Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কহলীল জিবরান রচনা সমগ্র (ভাষান্তর : মোস্তফা মীর)

    কহলীল জিবরান এক পাতা গল্প1071 Mins Read0

    নবী [দ্য প্রফেট]

    অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের আলমুস্তাফা ছিলেন তার সময়ের সুপ্রভাত, যিনি বারো বছর ধরে অর্ফালিজ নগরীতে অপেক্ষা করেছিলেন তার জাহাজের জন্য–যে জাহাজ ফিরে এসেছিল এবং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার জন্মের ক্ষুদ্রদ্বীপে।

    এবং বারো বছরের সেই বিশেষ মাসের সপ্তম দিনে অর্থাৎ ফসল-তোলার মাসে তিনি নগরপ্রাচীরের সাহায্য ছাড়াই পাহাড়ে উঠলেন, তাকালেন সমুদ্রের দিকে এবং দেখতে পেলেন তাঁর জাহাজ ধোঁয়াশার সঙ্গে এগিয়ে আসছে।

    তারপর ঝড়ের বেগে খুলে গেল তার হৃদয়ের দরজা এবং তার আনন্দ উড়াল দিল সমুদ্রের ওপর দিয়ে। এবং তিনি চোখ বন্ধ করে আত্মার নীরবতার ভেতরে প্রার্থনা করলেন।

    কিন্তু পাহাড়ে অবতরণের পর এক দুঃখবোধ এসে তাকে ঘিরে ধরে এবং তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন- কীভাবে আমি শান্তির ভেতরে প্রবেশ করব, দুঃখ ছাড়া?

    শুধু তাই নয়, অন্তরে আঘাত না-পাওয়া ছাড়াই এই নগর আমি পরিত্যাগ করব?

    যন্ত্রণার দীর্ঘদিন এবং একাকিত্বের দীর্ঘ রাত্রিগুলি আমি এই নগরীর দেয়ালের ভেতরে কাটিয়েছি এবং কে পারে অনুতাপ ছাড়া তার একাকিত্ব ও যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে যেতে।

    আত্মার অসংখ্য টুকরো আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছি এসব রাস্তায় এবং আমার আকুল। আকাক্ষার অসংখ্য শিশু নগ্ন অবস্থায় এসব পাহাড়ের ভেতরে হেঁটে বেড়ায়। কোনো গুরুভার অথবা ক্রমাগত অস্বস্তিকর বেদনা ছাড়া আমি তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি না।

    এটা কোনো পোশাক নয়, যা এই দিনে পরিত্যাগ করি কিন্তু আমি নিজের দুহাতে ছিন্নভিন্ন করি চামড়া,

    এটা কোনো চিন্তাও নয় যা পিছনে ফেলে এসেছি, কিন্তু একটি হৃদয় তৈরি হয়েছিল যা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় সুমিষ্ট।

    যদিও আমি কোনোভাবেই কালিমা লেপন করতে পারি না।

    সমুদ্র সবকিছুকেই আহ্বান জানায়, এমনকি আমাকে পর্যন্ত এবং অবশ্যই আমাকে জাহাজযাত্রা শুরু করতে হবে।

    কেননা, থেকে গেলে রাত্রির প্রতিটি ঘণ্টাই পুড়ে যাবে, হিমায়িত হবে, স্ফটিকাকার ধারণ করবে এবং আবদ্ধ হবে একটি ছাঁচে।

    আমি কি এখানকার সবকিছুই সঙ্গে নিয়ে যাব? কিন্তু কীভাবে আমি তা করব?

    একটি কণ্ঠস্বর জিভকে বহন করতে পারে না এবং ঠোঁটদুটো সেই কণ্ঠস্বরকে পাখা দিয়েছিল। অবশ্যই একাকী অনুসন্ধান করতে হবে সেই কণ্ঠস্বরকে ইথারের ভেতরে।

    এবং একাকী ঈগল তার বাসা ছাড়াই সূর্যের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যাবে।

    যখন পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তিনি আবার সমুদ্রের দিকে ফিরলেন এবং দেখতে পেলেন, তার জাহাজ পোতাশ্রয়ের নিকটবর্তী, জাহাজের অগ্রভাগে নাবিকরা তার নিজ বাসভূমের মানুষেরা।

    তাদের দেখে তাঁর আত্মা তখন কেঁদে উঠল এবং তিনি বললেন:

    আমার প্রাচীন মাতার পুত্রসন্তানেরা, তোমরা স্রোতারোহী। কীভাবে তোমরা প্রায়ই আমার স্বপ্নের ভেতরে সমুদ্রে ভেসে গেছ। এবং এখন তোমরা এসেছ আমার জাগরণে, যা কিনা আমার গভীরতর স্বপ্ন।

    বাতাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা নাবিকদের সঙ্গে আমি এবং আমার ব্যাকুলতা ভেসে যেতে প্রস্তুত।

    শুধুমাত্র অন্য প্রশ্বাস যা আমি গ্রহণ করব এই নিশ্চল বাতাসে, শুধুমাত্র ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করব পেছনদিকে।

    এবং তারপর আমি তোমাদের ভেতরে দাঁড়াব, সমুদ্রযাত্রীদের ভেতরে একজন সমুদ্রযাত্রী।

    এবং তুমি, বিশাল সমুদ্র, ঘুমন্ত মাতা,

    নদী ও স্রোতের কাছে একাকী কারা হয় শান্তি ও স্বাধীনতা, শুধুমাত্র অন্য বায়ুপ্রবাহ তৈরি করবে এই স্রোত, শুধুমাত্র অন্য মর্মরধ্বনি শোনা যাবে বনের ভেতরের উন্মুক্ত প্রান্তরে। এবং তখন আমি তোমাদের কাছে আসব- একটি উন্মুক্ত সমুদ্রে একটি উন্মুক্ত জলবিন্দু।

    এবং তিনি হেঁটে আসতেই দেখতে পেলেন, দূরে নারী ও পুরুষেরা ফিরে আসছে তাদের মাঠ ও আঙুরক্ষেত থেকে এবং ছুটে চলেছে নগরতোরণের দিকে।

    এবং তিনি শুনতে পেলেন তাঁর নাম ধরে তারা ডাকছে এবং মাঠ থেকে মাঠে একে অন্যকে চিৎকার করে বলছে, ‘তার জাহাজ আসছে।’

    এবং তিনি নিজেকে বললেন :

    বিচ্ছিন্নতার এই দিন কি জনসমাবেশের দিনে পরিণত হবে? এবং বলবে কি আমার সুপ্রভাতে আমার ঈভ [পৃথিবীর প্রথম নারী হাওয়ার বাইবেলকৃত নাম] ছিল সত্যের ভেতরে?

    এবং আমি তাকে কি দেব যে হলরেখায় তার লাঙল ফেলে এসেছে অথবা যে বন্ধ করে রেখেছে তার আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের চাকা?

    আমার হৃদয় কি হবে একটা ফলে বোঝাই গাছ, যা থেকে আমি ফল জড়ো করতে পারি এবং তাদের বিলিয়ে দিতে পারি?

    এবং আমার ইচ্ছাগুলি কি প্রস্রবণের মতো প্রবাহিত হবে যেখান থেকে আমি পারি তাদের কাপ পূর্ণ করে দিতে?

    আমি কি একটি বাদ্যযন্ত্র, পরাক্রমশালীর হাত আমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে অথবা একটি বাঁশি, যার নিশ্বাস আমার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে যেতে পারে আমাকেই?

    .

    আমি কি একজন নীরবতা অন্বেষণকারী এবং কী সম্পদ আমি নীরবতার ভেতরে আহরণ করেছি তা কি আস্থার সঙ্গে বণ্টন করতে পারি?

    এটা হয় যদি আমার ফসল-তোলার দিন তাহলে কোন্ মাঠে বপন করেছি বীজ এবং কোন্ সেই ঋতুগুলিতে,
    যা স্মরণ করা হয় না কখনই?

    অন্ততপক্ষে এটা যদি হয় সেই সময় যখন আমি আমার লণ্ঠন তুলে ধরি, এটা নয় আমার শিখা যা আমাতেই পুড়ে যাবে।

    শূন্যতা ও অন্ধকারে, আমি আমার লণ্ঠন তুলে ধরব, রাত্রির অভিভাবক লণ্ঠন তেলে পূর্ণ করে দেবেন এবং নিজেই জ্বেলে দেবেন আলো।

    এ সবকিছুই তিনি খুলে বললেন।
    কিন্তু তাঁর হৃদয়ে না-বলা রয়ে গেল অনেক বেশিকিছু।
    নিজেই নিজের গভীরতর গোপনকে তিনি উন্মোচন করতে পারেন না,

    এবং তিনি নগরে প্রবেশ করলে নগরবাসী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এল এবং তারা তখন অঝোরে কাঁদছিল এবং তাদের কান্নার শব্দ ছিল একটাই।
    নগরীর বয়োবৃদ্ধরা সামনে এসে দাঁড়াল এবং বলল, আমাদের ছেড়ে আর যাবেন না, আপনি হলেন মধ্যাহ্ন আমাদের গোধূলিবেলায় এবং আপনার যৌবন আমাদেরকে দিয়েছে। স্বপ্ন-দেখার স্বপ্ন।

    আমাদের ভেতরে আপনি কোনো আগন্তুক নয়, নয় একজন অতিথি, বরং আমাদের সন্তান এবং অত্যন্ত প্রিয় সন্তান।

    আমরা কষ্ট পাই ততক্ষণ যতক্ষণ-না আমাদের দৃষ্টি আপনার মুখের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে।

    এবং যাজক ও যাজিকারা বলল :
    সমুদ্রের ঢেউ যেন এখন আমাদেরকে আলাদা না করে
    এবং যে-বছরগুলি আপনি আমাদের ধোঁয়াশার
    ভেতরে কাটিয়েছেন তা পরিণত হয়েছে স্মৃতিতে।
    আপনি আত্মার মতো আমাদের ভেতরে চলাচল করেছেন
    এবং আপনার ছায়া আলোকিত করেছে আমাদের মুখমণ্ডল।
    আপনাকে খুবই ভালোবেসেছি আমরা।
    কিন্তু নির্বাক ছিল আমাদের ভালোবাসা এবং তা ছিল অবগুণ্ঠনে অবগুণ্ঠিত।
    এখনও পর্যন্ত তা আপনার কাছে ক্রন্দন করছে
    এবং আপনার সামনেই সে সবকিছু ফাস করে দেবে।
    এবং কখনও এমন হয়েছে যে, পৃথকীকরণের সময় না-আসা পর্যন্ত ভালোবাসা নিজের গভীরতা জানতে পারে না।

    অন্যেরাও এল এবং তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল।
    কিন্তু তিনি তাদের কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
    শুধুমাত্র তিনি তার মাথাটা নোয়ালেন এবং কাছে যারা দাঁড়িয়েছিল প্রত্যেকেই দেখল তার বুকের ওপর অশ্রু ঝরে পড়ছে।
    এবং তিনি ও জনতা মন্দিরের সামনের বিশাল চত্বরের দিকে এগোলেন।
    সেই চত্বরে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল এক নারী, যার নাম আলমিতরা এবং সে ছিল একজন ভবিষ্যদ্রষ্টা।
    চূড়ান্ত স্নেহের দৃষ্টিতে তিনি সেই নারীর দিকে তাকালেন, কারণ এটা ছিল সেই নারী যে তাকে প্রথম অন্বেষণ করে
    এবং তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে যখন তিনি পুরো একদিন তাদের নগরীতে কাটিয়েছিলেন।
    এবং সেই নারী তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলে :
    হে ঈশ্বরের প্রেরিতপুরুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চারণকারীর সন্ধানে আপনার জাহাজের জন্য অনুসন্ধান করেছেন গভীর দূরত্ব।
    এখন আপনার জাহাজ এসেছে এবং আপনার অবশ্যই যাওয়া প্রয়োজন।
    আপনার অসংখ্য স্মৃতির ভূমি এবং বৃহত্তম বাসনার বসতির জন্য আপনার গভীর আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের ভালোবাসা আপনাকে বেঁধেও রাখবে না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে ধরেও রাখবে না।
    যদিও আপনি আমাদের পরিত্যাগ করার আগেই আমরা তা জিজ্ঞাসা করি, যা আপনি আমাদেরকে বলেন এবং আপনার সত্য আমরা জানতে পারি।
    আমরা এই সত্যগুলো পৌঁছে দেব আমাদের শিশুদের কাছে এবং তারা তা পৌঁছে দেবে তাদের শিশুদের কাছে এবং এই সত্য কখনই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না।
    আপনার একাকিত্বের ভেতরে আপনি পর্যবেক্ষণ করেছেন আমাদের দিনগুলি এবং আপনার জাগরণের ভেতরে শুনেছেন আমাদের ঘুমন্ত অস্তিত্বের হাসি ও কান্না।
    সুতরাং আমাদেরকে এখন আমাদের কাছে উন্মোচন করুন এবং আমাদেরকে বলুন জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের সেইসব যা আপনাকে দেখানো হয়েছে।
    এবং তিনি উত্তরে বলেন :
    যে অর্ফালিজবাসী, আমি সেইসব ছাড়া কি বলতে পারি, এমনকি যা এখন তোমাদের আত্মার ভেতরে চলাচল করছে?
    তখন আলমিরা বলল :
    আমাদেরকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলুন।
    তিনি মাথা তুলে জনতার দিকে তাকালেন, জনতা স্থির হয়ে গেল এবং তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন :
    যখন ভালোবাসা তোমাদের ঈশারায় ডাকে তখন তাকে অনুসরণ করো যদিও তার পথ কঠিন এবং আরোহণযোগ্য নয়।
    এবং যখন তার পাখা তোমাদের আলিঙ্গন করে তখন তোমরা তার বশ্যতা স্বীকার করো, যদিও তার পালকের ভেতরে লুকানো তরবারি তোমাদের আহত করতে পারে।
    এবং যখন ভালোবাসা কথা বলে তোমরা তা বিশ্বাস করো, যদিও তার কণ্ঠস্বর তোমাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে, যেভাবে উত্তরে বাতাস উদ্যানকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
    ভালোবাসা তোমাদেরকে যেমন মুকুট পরাবে তেমনি ক্রুশবিদ্ধ করবে আবার।
    এমনকি এই ভালোবাসা তোমাদের ক্রমোন্নতির জন্য, আবার এই ভালোবাসাই তোমাদের জন্য কাস্তে হয়ে ওঠে।
    এমনকি সে আরোহণ করে তোমাদের মাথার ওপরে এবং স্নেহের স্পর্শ দেয় তোমাদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর শাখাগুলিকে যা সূর্যালোকে শিহরিত হয়।
    সুতরাং ভালোবাসা কি তোমাদের শেকড়ের কাছে নেমে যাবে এবং নাড়া দেবে শেকড়সুদ্ধ পৃথিবীকে?
    তোমাদেরকে সে জড়ো করে তার কাছে শস্যের আঁটির মতো। দলে-মুচড়ে সে তোমাদেরকে নগ্ন করে ফেলে।
    তোমাদের খোলস থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করতে ভালোবাসা তার চালুনি দিয়ে তোমাদের হেঁকে নেয়।
    চূর্ণ-বিচুর্ণ করে সে তোমাদের উজ্জ্বলতা।
    নমনীয় না-হওয়া পর্যন্ত সে তোমাদের ময়দার মতো পিষে ফেলে এবং তারপর তার পুত পবিত্র অগ্নির দায়িত্ব অর্পণ করে তোমাদের, যা তোমাদেরকে পবিত্র রুটিতে পরিণত করতে পারে ঈশ্বরের পবিত্র ভোজ-উৎসবের জন্য।
    ভালোবাসা তোমাদের প্রতি এই সবকিছুই করবে, তোমরা যা তোমাদের হৃদয়ের গোপনীয়তার কাছে জেনে নিতে পারো এবং সেই জ্ঞানের ভেতরে পরিণত হও জীবনের অন্তরতম প্রদেশের খণ্ডাংশে।
    কিন্তু তোমরা যদি আতঙ্কগ্রস্ত হও তাহলে শুধুমাত্র অনুসন্ধান করবে ভালোবাসার শান্তি ও ভালোবাসার আনন্দ।
    তবে তোমাদের নগ্নতাকে তোমরা ঢেকে ফেলো এবং বেরিয়ে এসো ভালোবাসার মাড়াইখানা থেকে এবং এটা তোমাদের জন্য উত্তম।
    ঋতুহীন পৃথিবীতে তোমরা যেখানে হেসে উঠবে তার সবগুলিই তোমাদের হাসি নয়, নয় তোমাদের কান্না, এমনকি তা নয় তোমাদের অশ্রুবিন্দুগুলি।
    ভালোবাসা উপহার দেয় না কিছুই শুধুমাত্র ভালোবাসা ছাড়া এবং একমাত্র নিজেকে ছাড়া গ্রহণ করে না কোনোকিছু।
    ভালোবাসা ভোগদখল করে না, এমনকি নিজেও কারও অধিকারে আসে না,
    কারণ ভালোবাসার প্রতি ভালোবাসাই যথেষ্ট।
    যখন তোমরা ভালোবাসো তখন বলা উচিত নয়,
    ‘ঈশ্বর আমার হৃদয়ে আছেন,’ বরং বলল, ‘ঈশ্বরের হৃদয়ে আমি আছি।’
    এবং ভাবো, তোমরা কেউই ভালোবাসার গতিপথ পরিচালনা করতে পারো না ভালোবাসার জন্য,
    যদি ভালোবাসা তোমাদের মূল্যবান মনে করে তাহলেই তোমাদের গতিপথ পরিচালনা করে।
    ভালোবাসার অন্যকোনো আকাঙ্ক্ষা নেই নিজেকে পরিপূর্ণ করা ছাড়া। কিন্তু যদি তোমরা ভালোবাসো এবং নিশ্চিতই আকাক্ষার প্রয়োজন হয় তাহলে সেগুলিকে তোমাদের আকাক্ষা হতে দাও:
    তাকে গলে যেতে এবং প্রবহমান নদীর মতো হয়ে উঠতে দাও, রাত্রির কাছে তার সুরের সংকেত দেয় অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতার বেদনা জানতে,
    আহত হতে ভালোবাসার নিজস্ব বোঝাবুঝি দ্বারা এবং স্বেচ্ছায় ও আনন্দের সঙ্গে রক্তাক্ত হতে।
    কোনো সকালে পাখাবিশিষ্ট হৃদয় নিয়ে জেগে উঠতে এবং ধন্যবাদ জানাতে ভালোবাসার অন্যকোনো দিনকে,
    অবসর নিতে মধ্যাহ্নবেলায় এবং গভীরভাবে বিবেচনা করতে ভালোবাসার পরমানন্দ। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে আসতে এবং তারপর তোমাদের হৃদয়ের অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের মানুষের জন্য প্রার্থনার সঙ্গে ঘুমাতে এবং তোমাদের ওষ্ঠে তখন প্রশংসার সংগীত।

    .

    তারপর আলমিরা আবার বলল,
    প্রভু, বিয়ে কী?
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমরা একসঙ্গে জন্মেছিলে এবং আবার তোমরা একত্রিত হবে চিরকালের জন্য।
    তোমরা একত্রিত হবে যখন মৃত্যুর সাদা পাখা তোমাদের দিনগুলিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবে, এমনকি তোমরা একত্রিত হবে ঈশ্বরের শব্দহীন স্মৃতির ভেতরে।
    কিন্তু তাকে তোমাদের ঐক্যবোধের ভেতরে স্থান দাও এবং স্বর্গের বাতাস তোমাদের মাঝে নৃত্য করুক।

    একে অন্যকে ভালোবাসো, কিন্তু ভালোবাসার বন্ধন তৈরি কোরো না :
    তাকে বরং তোমাদের আত্মার তীরভূমির মাঝে গতিশীল সমুদ্র হতে দাও।
    একে অন্যের পেয়ালা পূর্ণ করে দাও কিন্তু পান কোরো না এক পেয়ালা থেকে প্রত্যেকেই।
    তোমাদের রুটি তোমরা ভাগাভাগি করো একে অন্যের সাথে কিন্তু একই রুটি প্রত্যেকেই খেয়ো না।
    একসঙ্গে নাচো, গাও এবং উল্লসিত হও কিন্তু একা হতে দাও তোমাদের প্রত্যেককে।
    যেমন বীণার তারগুলি নিঃসঙ্গ হলেও একই সুরের সঙ্গে তারা কেঁপে ওঠে।

    তোমরা হৃদয় দাও কিন্তু প্রত্যেকের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নয়, শুধুমাত্র জীবনের হাতই তোমাদের ধারণ করতে পারে,
    এবং একত্রে দাঁড়াও যদিও এই একত্রিত হওয়া খুব কাছের নয়; মন্দিরের স্তম্ভের মতো দাঁড়াও আলাদা আলাদাভাবে, কারণ ওক ও সাইপ্রেস গাছ একে অন্যের ছায়ায় কখনও বাড়ে না।

    .

    এবং বুকের ওপর শিশুকে ধরে রাখা এক নারী বলল,
    শিশুদের সম্পর্কে আমাদের বলুন।
    এবং তিনি বললেন :
    তোমাদের শিশুরা তোমাদের শিশু নয়।
    জীবনের জন্য জীবনের প্রবল আকাঙ্ক্ষার পুত্রকন্যা তারা। তোমাদের মাধ্যমে আসে কিন্তু তোমাদের থেকে তারা আসে না, এবং তারা তোমাদের সঙ্গে আছে কিন্তু তারা তোমাদের কেউ নয়।

    তোমরা শিশুদের ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের চিন্তাগুলি নয়, কারণ তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাবনা।
    তাদের দেহকে তোমরা গৃহবন্ধী করতে পারো কিন্তু আত্মাকে নয়।
    কারণ তাদের আত্মা বসবাস করে আগামীকালের গৃহে, সে গৃহ তোমরা পরিদর্শন করতে পারো না, এমনকি স্বপ্নের নয়।
    তোমরা তাদের মতো হতে চেষ্টা করতে পারো কিন্তু তাদেরকে তোমাদের মতো করে তুলতে চেষ্টা কোরো না।
    কারণ জীবন যেমন পেছনে ধাবিত হয় না তেমনি অতীত কলঙ্ক নিয়েও বসে থাকে না। তোমরা হলে ধনুক, যেখানে থেকে জীবন্ত তীরের মতো তোমাদের সন্তানেরা দূরে চলে যায়।
    তীরন্দাজ সীমাহীন পথের ওপর দেখতে পায় লক্ষ্যস্থল এবং সে ক্ষমতা দিয়ে তোমাদেরকে নুইয়ে ফেলে যেন তার তীর দ্রুত দূরে যেতে পারে।
    তীরন্দাজের হাতে তোমাদের এই নুয়ে পড়াকে আনন্দিত হতে দাও;
    কারণ সে উড়ন্ত তীর ভালোবাসে, সুতরাং যে আরও ভালোবাসে ধনুক, যা কিনা স্থায়ী।

    .

    তারপর একজন ধনী ব্যক্তি বলল,
    আমাদেরকে দানশীলতা সম্পর্কে বলুন।
    এবং উত্তরে তিনি বললেন :
    তোমরা যখন তোমাদের সহায়-সম্পদ দান করো তখন সামান্যই দান করা হয়।
    আর যখন নিজেকে দান করো তখনই প্রকৃতপক্ষে তোমরা দান করে থাকো।
    কারণ তোমাদের সহায়-সম্পদ কী? তা কেবলই বস্তু যা তোমরা রক্ষা করো এবং আগামীকাল প্রয়োজন হতে পারে এই ভয়ে পাহারা দাও।
    এবং আগামীকাল, আগামীকাল কি বহন করে আনবে অতি সতর্ক কুকুরের কাছে, যে পদচিহ্নহীন বালিতে সমাহিত করছে হাড়গুলি, যেমন সে অনুসরণ করে পবিত্র নগর পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের?
    এবং প্রয়োজনের ভয় কি কেবল প্রয়োজনকেই চায়?
    তৃষ্ণার কোনো আতঙ্ক নেই যখন তোমার কূপ পরিপূর্ণ
    তবে তৃষ্ণা প্রকৃতঅর্থেই নিবারণযোগ্য নয়।
    এরা হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যাদের অনেক থাকলেও সামান্যই দান করে এবং তারা দান করে স্বীকৃতির জন্য এবং তাদের গোপন আকাঙ্ক্ষা তাদের দানকে অনুজ্জ্বল করে তোলে।
    এবং এরা হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যাদের অল্প আছে এবং পুরোটাই দান করে।
    এরা হচ্ছে জীবন ও জীবনের উদারতায় বিশ্বাসী এবং তাদের রত্নভাণ্ডার কখনই শূন্য হয় না।
    এরা হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যারা আনন্দের সঙ্গে দান করে
    এবং সেই আনন্দ হল তাদের পুরস্কার।
    এবং এরা হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যারা দান করে বেদনার সঙ্গে
    এবং এই বেদনা হল তাদের ব্যাপ্তিস্ত লাভ।
    এরা হচ্ছে সেইসব ব্যক্তি যারা দান করে এবং দানের বেদনা সম্পর্কে জানে না, তারা সন্ধান করে না আনন্দ, এমনকি অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে তারা দানও করে না।
    তারা দান করে যেমন ওই উপত্যকায় চিরহরিৎ গুল্মদল মহাশূন্যে প্রশ্বাসের সঙ্গে শুষে নেয় এর সুগন্ধি। হাত বাড়িয়ে সাহায্য করার মাধ্যমে এরকম সবকিছুই ঈশ্বর বলেন এবং তাদের চোখের পেছন থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তিনি হাসেন।

    চাইলে দান করা ভালো, কিন্তু বোঝাবুঝির মাধ্যমে না-চাইতেই দান করা উত্তম এবং যে মুক্তহস্তে দান করে সে একজনকেই খোঁজে যে দানের চেয়েও অনুভব করবে গ্রহণের বৃহত্তর আনন্দ।
    এবং সেখানে যা-কিছু আছে তোমরা কি তা অস্বীকার করবে? কোনো একদিন তোমাদের সবাইকে দান করা হবে,
    সুতরাং এখন দান করো, সেই দানের ঋতু তোমাদের হতে পারে তবে তোমাদের উত্তরাধিকারীর নয়।
    তোমরা প্রায়ই বলো, ‘আমি দান করব শুধুমাত্র তাকেই যে দানের উপযুক্ত।’
    তোমাদের ফলবাগানের গাছেরা অবশ্য তা বলে না, আবার চারণভূমি জুড়ে থাকা পশুর পালও তা বলেনি কোনোদিন।
    তারা দান করে যেন তারা বাঁচতে পারে, কারণ নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার অর্থই হল লোপ পাওয়া।
    নিশ্চিত সেই ব্যক্তিই তোমাদের সবকিছু এবং নিজের দিনরাত্রিগুলি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যোগ্যতম।
    এবং এটা হচ্ছে সে-ই জীবনের সমুদ্র থেকে যার পান করার যোগ্যতা রয়েছে এবং তোমাদের সীমিত স্রোতোধারা থেকে নিজের পেয়ালা পূর্ণ করে নেবার জন্য সে-ই উপযুক্ত।
    এবং মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের ভেতরে শুয়ে থাকা সেই মরুভূমির চেয়ে কোন্ মরুভূমি সেখানে বৃহত্তর হবে?
    নাকি গ্রহণের বদান্যতা?
    এবং তোমরা কারা?
    সেই মানুষগুলির উচিত তাদের বক্ষ বিদীর্ণ করে ফেলা এবং অহংকার উন্মোচন যেন তোমরা দেখতে পারো তাদের নির্দিষ্ট মূল্যের পরিমাণ নগ্নতা এবং লজ্জাহীন অহংকার।
    প্রথমেই লক্ষ্য করো, তোমরাই দাতা হওয়ার উপযুক্ত এবং প্রত্যেকেই একেকটি দানের যন্ত্র।
    কারণ, সত্যের ভেতরে এটা হচ্ছে জীবন যা জীবনকে দান করা হয়- যখন তুমি অর্থাৎ যে নিজেকে দাতা মনে করে সে মূলত দানের সাক্ষী হয়ে থাকে।
    এবং তোমরা যারা গ্রহীতা এবং সকল গ্রহীতারা- কৃতজ্ঞতার ভার সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণা নেই, এজন্য তোমরা একটা জোয়াল চাপিয়ে দাও নিজের ওপরে এবং তার ওপর যে দান করে।
    বরং একত্রে জেগে ওঠো দাতার সঙ্গে তার দানের ওপরে, কারণ তোমাদের ঋণ সম্পর্কে অতি মনোযোগী হতে হলে তার উদারতায় অবিশ্বাস করা হয়, যার রয়েছে মায়ের জন্য উন্মুক্ত হৃদয়ের পৃথিবী এবং পিতার জন্য ঈশ্বর।

    .

    তারপর পান্থশালার এক বৃদ্ধ প্রহরী বলল, আমাদেরকে পানাহার সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি বললেন :
    তোমরা পারবে পৃথিবীর সুগন্ধের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে এবং আলোর সাহায্যে স্থায়ী হতে বাতাসের একটি চারাগাছের মতো।
    কিন্তু তোমরা অবশ্যই খাবারের জন্য হত্যা করো এবং তোমাদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মায়ের বুক থেকে অপহরণ করো দুধ-পানরত নবজাত শিশুকে, তারপর তাকে হতে দাও ধমানুষ্ঠানের কর্ম।
    এবং তোমাদের ভোজসভার টেবিলকে পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়াতে দাও যার ওপরে সমতল এবং বনভূমির শুদ্ধতা ও নিরীহতা উৎসর্গীত হয়, যা মানুষের ভেতরে অধিক শুদ্ধতর এবং এখনও পর্যন্ত অধিক নিরীহ।
    যখন তোমরা একটা পশুকে হত্যা করো তখন তাকে হৃদয় থেকে বলো :
    ‘একই শক্তি তোমাকে হত্যা করে, আমিও খুন হই এবং আমাকেও খেয়ে ফেলা হবে।’
    ‘তাই সেই আইন যা তোমাকে আমার হাতে অর্পণ করেছে, আবার আমাকে অর্পণ করবে প্রবল শক্তিমানের হাতে।’
    ‘তোমার এবং আমার রক্ত মূল্যহীন কিন্তু এর প্রাণরস স্বর্গের বৃক্ষকে আহার জোগায়।’
    যখন তোমরা দাঁতে চূর্ণবিচূর্ণ করো একটি আপেলকে তখন তাকে হৃদয় থেকে বলো :
    ‘তোমার বীজগুলি আমার দেহের ভেতরে বেঁচে থাকবে,
    তোমার আগামীকালের মুকুলগুলি ফুটে উঠবে আমার হৃদয়ে,
    তোমার সুগন্ধ হবে আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাস
    এবং আমরা একত্রে সব ঋতুতেই আনন্দোৎসব করব।’
    এবং তোমরা শরতে যখন তোমাদের আঙুরক্ষেত থেকে আঙুর জড়ো করো আঙুর পেষণকারী যন্ত্রের জন্য তখন মনে মনে ব’ল : ‘আমিও একটি আঙুরক্ষেত, আমার ফলও জড়ো হবে আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের জন্য এবং নতুন মদের মতো আমি রক্ষিত হব চিরস্থায়ী পাত্রে।’
    এবং শীতে যখন তোমরা মদ উত্তোলন করো, তখন তোমাদের হৃদয়ে হতে দাও একটিই গান প্রতিটি পেয়ালার জন্য।
    এবং সেই গান হোক স্মরণসংগীত শরতের দিনগুলির জন্য, আঙুরক্ষেতের জন্য এবং আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের জন্য।

    .

    তারপর একজন কৃষক বলল, আমাদেরকে কাজ সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমরা কাজের মাধ্যমে পৃথিবী ও পৃথিবীর আত্মার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারো।

    আর কর্মে নিষ্ক্রিয় হতে হলে ঋতুগুলির কাছে আগন্তুকে পরিণত হও এবং জীবনের শোভাযাত্রায় দ্রুতবেগে হাঁটো, রাজকীয় ক্ষমতা ও গর্বিত আনুগত্যের ভেতরে যে কুচকাওয়াজ চলেছে অনন্তের দিকে।

    যখন তোমরা কাজ করো তখন তোমরা একটি বাঁশিতে পরিণত হও, যার হৃদয়ের ভেতর দিয়ে সময়ের ফিসফিসানি সংগীত হয়ে ওঠে।

    যখন প্রত্যেকেই ঐক্যের ভেতরে একত্রে গান গায় তখন তোমাদের কোনো গান হবে একটি নলখাগড়া, বধির এবং নীরব।

    সবসময়ই তোমাদেরকে বলা হয়েছিল, কাজ হচ্ছে একটি অভিশাপ এবং শ্রম হচ্ছে দুর্ভাগ্য।

    কিন্তু আমি তোমাদের বলি, যখন তোমরা কাজ করো তখন পৃথিবীর সবচেয়ে দূরবর্তী স্বপ্নের একটি অংশকে তোমরা পরিপূর্ণ করে তোলে এবং এই দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে যখন এই স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল।

    কাজের ভেতর তোমাদের ডুবে থাকার অর্থ হল তোমরা সেই জীবনের ভেতরে আছ যে জীবন সত্য ভালোবাসে।

    এবং কাজের মাধ্যমে জীবনকে ভালোবাসলে তা হবে জীবনের অন্তরাত্মার গোপনীয়তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা।

    কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের বেদনার ভেতরে জন্মের যন্ত্রণাকে আহ্বান জানাও এবং মাংসের সহায়তায় একটি অভিশাপ লেখা হয় তোমাদের ললাটের ওপর, তাহলে আমি বলছি এ সবই মূল্যহীন কিন্তু সেখানে যা লেখা হয়েছে তোমাদের ললাটের ঘাম তার সবই মুছে ফেলে দেবে।

    তোমাদেরকে আরও বলা হয়েছিল যে, জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং তোমাদের ক্লান্তির ভেতরে তোমরা সেই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করো যা ক্লান্তি উচ্চারণ করেছিল।

    এবং আমি বলি জীবন সত্যিই অন্ধকারাচ্ছন্ন তবু তাকে রক্ষা করো যখন সেখানে তীব্র আকাক্ষা রয়েছে।

    এবং সমস্ত তীব্র আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে অন্ধ,
    তবু তাকে রক্ষা করো যখন জ্ঞান সেখানে রয়েছে।
    এবং সমস্ত জ্ঞানই ব্যর্থ, তবু তাকে রক্ষা
    করো যখন সেখানে রয়েছে কাজ।
    এবং সমস্ত কাজই শূন্যতায় পরিণত হয়
    তবু তাকে রক্ষা করো যখন সেখানে ভালোবাসা রয়েছে।
    এবং যখন তোমরা ভালোবাসার সঙ্গে কাজ করো।
    তখন তোমরা বন্ধন তৈরি করে নিজেদের সঙ্গে,
    একে অন্যের সঙ্গে এবং প্রত্যেকে ঈশ্বরের সঙ্গে।
    এবং কী সেই কাজ যা ভালোবাসার সঙ্গে করা যায়?
    তোমাদের হৃদয় থেকে তুলে নেওয়া
    সুতো দিয়ে পোশাক বোনাই হল সেই কাজ,
    যেন সেই পোশাকটা তোমাদের অত্যন্ত
    প্রিয় মানুষ পরেছিল।
    অনুরাগ দিয়ে একটি গৃহ নির্মাণ করাই হল সেই কাজ
    যেখানে বসবাস করেছিল তোমাদের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ।
    স্নেহপরায়ণতার সঙ্গে বীজ বপন করা এবং
    আনন্দের সঙ্গে ফসল পাকানো হল সেই কাজ, যেন তোমাদের অতিশয় প্রিয় মানুষ ফলটি খেয়েছিল।

    তোমাদের নিজস্ব উদ্যমের শ্বাস-প্রশ্বাসের ভঙ্গিতে সবকিছুর মূল্য দেওয়া হল সেই কাজ এবং যেসব আশীর্বাদপ্রাপ্ত মৃতরা তোমাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং তোমাদের লক্ষ্য করছে তাদের সম্পর্কে জানা।

    প্রায়ই আমি শুনেছি তোমরা বলো, যেন ঘুমের মধ্যে বলছ, ‘যে ভূমি চাষ করে তার চেয়ে অধিক মহৎ যে মর্মরপাথরের ওপর কাজ করে এবং পাথরে আপন আত্মার আকার খুঁজে পায়।’

    এবং যে আমাদের পায়ের জন্য স্যান্ডেল তৈরি করে তার চেয়ে রঙধনু ছিনিয়ে এনে মানুষের আদলে কাপড়ের ওপর যে শুইয়ে দিতে পারে তার নৈপুণ্য অনেক বেশি।

    কিন্তু আমি বলি, ঘুমের ভেতরে নয়, তবে দুপুরের অতিরিক্ত বিনিদ্রতার ভেতরে দৈত্যাকৃতি ওকের সাথেও ততটা মিষ্টি কথা হয় না বাতাসের, যতটা হয় তৃণশাখার সবগুলি ক্ষুদ্রতম অংশের সাথে।

    এবং একাকী সে-ই মহৎ যে বাতাসের শব্দকে সংগীতে পরিণত করে এবং তাকে নিজের পছন্দের গানের চেয়েও অধিকতর মধুর করে তোলে।

    কাজ হচ্ছে ভালোবাসা যা দৃশ্যমান করে তোলে সবকিছুই।

    এবং শুধুমাত্র অপছন্দের কারণে যদি তোমরা ভালোবাসার সঙ্গে কাজ করতে না পারো, তাহলে তোমাদের উচিত কর্ম পরিত্যাগ করা, যা তোমাদের জন্য উত্তম এবং মন্দিরের দরজায় বসে থাকা এবং ভিক্ষা নেওয়া সেইসব মানুষের কাছ থেকে যারা আনন্দের সঙ্গে কাজ করে।

    কারণ, তোমরা যদি অযত্নের সঙ্গে রুটি সেঁকে থাকো তাহলে তোমাদের সেঁকে তোলা রুটির স্বাদ তিক্ত, যা খাওয়া যায় কিন্তু তাতে অর্ধেক খিদে মেটে মানুষের।

    এবং তোমরা যদি অনিচ্ছাসত্ত্বেও আঙুর চূর্ণবিচূর্ণ করার অনুমতি দাও তাহলে তোমাদের এই অনিচ্ছাকৃত সম্মতি মদে মিশ্রিত বিষকেও ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরিয়ে ফেলে।

    এবং তোমরা দেবদূতের মতো গান গাও যদিও তোমরা গান গাইতে ভালোবাসো না এবং ঢেকে ফেল মানুষের কর্ণকুহর দিন ও রাত্রির শব্দাবলি থেকে।

    .

    তারপর একজন নারী বলল, আমাদেরকে আনন্দ ও বেদনা সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমাদের আনন্দ হচ্ছে তোমাদের বেদনা এবং তা মুখোশহীন।
    এবং একই কূপ যা থেকে তোমাদের হাস্যধ্বনি বেরিয়ে আসে,
    প্রায় সময়ই তা তোমাদের চোখের জলে পরিপূর্ণ ছিল। “
    এবং কীভাবে তা হতে পারে?
    গভীরতর বেদনা তোমাদের অস্তিত্বের ভেতরে আকার নিলেও অধিকতর আনন্দ তোমরা ধারণ করতে পারো।
    যে পেয়ালা তোমাদের মদ্য ধারণ করে নাই সেই পেয়ালা কি কুমোরের ভাটিখানায় পুড়ে গিয়েছিল?
    এবং যে বীণা তোমাদের উচ্ছ্বাসকে শান্ত করতে পারেনি সেই বীণার কাঠ কি ফাঁপা হয়েছিল ছুরির ফলায়?
    যখন তোমরা আনন্দিত হও তখন হৃদয়ের গভীরে তাকাও এবং তোমরা কেবল সেটাই খুঁজে পাবে যা তোমাদেরকে দুঃখ দিয়েছে এবং যা এখন তোমাদের আনন্দ দিচ্ছে।
    যখন তোমরা বেদনা-ভারাক্রান্ত তখন আবার হৃদয়ের গভীরে তাকাও এবং দেখতে পাবে তোমরা সত্যের ভেতরে কাঁদছ, সে-কারণে ঐ কান্নাই হয়েছে তোমাদের আনন্দ।
    তোমাদের কেউ কেউ বলে, ‘আনন্দ বেদনার চেয়ে বড়,’
    আবার অন্যেরা বলে, ‘না, বেদনা আনন্দের চেয়ে বড়।’
    কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, তারা বিভাজনযোগ্য নয়।
    তারা একত্রে আসে এবং যখন একজন একাকী এসে তোমাদের সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে– মনে রেখে অন্যজন তখন জেগে আছে তোমাদের বিছানায়।
    প্রকৃতঅর্থেই তোমাদের আনন্দ ও বেদনার মাঝখানে তোমরা হলে খসে-পড়া আঁশের মতো কর্মচ্যুত।
    শুধুমাত্র যখন তোমরা শূন্য অবস্থায় থাকো
    তখনই তোমরা নিশ্চল এবং ভারসাম্যপূর্ণ।
    যখন ভাণ্ডাররক্ষক তার সোনা ও রুপা ওজন করার জন্য তোমাদেরকে তুলে ধরে তখন তার অবশ্যই প্রয়োজন তোমাদের আনন্দ অথবা বেদনার উত্থান অথবা পতন।

    .

    তারপর একজন রাজমিস্ত্রি সামনে এগিয়ে এল এবং বলল, আমাদেরকে গৃহ সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমাদের কল্পনা দিয়ে তেপান্তরে একটি কুঞ্জবন তৈরির আগে নগরপ্রাচীরের ভেতরে একটি গৃহ নির্মাণ করো।
    কারণ তোমরা ঘরে ফিরেছ তোমাদের গোধূলিবেলায়,
    সুতরাং তোমাদের ভেতরে যারা পথ হারিয়েছে তারাই চির দূরবর্তী এবং একাকী।
    তোমাদের গৃহ হল তোমাদের বিশাল শরীর।
    এই গৃহ বেড়ে ওঠে সূর্যালোকে এবং রাত্রির নীরবতার ভেতরে
    ঘুমিয়ে পড়ে এবং এই গৃহ স্বপ্নহীন নয়।
    তোমাদের গৃহ কি স্বপ্ন দেখে না? এবং নগর পরিত্যাগ করে কুঞ্জবন অথবা পাহাড়চূড়ায় যাবার স্বপ্ন এখনও দেখছে না?

    আমি কি তোমাদের গৃহগুলি আমার হাতের মুঠোয় জড়ো করতে পারব এবং একজন বীজবপনকারীর মতো তাদেরকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেব বনভূমি ও পশুদের চারণভূমিতে।
    উপত্যকাগুলি কি তোমাদের পথে পরিণত হয়েছিল এবং সবুজ পথগুলি তোমাদের উপত্যকায়, তাহলে আঙুরক্ষেতের মাধ্যমে তোমরা একে অন্যের সন্ধান করতে পারো এবং ফিরে আসতে পারো তোমাদের পোশাকে মাটির সুগন্ধ নিয়ে।
    কিন্তু এসব এখনও পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।
    তোমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের আতঙ্কের ভেতরে তোমাদেরকে জড়ো করে খুব কাছাকাছি এবং সেই আতঙ্ক খুব অল্পসময় স্থায়ী হবে। আর এই স্বল্পকালীন স্থায়িত্বের কারণেই নগরপ্রাচীর পৃথক করবে তোমাদের ভিটেমাটি শস্যক্ষেত থেকে।

    এবং হে অর্ফালিজবাসী আমাকে বলল, কী আছে তোমাদের এসব গৃহে? এবং দরজাবন্ধ গৃহে কি তোমরা পাহারা দাও?
    তোমরা কোন্ শান্তিতে আছ যার পরিপূর্ণ বাসনা তোমাদের ক্ষমতাকে প্রকাশ করে দেয়?
    তোমাদের কি স্মৃতিচিহ্ন আছে যার বাঁকা চাহনির নিবু নিবু আলো মনের শিখর ছুঁয়ে প্রসারিত হয়?
    সৌন্দর্য কি আছে তোমাদের যা হৃদয়েকে নেতৃত্ব দেয় কাঠ ও পাথরে অলংকৃত বস্তু থেকে পবিত্র পাহাড়ের দিকে যেতে? আমাকে বলল, তোমাদের গৃহে কি এসব আছে?
    অথবা তোমরা কি কেবলই স্বস্তিতে আছ এবং স্বস্তির জন্য লালসা হল একটি গোপনীয় জিনিস যা অতিথি হয়ে গৃহে প্রবেশ করে, তারপর সে হয়ে ওঠে গৃহকর্তা এবং তারপর সে হয় প্রভু।

    হ্যাঁ, এটা পরিণত হয় সেই ব্যক্তিতে যে পোষ মানায় এবং আংটা ও বেদনাবোধ দিয়ে তৈরি করে তোমাদের বিশাল আকাক্ষার অসংখ্য নাচের পুতুল।
    যদিও তার হাতদুটো নরম ও চকচকে এবং হৃদয় হচ্ছে লোহার।
    সে কেবলই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদেরকে ঘুম পাড়ানোর জন্য শান্ত করে এবং উপহাস করে মাংসের মর্যাদাকে। তোমাদের ধ্বনি সম্পর্কিত জ্ঞানকে সে বিদ্রূপ করে এবং তাদেরকে শুইয়ে দেয় গোক্ষুর বীজ ধারণকারী খোসার ভেতরে ভঙ্গুর জলযানের মতো।
    প্রকৃতঅর্থেই লালসা আয়েশের জন্য আত্মার অনুভূতিকে হত্যা করে এবং তারপর পেঁতো হাসি হাসতে হাসতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়।

    কিন্তু তোমরা, মহাশূন্যের সন্তানেরা, বিশ্রামের ক্ষেত্রে তোমরা ক্লান্তিহীন, তোমার ফাঁদেও পড়বে না, তোমরা পোষ্যও হবে না।
    তোমাদের গৃহগুলি মাস্তুল হবে কিন্তু নোঙর হবে না।
    এটা কখনই হবে না কোনো চকচকে পাতলা আবরণ যা একজন আহতকে ঢেকে ফেলে, কিন্তু চোখের একটি পাতাই চোখকে পাহারা দিয়ে রাখে।
    তোমরা দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারো এজন্য তোমাদের পাখা মুড়তে ভয় পাবে না, তোমরা মাথা নোয়বে না ছাদে মাথা ঠুকে যেতে পারে এই ভয়ে, এমনকি ভয় পাবে না নিশ্বাস নিতে পাছে দেয়ালে চিড় ধরে এবং খানখান হয়ে তা ভেঙে পড়ে যায়।
    বেঁচে থাকার জন্য তোমরা কখনই মৃতের তৈরি সমাধিতে বসবাস করবে না।
    যদিও তা চমৎকারিত্ব এবং গৌরব কিন্তু তোমাদের গৃহগুলি ধারণ করবে না তোমাদের গোপনীয়তা, তোমাদের আকুল আকাঙ্ক্ষাকেও দেবে না আশ্রয়।

    সে-কারণে তোমাদের ভেতরে কোন্ সেই সীমাহীনতা যে আকাশের অট্টালিকায় প্রতীক্ষা করে থাকে, যার দরোজাগুলি হল ভোরের ধোঁয়াশা এবং জানালাগুলো হচ্ছে অসংখ্য সংগীত ও রাত্রির অন্তহীন নীরবতা।

    .

    এবং তাঁতি বলল, আমাদেরকে বস্ত্র সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন,
    তোমাদের পোশাক তোমাদের সৌন্দর্যের অনেকটাই লুকিয়ে রাখে, যদিও তারা সৌন্দর্যহীনতাকে গোপন করে না।
    যদিও তোমরা একান্ত গোপনীয়তার স্বাধীনতাকে অন্বেষণ করো পোশাকের ভেতরে, কিন্তু তোমরা ঘোড়ার সাজ-পোশাক ও শৃঙ্খলের ভেতরে সেই স্বাধীনতা খুঁজে পেতে পারো।
    তোমরা সূর্য ও বাতাসের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে তোমাদের চামড়ার চেয়ে বেশি এবং তোমাদের পোশাকের চেয়ে কম।
    কারণ জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস চলাচল করে সূর্যালোকে এবং জীবনের হাতদুটি থাকে বাতাসের ভেতরে।

    তোমাদের কেউ কেউ বলে, ‘এটা হচ্ছে উত্তরের বাতাস যে পোশাকগুলি বুনেছে যা আমরা পরিধান করি।’
    এবং আমি বলি, হ্যাঁ এটা ছিল উত্তরের বাতাস কিন্তু তার তাঁর ছিল তার লজ্জা এবং মাংসপেশির নমনীয়তাই ছিল তার সুতো।
    এবং যখন তার কাজ সম্পন্ন হয় তখন সে বনভূমির ভেতরে হেসে ওঠে।
    ভুলে যেও না সেই পরিমিতিবোধ হচ্ছে একটি রক্ষাকবচের জন্য, আবার এই রক্ষাকবচই হয় অশুচির চোখ।
    এবং যখন এই অপবিত্র অধিক কিছুই হবে না তখন কোথায় ছিল পরিমিতিবোধ মনের প্রতিবন্ধক ও অশ্লীলতা ছাড়া?
    ভুলে যেও না তোমাদের নগ্ন পদযুগ স্পর্শ করে মাটি উত্যু হয় এবং বাতাস দীর্ঘ সময় ধরে তোমাদের চুলের সঙ্গে খেলা করে।

    .

    এবং একজন ব্যবসায়ী বলল, আমাদেরকে বেচাকেনা
    সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    মাটি তোমাদের কাছে প্রাকৃতিক রীতিতে তার ফল উৎপন্ন করে এবং তোমরা কখনই তা চাইবে না যদি তোমরা জানো কীভাবে হাতের মুঠো পূর্ণ করে নিতে হয়।
    বিনিময় প্রক্রিয়ার ভেতরে এটা হচ্ছে মাটির উপহার, যার মধ্যে তোমরা খুঁজে পাবে অতি প্রাচুর্য এবং পরিতৃপ্ত হবে।
    বিনিময় প্রক্রিয়া ভালোবাসার ভেতরে সম্পন্ন হবে না এবং দয়া করে তা সুবিচারও করবে না কিন্তু কাউকে নেতৃত্ব দেবে লোভের প্রতি এবং অন্যদের ক্ষুধার প্রতি।

    বাজার এলাকায় যখন তোমরা সমুদ্র, শস্যক্ষেত এবং আঙুরক্ষেতের এক-একজন কঠোর পরিশ্রমী তখন তোমাদের দেখা হয় তাঁতি, কুমোর এবং যারা মশলা জড়ো করে তাদের সঙ্গে–
    তারপর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো মাটির সর্বোচ্চ উদ্যম যেন সে তোমাদের মাঝে আসে, পবিত্র করে তোলে তুলাদণ্ড এবং পরিশোধকৃত মূল্যের হিসাব যা ওজন করা হয় মূল্যের বিপরীত মূল্য দিয়ে।
    এবং কষ্ট পেয়ো না শূন্যহাতে তোমাদের লেনদেনে অংশ নিতে, কারা তাদের কথা বিক্রি করবে তোমাদের শ্রমের জন্য।
    এরকম মানুষের কাছে তোমাদের বলা উচিত :
    ‘আমাদের সঙ্গে এসো শস্যক্ষেতে অথবা আমাদের ভাইদের সঙ্গে সমুদ্রে ভেসে যাও এবং তোমার জাল ফেলে রাখো,
    সে কারণে ভূমি ও সমুদ্র হবে তোমার কাছে যথেষ্ট, যেমন আমাদের কাছে।’

    এবং যদি সেখানে গায়ক, নৃত্যশিল্পী এবং বংশীবাদকেরা আসে তবে তাদের জন্যও উপহার কিনে নাও।
    কারণ তারাও ফল ও রজন একত্রকারী এবং সেটাই তারা বহন করে আনে, যদিও স্বপ্নের প্রথা হয় তোমাদের আত্মার জন্য পোশাক এবং খাবার।

    এবং বাজার এলাকা পরিত্যাগ করার আগে তোমরা দেখতে পাও কেউই শূন্যহাতে নিজের পথে যায়নি।
    কারণ মাটির সর্বোচ্চ উদ্যম কখনই বাতাসের ওপর শান্তিতে ঘুমাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত না হয়।

    .

    তারপর শহরের বিচারকদের ভেতর থেকে একজন সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল এবং বলল, আমাদেরকে অপরাধ এবং শাস্তি সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    এটা হল সেই সময় যখন তোমাদের উদ্যম বাতাসের ওপর দিয়ে দীর্ঘ পর্যটনে যায়, তাই তোমরা একাকী এবং অরক্ষিত, তোমরা অন্যের প্রতি অন্যায় করো এবং একইভাবে তা করো নিজেদের প্রতি।
    এবং সেই অন্যায়ের জন্য তোমরা অবশ্যই অমনোযোগের সঙ্গে কড়া নাড়ো এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আশীর্বাদপ্রাপ্তদের দরজায়।

    সমুদ্রের মতো তোমাদের ঈশ্বর-সত্তা,
    এটা কখনই কলুষিত হয় না।
    এবং ইথারের মতো তা উত্তোলিত
    হলেও দ্রুত উড়ে চলে যায়।
    এমনকি সূর্যের মতো তোমাদের ঈশ্বর-সত্তা,
    সে গন্ধমুষিকের পথ চেনে না, খোঁজে না সে সাপের গর্ত।
    কিন্তু তোমাদের ঈশ্বর-সত্তা তোমাদের অস্তিত্বের ভেতরেও একা বসবাস করে না।
    এই সত্তার অধিকাংশই তোমাদের ভেতরে এখনও মানুষ এবং অধিকাংশই তোমাদের ভেতরে এখনও মানুষ হয়ে ওঠেনি।
    কিন্তু একজন বেঢপ আকারের পিগমি ধোঁয়াশার ভেতরে তার নিজস্ব জাগরণের খোঁজে
    ঘুমন্ত অবস্থায় হেঁটে বেড়ায়।
    এবং এখন তোমাদের ভেতরের মানুষটির সঙ্গে আমি কথা বলি।
    কারণ, এটা নয় তোমাদের ঈশ্বর-সত্তা, নয় ধোঁয়াশার ভেতরের সেই পিগমি, এটা হচ্ছে সে-ই যে অপরাধ ও অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে জানে।

    প্রায়ই আমি শুনেছি তোমরা একজনের কথা বলো যে অপরাধ করেছে, যদিও সে তোমাদের একজন ছিল না কিন্তু সে তোমাদের কাছে একজন অচেনা এবং তোমাদের পৃথিবীতে একজন অনধিকার প্রবেশকারী।
    কিন্তু আমি বলি পবিত্রতা এবং ন্যায়পরায়ণতা সর্বোচ্চতার ওপরে বেড়ে উঠতে পারে না,
    যা তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরে আছে।
    সুতরাং দুর্বৃত্ত এবং দুর্বল নিম্নতম পর্যায়ের চেয়ে নিম্নতর পর্যায়ে পতিত হতে পারে না, যা তোমাদের ভেতরেও আছে।

    এবং গাছের একমাত্র পাতা হিসেবে তা হলুদ হয় না কিন্তু পুরো বৃক্ষের শব্দহীন জ্ঞানের সঙ্গে তা আবর্তিত হয়।
    সুতরাং অন্যায়কারী অন্যায় করতে পারে না তোমাদের প্রত্যেকের গোপন ইচ্ছাশক্তি ছাড়া।
    মিছিলের মতো তোমরা একত্রে হাঁটতে থাকো তোমাদের ঈশ্বর-সত্তার দিকে।
    তোমরাই হলে পথ এবং পথচারী
    এবং যখন তোমাদের একজন ভূমিতে পতিত হয়
    তখন সে পতিত হয় তাদের জন্য
    যারা তার পেছনে রয়েছে,
    এটা হল পাথরে হোঁচট না-খাওয়ার জন্য সতর্কতা।
    হ্যাঁ, সে পতিত হয় অদের জন্য যারা তার সামনে রয়েছে এবং তারা অধিক দ্রুততার সঙ্গে দৃঢ়পায়ে হেঁটে চলে যায় যদিও প্রতিবন্ধক পাথরটিকে সরানো হয়নি।

    এবং এই সবকিছু, যদিও অসংখ্য কথা
    তোমাদের হৃদয়ে বোঝার মতো চেপে বসে আছে :
    খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তি নিজের খুনের জন্য
    দায়ী হয় না এরকম নয়,
    এবং অপহরণ করা হয়েছে যাক সে নির্দোষ নয় যখন সে অপহৃত হয়।
    ন্যায়পরায়ণতা নির্দোষ নয় যখন দুর্বৃত্ত
    তার কৃতিত্ব প্রদর্শন করে,
    এবং যে মানবহত্যায় নিজের হাত কলক্ষিত করে নি
    তার হাতও পবিত্র নয় যখন সে নৃশংস কাজ করে।

    এ্যা, অপরাধী প্রায় সময়ই আঘাতপ্রাপ্তির শিকার হয়।
    এবং এখনও পর্যন্ত প্রায় সময়ই দণ্ডপ্রাপ্তরাই নির্দোষ ও নিরপরাধীর বোঝা বহনকারী।
    তোমরা আলাদা করতে পারো না অন্যায় থেকে ন্যায়কে এবং মন্দ থেকে ভালোকে,
    কারণ তারা একত্রে সূর্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে, এমনকি কালো ও সাদা সুতোর মতো একত্রে তাদের বয়ন করা হয়।
    এবং কালো সুতো ছিঁড়ে গেলে বয়নকারী তার পুরো বস্ত্রের দিকে তাকাবে এবং পরীক্ষা করবে তাঁত।

    যদি তোমাদের কেউ অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে বিচারের জন্য নিয়ে আসে, তাহলে তাকে ঐ রমণীর স্বামীর হৃদয়কে তুলাদণ্ডে ওজন করতে দাও এবং তার আত্মাকে পরিমাপ করতে দাও পরিমাণ দ্বারা।
    এবং তাকে দাও দাগী আসামিকে চাবুক মারতে যে আইন-লঙ্ঘনকারীর উদ্যমের দিকে তাকায়।

    এবং যদি তোমাদের কেউ ন্যায়নিষ্ঠার নামে শাস্তি প্রদান করে এবং কুঠারটিকে শুইয়ে দেয় পাপী বৃক্ষের গোড়ায়, তবে তাকে দেখতে দাও ঐ বৃক্ষের শেকড়গুলো,
    এবং প্রকৃতঅর্থেই সে অনুসন্ধান করবে ভালো ও মন্দের শেকড়গুচ্ছ, অনুসন্ধান করবে সুফল এবং সাফল্য আর সবগুলিই মাটির শব্দহীন হৃদয়ে একত্রে পেঁচিয়ে যাবে।
    এবং তোমরা, বিচারকেরা কে হবে ন্যায়পরায়ণ?
    কী রায় তোমরা ঘোষণা করো তার প্রতি,
    যদিও সে শরীরের ক্ষেত্রে সৎ এবং মনের দিক থেকে একজন চোর?
    কী দণ্ড তোমরা তাকে দাও যে মাংসের ভেতরে খুন করে,
    যদিও মনের ভেতরে সে নিজে খুন হয়?
    এবং তোমরা তার বিরুদ্ধে কীভাবে মামলা দায়ের কর,
    প্রতারক ও নিপীড়ক হিসেবে যে সক্রিয়,
    যদিও সে অত্যাচারিত এবং প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

    এবং তোমরা কিভাবে তাদেরকে শাস্তি দেবে
    যাদের অপকর্ম তাদের অনুতাপের চেয়েও বড়?
    অনুতাপ কি ন্যায়পরায়ণতা নয় যা সেই আইন দ্বারা পরিচালিত,
    যে আইন তোমরা সানন্দে পরিবেশন করো?
    যদিও তোমরা নির্দোষের ওপর অনুতাপকে
    চাপিয়ে দিতে পারো না, পারো না অপরাধীর হৃদয় থেকে তাকে তুলে নিতে।
    অনাদিষ্টরা রাত্রিকালে তাকে ডাকবেই এবং সেই মানুষেরা পারে জেগে থেকে পাহারা দিতে ও স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে নিজেদের দিকে।
    এবং তোমরা যারা ন্যায়পরায়ণতা বোঝো, কিন্তু কীভাবে তা বুঝবে, যদি তোমরা আলোর পরিপূর্ণতার ভেতরে সমস্ত কৃতিত্বকে বিশেষ দৃষ্টিতে না দ্যাখো?
    তারপর শুধুমাত্র তোমরাই জানবে উত্থান এবং পতন হচ্ছে একই ব্যক্তি যে তার পিগমি-সত্তার রাত্রি এবং ঈশ্বর-সত্তার দিনের মাঝখানে গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে আছে।
    এবং মন্দিরের কোনার পাথরটি মোটেও উচ্চতর নয়
    মন্দিরের মূল ভিত্তির সর্বনিম্ন পাথরের চেয়ে।

    .

    তারপর একজন আইনজীবী বলল : প্রভু আমাদের আইনগুলি কী?
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমরা আইনকে শায়িত করে উৎফুল্ল হও, আরও উৎফুল্ল হও তোমরা আইন ভঙ্গ করে।
    সমুদ্রের সঙ্গে খেলতে থাকা শিশুদের মতো কে তৈরি করে বালির সৌধ দৃঢ়তার সাথে এবং তারপর তাদের ধ্বংস করে হাসতে হাসতে।
    কিন্তু তোমরা যখন বালির সৌধ তৈরি করো, সমুদ্র তখন অধিক বালি এনে জমা করে তার তীরে এবং যখন তোমরা তা ধ্বংস করো সমুদ্র তখন তোমাদের সঙ্গে হেসে ওঠে।
    প্রকৃতপক্ষে সমুদ্র সবসময়ই নিরপরাধের সঙ্গে হেসে ওঠে।

    কিন্তু তারা কেমন আছে যাদের কাছে জীবন সমুদ্র নয় এবং মানুষের তৈরি আইন নয় কোনো বালির সৌধ,
    তাদের কাছে জীবন হল একটি পাথরখণ্ড এবং আইন হচ্ছে একটি বাটালি, যা দিয়ে সেই পাথরটাকে তারা নিজের ইচ্ছামতো খোদাই করে?
    পঙ্গু লোকটির খবর কী, যে নৃত্যশিল্পদের ঘৃণা করে?
    সেই ষাঁড়টি কেমন আছে যে তার জোয়াল ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে অরণ্যের এলক ও হরিণেরা পথভ্রষ্ট এবং ছন্নছাড়া প্রাণী?
    সেই বৃদ্ধ সাপটি কেমন আছে যে তার নিজের খোলস বদলাতে পারে না কিন্তু অন্য সবাইকে নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে আহ্বান জানায়?
    এবং সেই ব্যক্তি কেমন আছে যে বিয়ের ভোজপর্বে আগেভাগে আসে এবং অতিভোজন ও ক্লান্তি যখন তার পথে চলে যায় তখন সে বলে প্রতিটি ভোজপর্বই এক-একটি নিয়মভঙ্গের অনুষ্ঠান এবং যারা ভোজ খায় প্রত্যেকেই আইনভঙ্গকারী?

    আমি তাদের সম্পর্কে কী বলব যারা সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে থাকে?
    তারা শুধুমাত্র নিজের ছায়া দেখতে পায় এবং তাদের ছায়াই হচ্ছে তাদের আইন।
    এবং সূর্য কি তাদের কাছে একটি ছায়া ধারণকারী ধাতব পাত্র?
    এটা কি আইনের সত্যতা স্বীকার করা নিম্নমুখী হতে এবং তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে মাটির ওপরে?
    কিন্তু তোমরা যারা সূর্যের মুখোমুখি হাঁটো, কী প্রতিমূর্তি মাটিতে অঙ্কিত হয় যা তোমাদেরকে ধরে রাখতে পারে?
    তোমরা যারা বাতাসের সঙ্গে পর্যটনে যাও কোন্ পক্ষিমূর্তি তোমাদের গতি পরিচালনা করবে?
    কোন মানুষের আইন তোমাদের বন্ধনে আবদ্ধ করবে যদি তোমাদের জোয়াল তোমরা ভেঙে ফ্যালো কিন্তু তা কোনো কারাবন্দির দরজার ওপরে নয়।
    কোন্ সেই আইন যার জন্য তোমরা নাচতে ভয় পাবে, তবে নাচতে নাচতে কোনো মানুষের লোহার শিকলে হোঁচট খেও না?
    এবং কে সে, যে তোমাদেরকে বিচারের জন্য নিয়ে আসবে যদি তোমরা তোমাদের পোশাক ছিঁড়ে ফ্যালো, যদিও তা পরিত্যক্ত হয় না মানুষের পথের ওপর?
    হে অর্ষালিজবাসী, তোমরা এখন ঢোলের শব্দ থামাতে পারো এবং ঢিলে করতে পার বীণার তার, কিন্তু কে এখন গান না গাইতে আদেশ দেবে ভরতপাখিকে?

    .

    একজন বক্তা বলল, আমাদেরকে স্বাধীনতা সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন : নগর-তোরণের সামনে এবং তোমাদের অগ্নিকুণ্ডের পাশে আমি দেখেছি নিজেদেরকে মাটিতে উপুড় করে তোমরা শুইয়ে দাও এবং উপাসনা করো নিজস্ব স্বাধীনতার।
    যেমন দাসেরা নিজেদের বিনয়ী করে তোলে একজন প্রজাপীড়ক শাসকের সম্মুখে এবং তার মহিমাকীর্তন করে, যদিও তার হাতেই তারা খুন হয়।
    হ্যাঁ, মন্দিরের কুঞ্জবনে এবং নগরদূর্গের ছায়ায় আমি দেখেছি তোমাদের মাঝে সবচেয়ে স্বাধীন মানুষ নিজের স্বাধীনতা হিসেবে জোয়াল ও হাতকড়া পরিধান করে আছে।
    এবং আমার হৃদয়ের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়, কারণ তোমরা তখনই শুধুমাত্র স্বাধীন হতে পারবে যখন স্বাধীনতা রক্ষার আকাঙ্ক্ষা পরিণত হবে তোমাদের কাছে একটি ভারবাহী পশুর সাজপোশাকে এবং যখন তোমরা লক্ষ্য ও পরিপূর্ণতা হিসেবে স্বাধীনতা সম্পর্কে বলাবলি থেকে বিরত থাকবে।
    তোমরা প্রকৃতঅর্থেই স্বাধীন হবে যখন তোমাদের দিনগুলি পরিচর্যাহীন নয়, রাত্রিগুলি নয় অভাব ও দুর্দশামুক্ত।
    কিন্তু এই সবকিছুই তোমাদের জীবনকে ঘিরে রাখে এবং তা সত্ত্বেও তোমরা তাদের ওপরে বেড়ে ওঠো উলঙ্গ ও বন্ধনহীন।
    এবং কীভাবে তোমরা বেড়ে উঠবে তোমাদের দিন ও রাত্রির ওপরে যদি-না তোমরা শৃঙ্খল ভেঙে ফ্যালো, যা তোমাদের বোঝাবুঝির ভোরবেলায় একত্রিত করেছ তোমাদের পুরোটা দুপুর জুড়ে।
    সত্যের ভেতরে তোমরা যাকে স্বাধীনতা বলে ডাকো তা হচ্ছে এসব শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ শক্তি, যদিও এই শক্তি সূর্যালোকে ঝকমকিয়ে ওঠে এবং তীব্র আলোতে তোমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

    .

    এবং এটা কি কেবলই তোমাদের নিজস্ব আত্মার সুগন্ধ যা আগ্রাহ্য করে তোমরা স্বাধীন হতে পারো? যদি এটা হয় একটা অন্যায় আইন যা তোমরা বিলোপ করেছ কিন্তু আইনটি লেখা হয়েছিল তোমাদের নিজের হাতে নিজের ললাটের ওপর।
    তোমরা তা মুছে ফেলতে পারো না তোমাদের আইনগ্রন্থগুলো পুড়িয়ে ফেলে, ধৌত করতে পারো না তোমাদের বিচারকদের ললাট, যদিও তোমরা তাদের ওপর সমুদ্র ঢেলে দাও।
    এবং এটা যদি হয় একজন স্বৈরশাসক, তোমরা যাকে সিংহাসনচ্যুত করো, লক্ষ্য করো, তার সিংহাসন তোমাদের ভেতরে উত্থিত হয়েই আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
    একজন অত্যাচারী শাসক কীভাবে শাসন করতে পারে স্বাধীন এবং গর্বিতদের, যদি তাদের নিজস্ব স্বাধীনতার ভেতরে নিপীড়ন এবং নিজস্ব গর্বের ভেতরে লজ্জা না থাকে?
    এবং এটা যদি হয় পরিচর্যা তোমরা যা প্রত্যাখ্যান করো, সেটাই তোমরা পছন্দ করেছ তোমাদের ওপর আরোপিত পরিচর্যার চেয়ে।
    এবং এটা যদি ভীতি হয় যা তোমরা দূর করে দাও, তাহলে সেই ভয়ের আসন হচ্ছে তোমাদের হৃদয়ে, যা ভীত মানুষের হাতে নয়।
    প্রকৃতঅর্থে সবকিছুই তোমাদের অস্তিত্বের ভেতরে চলাচল করে- অপরিবর্তনীয় অর্ধ-আলিঙ্গন, আকাঙ্ক্ষিত ও আতঙ্কিত, বেমানান ও যত্নে লালিত, অভিযুক্ত এবং সে কারণেই তোমরা মুক্ত হও।
    এ সবকিছুই তোমাদের ভেতরে চলাচল করে আলো এবং ছায়ার মতো পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে থেকে জোড়ায় জোড়ায়।
    এবং যখন ছায়া বিবর্ণ হতে হতে আর ছায়া থাকে না তখন সেই আলো অন্য আলোর কাছে তাকে ছায়ায় পরিণত হতে বিলম্ব ঘটায়।
    এবং এইভাবে তোমাদের স্বাধীনতা যখন তার শৃঙ্খল হারায় তখন নিজেই সে বৃহত্তর স্বাধীনতার শৃঙ্খলে পরিণত হয়।

    .

    এবং যাজিকা আবার বলল, আমাদেরকে কারণ ও আসক্তি সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    প্রায় সময়ই তোমাদের আত্মা হচ্ছে একটা যুদ্ধক্ষেত্র যার ওপর তোমাদের কারণ এবং বিচার তোমাদের আসক্তি ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
    আমি কি তোমাদের আত্মার শান্তির নির্মাতা হব যেখানে তোমাদের উপাদানসমূহের বিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আমি একত্ব ও সংগীতে পরিণত করতে পারি।
    কিন্তু কীভাবে আমি তা করব যদি তোমরা নিজেরাই শান্তির নির্মাতা না হও, না হও। তোমাদের উপাদানসমূহের প্রেমাস্পদ?
    তোমাদের কারণ এবং আসক্তি হচ্ছে সমুদ্রে ভ্রমণরত তোমাদের আত্মার হাল এবং পাল।
    যদি তোমাদের হাল অথবা পালগুলি ভেঙে যায় তাহলে তোমরা তা শূন্যে ছুঁড়ে মারতে পার এবং সমুদ্রে ভেসে যেতে পারো অথবা নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতে পারো মধ্যসমুদ্রে।
    তাই কারণ হচ্ছে একটি সীমাবদ্ধ শক্তি যা একাকী শাসন করে এবং আসক্তি হচ্ছে একটি অরক্ষিত শিখা যা পুড়িয়ে ফেলে এর নিজস্ব সর্বনাশকে।
    সুতরাং তোমাদের আত্মাকে দাও তোমাদের কারণগুলির প্রশংসা করতে আসক্তির চূড়া পর্যন্ত যেন তা গান গাইতে পারে।
    এবং তাকে পরিচালনা করতে দাও তোমাদের আসক্তিকে কারণসহ, যে আসক্তি বেঁচে থাকতে পারে তার নিত্য পুনরুত্থানের মাধ্যমে এবং ফিনিক্স* পাখির মতো বেড়ে ওঠে এর নিজস্ব ছাইয়ের ওপর।

    আমি তোমাদের বিচার ও ক্ষুধাকে বিবেচনা করব যেমন তোমরা বিবেচনা করো তোমাদের গৃহে একসঙ্গে দুজন পছন্দের অতিথি।
    নিশ্চয়ই তোমরা একজন অতিথিকে অন্যজনের ওপরে স্থান দাও না। কারণ যে একজন অধিক মনোযোগী সে-ই হারিয়েছে উভয়ের ভালোবাসা এবং বিশ্বাস।

    পাহাড়গুচ্ছের ভেতরে যখন তোমরা সাদা পপলার গাছের ঠাণ্ডা ছায়ায় বসে ভাগাভাগি কর দূরবর্তী মাঠ এবং পশুচারণভূমির শান্তি ও প্রশান্তি-তখন তোমাদের হৃদয়কে নীরবতার ভেতরে বলতে দাও ‘ঈশ্বর কারণের ভেতরে বিশ্রাম গ্রহণ করেন।’
    এবং যখন ঝড় আসে, পরাক্রমশীল বাতাস নাড়া দেয় বনভূমি এবং বজ্র ও বিদ্যুৎচমক আকাশের রাজকীয় ক্ষমতা ঘোষণা করে- তখন তোমাদের হৃদয়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে দাও ঈশ্বর আসক্তির ভেতরে চলাচল করেন।
    এবং যেহেতু তোমরা ঈশ্বরের গোলকের শ্বাসপ্রেশ্বাস এবং ঈশ্বরের বনভূমির একটি পাতা সেহেতু তোমাদের উচিত আসক্তির ভেতরে চলাচল করা ও কারণের ভেতরে বিশ্রাম গ্রহণ।

    [*পৌরাণিক পাখি-যে আরব্য মরুভূমিতে শত বছর বেঁচে থাকার পর চিতাগ্নিতে নিজেকে ধ্বংস করে। এবং সেই চিতাভষ্ম থেকে পুনরায় বেঁচে ওঠে।]

    .

    একজন নারী বলল, আমাদেরকে যন্ত্রণা সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি বললেন :
    তোমাদের যন্ত্রণা হচ্ছে সেই খোলসের ভাঙন, যে খোলস তোমাদের বোঝাবুঝিকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
    এমনকি ফলের বিচির মতো ভেঙে যায় যেন এর হৃদয় সূর্যালোকে দাঁড়াতে পারে, সুতরাং অবশ্যই তোমরা বেদনা সম্পর্কে জানো।
    এবং তোমরা কি তোমাদের হৃদয়কে রক্ষা করতে পারবে তোমাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিস্ময়কর ঘটনার ভেতরে, যেখানে তোমাদের যন্ত্রণা কম বিস্ময়কর মনে হবে না তোমাদের আনন্দের চেয়ে।
    এবং তোমরা কি তোমাদের হৃদয়ের ঋতুগুলিকে গ্রহণ করবে, যেমন তোমাদের মাঠের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঋতুগুলিকে তোমরা সবসময় গ্রহণ করেছ।
    এবং তোমরা প্রশান্তির সঙ্গে তা লক্ষ্য করবে তোমাদের মর্মবেদনার শীত ঋতুগুলির ভেতরে।
    তোমাদের অধিকাংশ যন্ত্রণাই হচ্ছে তোমাদের বেছে নেওয়া।
    এটা হচ্ছে তিক্ত তরল ওষুধ যা দিয়ে চিকিৎসক তোমাদের ভেতরের অসুস্থ সত্তাকে সারিয়ে তোলে।
    সুতরাং চিকিৎসককে বিশ্বাস করো এবং পান করো তার প্রতিষেধক নীরবতা ও প্রশান্তির ভেতরে :
    কারণ হাত হাত ভারী এবং কঠিন হলেও অদৃশ্যের কোমল হাত দ্বারা পরিচালিত এবং যে কাপ সে বহন করে তা তোমাদের ঠোঁট পুড়িয়ে দেয় যদিও তা কাদামাটির কারুকার্যখচিত, যে কাদামাটি কুমোর তার নিজের পবিত্র অশ্রুবিন্দুতে ভিজিয়েছে।

    .

    এক ব্যক্তি বলল, আমাদেরকে আত্মজ্ঞান সম্পর্কে বলুন।
    এবং উত্তরে তিনি বললেন :
    তোমাদের হৃদয় নীরবতার ভেতরে দিন ও রাত্রির গোপনীয়তাগুলি জানে।
    কিন্তু তোমাদের কান হৃদয় থেকে উদ্ভূত জ্ঞানের শব্দ শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত।
    তোমরা তা জানবে কথার ভেতরে যা তোমরা সবসময় চিন্তায় জেনেছ।
    তোমরা আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করবে তোমাদের স্বপ্নের নগ্ন দেহ।

    এবং এটা হচ্ছে কল্যাণ যা তোমাদের করা উচিত।
    তোমাদের আত্মার গোপন বসন্তের প্রয়োজন অবশ্যই বেড়ে ওঠা, সমুদ্রের কুলকুল ধ্বনির সঙ্গে দৌড়ানো এবং তোমাদের অনন্ত গভীরতার সম্পদ তোমাদের দৃষ্টির সম্মুখে প্রকাশিত হবে।
    কিন্তু সেখানে কোনো তুলাদণ্ড থাকতে দিও না তোমাদের অচেনা সম্পদ ওজন করতে এবং অন্বেষণ কোরো না তোমাদের জ্ঞানের গভীরতা ছড়ি অথবা সমুদ্রের গভীরতামাপক যন্ত্র দিয়ে।
    কারণ সত্তা হচ্ছে বন্ধনহীন ও পরিমাপহীন একটি সমুদ্র।
    তোমরা বো’লোনা, আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি,’ বরং বলো, আমি একটি সত্য খুঁজে পেয়েছি।’
    বো’লোনা, আমি আত্মার পথ খুঁজে পেয়েছি,’ বরং বলল, আমার পথের ওপর ভ্রমণরত আত্মার সাথে আমার দেখা হয়েছে।
    কারণ আত্মা সকল পথের ওপর হেঁটে বেড়ায়।
    আত্মা যেমন একটি নির্দিষ্ট সরলরেখায় চলাচল করে না তেমনি তা নলখাগড়ার মতো। বেড়েও ওঠে না।
    আত্মা নিজেকেই উন্মোচন করে অসংখ্য পাপড়িসমৃদ্ধ পদ্মফুলের মতো।

    .

    তারপর একজন শিক্ষক বলল, আমাদেরকে শিক্ষাদান সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি বললেন :
    কোনো মানুষই তোমাদেরকে কিছুমাত্র দেখতে পারে না, যা ইতিমধ্যেই তোমাদের জ্ঞানের ভোরবেলায় আধা-ঘুমন্ত অবস্থায় আছে।
    যে শিক্ষক মন্দিরের ছায়ায় তার শিষ্যদের ভেতরে হেঁটে বেড়ায়, সে দান করে না তার স্বাধীনতা বরং সে দান করে তার বিশ্বাস ও স্নেহশীলতা।
    বস্তুতপক্ষে সে যদি জ্ঞানী হয় তাহলে সে তোমাদের আমন্ত্রণ জানায় না তার স্বাধীনতার গৃহে প্রবেশ করতে, বরং তোমাদেরকে নেতৃত্ব দেয় তোমাদের মনের প্রবেশপথে ঢুকে যেতে।
    জ্যোতির্বিজ্ঞানী তোমাদেরকে মহাশূন্যবিষয়ক জ্ঞান সম্পর্কে বলতে পারে কিন্তু সে তার নিজের উপলব্ধি তোমাদেরকে দান করতে পারে না।
    সমগ্র মহাশূন্যে যে ছন্দ রয়েছে সংগীতজ্ঞ সেই ছন্দে গান গাইতে পারে কিন্তু সে তোমাদেরকে দান করতে পারে না সেই বাতাস যা ছন্দকে বন্দি করে রাখে, দান করতে পারে না সেই কণ্ঠস্বর যা প্রতিধ্বনিত হয়।
    এবং সংখ্যার বিজ্ঞান সম্পর্কে যে অভিজ্ঞ সে-ই বলতে পারে ওজন ও পরিমাপের এলাকা সম্পর্কে কিন্তু সে পারে না তোমাদেরকে যত্রতত্র পরিচালনা করতে।
    কারণ একজন মানুষের দূরদৃষ্টি অন্য মানুষের কাছে তার দূরদৃষ্টির পাখাগুলি ধার করে না।
    এমনকি তোমাদের প্রত্যেকেই ঈশ্বরের জ্ঞানের ভেতরে একাকী দাঁড়াও, সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে অবশ্যই একা হবে প্রত্যেকের ঈশ্বর-সম্পর্কিত জ্ঞান এবং মাটি সম্পর্কিত উপলব্ধির ভেতরে।

    .

    একজন যুবক বলল, আমাদেরকে বন্ধুত্ব সম্পর্ক বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমাদের বন্ধু হচ্ছে তোমাদের নিরুত্তর প্রয়োজনগুলি।
    বন্ধু হচ্ছে তোমাদের মাঠ যেখানে তোমরা ভালোবাসার সঙ্গে বীজ বপন করো এবং ফসল পাকাও ধন্যবাদের সঙ্গে।
    এবং সে হচ্ছে তোমাদের ভোজসভার টেবিল এবং তোমাদের চুলার পার্শ্বদেশ।
    কারণ তোমরা তোমাদের ক্ষুধা নিয়ে তার কাছে আসো এবং শান্তির জন্য তোমরা অন্বেষণ কর তাকে।

    যখন তোমাদের বন্ধু তার মন থেকে কথা বলে তখন তোমরা নিজের মনের ‘না’-কে ভয় পাও না, এমনকি ‘হ্যাঁ’-কেও আটকে রাখতে পারো না।
    এবং যখন সে নীরব থাকে তখনও তোমাদের হৃদয় বিরত হয় না তার হৃদয়ের কথা শোনা থেকে,
    কারণ কথাহীন বন্ধুত্বের ভেতরে সব চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা জন্মগ্রহণ করে এবং ভাগাভাগি হয় আনন্দের সঙ্গে যা করতালিযোগ্য নয়।
    যখন তোমরা তোমাদের বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন হও তখন তোমরা দুঃখ পাও না, কারণ যেজন্য তোমরা তাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো হয়তো তার অনুপস্থিতিতে তা অধিক স্পষ্ট, যেমন অধিক স্পষ্ট আরোহীর কাছে সমতলভূমির চেয়ে বিশাল পাহাড়।
    এবং বন্ধুত্বের ভেতরে কোনো উদ্দেশ্যকে প্রশ্রয় দিও না উদ্যমের গভীরতাকে রক্ষা করতে।
    কারণ, ভালোবাসাই যা কিছু অন্বেষণ করে কিন্তু এর রহস্য উন্মোচন করা ভালোবাসা নয়, তবে একটি জাল যা সম্মুখে জড়ো হয়
    এবং কেবলই অলাভজনক এই জালে ধরা পড়ে যাওয়া।

    এবং তোমাদের উত্তম অংশকে তৈরি হয় উঠতে দাও তোমাদের বন্ধুর জন্য।
    যদি নিশ্চিতই সে তোমাদের জোয়ারের ভাটা সম্পর্কে জানে তবে তাকে তোমাদের প্লাবন সম্পর্কেও জানতে দাও।
    কারণ, তোমাদের বন্ধু কি তা তোমাদের অন্বেষণ করে দেখা উচিত তাকে হত্যার সময়? বেঁচে থাকার সময়সহ সারাক্ষণ অন্বেষণ করো তাকে।
    কারণ তার এইসব তোমাদের চাহিদাকে পূর্ণ করে কিন্তু তোমাদের শূন্যতাকে ভরে তোলে না।
    এবং বন্ধুত্বের মধুরতার ভেতরে তাদেরকে হাসিতে পরিণত হতে দাও এবং ভাগাভাগি করতে দাও আনন্দ।
    কারণ ক্ষুদ্র জিনিসসমূহের শিশিরের ভেতরে হৃদয় অন্বেষণ করে এর সকাল এবং প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

    .

    তারপর একজন বিদ্বান বলল, কথোপকথন সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    যখন তোমরা কথা বলো তখন তোমরা চিন্তায় শান্তিতে পরিণত হওয়া থেকে বিরত থাকো এবং তোমরা যখন তোমাদের আত্মার চূড়ায় দীর্ঘ সময় বসবাসের জন্য যেতে পারো না তখন তোমরা ঠোঁটের ওপর জীবনধারণ করো এবং শব্দ হচ্ছে তখন একটি বিনোদন ও একটি অতিক্রান্ত সময়।
    এবং তোমাদের অধিকাংশ কথোপকথনের ভেতরে চিন্তা হচ্ছে অর্ধমৃত।
    কারণ চিন্তা হচ্ছে মহাশূন্যের একটি পাখি, যে কথার খাঁচায় বসবাস করে,
    বস্তুতপক্ষে সে তার পাখা খুলতে পারে কিন্তু উড়তে পারে না।

    তোমাদের মধ্যে সেখানে তারাই আছে যারা বাঁচালকে অন্বেষণ করে একা হওয়ার ভয়ে।
    একাকিত্বের নীরবতা তাদের চোখের সামনে প্রকাশ করে তাদের নগ্ন সত্তা এবং তারা পালিয়ে যায়।
    এবং সেখানে তারাই আছে যারা কথা বলে এবং পূর্বজ্ঞান অথবা কোনো জ্ঞান ছাড়াই প্রকাশ করে একটি সত্যকে যা তারা নিজেই বোঝে না।
    এবং সেখানে তারাই আছে যাদের সত্য থাকে তাদের ভেতরেই কিন্তু তারা তা প্রকাশ করতে পারে না কথায়।
    হৃদয়ের ভেতরে এই সবকিছুর মতো উদ্দীপনাও ছন্দময় নীরবতার ভেতরে বসবাস করে।

    যখন রাস্তার পাশে অথবা বাজার-এলাকায় বন্ধুর সঙ্গে তোমাদের দেখা হয় তখন তোমাদের ভেতরের উদ্দীপনাকে দাও তোমাদের ওষ্ঠগুলি সচল রাখতে এবং পরিচালনা করতে তোমাদের জিভ।
    তোমাদের কণ্ঠস্বরের ভেতরের কণ্ঠস্বরকে দাও তার কর্ণকুহরের কর্ণকুহরে কথা বলতে, কারণ তার আত্মা তোমাদের হৃদয়ের সত্যকে রক্ষা করবে যেভাবে পুরোনো মদের স্বাদ স্মরণে আসে।
    যখন রঙ বিস্মৃত হয় তখন আর কোনো জলযান নেই।

    .

    এবং একজন জ্যোতির্বিদ বলল, প্রভু সময় কী?
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমরা সময়কে পরিমাপ করো, যা পরিমাপহীন এবং পরিমাপযোগ্য নয়।
    তোমরা তোমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করো এবং উদ্দীপনার গতিপথ পরিচালনা করো সময় এবং ঋতু অনুসারে।
    তোমরা সময়ের স্রোত তৈরি করো সেই নদীতে যার তীরে তোমরা বসো এবং লক্ষ্য করো এর স্রোতপ্রবাহ।

    যদিও অনন্তকাল তোমাদের ভেতরে জীবনের সময়হীনতা সম্পর্কে সচেতন এবং জানে যে গতকাল হচ্ছে আজকের স্মৃতি এবং আগামীকাল হচ্ছে আজকের স্বপ্ন।
    এবং সেই স্মৃতি ও স্বপ্ন তোমাদের ভেতরে গান গায় ও গভীরভাবে চিন্তা করে যা এখনও সেই প্রথম মুহূর্তের বন্ধনের ভেতরে বসবাস করছে, যে মুহূর্ত মহাশূন্য জুড়ে নক্ষত্রপুঞ্জকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়।
    তোমাদের ভেতরে কে অনুভব করে না যে তার ভালোবাসার ক্ষমতা সীমাহীন?
    এবং সেই ভালোবাসা কারা অনুভব করে না, যদিও তা বন্ধনহীন অস্তিত্বের কেন্দ্রে পরিবেষ্টিত এবং তা চলাচল করছে, তবে ভালোবাসার চিন্তা থেকে ভালোবাসার চিন্তায় নয়, নয় ভালোবাসার চুক্তি থেকে অন্য ভালোবাসার চুক্তিতে?
    এবং সময় কি ভালোবাসার মতো অবিভক্ত এবং পদক্ষেপহীন নয়?

    কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের চিন্তায় নিশ্চিতভাবে সময়কে পরিমাপ করো ঋতুর ভেতরে তাহলে প্রত্যেক ঋতুকে অন্যসব ঋতুর দ্বারা বৃত্তাকারে পরিবেষ্টিত হতে দাও।
    এবং আজকের দিনকে আলিঙ্গন করতে দাও স্মৃতিচিহ্নসহ অতীতকে এবং প্রতীক্ষাসহ ভবিষ্যৎকে।

    .

    নগরের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বলল, আমাদেরকে ভালো ও মন্দ সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমাদের ভেতরে যা-কিছু ভালো সেসব আমি বলতে পারি কিন্তু মন্দ সম্পর্কে নয়।
    কারণ ভালো তার নিজস্ব ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দ্বার নির্যাতিত কিন্তু মন্দ কী?
    বস্তুতপক্ষে ভালো যখন ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে তখন সে অন্ধকার গুহায়ও খাবার অন্বেষণ করে এবং তৃষ্ণার্ত হলে পান করে বদ্ধ জলাভূমির পানি।

    তোমরা তখনই ভালো, যখন তোমরা নিজের সঙ্গে একজন।
    অবশ্য যখন তোমরা নিজের সঙ্গে একজন নও তখন তোমরা মন্দ নয়।
    কারণ একটি বিভাজিত গৃহ নয় চোরদের গোপন আস্তানা, এটি শুধুই একটি গৃহ যা বিভাজিত হয়েছে।
    এবং রাডারবিহীন একটি জাহাজ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে বিপজ্জনক দ্বীপসমুহের মাঝখানে এর তলদেশ ডুবে না-যাওয়া পর্যন্ত।
    তোমরা তখনই ভালো যখন তোমরা প্রাণপণ চেষ্টা করা নিজেদেরকে দান করতে।
    যদিও তোমরা মন্দ নয়, যখন নিজের জন্য তোমরা প্রাপ্তি অন্বেষণ করো।
    কারণ, যখন তোমরা প্রাপ্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করো তখন একটি শিকড় মাটির সঙ্গে সেঁটে থাকে এবং মাটির স্তন্য চুষে খায়।
    নিশ্চিতভাবে ফল শিকড়কে বলতে পারে না, আমার মতো হও, পেকে ওঠো, তারপর পরিপূর্ণ হও এবং চিরকাল হও অতিপ্রাচুর্যের কল্যাণদানকারী।
    কারণ ফলের কাছে দান হচ্ছে একট চাহিদা যেমন গ্রহণ হচ্ছে একটি চাহিদা শিকড়ের কাছে।

    তোমরা তখনই ভালো যখন তোমরা পরিপূর্ণভাবে তোমাদের বাকশক্তির ভেতরে বিনিদ্র। যদিও তোমরা মন্দ নয় যখন তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো এবং তোমাদের জিভ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই শৃঙ্খলাহীনভাবে নড়াচড়া করে।
    এমনকি হোঁচট খাওয়া বাকশক্তি অধিকতর শক্তিশালী করতে পারে একটি দুর্বল জিভকে।

    তোমরা তখনই ভালো যখন তোমাদের লক্ষ্যের দিকে তোমরা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় পদক্ষেপে হেঁটে যাও।
    যদিও তোমরা মন্দ নয় যখন তোমরা যাও খুঁড়িয়ে চলা মানুষের দিকে।
    এমনকি তারা, যারা খুঁড়িয়ে চলে তবে পেছনে যায় না।
    কিন্তু তোমরা যারা শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন তারা লক্ষ্য করো, তোমরা কোনো পঙ্গুর সামনে খোঁড়াও না এবং বিশ্বাস করো এটা দয়াপরায়ণতা।
    তোমরা বিভিন্নভাবে ভাল এবং তোমরা মন্দ নও যখন তোমরা ভালো কিছু করো না।
    তোমরা কেবলই অলস এবং ইতস্তত ঘুরে বেড়াও।
    করুণা করো সেই অবস্থাকে, যে অবস্থা কচ্ছপকে দ্রুতগামিতা শেখাতে পারে না।

    তোমাদের বিশাল সত্তার জন্য তোমাদের সদ্গুণ তোমাদের আকুল আকাক্ষার ভেতরে শুয়ে আছে :
    এবং সেই প্রতীক্ষা আছে তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরে।
    কিন্তু তোমাদের কারও কারও ভেতরে সেই আকাক্ষা হচ্ছে একই প্রবল জলধারা যা প্রবল ক্ষমতার সাথে ছুটছে সমুদ্রের দিকে, আর বহন করছে পাহাড়ের পার্শ্বদেশের গোপনীয়তা এবং বনভূমির গানগুলি।
    কিন্তু অন্যদের ভেতরে এটি একটি বৈচিত্র্যহীন স্রোত যা অন্য দুটি স্রোতের মধ্যবর্তী স্থানে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তীরে পৌঁছানোর আগে তা বাঁক নেয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে।
    কিন্তু যাদের আকাঙ্ক্ষা প্রবল তাদেরকে বলতে দিও না যাদের আকাঙ্ক্ষা কম তাদের কাছে, ‘কি কারণে তোমরা ধীরগামী এবং ইতস্তত ঘুরে বেড়াও?’
    প্রকৃতঅর্থেই ‘ভালো’ কোনো নগ্ন মানুষকে জিজ্ঞাসা করে না তোমার পোশাক কোথায়?
    জিজ্ঞাসা করে না কোনো গৃহহীনকে, ‘তোমার গৃহের ভাগ্যে কী ঘটেছে?’

    .

    তারপর একজন যাজিকা বলল, আমাদেরকে প্রার্থনা সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    তোমরা প্রার্থনা করো তোমাদের যন্ত্রণা এবং তোমাদের চাহিদার ভেতরে, তোমরা আরও প্রার্থনা করতে পারো তোমাদের আনন্দের পরিপূর্ণতার ভেতরে এবং তোমাদের অতিপ্রাচুর্যের দিনগুলিতে।

    কারণ প্রার্থনা কি কেবলই জীবন্ত ইথারের ভেতরে তোমাদের সত্তার বিস্তার?
    এবং যদি এটা হয় তোমাদের আয়েশের জন্য মহাশূন্যে তোমাদের অন্ধকারকে ঢেলে দেওয়া, তাহলে তা তোমাদের আনন্দের জন্যও তোমাদের হৃদয়ের ভোরবেলাকে তোমাদের সামনে ঢেলে দেয়।
    এবং যদি তোমরা না পারো তাহলে কেঁদে ওঠো যখন তোমাদের আত্মা তোমাদেরকে প্রার্থনা করতে ডেকে পাঠায়, যদিও তোমরা কাঁদছ তবু তার উচিত তোমাদেরকে বারবার তাড়িত করা যতক্ষণ তোমরা না হাসবে।
    যখন তোমরা প্রার্থনা করো তখন তোমরা বেড়ে ওঠো বাতাসের ভেতরে তাদের সঙ্গে মিলিত হতে যারা সেই বিশেষ সময়ে প্রার্থনা করছে এবং প্রার্থনার ভেতরে তোমাদেরকে যে রক্ষা করে তার সঙ্গে দেখা নাও হতে পারে।
    সুতরাং তোমাদের সেই মন্দির পরিদর্শনকে অদৃশ্যে পরিণত হতে দাও কোনোকিছু না থাকার জন্য, তবে তা যেন হয় পরমানন্দ এবং সুমধুর আলাপন।
    কারণ যা তোমার গ্রহণ করতে পারবে না তা জিজ্ঞাসা করার চেয়ে অন্যকোনো উদ্দেশ্যে তোমাদের মন্দিরে প্রবেশ করা উচিত নয়,
    এবং তোমরা উত্তোলিত হবে না যদি তোমরা বিনয়ের সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করো।
    এমনকি তোমরা কিছুই শুনতে পাবে না যদি তোমরা অন্যের ভালোর জন্য মন্দিরে প্রবেশ করো ভিক্ষা করতে।
    এটাই যথেষ্ট যে তোমরা মন্দিরে প্রবেশ করো অদৃশ্য হয়ে।

    কথার ভিতরে কীভাবে প্রার্থনা করতে হয় তা আমি শিক্ষা দিতে পারি না।
    ঈশ্বর তোমাদের কথা শুনতে পান না কিন্তু তোমাদেরকে রক্ষা করেন যখন তার কথা তিনি উচ্চারণ করেন তোমাদের ঠোঁটে।
    আমি তোমাদেরকে পাহাড়, বনভূমি ও সমুদ্রের প্রার্থনা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারি না।
    কারণ তোমাদের ভেতরে যারা পাহাড়, সমুদ্র ও বনভূমিতে জন্মেছে তারা তাদের প্রার্থনাকে খুঁজে নিতে পারে তোমাদের হৃদয়ে।
    এবং তোমরা যদি রাত্রির নিস্তব্ধতার ভেতরে এসব শুনতে পাও তাহলে শুনতে পাবে তারা নিরবতার ভেতরেও কথা বলছে :
    ‘আমাদের ঈশ্বর যিনি আমাদের পাখাযুক্ত আত্মা সৃজন করেন এটা হচ্ছে তাঁর ইচ্ছা আমাদের ভেতরে, যা ইচ্ছাকৃত।’
    ‘এটা হচ্ছে তাঁর আকক্ষা আমাদের ভেতরে যা আকাক্ষিত।’
    ‘এটা হচ্ছে তাঁর তীব্র বাসনা আমাদের ভেতরে যা রাত্রিতে পরিণত হয়, যে রাত্রি ও দিনের ভেতরে মিহি রাত, শুধু মিহি রাত।’
    ‘আমরা আপনাকে যা ইচ্ছা তাই জিজ্ঞাসা করতে পারি না, কারণ আমাদের চাহিদা সম্পর্কে আপনি সবচেয়ে বেশি জানেন, আমাদের ভেতরে চাহিদাগুলি জন্ম নেওয়ার আগেই।’
    ‘আমাদের চাহিদা আপনি সৃজন করেন এবং আমাদের যা দান করা হয় তার ভেতরে আপনিই অধিক, আপনিই আমাদের প্রত্যেকের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা।’

    .

    তারপর এক সন্ন্যাসী যে-বছরে একবার এই নগর পরিদর্শন করে সে সামনে এগিয়ে এল এবং বলল, আমাদের আনন্দ সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    আনন্দ হচ্ছে একটি স্বাধীনতা-সংগীত, কিন্তু তা স্বাধীনতা নয়। এটা হচ্ছে তোমাদের। আকাঙ্ক্ষাগুলির ফুটে ওঠা, কিন্তু এগুলি আকাঙ্ক্ষার ফল নয়।
    এটি একটি গভীরতা যা উঁচুতে উঠতে আহ্বান জানায়, কিন্তু এটা গভীরও নয় উঁচুও নয়।
    এটা হচ্ছে খাঁচাবদ্ধ আকর্ষণীয় পাখা, কিন্তু এই পাখা মহাশূন্য পরিবেষ্টন করে না। হ্যাঁ, সত্যের ভেতরে আনন্দ হচ্ছে একটি স্বাধীনতা-সংগীত।
    এবং আমি আনন্দিত হয়েছি যে তোমরা এই গান গাও হৃদয়ের পরিপূর্ণতাসহ, যদিও এই গানের ভেতরে তোমাদের হারিয়ে যাওয়া হৃদয় আমি খুঁজে পাব না।

    তোমাদের কিছু কিছু যুবক আনন্দ অন্বেষণ করে যেন এটাই ছিল সবকিছু এবং তারা প্রত্যেকেই রায়প্রাপ্ত এবং তিরস্কৃত।
    আমি তাদের বিচার করব না আবার তিরস্কারও করব না, আমি তাদেরকে খুঁজে নেব।
    কারণ তারা আনন্দ অন্বেষণ করবে তবে শুধুই আনন্দ নয়। আনন্দের সাত বোন এবং সবচেয়ে ছোটটি আনন্দের চেয়েও অধিক সুন্দরী।
    তোমরা কি সেই মানুষের কথা শোনো নাই যে মাটি খুঁড়েছিল শিকড়ের জন্য এবং পেয়েছিল একটি ধনভাণ্ডার?
    এবং তোমাদের কোনো-কোনো বায়োজ্যেষ্ঠ অনুতাপের সঙ্গে আনন্দকে স্মরণ করে। মাতাল অবস্থায় ভুল করার মতো।
    কিন্তু অনুতাপ হচ্ছে মনের একটি মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা এবং এটা শাস্তিযোগ্য নয়।
    তাদের উচিত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের আনন্দকে স্মরণ করা, যেমন করে তারা গ্রীষ্মকালে ফসল কাটার সময়।
    এটা যদি তাদেরকে দুঃখ করতে আয়েশ দেয় তাহলে তাদেরকে আয়েশি হতে দাও।

    এবং তোমাদের ভেতরে সেখানে তারাই আছে যারা অন্বেষণের জন্য যুবক নয়, আবার বৃদ্ধও নয় স্মৃতিচারণের জন্য।
    এবং তাদের অন্বেষণ ও স্মৃতিচারণের ভয়ের ভেতরে তারা সমস্ত আনন্দ পরিহার করে, এজন্য তারা উদ্দীপনাকে উপেক্ষা করে অথবা লঙ্ঘন করে এর নিয়ম।
    এমনকি তাদের অগ্রবর্তী হওয়ার ভেতরেই রয়েছে তাদের আনন্দ।
    এবং তারাও তা খুঁজে পায় এবং সংরক্ষণ করে যদিও তারা কম্পিত হাতে মাটি খনন করে শিকড়ের জন্য।
    কিন্তু আমাকে বলো কে সেই ব্যক্তি যে পারে উদ্দীপনাকে মর্মাহত করতে?
    নাইটিংগেল* কি রাত্রির প্রশান্তিকে ভেঙে চুরমার করে দেবে অথবা জোনাকি অপমান করবে নক্ষত্রকে?

    [* গায়ক পাখি। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গান গায়।]

    এবং তোমাদের আগুনের শিখা অথবা এর ধোয়া কি বোঝা হবে বাতাসের ওপর?
    তোমরা কি ভাবো উদ্দীপনা হচ্ছে একটি স্রোতহীন জলাশয় যেখানে তোমাদের ছড়ি নিয়ে তোমরা অসুবিধায় পড়তে পারো? প্রায় সময়ই আনন্দের ভেতরে তোমরা নিজেদেরকে অগ্রাহ্য করো কিন্তু আকাঙ্ক্ষাগুলিকে সংরক্ষণ করো তোমাদের সত্তার দীর্ঘ অবকাশের ভেতরে।
    কে জানে যে, আজ যা অসম্পন্ন মনে হয়, তা অপেক্ষা করে আগামীকালের জন্য?
    এমনকি তোমাদের শরীর জানে তার উত্তরাধিকার ও এর ন্যায়সম্মত চাহিদা এবং সে প্রতারিত হবে না।
    এবং তোমাদের শরীর হল তোমাদের আত্মার বাদ্যযন্ত্র এবং এই বাদ্যযন্ত্র থেকে সুমধুর। সংগীত অথবা দ্বিধান্বিত ধ্বনিগুচ্ছকে সামনে নিয়ে আসাই হল তোমাদের কাজ।

    এবং এখন তোমরা মন থেকে জিজ্ঞাসা করো, ‘কীভাবে আমরা পার্থক্য করব আনন্দের ভেতরে কী ভাল এবং কী ভালো নয়?’
    তোমরা তোমাদের বাগান ও শস্যক্ষেতে যাও এবং তোমরা শিখবে যে, এটা হচ্ছে মৌমাছিদের ফুলের মধু সংগ্রহ করার আনন্দ,
    কিন্তু এটা ফুলেরও আনন্দ মৌমাছির জন্য ফুলে মধু উৎপন্ন করা।
    কারণ মৌমাছির কাছে একটি ফুল হচ্ছে জীবনের ঝর্ণা,
    এবং ফুলের কাছে একটি মৌমাছি হচ্ছে ভালোবাসার একজন বার্তাবহনকারী,
    এবং ফুল ও মৌমাছি উভয়ের কাছে আনন্দের দান ও গ্রহণ হচ্ছে একটি চাহিদা এবং একটি পরমানন্দ।

    হে অর্ষালিজবাসী, তোমাদের আনন্দের ভেতরে তোমরা পুষ্পদল ও মৌমাছির মতো হয়ে ওঠো।

    .

    একজন কবি বলল, আমাদেরকে সৌন্দর্য সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন :
    কোথায় এবং কীভাবে তোমরা সৌন্দর্য অন্বেষণ করবে যদি সৌন্দর্য নিজেই না হয় তোমাদের পথ এবং পথপ্রদর্শক?
    এবং কীভাবে তোমরা তার সম্পর্কে বলবে তাকে তোমাদের কথার বয়নকারী হওয়া ছাড়া?

    অত্যাচারিত ও আহতেরা বলে, ‘সৌন্দর্য হচ্ছে দয়ালু এবং বিনয়ী।
    আধা-লাজুক যুবতী মাতার মতো আপন মহিমায় সে আমাদের মাঝে হেঁটে বেড়ায়।’
    এবং আবেগপ্রবণেরা বলে, ‘না, সৌন্দর্য হচ্ছে প্রবল ক্ষমতা ও আতঙ্কের বস্তু।
    প্রবল ঝড়ের মতো সে নাড়া দেয় আমাদের তলার মাটি ও ওপরের আকাশকে।’

    ক্লান্ত ও পরিশ্রান্তেরা বলে, ‘সৌন্দর্য হচ্ছে একটি কোমল ফিসফিসানি এবং সে আমাদের উদ্দীপনার ভেতরে কথা বলে।
    তার কণ্ঠস্বর আমাদের নীরবতা উৎপাদন করে, দুর্বল আলোর মতো যা কাঁপতে থাকে ছায়ার ভয়ে।’
    কিন্তু ক্লান্তিহীনেরা বলে, ‘আমরা পাহাড়ের ভেতরে সৌন্দর্যের চিৎকার শুনেছি এবং তার কান্নার সঙ্গে এসেছিল খুরের শব্দ, পাখার আঘাত এবং সিংহের গর্জন।’

    রাতে নগরের পাহারাদার বলে, ‘সৌন্দর্য ভোরবেলার সঙ্গে উদিত হবে পূবদিকে থেকে।’
    এবং মধ্যদুপুরে কঠোর পরিশ্রমী ও পথিকেরা বলে, ‘আমরা তাকে দেখেছি সূর্যাস্তের জানালা থেকে নেমে এসে মাটিতে হেলান দিয়ে আছে।‘’

    শীতকালে প্রচুর তুষারপাতের ফলে ভ্রমণে অক্ষম ব্যক্তিরা বলে, ‘বসন্তের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্য আসবেই এবং লাফিয়ে পড়বে পাহাড়ের ওপরে।‘’

    এবং গ্রীষ্মের দাবদাহের ভেতরে যারা ফসল কাটে তারা বলে, ‘শরৎকালে গাছের পাতার সঙ্গে তাকে আমরা নাচতে দেখেছি এবং তখন আমরা তার চুলে বরফের এটা স্রোত। দেখতে পেয়েছিলাম।’

    সৌন্দর্য সম্পর্কে এই সবকিছুই তোমরা বলেছ, যদিও সত্যের ভেতরে তোমরা তার সম্পর্কে বলো নাই যতটা বলেছ অতৃপ্ত বাসনা সম্পর্কে।

    এবং সৌন্দর্য একটি চাহিদা নয়, সৌন্দর্য একটি পরমানন্দ।
    এটি নয় মুখের তৃষ্ণা, নয় সামনে প্রসারিত একটি শূন্য হাত,
    বরং সৌন্দর্য হচ্ছে একটি উত্তপ্ত হৃদয় ও একটি মন্ত্রমুগ্ধ আত্মা।
    এটা নয় সেই প্রতিমূর্তি যা তোমরা দেখে থাকো, নয় এটা সেই সংগীত যা তোমরা শ্রবণ করো,
    বরং এটা এমন একটা প্রতিচ্ছবি যা তোমরা দ্যাখো, যদিও তোমরা বন্ধ করে রাখো তোমাদের চোখ এবং এমন একটি সংগীত যা তোমরা শ্রবণ করো, যদিও তোমরা বন্ধ করে রাখো তোমাদের কান।
    এটা নয় কোনো গুপ্তপরিখা যার ভেতরে হলরেখার গর্জন,
    নয় এটা একটা পাখা যা নখরযুক্ত পায়ের সঙ্গে সংযুক্ত।
    বরং সৌন্দর্য হচ্ছে একটি বাগান যা চিরকালের জন্য ফুটে আছে এবং যেখানে একদল দেবদূত চিরকালের জন্য উড়ে বেড়ায়।

    হে অর্ফালিজবাসী, সৌন্দর্য হচ্ছে জীবন, যখন জীবন তার পবিত্র মুখমণ্ডল অনাবৃত করে।
    কিন্তু তোমরাই জীবন এবং তোমরাই হলে অবগুণ্ঠন।
    সৌন্দর্য হচ্ছে অনন্তকাল, দর্পণের ভেতরে যা স্থিরদৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে।
    কিন্তু তোমরাই হলে অনন্তকাল এবং তোমরাই হলে দর্পণ।

    .

    এবং একজন বৃদ্ধ যাজক বলল, আমাদেরকে ধর্ম সম্পর্কে বলুন।
    এবং তিনি বললেন :
    আমি এ সম্পর্কে কিছুমাত্র বলেছি কী?
    ধর্ম কি নয় সমস্ত কর্মকাণ্ড এবং সবকিছুর প্রতিফলন এবং যা প্রতিফলনও নয় আবার কর্মকাণ্ডও নয় কিন্তু আত্মার ভেতরে চিরকালীন একটি বিস্ময় এবং একটি চমক উদ্ভূত হয়, এমনকি যখন হাতগুলি টুকরো করে ফেলে পাথর অথবা যত্ন নেয় তাঁতের?
    কে পারে তার কাজ থেকে বিশ্বাসকে আলাদা করতে অথবা পেশা থেকে বিশ্বাসকে?
    কে তার নিজের সামনে সময়কে এই বলে বিস্তৃত করতে পারে, এটা হচ্ছে ঈশ্বরের জন্য এবং এটা আমার জন্য, এটা আমার আত্মার জন্য এবং আমার শরীরের জন্য অন্যটি?
    তোমাদের সময়গুলি হচ্ছে পাখাবিশিষ্ট যা মহাশূন্যের ভেতরে সত্তা থেকে সত্তায় আঘাত করে থাকে। সে পরিধান করে তার নৈতিকতা যার উত্তম পোশাক ছিল নগ্নতা, যা অধিকতর ভালো।
    বাতাস এবং সূর্য তার চামড়ায় কোনো গর্তই তৈরি করবে না।
    এবং যে নিজের চরিত্র নির্ধারণ করে নৈতিকতা দিয়ে আবার সে-ই তার গায়ক পাখিকে বন্দি করে রাখে খাঁচার ভেতরে।
    সবচেয়ে স্বাধীন সংগীত নদীর মোহনার স্রোত এবং তারের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে না।
    এবং সে যার উপসানা করে সে হচ্ছে একটি জানালা যা খোলা যায় আবার বন্ধও হয়, যদিও তা পরিদর্শন করেনি তার আত্মার গৃহ যার জানালাগুলি ভোরবেলা থেকে ভোরবেলায় বিস্তৃত।

    তোমাদের প্রাত্যহিক জীবন হচ্ছে তোমাদের মন্দির এবং তোমাদের ধর্ম।
    যখন তোমরা এর ভেতরে প্রবেশ করে তখন তোমাদের সবকিছুই তোমরা সঙ্গে নাও।
    তোমরা সঙ্গে নাও লাঙল, কামারের হাপর, হাতুড়ি এবং বীণা। এসব জিনিস তোমরা সঙ্গে নাও তোমাদের প্রয়োজনকে অলংকৃত করতে অথবা আনন্দের জন্য।
    কারণ দিবাস্বপ্নের ভেতরে তোমরা বেড়ে উঠতে পারো না তোমাদের অর্জনের ওপরে, নামতে পারো না তোমাদের ব্যর্থতার নিচে।
    এবং তোমরা সব মানুষকে তোমাদের সঙ্গে নাও :
    কারণ, ভক্তির ভেতরে তোমরা তার প্রত্যাশার চেয়েও ওপরে উড়াল দিতে পারো না, পারো না বিনয়ের সঙ্গে নিচে নামতে তাদের হতাশার চেয়েও।

    এবং যদি তোমরা ঈশ্বরকে জেনে থাকো তাহলে কখনও ধাঁধার সমাধানকারী হতে যেয়ো না বরং তোমরা চারপাশের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করো এবং তোমরা দেখবে তিনি তোমাদের শিশুর সঙ্গে খেলা করছেন।
    এবং মহাশূন্যের দিকে তাকাও, তোমরা দেখতে পাবে তিনি মেঘের ভেতরে হাঁটছেন, বজ্রের ভেতরে তাঁর বাহুদুটি প্রসারিত এবং তিনি অবতরণ করছেন বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে।
    তোমরা দেখতে পাবে তিনি ফুলের ভেতরে হাসছেন, তারপর বেড়ে উঠছেন এবং তাঁর হাত বৃক্ষের পত্রপল্লবের ভেতরে দুলছে।

    .

    তারপর আলমিতরা বলল, আমরা এখন মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি।
    এবং তিনি বললেন :
    তোমরা মৃত্যুর গোপনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাও।
    কিন্তু কীভাবে তোমরা তাকে খুঁজে পাবে যদি জীবনের অন্তঃস্থলে তোমরা তাকে অন্বেষণ
    না করো।
    যে প্যাঁচার রাতজাগা চোখ দিনের আলাতে অন্ধ সে উন্মোচন করতে পারে না আলোর রহস্য।
    যদি তোমরা প্রকৃতঅর্থেই মৃত্যুর উদ্দীপনা সম্পর্কে জানতে চাও তাহলে তোমাদের হৃদয়কে উন্মোচিত করো এবং প্রসারিত করো তাকে জীবনের শরীরের দিকে।
    কারণ জীবন এবং মৃত্যু হচ্ছে একজন, যেমন নদী ও সমুদ্র হচ্ছে একজন।

    ঊর্ধ্বলোক সম্পর্কে তোমাদের শব্দহীন জ্ঞান তোমাদের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার গভীরতার ভেতরে শুয়ে আছে।
    এবং বরফের নিচে পড়ে থাকা বীজের স্বপ্ন দেখার মতো তোমাদের হৃদয়ও বসন্তের স্বপ্ন দেখে।
    স্বপ্নগুলিকে বিশ্বাস করো, কারণ তাদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে অনন্তকালের দরজা।
    তোমাদের মৃত্যুভয় হচ্ছে মেষপালকের ভীতি, যখন সে রাজার সম্মুখে দাঁড়ায়, যে রাজা শ্রদ্ধার সঙ্গে তার মাথায় হাত রাখে।
    মেষপালক কি আনন্দে পরিপূর্ণ নয় তার ভীতির অন্তরালে, যা সে পরিধান করবে তা হচ্ছে রাজার চিহ্ন?
    সে কি তার ভীতি সম্পর্কে অধিক মনোযোগী নয়?

    কারণ এটা কি, যা মরে যাবার জন্য নগ্ন হয়ে বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সূর্যালোকে গলে যায়?
    এবং এটা কি, যা শ্বাসপ্রশ্বাস থামিয়ে দেয় কিন্তু তার ক্লান্তিহীন স্রোত থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস মুক্তিলাভ করে, যা বেড়ে উঠতে পারে, বিস্তৃত হতে পারে এবং অন্বেষণ করতে পারে। ভারমুক্ত ঈশ্বরকে?

    শুধুমাত্র তোমরা যখন নীরবতার নদী থেকে পান করো তখন প্রকৃতঅর্থেই তোমরা গান গাইবে।
    এবং যখন তোমরা পাহাড়চূড়ায় পৌঁছেছ তখন তোমরা অবশ্যই পাহাড়ে চড়তে শুরু করবে।
    এবং যখন মাটি দাবি করবে তোমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তখন তোমরা সত্যিই নাচতে থাকবে।

    .

    এবং এটা ছিল সন্ধ্যা।
    এবং ভবিষ্যদর্শী আলমিতরা বলল,
    মহিমান্বিত হোক এই দিন ও স্থান এবং মহিমান্বিত হোক আপনার মূল বক্তব্য যা আপনি বলেছেন।
    এবং তিনি উত্তরে বললেন, এটা কি আমি ছিলাম যে এইসব বলেছে?
    আমি কি একজন শ্রোতাও নয়?

    তারপর তিনি মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন
    এবং উপস্থিত প্রত্যেকেই তাকে অনুসরণ করল।
    তিনি তার জাহাজে পৌঁছে ডেকের ওপর দাঁড়ালেন।
    জনতা আবার তার মুখোমুখি হল এবং তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন :
    হে অর্ষালিজবাসী, বাতাস আমাকে আহ্বান জানায় তোমাদেরকে পরিত্যাগ করতে। যদিও আমি বাতাসের চেয়ে কম গতিসম্পন্ন তবুও আমাকে যেতে হবে।
    আমরা যারা পথভ্রষ্ট, চিরকাল অনুসন্ধান করছি নিঃসঙ্গদের পথ, আমাদের কোনো দিন শুরু হয়নি সেখান থেকে যেখানে আমরা অন্য দিন শেষ করেছি এবং সেখানে কোনো সূর্যোদয়ই আমাদেরকে খুঁজে পায় না যেখানে সূর্যাস্ত আমাদেরকে পরিত্যাগ করে যায়।
    এমনকি যখন পৃথিবী ঘুমায় তখন আমরা ভ্রমণ করি।
    আমরা হলাম মাটি আঁকড়ে ধরে রাখা বৃক্ষের বীজ এবং এই বীজ রয়েছে আমাদের হৃদয়ের পকৃতা ও পরিপূর্ণতার ভেতরে যা আমরা দান করেছি বাতাসকে এবং তারা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

    খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল আমার দিনগুলি তোমাদের মাঝে এবং আরও সংক্ষিপ্ত ছিল যা কিছু আমি বলেছি।
    কিন্তু যদি আমার কণ্ঠস্বর তোমাদের কানে অস্পষ্ট হয়ে আসে এবং আমার ভালোবাসা তোমাদের স্মৃতিতে অদৃশ্য হয়ে যায়,
    তখন আমি আবার আসব।
    এবং অধিকতর সমৃদ্ধ হৃদয় ও ওষ্ঠ নিয়ে আমি যা বলব সেগুলিই অধিক উৎপন্ন হবে আত্মায়।
    হ্যাঁ, আমি অবশ্যই জোয়ারের সঙ্গে ফিরে আসব, যদিও মৃত্যু আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারে এবং ঢেকে রাখতে পারে বিশাল নৈঃশব্দ, তবুও আমি অনুসন্ধান করব তোমাদের উপলব্ধিকে।
    যা-কিছু বলেছি আমি তা যদি সত্য মনে হয়, তবে সেই সত্য সুস্পষ্ট কণ্ঠে নিজেকে প্রকাশ করবে এবং কথার ভেতরে তা হবে তোমাদের চিন্তার নিকটাত্মীয়।

    হে অর্ফালিজবাসী, আমি বাতাসের সঙ্গে যাচ্ছি কিন্তু শূন্যতার ভেতরে নেমে যাচ্ছি না এবং যদি আজকের দিন তোমাদের প্রয়োজন ও আমার ভালোবাসার পরিপূর্ণতার জন্য না হয়ে থাকে তাহলে তাকে প্রতিজ্ঞায় পরিণত হতে দাও অন্যদিন পর্যন্ত।
    মানুষের প্রয়োজন বদলায় কিন্তু তার ভালোবাসা নয়, নয় তার আকাঙ্ক্ষাগুলি যা তার ভালোবাসা এবং ভালোবাসার উচিত তার প্রয়োজনকে পরিতুষ্ট করা।
    অতএব, জেনে রাখো, অধিকতর বিশাল নৈঃশব্দের ভেতর থেকে ফিরে আসব আমি।
    যে কুয়াশা ভোরবেলা বাতাসে ভেসে যায়, ফেলে যায় মাঠে মাঠে অজস্র শিশির, যা বেড়ে উঠবে ও জড়ো হবে মেঘের ভেতরে,
    এবং তারপর ঝরে পড়বে বৃষ্টির সাথে ফোঁটায় ফোঁটায়।
    এবং আমিও এই কুয়াশার মতো।
    রাত্রির নীরবতার ভেতরে তোমাদের পথে পথে হেঁটেছি আমি
    এবং আমার আত্মা প্রবেশ করেছে তোমাদের গৃহে,
    এবং তোমাদের হৃদস্পন্দন ছিল আমার হৃদয়ে, তোমাদের নিঃশ্বাস পড়েছিল আমার মুখের ওপরে এবং আমি তোমাদের প্রত্যেককে জানলাম।
    হ্যাঁ, আমি জানলাম তোমাদের আনন্দ ও বেদনা এবং তোমাদের ঘুমের ভেতরে তোমাদের স্বপ্নগুলি ছিল আমার স্বপ্ন এবং প্রায় সময়ই আমি ছিলাম তোমাদের ভেতরে একটি পাহাড়ি হ্রদ।
    আমি প্রতিবিম্বিত করব তোমাদের ভেতরের পাহাড়চূড়া
    এবং বাঁকানো ঢালগুলি, এমনকি তোমাদের চিন্তা ও আকাক্ষার অপসৃয়মাণ পাখির ঝাঁককেও।
    এবং আমার নীরবতার ভেতরে স্রোতের সঙ্গে আসে তোমাদের শিশুর হাসি এবং নদীতে ভেসে ভেসে আসে তোমাদের যুবকদের আকুল আকাঙ্ক্ষাগুলি।
    এবং যখন তারা আমার গভীরে পৌঁছায় তখন নদী এবং স্রোত কেউই থামায় না তাদের গান।
    কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা হাসির চেয়ে অধিকতর মধুর
    এবং আমার ভেতরে যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম হল তার চেয়েও বিশাল।
    তোমাদের ভেতরে এই সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা ছিল,
    সেই বিশাল লোকটি যার ভেতরে তোমরা প্রত্যেকেই আছ শুধু তোমাদের কোষ এবং পেশিগুলি ছাড়া,
    এবং শব্দহীন স্পন্দন ছাড়াই সে গায় তোমাদের সবগুলি গান।
    এই সবকিছুই আছে সেই বিশাল লোকটির ভেতরে, তাই তোমরাও বিশাল।
    এবং তাকে দেখার সময় আমি তোমাদের দেখেছিলাম
    এবং ভালবেসেছিলাম।
    কারণ সেই সীমা কি পৃথিবীতে নেই যতদূর ভালোবাসা যেতে পারে?
    কোন্ দূরদৃষ্টি, কোন্ প্রত্যাশা এবং কোন্ দুঃসাহস উড়াল দিতে পারে আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে?
    তোমাদের ভেতরে সেই বিশাল মানুষটি হল ফুটন্ত আপেলে ঢেকে থাকা দৈত্যাকৃতির ওকগাছের মতো।
    সে তোমাদেরকে বেঁধে ফেলতে পারে মাটির সঙ্গে, তার সুগন্ধ তোমাদেরকে উত্তোলন করতে পারে মহাশূন্যের ভেতরে এবং তার স্থায়িত্বের ভেতরে তোমারা হলে মৃত্যুহীন। তোমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, শিকলের মতো তোমাদের দুর্বলতম সংযুক্তির চেয়েও তোমরা দুর্বল।
    এটা হল অর্ধসত্য। তোমরা হলে তোমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংযুক্তির মতোই শক্তিশালী।
    তোমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মকাণ্ড দিয়ে তোমাদের পরিমাপ করার অর্থই হল দুর্বল ফেনার সাহায্যে সমুদ্রের ক্ষমতাকে গণনা করা।
    তোমাদের ব্যর্থতা দিয়ে তোমাদেরকে বিচার করার অর্থই হল ঋতুগুলিকে নিন্দা করা তাদের অস্থিরতার জন্য।

    হ্যাঁ, তোমরা হলে সমুদ্রের মতো এবং সমুদ্রের তলস্পর্শী বিশাল জাহাজ তোমাদের তীরে জোয়ারের প্রতীক্ষায় আছে, যদিও তোমরা সমুদ্রের মতো তোমাদের জোয়ারকে ত্বরান্বিত করতে পারো না।
    এবং ঋতুগুলির মতো তোমরাও এক-একটি ঋতু।
    যদিও তোমাদের শীতকালে তোমরা বসন্তকে নিজের বলে স্বীকার করো না।
    যদিও বসন্ত আবার তোমাদের ভেতরে এসে বসে, হাসে তার তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতরে এবং সে ব্যথিত হয় না।
    ভেবো না আমি এইসব বলেছি এজন্য যে তোমরা একে অন্যকে বলতে পারো, ‘তিনি আমাদের প্রশংসা করলেন এবং আমাদের ভেতরে শুধু ভালোটাই দেখতে পেলেন।’
    আমি আমার ভাষায় তোমাদেরকে শুধুই সেইসব বলেছি যা তোমরা জেনেছ চিন্তার ভেতরে।
    এবং কথার জ্ঞান কি কেবলি কথাহীন জ্ঞানের ছায়া?
    তোমাদের চিন্তা এবং আমার কথারা হল সিলমোহরকৃত স্মৃতি থেকে আসা ঢেউ যা নথিভুক্ত করে আমাদের গতকালকে এবং আমাদের পুরোনো দিনগুলিকে, যখন পৃথিবী জানত না আমাদেরকে, জানত না নিজেকে এবং রাত্রিগুলিকে-দ্বিধায় বিভ্রান্ত ছিল পৃথিবী যখন।

    জ্ঞানী ব্যক্তিরা এসেছেন তাদের বিচক্ষণতা তোমাদেরকে দান করতে, আর আমি এসেছি তোমাদের বিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে :
    এবং লক্ষ্য করো, আমি তা খুঁজে পেয়েছি যা বিচক্ষণতার চেয়ে অধিকতর মহৎ।
    তোমাদের ভেতরে এটা হচ্ছে আত্মার একটি শিখা যা নিজের চেয়েও অধিক পরিমাণে জড়ো হয় চিরকালের জন্য।
    যখন তোমরা এই শিখার বিস্তার সম্পর্কে অসতর্ক হও তখনই তোমাদের বিমর্ষ দিনগুলি উচ্চৈস্বরে বিলাপ করতে থাকে।
    এটা হচ্ছে দেহের ভেতরে জীবনের জীবন খুঁজে ফেরা যা কবরের ভয়ে ভীত।

    এখানে কোনো কবর নেই।
    এই পাহাড়গুচ্ছ এবং সমতলভূমিগুলি হচ্ছে দোলনা এবং পাথরফলক-যার ওপর পা রেখে অগভীর স্রোতস্বিনী পার হওয়া যায়।
    যখন তোমরা সেই মাঠ অতিক্রম করো যেখানে তোমাদের পূর্বপুরুষকে তোমরা শুইয়ে রেখেছ, এখন ভালো করে তাকাও এবং দেখতে পাবে তোমরা ও তোমাদের শিশুরা সেখানে হাত ধরাধরি করে নেচেই চলেছ।
    বস্তুতপক্ষে প্রায় সময়ই তোমরা কোনোকিছু না-জেনেই উস্ফুল্ল হও।

    অন্যেরা তোমাদের কাছে এসেছে সোনালি শপথের জন্য যা তৈরি করেছে তোমাদের আস্থা এবং তোমরা দান করেছ সম্পদ, ক্ষমতা এবং গৌরব।
    একটি প্রতিজ্ঞার চেয়েও কমকিছু আমি দিয়েছি তোমাদের, যদিও আমার কাছে তোমরা অধিকতর উদার।
    তোমরা আমাকে দিয়েছ আমার জীবন-পরবর্তী গভীরতর তৃষ্ণা।
    প্রকৃতঅর্থেই এটা নয় বড় উপহার একজন মানুষের কাছে যে তার লক্ষ্যগুলিকে রোদে পুড়ে যাওয়া ওষ্ঠে পরিণত করে এবং সমস্ত জীবন পরিণত করে ঝর্ণায়।
    এবং এর ভেতরেই শুয়ে থাকে আমার সম্মান এবং আমার পুরস্কার–
    যখনই আমি তৃষ্ণা মেটাতে আসি সেই ঝর্নায় দেখি জীবন্ত জল নিজেই তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। এবং আমি যখন তাকে পান করি তখন সে আমাকেই পান করে।
    তোমাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেছে আমি দাম্ভিক এবং পুরস্কার গ্রহণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লাজুক।

    যদিও মজুরি নেবার বেলায় আমি খুবই গর্বিত কিন্তু উপহার নেবার সময় নয়।
    যদিও আমি জাম খেয়েছি পাহাড়ের ভেতরে যখন তোমরা আমাকে তোমাদের ভোজসভায় বসিয়েছিলে এবং ঘুমিয়েছিলাম মন্দিরের চাতালে যখন তোমরা আনন্দের সঙ্গে আমাকে আশ্রয় দিয়েছ।
    যদিও এটা ছিল তোমাদের ভালোবাসাপূর্ণ মনোযোগ আমার দিন ও রাত্রিগুলির ওপর, যা আমার মুখে খাবারকে কি মধুর করেনি, বেষ্টন করেনি আমার ঘুমকে দূরদৃষ্টি দিয়ে?

    এজন্যই তো তোমাদেরকে সবচেয়ে বেশি আশীর্বাদ করি :
    তোমরা এতটা দাও এবং তোমরা যে আদৌ দিতে পারো তা তোমরা জানো না।
    প্রকৃতঅর্থে যে দয়া স্থিরদৃষ্টিতে নিজেকেই দেখতে থাকে আয়নার ভেতরে সে পাথরে পরিণত হয়।
    এবং একটি ভালো কাজ নিজেকেই ডাকে তার স্পর্শকাতর নামগুলি ধরে যে হয়ে ওঠে একটি অভিশাপের পূর্বপুরুষ।

    এবং তোমাদের কেউ কেউ আমাকে উদাসীন বলে ডেকেছ এবং পান করেছ আমার একাকিত্বের সঙ্গে এবং তোমরা বলেছ, ‘তিনি সভা করেন বনভূমির বৃক্ষদের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে নয়।
    তিনি একাকী বসে থাকেন পাহাড়চূড়ায় এবং নিচে তাকিয়ে থাকেন আমাদের শহরের ওপরে।‘’
    এটা সত্যি যে আমি পাহাড়ে উঠেছি এবং হেঁটেছি দুর্গম এলাকাগুলিতে।
    উঁচু না হলে আমি কীভাবে দেখতে পেতাম বিশাল উচ্চতা অথবা কীভাবে পারতাম বিশাল দূরত্ব থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করতে?
    কীভাবে একজন কাছের হবে প্রকৃতপক্ষে যদি সে দূরের না হয়?

    এবং তোমাদের কেউ কেউ কথা বলে ডাকেনি আমাকে তবে তারা এরকম বলেছে :
    ‘আগন্তুক, হে আগন্তুক, যেখানে পৌঁছানো যাবে না এরকম উচ্চতার প্রেমিক, কেন তুমি পাহাড়শৃঙ্গের ভেতরে বসবাস করো যেখানে ঈগলেরা তাদের বাসা তৈরি করে?’
    ‘কেন অন্বেষণ করো তাকে, যাকে অর্জন করা সম্ভব নয়?’
    ‘কোন বায়বীয় পাখিকে তুমি আকাশে শিকার করতে চাও?’
    ‘এসো এবং হও আমাদের একজন।‘’
    ‘নেমে এসো এবং তোমার ক্ষুধা নিবৃত্ত করো আমাদের রুটি দিয়ে এবং তোমার তৃষ্ণা মেটাও আমাদের মদ পান করে।‘’
    তাদের আত্মার নিঃসঙ্গতার ভেতরে তারা এইসব বলেছিল, তাদের এই নির্জনতা ছিল গভীরতর এবং তারা জানত যে আমি তাদের আনন্দ ও বেদনার গোপনীয়তাকেই অন্বেষণ করেছি।
    এবং আমি শিকার করেছি তোমাদের বৃহত্তর আত্মা যা আকাশে হেঁটে বেড়ায়।
    কিন্তু শিকারিও শিকারে পরিণত হয়েছে।
    কারণ আমার ধনুক থেকে অসংখ্য তীর বেরিয়ে গেছে আমারই বক্ষস্থলে ঢুকে পড়ার জন্য।
    এবং যে উডুক্কু সে-ই আবার পাখাহীন পতঙ্গবিশেষ, কারণ যখন আমার পাখাগুলি সূর্যালোকে বিস্তৃত হয়েছিল তখন তার ছায়া পড়েছিল পৃথিবীর ওপর- যা ছিল একটা কচ্ছপের মতো।
    এবং আমি ছিলাম একই সঙ্গে বিশ্বাসী ও সন্দেহকারী,
    কারণ প্রায়ই আমি আমার ক্ষতের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়েছি যেন তোমাদেরকে আরও বেশি বিশ্বাস করতে পারি, জানতে পারি তোমাদের মহত্তর জ্ঞান সম্পর্কে।

    এবং এইসব বিশ্বাস ও এইসব জ্ঞান নিয়ে আমি বলি : তোমাদের শরীরের ভেতরে তোমরা সংযুক্ত নও, আবদ্ধ নও গৃহের ভেতরে অথবা শস্যক্ষেতে।
    যে কারণে তোমরা বসবাস করো পাহাড়ের ওপরে এবং ঘুরে বেড়াও বাতাসের সঙ্গে।
    এটা নয় এমন কোনোকিছু যা সূর্যালোকে হামাগুড়ি দিয়ে চলে উষ্ণতার জন্য অথবা নিরাপত্তার প্রয়োজনে অন্ধকারে গর্ত খনন করে, কিন্তু স্বাধীন কোনোকিছু হল একটি আত্মা যা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলে এবং ইথারের ভেতরে চলাচল করে।
    এসব কথারা যদি অস্পষ্ট হয় তবে তাদের স্পষ্ট করতে চেষ্টা কোরো না।
    সবকিছুরই শুরুটা হচ্ছে অস্পষ্ট এবং ঝাপসা কিন্তু এটাই তাদের শেষ নয়।
    এবং আমি আনন্দিত যে তোমরা আমাকে শুরু হিসেবে স্মরণ করেছ।
    জীবন এবং সমস্ত জীবন্তেরা কুয়াশার গর্ভে রয়েছে, স্বচ্ছতার ভেতরে তারা নেই।
    এবং কে না জানে স্বচ্ছতা মানেই হচ্ছে কুয়াশার ক্ষয়ে যাওয়া।

    আমার কথা মনে করতে গিয়ে তোমরা এসব স্মরণ করছে:
    যা-কিছু তোমাদের ভেতরে সবচেয়ে দুর্বল ও বিভ্রান্ত মনে হয় তা-ই হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে সঠিক নির্ণয়।
    এটা কি তোমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস নয় যা নির্মাণ ও মজবুত করেছে তোমাদের হাড়ের কাঠামোকে?
    এবং এটা নয় একটি স্বপ্ন যা তোমাদের কেউই স্মরণ করতে পারে না স্বপ্ন দেখার সময়, যে স্বপ্ন নির্মাণ করে তোমাদের নগর এবং সেই নগরের ভেতরে সেখানে যা-কিছু আছে তার সবকিছু করে অলংকৃত।
    তোমরা যদি সেই শ্বাসপ্রশ্বাসের জোয়ার-ভাটা দেখতে পেতে তাহলে আর কোনো কিছুই। দেখতে না এবং যদি তোমরা স্বপ্নের ফিসফিসানি শুনতে পেতে তাহলে কোনো শব্দই তোমরা শুনতে না আর।

    কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না, শুনতেও পাও না এবং এটাই ভালো।
    যে অবগুণ্ঠন তোমাদের চোখে মেঘ নামিয়েছে সে অবশ্যই উত্তোলিত হবে সেই হাতে, যে হাত বয়ন করে এই ছদ্মবেশ।
    এবং যে মাটি পরিপূর্ণ করে তোমাদের কান, সেই মাটিকেই বিদ্ধ করবে সেই আঙুলগুলো যে আঙুল মাটিকে দলিত-মথিত করেছে।
    তোমরা তখনই দেখবে এবং শুনবে।
    যদিও তোমরা অনুশোচনা করবে না নিজেকে অন্ধ ভেবে, বধির ভেবেও কখনও করবে না আক্ষেপ।
    কারণ সেইদিন তোমরা জানবে সবকিছুর ভেতরের গোপন উদ্দেশ্য এবং তোমরা। অন্ধকারকে আশীর্বাদ করবে যেমন আলোকে করে থাক।

    এসব বলার পর কাউকে খুঁজলেন তিনি এবং দেখলেন তার জাহাজের চালক হালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থিরদৃষ্টিতে দেখছে তার তুলে দেওয়া পালগুলি যা এখন কেবলি দূরত্ব।
    এবং তিনি বললেন :
    ধৈর্যশীল, অত্যন্ত ধৈর্যশীল আমার জাহাজের চালক, বইছে বাতাস, পালগুলি অস্থির হয়ে উঠেছে এবং রাডারও প্রার্থনা করছে দিকনির্দেশ, যদিও আমার চালক অপেক্ষা করছে কখন আমার ওপর নীরবতা নামবে এবং আমার এইসব নাবিকেরা, যারা বৃহত্তর সমুদ্রের গান শুনেছে তারা আমার কথাও শুনেছে ধৈর্যের সঙ্গে।
    এখন তারা আর অপেক্ষা করবে না, আমিও প্রস্তুত।
    নদী এসে সমুদ্রে পৌঁছেছে এবং আরও একবার বৃহত্তর মাতা তার সন্তানকে বুকে তুলে নিলেন।

    বিদায় হে অর্ফালিজবাসী।
    এই দিন শেষ হয়েছে।
    রুদ্ধ হয়ে আসছে এই দিন আমাদের ওপর যেমন শাপলাফুল বন্ধ হয়ে যায় তার নিজস্ব আগামীকালের ওপর।
    এখানে আমাদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তা আমরা রক্ষা করব,
    এবং যদি তা যথেষ্ট না হয় তাহলে আমরা আবার একত্রে আসবই এবং দাতার দিকে একত্রে বাড়িয়ে দেব হাত।
    ভুলে যেও না আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব।
    একটু অপেক্ষার পর আমার আকুল আকাক্ষা অন্য শরীরের জন্য জড়ো করবে ধূলো এবং ফেনা।
    একটু অপেক্ষার পর বাতাসের ওপর মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেব এবং আমাকে ধারণ করবে অন্য এক নারী।
    বিদায় তোমাদেরকে এবং আমার যৌবনকে যা আমি তোমাদের সঙ্গে কাটিয়েছি।
    এটা ছিল গতকাল যেখানে স্বপ্নের ভেতরে আমাদের দেখা হয়েছিল।
    তোমরা আমার একাকীত্বের ভেতরে গান গেয়েছ এবং আমি তোমাদের আকুল আকাঙ্ক্ষা দিয়ে সৌধ নির্মাণ করেছি আকাশে।
    কিন্তু এখন আমাদের ঘুম পালিয়েছে, আমাদের স্বপ্ন দেখাও শেষ এবং এই সময় মোটেও কোনো ভোরবেলা নয়।
    আমাদের মাথার ওপরে এখন মধ্যদুপুর, আমাদের অর্ধ-জাগরণ পরিণত হয়েছে পরিপূর্ণ দিনে এবং আমাদেরকে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন হতে হবে।
    স্মৃতির গোধূলিবেলায় যদি আরও একবার আমাদের দেখা হয় তাহলে আমরা আবার কথা বলব পরস্পর এবং তোমরা আমাকে শোনাবে একটি গভীরতর গান।
    এবং অন্য স্বপ্নের ভেতরে যদি আমরা পরস্পরের হাত ধরি তাহলে আমরা অন্য এক সৌধ নির্মাণ করব আকাশে।

    এইসব বলে তিনি নাবিকদের ইঙ্গিত করলেন এবং তারা সরাসরি এদিয়ে এসে নোঙর তুলল, খুলে দিল দড়িদড়া এবং জাহাজ এগিয়ে চলল পুবদিকে।
    এবং জনতার ভেতর থেকে একটি কান্না ভেসে এল যেন তা একটি মাত্র হৃদয়ের কান্না এবং সন্ধ্যার অন্ধকারে তা বেড়ে উঠল এবং ভেরির মতো সমুদ্রের ওপর দিয়ে ধাবিত হল।
    শুধুমাত্রা আলমিতরা ছিল নীরব এবং স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিল ধাবমান জাহাজের দিকে ধোঁয়াশায় তা অদৃশ্য না-হওয়া পর্যন্ত।
    এবং জনতা চলে গেলে শুধুমাত্র আলমিতরা দাঁড়িয়ে থাকল সমুদ্রপ্রাচীরের ওপর এবং মনে মনে স্মরণ করতে থাকল তার সেই কথা :
    একটু অপেক্ষার পর বাতাসের ওপর মূহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেব এবং আমাকে ধারণ করবে অন্য এক নারী।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী
    Next Article শেবা – জ্যাক হিগিনস
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.