Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    লেখক এক পাতা গল্প315 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১০. প্রেমেনের দুটো চিঠি

    জিজ্ঞাসা ও নৈরাশ্য, সংগ্রাম ও অপূর্ণতা এই দুই যতির মধ্যে দুলছে তখন কল্লোলের ছন্দ। সে সময়কার প্রেমেনের দুটো চিঠি—প্রথমটা এই–

    অচিন, আমি অধঃপাতে চলেছি। তাও যদি ভালো ভাবে যেতে পারতুম! জীবন নিয়ে কি করতে চাই ভালো করে বুঝি না, যা বুঝি তাও করতে পারি না। মাঝে-মাঝে ভাবি, বোঝবার দরকার কিছু আছে কি? এই যে দার্শনিক কবি মানবহিতৈষী মহাপুরুষেরা মাথা ঘামিয়ে মরছেন এ ঘর্ম বোধ হয় একেবারেই নিরর্থক। জীবনটাকে যে বেঁকিয়ে দুমড়ে বিকৃত করে ছেড়ে গেল, আর যে প্রাণপণ শক্তিতে জীবনকে কবিতা করার চেষ্টা করলে, দুজনেই বাজে কাজে হয়রান হল সমানই। তুমি বলবে আনন্দ আর দুঃখ—আমি বলি, তার চেয়ে ছেড়ে দাও, যার আদি বুঝি না অন্ত বুঝি না, ছেড়ে দাও তাকে নিজের খেয়ালে। হাসি পেলে হাস, আর যেদিন শ্রাবণের আকাশ অন্ধকারে আর্দ্র হয়ে উঠবে সেদিন জেনে ও মেনো কাদতে পাওয়াটাই পরম সৌভাগ্য। কোন দিন যদি খুশী হয়, নিজের সমস্ত সত্যকে মিথ্যার খোলসে ঢেকে নিজের সঙ্গে খুব বড় একটা পরিহাস কোরো, কোন ক্ষতি হবে না।

    আমরা ছোট মানুষ, কুয়োর ব্যাঙ, কিছু জানি না, তাই ভাবি আমরা মস্ত একটা কিছু। নিজেদের জগতে চলাফেরা করি, ছোষ্ট্র চেতনার আলোকে নিজের ঘরে নিজের সত্তার প্রকাণ্ড ছায়াটা দেখি আর মনে মনে বড়-বড় খেলা করি। কিন্তু ভাই আজ যদি এই পৃথিবীর গায়ের চুলকানির কীটের মত এই সমস্ত মানুষ জাতটার সবাই মিলে পণ করে উচ্ছন্নে যাই, এই বিপুল নিখিলে এই বিরাট আকাশে কোনখানে এতটুকু কান্না জাগবে না, উল্কাপাত হবে না, অগ্নি বৃষ্টি হবে না, প্রলয় হবে না, বিরাট নিখিলে একটি চোখের পালক খসবে না।

    তবে যদি মানুষকে একটা কথা শেখাতে চাও, আমি তোমার মতেযদি এই নির্বোধ মানুষ জাতটাকে শেখাও শুধু স্ফূর্তির, নিছক স্ফুর্তির উপাসনা—এই দেবতা-ঠাকুরকে দূর করে দিয়ে, ঝেটিয়ে ফেলে সব সমাজশাসন সব নীতির অনুশাসন—শুধু জীবনটাকে আনন্দের সাবথানায় অপব্যয় করতে—তবে রাজী আমি।

    কিন্তু আনন্দ, সত্যকারের আনন্দ পেতে হলে চাই আবার সেই বন্ধন, চাই আবার সেই সমাজশাসন, যদিও উদারতর; চাই সত্যের ভিৎ, যদিও দৃঢ়তর-চাই সচেতন সৃষ্টি প্রতিভা, চাই বিভিন্ন জীবনপ্রেরণার এমন সংযম ও সংযোগ যা সঙ্গীত।

    সুতরাং এতক্ষণ সব বাজে বকেছি-বাজে বকব বলেই বাজে বকেছি। কারণ চিঠি লেখার চরম উদ্দেশ্য জীবনের নির্মম বাস্তবতাকে। কিছুক্ষণের জন্যে অপদস্থ করে হাস্যাস্পদ করা।

    আজ এখানে বেজায় বাদল, কাল থেকেই শুরু হয়েছে। শাল মুড়ি দিয়ে এলোমেলো বিছানায় বসে চিঠি লিখছি। এখন রাত সাড়ে সাতটা হবে। খুব সম্ভব তুই এখন গল্প লিখছিস-লিখছিস হয়ত বিরহী নায়ক তার প্রিয়ার ঘরের প্রদীপের আলোকে নিজের ব্যর্থ কামনার মৃত্যু দেখছে। হয়ত কোন ব্যথিত প্রণয়ী তোর হৃদয়ের কান্নার উৎসে জন্ম নিয়ে আজ চলল মানুষের আনন্দলোকের অবিনাশী মহাসভায়—যেখানে কালিদাসের যক্ষ আজো বিলাপ কয়ছে, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মানবষ্টর সৃষ্টি অমর হয়ে আছে।

