Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    লেখক এক পাতা গল্প315 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯. সান-ইয়াৎ-সেন মানে সনৎ সেন

    সান-ইয়াৎ-সেন আসত কল্লোলে। সান-ইয়াৎ-সেন মানে আমাদের সনৎ সেন। সনৎ সেনকে আমরা সান-ইয়াৎ-সেন বলতাম। অৰ্ধাঙ্গিণী নামে একখানা উপন্যাস লিখেছিল বলে মনে পড়ছে। আধপোড় চুরুট মুখে দিয়ে প্রায়ই আসত আড্ডা দিতে, প্রসন্ন চোখে হাসত। দৃষ্টি হয়তো সাহিত্যের দিকে তত নয় যত ব্যবসার দিকে। বাণিজ্যে বাঙ্গালীর স্থান বলে কিছু একটা লিখেওছিল এ বিষয়ে। হঠাৎ একদিন ফাঁসির গোপীনাথ বলে বই বের করে কাণ্ড বাধালে। কল্লোল-আপিসেই কাণ্ড, কেননা কল্লোলই ছিল ঐ বইয়ের প্রকাশক। একদিন লাঠি ও লালপাগড়ির ঘটায় কল্লোল-আপিস সরগরম হয়ে উঠল। জেলে গোপীনাথের যেমন ওজন বেড়েছিল বইএর বিক্রির অঙ্কটা তেমনি ভাবে মোটা হতে পেল না। সরে পড়ল সান-ইয়াৎ সেন। পস্টাপস্টি ব্যবসাতে গিয়েই বাসা নিলে।

    কিন্তু বিজয় সেনগুপ্তকে আমরা ডাকতাম কবরেজ বলে। শুধু বদ্যি বলে নয়, তার গায়ের চাদর-জড়ানো বুড়োটে ভারিকিপনা থেকে। এককোণে গা-হাত-পা ঢেকে জড়সড় হয়ে বসে থাকতে ভালবাসত, সহজে ধরা দিতে চাইত না। কিন্তু অন্তরে কাষ্ঠ কার্পণ্য নিয়ে কল্লোলের ঘরে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে এমন তোমার সাধ্য কি। আস্তে-আস্তে সে ঢাকা খুললে, বেরিয়ে এল গাম্ভীর্যের কোটর থেকে। তার পরিহাস-পরিভাষে সবাই পুলকম্পন্দিত হয়ে উঠল। একটি পরিশীলিত সূক্ষ্ম ও স্নিগ্ধ মনের পরিচয় পেলাম। তার জমত বেশি সুকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। হয়তো দুজনেই কৃষ্ণনগরের লোক এই সুবাদে। বিজয় পড়ছে সিকসথ ইয়ার ইংরিজি, আর সুকুমার এম এস সি আর ল। দুজনেই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট। কিংবা হয়তো আরও গভীর মিল ছিল যা তাদের রসস্ফুর্ত আলাপে প্রথমে ধরা। পড়ত না। তা হচ্ছে দুজনেরই কায়িক দিনযাপনের আর্থিক কৃজ্ঞতা।

    কষ্টে-ক্লেশে দিন যাচ্ছে, পড়া-থাকার খরচ জোগানো কঠিন, অবন্ধু সংসারের নির্দয় রুক্ষতায় পদে পদে বিপয়, কিন্তু সরসবচনে সুখসৃষ্টিতে আপত্তি কি।

    বিজয় হয়তো বললে, সুকুমারটা একটা ফল্‌স্‌।

    সুকুমার পালটা জবাব দিলে, বিজয়টা একটা বোগাস।

    হাসির হল্লোড় পড়ে যেত। ঐ সামান্য দুটো কথায় এত সবার কি ছিল আজকে তা বোঝানো শক্ত। অবিশ্যি উক্তির চেয়ে উচ্চারণের কারুকার্যটাই যে বেশি হাসত তাতে সন্দেহ নেই। তবু আজ ভাবতে অবাক লাগে তখনকার দিনে কত তুচ্ছতম ভঙ্গিতে কত মহত্তম আনন্দলাভের নিশ্চয়তা ছিল। দুটি শব্দ—ইয়ে, আর উহ-বিজয় এমন অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করত যে মনে হত এত সুন্দর রসাত্মক বাক্য বুঝি আর সৃষ্টি হয়নি। নৃপেনকে দেখে নেপোয় মারে দই কিংবা আফজলকে দেখে কেউ যদি বলত ডাজল, নামত অমনি হাসির ধারাবর্ষণ। আজকে ভাবতে হাসি পায় যে হাসি নিয়ে জীবনে তখন ভাবনা ছিল না। বুদ্ধি-বিবেচনা লাগত না যে হাসিটা সত্যিই বুদ্ধিমানের যোগ্য হচ্ছে কিনা। অকারণ হাসি, অবারণ হাসি। কবিতার একটা ভালো মিল দিতে পেরেছি কিংবা মাথায় একটা নতুন গল্পের আইডিয়া এসেছে এই যেন যথেষ্ট সুখ। প্রাণবহনের চেতনায় প্রতিটি মুহূর্ত স্বর্ণঝলকিত। কোন দুর্গম গলির দুর্ভেদ্য বাড়িতে নিভৃত মনের বাতায়নে উদাসীনা প্রেয়সী অবসর সময়ে বসে আছেন এই মান দিগন্তের দিকে চেয়ে—এই যেন পরম প্রেরণা। আয়োজন নেই, আড়ম্বর নেই, উপচার-উপকরণ নেই–একসঙ্গে এতগুলি প্রাণ যে মিলেছি এক তীর্থসতে, জীবনের একটা ক্ষুদ্র ক্ষণকালের কোঠায় খুব ঘেঁসাঘেঁসি করে যে বসতে পেরেছি একাসনে–এক নিমন্ত্রণে—এই আমাদের বিজয়-উৎসব।

    সুকুমারের গল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের সংগ্রামের আভাস ছিল, বিজয়ের গল্প বিশুদ্ধ প্রেম নিয়ে। যে প্রেমে আলোর চেয়ে ছায়া, ঘরে চেয়ে ঘরের কোণটা বেশি স্পষ্ট। যেখানে কথার চেয়ে স্তব্ধতাটা বেশি মুখর। বেগের চেয়ে বিরতি বা ব্যাহতি বেশি সক্রিয়। এক কথায় অপ্রকট অথচ অকপট প্রেম। অল্প পরিসরে সংযত কথায় সূক্ষ্ম আঙ্গিকে চমৎকার ফুটিয়ে তুলত বিজয়। দুটি মনের দুদিকের দুই জানলি কখন কোন হাওয়ায় একবার খুলছে আবার বন্ধ হচ্ছে তার খেয়ালিপনা। দেহ সেখানে অনুপস্থিত, একেবারে অনুপস্থিত না হলেও নিরুচ্চার। শুধু মনের উয়ের ঘূর্ণিপাক। একটি ইচ্ছুক মনের অদ্ভুত ঔদাসীন্য, হয়তো বা একটি উদ্যত মনের অদ্ভুত অনীহা। তেরোশ তিরিশের প্রায় গোড়া থেকেই বিজয় এসেছে কল্লোলে, কিন্তু তার হাত খুলেছে তোরেশ একত্রিশ থেকে। তেরোশ একত্রিশ-বত্রিশে কটি অপূর্ব প্রেমের গল্প সে লিখেছিল। যে প্রেম দূরে-দূরে সরে থাকে তার শূন্যতাটাই সুন্দর, না, যে প্রেম কাছে এসে ধরা দেয় তার পূর্ণতাটাই চিরস্থায়ী—এই জিজ্ঞাসায় তার গল্প গুলি প্রাণস্পন্দী। একটি ভঙ্গুর প্রশ্নকে মনের নানান আঁকাবাঁক গলিঘুজিতে সে খুঁজে বেড়িয়েছে। আর যতই খুঁজেছে ততই বুঝেছে এ গোলকধাঁধার পথ নেই, এ প্রশ্নের জবাব হয় না।

    বিজয় কিন্তু আসে মণীশ ঘটকের সঙ্গে। দুজনে বন্ধু ছিল কলেজে, সেই সংসর্গে। একটা বড় রকম অমিল থেকেও বোধহয় বন্ধুত্ব হয়। বিজয় শান্ত, নিরীহ; মণীশ দুর্ধর্ষ, উদ্দাম। বিজয় একটু বা কুনো, মণীশ নির্ধারিত। ছ-ফুটের বেশি লম্বা, প্রস্থে কিছুটা দুঃস্থ হলেও বলশালিতার দীপ্তি আছে তার চেহারায়। অতখানি দৈর্ঘ্যই তো একটা শক্তি। কল্লোলে আত্মপ্রকাশ করে সে যুবনাশ্বের ছদ্মনাম নিয়ে। সেদিন যুবাশ্বের অর্থ যদি কেউ করত জোয়ান ঘোড়, তাহলে খুব ভুল করত না, তার লেখায় ছিল সেই উদ্দীপ্ত সবলতা। কিন্তু এমন বিষয় নিয়ে সে লিখতে লাগল যা মান্ধাতার বাপের আমল থেকে চলে এলেও বাংলাদেশের সুনীতি সত্যের মেম্বাররা দেখেও চোখ বুজে থাকছেন। এ একেবারে একটা নতুন সংসার, অধন্য ও অকৃতার্থের এলাকা। কাণা খোঁড়া ভিক্ষুক গুণ্ডা চোর আর পকেটমারের রাজপাট। যত বিকৃত জীবনের কারখানা। বলতে গেলে, মণীশই কল্লোলের প্রথম মশালচী। সাহিত্যের নিত্যক্ষেত্রে এমন সব অভাজনকে সে ডেকে আনল যা একেবারে অভূতপূর্ব। তাদের একমাত্র পরিচয় তারাও মানুষ, জীবনের দরবারে একই সই-মোহর-মারা একই সনদের অধিকারী। মানুষ? না, মানুষের অপচ্ছায়া? কই তাদের হাতে সেই বাদশাহী পাঞ্জার ছাপ-তোলা নদ? তারা যেসব বিনা টিকিটের যাত্রী। আর, সত্যি করে বলো এটা কি দরবার, না বেচাকেনার মেছোহাটা? তারা তো সব সস্তায় বিকিয়ে যাওয়া ভুষিমাল।

    যুবনাশ্বের ঐ সব গল্পে হয়তো আধুনিক অর্থে কোনো সক্রিয় সমাজসচেতনতা ছিল না, কিন্তু জীবন সম্বন্ধে ছিল একটা সহজ বিশালতাবোধ। যে মহৎ শিল্পী তার কাছে সমাজের চেয়েও জীবনই বেশি অর্থান্বিত। যে জীবন ভগ্ন, রুগ্ন, পর্যদস্ত, তাদেরকে সে সরাসরি ডাক দিলে, জায়গা দিলে প্রথম পংক্তিতে। তাদের নিজেদের ভাষায় বলালে তাদের যত দগদগে অভিযোগ, জীবনের এই খলতা এই পঙ্গুতার বিরুদ্ধে কশায়িত তিরস্কার। দেখালে তাদের ঘা, তাদের পাপ, তাদের নিজত। সমস্ত কিছুর পিছনে দয়াহীন দারিদ্র। আর সমস্ত কিছু সত্ত্বেও একটি নিষ্পঙ্ক ও নীরোগ জীবনের হাতছানি।

    ভাবতে অবাক লাগে যুবনাশ্বের সেই সব গল্প আজও পর্যন্ত পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়নি। চব্বিশ বছর আগে বাংলাদেশে এমন প্রকাশক অবিশ্যি ছিল না যে এ গল্পগুলি প্রকাশ করে নিজেকে সম্ভ্রান্ত মনে করতে পারত। কিন্তু আজকে অনেক দৃষ্টিবদল হলেও এদিকে কারু চোখ পড়ল না। ভয় হয়, অগ্রনায়ক হিসেবে যুবনাশ্বের নাম না একদিন সবাই ভুলে যায়। অন্তত এই অগ্রদৌত্যের দিক থেকে এই গল্পগুলি সাহিত্যের ইতিহাসে গণনীয় হয়ে থাকবে। এরাই বাংলা সাহিত্যে নতুন আবাদের বীজ ছড়ালে। বাস্তবতা সম্বন্ধে সরল নির্ভীকতা ও অপধ্বস্ত জীবনের প্রতি সশ্রদ্ধ সহানুভূতি এই দুই মহৎ গুণ তার গল্পে দীপ্তি পাচ্ছে।

    কালনেমি-র ডাকু জোয়ান মরদ-রেলে কাটা পড়ে কাজের বার হয়ে যায়। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে স্ত্রী ময়নাকে নিয়ে পটলডাঙার ভিখিরিপাড়ায় এসে আস্তানা নেয়। ডাকুকে বোজ রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দিয়ে ময়না দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষের সন্ধানে, ফিরে এসে আবার স্বামীকে তুলে নিয়ে যান। কিন্তু সেই ভিখিরিপাড়ায় স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের কোনো অস্তিত্ব নেই, নিয়ম নেই থাকবার। সেখানে প্রতি বছরই ছেলে জন্মায়, কিন্তু বাপ-মার ঠিক-ঠিকানা জানবার দরকার হয় না। কেউ কারু একলার নয়। ময়না এ জগতে একেবারে বিদেশী, কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারে না। এই বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে। তাই একদিন রতনার আক্রমণে সে রুখে ওঠে।

    স্বামীকে গিয়ে বলে—তু একটা বিহিত করবিনে?

    একটু চুপ করে থেকে ডাকু তাকে বুকে সাপটিয়ে ধরে। বলেহোকগে। থাকতেই হবে যখন হেতায় তখন কি হবে আর ঘাঁটিয়ে?–আয় তুই … ।

    ময়না চারিদিকে তাকিয়ে আশ্রয় খোঁজে। গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় স্বামীর কবল থেকে।

    ডাকু বলে–চললি কোতা?

    রতনার কাছে।

    কিন্তু ডাকু তাতে দমে না। বলে-দোহাই তোর, আমাকে একেবারে ফাঁকি দিসনে। একটিবার আসিস রেতে–

    গোষ্পদ গল্পে অন্য রকম সুর। একটি ক্ষণকালিক সদিচ্ছার কাহিনী। খেঁদি-পিসি পটলডাঙার ভিখিরিদলের মেয়ে-মোড়ল। একদিন পথে ভঘরের একটি বিবর্জিত বউকে কুড়িয়ে পায়। তাকে নিয়ে আসে বস্তিতে। প্রথমেই তো সে ভিক্ষুকের ছাড়পত্র পেতে পারে ন, সেই শেষ পরিচ্ছেদের এখনো অনেক পৃষ্ঠা বাকি। তাই প্রথমে খেঁদি ধমক দিয়ে উঠল। বললে, আমাদের দলে যাদের দেখলে, সবই ত ওই করত এককালে। পরে, বুড়ো হয়ে, কেউ ব্যায়ামে পড়ে পথে বেরিয়েছে। তোমার এই বয়সে অন চেহারা—তা বাপু, নিজে বোঝ—

    মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

    এবার আর খেঁদি কান্না শুনে খিটখিট করে উঠল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কি ভাবল। হয়তো ভাবল এই অবুঝ মেয়েটাকে বাঁচানো যায় কিনা। যায় না, তবু যত দিন যায়। তাই সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,-আচ্ছা থাকে। কিন্তু এ চেহারা নিয়ে কলকাতা হেন জায়গায় কি সামলে থাকতে পারবে? আমার খবরদারিতে যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ অবিশ্যি ভয় নেই। কিন্তু সব সময় কি আমি চোখ রাখতে পারব?

    না, ভয় নেই। থাকো, কোথায় যাবে এই জঙ্গলে? যতক্ষণ ঘরে খেঁদি আছে ততক্ষণ, ততটুকু সময় তো মেয়েটি নিরাপদ।

    মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের গল্প-গোবরগাদায় পদ্মফুল। ও-তল্লাটে চঞ্চু সবচেয়ে ঝানু বদমাইস, হৃদয়হীন জানোয়ার। থাকত ক্ষ্যান্তর ঘরে— ক্ষ্যান্ত হচ্ছে খেঁদির ডান-হাত। দলের সেরা হচ্ছে চঞ্চু, তাই তার ডেরাও মজবুত—ক্ষ্যান্তর ঘর। এ হেন চঞ্চু একদিন ময়লা, রোগ। আর বোবা এক ছুঁড়িকে নিয়ে এসে দলে ভর্তি করে দিলে। কিন্তু সেই থেকে, কেন কে জানে, তা আর ভিক্ষেয় বেরোতে মন ওঠে না। শুধু তাই নয়, সেদিন সে পটলাকে চড়িয়ে দিযেছে একটা মেয়ের হাত থেকে বালা ছিনিয়ে নেবার সময় তার আঙুল মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে বলে। চঞ্চুর এই ব্যাপার দেখে সবাই খাপ্পা হযে খেঁদিকে গিয়ে। ধরল। বললে,-এর একটা বিহিত তোকে আজই করতে হবে পিসি। নইলে সব যে যেতে বসেছে। ড্যাকরার কি যে হয়েছে কদিন থেকে সাবুগিরি ফলাতে শুরু করেছে মাইরি।

    খেঁদি গিয়ে পড়ল চঞ্চুকে নিয়ে। মুখিয়ে উঠল : বল মুখপোড়া, তুই ভেবেছিস কি? দলের নাম ডোবাতে বসেছিস রে।

    চঞ্চু হাঁ-না কোনো জবাব দিল না।

    একজন বলল অরে, ও তো এমন ছেল না। ওই শুঁটকি মাগী। এসেই তো ওকে বিগড়েছে! ওকে না তাড়ালে চঞ্চুকে ফেরাতে পারবি না—

    খেঁদি বলল, সত্যি করে বল তুই, ও-মাগী তোর কে? আমি কেন, দশজনে দেখছে, ওই তোকে সারছে। ও কে তোর?

    বোবা মেযেটাও ইতিমধ্যে এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। চঞ্চু তার দিকে তাকিয়ে রইল স্পষ্ট করে। বললে, ও আমার বোন।

    বোন? খেঁদির দলে বোন? মা-বোনের ছোঁয়াচ তো টের দিনই সবাই এড়িয়ে এসেছে।

    –শোন, এই তোকে বলছি—খেঁদি খেঁকিয়ে উঠল—ও মাগীকে তোর ছাড়তে হবে। যেখান থেকে ওকে কুড়িয়ে পেয়েছি, কাল গে সেইখানে রেখে আসবি নইলে

    চঞ্চু তাকাল খেঁদির দিকে।

    —নইলে দল ছাড়তে হবে তোকে। আগেকার মত যদি হতে পারিস তবেই থাকতে পারবি, নইলে আর নয়। বুঝেছিস?

    ভোর রাতের আবছা আলোয় খেঁদি পিসির আস্তানা থেকে বেরিয়ে এল চঞ্চু, সেই বোবা মেয়েটার হাত-ধরা। অনেক দিন চলে গেল, আর তাদের হদিস নেই।

    রতন টিপ্পনি কাটল,–বলেছিনু কিনা। শক্ত একট: কিছু বেঁধেছে বাবা। নইলে চঞ্চুর মত স্যায়ন ঘাগী–

    তেরোশ বত্রিশের কল্লোলে যুবনাশ্ব তিনটি গল্প লেখে মন্থশেষ, ভুখা ভগবান আর দুর্যোগ। এর মধ্যে দুর্যোগ অপরূপ। পটলডাঙার গল্প নয়, পদ্মার উপরে ঝড় উঠেছে—তার মধ্যে যাত্রীবাহী স্টিমার–বাজার্ডের গল্প। জোরালো হাতে লেখা। কলম যেন ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে।

    গতিক বড় সুবিদার জোগন্নাথ, ঝোরি-বিষ্টি আইব মনে হয়। বুচি লো, চুন দে দেহি এট্টু–

    সতরঞ্চির ওপর হুঁকো ও গামছা-বাঁধা জলতরঙ্গ টিনের তোরঙে ঠেস দিয়ে আজানু গোলাপী পাঞ্জাবি ও তদুপরি নীল স্ট্রাইপ-দেওয়া টুইলের গলফ-কোট গায়ে একটি বছর সাতাশ-আটাশের মদনমোহন শুয়েছিল। বোধ করি তারই নাম জগন্নাথ। সে চট করে কপালের লতায়িত কেশগুচ্ছের ওপর হাত বুলিয়ে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে,–

    ডাইল! হালায় আপনের যত গাজাখুরি কথা। হুদাহুদি ঝরি আইব ক্যান? আর আহেই যদি হালার ডর কিসের? আমরা ত হালার জাইল্যা ডিঙিতে যাইত্যাছি না।

    আকাশের দিকে চেয়ে মনে হল, ঝড় আসা বিচিত্র নয়। সমস্ত আকাশের রং পাংশু-পিঙ্গল, ঈশান কি নৈঋত কি একটা কোণে হিংস্র শ্বাপদের মত একরাশ ঘোর কালো মেঘ শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়বার আগের মুহূর্তের মতই ওৎ পেতে বসেছে। তীরে গাছের পাতা স্পন্দহীন, কেবল ষ্টিমারের আশপাশ ঘুরে গাংচিলের ওড়ার আর বিরাম নেই! চারদিকে কেমন একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা থমথম করছে।

    হঠাৎ চোখে পড়ল একটি লোক আমার পাশ কাটিয়ে ফিমেলকম্পার্টমেন্টের ধারে গিয়ে আপদি গ্রীবা সতরঞ্চি মুড়ি দিয়ে উবু হয়ে বসল। বসে সন্তর্পণে একবার কপালের কেয়ারিতে হাত বুলাতেই চিনতে পারলাম সে পুর্বোক্ত প্রমান জগন্নাথ। হাবভাবে বুঝলাম, শ্ৰীমান ভীত হয়েছেন।

    বাইরে তাকিয়ে দেখি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ওলটপালট হয়ে গেছে। আকাশ-কোণের শ্বাপদজন্তুটা দেহ-বিস্তার করে আকাশের অর্ধেকের বেশি গ্রাস করে ফেলেছে। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ে না, থেকে-থেকে চারদিক মৃদু আলোক-কম্পনে চমকে-চমকে উঠছে। সে আলোয় ধূসর বৃষ্টি-ধার। ভেদ করে দৃষ্টি চলে না, একটু গিয়েই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। শিকার কায়দায় পেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন উদ্বিগ্ন আনন্দে গোংরাতে থাকে, সমস্ত আকাশ জুড়ে তেমনি শব্দ হচ্ছে …।

    যান যান, আপন-আপন জায়গায় যান। গাদি করবেন না এক মুড়ায়-দ্যাহেন না হালার জা’জ কাইত অইয়া গেছে—

    উপদেশ শোনা ও তদনুসারে কাজ করবার মত স্থান ও কাল সেটা নয়, তাই নিজ-নিজ জায়গার ওপর কারো বিশেষ আকর্ষণ দেখা গেল না; যিনি পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তাঁরও না।

    বাহিরে অষ্ট দিকপালের মাতামাতি সমানে চলছে। অবিরল বৃষ্টি, অশ্রান্ত বিদ্যুৎ, আকাশের অশান্ত সরব আস্ফালন, সমস্ত ডুবিয়ে উন্মত্ত বায়ুর অধীর হুহুঙ্কার। তারই ভেতর দিয়ে আমাদেব একমাত্র আশ্রয়স্থল বাজার্ড ষ্টিমার বাযুতাড়িত হয়ে কোন এক ঝড়ের পাখীর মতই সবেগে ছুটে চলেছে।

    হঠাৎ মনে হল কে যেন ডাকছে। কাকে, কে জানে। ওকি,–আমাকেই–

    শুনুন একবার এদিকে—

    চেয়ে দেখি মেয়ে-কামরার দরজার কাছে দাডিযে বছর বুডিবাইশের একটি সাদাসিধে হিন্দু ঘবের মেয়ে। আমি এগিয়ে যেতেই তিনি ব্যগ্রভাবে বললেন—অবি—অবিনাশবাবুকে ডেকে দেবেন একটু? অবিনাশ বোস। অনেকক্ষণ হল নীচে গেছেন, ফেরেন নি। তিনি আমার স্বামী।

    বিধ্বস্ত জনসংঘের মধ্যে হাতড়ে-হাতড়ে অনেক কষ্টে অবিনাশবাবুর সন্ধান পাওয়া গেল। ডেক, সেলুন, হস্পিটাল কোথাও তিনি নেই–জাহাজ ডুবছে—এই মহামারণ দুর্যোগে তিনি শুঁটকি মাছের চাঙারির মধ্যে বসে আছেন নিশ্চিন্ত হয়ে। নিশ্চিন্ত হয়ে? হ্যাঁ, ঘাড় দাবিয়ে উবু হয়ে বসে বিপন্না অপরিচিতার স্বামী অবিনাশ বেসি পাশের একটি অর্ধনগ্ন জোয়ান কুলি-মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাব্যচর্চা করছেন। নিশ্চিন্ততা, না, দুর্যোগ?

    মণীশের চেয়েও দীর্ঘকায় আরো একজন সাহিত্যিক ক্ষণকালের জন্যে এসেছিল কল্লোলে, গল্পলেখার উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি নিয়ে। নাম দেবেন্দ্রনাথ মিত্র। কত দিন পরে চলে গেল সার্থক জীবিকার সন্ধানে, আইনের অলি গলিতে। বেীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওকালতিতে গেল বটে, কিন্তু টিকে ছিল শেষ পর্যন্ত, যত দিন কোল টিকে ছিল। মণীশের সঙ্গেই সে আসে আর আসে সেই উদ্দাম প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে। ছাত্র হিসাবে কৃতী, রসবোধের ক্ষেত্রে প্রধী, চেহারায় সুন্দর-সুঠাম দেবীদাস কল্লোলের বীণার একটি প্রধান তন্ত্রী ছিল। উচ্চ তানের তন্ত্রী সন্দেহ নেই। ঝড়ের ঝংকার নিয়ে আসত, দুর্নিবার আনন্দের ঝড়। নিয়ে আসত অনিয়মের উন্মাদনা। উজরোল, উতরোল, হুল্লোড় পড়ে যেত চারদিকে। দেবীদাস কিন্তু রবাহূত হয়ে আসেনি। এসেছে স্বাধিকারবলে, সাহিত্যিকের ছাড়পত্র নিয়ে। কল্লোলে একবার গল্পপ্রতিযোগিতায় দেবীদাসের গল্পই প্রথম পুরস্কার পায়। যত দূর মনে পড়ে, এক কুষ্ঠরুগী নিয়ে সে গল্প। একটা কালো আতঙ্কের ছায়া সমস্ত লেখাটাকে ঢেকে আছে। সন্দেহ নেই, শক্তিধরের লেখনী।

    কল্লোলে ভিড় যত বাড়ছে ততই মেজবৌদির রুটির পাঁজা শীর্ণ হয়ে আসছে—সে জঠরারণ্যের খাণ্ডবদাহ নিবৃত্ত করবার সাধ্য নেই কোনো গৃহস্থের। চঁদা দাও, কে-কে অপারগ হাত তোল, চাঁদায় না কুলোয় ধরে। কোনো ভারী পকেটের খদ্দেরকে। এক পয়সায় একখানা ফুলকো লুচি, মুখভরা সন্দেশ একখানা এক আনা, কাছেই পুঁটিরাম মোদকের দোকান, নিয়ে এস চ্যাঙারি করে। এক চাঙারি উড়ে যায় তো আরেক চাঙারি। অতটা রাজাহার না জোটে, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটের মোড়ে বুড়ো হিন্দুস্থানীর দোকান থেকে নিয়ে এস ডালপুরি। একটু দগ্ধভক্ষ খাবে নাকি, যাবে নাকি অশাস্ত্রের এলাকায়? অশাসনের দেশে আবার শাস্ত্র কি, শেয়ালদা থেকে নিয়ে এস শিককাবাব। সঙ্গে ছন্দ রেখে মোগলাই পরোটা!

    আর, তেমন অশন-আচ্ছাদনের ব্যবস্থা যদি না জোটাতে পারে, চলে যাও ফেভরিট কেবিনে, দু পয়সার চায়ের বাটি মুখে করে অফুরন্ত আড্ডা জমাও।

    মির্জাপুর স্ট্রিটে ফেভরিট কেবিনে কল্লোলের দল চা খেত। গোল শ্বেতপাথরের টেবিল, ঘন হয়ে বসত সবাই গোল হয়ে। দোকানের মালিক, চাটগেঁয়ে ভদ্রলোক, নাম যতদূর মনে পড়ে, নতুনবাবু, সুজনসুলভ স্নিগ্ধতায় আপ্যায়ন করত সবাইকে। সে সম্বর্ধনা এত উদার ছিল যে চা বহুক্ষণ শেষ হয়ে গেলেও কোনো সঙ্কেতে সে যতিচিহ্ন আঁকত না। যতক্ষণ খুশি আজ্ঞা চালিয়ে যাও জোর গলায়। কে জানে হয়তো আড়াই আকর্ষণ করে আনবে কোনো কৌতূহলীকে, তৃষার্তচিত্তকে। পানের অভাব হতে পারে কিন্তু স্থানের অভাব হবে না। এখুনি বাড়ি পালাবে কি, দোকান এখন অনেক পাতলা হয়েছে, এক চেয়ারে গা এলিয়ে আরেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে দিয়ে বোস। শাদা সিগারেট নেই একটা? অন্তত একটা খাকি সিগারেট?

    বহু তর্ক ও আস্ফালন, বহু প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যচিত্বন হয়েছে সেই ফেভরিট কেবিনে। কল্লোল সম্পূর্ণ হত না যদি না সেদিন ফেভরিট কেবিন থাকত।

    এক-একদিন শুকনো চায়ে মন মানত না। ধোঁয়া ও গন্ধ-ওড়ানো তপ্ত-পক্ক মাংসের জন্যে লালসা হত। তখন দেলখোস কেবিনের জেল্লাজমক খুব, নাতিদূরে ইণ্ডোৰ্মার পরিচ্ছন্ন নতুনত্ব। কিন্তু খুব বিরল দিনে খুব সাহস করে সে-সব জায়গায় ঢুকলেও সামান্য চপ-কাটলেটের বেশি জায়গা দিতে পকেট কিছুতেই রাজি হত না। পেট ও পকেটের এই অসামঞ্জস্যের জন্যে ললাটকে দায়ী করেই শান্ত হতাম। কিন্তু সাময়িক শান্তি অর্থ চিরকালের জন্যে ক্ষান্ত হওয়া নয়। অন্তত নৃপেন জানত না ক্ষান্ত হতে। তার একমুখো মন ঠিক একটা না-একটা ব্যবস্থা করে উঠতই।

    একদিন হয়তো বললে, চল কিছু খাওয়া যাক পেট ভরে। বাঙালি পাড়ায় নয়, চীনে পাড়ায়।

    উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। পয়সা?

    পয়সা যে নেই তুই ও জানিস আমিও জানি। ও প্রশ্ন করে লাভ নেই।

    তবে?

    চল, বেরিয়ে পড়া যাক একসঙ্গে। বেগ-বরো-অর-ষ্টিল, একটা হিল্লে নিশ্চয়ই কোথাও হবে। আশা করি চেয়ে-চিন্তে ধারধুর করেই জুটে যাবে। শেষেরটার দরকার হবে না।

    দুজনে হাঁটতে সুরু করলাম, প্রায় বেলতলা থেকে নিমতলা, সাহাপুর থেকে কাশীপুর। প্রথম প্রথম নৃপেন মোল আনা চেনা বাড়িতে ঢুকতে লাগল, শেষকালে দু-আনা এক-অন। চেনায়ও পেছপা হল না। মুখচেনা নামচেনা কিছুতেই তার উচ্চম-ভঙ্গ নেই। আমাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে রেখে একেকটা বাড়িতে গিয়ে ঢোকে আর বেরিয়ে আসে শূন্য মুখে, বলে, কিছুই হল না, কিংবা বাড়ি নেই কেউ, কিংবা ছোট একটি অভিশপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে দুচরণ মেঘদূত আওড়ায়। এমনিতে স্থির হয়ে বসে থাকতে যা হত হাঁটার দরুন খিদেটা বহুগুণ চনচনে হয়ে উঠল। যত তীব্র তোমার ক্ষুধা তত দূর তোমার যাত্রা। সুতরাং থামলে চলবে না, না থামাটাই তো তোমার খিদে-পাওয়ার সত্যিকার সাক্ষ্য। কিন্তু রাত সাড়ে আটটা বাজে, ডিনার টাইম প্রায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল, আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কি, এবার ভাল ছেলের মত বাড়ি ফিরে যৎ প্রাপ্তং তৎ ভক্ষিতং করি গে। হাত ধরে বাধা দিলাম নৃপেনকে, বললাম, এ পর্যন্ত ঠিক কত পেয়েছিস বল সত্যি করে?

    হাতের মুঠ খুলে অম্লান মুখে নৃপেন বললে, মাইরি বলছি, মাত্র দুটাকা।

    দু টাকা! দুটাকায় প্রকাণ্ড খ্যাঁট হবে। ঈষদূন খাওয়া যাবে আকণ্ঠ। তবে এখনো চীন দেশে না গিয়ে শ্যামরাজ্যে আছি কেন?

    হতাশমুখে নৃপেন বললে, এ দুটাকায় কিছুই হবে না, এ দুটাকা আমার কালকের বাজার-খরচ।

    এই আমাদের রোমাণ্টিক নৃপেন, একদিকে বিদ্রোহী, অন্যদিকে ভাবানুরাগী। ভাগ্যের রসিকতায় নিজেও ভাগ্যের প্রতি পরিহাসপ্রবণ। বস্তুত কল্লোল যুগে এ দুটোই প্রধান সুর ছিল, এক, প্রবল বিরুদ্ধবাদ; দুই, বিহ্বল ভাববিলাস। একদিকে অনিয়মাধীন উদ্দামতা, অন্যদিকে সর্বব্যাপী নিরর্থকতার কাব্য। একদিকে সংগ্রামের মহিমা, অন্যদিকে ব্যর্থতার মাধুরী। আদর্শবাদী যুবক প্রতিকূল জীবনের প্রতিঘাতে নিবারিত হচ্ছে-এই যন্ত্রণাটা সেই যুগের যন্ত্রণা। শুধু বন্ধ দরজায় মাথা খুড়ছে, কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না, কিংবা যে জায়গায় পাচ্ছে তা তার আত্মার আনুপাতিক নয়—এই অসন্তোষে এই অপূর্ণতায় সে। ছিন্নভিন্ন। বাইরে যেখানে বা বাধা নেই সেখানে বাধা তার মনে, তার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের অবনিবনায়। তাই একদিকে যেমন তার বিপ্লবের অস্থিরতা, অন্যদিকে তেমনি বিফলতার অবসাদ।

    যাকে বলে ম্যালাডি অফ দি এজ বা যুগের যন্ত্রণা তা কল্লোলের মুখে স্পষ্টরেখায় উৎকীর্ণ। আগে এর প্রচ্ছদপটে দেখেছি একটি নিঃসম্বল ভাবুক যুবকের ছবি, সমুদ্র পাবে নিঃসঙ্গ ঔদাস্যে বসে আছেকেন-উত্তাল তরঙ্গশৃঙ্গট। তার থেকে তখনও অনেক দূরে। তেরোশ একত্রিশের আশ্বিনে সে-সমুদ্র একেবারে তীর গ্রাস করে এগিয়ে এসেছে, তরঙ্গতরল বিশাল উল্লাসে ভেঙে ফেলছে কোন পুরোনো না পোড়ো মন্দিরের বনিয়াদ। এই দুই ভাবের অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল কল্লোলে। কখনো উন্মত্ত, কখনো উন্মনা। কখনো সংগ্রাম, কখনো বা জীবনবিতৃষ্ণা। প্রায় টুর্গেনিভের চরিত্র। ভাবে শেলীয়ান, কর্মে হ্যামলেটিশ।

    এ সময়টায় আমরা মৃত্যুর প্রেমে পড়েছিলাম। বিপ্লবীর জন্যে সে সময় মৃত্যুটা বড়ই রোমাণ্টিক ছিল—সে বিপ্লব রাজনীতিই হোক বা সাহিত্যনীতিই হোক। আর, সঙ্গ বা পরিপার্শ্ব অনুসারে রাজনীতি না হয়ে আমাদের ভাগে সাহিত্য। নইলে দুই ক্ষেত্রেই এক বিদ্রোহের আগুন, এক ধ্বংসের অনিবার্যতা। এক কথায়, একই যুগ-যন্ত্রণা। তাই সেদিন মৃত্যুকে যে প্রেয়সীর সুন্দর মুখের চেয়েও সুন্দর মনে হবে তাতে আর বিচিত্র কি।

    সেই দিন তাই লিখেছিলাম

    নয়নে কাজল দিয়া
    উলু দিও সখি, তব সাথে নয়, মৃত্যুর সাথে বিয়া।

    আর প্রেমেন লিখেছিল :

    আজ আমি চলে যাই
    চলে যাই তবে,
    পৃথিবীর ভাই বোন মোর
    গ্রহতারকার দেশে,
    সাক্ষী মোর এই জীবনের
    কেহ চেনা কেহ বা অচেনা।
    তোমাদের কাছ হতে চলে যাই তবে।
    যে কেহ আমার ভাই যে কেহ ভগিনী,
    এই উমি-উদ্বেলিত সাগরের গ্রহে
    অপরূপ প্রভাত-সন্ধ্যার গ্রহে এই
    লহ শেষ শুভ ইচ্ছা মোর,
    বিদায়পরশ, ভালোবাসা;
    আর তুমি লও মোর প্রিয়া
    অনন্তরহস্যময়ী,
    চিরকৌতূহল-জ্বালা—
    অসমাপ্ত চুম্বনখানিরে
    তৃপ্তিহীন।…
    যত দুঃখ সহিয়াছি
    বহিয়াছি যত বোঝা, পেয়েছি আঘাত
    কাটায়েছি স্নেহহীন দিন
    হয়ত বা বৃথা,
    আজ কোনো ক্ষোভ নাই তার তরে
    কোনো অনুতাপ আজ রেখে নাহি যাই—

    আর নৃপেনের গলায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিধ্বনি :

    মৃত্যু তোর হোক দূরে নিশীথে নির্জনে,
    হোক সেই পথে যেথা সমুদ্রের তরঙ্গগর্জনে,
    গৃহহীন পথিকেরি
    নৃত্যচ্ছন্দে নিত্যকাল বাজিতেছে ভেরী
    অজানা অরণ্যে যেথা উঠিতেছে উদাসমর্মর
    বিদেশের বিবাগী নির্ঝর
    বিদায় গানের তালে হাসিয়া বাজায় করতালি,
    যেথায় অপরিচিত নক্ষত্রের আরতির থালি
    চলিয়াছে অনন্তের মন্দিরসন্ধানে,
    পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে।
    দুয়ার রহিবে খোলা, ধরিত্রীর সমুদ্রপর্বত
    কেহ ডাকিবে না কাছে, সকলেই দেখাইবে পথ।
    শিয়রে নিশীথরাত্রি বহিবে নির্বাক,
    মৃত্যু সে যে পথিকেরে ডাক।।

    পথিকেরা সেই ডাক যেন তখন একটু বেশি-বেশি শুনছিল। পথিকদের তার জন্যে খুব দোষ দেয়া যায় না। তাদের পকেট গড়ের মাঠ, ভবিষ্যৎ অনির্ণেয়। অভিভাবক প্রতিকুল, সমালোচক যমদূতের প্রতিমূর্তি। ঘরেবাইরে সমান খড়গহস্ততা। এক ভরসাস্থল প্রণয়িনী, তা তিনিও পলায়নপর, বামলোচন। আর তাঁর যারা অভিভাবক তারা আকাট গুণ্ডামার্কা। এই অসম্ভব পরিস্থিতিতে কেউ যদি মরণকে শ্যামসমান বলে, মিথ্যে বলে না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএ ডলস হাউস – অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ
    Next Article কাকজ্যোৎস্না – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }