Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প173 Mins Read0

    দর্শন পর্ব

    দরজার সামনে সিঁড়ির নিচে দিয়ে শায়িত ফোয়ারার মতো করে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল ক্ষীণধারায় ঝিরঝিরিয়ে জল বেরিয়ে আসছে; যাত্রীদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রথমেই বিরক্তি হল। কী জ্বালা, পা কাদাকাদা হয়ে গেল। তারপরে হঠাৎ সন্দেহ হয় এ বুঝি আচমনের অঙ্গ—পা দুটি জোর করে ধুইয়ে নেওয়া হচ্ছে মন্দিরে প্রবেশের আগে? মন্দিরে

    ঢুকতে গেলে বিশল রুপোর তোরণ পার হতে হয় দু’একটা। গুনিনি ঠিক কতগুলো। অত মোটাসোটা রুপোর পাত বাঁধানো উঁচু চওড়া চৌকাঠ পা দিয়ে মাড়াতে মাথা ঘোরে—কথাটা বলতেই বাসু সগর্বে বললেন—’এর পরেরটা তো সোনার চৌকাঠ, খাঁটি সোনার তোরণ।’ বেজায় রাগ হয়ে গেল। সোনা রুপো বুঝি এমনি মাড়িয়ে যাবার জিনিস। ওদিকে ‘সর্বদর্শন’ কিউ-এর দিকে তাকিয়ে দেখলুম—যাঁরা কত কষ্ট করে চলেছেন সোনার গেট মাড়িয়ে, তাঁদের অধিকাংশেরই আপন অঙ্গে সোনার কুচি থাকার চিন্তাও স্বপ্নবৎ। অবশ্য দক্ষিণে দারিদ্র্যের সেই উৎকট হতশ্রী চেহারাটি নেই, উত্তরে নগ্নভাবে যেটা চোখে বেঁধে। দক্ষিণে দারিদ্র্যের মধ্যেও একটা লক্ষ্মীশ্ৰী আছে। এটা কেন, কী কারণে, অতশত অর্থনীতিবিদরা জানবেন অথবা সমাজতাত্ত্বিকেরা। এটা আর্থিক কারণে, না সমাজচরিত্রের গুণে, তা আমি জানি না। কিন্তু পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট।

    .

    তিরুপতি যাবার পথে প্রায়ই নেড়া-মাথা বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ চোখে পড়ে। ছেলেদের মতো চুল, যাকে ‘বজ কাট’ বলে, তেমনি ফ্যাশনেবল চুল নিয়ে বহু গ্রাম্য স্ত্রীলোক হরদম হাটবাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রথমে এটা খুব অবাক লাগলেও যেই মনে পড়ল এই মন্দির প্রচুর বিদেশী মুদ্রা কুড়িয়ে আনে বহির্বিশ্বে চুল বেচে, পরচুলার ব্যবসায়ে—অমনি ব্যাপারটা বোঝা গেল এখানে হামেশাই চুল মানত করা হয়। ‘মেয়েদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান, প্রিয়তম বস্তু হল রূপ’—বললেন পার্থসারথি। ‘সেই রূপ চুলেই অনেকটা নিহিত। মেয়েরা যখন ভেঙ্কটেশ্বরের কাছে কিছু চেয়ে পায়, তখন তাঁর কাছে সেই প্রিয়তম বস্তুটিই নিবেদন করে যায়। ভেঙ্কটেশ্বর আমাদের বড়ো জাগ্রত ঠাকুর। মন্দিরে ঢোকার আগে আপনাকে নাপিতখানাটা দেখিয়ে নিয়ে যাব, যেখানে মস্তক মুণ্ডন করা হয়।

    বড়ো বেড়া দেওয়া দরজার পাশে ছোটো বেড়া দেওয়া দরজা—সেখানেও দুটো ভাগ—সর্বদর্শনের প্রবেশপথ এক কোণে—আর স্পেশাল দর্শনের প্রবেশ মধ্যভাগে—হায় দৈব সুবিচার! বিজ্ঞাপন পড়লুম, ২৫ টাকায় স্পেশাল দর্শন টিকিট কেনা যায়। কিন্তু আমরা, আমি যতদূর বুঝলুম, বিনা টিকিটের যাত্রী। আমাদের বোধহয় ‘পাশ’ আছে। সেই পাশ হল মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলের পদ, আর টাউন কংগ্রেসের সভাপতিত্ব। আমি হচ্ছি ফাউ। ঢুকলুম মন্দিরে। সুমুখেই সোনার ধ্বজদণ্ড। দাক্ষিণাত্যের সমস্ত মন্দিরেরই এই লক্ষণটি আছে—গর্ভগৃহের আগে চওড়া দালান-নাটমণ্ডপ তারও আগে ধ্বজদণ্ড। ধ্বজদণ্ড এবং একটি সোনামোড়া স্তূপমতন—এটা কি বুঝতে পারিনি। সবাই দুটোকেই প্রদক্ষিণ করছে। ওগুলির গায়ে মাথা ঠেকাচ্ছে। সিঁদুর-কুঙ্কুম ঢালছে, ঘৃতপ্রদীপ জ্বেলে দিচ্ছে নিচে। তারপর আবার তোরণ। আবার একচিলতে উঠোন—তারপর দুটো বড়ো বড়ো, সোনারই বোধহয়, দরজা। তারই একটা দিয়ে ঢুকে দেখি আহা স্বর্গের দৃশ্য!! ফুল-চন্দন ধূপ-ধুনোর সুরভির মধ্যে শুদ্ধ পবিত্র এক পরিবেশে বেশ কয়েকজন ফোটাকাটা ব্রাহ্মণ গোল হয়ে বসে মনের সুখে গাদা গাদা টাকা-পয়সা গুনছেন দালানের একদিকে। আরেকদিকে আরও কয়েকজন ব্রাহ্মণ বসে ক্রমান্বয়ে নিবিষ্টচিত্তে পাহাড় প্রমাণ সরু চাল বাছছেন। এই দালানে অর্থ, অন্ন, দুয়েরই ছড়াছড়ি। কোন ভারতবর্ষ? আরও একদিকে সর্বদর্শনের প্রবেশ ঘটছে এবং নিষ্ক্রান্ত হওয়াও। আমাদের জন্য এককোণে কম্বলের আসন পেতে দেওয়া হল। চালটা ভোগের জন্য। টাকাগুলো প্রণামী। আমি বসে বসে আদেখলে হয়ে মুগ্ধ নয়নে টাকা গোনা দেখতে লাগলুম। ভগবৎ চিন্তা চুলোয় গেল। এত টাকা একসঙ্গে জীবনে দেখিনি। দশটাকার নোট, একশো টাকার নোট, পাঁচ, দুই, এক আলাদা আলাদা তোড়া বাঁধা হচ্ছে খুচরোও গুনে গুনে স্তূপ করা হচ্ছে ভাগে ভাগে ওই বিশেষভাবে পবিত্র অঞ্চলটির পবিত্রতা বজায় রাখছেন বন্দুকধারী পুলিশের দল। ঘিরে দাঁড়িয়ে। দালানের উত্তর-পশ্চিম কোণে, পিছনদিকে লোহার বেড়াজালের মধ্যে প্রকাণ্ড এক সাদা কোরা কাপড়ের থলি–ছ’ সাত ফুট উঁচু হবে। ভক্তরা সারি বেঁধে এসে তার মধ্যে টাকাকড়ি ঢালছেন। সেখানেও থিকথিকে সশস্ত্র পাহারা। ওই থলির নাম হুডি—এটা মানতের থলি। যে. যা মানত করেন, ওরই মধ্যে ঢেলে দেন। মানত করা চুলের জন্যেও হুডি আছে। ঢোকার আগেই দেখে এসেছি মন্দিরের বাইরের একটা নাপিতঘর–সেখানে সারি বেঁধে পাশাপাশি ভক্তেরা উবু হয়ে বসে চুল কাটছেন। মেয়েরাও মাথা কামাচ্ছেন হাসিমুখে। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের এমন একটি একক নিখরচার কারখানা ভারতবর্ষে আর কোথাও নেই। আমি কদাচ কুত্রাপি যা দেখিনি—এই মন্দিরে হতবাক হয়ে তাই দেখছি। এমন সময়ে ডাক পড়ল। উঠে গর্ভগৃহের দরজায় ঢুকলুম—এবারে সবাই সমান। এখানে সর্বদর্শন আর স্পেশাল দর্শনের আলাদা কিউ নেই। কি ভাগ্যি।

    ঢুকেই অন্ধকারে একটা উঁচু চৌকাঠে উঠে দাঁড়ালুম, খুব ভিড়, দম আটকানো, যদিও শৃঙ্খলায় সুবিন্যস্ত যাত্রিদল। যেই মনে হল সোনার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছি, অমনি কেমন তিক্ত বিস্বাদ হয়ে গেল মন। পা যেন পিছলে যেতে চায়। টাল সামলাতে হাত বাড়ালুম সোনার দরজা ধরতে। ধরি কাকে-দরজাগুলো বিরাট। চৌকো চৌকো ফোকর অবশ্য কাটা আছে, তার ভেতর আমার ক্ষুদ্র হাতটি ভরতে চেষ্টা করলুম। সামনেই একটি আধো আঁধারি ঘরের দেওয়ালে সাত-আটটি গডরেজের লৌহসিন্দুক, অর্ধচন্দ্রকারে সাজান। সিন্দুকবৃন্দ দানবীয় গরিমায় খাড়া হয়ে আছেন সারি সারি প্রহরীর মতো। বুঝলুম ওদের মধ্যেই তিরুপতিনাথের বহু প্রসিদ্ধ রত্নাভরণ সব সুরক্ষিত। ওপাশে একটি প্রমাণ মাপের বিশাল রূপোর সিংহাসন অনাদরে উলটে আছে পাথুরে মেঝেয়। দেখে আবার মনে পড়ল আমার পায়ের নিচে রয়েছে সোনা বাঁধানো চৌকাঠ। অমনি পা-টা বড়ো দুর্বল বোধ হল, আপনিই হাত এগিয়ে এল অবলম্বনের আশায় হলদেটে সোনার দরজার দিকে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় ‘পেতল’ শব্দটা সঙ্গে সঙ্গে হাতে লাগে শীতল ধাতুর স্পর্শ—মনে হল ‘ধাতু’ শব্দটা এবং কেউ যেন আমার মধ্যে বলে উঠল—ওহে হাঁদারাম, দেবতার কাছে পেতলও যা, সোনাও তা, রুপোও তা, লোহাও তা, সবই তো ধাতু। মাটির বুকের জিনিস। সোনার আর লোহার যা তফাত তা কেবল তোমার কাছেই–ভেঙ্কটেশ্বরের তাতে বয়েই গেল। মানুষের দোষে দেবতার উপর রাগ করে কীকরবে।

    তক্ষুনি সামনে চেয়ে দেখি পুরোহিত মস্ত স্বর্ণপ্রদীপ তুলে ধরেছেন, তাতে ঝলমলিয়ে উঠেছে ভেঙ্কটেশ্বরের মণিরত্নখচিত, বিপুল তিলকশোভিত, চোখে চন্দনের পট্টি-বাঁধা বিগ্রহ চিবুকেও মস্ত এক খাবলা চন্দনতিলক। মোটামুটি তাঁকে খুব সুশোভন, সুদর্শন ভাবতে কিন্তু পারলুম না। মুখখানিই যে মুখোশের মতো তিলকে তিলকে ঢাকা। আর অত ধনরত্নে অঙ্গ ভারী। দক্ষিণ হস্ত নত বরদমুদ্রায়, হাতের পাতাটি পর্যন্ত মণিরত্নের দস্তানায় ঢাকা। স্বয়ং ঈশ্বরেরও এত ঐশ্বর্যে মন বড়ো ধাক্কা খায়। ভাবতে ভাবতে দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার ঠিক পিছনের গ্রাম্য মানুষটি কাকে যেন চিৎকার করে ডেকে উঠল—’গোবিন্দ! গোবিন্দ-ও-ও-ও! গো-ও-বিন্দ-!’ গোবিন্দ বুঝি হারিয়ে গিয়েছে? গোবিন্দ কোথায় গেল এই ভিড়ে, এই অন্ধকারে? ওহে গোবিন্দ, তুমি কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে পিছনে একদল ব্যাকুল স্ত্রী-পুরুষ স্তব্ধ মন্দির কাঁপিয়ে দিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে—’গোবিন্দ! গোবিন্দ-ও-ও-ও। গো-ও-বিন্দ-ও!’ সেই কাতর গোবিন্দ ডাক আর থামলো না। সর্বদর্শনের মানুষের সঙ্গে আমারও বুকের গভীরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল সেই আহ্বান। না, এ কোনো একজনের হারানো সন্তানের প্রতি নয়—এ ডাক প্রত্যেকের যার যার নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বকীয় সত্তার প্রতি। ফিরে আসার ডাক। জীবনে তীর্থ করতে যাইনি, জানিনা এটাই নিয়ম কিনা। কিন্তু আমি এর আগে কোনও দেবতার প্রতি কখনও শুনিনি এমন নিবিড়, এমন আকুল, এমন আন্তরিক বিনা-সাজের পারিবারিক সুরের ডাক। এ যেন সন্ধের পর মাঠে গিয়ে না-ফেরা গোরুটির নাম ধরে ধরে উদ্বিগ্ন রাখালের হাঁক। কিংবা দুধের গেলাস হাতে বাগানে গিয়ে দুষ্টু ছেলেটাকে মায়ের ব্যাকুল ডাকাডাকি। এই পাগল-করা গোবিন্দহাঁকের মধ্যে কখন যেন চলে এসেছি বিগ্রহের ঠিক সামনে। পুরোহিত মাথায় স্পর্শ করিয়েছেন পবিত্র রত্ন-মুকুট, হাত পেতে কখন বুঝি অঞ্জলিতে নিয়েছি চরণামৃত। সামনে থেকে দেখেছি সেই চন্দনচর্চিত রত্নমূর্ছিত মূর্তি। বিগ্রহের মুখ দেখা গেল না, মুখ দেখতে পেলুম না, মনে এই খুঁতখুঁতুনি নিয়ে বেরিয়ে এলুম মাঝখানে দড়িবাঁধা, একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে ফিরে বেরিয়ে আসছেন ভক্তরা। ভেতরে মন্দিরের প্রহরী-পুরুতের চেড়ীর দল কঠোর স্বরে হাঁকছেন-’বেরিয়ে যান… বেরিয়ে যান….।’ হায়! এই কি দেবতার মন্দিরে উচ্চারণ করার যোগ্য কথা? এঁরা তিনচার ঘণ্টা ধরে কড়া রোদের মধ্যে সারি বেঁধে অপেক্ষা করছেন কত ভালোবাসায়, কত ধৈর্যে; শান্ত হয়ে। কত দূর দূর থেকে ভক্তরা ছুটে এসেছেন—মাত্র এইটুকুর জন্যে? এই অতিকৃপণ একটি মুহূর্তের ঝাঁকি দর্শন? এ তো ফাঁকি দর্শন। এ কী অতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফেরা! মুখখানি তো মনেই থাকবে না; দেখাই হল না যে। ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এসেই আবার ওপাশের দড়ির তলা দিয়ে গলে ঢুকে পড়ি। আরেকবার যাই। মুখখানা দেখে আসতেই হবে। সামনে গিয়ে পৌঁছেও সেই চন্দন-কলঙ্কিত, মুখোশ-পরা মুখ। আবার অতৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে আসছি, মনে মনে ঝগড়াই করে ফেলি এবার তিরুপতিনাথের সঙ্গে। কেমন দেবতা হে তুমি? খুনে ডাকাতের মতো চোখে পট্টি বেঁধে মুখে মুখোশ পরে বসে আছ? মুখই যদি না দেখতে দিলে তবে ডেকে এনেছ কেন এই এতজনকে? একি কেবল সোনার খেলা রুপোর খেলা দেখে বাড়ি ফিরে যাবার জন্যে? অঙ্গ তো মুড়ে রেখেছ মণিমুক্তোয়। মুখখানা পর্যন্ত ছোপছোপ চন্দনে লেপাপোঁছা! চোখেই যদি না দেখতে পেলুম তাহলে ‘দেখাটা হবে কার সঙ্গে? কেমন করে?’

    এমন সময়ে দেখা হয়ে গেল। একেবারে অভাবিত। চোখে চন্দনের পট্টি বাঁধা, চিবুকে চন্দনের পট্টি বাঁধা, কিন্তু ঠিক মধ্যিখানে ঝিকিয়ে উঠল নিখুঁত নাসার তলায় একজোড়া ঠোটে কালোপাথরের দুষ্টু হাসি। স্পষ্ট কৌতুকে উজ্জ্বল। ‘কেমন জব্দ? মুখ দেখা হয়নি? নাই বা হল। দেখি তো কেমন করে ভুলবে আমাকে? এ না-দেখা মুখখানাই মনে থাকবে, তাড়া করে ফিরবে তোমাকে এই হাসিটি।’ কষ্টিপাথরে খোদা সেই অনিন্দ্যসুন্দর হাসিটি সত্যিই বুকের ভেতর খোদাই হয়ে যায়। যেমন বহুপরিচিত প্রিয় বন্ধুর ঠাট্টা। ধন্য সেই নামহীন শিল্পী, যাঁর হাতে গড়া এই বিশাল কালোপাথরের বিগ্রহ। একটিই পাথর কুঁদে-গড়া ভেঙ্কটেশ্বরের মূর্তি। পুজো করবার জন্যে দেবতার রূপ ঠিক কেমন হবার কথা জানি না—তবে কানামাছি খেলার কোনো প্রিয় সাথীকে দেখছি বলে আমার মনে হল। খোলা তো কেবল দুটি ঠোট, তাতেই রূপ, তাতেই প্রাণ, তাতে অফুরন্ত কৌতুক। সেই রূপে আধ্যাত্মিক শান্তি বা পারত্রিক মুক্তি কে কী দেখেন জানি না, আমি দেখেছি অখণ্ড ভালোবাসা। অঢেল তারুণ্য। প্রাণশক্তি। বেরিয়ে এসেই হাতে শালপাতার বাটিভর্তি খিচুড়ি-প্রসাদ পেলুম ‘পোঙ্গল রাইস’–সেদিন ১৭ই। ১৪।১৫ই পুণ্য ‘পোঙ্গল’তিথি, দাক্ষিণাত্যে মকর সংক্রান্তির নবান্ন উৎসব। বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রসাদ খেলুম—সামনেই দুটি বড়ো বড়ো ঝুড়ি রাখা, সবাই প্রসাদ খেয়ে ঠোঙাটি তার মধ্যে ফেলছেন। পরিচ্ছন্ন পাথরের প্রাঙ্গণে সিঁদুরটুকু পড়লেও তুলে নেওয়া যায়, এমনই পরিপাটি। উত্তরাঞ্চলের কোনো তীর্থেই এটা কল্পনা করি না। সেখানে এই ঝুড়িটা পড়ে থাকত শূন্য হয়ে, আর এঁটো ঠোঙাগুলো থাকত ইতস্তত মাটিতে ছিটোনো। তারপর কাকে কুকুরে ষাঁড়ে-ভিখিরিতে টানাটানি চলত। এবারে এল মন্দির-প্রদক্ষিণ পর্ব। সেদিকটা বোধহয় মন্দিরের উত্তরেই হবে—মন্দির-শিখরের কাছে এক কোণে একটা কালো টিনের তীরচিহ্ন লাগান আছে—সেটা দেখিয়ে বাসু বললেন—’বাইরের এই সিঁড়িতে বসে বসে একজন সাধক বহুকাল সাধনা করেন। তাকে দেখা দিতে তিরুপতিনাথ ভেঙ্কটেশ্বর স্বয়ং একবার এইখানেই মন্দিরের গায়েই আবির্ভূত হন, ঝলসে ওঠেন। ঐ দেখুন তার চিহ্ন।’ মন্দিরের সোনার চুড়োর গায়ে বহুবিধ সোনার কারুকার্য—তারই মধ্যে এককোণে দেখি খচিত রয়েছে ‘আকস্মিক একটি ভেঙ্কটেশ্বরের সোনার মূর্তি। তাঁর হঠাৎ দেখা দেওয়ার স্বর্ণচিহ্ন। ডিজাইন ভাঙা, বেখাপ্পা।

    বাইরে এসে শিশমহলের সিঁড়িতে বসে রইলুম। ওঁরা মন্দিরের পেশকারের সঙ্গে কথা বলে ‘নির্ভেজাল’ মহাপ্রসাদ কিনতে পাঠালেন। এ জীবনে সর্বত্রই মহাপ্রসাদে বড় ভেজালের ভয়। শুনলাম শিশমহলের সর্বত্র দেওয়ালে আয়না বসানো। একটা কী দিলে ভেঙ্কটেশ্বরের একটি নকল মূর্তি ওইঘরে এনে দেখানো হয়—চতুর্দিকে ঘরভর্তি করুণায় ঝলমলিয়ে ওঠেন ভেঙ্কটেশ্বর। ইন্দ্রিয়ের সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। মোগল বাদশারা এটা ভেবে বের করেছিলেন—(রাজাপুত রাজারাও) নর্মের প্রসঙ্গে। এঁরা সেটাই প্রয়োগ করছেন ধর্মে। মন্দ কি? অবশ্য আপাতত সে ঘরে বিরাট তালা ঝুলছে। মহাপ্রসাদের অপেক্ষায় সিঁড়িতে বসে রইলুম। অন্তবিহীন কাল ধরে আমার কানের ভেতরে কান জুড়ে বাজতে লাগল সেই আকুল করা গোবিন্দ ডাক, আর চোখের ভেতরের চোখদুটি ঝলসে রইল একজোড়া কালো ঠোটের চাপা হাসির আলোয়।

    বেরুবার পথে সেই ফেরিওলা ছেলে এল তিরুপতি মাহাত্ম্য বেচতে। ঠিক যেন অরণ্যদেব জাতীয় ‘কমিক’ ছবিতে দৈব মাহাত্ম্য বর্ণনা করা। বেশ কমার্শিয়াল বস্তু। তারপরে দেখতে গেলুম শ্রীমতী পদ্মাবতী দেবীকে। তিনি সমতলের বাসিন্দা, স্বামীর সঙ্গে পাহাড়ে ওঠেন নি। পাদদেশেই আছেন আলাদা মন্দিরে প্রতিষ্ঠিতা। দক্ষিণ মন্দিরের নিয়মে পদ্মাবতীর মন্দিরের সামনেও সুন্দর চৌকো পুষ্করিণী। শুনলাম সধবা মেয়ের অত্যাবশ্যক তুক—পদ্মাবতীর সিঁদুর। স্বামী সোহাগিনী পদ্মাবতী হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মী। ওদিকে পাহাড়ের ওপরে তিরুপতিনাথ স্বয়ং নারায়ণ—শুনলাম তিনি নাকি শনিদেবতাও—তাই তাঁর চক্ষুদুটি অমন চন্দনে বাঁধা। এক চিমটি সিঁদুর নিয়ে যাব নাকি সঙ্গে? এ দেখি বেশ মজার দাম্পত্য। পদ্মাবতী ছায়া ইব স্বামী-সন্নিধানে থাকেন না; দিব্যি লিবারেটেড দেবী। (মা কালীর মতো অবশ্য নন।) স্বনির্ভরা পদ্মাবতী যখন অতদূরে একা থেকেও সতীলক্ষ্মী স্বামী-সোহাগিনী, তখন অন্যে পরে কা কথা?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন
    Next Article নবনীতা দেবসেনের গল্প

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কাঙাল মালসাট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    লুব্ধক – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    হারবার্ট – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.