    একদিন নাকি পৃথিবীতে কান্না থাকবে না, কদবার কিছু থাকবে না। সেদিনকার হতভাগ্য মানুষেরা হয়ত শখ করে তোদের সভায় কাঁদতে আসবে আর আশীর্বাদ করবে এই তোদের, যারা তাদের ক্রন্দনহীন জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিবি।

    দ্বিতীয় চিঠি।

    বড় দুঃখ আমার এই যে কোন কাজই ভাল করে করতে পারলুম না। জীবনের মানেও বুঝতে পারি না। জানি শক্তিসংগ্রহে সুখ, পূর্ণ উপভোগ সুখ। কিন্তু সুখ আর কল্যাণ কোথায় এক হচ্ছে বুঝতে পারি না।

    জীবনটা যখন চলা তখন একটা দিকে ত চলা দরকার, চার দিকে সমানভাবে দৌড়াদৌড়ি করলে কোন লাভ হবে না নিশ্চয়ই। সেই পথের লক্ষ্যটা একমাত্র আনন্দ ছাড়া আর কি করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না।…

    আনন্দ কল্যাণের সঙ্গে না মিশলেই যায় সব ভেঙে। অনেক ধনী হয়ে অনেক টাকা বাজে অপব্যয় করার আনন্দ আছে, খুব ব্যভিচারী লম্পট হওয়াতেও আনন্দ আছে, সর্বত্যাগী বৈরাগী তপন্থী সন্ন্যাসী হওয়াতে আনন্দ আছে, কিন্তু কল্যাণের সঙ্গে আনন্দ মেশে না, তাই গোল। এগিয়েও ভুল করতে পারি, পেছিয়েও। পাল্লা সমান রেখে কেমন করে চলা যায় তাও ত ভেবে পাই না।

    আমার মনে হয় আনন্দ আমার কাছে আনন্দ আর দুঃখ দুঃখ, শুধু এই জন্যেই যে, আনন্দ জীবনের সার্থকতার প্রমাণ আর দুঃখ মৃত্যুর

    কুটি। কথাটা একটু হেঁয়ালি ঠেকছে। আর যখন দেখা যায় আনন্দ জীবনের মূলচ্ছেদেও মাঝে মাঝে পাওয়া যায় তখন আরো হেঁয়ালি দাঁড়ায় বটে কথাটা। তবু আমার মনে হয় কথাটা সত্যি।

    আর এ ছাড়াও, অর্থাৎ এ যদি সত্যি না হয়, তবু আনন্দ ছাড়া জীবনের পথের পাতা আর আমাদের কেউ নেই। যারা কর্তব্য-কর্তব্য বা বিবেক-বিবেক বলে চেঁচিরে মরে তারা আমার মনে হয় একেবারে অন্ধ, না হয় একেবারে পাগল। কি কর্তব্য আর বিবেক কি বলে এটা যদি ঠিক করতেই পারা যাবে তাহলে আর এত গোল কেন? জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তো বিবেক তৈরি হয়েছে আর কর্তব্য-অকর্তব্য প্রাণ পেয়েছে।

    এই যে পাণ্ডাটি আমাদের, এ মাঝে-মাঝে ভুল করে, কিন্তু নাচার হয়ে আমাদের তাকেই সঙ্গে নিতে হবে পথ দেখাতে।

    এমনিতর অনেক কথা ভাবি কিন্তু কিছু ঠিক করতে পারি না। ছেলেবেলা একটা সহজ idealism ছিল, ভালো মন্দ বেশ সুস্পষ্টভাবে মনে বিভক্ত হয়ে থাকত। মনে হত পথটা জানি চলাটাই শক্তএখন দেখছি চলার চেয়ে পথটা জানা কম কথা নয়।

    এই ধর জীবনের একটা programme দিই। বিদ্যা জ্ঞান স্বাস্থ্য শক্তি সৌন্দর্য শিল্পসাধনা গেল প্রথম। দ্বিতীয় ভালবাসা পাবার। ধর পেলুম কি পেলুম না। তারপর আরো সাধনা পরিপূর্ণতার জন্যে। পরের উপকার, বিশ্বমানবের জন্যে দরদ, পৃথিবীজোড়া দুঃখ দারিদ্র্য হাহাকারের প্রতিকার চেষ্টায় যথাসাধ্য নিজেকে লাগান। তৃতীয় সারা জীবন ধরেই ভূমার জন্য তপস্যা, সারাজীবন ধরে দুঃখকে অবহেলা করবার ব্যর্থতাকে তুচ্ছ করবার মৃত্যুকে উপহাস করবার শক্তি অর্জন।

    বেশ! মন্দ কি। কিন্তু যত সহজ দেখাচ্ছে ব্যাপারটা, আসলে মোটই এমনি সহজে মীমাংসা হয় না। কি যে ভূমা আর কি যে পরিপূর্ণত, কি যে মানুষের উপকার আর কি যে শিল্প আর জ্ঞান তা কি মীমাংসা হল?…

    না। মাথা গুলিয়ে যায়। আসল কথা হচ্ছে এই যে, আফ্রিকার সব চেয়ে আদিম অসভ্য Bushman-এর একটা বিংশ শতাব্দীর সম্পূর্ণ এয়োপ্লেন পেলে যে অবস্থা হয় আমাদের এই জীবনটা নিয়ে হয়েছে তাই। আমরা জানি না এটা কি এবং কেন? এর কোথায় কি তা তো জানিই না, এর সার্থকতা ও উদ্দেশ্য কি তাও জানি না। হয়ত আমাদের আনাড়ি নাড়াচাড়ায় কোন একটা কল নড়ে-চড়ে পাখাটা একবার ঘুরে উঠছে, আমরা ভাবছি হাওয়া খাওয়াই এর উদ্দেশ্য, কি হয়ত পাখা লেগে কারুর গা হাত-পা কেটে যাচ্ছে তখন ভাবছি এটা একটা উৎপীড়ন।

    উপমাটা ঠিক হল না। কারণ অবস্থা ওর চেয়ে খারাপ এবং আফ্রিকার Bushmat-এর কাছে একটা এয়োপ্লেন যত জটিল ও অর্থহীন, অদ্ভুত জীবনটা আমাদের কাছে তার চেয়ে ঢের বেশি। মানুষ কত কোটি বছর পৃথিবীতে এসেছে এ নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের তর্ক আজও শেষ হয়নি, সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি, কিন্তু জীবনের অর্থ যে আজও পাওয়া যায়নি এ নিয়ে মতভেদ নেই বোধ হয়।

    কবিত্ব করা যায় বটে এই বলে যে বোঝা যায়না বলেই জীবন অপরূপ মধুর সুন্দর, কিন্তু ভাই, মন হা হা করে। কি করি এই দুর্বোধ অনধিগম্য জীবন নিয়ে? যতদিন না মৃত্যু-শীতল হাত থেকে আপনি খসে পড়বে ততদিন এমনি করে ছুটোছুটি করে মরব আর কেঁদে কাটাব?

    তা ছাড়া শুধু সুখ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবার উপায়ও যদি থাকত। তাও ত নেই। আমি হয়ত কুৎসিত আর একজন চিররুগ্ন, আর একজন নির্বোধ, আর একজন অন্ধ বা পঙ্গু, আর একজন দীন ভিখারীর মেয়ে। বলছ আনন্দ না পাও আনন্দের সাধনা কর, কেমন? কিন্তু জন্মান্ধের দেখতে পাবার সাধনা খন্ধের নৃত্যসাধনা করা বোকামি নয় কি? স্কুল জগতে যেমন দেখছি মনের জগতেও অমনি নেই কে বলতে পারে? বোবা হয়ে গানের সাধনা তপস্যা করতে বল কি? জীবনের কোন গানের সাধনায় আমি যোবা তাত জানি না। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ি যদি হয় ত আমার গায়েই লাগবে।

    কি হবে এত সব জিজ্ঞাসায় জর্জরিত হয়ে, সক্রেটিসীয় দার্শনিকের মত মৃত্যুরূপী পরিপূর্ণতার প্রতীক্ষা করে? তার চেয়ে চলল, মাঠে চলল, মোহনবাগানের খেলা দেখে আসি।

    মোহনবাগান। আজকাল আর যেন তেমন করে বাজে না বুকের মধ্যে। সেই ইস্ট ইয়র্কস নেই, ব্ল্যাক-ওয়াচ ডারহামস এইচ-এল-আই ডি-সি-এল-আই নেই, সেই মোহনবাগানও নেই। আজকালকার মোহনবাগান যেন মোহন সিরিজের উপন্যাসের মতই বাসি।

    কিন্তু সেসব দিনের মোহনবাগান মৃত দেশের পক্ষে সঞ্জীবনী ছিল। বলা বাহুল্য হবে না, রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন ছিল বন্দেমাতরম তেমনি খেলার ক্ষেত্রে মোহনবাগান। পলাশীর মাঠে যে কলঙ্কঅর্জন হয়েছিল তার স্থান হবে এই খেলার মাঠে। আসলে, মোহনবাগান একটা ক্লাব নয়, দল নয়, সে সমগ্র দেশ—পরাভূত, পদানত দেশ, সেই দেশের সে উদ্ধত বিজয়-নিশান।

    এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না যে মোহনবাগানের খেলার মাঠেই বাঙলা দেশের জাতীয়তাবোধ পরিপুষ্ট হয়েছিল। যে ইংরেজবিদ্বেষ মনে-মনে ধূমায়িত ছিল মোহনবাগান তাতে বাতাস দিয়ে বিশুদ্ধ আগুনের সুস্পষ্টতা এনে দিয়েছে। অত্যাচারিতের যে অসহায়তা থেকে টেররিজম জন্ম নেয় হয়তো তার প্রথম অঙ্কুর মাথা তুলেছি এই খেলার মাঠে। তখনো খেলার মাঠে সাম্প্রদায়িকতা ঢোকেনি, মোহনবাগান তখন হিন্দু-মুসলমানের সমান মোহনবাগান—তার মধ্যে নেবুবাগান কলাবাগান ছিল না। সেদিন যে ক্যালকাটা মাঠের সবুজ গ্যালারি পুড়েছিল তাতে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, একজন এনেছিল পেল, আরেকজন এনেছিল দিয়াশলাই। সওয়ার পুলিশের উজ্জ্বল ঘোড়ার খুলে একসঙ্গে জখম হয়েছিলে দুজনে।

    সেসব দিনে খেলার মাঠে ঢোকার লাঞ্ছনার কথা ছেড়ে দিই, খেলা মাঠে ঢুকে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে যে অবিচার অনুষ্ঠিত হতে দেখে দেশের লোক, তাতে রক্ত ও বাক্য দুইই তপ্ত হয়ে উঠেছে ইংরেজের বিরুদ্ধে। আর এই তপ্ত বাক্য আর রক্তই ঘরে-বাইরে স্বাধীন হবার সংকল্পে ধার জুগিয়েছে। সেসব দিনের রেফারিগিরি করা ইংরেজের একচেটে ছিল, আর সেই একচোখো রেফারি পদে-পদে মোহনবাগানকে বিড়ম্বিত করেছে। অবধারিত গোল দেবে মোহনবাগান, হুইসল দিয়েছে অফসাইড বলে। ফাউল করলে ক্যালকাটা, ফাউল দিলে না, যদি বা দিলে, দিলে মোহনবাগানের বিপক্ষে। কিছুতেই মোহনবাগানকে দাবানো যাচ্ছে না, বিনামেঘে বজ্রপাতের মত বলা-কওয়া-নেই দিয়ে বসল। পেনাল্টি। একেকটা জোচ্ছরি এমন দুকান-কাটা ছিল যে সাহেবদের কানও লাল না হয়ে থাকতে পারত না। একবার এমনি ক্যালকাটা। সঙ্গে খেলায় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে রেফারি হঠাৎ পেনাল্টি দিয়ে বসল। যেটা খুবই অসাধারণ, ব্যাক থেকে কলভিন না বেনেট এল শট করতে। শট করে সে-বল সে গোলের দিকে না পাঠিয়ে কয়েক মাইল দূর দিয়ে পাঠিয়ে দিলে। সেটা রেফারির গালে প্রায় চড় মারার মত-দিবালোকের মত এমন নিলজ্জ ছিল সেই পেনাল্টি। খেলোয়াড়ের পক্ষে রেফারিকে মারা অত্যন্ত গর্হিত কর্ম সন্দেহ নেই, কিন্তু তিক্তবিরক্ত হয়ে সেদিন যে ভ্যালহৌসির মাঠে বলাই চাটুজ্জে ক্লেটন সাহেবকে মেরেছিল সেটা অবিস্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে।

    শুধু রেফারি কেন, সমস্ত শাসকবংশই মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রী ছিল। নইলে ১৩০৩ সালে মোহনবাগানকে ক্যালকাটার বিরুদ্ধে শি-ফাইন্যালে খেলানো হত না। সেদিন রাত থেকে ভুবনপ্লাবন বা, সারা দিনে এক বিন্দু বিরাম নেই। মাঠে এক হাঁটু জল, কোথাও বা এক কোমর, হেলো না থাকলে সে-মাঠে অনায়াসে ওয়াটার-পোলদা খেলা চলে। ফুটবল বর্ষাকালের খেলা সন্দেহ নেই, কিন্তু বর্ষারও একটা সীমা আছে সভ্য আছে। মোহনবাগান তখন দুর্ধর্ষ দল, ফরোয়াডে শরৎ সিজি, কুমার আর রবি গাঙ্গুলি—তিন তিনটে অভ্রান্ত বুলেট-আর ব্যাকে সেই দুর্ভেদ্য চীনের দেয়ালগোষ্ঠ পাল। ক্যালকাটা ভাল করেই জানে শুকনো মাঠে এই দুর্বারণ মোহনবাগানকে কিছুতেই শায়েস্তা করা যাবে না। সুতরাং বানভাসা মাঠে একবার তাকে নামাতে পারলেই সে কোনঠাসা হয়ে যাবে! শেষদিকে বৃষ্টি বন্ধ করানো গেলেও খেলা কিছুতেই বন্ধ করানো গেল না। ক্যালকাটা কতৃপক্ষের সে অসঙ্গত অনতা পরোক্ষে দেশের মেরুদণ্ডকেই আরো বেশি উদ্ধত করে তুললে। যে করে হোক পরাভূত করতে হবে এই দম্ভদৃপ্তকে। যে সহজ প্রতি যোগিতার ক্ষেত্রে এসেও ভুলতে পারে না সে উপবিতন, সে একতন্ত্রী।

    আর, মোহনবাগানকেও বলিহরি। খেলছিস ফুটবল, ছুটতে গিয়ে যেখানে প্রতিপদে আছাড় খেতে হবে, পায়ে বুট পরে নিস না কেন? উপায় কি, বুট পরলে আর ছুট দিতে পারব না, ছেলেবেলা থেকে অভোস বে। দেশে-গাঁয়ে যখন বাতাবি নেবু পিটেছি তখন থেকে, সেই সুরুর থেকেই তো খালি-পা। জুতো কিনি তার সঙ্গতি কই? স্কুল-কলেজে যাবার জন্যে এক জোড়া জোটানোই কষ্টকর, তায় মাঠে-মাঠে লাফাবার জন্যে আরেক জোড়া? মোটে মা রাধেন না, তং আর। পান্তা। দেখ না এই খালি পায়েই কেমন পক্ষিরাজ ঘোড়া ছুটাই। কেমন দিগ্বিজয় করে আসি। ভেব না, তাক লাগিয়ে দেব পৃথিবীর। খালি পায়েই ঘায়েল করব বুটকে। উনিশশো এগারো সনে এই খালি পায়েই শিল্ড এনেছিলাম। এবার পারলাম না, কিন্তু, দেখো, আবার পারব। যে সব তোমরা।

    যাব তো ঠিক, কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ কোথা থেকে এক টুকরো কালো মেঘ ভেসে এসেছে, অমনি নিমেষে সকলের মুখ কালো হয়ে গেল। হে মা কালীঘাটের কালী, হে মা কালীতলার কালী, তোমরা কে বেশি কালো জানি না, কিন্তু এ মেঘ তোমাদের গায়ে মেখে-মেখে মুছে দাও মা, তোমাদের কালো কেশে উড়িয়ে নিয়ে যাও কৈলাসে। কত তুকতাক, কত মানৎ, কত ইষ্টম, হাওয়া উঠুক, ধুলো উডুক, মেঘ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাক। সব সময় প্রার্থনা কি আর শোনে! মেঘের পরে মেঘ শুধু জমাটই হতে থাকে, ঘন নৈরাশ্যের পর ঘনতর মনস্তাপ। সে যে কী দুঃসময় তা কে বা বোঝে, কাকে বা বোঝাই! ঘাড় গলা উঁচু করে শুধু আকাশের দিকে তাকানো আর মেঘের অবয়ব আর চরিত্র নিয়ে গবেষণা। পশ্চিমের মেঘ যে অমোঘ হয় এই মন্তুদ সত্য চার আনার সবুজ গ্যালারিতে বসেই প্রথম উপলব্ধি করেছি। ফটিকজল পাখি আছে শুনেছি, এখন দেখলাম ফটিকয়োদ পাখি। যারা জ্বল চায় না রোদ চায়, মেঘের বদলে মরুলীর জন্যে হা হা করে। হেনে বৃষ্টি আসবার ছড়া আছে, মেঘ-মাণমন্ত্রের প্রথম ছড়া সৃষ্টি হয় এই মোহনবাগানের মাঠে!

    ওরে মেঘ দূরে
    যা শিগগির উড়ে।
    নেবুর পাতা করমচা
    রকে বসে গরম চা!

    তবু, পাহাড় সরে তো মেঘ সরে না। ব্যঙ্গের ভঙ্গিমায় নেমে আসে বাস্তব বৃষ্টি। মনে হয় না ঘনকৃষ্ণ কেশ আকুলিত করে কেউ কোনো নীপবনে ধারাস্নান করছে। বরং মনে হচ্ছে দেশের মাথার উপর ঝরে পড়ছে দোর্দণ্ড অভিশাপ। আর যেমনি জল ঝরল অমনি মোহনবাগানের জৌলুস গেল ধুয়ে। আশ্চর্য, তখন তাতে না রইল আর বাগান, না বা রইল মোহ। তখন তার নাম গোয়াবাগান বা বাদুড়বাগান রাখলেও কোন ক্ষতি নেই।

    তবু কালে-ভদ্রে এমন একেকটা বোমহর্ষক খেলা সে জিতে ফেলে যে তার উপর আবার মায়া পড়ে, মন বসে। বারেবারে প্রতিজ্ঞা করে মাঠ থেকে বেরিয়েছি ও-হতচ্ছাড়ার খেলা আর দেখব না, আবার বারেবারেই প্রতিজ্ঞা-ভক্ত হয়েছে। তাই তেরোশো তিরিশের হারের পরও যে আবার মাঠে যাব—কল্লোলের দল নিয়ে—তা আর বিচিত্র কি। ওরা খেলে না জিতুক, আমরা অন্তত চেঁচিয়ে জিতব। জিত আমাদের হবেই, হয় খেলায় নয় এই একত্বমেলায়।

    কল্লোলের লাগোয়া পূবের বাড়িতে থাকত আমাদের সুধীনসুধীন্দ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ তরুণ উৎসাহী। সুগৌর-সুন্দর চেহারা, সকলের স্নেহভাজন। দলপতি স্বয়ং দীনেশ। যৌবনের সেই যৌবরাজ্যে বয়সের কোনো ব্যবধান ছিল না, আর মোহনবাগানের খেলা এমন এক ব্যাপার যেখানে ছেলে-বুড়ো শ্বশুরজামাই সব একাকার, সকলের এক দূরে মাথা মোড়ানো। অতি উৎসাহে সামনে কারু পিঠে হয়তো চাপড় দিয়েছি, ভদ্রলোক ঘড় ফেরাতেই চেয়ে দেখি পূজ্যপাদ প্রফেসর। উপায় নেই, সব এখন এক সানকির ইয়ার মশাই, এক গ্যালারির গায়েক-গায়েন। আরো একটু টানুন কথাটা, এক সুখদুঃখের সমাংশভাগী! তাই, ঐ দেখুন খেলা, বেশিক্ষণ ঘাড় ফিরিয়ে চোখ গোল করে পেছনে তাকিয়ে থাকার কোন মানে হয় না। বলা বাহুল্য, উত্তেজনার তরলে ঐ সব ছোটখাট রাগ-দুঃখের কথা ভুলে যেতে হয়, আর দর্শকদের বহু জন্মের সুকৃতির ফলে মোহনবাগান যদি একবার গোল দেয়, তখন সেই পূজ্যপাদ প্রফেসরও হাত-পা ছুড়ে চীৎকার করেন আর ছাত্রের গলা ধরে আনন্দ-মহাসমুদ্রে হাবুবু খান। সব আবার এক খেয়ার জল হয়ে যায়।

    বস্তুত আট আনার লোহার চেয়ারে বসে কি করে যে ভালোক সেজে ফুটবল খেলা দেখা চলে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। এ কি ক্রিকেট খেলা, যে পাঁচ ওভার ঠুকঠাক করবার পর খুঁচ করে একটা গ্লান্স হবে, না, সা করে একটা ড্রাইভ হবে। এর প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগে উত্তেজনায় ঠাসা, বল এখন বিপক্ষের গোলের কাছে, পলক না পড়তেই আবার নিজের নিজের হৃৎপিণ্ডের দুয়ারে। সাধ্য কি তুমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে পার। এই, সেন্টার কর, ওকে পাশ দে, ঐখানে থ, মা—এমনি বহু নির্দেশ-উপদেশ দিতে হবে তোমাকে। শুধু তাই? কখনো কখনো শাসন-তিরস্কারও করতে হবে বৈ কি। খেলতে পারিস না তো নেমেছিস কেন, ল্যাকপ্যাক করছিস যে মাল খেয়ে নেমেছিস নাকি, বুক দিয়ে পড় গোলের কাছে, পা দুখানা যায় তো সোনা দিয়ে মিউজিয়মে বাঁধিয়ে রাখব। তারপর কেউ যদি গোল মিস করে, তখন আবার উল্লম্ফন : বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা মাঠ থেকে, গিন্নির আঁচল ধরে থাক গে। আর যদি রেফারি একটা অমনোমত রায় দেয় অমনি আবার উচ্চঘাষ : মারে, মারে শালাকে, থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দাও। এ সব মহৎ উত্তেজনা গ্যালারি ছাড়া আর কোথায় হওয়া সম্ভব? উঠে দাঁড়াতে না পারলে উল্লাস উল্লোল হওয়া যায় কি করে? তাই গ্যালারিতেই আমাদের কায়েমী আসন ছিল, মাঝ-মাঠে সেন্টারের কাছাকাছি, পাঁচ কি ছয় ধাপ উপরে। প্রায়ই আমরা এক সঙ্গে যেতাম কল্লোল-আপিস থেকে—দীনেশদা, সোমনাথ, গোরা, নৃপেন, প্রেমেন, সুধীন আর আমি কোনো কোন দিন আত ঘোষ সঙ্গে জুটত। আরো কিছু পরে অবোধ সান্যাল। অবিশ্যি যে সব দিন এগারোটা-বারোটায় এসে লাইন ধরতে হত সে সব দিন মাঠের বাইরে আগে থেকে সবাই একত্র হওয়া যেত না, কিন্তু মাঠে একবার ঢুকতে পেরেছ কি নিশ্চিন্ত আছ তোমার নির্ধারিত জায়গা আছে। নজরুল আরো পরে ঢেকে খেলার মাঠে এবং তখনো সে বেশ সন্ত্রান্ত ও খ্যাতিচিহ্নিত। তাই সে জনগণের গ্যালারিতে না এসে বসেছে গিয়ে আট আনার চেয়ারে, কিন্তু তার উল্লাস-উড্ডীন রঙিন উত্তরীয়টি ঠিক আছে। অবিশ্যি চাদর গায়ে দিয়ে খেলার মাঠে আসতে হলে অমনি উচ্চতর পদেই আসা উচিত। আমাদের তো জামা ফদা-ফাই আর জুতো চিচিংফাঁক। বৃষ্টি নেই এক বিন্দু, অথচ তিন ঘণ্টা ধস্তাধস্তি করে মাঠে ঢুকে দেখি এক হাঁটু কাদা। ব্যাপার কি? শুনলাম জনগণের মাথার ঘাম পায়ে পড়ে-পড়ে ভূমিতল কাদা হয়ে গেছে। সঙ্গে না আছে ছাতা না বা ওয়াটারপ্রুফ-শুধু এক চশমা সামলাতেই প্রাণান্ত। কনুয়ের ঠেলায় কত লোকের চশমা যে নাসিকাচ্যুত হয়েছে তার ইতি-অন্ত নেই। আর চক্ষুলজ্জাহীন চশমাই যদি চলে যায় তবে আর রইল কি? কখনো-কখনো ভূমিপৃষ্ঠ থেকে পাদস্পর্শ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, জলে ভাসা জানি, এ দেখছি সূলে ভাসা। নগ্ন। পদের খেলা দেখতে রিক্ত হাতে শূন্য মাথায় কখনো ব নগ্ন পদেই মাঠে ঢুকেছি।

    শুধু গোকুলকেই দেখিনি মাঠে, তার কারণ কল্লোলের দ্বিতীয় বছরেই ভার অমুখ করে আর সে-অসুখ আর তার সারে না। কিন্তু যতদুর মনে পড়ে শৈলজা একদিন গিয়েছিল আর চুপি-চুপি জিগগেস করেছিল, গোঠ পাল কোন জন? আরো পরে, বুদ্ধদেব বসুকে একদিন নিয়ে গিয়েছিলাম, সে বলেছিল, কনার আবার কাকে বলে? শুনেছি ওরা আর দ্বিতীয় দিন মাঠে যায়নি।

    তবু তো এখন কিউ হয়েছে, আগে-আগে ঘোড়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ঢুকতে হয়েছে, মাঝদিকে তার কাছ থেকে বেশি দরে টিকিট কিনে। আগে-আগে গ্যালারির বাইরে কাটা-তারের বন্ধন ছিল না, বাইরের কত লোককে যে কত জনে টেনে তুলেছে ভিতর থেকে তার লেখাজোখা নেই। যাকে টেনে তুলছে সে যে সব সময়ে পরিচিত বা আত্মীয়বস্তু তার কোনো মানে নেই, দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাও বলা যায় না, তবু নিঃস্বার্থভাবে পরোপকার করা—এই একটা নিষ্কাম আনন্দ ছিল। এখন কাঁটাতালের বড় কড়াকড়ি, এখন কিউর লাইন এসে দাঁড়ায় হল-য়্যাণ্ড-য়্যাণ্ডাসন পর্যন্ত, খেলা দেখায় আর সেই পৌরুষ কই।

    নরক গুলজার করে খেলা দেখতাম সবাই। উল্লাসজ্ঞাপনের যত রকম রীতিপদ্ধতি আছে সব মেনে চলতাম। এমন কি পাশের লোকের হাত থেকে কেড়ে ছাতা ওড়ানো পর্যন্ত। বৃষ্টি বদি নামত তো চেঁচিয়ে উঠতাম সবার সঙ্গে : ছাতা বন্ধ, ছাতা বন্ধ। যাড সোজা বেখে ভিজতাম। শেষকালে যখন চশমার কাচ মুছবার জন্যে আর কোনো কাপড় থাকত না তখনই বাধ্য হয়ে কারু ছাতার আশ্রয়ে বসে পড়তে হত। খেলা যদি দেখতে চাও তো বসে থাকে। ভিড়ে বেরাল হয়ে। মনে আছে এমনি এক বর্ষার মাঠে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে এক ছাতার তলায় গুড়ি মেরে বসেছিলাম সারাক্ষণ। বৃষ্টির জলের চেয়ে পার্শ্ববর্তী ছাতার জলই যে বেশি বিরক্তিকর মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম সেদিন।

    কিন্তু যদি আকাশভরা সোনার রোদ থাকে, মাঠ শুকনো খটখটে, তবে সব কষ্ট সহ্য করবার দায়ধারী আছি। আর সে গগনলন গ্রীষের কষ্টই কি কম। তারপর যদি দুপুর থেকে বসে থেকে মাথার রোদ ক্রমে-ক্রমে মুখের উপর তুলে আনতে হয়। কিন্তু, খবর, ভুলেও জল চেও না, জল চাইতে না মেঘ এসে উদয় হয়! যা দেবী সর্বভূতেষু তৃষ্ণারূপেন সংস্থিতা তার ধ্যান কব। বরফের টুকরো বা কাটা শশা। বা বাতাবিনেবু না জোটে তো শুকনো চীনেবাদাম খাও। আর যদি ইচ্ছে করো আলগোছে কারে শূন্য পকেটে শুকনো খোমলো চালান করে দিয়ে বকধার্মিক সাজো।

    যেমনি দুই দিক থেকে দুই দল শূন্তে বল হাই কিক মেয়ে মাঠে নামল অমনি এক ইঙ্গিতে সবাই উঠে দাঁড়াল গ্যালারিতে। এই গ্যালারিতে উঠে দাঁড়ানো নিয়ে বন্ধুবর শচীন করকে একবার কোন সাপ্তাহিকে আক্ষেপ করতে দেখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তার বক্তব্য ছিল এই, যে, গ্যালারিতে যে যার জায়গাই বসেই তো দিব্যি খেলা দেখা যায়, তবে মিছিমিছি কেন উঠে দাঁড়ানো? ধু যে যোগ্য উত্তেজনা দেখানোর তাগিদেই উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে তা নয়, উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে আট আনার চেয়ার ও চার আনার গ্যালারির মধ্যেকার জায়গায় লোক দাঁড়িয়েছে বলে। বাধ্য হয়েই তাই গ্যালারির প্রথম ধাপের লোককে দাঁড়াতে হচ্ছে এবং তার ফলে একে-একে অন্যান্য ধাপ। তাছাড়া বসে বসে বড় জোর হাততালি দেওয়ার মত খেলা তো এ নয়। উঠে দাঁড়াতেই হবে তোমাকে, অন্তত মোহনবাগান যখন গোল দিয়েছে। কখনো-কখনো সে চীৎকার নাকি বালি থেকে বালিগঞ্জ পর্যন্ত শোনা গেছে। সে চীৎকার কি বসে-বসে হয়?

    তবু এত করেও কি প্রত্যেক খরার দিনেই জেতাতে পেরেছি মোহনবাগানকে? একেবারে ঠিক চূড়ান্ত মুহূর্তে অত্যন্ত অনাবশ্যক ভাবে হেরে গিয়েছে দুর্বলতর দলের কাছে। কুমোরটুলি এরিয়ান্স হাওড়া ইউনিয়নের কাছে। ঠিক পারের কাছে নিয়ে এসে বানচাল করে দিয়েছে নৌকো। সে সব দুর্দৈবের কথা ভাবতে আজো নিজের জয়ে দুঃখ হয়—সেই ঝেড়ো কাক হয়ে ম্লান মুখে বাড়ি ফিরে যাওয়া। চলায় শক্তি নেই, রেস্তরাঁয় ভক্তি নেই—এত সাধের চীনেবাদামে পর্যন্ত বাদ পাচ্ছি না—সে কি শোচনীয় অবস্থা! ওয়ালফোর্ডের হাদ-খোলা দোতলা বাস-এ সান্ধ্যভ্রমণ তখন একটা বিলাসিতা, তাতে পর্যন্ত মন ওঠে না, ইচ্ছে করে ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাশে উঠে মুখ লুকোই। কে একজন যে মোহনবাগানের হেরে যাওয়ায় আত্মহত্যা করেছিল তার মর্মবেদনাটা যেন কতক বুঝতে পারি। তথনই এতিয়া করি আর যাব না ঐ অভাগ্যের এলাকায়। কিন্তু হঠাৎ আবার কোন সুদিনে সমস্ত সংকল্প পিটটান দেয়। আবার একদিন পাঞ্জাবির, ঘড়ির পকেটে গুনে-গুনে পয়সা গুঁজি। বুঝতে পারি মোহনবাগান যত না টানে, টানে সেন্টারের কাছাকাছি সেই কল্লোলের দল।

    আচ্ছা, এরিয়ান্স হাওড়া ইউনিয়ন—এরাও তো দিশি টিম, তবে এরা জিতলে খুশি হই না কেন, কেন মনে-মনে আশা করি এরা মোহনবাগানকে ভালবেসে গোল ছেড়ে দেবে, আর গোল ছেড়ে না দিলে কেন চটে যাই? যখন এরা সাহেব টিমের সঙ্গে খেলছে তখন অবিশ্যি আছি আমরা এদের পিছনে, কিন্তু মোহনবাগানের সঙ্গে খেলতে এসেছ কি খবরদার, জিততে পাবে না, লক্ষ্মী ছেলের মত লাড্ড, খেয়ে বাড়ি ফিরে যাও। মোহনবাগানের ঐতিহ্যকে নষ্ট কোনো না যেন।

    রোজ-বোজ খেলা দেখার ভিড় ঠেলার চেয়ে মোহনবাগানের মেম্বর হয়ে যাওয়া মন্দ কি। কিন্তু মেম্বর হয়েও যে কি দুর্ভোগ হতে পারে তারও দৃষ্টান্ত দেখলাম। একদিন কি একটা খবরের কাগজের শুম্ভকাপানো বিখ্যাত খেলায় দেখতে পেলাম তিন-চারজন মেম্বর মাঠে না ঢুকে বাইরে বসে সিগারেট ফুকছে, তাদের ঘিরে ছোট্ট একটি ভিড়। বিশ্বসাতীত ব্যাপার-ভিতরে ঐ চিত্ত-চমকানো খেলা, আকাশঝলসানো চীৎকার—অথচ এ কয়জন জাদরেল মেম্বর বাইরে ঘাসের উপর বসে নির্লিপ্ত মুখে সিগারেট খাচ্ছে আর মন্দ মন্দ পা দোলাচ্ছে। ভিড়ের থেকে একজন এগিয়ে গিয়ে বিস্মিত স্বরে জিগগেস করলে, এ কি, আপনারা মাঠে ঢোকেন নি যে? ভদ্রলোকের মধ্যে একজন বললে: আমরা তো কেউ মাঠে ঢুকি না, বাইরেই বসে থাকি চিরদিন। আমরা non-seeing মেম্বর। তার মানে? তার মানে, আমরা অপয়া, অনামুখো, অলক্ষুনে, আমরা মাঠে ঢুকলেই মোহনবাগান নির্ঘাৎ হেরে যায়, মেম্বর হয়েও আমরা তাই খেলা দেখি না, বাইরে বসে যাতে ঘাস কাটি আর চীৎকার শুনি।

    এই অপূর্ব স্বার্থশূন্যতার কথা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার যোগ্য। বাড়িতে বা অন্য কোথাও গেলে বা বসে থাকলে চলবে না, খেলার মাঠে আসতে হবে ঠিক, আর খেলার মাঠে অনায়াসে ঢোকবার হকদার হয়েও ঢুকবে না কিছুতেই, বাইরে বসে থাকবে এককোণে—এমন আত্মত্যাগের কথা এ যুগের ইতিহাসে বড় বেশি শোনা যায়নি। আবো একটা উদাহরণ দেখেছি স্বচক্ষে একটি খঞ্জ ভদ্রলোকের মাধ্যমে। কি হল, পা গেল কি করে? গাড়ি-চাপ? ভদ্রলোক কঠিন মুখে করুণ ভাবে হাসলেন। বললেন, না। ফুটবল-চাপা। সে কি কথা? আর কথা নয়, কাজ ঠিক আদায় করে নিয়েছেন ষোল আনা। শুধু আপনাকে বলছি না, দেশের লোককে বলছি। সবাই বলেছিলেন ফুটবল মাঠে পা-খানা রেখে আসতে, আপনাদের কথা শুনে তাই রেখে এসেছি। কই এখন সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখবেন না যাদুঘরে?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএ ডলস হাউস – অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ
    Next Article কাকজ্যোৎস্না – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }