Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    লেখক এক পাতা গল্প315 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২৪. তারাশঙ্করের আবির্ভাব

    তারাশঙ্করেরও প্রথম আবির্ভাব কল্লোলে।

    অজ্ঞাত-অখ্যাত তারাশঙ্কর। হয়তো পৈত্রিক বিষয় দেখবে, নয়তো কয়লাখাদের ওভারম্যানি থেকে শুরু করে পারমিট-ম্যানেজার হবে। কিংবা বড় জোর স্বদেশি করে এক-আধবার জেল খেটে এসে মন্ত্রী হবে।

    কিন্তু বাংলা দেশের ভাগ্য ভালো। বিধাতা তার হাতে কলম তুলে দিলেন, কেরানি বা খাজাঞ্চির কলম নয়, স্রষ্টার কলম। বেঁচে গেল তারাশঙ্কর। শুধু বেঁচে গেল নয়, বেঁচে থাকল।

    সেই মামুলি রাস্তায়ই চলতে হয়েছে তারাশঙ্করকে। গাঁয়ের সাহিত্য সভায় কবিতা পড়া, কিংবা কারুর বিয়েতে প্রীতি-উপহার লেখা, যার শেষ দিকে না বা প্রভুকে লক্ষ্য করে কিছু ভাবাবেশ থাকবেই। মাঝেমাঝে ওর চেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে হত না তা নয়। ডাক-টিকিটসহ গোটা কবিতা পাঠাতে লাগল মাসিকপত্রে। কোনোটা ফিরে আসে, কোনোটা আবার আসেই না—তার মানে, ডাক-টিকিটসহ গোটা কবিতাটাই লোপাট হয়ে যায়। এই অবস্থায় মনে শ্মশানবৈরাগ্য আসার কথা। কিন্তু তারাশঙ্করের সহিষ্ণুতা অপরিমেয়। কবিতা ছেড়ে গেল সে নাট্যশালায়।

    গাঁয়ে পাকা স্টেজ, অঢেল সাজ-সরঞ্জাম, মায় ইলেটিক লাইট আর ডায়নামো। যাকে বলে ষোল কলা। সেখানকার সখের থিয়েটারের উৎসাহ যে একটু তেজালো হবে তাতে সন্দেহ কি। নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেই নাট্যসভার সভাপতি—তার নিজেরও লাহিত্যসাধনার মূলধারা ছিল এই নাট্যসাহিত্য। তা ছাড়া তিনি কৃতকীর্তি—তার নাটক অভিনীত হয়েছে কলকাতায়। তারাশঙ্কর ভাবল, জুনেই বুঝি সুগম পথ, অমনি নাটক লিখে একেবারে পাদপ্রদীপের সামনে চলে আসা। খ্যাতির তিলক না পেলে সাহিত্য বোধহয় জলের তিলকের মতই অসার।

    নাটক লিখল তারাশঙ্কর। নির্মলশিববাবু তাকে সাননে সংবর্ধনা করলেন—সখের থিয়েটারের রথী-সারথিরাও উৎসাহে-উদ্যমে মেতে উঠল। মঞ্চস্থ করলে নাটকখানা। বইটা এত জমল যে নির্মলশিববাবু ভাবলেন একে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে রাজধানীতে নিয়ে যাওয়া দরকার। তদানীন্তন আর্ট-থিয়েটারের চাইদের সঙ্গে নির্মলশিববাবুর দহরম-মহরম ছিল, নাটকখানা তিনি তাদের হাতে দিলেন। মিটমিটে জোনাকির দেশে বসে তারাশঙ্কর বিদ্যুৎদীপতির স্বপ্ন দেখলে। আর্ট-থিয়েটার বইখানি সযত্নে প্রত্যর্পণ করলে, বলা বাহুল্য অনধীত অবস্থায়ই। সঙ্গে সঙ্গে নির্মলশিববাবুর কানে একটু গোপনগুঞ্জনও দেয়া হল : মশাই, আপনি জমিদার মানুষ, আমাদের বন্ধুলোক, নাট্যকার হিসেবে ঠাঁইও পেয়েছেন আসরে। আপনার নিজের বই হয়, নিয়ে আসবেন, যে করে হোক নামিয়ে দেব। তাই বলে বন্ধুবান্ধব শালা-জামাই আনবেন না ধরে-ধরে।

    নির্মলশিববাবু তারাশঙ্করের মামাশ্বশুর।

    সবিষাদে বইখানি ফিরিয়ে দিলেন তারাশঙ্করকে। ভেবেছিলেন কথাগুলি আর শোনাবেন না, কিন্তু কে জানে ঐ কথাগুলোই হয়তে মনের মত কাজ করবে। তাই না শুনিয়ে পারলেন না শেষ পর্যন্ত, বললেন, তুমি নাকি অপাঙক্তেয়, তুমি নাকি অনধিকারী। রঙ্গমঞ্চে তোমায় স্থান হল না তাই, কিন্তু আমি জানি তোমার স্থান হবে বঙ্গমালঞ্চে। তুমি নিরাশ হয়ো না। মনোভদ মানায় না তোমাকে।

    স্তোকবাক্যের মত মনে হল। রাগে-দুঃখে নাটকখানিকে অলঃ উনুনের মধ্যে গুঁলে দিল তারাশঙ্কর।

    ভাবল সব ছাই হয়ে গেল বুঝি! পাদপ্রদীপের আলো বুঝি সব নিবে গেল। হয়ত গিয়ে ঢুকতে হবে কয়লাখাদের অন্ধকারে, কিংবা জমিদারি সেরেস্তার ধুলো-কাদার মধ্যে। কিংবা সেই গতানুগতিক শ্রীঘরে। নয়তো গলায় তিনকন্ঠী তুলসীর মালা দিয়ে সোজা বৃন্দাবন।

    কিন্তু, না, পথের নির্দেশ পেয়ে গেল তারাশঙ্কর। তার আত্মসাক্ষাৎকার হল।

    কি-এক মামুলি স্বদেশী কাজে গিয়েছে এক মফস্বলি শহরে। এক উকিলের বাড়ির বৈঠকখানায় তক্তপোশের এক ধারে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে-শুয়ে আর সময় কাটে না—কিছু একটা পড়তে পেলে মন্দ হত না হয়তো। যেমন ভাবনা তেমনি সিদ্ধি। চেয়ে দেখলো তক্তপোশের তলায় কি-একটা ছাপানো কাগজ-মতন পড়ে আছে। নিলাম-ইস্তাহার জাতীয় কিছু না হলেই হয়। কাগজটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিল তারাশঙ্কর। দেখল মলাট-ছেঁড়া ধুলোমাখা একখানা কালিকলম।

    নামটা আশ্চর্যরকম নতুন। যেন অনেক শক্তি ধরে বলেই এত সহজ। উলটে-পালটে দেখতে লাগল তারাশঙ্কর। কি-একটা বিচিত্র নামের গল্প পেয়ে থমকে গেল। গল্পের নাম পোনাঘাট পেরিয়ে—আর লেখকের নামও দুঃসাহসী-প্রেমেন্দ্র মিত্র।

    এক নিশ্বাসে গল্পটা শেষ হয়ে গেল। একটা অপূর্ব আস্বাদ পেল তারাশঙ্কর, যেন এক নতুন সাম্রাজ্য আবিষ্কার করলে। যেন তার প্রজ্ঞানময় তৃতীয় চক্ষু খুলে গেল। খুঁজে পেল সে মাটিকে, মলিন অথচ মহত্বময় মাটি; খুঁজে পেল সে মাটির মানুষকে,উৎপীড়িত অথচ অপরাজেয় মানুষ। পতিতের মধ্যে খুঁজে পেল সে শাশ্বত আত্মার অমৃতপিপাসা উঠে বসল তারাশঙ্কর। যেন তার মন্ত্রচৈতন্য হল।

    স্বাদু স্বাদু পদে পদে। পৃষ্ঠা ওলটাতে-ওলটাতে পেল সে আরেকটা গল্প। শৈলজানন্দর লেখা। গল্পের পটভূমি বীরভূম, তারাশঙ্করের নিজের দেশ। এ যে তারই অন্তরঙ্গ কাহিনী–একেবারে অন্তরের ভাষায় লেখা! মনের সুষমা মিশিয়ে সহজকে এত সত্য করে প্রকাশ করা যায় তা হলে! এত অর্থান্বিত করে। বাংলা সাহিত্যে নবীন জীবনের আভাস-আস্বাদ পেয়ে জেগে উঠল তারাশঙ্কর। মনে হল হঠাৎ নতুন প্রাণের প্লাবন এসেছে–নতুন দর্শন নতুন সন্ধান নতুন জিজ্ঞাসার প্রদীপ্তি-নতুন বেগবীর্যের প্রবলতা। সাধ হল সেও এই নতুনের বন্যায় পা ভাসায়। নতুন বসে কলম ডুবিয়ে গল্প লেখে।

    কিন্তু গল্প কই? গল্প তোমার আকাশে-বাতাসে মাঠে-মাটিতে হাটেবাজারে এখানে-সেখানে। ঠিক মত তাকাও, ঠিক মত শোনো, ঠিক মত বুকের মধ্যে অনুভব করে।

    বৈষয়িক কাজে ঘুরতে ঘুরতে তারাশঙ্কর তখন এসেছে এক চাষীগাঁয়ে। যেখানে তার আস্তানা তার সামনেই রসিক বাউলের আখড়া। সরোবরের শোভা যেমন পদ্ম, তেমনি আখড়ার শোভা কমলিনী বৈষ্ণবী।

    প্রথম দিনই কমলিনী এসে হাজির—কেউ না ডাকতেই। হাতে তার একটি রেকাবি, তাতে দুটি সাজা পান আর কিছু মশলা। রেকাবিটি তারাশঙ্করের পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে প্রণাম করলে গড় হয়ে, বললে, আমি কমলিনী বৈষ্ণবী, আপনাদের দাসী।

    শ্রবণলোভন কণ্ঠস্বর। অতুল-অপরূপ তার হাসি। সে-হাসিতে অনেক গভীর গল্পের কথকতা।

    কি একটা কাজে ঘরের মধ্যে গিয়েছে তারাশঙ্কর, শুনল গোমস্তা কমলিনীর সঙ্গে রসিকতা করছে; বলছে, বৈষ্ণবীর পানের চেয়েও কথা মিষ্টি—তার চেয়েও হাসি মিষ্টি–

    জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল কমলিনীর মুখ। সহজের সুষমা মাখান সে-মুখে। যেন বা সর্বসমর্পণের শান্তি। মাথার কাপড়টা আরো একটু টেনে নিয়ে আরো একটু গোপনে থেকে সে হাসল। বললে, বৈষ্ণবের ওই তো সম্বল প্রভু।

    কথাটা লাগল এসে বাঁশির সুরের মত। যে সুর কানের নয়, মর্মের-কানের ভিতর দিয়ে যা মর্মে এসে লেগে থাকে। শুধু লোত্রের কথা নয়, যেন তত্ত্বের কথা—একটি সহজ সরল আচরণে গহন-গৃঢ় বৈষ্ণব তত্বের প্রকাশ। কোন সাধনায় এই প্রকাশ সম্ভবপর হল—ভাবনায় ভোর হয়ে গেল তারাশঙ্কর। মনে নেশার ঘোর লাগল। এ যেন কোন আনন্দসায় গভীর প্রাপ্তির স্পর্শ!

    এল বুড়ো বাউল বিচিত্রবেশী রসিক দাস। যেমন নামে-ধামে তেমনি কথায়-বার্তায়, অত্যুজ্জ্বল রসিক সে। আনন্দ ছাড়া কথা নেই। সংসারে সৃষ্টিও মায়া সংহারও মায়া-সুতরাং সব কিছুই আনন্দময়।

    এ কে কমলিনীর?

    কমলিনীর আখড়ায় এ ঝাড়ুদার। সকাল-সন্ধেয় ঝাড়ু দেয়, জল তোলে, বাসন মাজে–আর গান গায়। মহানন্দে থাকে।

    তারাশঙ্কর ভাবলে এদের নিয়ে গল্প লিখলে কেমন হয়। এ মধুভাব সাধন–শ্রদ্ধাযুক্ত শান্তি–এর বসতত্ত্ব কি কোনো গল্পে জীবন্ত করে রাখা যায় না?

    কিন্তু শুরু করা যায় কোত্থেকে?

    হঠাৎ সামনে এল আধ-পাগলা পুলিন দাস। ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে।

    রাতে চুপচাপ বসে আছে তারাশঙ্কর, কমলিনীর আখড়ার কথাবার্তা তার কানে এল।

    পুলিন আড্ডা দিচ্ছিল ওখানে। বাড়ি যাবার নাম নেই। রাত নিঝুম হয়েছে অনেকক্ষণ।

    কমলিনী বলছে, এবার বাড়ি যাও।

    না। পুলিন মাথা নাড়ছে।

    না নয়। বিপদ হবে।

    বিপদ? কেনে? বিপদ হবে কেনে?

    গোসা করবে। করবে নয় করেছে এতক্ষণ।

    কে?

    তোমার পাঁচসিকের বষ্টুমি। বলেই কমলিনী ছড়া কাটল : পাঁচসিকের বোষ্টুমি তোমার গোসা করেছে হে গোসা করেছে–

    তারাশঙ্করের কলমে গল্প এসে গেল। নাম রসকলি। গল্পে বসিয়ে দিলে কথাগুলো।

    তারপর কি করা! সব চেয়ে যা আকাঙ্ক্ষনীয়, প্রবাসীতে পাঠিয়ে দিল তারাশঙ্কর। সেটা বোধ হয় বৈশাখ মাস, ১৩৩৪ সাল। সঙ্গে ডাক-টিকিট ছিল, কিন্তু মামুলি প্রাপ্তিসংবাদও আসে না। বৈশাখ গেল, জ্যৈষ্ঠও যায়-যায়, কোন খবর নেই। অগত্যা তারাশঙ্কর জোড়া কার্ডে চিঠি লিখলে। কয়েকদিন পরে উত্তর এল—গল্পটি সম্পাদকের বিবেচনাধীন আছে। জ্যৈষ্ঠর পর আষাঢ়, আষাঢ়ের পর—আবার জোড়া কার্ড ছাড়ল তারাশঙ্কর। উত্তর এল, সেই একই বয়ান-সম্পাদক বিবেচনা করছেন। ভাদ্র থেকে পৌষে আরো পাঁচটা জোড়াকার্ডে একই খবর সংগৃহীত হল—সম্পাদক এখনো বিবেচনাময়। পৌষের শেষে তারাশঙ্কর জোড়া পায়ে একেবারে হাজির হল এসে প্রবাসী আপিসে।

    আমার গল্পটা–সভয় বিনয়ে প্রশ্ন করল তারাশঙ্কর।

    ওটা এখনো দেখা হয়নি।

    অনেক দিন হয়ে গেল—

    তা হয়। এ আর বেশি কি! হয়তো আরো দেরি হবে।

    আরো?

    আরো কতদিনে হবে ঠিক বলা কঠিন।

    একমুহূর্ত ভাবল তারাশঙ্কর। কাঁচের বাসনের মত মনের বাসনাকে ভেঙে চুরমার করে দিলে। বললে, লেখাটা তাহলে ফেরৎ দিন দয়া করে।

    বিনাবাক্যব্যয়ে লেখাটি ফেরৎ হল। পথে নেমে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারাশঙ্কর। মনে মনে সংকল্প করল লেখাটাকে নাটকের মতন অগ্নিদেবতাকে সমর্পণ করে দেবে, বলবে : হে অর্চি, শেষ অর্চনা গ্রহণ কর। মনের সব মোহ ভ্রান্তি নিমেষে ভস্ম করে দাও। আর তোমার তীব্র দীপ্তিতে আলোকিত কর জীবনের সত্যপথ।

    অগ্নিদেবতা পথ দেখালেন। দেশে ফিরে এসেই তারাশঙ্কর দেখল কলেরা লেগেছে। আগুন পরের কথা, কোথাও এতটুকু তৃষ্ণার জল নেই। দুহাত খালি, সেবা ও স্নেহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারাশঙ্কর। গল্পটাকে ভস্মীকৃত করার কথা আর মনেই রইল না। বরং দেখতে পেল সেই পুঞ্জীকৃত অজ্ঞান ও অসহায়তার মধ্যে আরো কত গল্প। আরো কত জীবনের ব্যাখ্যান।

    একদিন গাঁয়ের পোস্টাপিসে গিয়েছে তারাশঙ্কর। একদিন কেন প্রায়ই যায় সেখানে। গাঁয়ের বেকার ভবঘুরেদের এমন আড্ডার জায়গা আর কি আছে! নিছক আড্ডা দেওয়া ছাড়া আরো দুটো উদ্দেশ্য ছিল। এক, দলের চিঠিপত্র সদ্য-সদ্য পিওনের হাত থেকে সংগ্রহ করা; দুই, মাসিক-পত্রিকা-ফেরৎ লেখাগুলো গায়ের কাপড়ে ঢেকে চুপিচুপি বাড়ি নিয়ে আসা। এমনি একদিন হঠাৎ নজরে পড়ল একটা চমৎকার ছবি আঁকা মোড়কে কি-একটা খাতা না বই। এসেছে নির্মলশিববাবুর ছোট ছেলে নিত্যনারায়ণের নামে। নিত্যনারায়ণ তখন স্কুলের ছাত্র, রাশিয়াভ্রমণের খ্যাতি তখন তার জয়টীকা হয়নি। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল তারাশঙ্কর। এ যে মাসিক পত্রিকা। এমন সুন্দর মাসিক পত্রিকা হয় নাকি বাংলাদেশে! চমৎকার ছবিটা প্রচ্ছদপটের– সমুদ্রতটে নটরাজ নৃত্য করছেন, তাঁর পদপ্রান্তে উন্মথিত মহাসিন্ধু তাণ্ডবতালে উদ্বেলিত হচ্ছে—ধ্বংসের সংকেতের সঙ্গে এ কি নতুনতনো সৃষ্টির আলোড়ন। নাম কি পত্রিকার? এক কোণে নাম লেখা : কল্লোল। কল্লোল অর্থ শুধু ঢেউ নয়, কল্লোলের আরেক অর্থ আনন্দ।

    ঠিকানাটা টুকে নিল তারাশঙ্কর। নতুন বাঁশির নিশান শুনল সে। মনে পড়ে গেল রসকলির কথা—সেটা তো পোড়ানো হয়নি এখনো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে গল্পের শেষ পৃষ্ঠাটা সে নতুন করে লিখলে। ও পৃষ্ঠার পিঠে প্রবাসীতে পাঠাবার সময়কার পোর্ক পড়েছে, তাই ওটাকে বদলানো দরকার—পাছে এক জায়গার ফেরৎ লেখা অন্য জায়গায় না অরুচিকর হয়। জয় দুর্গা বলে পাঠিয়ে দিল লেখাটা। যা থাকে অদৃষ্টে।

    অলৌকিক কাণ্ড–চারদিনেই চিঠি পেল তারাশঙ্কর। শাদা শোস্টকার্ডে লেখা। সে-কালে শাদা পোস্টকার্ডের আভিজাত্য ছিল। কিন্তু চিঠির ভাষায় সমস্থ আত্মীয়তার সুর। কোণের দিকে গোল মনোগ্রামে কল্লোল আঁকা, ইতিতে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। মোটমাট, খবর কি? খবর আশার অধিক শুভ-গল্পটি মনোনীত হয়েছে। আরো সুখদায়ক, আসচে ফাল্গুনেই ছাপা হবে। শুধু তাই নয়, চিঠির মাঝে নির্ভুল সেই অন্তরঙ্গতার স্পর্শ যা স্পর্শমণির মত কাজ করে : এতদিন আপনি চুপ করিয়া ছিলেন কেন?

    পবিত্রব চিঠির ঐ লাইনটিই তারাশঙ্করের জীবনে সঞ্জীবনীর কাজ করলে। যে আগুনে সমস্ত সংকল্প ভস্ম হবে বলে ঠিক করেছিল সেই আগুনই জাললে এবার আশ্বাসিকা শিখা। সত্য পথ দেখতে পেল তারাশঙ্কর। সে পথ সৃষ্টির পথ, ঐশ্বর্যশালিতার পথ। যোগশাস্ত্রের ভাষায় ব্যুত্থানের পথ। পবিত্রর চিঠির ঐ একটি লাইন, কল্লোলের ঐ একটি স্পর্শ, অসাধ্যসাধন করল–যেখানে ছিল বিমোহ, সেখানে নিয়ে এল একা, যেখানে বিমর্ষতা, সেখানে প্রসঙ্গসমাধি। যেন নতুন করে গীতার বাণী বাহিত হল তার কাছে : তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব, জিত্বা শত্রূন ভূঙ্ক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধং–তারাশঙ্কর দৃঢ়পরিকর হয়ে উঠে দাঁড়াল। আগুনকে সে আর ভয় করলে না। জীবনে প্রজ্বলিত অগ্নিই তো গুরু।

    রসকলির পর ছাপা হল হারানো সুর। তার পরে স্থলপদ্ম। মাঝখানে তারুণ্যবন্দনা করলে এক মাঙ্গল্যসূচক কবিতায়। সে কবিতায় তারাশঙ্কর নিজেকে তরুণ বলে অভিখ্যা দিলে এবং সেই সম্বন্ধে কল্লোলের সঙ্গে জানালে তার ঐকাত্ম্য। যেমন শোক থেকে শ্লোকের, তেমনি তারুণ্য থেকেই কল্লোলের আবির্ভাব। তারুণ্য তখন বীর্য বিদ্রোহ ও বলবত্তার উপাধি। বিকৃতি যা ছিল তা শুধু শক্তির অসংযম। কিন্তু আসলে সেটা শক্তিই, অমিততেজার ঐশ্বর্য। সেই তারুণ্যের জয়গান করলে তারাশঙ্কর। লিখলে :

    হে নূতন জাগরণ, হে ভীষণ, হে চির-অধীর,
    হে রুদ্রের অগ্রদূত, বিদ্রোহের ধ্বজাবাহী বীর…
    ঝঞ্ঝার প্রবাহে নাচে কেশগুচ্ছ, গৈরিক উত্তরী,
    সেথা তুমি জীর্ণে নাশি নবীনের ফুটাও মঞ্জরী,
    হে সুন্দর, হে ভীষণ, হে তরুণ, হে চারু কুমার,
    হে আগত, অনাগত, তরুণের লহ নমস্কার।।

    এর পর একদিন তারাশঙ্করকে আসতে হল কল্লোল-আপিসে। যেখানে তার প্রথম পরিচিতির আয়োজন করা হয়েছিল সেই প্রশস্ত প্রাঙ্গণে। কিন্তু তারাশঙ্কর যেন অনুভব করল তাকে উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে বরণ-বর্ধন করা হচ্ছে না। একটু যেন মনোভদ হল তারাশঙ্করের।

    বৈশাখ মাস, দুপুরবেলা। তারাশঙ্কর কল্লোল-আপিসে পদার্পণ করলে। ঘরের এক কোণে দীনেশরঞ্জন, আরেক কোণে পবিত্র চেয়ারটেবিলে কাজ করছে, তক্তপোশে বসে আছে শৈলজানন্দ। আলাপ হল। সবার সঙ্গে, কিন্তু কেমন যেন ফুটল না সেই অন্তরের আলাপ চক্ষু। পবিত্র উঠে নমস্কার নিয়ে চলে গেল, কোথায় কি কাজ আছে তার। দীনেশরঞ্জন আর শৈলজা কি-একটা অজ্ঞাত কোডে চালাতে লাগল কথাবার্তা। তারাশঙ্করের মনে হল এখানে সে যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে। কল্লোলের লেখকদের মধ্যে তখন একটা দল বেঁধে উঠেছিল। তারাশঙ্করের মনে হল সে বুঝি সেই দলের বাইরে।

    কবিতা আওড়াতে-আওড়াতে উস্কোখুস্কো চুলে স্বপ্নালু চোখে ঢুকল এসে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ। এক হাতে দইয়ের ভাড়, কয়েকটা কলা, আরেক হাতে চিড়ের ঠোঙা। জিনিসগুলো রেখে মাথার লম্বা চুল মচকাতে মচকাতে বললে, চিড়ে খাব।

    দীনেশরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দিলেন। চোখ বুজে গভীরে যেন কি রসাস্বাদ করলে নৃপেন। তদগতের মত বললে, বড় ভাল লেগেছে রসকলি। খাসা!

    ঐ পর্যন্তই।

    কতক্ষণ পরে উঠে পড়ল তারাশঙ্কর। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলে।

    ঐ একদিনই শুধু। তারপর আর যায়নি কোনোদিন ওদিকে। হয়তো অন্তরে-অন্তরে বুঝেছে, মন মেলে তো মনের মানুষ মেলে না। কল্লোলে লেখা ছাপা হতে পারে কিন্তু কল্লোলের দলের সে কেউ নয়।

    অন্তত উত্তরকালে তারাশঙ্কর এমনি একটা অভিযোগ করেছে বলে শুনেছি। অভিযোগটা এই কল্লোল নাকি গ্রহণ করেনি তারাশঙ্করকে। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়, কিংবা এক দিক থেকে যথার্থ হলেও আরেক দিক থেকে সঙ্কুচিত। মোটে একদিন গিয়ে গোটা কল্লোলকে সে পেল কোথায়? প্রেমেন-প্রবোধের সঙ্গে বা আমার সঙ্গে তার তো চেনা হল প্রথম কালি-কলমের বারবেলা আসরে। বুদ্ধদেবের সঙ্গে আদৌ আলাপ হয়েছিল কি না জানা নেই। তা ছাড়া কল্লোলের সুরের সঙ্গে যার মনের তার বাঁধা, সে তো আপনা থেকেই বেজে উঠবে, তাকে সাধ্যসাধনা করতে হবে না। যেমন, প্রবোধ। প্রবোধও পরে এসেছিল কিন্তু প্রথম দিনেই অনুকূল ঔৎসুক্যে বেজে উঠেছিল, ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ঢেউ হয়ে। তারাশঙ্কর যে মিশতে পারেনি তার কারণ আহ্বানের অনান্তরিকতা নয়, তারই নিজের বহির্মুখিতা। আসলে সে বিদ্রোহের নয়, সে স্বীকৃতির, সে স্থৈর্যের। উত্তাল উর্মিলতার নয়, সমতল তটভূমির, কিংবা, বলি, তুঙ্গ গিরিশৃঙ্গের।

    দল যাই হোক, কল্লোল যে উদার ও গুণগ্রাহী তাতে সন্দেহ কি। নবীনবণ ও সবুদ্ধিসম্পন্ন বলেই তারাশঙ্করকে স্থান দিয়েছিল, দিয়েছিল বিপুল-বহুল হবার প্রেরণা। সেদিন কল্লোলের আহ্বান না এসে পৌঁছুলে আরো অনেক লেখকেরই মত তারাশঙ্করও হয়তো নিদ্রানিমীলিত থাকত।

    তারাশঙ্করে তখনো বিপ্লব না থাকলেও ছিল পুরুষকার। এই পুবুষকারই চিরদিন তারাশঙ্করকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে। পুরুষকারই কর্মযোগর বিস্তৃতি। কাষ্ঠের অব্যক্ত অগ্নি উদ্দীপিত হয় কাষ্ঠের সংঘর্ষে, তেমনি প্রতিভা প্রকাশিত হয় পুরুষকারের প্রাবল্যে। নিক্রিয়ের পক্ষে দৈবও অকৃতী। নিষ্ঠার আসনে অচল অটল সুমেরুবৎ বসে আছে তারাশঙ্কর–সাহিত্যের সাধনার থেকে একচুল তার বিচ্যুতি হয়নি। ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং–তারাশঙ্করের এই সংকল্পসাধনা। যাকে বলে স্বস্থানে নিয়তাবস্থা—তাই সে রেখেছে চিরকাল। তীর্থের সাজ সে এক মুহূর্তের জন্যেও ফেলে দেয়নি গা থেকে। ছাত্রের তপস্যায় সে দৃঢ়নিশ্চয়। রিপদে চলেছে সে পর্বতারোহণে। সম্প্রতি এত বড় ইষ্টনিষ্ঠা দেখিনি আর বাংলাসাহিত্যে।

     

    সরোজকুমার রায় চৌধুরীও কল্লোলের প্রথমাগত। দৈনিক বাংলায় কথায় কাজ করত প্রেমেনের সহকর্মী হিসেবে। তার লেখায় প্রসাদগুণের পরিচয় পেয়ে প্রেমেন তাকে কল্লোলে নিয়ে আসে। প্রথমটা একটু লাজুক, গম্ভীর প্রকৃতির ছিল, কিন্তু হৃদয়বানের পক্ষে হৃদয় উন্মোচিত না করে উপায় কি? অত্যন্ত সহজের মাঝে অত্যন্ত সরস হয়ে মিশে গেল সে অনায়াসে। লেখনীটি সূক্ষ্ম ও শান্ত, একটু বা কোমলা। জীবনের যে খুঁটিনাটিগুলি উপেক্ষিত, অন্তরদৃষ্টি তার প্রতিই বেশি উৎসুক। কল্লোলের যে দিকটা বিপ্লবের সেদিকে সে নেই বটে, কিন্তু যে দিকটা পরীক্ষা বা পরীষ্টির সে দিকের সে একজন। এক কথায় বিদ্রোহী না হোক সন্ধানী সে। এবং যে সন্ধানী সেই সংগ্রামী। সেই দিক থেকেই কল্লোলের সঙ্গে তার ঐকপ্য।

    মনোজ বসুও না লিখে পারেনি কল্লোলে। কল্লোলে ছাপা হল তার কবিতা-জসিমী ঢঙে লেখা। তার মেসের বিছানার তলা থেকে কবিতাটি লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল কবি ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মনোজের সঙ্গে পড়েছি এক কলেজে। মনের প্রবণতায় এক না হলেও মনের নবীনতায় এক ছিলাম। কল্লোল যে রোমান্টিসিজম খুঁজে পেয়েছে শহরের ইট-কাঠ লোহা-লক্কড়ের মধ্যে, মনোজ তাই খুঁজে পেয়েছে বনে-বাদায় খালে-বিলে পতিতে-আবাদে। সভ্যতার কৃত্রিমতায় কল্লোল দেখেছে মানুষের ট্রাজেডি, প্রকৃতির পরিবেশে মনোজ দেখেছে মানুষের স্বাভাবিকতা। একদিকে নেতি, অন্যদিকে আপ্তি। যোগবলের আরেক দৃপ্ত উদাহরণ মনোজ বস্তু। কর্মই ফলদাতা, তাই কর্মে সে অনম্য, কর্মই তার আত্মলক্ষ্য। যে তীব্র পুরুষকারন তার নিশ্চয়সিদ্ধি।

    একদিন, গুপ্ত ফ্রেণ্ডসএ, আশু ঘোষের দোকানে, বিষ্ণু দে একটি সুকুমার যুবকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে। নাম ভবানী মুখোপাধ্যায়। মিতবাক মিথ্যহান্য নির্মলমানস। শুনলাম লেখার হাত আছে। তবলায় শুধু চাঁটি মারবার হাত নয়, দস্তুরমতো বোল ফোঁটাবার হাত। নিয়ে এলাম তাকে কল্লোলে। তার গল্প বেরুলো, দলের খাতায় সে নাম লেখালে। কিন্তু কখন যে হৃদয়ের পাতায় তার নাম লিখল কিছুই জানি না। যখন আমাদের ভাব বদলায় তখন সঙ্গেসঙ্গে বন্ধুও বদলায়, কেননা বন্ধু তো ভাবেরই প্রতিচ্ছায়া। কিন্তু ভবানীর বদল নেই। তার কারণ বন্ধুর চেয়েও মানুষ যে বড় তা সে জানে। বড় লেখক তো অনেক দেখেছি, বড় মানুষ দেখতেই সাধ আজকাল। আর সে বড়ত্ব গ্রন্থের আয়তনে নয়, হৃদয়ের প্রসারতায়। যশবুদ্বুদ আর জনপ্রিয়তা মুহূর্তের ছলনা। টাকাপয়সা ক্ষণবিহারী রঙচঙে প্রজাপতি। থাকে কি? টেকে কি? টেকে শুধু চরিত্র, কর্মোদযাপনের নিষ্ঠা। আর টেকে বোধ হয় পুরানো দিনের বন্ধুত্ব। পুরোনো কাঠ ভালো পোড়ে, তেমনি পুরোনো বন্ধুতে বেশি উষ্ণতা। আনন্দ বস্তুতে নয়, আনন্দ আমাদের অন্তরের মধ্যে। সেই আনন্দময় অন্তরের স্বাদ পাওয়া যায় ভবানীর মত বন্ধু যখন অনন্তর।

    এই সম্পর্কে অবনীনাথ রায়ের কথা মনে পড়ছে। চিরকাল প্রায় প্রবাসেই কাটালেন কিন্তু বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বরাবর নিবিড় সংযোগ রেখে এসেছেন। চাকরির খাতিরে যেখানে গেছেন সেখানেই সাহিত্য সভা গড়েছেন বা মরা সভাকে প্রাণরসে উজ্জীবিত করেছেন। হাতে নিয়েছেন আধুনিক সাহিত্যপ্রচারের বতিকা। কলকাতায় এসেও যত সাহিত্য-ঘেষা সভা পেয়েছেন, রবিবাসর বা সাহিত্যসেবক সমিতি,—ভিড়ে গিয়েছেন আনন্দে। নিজেও লিখেছেন অজস্র সবুজ পত্র থেকে কল্লোলে। সাহিত্যিক শুনলেই সৌহার্দ্য করতে ছুটেছেন। আমার তিরিশ গিরিশে প্রথম খোঁজ নিতে এসে শুনলেন আমি দিল্লি গিয়েছি। মীরাট যাবার পথে দিল্লিতে নেমে আমাকে খুঁজে নিলেন সমরু প্লেসে, ভবানীদের বাড়িতে।

    কল্লোলে অনেক লেখকই ক্ষণদ্যুতি প্রতিশ্রুতি রেখে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে। অমরেন্দ্র ঘোষ তার আশ্চর্য ব্যতিক্রম। কল্লোলের দিনে একটি জিজ্ঞসু ছাত্র হিসেবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দেখি সে গল্প লেখে, এবং যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মত, বস্তু আর ভঙ্গি দুইই অগতানুগ। খুশি হয়ে তার ‘কলের নৌকা’ ভাসিয়ে দিলাম কল্লোলে। ভেবেছিলাম ঘাটে-ঘাটে অনেক রত্নপণ্যভার সে আহরণ করবে। কোথায় কোন দিকে যে ভেসে গেল নৌকো, কেউ বলতে পারল না। ডুবে তলিয়ে গেল কি-না তাই বা কে বলবে। প্রায় দুই যুগ পরে তার পুনরাবির্ভাব হল। এখন আর সে কলের নৌকা হয়ে নেই, এখন সে সমুদ্রাভিসারী সুবিশাল জাহাজ হয়ে উঠেছে নতুনতরো বন্দরে তার আনাগোনা। ভাবি জীবনে কত বড় যোগসাধন থাকলে এ উন্মোচন সম্ভবপর।

    কল্লোল-আপিসে তুমুল কলরব চলেছে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, কে একজন খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকছে গুটিসুটি। পাছে তাকে দেখে ফেলে হুল্লোড়ের উত্তালতায় বাধা পড়ে, একটি অট্টহাসি বা একটি চীৎকারও বা অর্ধপথে থেমে যায়—তাই তার সঙ্কোচের শেষ নেই। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সে চুপিচুপি। কিংবা এই বলাই হয়তো ঠিক হবে, নিজেকে মুছে ফেলছে সে সন্তর্পণে। সকালবেলায়ও আবার আড্ডা, তেমনি অনিবার্য অনিয়ম। আবার লোকটি বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে, তেমনি কুণ্ঠিত অপ্রস্তুতের মত—যেন তার অস্তিত্বের খবরটুকুও কাউকে না বিব্রত করে। কে এই লোকটি? কর্তা হয়েও যে কর্তা নয়, কে এই নির্লেপ-নির্মুক্ত উদাসীন গৃহস্থ? সবহুমানে তাঁকে স্মরণ করছি—তিনি গৃহস্বামী—দীনেশরঞ্জনের তথা কল্লোলের সবাইকার মেজদাদা। কারুর সঙ্গে সংশ্রব-সম্পর্ক নেই, তবু সবাইকার আত্মীয়, সবাইকার বন্ধু। বস্তুর আকারে কোনো কিছু না দিয়ে একটি রমণীয় ভাবও যদি কাউকে দেওয়া যায় তা হলেও বোধ হয় বন্ধুরই কাজ করা হয়। কল্লোলের মেজদাদা কল্লোলকে দিয়েছেন একটি রমণীয় সহিষ্ণুতা, প্রসন্ন প্রশ্রয়।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএ ডলস হাউস – অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ
    Next Article কাকজ্যোৎস্না – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }