Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প173 Mins Read0

    সভাপর্ব

    স্বামী রঙ্গনাথানন্দ ভালো বক্তা শুনেছিলুম। কত ভালো, তা জানা ছিল না। খুব সুন্দর বললেন। ভারতের আত্মিক একতা বিষয়ে তাঁর সাবলীল মৌখিক ভাষণ গীতা-উপনিষদ-পুরাণের ফুল তুলে সাজানো। এঁরাই স্বামী বিবেকানন্দের পথের পথিক। বুদ্ধিজীবী সন্ন্যাসী। কেরালার মানুষ, বাংলা দিব্যি বলেন—চমৎকার রসিকতার ক্ষমতা, বার বার সারা পৃথিবী ঘুরেছেন, বক্তৃতায় সেই বিস্তৃতির ছাপ! আধুনিক মনন, আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সঙ্গে অধ্যাত্মচিন্তার মিলনে তাঁর বচনে যে জ্যোতিটি ফুটে ওঠে সেটি খুব ভালো লাগল। সাধু সন্দর্শন শুরু হয়েছে আমার। কুম্ভে তো এজন্যেই যায় মানুষে।

    .

    দুপুরে চন্দ্রশেখর আমাকে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন হাসপাতালে পাকড়াও করে নিয়ে গেল। কলেরার ইঞ্জেকশন ও সার্টিফিকেট নিয়ে এলুম। তারপর গেলুম প্রফেসর মোহনের নেমন্তন্নে সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ ইংলিশে। ওখানে আজ প্রসিদ্ধ ইঙ্গ-ভারতীয় লেখক রাজারাও বক্তৃতা করবেন। বিষয়—’লেখক এবং পৃথিবী’ (Writer and the world)। এই বিষয়ে খুব উৎসাহ আছে আমার। আজকাল সাহিত্যের শিল্পজিজ্ঞাসার দিকটার চেয়ে জগৎ জিজ্ঞাসার দিকটাকে আমার ঢের বেশি জরুরী বলে মনে হয়। অন্যরা এ নিয়ে কে কী ভাবছেন জানতেও উৎসাহ বোধ করি। ইঙ্গ-ভারতীয় সাহিত্যে অবশ্য আমার জ্ঞান বেশি নয়। বাংলা ছাড়া ভারতীয় সাহিত্য পড়তে হলে আমি কষ্ট করেও ওড়িয়া—অসমীয়া—হিন্দি পড়তেও চেষ্টা করি; ভারতীয় ইংরাজিতে ঠিক ততটা উৎসাহ পাই না। রাজারাও-এর ‘কণ্ঠপুরা’ উপন্যাস পড়েছি। ভালোই লেগেছে। তবে কিনা তাকে বিভূতিভূষণ, তারাশংকরের লেখা উপন্যাসের স্তরের বলে মনে হয়নি। তবুও রাজারাও শুনে উৎসাহিত হলুম তার কারণ আমাদের স্বভাবগত সাহেবভক্তি। গতবার প্যারিসে সর্বনের অধ্যাপক ভূয়াজিন সাহেব বলেছেন, তাঁর কাছে দুটি ছাত্র (একটি পাকিস্তানী পাঞ্জাবী ও একজন ফরাসিনী) রাজারাও বিষয়ে গবেষণা করছেন। বহুকাল যেহেতু রাজারাও ফ্রান্সে ছিলেন, তাঁর ফরাসি যোগাযোগ কী কী ও রচনায় ফরাসি প্রভাব কতটা আছে ইত্যাদি নিয়ে। দিল্লীর নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়েও একজন ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সেও সরবফেরত এবং যথারীতি রাজারাও-পাগলা। সাহেবরা যখন এত ভালো বলে, দেখিতো একবার রাজারাও কেমন? এজন্যেই যাওয়া। প্রথমেই আবিষ্কার করলুম—বক্তৃতার বিষয় The writer and the world’ নয়—ওটা হবে The writer and the word’—লেখক এবং শব্দ। উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল, কবিতা লিখি বলে। সমস্যাটি কবিতাসৃষ্টির মূল মন্ত্র। কিন্তু উৎসাহ বাড়ল না। এখন আমার word-এর চেয়ে world-এর দিকেই ঝোঁক বেশি। মনে হয় শিল্পে ওই যোগাযোগটাই বেশি জরুরী। ওটাই প্রথম-লেখক এবং বিশ্বভুবন। শব্দের কৃত্য সেই ঘটকালিটা করা। রাজারাও আমাকে সেরেফ্ বসিয়ে দিলেন। এত অবিশ্বাস্য বাগাড়ম্বর, এমন অসহনীয় কৃত্রিম তথা ক্লান্তিকর বক্তৃতারাজী আমি ঠিক কল্পনা করতে পারিনি। ইঙ্গ-ভারতীয় লেখকরা অনেকে নানা ধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভোগেন বটে, কিন্তু ভালো বক্তাও যে অনেকেই আছেন! সুস্থ সুন্দর বক্তৃতাও (যেমন পুরুষোত্তমলাল, আর. কে. নারায়ণ অথবা এ.কে. রামানুজনের মুখে) তো কম শুনিনি।

    সন্তপ্রতিম ঢঙে শ্রীরাজারাও উবাচ—’জগতে বক্তাও নেই, শ্রোতাও নেই। আছেন কেবল বলা। কেবল শব্দরহস্য। যোগাযোগ (Communication) বলে কিছুই নেই এই দুনিয়ায়। তাই লেখকও নেই, পাঠকও নেই। আছেন কেবল লেখা। শব্দ কেবল শব্দ।’এখানে আমি একটু গুছিয়ে বলে ফেলেছি ঘটনাটা মাত্র তিন লাইনে। এটা মাস্টারি করার বদভ্যাসের ফল। উনি এটা বললেন ঠিক পুরো পঞ্চান্ন মিনিট সময় নিয়ে। খুব বেশি সরল অধ্যাত্মচিন্তার মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এবং ইতিউতি শিল্প-দর্শনের নাক তুলে। এবং সেই জাতের উন্নাসিকতার মার্জনা থাকা উচিত নয়। না, উদাসকণ্ঠে ‘Only the word exists’ বলাটা দোষের বলছি না—দোষের হল, তাঁর বিদেশি ভাষায় সাহিত্যচর্চার কারণ দর্শানোটা। তিনি নিজের মুখে বললেন—ইংরাজিতে লেখেন, কেননা তিনি ‘Precision’-এর পূজারী, ‘like Mallarme, that French poet’ এবং তিনি ‘Silence’-এর ভক্ত—‘like Rilke, my favourite German’! অথচ কান্নাড়া, তাঁর মাতৃভাষাটি বড়োই নাকি দুর্বল, বড়োই অনুন্নত ভাষা, রাজারাওয়ের সূক্ষ্ম চেতনাকে শিল্পে প্রকাশ করার মতো গূঢ় শক্তি তাতে নেই। সেই Preci sion এবং silence-এর খেলা ওসব কাঁচা ভাষাতে দেখানো যায় না। হ্যাঁ ভারতবর্ষে আরও একটি অন্তত জবরদস্ত ভাষা আছেন ইংরিজি বাদে, যাঁহাতে উহা সম্ভবে, তিনি হচ্ছেন সংস্কৃত। যদি সাধ্যে কুলোতো—তাহলে রাজারাও সংস্কৃতেই নিয়মিত লিখতেন। খাস দেবভাষায়। কেননা পাঠক তাঁর কাছে অস্তিত্বহীন। দেবভাষাটা ভালো জানেন না বলেই রাজভাষাতে লিখে থাকেন তিনি, অর্থাৎ ইংরিজিতে, যেহেতু সেটা অবশ্যই অতি সুপক্ব ভাষা। পরভাষান্নভোজী লেখকটির এই অতিপক্ক ভাষ্যটি শুনে বিশেষত আপন মাতৃভাষা বিষয়ে, তাঁর শ্রদ্ধাভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখে আমার তো মাথা গরম। এ কেমন বুদ্ধিমান পুত্র, যে নিজের মাকে বলে চরিত্রহীন? এ যে নিজেকেই বলছে পিতৃপরিচয়শূন্য? কলকাতা শহরে কেউ বাংলাভাষার সম্পর্কে এরকম কথা বললে তিনি যত বড়োই যশস্বী হোন, বাঙালি ছেলে-মেয়েরা নিশ্চয় তাঁকে অক্ষত ছেড়ে দিত না। অন্তত তাদের কাছে আমার তো তাই আশা। যশোলোভে শখ করে (অর্থাৎ ভুবনজোড়া পাঠক পাবার আশায় আকাঙ্ক্ষায়) ইঙ্গ-ভারতীয় লেখক হতে চাইলে যদি বাংলাকে আগে দুর্বল ভাষা বলে জারি করে নিতে হয়, তাহলে কলকাতা শহরে সে-লেখকের কপালে দুঃখ আছে। কিন্তু হায়দ্রাবাদ সত্যিই খুব ভদ্র শহর। তাছাড়া কান্নাড়া ওখানকার স্থানীয় ভাষাও নয়। ফলে রাজারাও-এর গলায় বাঁধা লাল টুকটুক রেশমী রুমালের ভাঁজটিও এদিক-ওদিক হল না—তাঁর শুভ্র-দীর্ঘ-কেশ যথাস্থানেই ধ্যানসম্মত বিবশতায় ঝুঁকে রইল। অবশ্য ভদ্রভাবে নানারকম টুকটাক্ প্রশ্নাদি হচ্ছিল—আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল এই প্রশ্নটি। একজন তরুণ ছাত্র উঠে ভক্তিভরে জিজ্ঞেস করলে ‘আচ্ছা, আপনি তো তাহলে ধ্যান করা (meditation), এবং সাহিত্যসৃষ্টি করাকে একই পর্যায়ের বলে মনে করেন?’ শ্রীগুরু গম্ভীরভাবে দামী মাথাটি নাড়লেন—‘হ্যাঁ, আমার কাছে দুটোই এক কাজ।’ ছেলেটি তখন বলল সবিনয়ে—’দুটোই যখন এক, তাহলে বরং আপনি ধ্যানই করুন না কেন? কষ্ট করে আর নাইবা লিখলেন।’ এই ছেলেটিকে আমার শতকোটি সাধুবাদ। তার ঠিক আগেই স্থূলভাবে আমি বৃথাই তর্ক করেছি—’যদি আপনি Communication-এ বিশ্বাস নাই করেন Silence পালন করার পক্ষে তো না-লেখাই সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া জগতে পাঠক যখন নাস্তি (non—existent), লেখকও যখন নেই—তাহলে আপনার প্রকাশক বেচারা কেন মাঝখান থেকে খামোকা অস্তিত্ব-যন্ত্রণা ভোগ করেন? শুধু লেখাই যদি সব—তবে সেই লেখা নিজের দেরাজে রেখে না-দিয়ে ছাপেন কেন আপনি?’ তিনি উত্তরে স্মিত হেসে বললেন—’লিখে আমি আনন্দ পাই তাই লিখি, এবং ছেপেও বড়ো আনন্দ পাই, তাই ছাপি।’ এই ‘বিশুদ্ধ আনন্দের পরিপ্রেক্ষিতে আমার আর কিছুই বলার ছিল না। ছেলেটির প্রশ্ন এবং উত্তর আমার সেই নিরুত্তরতার জবাব দিয়ে দিয়েছে। রাজারাওদের ধ্যানস্থ থাকাই তাবৎ জগৎসংসারের পক্ষে মঙ্গল। সন্দেহ নেই, রাজারাওদের টেক্সাসের তৈলখনিতেই মানায় ভালো। (উনি এখন সেই অঞ্চলেই চাকরি করেন।)

    ইতিমধ্যে আরেকজনের সঙ্গে আলাপ হল ওখান থেকে ফিরে এসে, তিনি কৃষ্ণ মেননের ভাগ্নে, সুপ্রীম কোর্টে প্র্যাকটিস করেন এবং সুযোগমতো রাজনীতি ঘাঁটেন, নাম রাজাগোপাল। তিনিও ওই অতিথিশালায় আতিথ্য নিয়েছেন। কুম্ভে যাচ্ছি শুনেই বললেন—’কুছ ভাবনা নেই, ওখানে আমার বন্ধু বহুগুণা আছেন, ওঁকে ফোন করে একবার…’ শুনেই তো আমি আঁতকে উঠি-ককিয়ে উঠি।—’থাক। হয়েছে হয়েছে। ওরে বাপরে! অত বড়ো বড়ো নামে আর কাজ নেই। আপনারা কি ছোটোখাটো মানুষ কাউকেই চেনেন না, যিনি আমার সমান মাপের? নিজের গায়ের চেয়ে বড়ো সাইজের জামা পরে আর তো চলতে পারছি না। তা ছাড়া এ এক রাজনীতিক বৃত্তে পা জড়িয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি বেচারী গরীব মাস্টার। বে-জায়গায় এসে কী মুশকিলেই পড়েছি। না-পালালে মুক্তি নেই। কী ভাগ্যি সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ইংলিশে আমার পুরনো বন্ধু মাখনলাল টিক্কু এলাহাবাদের দুজন ইংরিজির অধ্যাপকের নামে চিঠি লিখে আমাকে দিয়েছেন। এলাহাবাদে গিয়ে নেহাত মুশকিলে পড়লে তাঁদের শরণ নেওয়া যেতে পারবে।

    আমার আবুহোসেনী, অথবা ফাউস্টগিরি, যাই বলা যাক না কেন এ যেন এখন চরম স্বপ্নাদ্য পর্যায়ে। চন্দ্রশেখর ছায়ামূর্তি সহচর হয়ে আমাকে প্রচণ্ডভাবে গাইডেন্স দিচ্ছে। ঠিক রাত্রি ন’টায় যন্ত্রপাতিসুদ্ধ একজন হাস্যবদন অতি এফিশিয়েন্ট স্টেনো এসে হাজির। অচিরাৎ পেপার তৈরি হল। আমি ইতিমধ্যে বেডসুইচ আর কলিংবেলের তফাতটা শিখে ফেলে প্রায়ই চা-কফি চাইছি আর স্যাটাস্যাট মেমো সই করছি। আমাকে পায় কে? ভি. আই. পি. হতে শেখা খুব সোজা কাজ। কেবল চোখ বুজে মেমো সই করতে পারলেই হল। আমি একা কুম্ভে যাচ্ছি শোনার পর থেকে সেই ‘আহ বেচারী’ ভাবটাও আর কারুর মধ্যে নেই। চন্দ্রশেখরও এখন আমাকে একটু (একটু সংশয়-মিশ্রিত) সমীহের চোখে দেখছে বলে আমার ঘোরতর আশা হচ্ছে। রাত বারোটায় যখন স্টেনো, চন্দ্রশেখর এবং তাঁদের পৌঁছে দিতে রাজ্যেশ্বর বিদায় নিলেন, তখন আমি খাটে গা এলিয়ে পেপারটাতে চোখ বুলোতে শুরু করি। হাজার হোক এই জন্যেই তো আসা। কাল সকাল ন’টায় এটা পেশ করতে হবে।

    সকাল হলে গিয়ে দেখি স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী এসেছেন আমার বক্তৃতা শুনতে। খুবই কৃতজ্ঞ হলুম, লজ্জা পেলুম তার চেয়ে বেশি। বক্তৃতা অবশ্য জমে গেল কপালগুণে। ইনস্টিট্যুটের বন্ধুবান্ধব যথেষ্ট, হল ভর্তি। রঙ্গনাথানন্দজির কি যে পছন্দ হয়ে গেল আমার বলা, এবং তাঁর সঙ্গে যে কজন আশ্রমিক আশ্রমিকা এসেছিলেন তাঁদেরও। আমাকে ওঁরা বিকেলে ওঁদের রামকৃষ্ণ মিশনে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন। এই তো আমার সাধুসঙ্গের গোড়াপত্তন কুম্ভে তো যায় লোকে আসলে এই করতেই। সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে রঙ্গনাথানন্দজীর অবিস্মরণীয় গীতাভাষ্য শুনলুম। তার পর উনি আমায় ওঁর লেখা কয়েকটি বই উপহার দিলেন। আমি তো ধন্য। না, তীর্থযাত্রার শুরুটা জমেছে চমৎকার।

    .

    সালারজং জাদুঘর যদিও দেখা হল না তবুও রাত্রে যখন অতিথিশালায় ফিরলুম মনে তখন বিমল আহ্লাদ। একটু আধটু বেড়ানো হয়েছে চারমিনার অঞ্চলে, নেমন্তন্ন খাওয়া হয়েছে ভালো রেস্তোরাঁয়, আর যে বক্তৃতার কল্যাণে এই ভি. আই. পি. সমাদর কপাল জোরে সে-বক্তৃতাটিও দিব্যি উতরে গিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা কুম্ভে যাওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশেষ ফাউ পেয়ে গেছি : তিরুপতি! কাল ভোরে তিরুপতির প্লেন—ছ টার সময়!

    দীর্ঘকায় সুদর্শন তরুণ ব্যারিস্টার রাজাগোপাল দেখি বেশ ভক্ত মানুষ। সন্ধ্যেবেলায় নগ্নপদে হায়দ্রাবাদের নবনির্মিত বিড়লাতিরুপতি মন্দিরে গিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে, এক ঘণ্টা কিউ দিয়ে পুজো দিয়ে, কপালে ফোঁটা-তিলক এবং নাকে সর্দি নিয়ে ফিরেছেন। তিনি দুঃখু করতে লাগলেন, আগে জানলে আমার সঙ্গে আসল তিরুপিতিতেই যেতেন। কিন্তু কালই তাকে ভোরের প্লেনে দিল্লী ফিরতে হচ্ছে। একই সঙ্গে এয়ারপোর্টে রওনা হব ঠিক হল। উনি চা চাইলেন ভোর চারটেয়। আমি পাঁচটায়। উনি থ’!

    ‘সে কী? পাঁচটায় তো আপনার রিপোর্টিং টাইম?’ আমিও সেটা জানি। কিন্তু কাল রাত্রে উদ্বেগে মোটেই ভালো, ঘুমোইনি। সেটা তো ওঁকে বলা যায় না। চক্ষুলজ্জায় তখন বলি—”বেশ পৌনে পাঁচটায় চা। এয়ারপোর্ট তো কাছেই।’ রাজাগোপাল সানন্দে রাজী হলেন আমার আরেক অনুরোধে, দিল্লী পৌঁছে আমার মামাবাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেবেন যে ঐদিনই রাত্রের প্লেনে আমি দিল্লী যাচ্ছি। পালামে যেন গাড়ি পাঠানো হয়। খুবই ভদ্রলোক—যদি ফোন-যোগাযোগ ব্যর্থ হয়, তা হলে উনি নিজেই এয়ারপোর্টে আসবেন বললেন। ভাবনা নেই। কেউ না কেউ প্রতীক্ষিয়া থাকবেই, উৎকণ্ঠ আমার লাগি, পালামে।

    কিন্তু গোলমাল বাধলো ভোরে। সোয়া তিনটের সময়ে দোরে ধাক্কা। দোর খুলে দেখি চন্দন তিলকধারী, সদ্যোস্নাত শ্রীযুত রাজা গোপাল। ঘোর বেগুনীতে বড়বড় সাদা রসগোল্লা প্রিন্টেড সিল্কের শানদার শার্ট গায়ে দিয়ে, পেতলের গুল্ বসানো ইয়া চওড়া বেল্ট দিয়ে কোমর বেঁধে, তাবাক্ আফটার শেভ লোশনে ডুব দিয়ে ভুরভুরে সুসজ্জিত। বললেন—”উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন, স্নানটান করুন, চারটেয় তো চা আসবে।’—দূর ছাই, আমি চা দিলে তবে উঠি! আগেভাগে উঠে চায়ের অভ্যর্থনার জন্যে কে কবে তৈরি হয়ে বসে থাকে? কিন্তু অমায়িক হাস্যসহকারে বলতে হল—”অনেক ধন্যবাদ! ভাগ্যিস ডেকে দিলেন। অবশ্য আমি পৌনে পাঁচটায় চা চেয়েছি। এখন সোয়া তিনটে বেজেছে!’ রাজাগোপাল সরলভাবে বললেন—‘হ্যাঁ। এবার তা হলে গরমজলটা অন করে দিন, তৈরি-টৈরি হোন-আমি তো পৌনে তিনটেয় উঠেছি।’ পুনরায় অমায়িক হাস্য করে, দোরে খিল দিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু শুলে কি হবে? কপালে কি ঘুম আছে? চারটের সময় দোর ঠেলাঠেলি।—’ওকি মশাই? আবার ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? সর্বনাশ? প্লেন ধরবেন কি করে? চারটে যে বেজে গেল, চা এসে যাবে এক্ষুনি উঠে পড়ুন উঠে পড়ুন-উঠে পড়ুন–’ এবার দত্তকিড়িমিড়ি সজোরে নিয়ন্ত্রণ করে মৃদু উদ্বেগে বলি—ওঃ হো। তাই তো? ঘুমিয়েই পড়েছিলাম বটে! অবশ্য আমার চা-টা পৌনে পাঁচটায় দেবে। এখন চারটে।’ রাজাগোপাল বললেন ‘—কিন্তু স্নান?’—’স্নান তো আমি রাত্রেই করে শুয়েছি; ভোরবেলা আমি বড্ড আস্তে আস্তে নড়ি-চড়ি কিনা?’ রাজাগোপাল বললেন—’দূর—রাত্রে করলে হবে কেন? মন্দিরে যাচ্ছেন না? পবিত্র হয়ে যেতে হবে না?’ ও হরি, তাই তো? আমি কেবলই পরিচ্ছন্নতার টেকনিক্যাল দিকটা ভেবেছি। বাসি-তাজা ইত্যাদি অর্থাৎ পবিত্রতার ফর্ম্যাল দিকটা আমার মাথায় আসেনি। সাধারণত স্নান না করে মন্দিরে ঢোকবার জন্য আমার কাছে একটা ‘পাশ’ আছে—’ অপবিত্রো পবিত্রোবা সর্বাবস্থাং গতোঽপিবা যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষম’–এই উপায়ে আমি সর্বদাই বাহ্যাভ্যন্তরে শুচি হয়ে মন্দিরে ঢুকি। স্নান করার ঝামেলা থাকে না। কিন্তু ঘুমুতে তো উনি দেবেন না। হায়! একেই কি বলে আমার মনের শান্তি ও রাতের নিদ্রাহরণকারী? যুবকের প্রতি আমার হৃদয়ে যে কীদৃশ ভাবের উদয় হল, তা কবি কালিদাস কল্পনাও করতে পারতেন না? শরীরে অনিদ্রার এই ক্লান্তি একমাত্র জলেই দূর হবে, মন্ত্রে নয়। স্নান না করে পথ নেই। অতএব হাস্য বদনে…’থ্যাংক য়ু সো মাচ মিস্টার রাজাগোপাল!’ উঠে গরম জলের কল খুলি। পবিত্র হয়ে চা খেতে বসতে হবে এবারে। রাজাগোপাল চারটের চা খেয়ে, পৌনে পাঁচটায় পরিপূর্ণ ফুল ব্রেকফাস্ট খেয়ে, পাঁচটায় এয়ারপোর্টে। তাঁর দিল্লীর প্লেন অবিশ্যি সাতটায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন
    Next Article নবনীতা দেবসেনের গল্প

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.