ।

    পায়ের নীচ থেকে বাচ্চাদের একটি খেলনার প্যাকেট তুলে নিলো জাগদীশ। সুরাইয়া আড়চোখে দেখে আবারো মন দিলো মোবাইলফোনের ডিসপ্লের দিকে। সত্যি সত্যি অ্যাংরি বার্ডে আসক্ত হয়ে পড়েছে সে। প্যাকেট থেকে বন্দুকের মতো দেখতে একটা খেলনা বের করে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ডিভাইসটির সাথে ওটা কানেক্ট করে নিলো জাগদীশ। এটি আসলে সফিসটিকেটেড সাউন্ড-ক্যাচার, দুর থেকে, চারদেয়ালের ভেতরে মানুষজনের কথাবার্তাও ক্যাচ করতে পারে। আজ দুপুরের পর হেডকোয়ার্টার থেকে তাকে একটি অ্যাসাইনন্টে দেয়া হয়। মুম্বাই’র সন্ত্রাসীরা এখনও করাচির দু-জন হ্যান্ডলারের কাছ থেকে মোবাইলফোনের মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা পাচ্ছে। ওদের অবস্থান খুঁজে বের করে যে করেই হোক থামাতে হবে। কিন্তু এ মুহূর্তে করাচিতে আছে কেবল সে আর কুনাল। বাকি দুজন একসপ্তাহ ধরে ইসলামাবাদে অবস্থান করছে। তারপরও কোনো রকম দ্বিধা না করে কাজে নেমে পড়েছে সে। ন্যাপিয়ের রোড থেকে সুরাইয়াকে সঙ্গে নেবার একটাই কারণ–ধোঁকা দেয়া। বিবিসাবকে নিয়ে একটু কেনাকাটা করতে বের হয়েছে।

    এই মেয়েটি বিগত দু-তিনবছর ধরে তাদের সাথে কাজ করে গেলেও আজই প্রথম ন্যাপিয়ের রোডের বাইরে কাজ করছে। সাধারণত নিজের ডেরায় থেকেই সে যা করার করে, বিনিময়ে পায় মোটা অঙ্কের বখশিস।

    এই মেয়েটি তাদের এক এজেন্ট হুসেনের আবিষ্কার, যে কিনা এই মুহূর্তে জরুরি একটা কাজে ইসলামাবাদে অবস্থান করছে। সম্ভবত হুসেন ন্যাপিয়ের রোডে প্রায়ই যেতো। যাহোক, ও-ই প্রথম প্রস্তাব করে সুরাইয়াকে দিয়ে দারুণ কাজ করানো যেতে পারে। ওরা যাদের পেছনে লেগেছে তাদের অনেকেই সুরাইয়ার গাহাগ!

    কয়েকদিন আগে লস্করের যে লোকটাকে ফলো করে বত্রিশটা সিমের খোঁজ সে পেয়েছে সেটাও সুরাইয়ার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে। বোকাচোদাটা সুরাইয়ার সামনে টেলিফোনে গোপন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলো।

    “পরের বাড়িটার সামনে যাও,” বললো জাগদীশ।

    রাস্তার দু-পাশে থাকা বাড়িঘরের ভেতর থেকে মানুষজনের কথাবার্তা ভেসে আসছে। সে-সব কথাবার্তা একেবারেই মামুলি। পরের বাড়িটার সামনে গাড়ি থামলে প্রথমে সে বামদিকের বাড়িতে যন্ত্রটা তা করে সতর্ক হয়ে শুনে গেলো কয়েক মুহূর্ত। একটু পর তার মুখে হাসি দেখা দিলো। একলোক তার বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে জোড়াজুড়ি করছে! অনিচ্ছুক মেয়েটাকে ফুসলানোর চেষ্টা করছে বেচারা। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে কার্তিকের কুত্তা হয়ে গেছে এই ভরসন্ধ্যায়!

    এবার ডানদিকে রাস্তার ওপাড়ের বাড়িটার দিকে তাক করতেই নড়েচড়ে বসলো সে।

    একজন লোক কথা বলছে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। প্রায় তিন-চার মিনিট মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনার পর নিশ্চিত হলো জাগদীশ-এরাই সেই হ্যান্ডলার!

    “গাড়িটা এখান থেকে একটু সামনে নিয়ে যাও…পেয়ে গেছি…এই বাড়িটা-ই!”

    “আপনি শিওর?” কুনাল জানতে চাইলো।

    “একদম শিওর।”

    “তাহলে এখন কি করবো আমরা?”

    “আমি কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে জানাচ্ছি…তারা কি বলে সেটা জেনে নিতে হবে আগে।”

    অধ্যায় ৬৪

    মওলানা ইউসুফ হোসাইনী গম্ভীর মুখে ধীরপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচতলায় নামছে।

    বলা নেই কওয়া নেই তার মেয়েজামাই মানসুর রাঙ্গুওয়ালা বাড়িতে চলে এসেছে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। মেহমানদের সাথে দোতলায় জরুরি একটা কাজে ব্যস্ত আছে সে, এরকম সময় কারো সাথে দেখা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও ছিলো না। কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই নীচে নেমে দেখা করতে হচ্ছে। বাড়িতে জামাই চলে এলে তো কিছু করার থাকে না। এর আগে মানসুর কয়েকবার কল করলেও ফোন ধরে নি। ভেবেছে ধরে কোনো লাভ নেই। হয় তার মেয়ের নামে নালিশ করবে নয়তো বাড়িতে ফিরিয়ে নেবার জন্য বায়না ধরবে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মওলানা ইউসুফের ভেতর থেকে। মানসুরের বাবা আহামাদ রাওয়ালা ছিলো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খুব সম্মান করতো তাকে। নিজে থেকেই তার ছেলের সাথে আইনাতের বিয়ের পয়গাম দিয়েছিলো। প্রস্তাবটা শুনে যারপরনাই খুশিও হয়েছিলো সে। কিন্তু তাদের দুই পরিবারের সমস্ত খুশি ম্লান হয়ে গেছে এই নাদানটার জন্য। অবশ্য তার মেয়ের যে কোনো দোষ নেই তা নয়। লন্ডনে গিয়ে পড়াশোনা করার পর থেকেই মেয়েটার মাথা বিগড়ে গেছে। সে আর মানিয়ে-টানিয়ে নেবার ধাতে নেই। তবে মেয়ে বলে নয়, সে জানে বেশি দোষ এই নাদানটারই। লন্ডন থেকে যে মেয়ে লেখাপড়া করে এসেছে তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে, তার মেয়ে মরে গেলেও জামাইর সাথে থাকতে চাইছে না। বাবা হয়েও এ-নিয়ে খুব বেশি জোরও করতে পারছে না সে। মেয়েমানুষ একবার বেঁকে গেলে যে সোজা করতে সময় লাগে সেটা তার মাথামোটা নাদান জামাই বুঝতে পারছে না।

    লম্বা-চওড়া দেহের মানসুর বিশাল ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। তার হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট। মওলানাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সাথে সালাম দিলো। “স্লামালেকুম, আব্বাজান।”

    সালামের জবাব দিয়েই জামাইর নাকের ব্যাভেজের দিকে চেয়ে রইলো বিস্ময়ে। “তোমার নাকে কি হয়েছে?”

    কাচুমাচু খেলো মানসুর। “গতকাল মেহমুদাবাদে যাচ্ছিলাম…পেছন থেকে এক নালায়েক আমার গাড়িটা মেরে বসে…স্টিয়ারিংয়ে লেগে এই অবস্থা হয়েছে।”

    “এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বললো?” উদ্বিগ্ন দেখালো মওলানাকে।

    “জি, ভালো। ডাক্তার বলেছে কোনো সমস্যা নেই। জখম খুব সামান্য।”

    “বসো বসো,” জামাইকে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো সোফায়। “তোমার আম্মার শরীর কেমন? পরিবারের সবাই কেমন আছে?”

    “জি, ভালো।” বসে পড়লো মানসুর।

    “ব্যবসার কি অবস্থা?”

    “জি, ভালো।”

    গভীর করে দম নিলো মওলানা ইউসুফ। সে ভালো করেই জানে তার মেয়েজামাই পৈতৃক ব্যবসায় খুব একটা সময় দেয় না। “দুবাই থেকে কিছু মেহমান এসেছে..তাদের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমার ফোন ধরতে পারি নি। ঘটনা কি, বেটা?”

    “আব্বা, ঘটনা তো বহুত খারাপ।”

    “আইনাত কি কিছু করেছে?”

    “আমি আগেই বলেছিলাম, ও সব লাফাঙ্গাদের সাথে মেলামেশা করে। এখন তো ডিসকোতেও যাওয়া শুরু করে দিয়েছে।”

    ভুরু কুচকে ফেললো আইনাতের বাবা। “ডিসকোতে?!”

    “জি, আব্বাজান।”

    “তুমি এটা কিভাবে জানতে পারলে?”

    “ইয়ে মানে,” একটু কাচুমাচু খেলো মানসুর। “আমার এক পরিচিত লোক ওকে দেখেছে…ঐ যে বেগম নওয়াজিশ আলী আছে না?…ঐ জাহান্নামিটা ক্লিফটন বিচে একটা ডিসকো চালায়…আইনাত অনেকদিন ধরেই ওখানে যাওয়া আসা করছে।”

    আলীকে মওলানাও চেনে। জঘন্য এক পাপী। কী সম্ভ্রান্ত এক পরিবারেই না জন্মেছিলো! তার বাবা মিলিটারির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ছেলেটা বিয়েও করেছিলো এক ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েকে, তারপর মাথাটা পুরোপুরি শয়তানের কজায় চলে গেলো। মেয়েদের পোশাক পরে, মেকআপ করে থাকতে শুরু করলো আচমকা। এসব কারণে বিয়েটাও ভেঙে গেলো। এখন নষ্টামির চূড়ান্ত বলতে যা বোঝায় তার সবই সে করে বেড়াচ্ছে এই পাকজমিনে। প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়, তার নাকি নারী-পুরুষ দুটোই পছন্দ। আস্তাগফিরুল্লাহ! এমন নাচিজের আস্তানায় তার মেয়ে যাতায়াত করতে শুরু করেছে! ঘেন্নায় মুখ বিকৃত হয়ে গেলো তার।

    “আমি ওকে হাতেনাতে ধরেছিলাম…” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “আপনি বিশ্বাসও করতে পারবেন না, ও এক পরপুরুষ গাদ্দারের সাথে বসে মদ খাচ্ছিলো!”

    গাদ্দার! শব্দটা মওলানাকে আগ্রহী করে তুললো। সে জানে সাধারণ পাকিস্তানিরা গাদ্দার বলতে কি বোঝায়-এককালে তার স্বদেশী! “কার সাথে বললে?”

    “এক গাদ্দার, আব্বাজান।” বলেই মানসুর তার হাতে থাকা একটা এনভেলপ বাড়িয়ে দিলো। “এই দেখেন…এখানে গাদ্দারটার সবকিছু আছে…ঘটনা বহুত খারাপ…আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন।”

    অবাক হয়ে এনভেলপটা হাতে নিলো মওলানা। ওটার ভেতরে সবুজ রঙের একটি পাসপোর্ট, তার বিজনেস কার্ড আর মোবাইলফোনের মতো দেখতে অদ্ভুত একটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। হতবাক হয়ে দেখলো সে।

    বাংলাদেশী পাসপোর্ট! আমার কার্ড! আর এটা কি?

    পাসপোর্টটা খুলতেই যে ছবিটা দেখতে পেলো সেটা তাকে রীতিমতো চমকে দিলো, অবশ্য মেয়ের জামাইর সামনে বহুকষ্টে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো সে।

    এই লোকটা কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। দুবাইর প্লেনে তার সাথে পরিচয় হয় এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ির। সেই লোক তার কাছ থেকে একটা বই পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয় নি। ওটা ফেরত দিতে এসেছিলো এই যুবক।

    তার মাথায় অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। অবশেষে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে, “এই লোকটাকে তুমি আইনাতের সাথে দেখেছো?”

    “জি। গাদ্দারটাই তো আমার নাক…” মানসুর নিজের বোকামিটা ধরতে পেরে চুপ মেরে গেলো।

    ভুরু কুচকে তাকালো মওলানা। “এই লোকটা…” তওফিক আহমেদের পাসপোর্টটা দেখিয়ে বললো, “…তোমার নাক ভেঙে দিয়েছে?”

    কাচুমাচু খেলো মওলানার জামাই।

    ব্যাপারটা বুঝতে পারলো মও।না ইউসুফ হোসাইনী। গভীর করে আরো একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, “তুমি ওর পাসপোর্ট, আমার কার্ড আর এই জিনিসটা কিভাবে পেলে?”

    “ওর হোটেল রুম থেকে, আব্বাজান।”

    মওলানা চুপ মেরে রইলো কিছুক্ষণ। সে জানে মানসুর কতো বড় ত্যাদড়। তাওফিক আহমেদ নামের বাংলাদেশীটা ওর নাক ভেঙে দিয়েছে, সুতরাং লোকটার পেছনে ও লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে অবাক হচ্ছে এই লোকটা তার জামাইর মতো দশাসই একজনকে কিভাবে শায়েস্তা করতে পারলো! সে তাহলে কে? তার উদ্দেশ্যটা কি? বলেছিলো করাচিতে এসেছে দু তিনদিনের জন্য, এখন দেখতে পাচ্ছে লোকটা বেশ কদিন ধরেই এখানে আছে, তাও আবার গুলশান-এ-ইকবালে! তার অফিসের খুবই কাছে!

    “এই জিনিসটা কি, তুমি জানো?” জিপিএস ট্র্যাকারটা দেখিয়ে বললো মওলানা।

    “জি আব্বা। এটা হলো জিবিএস…” ভুলটা আত্মবিশ্বাসের সাথেই বললো মানসুর, “মোবাইলফোনের মতোই একটা জিনিস। আপনি কোথায় আছেন সেটা নাকি বোঝা যায়।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো মওলানা। সে পুরনো দিনের মানুষ, এইসব মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যাপারে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়, তারপরও এই জিনিসটার সাথে বেশ পরিচিত।

    “এই লোকটা এখন কোথায় আছে?” তওফিক আহমেদের পাসপোর্টটা দেখিয়ে বললো।

    “আব্বা, আইনাতই তো গাদ্দারটাকে গাড়িতে করে পালাতে সাহায্য করেছে। ও যে হোটেলে উঠেছে সেখানেও আর ফিরে যায় নি। ওকে পেলে আমি ওর হাড়ি-মাংস এক করে ফেলতাম না!”

    মওলানা ইউসুফের কপালে ভাঁজ পড়লো।

    “আপনি আইনাতকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন গাদ্দারটাকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে এসেছে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মওলানা। তার আর বুঝতে বাকি নেই তওফিক আহমেদ লোকটা কে। হিন্দুস্তানি এজেন্ট! পূর্ব-পাকিস্তান বহু আগেই হিন্দুস্তানের পদানত হয়ে গেছে। ওরা নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধীন। র-এর অনেক

    এজেন্ট বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে এই পাক-জমিনে ঢোকে।

    সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলো মানসুর উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

    “বেটা, আমি খুব পেরেসানির মধ্যে আছি…বাড়িতে মেহমান আছে। কিছু জরুরি কাজও আছে হাতে। তুমি দু-দিন পর দেখা করো আমার সাথে, তখন এ নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে, কেমন?”

    “জি, আব্বা,” মানসুর খুশি হলো। “দু-দিন পর কি এই বাড়িতেই আসবো?”

    “আলবৎ। তুমি এ বাড়ির জামাই, এটা ভুলে যাচ্ছো কেন?”

    মানসুরের হাসি আরো বিস্তৃত হলো।

    “এখানেই আসবে। ঠিক আছে?”

    “ঠিক আছে, আব্বাজান।”

    “আর শোনো, আমি খুব জলদি আইনাতকে তোমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো। এ নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না।”

    বিগলিত হয়ে উঠলো মানসুর।

    “বিয়ের পর মেয়েদের আসলে জামাইর বাড়িতে থাকাই ভালো। নইলে অনেক সমস্যা হয়। আমি আইনাতকে বলে দেবো, যা হবার হয়েছে, জামাইর সাথে যেনো আর কোনো ঝামেলা না করে।”

    মানসুর রাঙ্গুওয়ালার বিগলিত ভাব আরো বেড়ে গেলো।

    “আর তুমিও বেটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ কোরো। ঘরের সমস্যা মাথা গরম করে সমাধান করা যায় না।”

    “জি, আব্বা।”

    “আরেকটা কথা, এই ব্যাপারটা নিয়ে কারো সাথে কোনো কথা বোলো। আইনাতের সাথেও না। ঠিক আছে?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মওলানার মেয়ে-জামাই। “জি আব্বা।”

    অধ্যায় ৬৫

    বিশাল আকারের পিজা খাওয়ার পর দুপুরের খিদেটা একটু দেরিতেই এলো তাদের। প্রায় বিকেলের কাছাকাছি সময় হালকা লাঞ্চ করে দু-জনে মিলে খোশগল্প করতে শুরু করে। দীর্ঘদিন একাকীত্বে থাকা মেয়েটি একজন সঙ্গি পেয়ে প্রগলভ হয়ে উঠেছিলো যেনো। তার জীবনের যতো কথা আছে সবই বলে গেছে কোনোরকম ভনিতা ছাড়া। লন্ডনের দারুণ সময়গুলো, তার মায়ের সাথে চমৎকার সম্পর্কের গল্প, ভাইকে নিয়ে উদ্বিগ্নতা, মানসুরের সাথে তার দুঃসহ সময়গুলো-সবই বলেছে। বাস্টার্ড সুকৌশলে ভালো শ্রোতা হয়ে সব শুনে গেছে, নিজের কোনো কথা সে বলে নি। আইনাতও তেমন কিছু জানতে চায় নি। এসব কথা শোনার সময় তার মাথায় ঘুরছিলো অন্য একটি চিন্তা।

    “কফি খেলে কেমন হয়?” মেয়েটার গল্প শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে বলে ওঠে সে।

    “এখনই খেতে চাও?”

    “হুম।”

    “ওকে…তাহলে আমি নীচে যাই…গরম পানি ফ্লাস্কে করে নিয়ে এসে বানাবো এখানে।”

    “সেটাই ভালো হবে। তুমি পানি নিয়ে আসো, আমি মিক্সিং করবো আজ। দেখো, কেমন কফি বানাই।”

    “তুমি বানাবে?”

    “আহা, বার বার তুমি বানাবে কেন….একবার না-হয় আমিই বানালাম।”

    “ওকে ওকে,” হাসতে হাসতে চলে যায় আইনাত।

    মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ক্লোজেটটা খুলে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকায়। সকালে অল্পের জন্যে বেঁচে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিকল্পনা নিখুঁতভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। যেনো হঠাৎ করেই সবকিছু তার পক্ষে কাজ করতে শুরু করেছে আবার। দৈবাৎ কোনো কিছু ঘটছে না। হুট করে ঘটনা অন্যদিকেও মোড় নিচ্ছে না। সে চেয়েছিলো একটা পিৎজা হোম ডেলিভারি, সেটা খুব সুন্দরভাবেই করেছে জাভেদ। পিৎজার প্যাকেটের ভেতরে পিস্তল-গুলি-সাইলেন্সার আর ওষুধ হাতে পেয়ে যেতেই ধৈর্য ধরে বাকিটা সময় অপেক্ষা করে গেছে।

    বামহাতের তালুতে চারটা স্লিপিং পিল মুঠো করে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মেইনগেটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঐ দু-জনই দারোয়ানের কাজ করছে। ইয়াকুব এখনও ফিরে আসে নি। এটাও ভালো লক্ষণ। আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। সে আঘাত হানবে ঠিক মাগরেবের আজানের পর পরই। মওলানা অবশ্যই নামাজ পড়বে। এই বাড়ির দারোয়ান পর্যন্ত নামাজ পড়ে। সে দেখেছে দুপুরের জোহরের আজানের পর পরই নতুন লোকটাকে রেখে পুরনো দারোয়ান বড়বাড়ির নীচতলায় চলে গেছে। আইনাতকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলো, সে বলেছে, নীচতলায় একটা নামাজ ঘর আছে। দারোয়ান লোকটিও ওখানে নামাজ পড়ে। অনেক সময় মেহমানের সংখ্যা বেশি হলে নীচের নামাজ ঘরে এসে সবাই নামাজ আদায় করে।

    দরজা খোলার শব্দ শুনে জানালার কাছ থেকে সরে গেলো বাস্টার্ড। একটা ট্রের উপর ফ্লাস্ক, সুগার কিউব, ম্যাট, কফির পাত্র আর দুটো কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকলো আইনাত। ড্রইংরুমের কফি টেবিলের উপর ট্রেটা রেখে দিলো সে।

    “এখন তাহলে বানাও?”

    মুচকি হেসে বাস্টার্ড কফি বানাতে লেগে গেলো। “তুমি কয়টা কিউব নেবে তোমার কফিতে?”

    “তিন,” আইনাত বললো।

    ভুরু কপালে তুললো সে। “অনেক বেশি। এতো চিনি খাওয়া ঠিক না।” কাপে দুধ আর কফি ঢেলে দিলো কয়েক চামচ।

    “কফিতে একটু বেশিই খেতে হয় নইলে কেমন তেতো লাগে।”

    “হুম” মাথা নেড়ে সায় দিলো। “তা ঠিক।” একটা কাপে তিনটি সগার কিউব দিলো সে। “আমি অবশ্য দুটো নেই।” নিজের কাপে দুটো কিউব দিতে দিতে বললো।

    “দ্যাটস গুড,” মুচকি হেসে বললো মেয়েটি।

    “তোমার ঐ ভাই কি এখনো ফেরে নি?”

    “মনে হয় না। সম্ভবত পোর্টে গেছে। দুবাইতে কোনো শিপমেন্ট আছে হয়তো।”

    “মেইনগেটে কি এখনও দু-জন পাহারা দিচ্ছে?” ফ্লাস্ক থেকে কাপে গরম পানি ঢালতে নিলো এবার।

    আইনাত জানালার কাছে চলে গেলো। ঠিক এই সময়েই আস্তে করে বামহাতে রাখা স্লিপিং পিলগুলো একটা কাপে ঢেলে দিলো সে।

    “হুম,” জানালা দিয়ে দেখে বললো মেয়েটি।

    চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে বললো, “এই নাও তোমার কফি।”

    কাছে এসে কাপটা হাতে তুলে নিলো সে। “থ্যাঙ্কস।”

    এবার নিজের কাপে চামচ নেড়ে নিলো। “কেমন হয়েছে?”

    আইনাত একটা চুমুক দিয়ে একটু স্বাদ পরখ করে নিলো। “মন্দ না!”

    “আ-হা!” নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো সে। “একটু সৌজন্যতা দেখাও। মেহমানের বানানো কফি খারাপ হলেও ভালো বলতে হয়। মন্দ নয় মানে ভালো হয় নি।”

    হা-হা-হা করে হেসে উঠলো আইনাত। “সরি সরি। বেশ ভালো হয়েছে।”

    এবার হেসে উঠলো বাস্টার্ড। কফিতে চুমুক দিলো সে। “খুব একটা মন্দ হয় নি কিন্তু।”

    “হুম,” মুখ টিপে হেসে বললো মেয়েটি। আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছে কফিতে।

    “যেভাবেই হোক কাল সকালে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও গাড়িটা নিতে হবে…নইলে এই জেলখানা থেকে বের হওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে।”

    “কেন, আমার জেলখানা ভালো লাগছে না? এতো দ্রুত হাপিয়ে উঠলে?”

    “আমি তো পারলে আরো কয়েকটা দিন থাকতাম কিন্তু ধরা পড়ে গেলে কি কেলেংকারিটা হবে, বোঝো?”

    চুপ মেরে গেলে আইনাত।

    “আমি চাই না তুমি এরকম বিপদে পড়ো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো মেয়েটি। “হুম।”

    “তাই বলছিলাম, কাল সকালে যেভাবেই হোক একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে হবে। ঠিক আছে?”

    “ওকে। তুমি এটা নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। ইয়াকুব যদি গাড়ি না ও দেয় আমি আমার কোনো বন্ধুর হেল্প নেবো।”

    “ওরা তাহলে জেনে যাবে না?”

    “বন্ধুরা জানলে সমস্যা নেই।”

    “ওকে…যা ভালো মনে করো।”

    কফিতে চুমুক দিয়ে আশ্বস্ত করার হাসি দিলো আইনাত।

    বাস্টার্ডও নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে দেখতে লাগলো মেয়েটার কফি খাওয়া।

    নিজের কাপে আস্ত আস্তে চুমুক দিয়ে ড্রইংরুমের টিভিটার দিকে তাকালো সে। “তুমি মনে খুব কম টিভি দেখো, না?”

    “আরে না,” কফিতে চুমুক দিয়ে বললো মেয়েটি। “ঘরে থাকলে আমি সারাক্ষণই টিভি ছেড়ে রাখি। কিন্তু দু-দিন ধরে আমার টিভিটা নষ্ট হয়ে আছে…মেকানিকের কাছে আর নিয়ে যাওয়া হয় নি।”

    এমন সময় হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ শুনে চমকে উঠলো তারা দু জন।

    “কে?” চাপাস্বরে বললো বাস্টার্ড।

    আইনাত ঘাবড়ে গেলেও দ্রুত সামলে নিয়ে বললো, “চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি দেখছি।” কফির কাপটা নিয়েই সে চলে গেলো মেইনগেটের কাছে। পিপহোলে চোখ রাখতেই আৎকে উঠলো। “মাই গড!”

    বাস্টার্ড বুঝতে পারলো না ঘটনা কি।

    আইনাত ফিরে তাকালো ওর দিকে। মেয়েটার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তারপর ভয়ার্তকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “মানসুর!”

    সর্বনাশ!

    “তুমি বেডরুমে চলে যাও! আমি দেখছি,” চাপাকণ্ঠে তাড়া দিলো তাকে।

    কফির কাপটা হাতে নিয়েই সে চলে গেলো বেডরুমে। ওখানে গিয়েই কফি কাপটা রেখে দিলো বেডসাইড টেবিলে। তারপর ক্লোজেটে রাখা তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে তুলে নিলো। তার সমস্ত পরিকল্পনা আবারো ভেস্তে যেতে বসেছে আচমকা। আরো একবার তাকে ভড়কে দেবার মতো ঘটনা ঘটলো। মানসুর চলে এসেছে আইনাতের ফ্ল্যাটে!

    ফ্ল্যাটের দরজা খোলার শব্দ কানে গেলো। আইনাত উর্দুতে কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইছে মানসুর কেন এখানে এসেছে। লম্বুটা চিবিয়ে চিবিয়ে উর্দুতে কিছু বললেও সে পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। শুধু ধারনা করতে পারছে কিছুটা।

    তোমার বাবাকে বলে দিয়েছি তুমি ডিসকোতে গিয়ে কি করো! আজ বাদে কাল তোমাকে আমার বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তখন তোমার সব বেলেল্লাপনা আমি বের করে দেবো।

    আইনাত তার কথাগুলো পাত্তাই দিচ্ছে না। সেও চেঁচিয়ে পাল্টা বলে যাচ্ছে, মানসুরের বাড়িতে সে কখনও ফিরে যাবে না। যদি জোর করে তাহলে তার লাশ নিয়ে যেতে হবে ঐ বাড়িতে!

    বেডরুমের বন্ধ দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ তাদের দুজনের কথাবার্তা শুনে গেলো সে। তারপরই সজোরে দরজা বন্ধ করার শব্দ। রাগে গজ গজ করছে আইনাত।

    হাফ ছেড়ে বাঁচলো বাস্টার্ড। পিস্তলটা আবারো আগের জায়গায় রেখে কফির কাপটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

    “সন অব অ্যা বিচ!” দাঁতমুখ খিচে বললো আইনাত। “তার সাহস কতো, আমার ঘরে এসে আমাকে হুমকি-ধামকি দেয়!”

    “মনে হচ্ছে ও তোমার বাবাকে আমার কথা বলে দিয়েছে?”

    বাস্টার্ডের দিকে তাকালো মেয়েটি। “সেটাই তো স্বাভাবিক। এরকম একটা ঘটনা আব্বাকে বলবে না? আমি তো ভেবেছিলাম গতকালকেই নালিশ করবে।”

    বাস্টার্ড একটু অবাকই হলো আইনাতের কথা শুনে। “তুমি এটা নিয়ে চিন্তিত নও?”

    “আশ্চর্য, চিন্তার কি আছে? ও আমাদের দেখেছে না? আমি ডিসকোতে যাই সেটা ও জেনে গেছে। এতো কিছু জানার পর বাবাকে সে বলে দেবে, এতে মোটেও অবাক হই নি।”

    “এখন তাহলে কি হবে?”

    “কি আবার হবে?” গভীর করে দম নিয়ে বললো সে। এর আগেও এরকম অনেক নালিশ করেছে…আব্বা আমাকে ধমক-টমক দিয়ে পরে বুঝিয়ে বলেছে এসব যেনো না করি। এবারও তাই করবে।”

    “কিন্তু আমার সাথে যে দেখে ফেলেছে তোমাকে?”

    “তাতে কি?” একটু থেমে আবার বললো, “এর আগেও আমার কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখে বাবার কাছে নালিশ করেছিলো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড।

    “তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন, আজব! ও তো জানে না তুমি এখন আমার ফ্ল্যাটে আছো।” বলেই হেসে ফেললো মেয়েটি। “এখন এসব নিয়ে ভেবে ভেবে আমাদের সুন্দর সময়টা নষ্ট কোরো না তো। আসো…আমাকে একটু আদর করো…শূয়োরটার সাথে কথা বলে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।”

    “এখন যদি তোমার বাবা চলে আসেন এখানে?”

    “আহ,” বিরক্ত হলো মেয়েটি। “খামোখা চিন্তা করছো তুমি। আব্বা এখানে আসবেন না। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন। আমি নীচে গিয়ে দেখা করে আসবো।”

    “উনি কি তোমাকে এখন ডাকতে পারেন?”

    “এখন ডাকলেও আমি যাচ্ছি না…বলবো আমার খুব মাথা ধরেছে…পরে আসছি।” একটু থেমে বাস্টার্ডকে জড়িয়ে ধরলো আবার। “অ্যাই…তুমি আমাকে আদর করছো না কেন? মাত্র দু-দিনেই পুরনো হয়ে গেলাম নাকি?”

    হা-হা করে হেসে উঠলো সে। “তা তো হয়েছেই,” বলেই আইনাতকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো। “তবে আমি আবার পুরনো মদ বেশি পছন্দ করি…” মেয়েটার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খেলো। “আর তুমি হলে সেই পুরনো মদ!”

    মাতালের মতো হাসতে শুরু করলো আইনাত। অমনি তার মুখটা চেপে ধরলো বাস্টার্ড।

    “আস্তে!”

    জিভে কামড় দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো মেয়েটি, সরি!”

    “দ্যাটস লাইক মাই বেবি!” বলেই মেয়েটাকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেলো।

    “অ্যাই…আমাকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দাও…আমার খুব ঘুম পাচ্ছে!”

    বাস্টার্ড বুঝতে পারলো ওষুধটা কাজ করতে শুরু করেছে। মুচকি হাসলো সে।

    অধ্যায় ৬৬

    সন্ধ্যার কালোছায়া নেমে এসেছে করাচির উপর। পথঘাটের অবস্থা থমথমে। প্রতিবেশী দেশের মুম্বাই শহর এখনও সন্ত্রাসীদের থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে নি। গুলজার-এ-হিজরির তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ির ভেতরের পরিবেশ বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। বড়বাড়িটার দোতলায় মওলানা আর তার অজ্ঞাত মেহমান থাকলেও তাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না বাইরে থেকে।

    একটু আগে মানসুর চলে গেলেও মওলানা বসে আছে নীচের বড় ঘরটায়। সাধারণত এখানেই সে মানুষজনের সাথে বৈঠক করে। এই বড়ঘরটার পাশেই আছে নামাজ ঘর। বাড়িতে থাকলে ওখানেই নামাজ পড়ে। অবিশ্বাস্য চোখে মওলানা চেয়ে আছে জিপিএস ট্র্যাকারের দিকে।

    আমার বাড়িটা শো করছে!

    বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ির সাথে তার দেখা হলো প্লেনে। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলো সেই লোক। তার কাছ থেকে পড়ার জন্য একটা বই নেবার পর বিজনেস কার্ডটাও চেয়ে নিলো। এক্ষেত্রে মওলানা অবশ্য সতর্ক ছিলো বরাবরের মতোই। তার সবচাইতে ক্ষমতা আর সম্মানের উৎস খিদমাত-এ-খালাকের কার্ডটা না দিয়ে ফিশিং-কোম্পানির কার্ড দিয়েছিলো। লোকটার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখে নি, শুধু বার কয়েক তার বামহাতের ষষ্ঠ আঙুলটির দিকে আড়চোখে তাকানো ছাড়া। মওলানা এই দৃষ্টির সাথে ছোটোলো থেকেই পরিচিত। তার হাতের এই বাড়তি আঙুলটা প্রায় সবারই মনোযোগ আকর্ষণ করে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে। লোকটার সেই তাকানোর মধ্যে স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার ছিলো না। আরো একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটে কয়েকদিন আগে। সেই ব্যবসায়ি বাংলাদেশ থেকে এক তরুণকে পাঠায় প্লেনে ধার নেয়া বইটি ফেরত দেবার জন্য। ফেরত দেবার আরো অনেক সহজ উপায় ছিলো। লোকটার কাছে তার অফিসের কার্ড ছিলো, ডিএইচএল, ফেডেক্স, ইউপিএস যেকোনো একটা কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিলেই কয়েকদিনের মধ্যে বইটা সে পেয়ে যেতো। সত্যি বলতে, এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে কিন্তু কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। তবে একটা কাজ সে করেছে। দীর্ঘদিন পর অবশেষে বাড়তি আর অপ্রয়োজনীয় আঙুলটি ছোট্ট একটি অপারেশন করে বাদ দিয়ে দিয়েছে। ঐ যুবক দেখা করার দু-দিন পরই সে এটা করে। মাত্র আধঘণ্টার একটি অপারেশন। কণিষ্ঠ আঙুলের উপরে সামান্য একটি টেপ-ব্যান্ডেজ। কেউ খেয়ালই করে নি তার এই পরিবর্তনটি।

    এখন সেই ব্যান্ডেজের উপর হাত বুলিয়ে ভাবছে, বহুকাল আগে এক কামেল লোকের কথাটাই কি শেষ পর্যন্ত সত্যি হতে চলেছে কিনা!

    তার বয়স যখন পনেরো-ষোলো, তখন বাড়তি আঙুলটা নিয়ে খুব বিব্রত ছিলো। লোকজনের অযাচিত আগ্রহ তৈরি হতো ওটা নিয়ে। তাছাড়া দেখতেও কেমন বিশ্রী লাগতো নিজের কাছে। তো সে সিদ্ধান্ত নেয় আঙুলটা কেটে ফেলার। তার বাবাকেও রাজি করিয়ে ফেলে কিন্তু বিপত্তি বাধে এক কামেল লোকের কথায়। লোকটা ছিলো তাদের গ্রামেরই এক পীরবংশের সন্তান। সবাই বলতো, তার মধ্যে বিশেষ কিছু একটা আছে। তার বাবা খুব সম্মান করতো তাকে। বাড়ির সব সিদ্ধান্ত নিতে তার পরামর্শে। সেই লোক বলেছিলো, এই বাড়তি আঙুলটা যেদিন কেটে ফেলবে সেদিন থেকে তার দুভাগের সূচনা ঘটবে। এটা নাকি তর সৌভাগ্যের নিদর্শন। এ কথা শোনার পর তার বাবা বেঁকে বসে। নিরূপায় হয়ে আঙুল কেটে ফেলার সিদ্ধান্তটি বাদ দিতে হয় তাকে।

    এখন সে বুঝতে পারছে, ঐ জামিল আহমেদ লোকটা আসলে হিন্দুস্তানি এজেন্ট। যেচে তার সাথে ভাব জমাতে চেয়েছিলো। সুকৌশলে তার কাছ থেকে একটা বই পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয় নি। এরপর তওফিক নামের একজনকে পাঠায় সেই বই ফিরিয়ে দেবার জন্য। এসবের উদ্দেশ্য একটাই-মওলানাকে ট্রাক-ডাউন করা। সম্ভবত ঐ বইটার ভেতরেই কিছু আছে। সত্যি বলতে বইটা ইয়াকুবকে দিয়েছিলো বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করে সে ওটা গাড়িতেই রেখে দিয়েছে। জিপিএস নিয়ে এখন কোনো দুর্ভাবনা নেই তার। জিনিসটা বেহাত হয়ে গেছে ঐ হিন্দুস্তানি এজেন্টের কাছ থেকে। তবে খুব জলদি, ঐ লোকটাকে শেষ করে দিতে হবে। নইলে বিরাট বড় বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

    আরেকটা সিদ্ধান্ত নিলো, ঘরের মেহমানদের এসব বলা যাবে না। তার বাড়িটাকে নিরাপদ ভেবেই ওরা এখানে এসেছে। এখন যদি জানাজানি হয়ে যায় ওর মেয়ে হিন্দুস্তানী এজেন্টের খপ্পরে পড়েছে তাহলে সংগঠনে নিজের অবস্থান নাজুক হয়ে যাবে। ছোটো হয়ে যাবে সবার চোখে।

    গভীর করে দম নিয়ে নিলো সে। এটা অন্যভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলফোনটা তুলে নিয়ে ইয়াকুবকে একটি এসএমএম করে দিলো যতো দ্রুত সম্ভব যে যেনো বাড়িতে চলে আসে। দুবাইয়ের একটি বিশাল শিপমেন্টের ব্যাপারে পোর্টে ব্যস্ত আছে।

    অবশেষে উঠে দাঁড়ালো। ঘর থেকে বের হতেই দেখা হলো আসাদুল্লাহর সাথে। জাতে আফগান এই ছেলেটিকে তার মেহমানরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। তার সাথে চোখাচোখি হতেই সালাম দিলো ছেলেটি।

    “করিম কোথায়?” জানতে চাইলো মওলানা। করিম তার বাড়ির বহু পুরনো দারোয়ান।

    “মওলানাসাব, ওর শরীরটা খারাপ…একটু রেস্ট নিতে গেছে।”

    “ও,” একটু থেমে আবার বললো সে, “চোখ-কান খোলা রেখো। বাইরে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লেই আমাকে জানাবে।”

    “জি, মওলানাসাব।”

    “তোমার সঙ্গে অস্ত্র আছে না?”

    “জি, আছে।”

    “ঠিক আছে…” আর কিছু না বলে যে-ই না ঘুরে দাঁড়ালো অমনি দেখতে পেলো ছোটোবাড়িটার মেইনগেটের সামনে তার ছোটোছেলে ইউনুস হুইলচেয়ারে বসে আছে। থমকে গেলো সে। এই মানসিক আর শারিরীক প্রতিবন্ধী ছেলেটা তার জীবনের সবচাইতে বড় দীর্ঘশ্বাস। আল্লাহপাক কেন তাকে এমন সন্তান উপহার দিয়ে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেললো সে জানে না। পারতপক্ষে ছেলেটাকে এড়িয়েই চলে, আজও তাই করলো। বিরক্ত হয়ে ফিরে গেলো বড়বাড়ির ভেতরে।

    *

    আইনাত বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। তার স্বামী মানসুর চলে যাবার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই সে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে। কোলে করে বিছানায় নিয়ে আসার পরই সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। বাস্টার্ড জানে, মেয়েটার এই গাঢ় ঘুম আগামীকাল সকাল পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে মাঝরাতের আগে যে ওষুধের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে না সেটা নিশ্চিত।

    আইনাত ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথে কাজে নেমে পড়ে সে। সাইলেন্সর পিস্তলটা জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে রেখে জানালার সামনে বসে থাকে শিকারী পশুর মতো ধৈর্য নিয়ে। বড়বাড়িটার দিকে অনেকক্ষণ লক্ষ্য রাখার পরও বুঝতে পারে না ওখানে কতোজন আছে। তবে আইনাতে সাথে কথা বলার সময় ঐ বাড়ির অনেক কিছুই সে জেনে নিয়েছে সুকৌশলে। তিনতলা বাড়ির নীচতলাটি মূলত মওলানার অফিসঘর, বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দোতলায় থাকে মওলানা নিজে, আর তিনতলায় থাকে ছোটোছেলে ইয়াকুব। তবে বাস্টার্ড জানে, গতরাতে গাড়িতে করে কয়েকজন এসেছে। তারা যে এখনও চলে যায় নি সেটা তাদের গাড়ি দেখেই বোঝা যায়।

    আইনাতের ভাষায় ওরা ‘মেহমান। এরকম মেহমান প্রায়ই ওর আব্বার সাথে দেখা করতে আসে। সম্ভবত এনজিও’র কাজের সাথে ওরা সংশ্লিষ্ট। তার ধারণা এই মেহমানরা আছে দোতলায় মওলানার ঘরে। বড় বড় তিনটি বন্ধ জানালার কাঁচের ওপাশে মাঝেমধ্যে কিছু অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর তার মনে হয়েছে মওলানাসহ ঘরে আরো দু-জন মানুষ আছে। তবে ইয়াকুব এখনও বাড়িতে ফিরে আসে নি। যে গাড়িটা নিয়ে সে বেরিয়ে গেছে ওটা এখনও ড্রাইভওয়ের পাশে দেখা যাচ্ছে না। তার মানে দাঁড়ালো, কাজের লোকজন ছাড়া মেইনগেটের বাড়তি একজনকে ধরলে এই বাড়িতে এখন চারজন মানুষ আছে। দারোয়ান লোকটিকে হিসেবে রাখছে না সে, তবে তার সাথে যোগ দেয়া নতুন লোকটিকে রাখতে হচ্ছে। কারণ খুব সহজ : দারোয়ানকে স্বয়ং মওলানাই যদি হিসেবে রাখতো তাহলে বাড়তি একজনের দরকার পড়লো কেন? নিশ্চয় নতুন ঐ লোকটি বিশেষ কেউ। তাছাড়া দারোয়ান এখন গেটে নেই, নতুন লোকটিই পাহারা দিচ্ছে।

    মানুষজনের সংখ্যা নিয়ে মোটেও ভাবছে না এই মুহূর্তে। তার কাছে এখন সাইলেন্সার পিস্তল রয়েছে-তার প্রিয় জিনিস-নীরব এক ঘাতক। সে একা একা কাজ করে, তার কোনো গ্রুপ নেই, বাহিনী নেই। এমনকি আসল কাজের সময় কোনো সহযোগীও ব্যবহার করে না কখনও, ফলে সাইলেন্সর পিস্তল তার জন্য বিরাট সুবিধা বয়ে আনে। এই সামান্য সাইলেন্সার না থাকলে তার পক্ষে একা একা কাজ করাটা শুধু কঠিনই হয়ে যায় না, অসম্ভবও হয়ে ওঠে অনেক সময়। বাড়তি ম্যাগাজিনসহ তার কাছে এখন বিশটি গুলি আছে। দশ পনেরোজনকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। সে কোনো ট্রিগার-হ্যাপি নয়, এলোপাথারি গুলি করাও তার স্বভাবে নেই। তার নিশানাও বেশ ভালো। কাছ থেকে খুব কমই মিস করে। সুতরাং ঐ বাড়িতে ঢুকলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে সেটা অনুমাণ করতে পারলো : একদল নিরস্ত্র লোক তার নীরব ঘাতকের সামনে পটাপট ঘায়েল হয়ে যাবে। বাড়িতে একটা হৈ-হল্লার সৃষ্টি হবে হয়তো কিন্তু তাতে কিছুই হেরফের হবে না। মওলানাকে হত্যা করেই সে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে।

    ঠিক এমন সময় একটা দৃশ্য দেখতে পেয়ে ভুরু কুচকে যায় তার। বড়বাড়িটা থেকে একজন বৃদ্ধ মানুষ বের হয়ে আসে। মেইনগেটে থাকা লোকটার সাথে একটু কথা বলেই আবার ফিরে যায় বাড়ির ভেতরে। মানুষটাকে চিনতে একটুও সময়স্য হয় নি। এই নিয়ে তৃতীয়বার দেখলো তাকে। মওলানা সম্ভবত নামাজ পড়ার জন্য নীচতলায় নেমে এসেছে। মাগরিবের আজান দেবে আরেকটু পরই।

    দারুণ!

    এরপরই দেখতে পায় গতরাতে যোগ দেয়া লোকটি কোমর থেকে পিস্তল বের করে পরীক্ষা করে দেখছে!

    সশস্ত্ররক্ষী!

    ত্রিশ-পয়ত্রিশের এক যুবক। পেটানো শরীর। জ্যাকেট, গ্যাবাডিনের প্যান্ট, পায়ে কেডস জুতো আর গলায় মাফলার পেচানো। একেবারে টিপিক্যাল পাকিস্তানীদের মতো মোটা গোঁফ। পিস্তলটা পরীক্ষা করে আবারো কোমরে খুঁজে রেখেছে সে। নিয়মিত দরোয়ান অনেকক্ষণ ধরেই নেই। সম্ভবত বিশ্রামে গেছে। গতকাল থেকেই দেখছে বার বার মেইনগেটের মধ্যে যে ছোট্ট একটা খোপ আছে সেটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে এই লোক। এখনও তাই করছে। তার মানে কয়েক মিনিট এক নাগাড়ে এ কাজ করে যাবে সে।

    বাস্টার্ড বুঝতে পারলো এরকম দারুণ সুযোগ আর আসবে না। মাত্র একজন সশস্ত্র লোক, তাকে ঘায়েল করতে পারলেই বড়বাড়িতে ঢোকা যাবে। আর সেখানে আছে মওলানা ইউসুফ হোসাইনী।

    আর কিছু না ভেবে জ্যাকেটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে নিয়ে শাটার টেনে চেম্বারে গুলি লোড করে নিলো, তারপর সেফটি লক না করেই রেখে দিলো আগের জায়গায়। বিছানায় পড়ে থাকা আইনাতের দিকে তাকালো। মেয়েটার জন্য একটু মায়াই হলো তার, কিন্তু এটাও ঠিক, তার মিশন শেষ হলে সেও মুক্তি পাবে। দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলো। কাজের লোকজন সাধারণত এই বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করে না, পর্যবেক্ষণে তা-ই দেখেছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নিঃশব্দে। নীচের ল্যান্ডিংয়ে একটু থামলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ডান দিকে ঘুরে পা বাড়াতেই থমকে গেলো সে।

    ওহ!

    ছোটোবাড়িটার মেইনগেটের ঠিক সামনে, যেখানে এসে ড্রাইভওয়েটি শেষ হয়েছে, সেখানে হুইলচেয়ারে বসে আছে এক ছেলে। ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে সে চেয়ে আছে সামনের মেইনগেটের দিকে। বুঝতে পারলো এটা আইনাতের সেই ছোটোভাই ইউনুস। ছেলেটাকে এর আগে দেখে নি। তবে আইনাতের সাথে গল্প করার সময় কিছুটা জেনেছে। তার ভাই মানসিক এবং শারিরীক প্রতিবন্ধী, হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে।

    মূর্তির মতো জমে গেলো সে। তার সামনে এক প্রতিবন্ধী বসে আছে হুইলচেয়ারে, সামনে একটু দূরে মেইনগেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র এক যুবক। এখনও ছোট্ট খোপ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটু শব্দ হলেই পেছনে ফিরে তাকাবে। কী করবে বুঝতে পারছে না বাস্টার্ড। ছেলেটা তাকে দেখে ফেলার আগেই আইনাতের ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই আচমকা প্রতিবন্ধী ছেলেটি পাশ ফিরে তাকালো তার দিকে!

    অধ্যায় ৬৭

    আসাদুল্লাহ আফগানি দু-চোখ কুচকে বাড়ির বাইরে তাকিয়ে আছে। একটু আগে মওলানাসাব তাকে কড়া নজর রাখতে বলার পর পর একটা প্রাইভেটকার এসে থেমেছে মেইনগেটের ঠিক বাইরে, রাস্তার ওপাড়ে। গাড়িতে কয়জন আছে বোঝা যাচ্ছে না কালো কাঁচ আর ইনসাইড-লাইট অফ করে রাখার কারণে, তাই গাড়ির ভেতর থেকে কেউ এই বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না।

    আরো মনোযোগ দিয়ে দেখে গেলো আসাদুল্লাহ। এরকম সন্দেহজনক কিছুর ব্যাপারে তাকে আগেই বলে দেয়া হয়েছে। তার মুরব্বিরা বলেছে, বাড়ির সামনে সন্দেহজনক লোকজন দেখলে সে যেনো তাদের জানায়, কিন্তু সন্দেহ করার মতো ঘটনা এখনও ঘটে নি এই গাড়িটা আসার আগপর্যন্ত।

    আসাদুল্লাহ জানে, এইসব বড়লোকদের এলাকায় গাড়ির মধ্যে অনেকেই মেয়েমানুষ নিয়ে একটু আধটু ফুর্তি করে। সুতরাং তাকে আরেকটু দেখতে হবে। পুরোপুরি নিশ্চিত না-হয়ে উপরতলায় যারা আছে তাদেরকে এটা জানানোর মানে নিজেকে হাস্যকর করে তোলা। ওরা এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছে। এরকম কাজের সময় খামোখা পেরেসানির মধ্যে ফেলাটা ঠিক হবে না। সম্ভবত এই গাড়িটা বড়লোকের নষ্ট আর ফুর্তিবাজ পোলাপানেরই হবে।

    কয়েক মুহূর্ত পরই গাড়িটা আস্তে করে সামনের দিকে চলে গেলো। আসাদুল্লাহ তারপরও খোপ থেকে চোখ না সরিয়ে দেখে গেলো নিবিষ্টভাবে। নজরদারি করার ব্যাপারটা খুব কঠিন। এতে ধৈর্য লাগে, সেই ধৈর্য তার ভালোই আছে। একটানা অনেকক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকেও সে ক্লান্ত হয় না, বিরক্ত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঠিক করলো গাড়িটা আবার ফিরে আসে কিনা দেখবে।

    *

    নিষ্পাপ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রতিবন্ধী ছেলেটি। অচেনা কাউকে দেখেও চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই। হাসি দেবার চেষ্টা করলো বাস্টার্ড। ছেলেটাও জবাবে হেসে দিলো। আঙুল তুলে মেইনগেটের দিকে দেখালো, চোখেমুখে অস্বাভাবিক ভঙ্গি করে কিছু বলার চেষ্টা করলো সে। বাস্টার্ড নিজের মুখে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ থাকার ইশারা করলো। ছেলেটা দু-হাত তুলে এমন ভঙ্গি করলো যেনো বুঝতে পেরেছে। তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে আঙুল দিয়ে পিস্তল আর গুলি করার ভঙ্গি করলো সে। বোঝাতে চাইলে গেটের সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে তার কাছে পিস্তল আছে। মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। বুকে হাত রেখে সেও পিস্তলের ভঙ্গি করলো।

    আমার কাছেও আছে।

    আইনাতের ভাই খুশিতে আটখানা। চোখেমুখে খুশির ঝলকানি।

    বাস্টার্ড আবারো তাকে চুপ থাকার ইশারা করে পিস্তলটা হাতে তুলে নিলো। আমি ওকে গুলি করবো, ওকে? এরকম একটি ভঙ্গি করার চেষ্টা করে চোখ টিপে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে মুখে আঙুল দিয়ে চাপা দিলো ছেলেটি। দারুণ মজা পাচ্ছে যেনো। সেও চোখ টিপে দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু সফল হলো না, চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেলো শুধু।

    বাস্টার্ড দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো ড্রাইভওয়ে দিয়ে, একেবারে নিঃশব্দে, প্রায় বেড়ালের মতো। মেইনগেট দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা লোকটি এখনও টের পায় নি।

    বড়জোর দশগজ!

    লোকটা এখনও গেটের খোপ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।

    পাঁচগজ!

    বাস্টার্ডের পিস্তলটা আস্তে করে উপরে উঠে গেলো।

    গুলি করার ঠিক আগেই লোকটা চমকে চমকে ঘুরে দাঁড়ালো। অবিশ্বাসের সাথেই দেখতে পেলো তার দিকে পিস্তল তাক করে এগিয়ে আসছে এক যুবক! আৎকে ওঠার আগেই তোতা শব্দটি হলো। পর পর দুটো। চাপা আর্তনাদ করে লোকটা মেইনগেটের দিকে ছিটকে গেলো। তার পিঠটা গেটে লাগতেই একটা শব্দ হলো কিন্তু সেটাও তেমন জোরে নয়। বাস্টার্ড পিস্তল তা করে অপেক্ষা করলো কয়েক মুহূর্ত।

    একটা গলার নীচে, আরেকটা বুকে। মোটা জ্যাকেটটা রক্তের ধারায় ভিজে যাচ্ছে। লোকটা পিস্তল হাতে নেবারও সময় পায় নি।

    ঠিক তখনই হাত তালির শব্দ শুনে চমকে তাকালো সে। আইনাতের ভাই হুইলচেয়ারে বসে হাততালি দিচ্ছে খুশিতে। তার চোখেমুখে সে কী আনন্দ!

    উফুলু এক দর্শক!

    সর্বনাশ!

    ছেলেটাকে আবারো চোখ টিপে দিয়ে মুখে আঙুল এনে চুপ থাকার ইশারা করলো সে, কিন্তু এবার তাতে কাজ হলো না। খুশিতে আকাশের দিকে মুখ করে অদ্ভুত ভঙ্গি করতে লাগলো প্রতিবন্ধী ছেলেটি।

    বুঝতে পারলো এর পেছনে সময় ব্যয় করে লাভ নেই। নিথর দেহটার দিকে মনোযোগ দিলো এবার। লোকটার জ্যাকেটের কলার ধরে টেনে-হিঁচড়ে মেইনগেটের বামপাশে সীমানা প্রাচীরঘেষা একটি বড় গাছের নীচে রেখে দিলো। বড়বাড়িটার মেইনগেটের কাছে আসতেই দেখতে পেলো মওলানার ছেলে এখনও খুশিতে বিভিন্ন ধরণের অঙ্গভঙ্গি করে যাচ্ছে।

    বড়বাড়ির নীচতলায় এসে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো সে। কেউ নেই। পিস্তলটা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেলো ঘরের শেষ মাথায় থাকা সিঁড়িটার দিকে। সিঁড়ির পাশে আরেকটা দরজা। সেটা ভোলাই আছে। ভেতরে উঁকি মেরে দেখলো ঘরটা একদম খালি। দুই সারির সতরঞ্জি বিছানো। বুঝতে পারলো, এটা সেই নামাজঘর। তার মানে মওলানা আবারো উপরে চলে গেছে। পা টিপে টিপে খুব সাবধানে উঠে গেলো দোতলায়।

    সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের পরই একটা দরজা। সেটা বন্ধ কিনা তার জানা নেই। দরজায় কোনো পিপহোলও দেখা যাচ্ছে না। আস্তে করে দরজার নবে হাত রেখে মোচড় দিলো। লক্ করা নেই। তার জন্য সুসংবাদ। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে বোঝার চেষ্টা করলো ভেতরে কারা আছে।

    দু-জন মানুষের কথা ভেসে আসছে কিন্তু সেটা খুবই ক্ষীণ। সম্ভবত ভেতরের কোনো ঘর থেকে। দরজার ফাঁক দিয়ে এবার উঁকি দিলো সে। ঘরটা খুব কমই আলোকিত। তবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সামনের ঘরে কেউ নেই। আস্তে করে ঢুকে পড়লো বাস্টার্ড। দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে বেশ সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো দু-জন মানুষের কথাবাতার আওয়াজ অনুসরণ করে। সামনের ঘরটার পরই একটা ছোটো হলওয়ে, সেই হলওয়ের ডানদিকে একটি খোলা দরজা দিয়ে কথাগুলো ভেসে আসছে। বুঝতে পারলে আইনাতের ঘর থেকে এই ঘরটার জানালাই দেখেছে সে।

    চুপিসারে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

    “ভাই আব্দুল, মিডিয়া তো তোমাদের অ্যাকশনকে ৯/১১-এর সাথে তুলনা করছে…” কণ্ঠটা খুবই আমুদে। “টিভি নিউজে বলছে গতরাতে একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছে, বুঝলে?”

    উর্দু পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এই কথপোকথনটি বুঝতে তেমন অসুবিধা হলো না বাস্টার্ডের।

    “আমরা এখন দশ-এগারো তলায় আছি,” ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো এবার। স্পিকার মোড়ে দেয়া আছে ফোনটি, যাতে ঘরের অন্যেরাও শুনতে পায়। “পাঁচজন জিম্মি আছে আমাদের কজায়।”

    “মিডিয়ায় সব দেখানো হচ্ছে,” আমুদে কণ্ঠটি বললো আবার। যতোদূর সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি করো। লড়াই চালিয়ে যাও। কাউকে জীবিত রেখো না।” একটু বিরতি দিয়ে আবারো বললো সে, “মুসলিম দু-জন বাদে জিম্মিদের সবাইকে মেরে ফেলো। তোমাদের ফোন চালু রেখে যাতে আমরা গুলির শব্দ শুনতে পাই।”

    “তিনজন বিদেশী আছে, তার মধ্যে একজন নারী,” জবাব ভেসে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। “তারা সিঙ্গাপুর আর চায়নার।”

    “খতম করে দাও ওদের।” হুকুম দিলো ঘরে থাকা লোকটি।

    তারপরই গুলির শব্দ হলো ফোনের ওপাশ থেকে। মুচকি হাসি শোনা গেলো ঘরে। দু-জন মানুষ নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে কথা বলছে খোশ মেজাজে। তারপরই আবারো নির্দেশনা : “নীচের তলায় যাবার চেষ্টা করো এবার।”

    দরজার পাশে লুকিয়ে থেকে বাস্টার্ড আতঙ্কের সাথেই বুঝতে পারলো ঘটনাটি।এরা মুম্বাই হামলার সাথে জড়িত! অবিশ্বাস্য মনে হলো তার কাছে। মওলানা ইউসুফ হোসাইনী তার নিজের বাড়িতে যে মেহমানদের খাতির করছে দু-দিন ধরে তারা আসলে মুম্বাইয়ের হামলাকারীদের হ্যান্ডলার! এ-কারণেই হামলার পর পর রাতের বেলায় এইসব মেহমান চলে এসেছে মওলানার বাড়িতে। গেটের কাছে একজন সশস্ত্র প্রহরীও রেখেছে।

    মওলানা ইউসুফ হোসাইনী আসলে কি করে? কোন্ সংগঠনের সাথে জড়িত? তার মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। কী ভয়ঙ্কর ঘটনা! ঠাণ্ডা মাথায় সাধারণ মানুষজন হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে টেলিফোনে!

    মুম্বাই হামলার খবর সে খুব একটা রাখতে পারে নি কারণ ঘটনার পর পরই সে মওলানার বাড়িতে আটকা পড়ে। এই ঘটনা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামায় নি, কেননা তার নিজের মিশনটা বার বার জট পাকিয়ে যাচ্ছিলো। করাচিতে এসে একাত্তরের এক ঘাতককে হত্যা করতে এসে অযাচিতভাবে কোথায় ঢুকে পড়েছে সে!

    “নীচতলায় যাও ভাই আব্দুল…” আবারো নির্দেশ দেয়া হলো। “…টিভিতে দেখতে পাচ্ছি ওখানে অনেকে আছে এখনও…কাউকে বাঁচিয়ে রেখো না। মৃত্যুর আগপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও!”

    গভীর করে দম নিয়ে নিলো বাস্টার্ড। পিস্তলটা দু-হাতে ধরে বিদ্যুৎগতিতে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতরে। দু-জন মাঝবয়সি লোক বসে আছে সোফায়। তাদের সামনে একটা ফোন। তাকে পিস্তল হাতে ঢুকতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো হ্যান্ডলার দু-জন। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে। একজন সিগারেট চেপে রেখেছে ঠোঁটে, তার সিগারেটটি টুপ করে ঠোঁট থেকে পড়ে গেলো। বিস্ময়ে চেয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে। একেই তো সৈকতে দেখেছে!

    লোকটার চেহারা দেখে বাস্টার্ডেরও কেমন চেনা চেনা মনে হলো, কিন্তু তার মনোযোগ টার্গেটকে নিয়ে তাই এ নিয়ে খুব একটা ভাবলো না। হতাশ হয়েই সে দেখতে পাচ্ছে ঘরে মওলানা নেই।

    “মওলানা ইউসুফ হোসাইনী কোথায়?” ইংরেজিতেই বললো সে।

    ফোনে কথা বলছিলো যে লোকটা সে ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো তার দিকে।

    “ইউসুফ হোসাইনী কাহা?” আবারো প্রশ্নটা করলো সে, তবে এবার হিন্দিতে।

    বিস্ময়ে নিজের সঙ্গির দিকে তাকালো লোকটি। “কাফা! এই লোকটাই ঐদিন বিচে পিস্তল নিয়ে এসেছিলো! এটা তো ওদের লোক!”

    কাফা হতভম্ব হয়ে গেলো কথাটা শুনে। হিন্দুস্তানী এজেন্ট মওলানার বাড়িতে ঢুকে পড়েছে!

    ওয়াসির সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করলো। বাস্টার্ড দেখতে পেলো লোকটা তার কোমরে হাত দিতে যাচ্ছে।

    দেরি না করে গুলি চালিয়ে দিলো সে।

    পর পর দুটো ভোতা শব্দ হলো কেবল।

    অধ্যায় ৬৮

    মওলানা ইউসুফ হোসাইনী আজ অনেকদিন পর ছোটোবাড়িতে ঢুকছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী বেঁচে থাকতে প্রায়ই এখানে আসা হতো, কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের পর শেষ কবে এসেছিলো মনে নেই। বর্তমানে এখানে থাকে তার দু-সন্তান। ওদের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ বহন করে। ওদের জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছে, কিন্তু নির্মম সত্যি হলো, এই পক্ষের দু-সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক মোটেও স্বাভাবিক নয়। একজনকে তো আল্লাহপাক এমন করে পাঠিয়েছেন যে, তার সাথে সম্পর্ক রাখলেই কি না রাখলেই বা কি। পরিবার, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এসব বিষয় তার বোঝার সাধ্য নেই। আর অন্যজন আইনাত, এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটার সাথে তার সম্পর্ক ভালোই ছিলো। তার সব আব্দার মেটানোর চেষ্টা করেছে। লন্ডনে পড়াশোনা করার বায়না যখন ধরলো তখন তার ছেলেদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজি হয়েছিলো। কিন্তু নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাঙ্গুওয়ালার ছেলের সাথে বিয়ে দেবার পর থেকেই বাবা-মেয়ের সম্পর্ক বিগড়ে যায়।

    বড়বাড়ি আর ছোটোবাড়ির মধ্যে যাতায়াতের জন্য আরেকটি সরু পথ আছে। বড়বাড়ির নীচতলার নামাজঘরের একটি দরজা দিয়ে সীমানা প্রাচীর ঘেষে একটি গলি চলে গেছে ছোটোবাড়িটার পশ্চিমদিকে। এই পথ দিয়েই কাজের লোকেরা বড়বাড়িতে খাবারসহ দরকারি জিনিস আনা-নেয়ার কাজ করে। আজকে এই পথটি ব্যবহার করার কারণ ইউনুস। তার এই প্রতিবন্ধী ছেলেটার সামনে পারতপক্ষে সে পড়তেই চায় না। যেনো ছেলেটার মুখোমুখি হলেই তার মনে হয় কোনো এক গোপন পাপের ফল ভোগ করছে!

    নীচতলার করিডোর দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই এক কাজের মহিলা তাকে দেখতে পেয়ে সম্ভ্রমে সালাম ঠুকলো। মওলানাকে এ-পথ দিয়ে যেতে দেখে সে কিছুটা বিস্মিত।

    “ইউনুস বাইরে আছে…ওকে ঘরে নিয়ে যাও,” গম্ভীর মুখে বললো মওলানা। আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। চাপা রাগে তার সারা শরীর কাঁপছে। বখে যাওয়া মেয়ের কারণে তাকে অনেক অপমান হতে হয়েছে। “স্তান বলে মুখ বুজে সব সহ্যও করেছে সে, কিন্তু এখন এই মেয়ে না-বুঝে এমন একজনের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করে দিয়েছে যে কিনা মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।

    দোতলার ল্যান্ডিংয়ে এসে হাপিয়ে উঠলো। বয়স হয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ই এটা সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায়। আইনাতের ফ্ল্যাটের দরজায় নক করতে যাবে অমনি থেমে গেলো। দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। মওলানা ইউসুফ তারপরও ভেতরে ঢুকে পড়লো না, খোলা দরজায় কয়েকটা টোকা মারলো। নিজের সন্তান হলেও মেয়েছেলে বড় হয়ে গেলে হুটহাট করে তার ঘরে ঢোকা যায় না।

    “আইনাত?” কোনো সাড়াশব্দ নেই। “আইনাত?” একই ফল। এবার আর অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লো ভেতরে। ফ্ল্যাটটা অন্ধকারে ঢেকে আছে।’ দরজার পাশে সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিলো সে।

    ড্রইংরুমটা একটু এলোমেলো। কফি টেবিলের উপরে ট্রে, ফ্লাস্ক, সুগার কিউবের পট, কফিমেট, কফির কাপ আর পিৎজার একটি খালি প্যাকেট। ঘরের চারপাশে তাকালো। বেডরুমের দরজা পুরোপুরি খোলা। সেদিকে পা বাড়াবে অমনি থমকে গিয়ে কফি টেবিলের দিকে তাকালো আবার।

    দুটো কফি কাপ!

    ভুরু কুচকে গেলো তার। আইনাত একা থাকে। দরকারে কাজের লোকদের ডাকে, নইলে তার ফ্ল্যাটে কেউ ঢোকে না। মেয়েটার প্রাইভেসি জ্ঞান টনটনে। এ বাড়ির কেউ তাকে খুব একটা ঘাটায়ও না। কাজের লোক ছাড়া কেউ তার ফ্ল্যাটে আসার কথা নয়, তাহলে দুটো কফির কাপ কেন?

    আইনাতের বেডরুমে ঢুকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালাতেই বিছানায় মেয়েকে দেখতে পেলো। ঘুমাচ্ছে। “আইনাত?” বেশ গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলো সে। “আইনাত!” এবার বেশ জোরে। “আইনাত!”

    তার মেয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু সে ভালো করেই জানে আইনাতের ঘুম খুবই পাতলা। সামান্য খুটখাট শব্দেই এই মেয়ের ঘুম ভেঙে যায়। ছোটোবেলা থেকেই তার এমন স্বভাব। মেয়ের কপালে হাত রাখলো। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে আছে সে। “আইনাত?” আরো একবার ডাকলো মওলানা। এবার মেয়ের কাঁধ ধরে আলতো করে ঝাঁকুনি দিলো। “আইনাত! ওঠো…তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে!”

    চিন্তিত হয়ে উঠলো মওলানা ইউসুফ হোসাইনী। এটা একদম স্বাভাবিক নয়। তার মেয়ে যতো গাঢ় ঘুমই দিক না কেন এতোক্ষণে উঠে যাবার কথা। কোনো মানুষ এভাবে মরার মতো পড়ে ঘুমায় না। মেয়েকে দু-হাতে ধরে আবারো ঝাঁকুনি দিলো, গালে চাপড় মারলো বেশ কয়েকটা। “আইনাত?”

    “হু-উ-উ-ম?” গোঙানির মতো করে বলে চোখের পাপড়ি টেনে খোলার চেষ্টা করলো তার মেয়ে।

    “আইনাত!”

    মওলানা ইউসুফ বুঝতে পারলো তার মেয়ে নেশাজাতীয় কিছু খেয়েছে। দ্রুত অ্যাটাচড বাথরুমে চলে গেলো। তোয়ালেটা বেসিনের ট্যাপে ভিজিয়ে ফিরে এলো মেয়ের কাছে। ভেঁজা তোয়ালে দিয়ে তার চোখ-মুখ মুছে দিলো।

    “আইনাত?” গালে আবারো চাপড় মারলো কয়েকটা।

    “ত-ও-ফি-ক?” আধোঘুমের মধ্যেই টেনে টেনে বললো সে। “বা-বাতি নি-নিভিয়ে দাও…” শেষ কথাটা ইংরেজিতে বললো আইনাত।

    “কি!?” মওলানার মনে হলো তার শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো আচমকা। “কি বলছো?” উঠে দাঁড়ালো সে।

    আবারো গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো তার মেয়ে।

    মওলানার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো। সারা শরীর কাঁপছে এখন। “ওই লোকটা এখানে…??” কথাটা বিশ্বাস করতে এখনও বেগ পাচ্ছে যেনো।

    আইনাতের দিক থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া গেলো না।

    “হায় আল্লাহ্!” অস্কুটস্বরে বলে উঠলো মওলানা।

    বিপদের গন্ধ টের পেয়ে বেডরুম থেকে দ্রুত বের হয়ে গেলো সে, কিন্তু ড্রইংরুমের মাঝখানে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। তাকে দেখে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না। মাত্র কয়েকদিন আগেই এই মুখটা দেখেছে। মূর্তির মতো জমে গেলো মওলানা ইউসুফ হোসাইনী।

    “তুমি?!”

    অধ্যায় ৬৯

    দু-জন হ্যান্ডলারের মধ্যে ফোনে যে কথা বলছিলো না তার কাছে অস্ত্র ছিলো। কিন্তু আচমকা অস্ত্রহাতে একজনকে ঘরে ঢোকার পর তার নার্ভ নিশ্চয় ভেঙে পড়েছিলো নইলে বোকার মতো কোমরে হাত দিয়ে অস্ত্র বের করে আনার চেষ্টা করতো না। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে এই লোকটাকে নির্জন বিচে দেখেছে সে! লোকটাও তাকে চিনতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেছে। ওরা মনে করেছে সে একজন হিন্দুস্তানী এজেন্ট! সম্ভবত এই কারণেই নাভার্স হয়ে তড়িঘড়ি করে কোমর থেকে অস্ত্র নেবার মতো ভুল করে ফেলেছে হ্যান্ডলার লোকটি।

    এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে বাস্টার্ড মাথা ঠাণ্ডা রেখে কিছু কৌশল খাটাতো। মনোযোগ সামান্য সরিয়ে দেয়া। কিছু কথা বলে সময় নষ্ট করা। বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। পাজল করা। ধোঁকা দেয়া। কতো কিছুই তো করার আছে।

    কিন্তু যে লোকগুলো টেলিফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলো কিভাবে সুদূর মুম্বাইতে খুন-খারাবি করতে হবে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে হবে তারা এরকম কিছু। করে নি বলে সে অবাকই হয়েছে। এরা নিরীহ লোকজনের হত্যাকাণ্ড ফোনের এ প্রান্ত থেকে শুনে আমোদিত হচ্ছিলো, অথচ একজন অস্ত্রধারী যুবককে দেখে যারপরনাই ভড়কে যায়।

    তার দুটো গুলিতে ধরাশায়ী হয়ে যায় কাফা আর নাম না-জানা অন্য লোকটি। কাফা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় নি, কারণ গুলিটা তার বুকে বিদ্ধ হয়। তবে নাম না-জানা হ্যান্ডলার ঘোৎ করে একটা শব্দ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি। লোকটার বাম কপালে, ঠিক চোখের উপরে গুলিটা বিদ্ধ হয়। সোফাতেই হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকে সে। কাফার বুকে ডানপাশে গুলিটা লাগলে যন্ত্রণাকাতর চিৎকার দিয়ে ওঠে কিন্তু বাস্টার্ডের পিস্তলের নল তার মাথা বরাবর তা করা হলে জোর করে নিজেকে চুপ রাখতে বাধ্য হয় লোকটা।

    হিন্দিতেই জানতে চেয়েছিলো মওলানা কোথায়।

    “একটু আগে নীচে গেছে…উপরে আর আসে নি…” যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো কাফা।

    সে-ও দেখেছে মওলানাকে নীচে নামতে কিন্তু অল্প কিছু সময়ের জন্য, তারপর আবার বড়বাড়িতে ঢুকে পড়তে দেখে লোকটাকে।

    “সত্যি করে বললো, মওলানা কোথায়?” আহত লোকটার কাছে আবারো জানতে চেয়েছিলো সে।

    “সত্যি বলছি…” কথাটা বলার সময় কাফার সারা শরীর কাঁপছিলো।

    অবিশ্বাঙ্গে হ্যান্ডলারের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তার ধারণা মিথ্যে বলছে লোকটা। তার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে আবারো জানতে চায় মওলানা কোথায়।

    “সত্যি বলছি…”

    কাফা যখন এটা বলে ঠিক তখনই তার চোখ যায় আহত লোকটার পেছনে বড় জানালার দিকে। জানালার পর্দা একটু সরানো ছিলো। সেই ফাঁকটুকু দিয়ে সরাসরি আইনাতের ফ্ল্যাটের জানালাগুলো দেখা যায়। অবাক হয়ে সে দেখতে পায়, ফ্ল্যাটের ভেতরে আলো জ্বলে উঠছে। ঐ ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় সব বাতি বন্ধ করা ছিলো। তাহলে কেউ বাতি জ্বালিয়েছে? কিন্তু কে? আইনাতের পক্ষে এতো জলদি জেগে ওঠা অসম্ভব।

    তারপরই জানালা দিয়ে আইনাতের ঘরে একটা অবয়ব দেখতে পায়। খুব অল্প সময়ের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যায় কাফার কাছ থেকে যেটা জানতে চাইছে সেটার কোনো দরকার নেই। কিন্তু মওলানা ইউসুফ কিভাবে ছোটোবাড়িটাতে চলে গেলো বুঝতে পারে নি।

    কাঁধ তুলে আহত কাফাঁকে সে বলে, “শুকরিয়া…তুমি সত্যিই বলেছো।” তারপরই লোকটার কপালে একটা গুলি করে দেয় সে।

    দ্রুত বড়বাড়ির দোতলা থেকে নীচে নেমে আসে। বাড়িতে কোনো মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। কাজের লোকেরা সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। না ডাকলে ওখান থেকে সচরাচর বের হয় না তারা। বাস্টার্ড এগিয়ে যায় ছোটোবাড়িটার দিকে। হুইলচেয়ারে বসে থাকা আইনাতের ছোটোভাইকে আর সেখানে দেখতে পায় না। কাজের লোকজন হয়তো তাকে আবার ঘরের ভেতরে নিয়ে গেছে।

    পিস্তলটা হাতে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখতে পায় মওলানা বের হয়ে আসছে আইনাতের বেডরুম থেকে। তাকে দেখেই মওলানা চিনতে পারে। অনেকদিন পর নিজের মাতৃভাষায় কথা বলে উঠে একাত্তরের ঘাতক।

    “তাহলে মায়ের ভাষাটা পুরোপুরি ভুলে যান নি!”

    বাঁকাহাসি দিয়ে আস্তে করে দু-পা সামনে এগিয়ে গেলো বাস্টার্ড। মওলানার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেখে দারুণ অবাক হলো সে।

    “কার পাসপোর্ট এটা?”

    মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর মুখে আতঙ্ক। কথা না বলে পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। তার সেই বাড়িয়ে দেয়া হাত পার্কিনসন্স ডিজিজের রোগির মতোই কাঁপছে।

    পিস্তলটা মওলানার বুকের দিকে তাক্ করেই পাসপোর্টটা বাম হাতে নিয়ে নিলো। “আমার পাসপোর্ট?!” অবিশ্বাসে বলে উঠলো সে। “এটা আপনার কাছে কিভাবে এলো?”

    “মানসুর দিয়েছে,” নির্ভুল বাংলায় জবাব দিলো। “আইনাতের স্বামী।”

    মানসুর! বিস্মিত হলো বাস্টার্ড। তার হোটেলরুম থেকে তাহলে সবই বেহাত হয়ে গেছে! পাসপোর্টটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো।

    “তোমাকে ঐ জামিল আহমেদ পাঠিয়েছে?” নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে জানতে চাইলো মওলানা।

    মুচকি হাসলো সে। “অবশ্যই।”

    “কিন্তু কেন? আমি তার কি করেছি?”

    “আপনি এখনও জানেন না সে কে?”

    ভুরু কুচকালো মওলানা। “কে? হিন্দুস্তানী এজেন্ট?”

    বাঁকাহাসি দিলো বাস্টার্ড। “হিন্দুস্তানী এজেন্ট ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন না দেখছি!”

    কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখালো মওলানাকে।

    “একটু পেছনে ফিরে যান…অতীতের কথা ভাবুন, মি: ইউসুফ আলী।”

    এই নামটা শুনে চমকে উঠলো একাত্তরের ঘাতক।

    “বহু পুরনো ঘটনা যদিও…আশা করি ভুলে যান নি।”

    মওলানা ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো।

    “একাত্তরের ১৩ থেকে ১৪ই ডিসেম্বর অনেক লোককেই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছিলেন…সে-কথা কি ভুলে বসে আছেন?”

    বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলো একাত্তরের ঘাতক।

    “জামিলের বাবা ছিলেন তাদেরই একজন।”

    অবিশ্বাসে তাকালো এক সময়কার ইউসুফ আলী।

    এবার বাস্টার্ডের চোখ গেলো মওলানার বামহাতের দিকে। কড়ে আঙুলের পাশে ছোট্ট একটা টেপ-ব্যান্ডেজ। “ঐ আঙুলটা করে ফেলে দিলেন?”

    চমকে উঠলো মওলানা। আনমনেই ডানহাত দিয়ে বামহাতের ব্যান্ডেজটা ধরে ফেললো। তার ষষ্ঠ আঙুলের খবরও এই লোক জানে বলে যারপরনাই বিস্মিত।

    বাঁকাহাসি ফুটে উঠলো বাস্টার্ডের মুখে। “আরো আগে ফেলে দিলে ভালো করতেন,” একটু থেমে আবার বললো, “একটু দেরিতে ফেলেছেন, ইউসুফ আলী।”

    মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো মওলানা। হয় কোনো কথা বলার শক্তি নেই, নয়তো বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না এ-মুহূর্তে।

    “বলতে পারেন ঐ আঙুলটাই আপনার দুর্ভাগ্য ডেকে নিয়ে এসেছে!”

    মওলানার চোখে আতঙ্ক আর বিস্ময়। তারচেয়েও বেশি জিজ্ঞাসা। কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারলো না।

    বামহাত দিয়ে পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে নিলো বাস্টার্ড। “আসলে একটু আগে এই আইডিয়াটা আপনাদের কাছ থেকেই পেয়েছি…দারুণ আইডিয়া…আই লাইক ইট!”

    মওলানা ইউসুফের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো। বুঝতে পারছে না তার সামনে যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে সে কি করতে চলেছে।

    একটা নাম্বারে ডায়াল করলে চারবার রিং হবার পর কলটা রিসিভ করা হলো।

    “হ্যালো?” বারো শ’ মাইল দূরের কণ্ঠটা হতবুদ্ধিকর শোনালো।

    “জামিল আমেদ?”

    “হ্যাঁ…কে বলছেন?”

    “আমি করাচি থেকে বলছি…আশা করি চিনতে পেরেছেন।”

    একটু বিরতি, তারপরই ওপাশ থেকে বললো ভদ্রলোক। “হ্যা…অবশ্যই। বলেন, কি খবর?”

    “আপনার বাবার ঘাতক ইউসুফ আলী এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

    “কি!” ফোনের অপরপ্রান্তের কণ্ঠটা অবিশ্বাসে বলে উঠলো।

    মওলানার দিকে তাকালো সে। রীতিমতো কাঁপছে। দু-চোখে অবিশ্বাস আর বিস্ময়। “আপনি কি তার সঙ্গে কথা বলবেন?”

    ওপাশে নীরবতা নেমে এলো।

    “সরি…কিছু মনে করবেন না,” মওলানার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললো সে, “এটা আমার প্ল্যানের মধ্যে ছিলো না, কিন্তু সুযোগ যখন পাওয়া গেলো তখন ভাবলাম আপনি আপনার বাবার ঘাতকের সাথে একটু কথা বললে হয়তো খারাপ হয় না।”

    ওপাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেলো। যেনো কথাটা হজম করতে পেরেছে জামিল আহমেদ। “ঠিক আছে…দিন।”

    বাস্টার্ড মুচকি হেসে ফোনটা স্পিকার মোডে দিয়ে মওলানার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “কথা বলুন।”

    কাঁপতে থাকা হাতেই ফোনটা নিয়ে কানে চাপলো একাত্তরের ঘাতক।

    “ইউসুফ আলী…” ফোনের ওপাশ থেকে জামিল আহমেদের কণ্ঠটা বলে উঠলো। “…আমি শহীদ ডাক্তার শাফকাত আহমেদের একমাত্র সন্তান…প্লেনে আমাদের দেখা হয়েছিলো…সাইত্রিশ বছর পর।”

    “আ-আমি আপনার বাবাকে খুন করি নি…অবশেষে মওলানার মুখে বোল ফুটলো। “…বিশ্বাস করুন…ঐ ইউসুফ আর আমি এক ব্যক্তি না!…আপনাকে যারা এ কথা বলেছে তারা মিথ্যে বলেছে…ভুল বলেছে…সব প্রোপাগাণ্ডা…এসব কথার কোনো প্রমাণ নেই…কিছু নেই!…ঐ সময় আমি ঢাকাতেই ছিলাম না…এ-ব্যাপারে অনেক সাক্ষী আছে…অনেক সাক্ষী!…আপনি চাইলে-”।

    “চুপ কর শূয়োরেরবাচ্চা!” রেগেমেগে বললো জামিল আহমেদ। “…আমি নিজের চোখে দেখেছি তোকে! কোনো সাক্ষী-প্রমাণের দরকার নেই আমার।” একটু থেমে আবার বললো, “তুই আমাদের বাড়ির সামনে একটা জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস…সিগারেট খাচ্ছিস! তোর মুখ…তোর বামহাতের ছয়টি আঙুল…তোর চাহুনি…সব আমার মনে গেঁথে আছে!”

    মওলানার চোখেমুখে মৃত্যু আতঙ্ক জেঁকে বসলো যেনো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘাতকের দিকে তাকালো।

    “তুই ভেবেছিলি কোনোদিন তোর বিচার হবে না। তুই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবি! তোর পেয়ারে পাকিস্তানে থাকলে তোকে কেউ কিছু করতে পারবে না।”

    মওলানার শ্বাস-প্রশ্বাস আরো বেড়ে গেলো। বাস্টার্ড খেয়াল করলো লোকটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে দিয়েছে।

    “কি ভাবছিস?…সাইত্রিশ বছর আগের ঘটনা…ঐসব গণ্ডগোলের কথা ভুলে যাওয়া উচিত আমার?…আমাদের!” জামিল আহমেদ একটু থেমে দম নিয়ে নিলো। “কিন্তু কেমনে ভুলি?…বিচার হয়ে গেলে…ঘাতকেরা শাস্তি পেয়ে গেলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতাম…কিন্তু সেটা তো হয় নি…তোরাও মাফ চাস নি কখনও…বরং বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস ঢাকা, লন্ডন, করাচিতে!”

    “মি: জামিল, একটু জলদি করুন।” জোরেই বললো বাস্টার্ড যেনো তার কথাটা ফোনের ওপাশে শোনা যায়।

    কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো জামিল আহমেদ। তারপর বেশ শান্তকণ্ঠে ঘোষণা করলো সে : “কোনো আদালত তোর বিচার করতে না পারলেও আমি নিজে সেটা করবো এখন।” গভীর করে দম নেবার শব্দ শোনা গেলো ফোনের ওপাশ থেকে। “আমার বাবার মতো আরো অসংখ্য শহীদের পক্ষ থেকে, আমি তোকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম!”

    ফোনটা কান থেকে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো মওলানা। “না!”

    সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি ভোতা শব্দ বিদীর্ণ করলো একাত্তরের ঘাতকের কণ্ঠ। গুলির অভিঘাতে একটু পিছিয়ে গেলো, টলতে টলতে দু-হাতে নিজের গলা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো সে। ফিনকি দিয়ে তার দু-হাতের আঙুলের ফাঁক গলে রক্তধারা বেরিয়ে আসছে। মুহূর্তে তার সফেদ চাপদাড়ি, সাদা আচকান, ঘিয়েরঙা কোটি রক্তে লাল হয়ে গেলো। গলা দিয়ে অস্ফুট আর চাপা গোঙানি ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না। দু-চোখ যেনো কোটর থেকে ঠিকরে বের হয়ে যেতে চাইছে।

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড। একদম কাছ থেকে তিনটি গুলি করেছে। সবগুলোর লক্ষ্যই ছিলো ঘাতকের গলা। একটাও ব্যর্থ হয় নি। বুক আর গলার সংযোগস্থলে যে গুলিটা বিদ্ধ হয়েছে ওটাই তার প্রাণ হরণ করবে। আস্তে করে সামনে এগিয়ে উপুড় হয়ে মেঝের কার্পেট থেকে ফোনটা তুলে নিলো সে।

    “হ্যালো?”

    “হ্যাঁ…বলেন?”

    “মিশন অ্যাকম্প্রিড!…পরে কথা হবে।”

    ফোনটা কেটে দিয়ে মওলানার শেষ কিছু সেকেন্ড ভিডিও করে নিলো। তারপর দ্রুত আইনাতের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেলো সে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিস্তলটা রেখে দিলো জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে।

    ছোটোবাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা মেইনগেটের দিকে এগিয়ে গেলো। কাজের লোকজন তাকে দেখলো কি না দেখলো সে-সব পরোয়া করলো না। এখন তার একটাই কাজ, এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া। আর সেটা তেমন কঠিন কিছু না।

    মেইনগেটের সামনে এসে দেখতে পেলো পাশের যে ছোটো গেটটা দিয়ে মানুষজন চলাচল করে সেটাতে কোনো তালা নেই। ছিটকিরি দিয়ে আটকানো। আস্তে করে সেটা খুলে বাইরে বের হতেই তার দু-চোখ ঝলসে গেলো তীব্র আলোতে। সেইসাথে বেজে উঠলো হর্ন। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে গেটের দিকে!

    কপালের উপরে হাত রেখে দেখার চেষ্টা করলো সে।

    আইনাতের বড়ভাই ইয়াকুব! ড্রাইভিং সিট থেকে উৎসুক হয়ে তাকে দেখছে।

    দ্রুত জ্যাকেটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো বড় বড় পা ফেলে। মওলানার ছেলে বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করলো কিন্তু সিটবেল্ট বাধা বলে সুবিধা করতে পারলো না।

    ড্রাইভি ডোরের কাঁচ নামিয়ে রেখেছে বলে সেখান দিয়ে অনায়াসে পিস্তলটা তাক করে ট্রিগার টিপে দিলো। ভোতা দুটো শব্দ চাপা পড়ে গেলো অস্ফুট আর্তনাদে। সিটের উপর পড়ে গেলো ইয়াকুব, একটু কেঁপেই নিস্তেজ হয়ে গেলো তার দেহটা।

    কপালে আর বুকে দুটো গুলিই তার প্রাণ সংহার করে ফেললো চোখের নিমেষে।

    পিস্তলটা জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে রেখে আশেপাশে চকিতে দেখে নিলো বাস্টার্ড। অভিজাত এলাকা। যেমন পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো তেমনি নিরিবিলি। ডানদিকে, পঞ্চাশ গজ দূরে রাস্তার পাশে একটা প্রাইভেটকার পার্ক করে রাখা আছে। এছাড়া পুরো রাস্তাটাই ফাঁকা। একেবারে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হেঁটে চলে গেলো বাড়িটা থেকে যতোদূর চলে যাওয়া যায়।

    ইয়াকুবকে মারার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না কিন্তু সামনে পড়ে যেতেই দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় : আইনাতের মুক্তি নিশ্চিত করা দরকার।

    হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে এসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করলো সে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলো না, একটু দূরে পার্ক করে রাখা গাড়ির ভেতর থেকে তিনজন মানুষ মওলানার বাড়ির মেইনগেটের সামনে যা ঘটেছে তার সবটাই দেখে ফেলেছে।

    *

    গুলজার-এ-হিজরির তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ি থেকে সামান্য দূরে, রাস্তার উপরে পার্ক করে রাখা গাড়িতে বসে হতবাক হয়ে আছে জাগদীশ। এইমাত্র যে দৃশ্যটা সে দেখেছে সেটা কোনোভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না তার।

    একটু আগে বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর দিল্লিতে তার কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে। লস্কর-এ-তৈয়বার দু-জন হ্যান্ডলার ঠিক কোন্ বাড়িতে বসে মুম্বাইর হামলাকারীদের গাইড করে যাচ্ছে সেটা জানিয়েছে উর্ধতন কর্মতাকে। এতো দ্রুত সফলভাবে হ্যান্ডলারদের অবস্থান চিহ্নিত করাতে কন্ট্রোল খুবই বিস্মিত হয়, কিন্তু জাগদীশের কাছ থেকে বাড়িটার বর্ণনা শুনে দ্বিধায় পড়ে যায় সে। মাত্র দু-জন এজেন্টকে-হোক না তারা অভিজ্ঞ আর দক্ষ-লস্করদের ডেরায় ঢুকিয়ে ‘স্যাবোটাজ করতে বলার মানে আত্মঘাতি মিশনে পাঠানো। এদিকে হ্যান্ডলার দু-জনকে ‘নিউট্রাল করাটাও ভীষণ জরুরি। কন্ট্রোল যে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরে জাগদীশই প্রস্তাব করে তার সঙ্গে থাকা দুটো হ্যান্ডগ্রেনেড ঐ বাড়িতে চার্জ করতে পারবে। এতে করে হয়তো হ্যান্ডলাররা মারা পড়লেও পড়তে পারে। কন্ট্রোল এই প্রস্তাবে রাজি হলে ফোনটা রাখতে না রাখতেই কুনাল জানায় ঐ বাড়িতে একটা গাড়ি ঢুকছে। সেদিকে তাকাতেই বিস্ময়ের সাথে দেখে লম্বা-নলের পিস্তলহাতে এক যুবক ছোটোগেটটা খুলে বের হয়েই গাড়ির ভেতরে থাকা একজনকে গুলি করে মেরে ফেললো চোখের নিমেষে! খুনি এতোটাই শক্ত নার্ভের যে খুনটা করার পরও কোনোরকম ঘাবড়ে না গিয়ে, স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে চলে গেলো।

    “কি হলো এটা?”

    কুনালের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলো জাগদীশ।

    কাঁধ তুললো সে। “কিছুই বুঝতে পারছি না।”

    সুরাইয়াও দৃশ্যটা দেখেছে তবে যথারীতি কোনো প্রশ্ন করছে না মেয়েটি।

    জাগদীশ দ্বিতীয় চিন্তা না করে আবারও ফোন করলো তার কন্ট্রোলের কাছে। এবার সংযোগ পেয়ে গেলো একবারেই। সংক্ষেপে এবং দ্রুত জানালো কি হয়েছে। তাকে অবাক করে দিয়ে অভিজ্ঞ কন্ট্রোল জানালো, এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তারা যেনো এক্ষুণি ঐ এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

    জাগদীশ ফোনটা রেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তার কেনজানি মনে হচ্ছে ঐ যুবকের ব্যাপারে কন্ট্রোল অবগত আছে।

    “এখানে থেকে লাভ নেই, চলো ফিরে যাই,” অবশেষে কুনালকে বললো সে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেক্সট (বেগ-বাস্টার্ড – ৬) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }